বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ প্রাণঘাতের বিপরীতে মানুষের জন্য জানার এবং শেখার অনেক বার্তাও নিয়ে এসেছে। ভিনগ্রহের কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী নয় আমাদের নিজ গ্রহে সৃষ্ট একটি অতিক্ষুদ্র প্রাণহীন পার্টিকল আমাদের সকল দম্ভকে কত অনায়াসেই না চূর্ণ বিচুর্ণ করে দিয়েছে। পথে বসিয়ে দিয়েছে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের মহারাজাদের। মহা বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছে স্টক মার্কেটে। মানবজাতির নিরন্তর ঝগড়াঝাটি কাজিয়া ফ্যাসাদ যুদ্ধ বিগ্রহ এখন স্তব্ধ হয়ে গেছে। লক্ষ কোটি দরীদ্র মানবসন্তানকে অভুক্ত রেখে কেবল অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে সংগৃহিত পারমানবিক অস্ত্র অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান আর ক্ষেপনাস্ত্র এখন বাতিল তৈজষের মত পড়ে আছে আমাদের অহমিকা আর অসুস্থতার স্মারক হিসেবে। স্রেফ মানুষকে হত্যার জন্য আমরা এমনসব অস্ত্রের আবিস্কার ও মওজুত গড়েছি যার মাত্র এক শতাংশের বিস্ফোরণ ঘটালে এই গ্রহটিই মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। করোনা ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে মানুষ তার শত্রু হিসেবে শুধু মানুষকেই তার হিসেবে রেখেছে মানুষের বাইরেও যে অনেক শত্রু আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে সেই আশংকাকে আমরা শিকেয় তুলে রেখেছিলাম।

এক

আমাদের হৃদয় প্রাণ উজাড় করে দেয়া প্রেম ভালবাসা স্নেহ মমতা বাৎসল্য নিয়ে আমাদের কত গর্ব আর অহংকার।এইসব মানবিক উপলব্ধিকে ভিত্তি করে কত লক্ষ কোটি গ্রন্থ কিতাব আমরা রচনা করেছি কিন্তু এগুলিযে কতটকু ঠুনকো এবং আবেগ-সঞ্জাত এবং দিনশেষে মানুষ ভয়ংকর স্বার্থপর এবং পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম একটি প্রাণী তারই চাক্ষুস প্রমাণ দিয়েছে কোভিড-১৯। যে সন্তানের জন্য আমাদের মমত্ববোধ প্রশ্নাতীত সেই বুকছেঁড়া ধনটি যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে  স্কুল থেকে ঘরে ফেরে মমতাময়ী মাটি তাকে এখন আদরে বুকে জড়িয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলেননা বরং তাকে শরীরে বোমাবাঁধা  জঙ্গির মত বিষ্ফোরক মনে করে প্রথমেই তাকে ওয়াশরোমে ঠেলে পাঠান। সারাদিন কর্ম শেষে ক্লান্ত স্বামীর স্পর্শ এড়িয়ে পাশ ফিরে ঘুমোতে যান প্রিয়তমা স্ত্রী।তার সন্দেহ হয় এটি তার স্বামী না ঘাতক ভাইরাসবাহী একটি বিপজ্জনক মানবশরীর। সোহাগের চুম্বনকে মনে হয় কোবরার ছোবল। যে সিনিওর সদস্যটির প্রতি আমাদের ভালবাসার হাত অবারিত সেই সদস্যটি এখন সাধারণ ঠান্ডাজনিত কারণে একটুখানি কাশি দিলেই আমরা সচকিত হয়ে উঠি। লোকটাকে কি ধরে ফেলল অবশেষে? তাহলে তো তাকে এখনই আইসোলেসনে পাঠানো উচিৎ। যে লোকটি সংসারে এমনিতেই আইসোলেটেড সে আরো আইসোলেটেড হয়। আরও অধিকমাত্রায় বিচ্ছিন্ন হয়। এভাবেই আমরা ভেঙ্গে যাচ্ছি। আমাদের স্নেহ মমতা ভালবাসার পর্দা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে আমাদের নির্মম আত্মকেন্দ্রিকতার অস্থি কংকাল। আমাদের সকল মানবিক অনুভূতি সামাজিক সম্পর্ক যে নিরেট অভিজ্ঞতালব্ধ আবেগসঞ্জাত এবং প্রয়োজন নির্ভর তাই নতুন করে প্রমাণিত হয়।

