এক শিষ্য প্রশ্নটা করেছিল গ্রীক দার্শনিক হিরোডোটাসকে, মহাশয় আপনি কার পক্ষে, যুদ্ধ না শান্তি? হিরোডোটাস উত্তর দিয়েছিলেন-বৎস, আমি শান্তির পক্ষে, কারন শান্তির সময় সন্তান বহন করে তার পিতার লাশ আর যুদ্ধের সময় পিতার কাঁধকে বইতে হয় সন্তানের লাশের কঠিন ভার।
কাশেম সোলাইমানী হত্যা আর সম্ভাব্য ইরান আমেরিকার যুদ্ধ নিয়ে উত্তপ্ত পৃথিবী। বাঙ্গালীর চায়ের কাপের মেঠো আড্ডা থেকে শুরু করে অফিসের ডেস্ক মুখরিত হয় আমেরিকার আর ইরানের মধ্যকার এই ছায়াযুদ্ধে জিতছে কে আর কিভাবে ইরান আমেরিকার নাভিশ্বাস ছোটাতে পারে তার নানাবিধ বিচার, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ নিয়ে। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে ইরান আমেরিকার অস্ত্র ভাণ্ডার নিয়ে নানান রকম বিশ্লেষন, প্রতিবেদন। এত গোলা-বারুদ, ট্যাংক মিসাইলের খবরের মাঝে একটা ছোট খবর খুব আড়ালেই পড়ে যায়- কাশেম সোলাইমানির জানাযায় পদদলিত হয়ে ৪০ জনের মৃত্যু।
ঈদের আগে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই নিউজ হয়-অমুক জায়গায় যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে মানুষের মৃত্যু। মৌলিক চাহিদা হিসেবে খাদ্যের পরই বস্ত্রের অবস্থান। আদিম মানুষ এক সময় বস্ত্রহীন অবস্থায় বাস করলেও তার শরীরকে নানা রকম প্রাকৃতিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য ঢেকে রাখার প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজন এক সময় পরিণত হয় সামাজিক মূল্যবোধে যেটাকে আমরা সম্ভ্রম রক্ষা বলি। সমাজ পরিবর্তনের সাথে এই মূল্যবোধ এক সময় পরিণত হয় আবশ্যিক মূল্যবোধ বা মৌলিক চাহিদায়। মুলত বিনা পয়সায় বস্ত্রের মৌলিক চাহিদা পুরনের আকাঙ্ক্ষা থেকে মাত্রাতিরিক্ত দরিদ্য মানুষের জমায়েত আর তা থেকে সৃষ্টি হওয়া বিশৃঙ্খলাই যাকাতের কাপড় নিতে যেয়ে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর কারন।
জেনারেল কাশেম সোলাইমানি একজন জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদী, তিনি তার জীবদ্দশার একটা বড় সময় ব্যয় করেছেন ইরানের বৈশ্বিক স্বার্থরক্ষা আর মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া বলয়কে শক্তিশালী করার কাজে। আমরা জানি বিশ্বজুড়েই এখন জাতীয়তাবাদের জয়জয়কার। সেটা ট্রাম্পের আমেরিকা থেকে শুরু করে পুতিনের রাশিয়া, ব্রেক্সিটপন্থী ব্রিটেন থেকে শুরু করে এরদোগানের তুরস্ক কিংবা মোদীর ইন্ডিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। পৃথিবীজুড়ে জাতীয়তাবাদের দাপট আর সোলাইমানি জানাযায় মানুষের মৃত্যু সম্ভবত এই সত্যটাকে তুলে আনছে যে আস্তে আস্তে জাতীয়তাবাদকে মানুষের এক ধরনের মেকি জাতীয় মৌলিক চাহিদায় পরিণত করা হচ্ছে। বস্ত্র যেমন মানুষের বাহ্যিক সম্ভ্রম রক্ষায় ব্যবহৃত হয় তেমনি এই জাতীয়তাবাদ যেন পরিণত হয়েছে জাতির “সম্ভ্রম” রক্ষার প্রধান উপকরনে। যাকাতের কাপড় যেমন কিছু দরিদ্র মানুষকে খুব সহজেই তার মৌলিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ দেয় তেমনি সোলাইমানীর জানাযাও ইরানীদের সুযোগ করে দিয়েছিল খুব সহজেই জাতীয় এই মৌলিক চাহিদা মেটানোর অর্থাৎ নিজেদেরকে জাতীয়তাবাদী হিসেবে প্রমাণ করবার।