দুই

দরিদ্র এবং আগ্রাসী দেশগুলি তার দেশের নাগরিকের ক্ষুধা নিবারণ আর চিকিৎসা সেবা না বাড়িয়ে সমরাস্ত্র কিনতেই দেশের সকল অর্থ ব্যয় করে ফেলে। কেন এই আত্নঘাতি অপচয়? কারণ প্রতিবেশী দেশটিকে সায়েস্তা করতে হবে। দেশের মানুষ না খেয়ে মরুক তাতে কী এসে যায়? পাকিস্তানের প্রয়াত নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন-প্রয়োজনে ঘাস খেয়েও পাকিস্তান পারমানবিক বোমা বানাবে। ভুট্টোর এই উক্তিই প্রমাণ করে এইসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের দম্ভ আর প্রতিযোগিতার কাছে সেদেশের জনস্বাস্থ্য তথা জনস্বার্থ কত তুচ্ছ আর ফেলনা একটি বিষয়। এই উক্তি ভুট্টোর হলেও প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে বৈরিভাব পোষণকারী প্রতিটি দেশ ও তার সরকারেরই মানসিকতা এটি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথাই ধরুন। দেশটি এখন শনৈ শনৈ গতিতে সুপারপাওয়ার হওয়ার পথে।সম্প্রতি তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কেনার চুক্তি করেছে অথচ সেদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে এখনও খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করেন। এটি অস্বাস্থ্যকর এবং আদিম। হোমো সেপিয়েন্সরা এভাবেই মলমূত্র ত্যাগ করত। ভারতীয় ডাক্তারগণ পৃথিবী জয় করে নিয়েছেন অথচ তাদের নিজদেশে জনস্বাস্থ্যের কী নির্মম বাস্তবতা।অস্ত্রভান্ডারে তারা সুসমৃদ্ধ ও অত্যাধুনিক অথচ তাদের বেশিরভাগ নাগরিকের নিত্যকর্ম থেমে আছে হোমোসেপিয়েন্স যুগে। কী আকাশ পাতাল বৈপরিত্ব। যে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ঘোষণা দিয়ে করোনা মোকাবেলায় প্রকাশ্যে গোমূত্র পানের পার্টি করতে পারে সেদেশের  জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারটি রাষ্ট্রের কাছে যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?

তিন

সুখের কথা কোভিড-১৯ মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের দেশের বিরুদ্ধে দেশের যুদ্ধযাত্রায় আপাতত রাশ টানতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চিরশত্রু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। সম্মিলিতভাবে এবার কমন শত্রু করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আলাপ আলোচনা চলছে এটা সত্যি অভাবনীয়। করোনা ভাইরাসের এটি এক যুগান্তকারী সফলতা। শুধু ভারত পাকিস্তান নয় পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রপ্রধানই এখন পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কোভিড-১৯ যত ভয়ংকর হবে এই ভ্রাতৃত্ববোধ বোধগম্য কারণেই আরও সুদৃঢ় হবে।এভাবেই যদি মানবজাতির বোধোদয় ঘটে  আমরা জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে যে একই হোমো সেপিয়েন্সের উত্তরাধিকারী আমরা পরস্পরের জিঘাংসাকে যদি ভালবাসায় এবং সহমর্মিতায় রূপান্তর করতে পারি আমরা যুদ্ধাস্ত্র তৈরি বিক্রি এবং কেনার বদলে যদি সেই অর্থ আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যয় করি নাগরিকের খাদ্য স্বাস্থ্য শিক্ষা বাসস্থানের দিকে অধিকতর মনযোগী হই শক্তিধর দেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মহোদয় যদি উপলব্ধি করতে সমর্থ হন জ্বালানী পোড়ালে কার্বন হয় আর সেই কার্বন  কোভিড-১৯ এর চেয়েও হাজার লক্ষগুণ মাত্রার ঘাতক হয়ে আমাদের সবুজ গ্রহটিকে গ্রাস করে ফেলবে তাহলে কোভিড-১৯ এর হানাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখাই ভাল।

চার

কোভিড-১৯ চিরাচরিত ঈশ্বর ধারণায়ও যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। পূর্বে সব ধর্মের অনুসারীদেরই ধারণা ছিল তাদের ধর্মস্থানগুলি দুঃসময়ে শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু করোনা ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে এ ধারণা ভুল। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর দুয়ার একে একে রুদ্ধ করে দিয়ে সেখান থেকে পালিয়েছে ঈশ্বর। যে কাবাঘরকে মনে করা হত সাক্ষাৎ আল্লাহর নিজের ঘর হিসেবে সেই কাবাচত্তর এখন বিরাণ জনশূন্য। হাজার বছর ধরে যে আজানের ধ্বণি শুনতে শুনতে একটি শিশুর কাছেও যা লাইন টু লাইন মুখস্ত এবং চির অপরিবর্তনশীল বলে প্রশ্নাতীত হয়ে আছে তাকেই বদলে দিয়েছে সামান্য একটি ভাইরাস।এখন ‘হাইয়ালা সালাহ বদলে দিয়ে ‘আল সালাতু ফি বুয়ুতিকুম পড়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে মসজিদে না এসে ঘরে বসে নামায আদায়ের কথা বলা হচ্ছে।অথচ ধর্মগ্রন্থে  মসজিদে নামায আদায়ের উপর কত গুরুত্বই না দেয়া হয়েছে। হার্টফোর্ড চার্চ একশত বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো তাদের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে। খৃষ্টধর্মের প্রাণকেন্দ্র ভ্যাটিকান বন্ধ।হিন্দুদের তিরুপতি ও সিরিডির দুয়ার বন্ধ। জেরুজালেমের আল আকসায় নামায পড়া বন্ধ। কোভিড-১৯ বুঝিয়ে দিয়েছে মানুষ নিজে খেয়ে না খেয়ে পরকালে অনন্ত সুখ লাভের প্রত্যাশায় বিপুল বিপুল অর্থ ব্যয় করে  ঈশ্বরের ঘরবাড়ি হিসেবে যেসব নান্দনিক উপাসনালয় নির্মাণ করেছে ইমারত হিসেবে এসবের অনেকগুলির স্থাপত্যমূল্য থাকলেও তাতে ঐশ্বরিকতার ছিটেফোঁটাও নেই।মন্দির মসজিদ গীর্জা সিনেগগ তৈরির নামে আমরাযে রাশি রাশি অর্থ ব্যয় করছি সে অর্থ দিয়ে যদি আমরা দরীদ্র মানুষের পেঠের ভাত চিকিৎসার ওষুধ সরবরাহ করতাম উপাসনালয়ের স্থানে এক বা একাধিক ছিন্নমূল পরিবারকে পুনর্বাসিত করতাম তবে তাই হতো অধিক কল্যাণকর এবং অর্থবহ।

 

জেনিফার হেলার যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত প্রথম কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন শরীরে গ্রহণকারী ৪৫ স্বেচ্ছাসেবীর একজন।

এই লেখার শেষকথাও এই-  প্রাণঘাতি এই ভাইরাস বা অন্য যে কোনো রোগ বালাইয়ের আক্রমন থেকে মুক্তি পেতে বা প্রতিহত করতে আমরা কোনো ঈশ্বরের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল নই। ইতোপূর্বে রোগ বালাই মহামারীর যত ওষুধ প্রতিষেধক আবিস্কৃত হয়েছে তার একটিও আকাশ থেকে দৈববাণী হয়ে নেমে আসেনি সবকিছুর কৃতিত্বের দাবিদার এই মানুষই। আমরা অধীর আগ্রহে প্রতিক্ষা করে আছি-আমাদের মাঝ থেকেই কিছু বুদ্ধিমান মানুষ এই ভাইরাসের প্রতিষেধক  আবিস্কার করে বর্তমান সময়ের এই চরম উদ্বেগ উৎকন্ঠা থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দেবে। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি উপলব্ধি করুক-মারণাস্ত্র ধ্বংসই সাধন করে সৃষ্টি নয়।মারণাস্ত্রের সকল বিনিয়োগ বিজ্ঞান গবেষণায় লাগালে পৃথিবীটা ক্রমশ নিরাপদ বসযোগ্য একটি গ্রহ হিসেবে অনেক অনেকদিন টিকে থাকবে। আবার এটাও সত্য এই সাময়িক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার পর কিছু অকৃতজ্ঞ মানুষ বিজ্ঞানীদের সকল অবদানকে ভুলে গিয়ে আবার সেই অলীক শক্তির স্তব বন্দনা আর অর্থহীন সব গবেষণায় মেতে উঠবে। তাদের জন্য সিলেটী উপভাষায় বহুলভাবে ব্যবহৃত “খাই হাইর আর গাই লাঙ্গের” প্রবাদটিই অধিক প্রযোজ্য হবে যার অর্থ-স্বামীর খেয়ে দেয়ে উপপতির গুণগান করা। উপপতি বা উপপত্নীর গুণগান করা দ্বিচারিণী বা দ্বিচারির গুণগানের পেছনে তবুও একটি বাস্তব স্বত্বার অস্তিত্ব থাকে কিন্তু উল্লেখিতদের তো তাও নেই।