সোলাইমানির জানাযায় পদদলিত হয়ে মৃত্যু আর যাকাতের কাপড় নিতে যেয়ে মানুষের মৃত্যুর মধ্যকার মিল তখন আর কাকতালীয় থাকে না। দুই ক্ষেত্রেই দায়ী সুবিধাবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র যে রাষ্ট্রযন্ত্র শোষন আর দুর্নীতির কারনে সাধারন মানুষের খাদ্য বস্ত্রের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় এবং প্রয়োজনে অমুকদেশ জিন্দাবাদ কিংবা “মেক আমেরিকা গ্রেইট এগেইন” স্লোগান তুলে সাধারন মানুষের মাঝে জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেয়।
আমরা পুঁজিবাদী সমাজে বাস করি। বিশ্বজুড়েই পুঁজিবাদ এক মহা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদদের অভিমত। এই সংকটের নাম সম্পদের অসাম্যতা অর্থাৎ খুব ছোট এক শ্রেনীর মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ছে আর বাকি বিশাল সংখ্যক মানুষের হাতে আছে খুব অল্প পরিমাণ সম্পদ। ফলে বিশ্বজুড়েই বাড়ছে সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য। পুঁজিবাদ তার নিজ স্বার্থেই জাতীয়তাবাদকে প্রমোট করে। যত বেশি জাতীয়তাবাদ আর যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ তত বেশি অস্ত্র বিক্রি। এর বাইরে পুঁজিবাদ বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেনীকে দুর্বল করতে তাদের নিজ নিজ বঞ্চিত শ্রেণী সত্ত্বার বাইরে জাতীয় সত্ত্বাকে গুরুত্ব দিতে শেখায়। ফলে সাধারন মানুষ তার খাদ্য বস্ত্রের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলেও, রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণকারী কর্পোরেট সুবিধাবাদীদের কাছ থেকে বঞ্ছনার শিকার হলেও তার দেশ ট্যাংক, বিমান কিনছে, তার দেশের সৈন্যরা প্রতিপক্ষের সৈন্যদের কচু কাটা করছে দেখে এক ধরনের আত্মগৌরব নিয়ে রাতে ঘুমাতে যায়। এভাবেই পুঁজিবাদের মহা সংকটটাকে পর্দার আড়ালে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে জাতীয়তাবাদ ।
ট্রাম্প, পুতিন, সালমান, মোদী কিংবা মৃত্যুর আগে সোলাইমানিরা যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি-সমরনীতির প্রসার ঘটিয়েছেন তার ফল মানব সভ্যতার জন্য কখনোই ভাল ফল বয়ে আনবে না। এই জাতীয়তাবাদের প্রসারের ফলে বিশ্বজুড়েই নানা প্রান্তে চলতে থাকবে নানা রকম প্রক্সি ওয়ার। বাড়বে ধবংস, মৃত্যু, হাহাকার, বাড়বে পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ। আমরা হয়তো ভুলতে বসেছি যে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, শিয়া-সুন্নী, সাদা-কালো সবারই প্রধান সমস্যা ক্ষুধা, দারিদ্র, রোগ, অশিক্ষা, কুসংস্কার। ধর্ম-বর্ণ-দেশ ভিত্তিক জাতীয়বাদের অন্ধ নেশার চেয়ে এই মৌলিক অভাব গুলো থেকে মুক্তি পাওয়াই হওয়া উচিত প্রধান চ্যালেঞ্জ। কবির সুমনের গানের লাইন তাই আজ বড়ই প্রাসঙ্গিক, শেষটা সেটা দিয়েই করি- “পাকস্থলীতে নেইকো ইসলাম, নেইকো হিন্দুয়ানী তাতে যাহা জল তাহাই পানি”।
Leave A Comment