লিখেছেন: কাজল কুমার দাস
সবথেকে বেশী যে প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে হয় আমাকে, তা হলো- “আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না?”
আসলে কি জানেন, বিশ্বাস শব্দটা আমার কাছে আপেক্ষিক। তারপর তা যদি হয় সৃষ্টিকত্তা তবে তো কথাই নেই। কিন্তু এই সময়ে আর এই সমাজে বাস করে ধম্মপান্ডাদের খগড়ের নীচে দাঁড়িয়ে কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে বলুন তাকে অবিশ্বাস করে? যাকগে ওসব তক্কে আজ আর যাচ্ছি না। বিষয়টা যখন আমার বিশ্বাস আর অবিশ্বাস নিয়েই তখন সেটাই আরেকটু পরিস্কার করা যাক। আসলে জানেন কি; আমার বিশ্বাসও যুক্তি নির্ভর। মানে ছেঁকে-ছেঁটে যতটুকু টেকে ততটুকুই নেই। তবে আপনি যদি আপনার প্রথাগত ঘম্মের অন্ধবিশ্বাস নিয়েই যুক্তি-তর্ক করতে চান তবে আপনাকে কিন্তু কত্তার আর তেনার ক্ষমতার যে বর্ননা আপনার ধম্মপুস্তকে দেয়া হয়েছে তার পুরোটাই মানতে হবে। এই যেমন ধরুন “তার ইচ্ছাহীন-ইশারা ভিন্ন গাছের পাতাটিও নড়ে না…….” এই রকমের কথা। এসব দিয়ে স্পষ্ট করা হয়েছে এ জগৎময় যা কিচ্ছু হয়েছে-হচ্ছে-হবে সকলই তেনার ইচ্ছেতে। আচ্ছা এবার আসুন, আমি মেনে নিলাম তেনার ইচ্ছানুসারেই সকল কম্ম হয়- তবে ৩ বছরের শিশু ধর্ষন, মানুষকে পুড়িয়ে মারা, ধম্মের নামে
হত্যা-লুট-ধর্ষন সকলই কি তাঁর ইচ্ছেতেই হচ্ছে? চোর চুরি করছে তার ইচ্ছেতে;? মানুষ দুর্নীতি করছে তাঁর ইচ্ছেতে; ধর্ষন-হত্যা হচ্ছে তাঁর ইচ্ছেতে; হিংস্ত্র প্রানী নিরিহ প্রানীগুলোকে মেরে খাচ্ছে তাঁর ইচ্ছেতে; অস্ত্র কারখানায় মানুষ মারার জন্য অস্ত্র তৈরি হচ্ছে তাঁর ইচ্ছেতেই; তাঁর ইচ্ছেতেই মানুষের উপর যুগ-যুগ থেকে চলে
আসছে যত অনিয়ম আর নির্যাতন। তাহলে আমি তাঁকে যে বিশ্বাস করি না এটাওতো নিশ্চই তারই ইচ্ছেতেই হচ্ছে; শুধু আমিই নই, এই পৃথিবীর সকল ঈশ্বরে অবিশ্বাসীই তাঁর প্রতি যে অবিশ্বাস করছে- সে সব তাঁর ইচ্ছেতেই হচ্ছে।
আসুন আপনাকে একটা গল্প শোনাই, গল্পটা বহুদিন আগের- পুরনো, তাই পুরোটা অত স্পষ্ট মনে নেই আর। এক ভদ্রলোক একটা ফুলের বাগান করলেন বাড়ির ঠিক সামনেই, তাতে ফুল ফুটেছে অনেক রঙের। একদিন বাগানের গেট খোলা পেয়ে একটা গরু ঢুকে গাছগুলো খেতে শুরু করলো। ভদ্রলোক এসেই এসব দেখে চক্ষুস্হির। একটা কাঠ দিয়ে গরুটাকে আঘাত করলেন- ব্যাস, গরুটা মারা পড়লো। এবার ভদ্রলোক ভয় পেলেন। হায়রে গরুটা মারা পড়লো এবারতো আমার মহাপাপ হবে। হঠাৎ তার মাথায় এলো; আরে আমি শাস্ত্রে পড়েছি সূর্যের শক্তিতে চোখ দেখে, পবনের শক্তিতে কান শোনে, ইন্দ্রের শক্তিতে হাত কাজ করে, ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা। ভদ্রলোকের সেই কথাগুলি তখন মনে পড়ায় ভাবল- “যাকগে আমি কিছুই করি না ঈশ্বরই সব করান; তাহলে আমার আর কোন দোষ নেই। তাছাড়া এই হাত চালানো দেবরাজ ইন্দ্র তিনিই এসব করেছেন”। ব্যাস্ যেইনা এসব ভাবা অমনি দন্ডের খাতায় তার পাপের পরিবর্তে ইন্দ্রের খাতায় পাপের জমা হলো। ইন্দ্রকে সাথে-সাথে মেসেজ দেয়া হলো। যাই হোক দেবরাজ বলে কথা। ইন্দ্র তো মহাচিন্তায় পড়ে গেলো- এ ব্যাটা মস্ত খচ্চর! আমাকে শেষব্দি ফাঁসালো। ইন্দ্রও ছাড়বার পাত্র নয়, দেবালয় থেকে মর্তে নেমে এলেন এর একটা সুরাহা করতে। তিনি এক ব্রাহ্মনের রূপ ধরে ঘুরতে লাগলেন ওই ভদ্রলোকের বাড়ির সামনে। একটু পরেই তিনি হনহন করে ঢুকে গেলেন ভেতরে, বাগানের পাশে এসেই বল্লেন “বাহ্ কি সুন্দর পুষ্প শোভিত পল্লব, এই বাগানটি কে করেছে?” ভদ্রলোক পাশেই ছিলেন, এত প্রশংসায় তিনি আল্হাদিত হয়ে বলেই ফেললেন আমিই করেছি। এবার ইন্দ্র আরেকটু এগিয়ে আসলেন, এসেই দেখলেন সেই মরা গরুটি। এবার বল্লেন, “আরে এই গরুটি কে মেরেছে?” ভদ্রলোক এবার
থমকে গিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বল্লেন, “আজ্ঞে আমি নই, মেরেছেন দেবরাজ ইন্দ্র!”। ইন্দ্র এবার নিজের রূপে ফিরে এসে ভদ্রলোককে এক ধমক দিয়ে বললেন, “আরে বেটা ভালো কাজ সব তোর আর খারাপটা আমার, দাড়া দেখাচ্ছি তোকে”। সেই ভদ্রলোকের তো অবস্থা খারাপ, কাচুমাচু করতে করতে পালায় আরকি!
মোদ্দাকথা হচ্ছে- যদি মানেন সকল কিছুই কত্তার ইচ্ছেতে হচ্ছে; তবে সকল কিছুই কিন্তু। যত ভালো- যত মন্দ সকলই। যেহেতু তিনি সকল বস্তুতেই বিরাজিত অতএব ‘নিরাকারে তিনি, আকারেও তিনি। বীজেও তিনি, বিষ্ঠায়ও তিনিই’ ….. জগৎইতো তিনিময়। ভোগ আর নৈবদ্য দেবার সময় শুধু ক্ষীর আর ননীটা খাওয়াবেন তা হচ্ছে না বাপু, চিকেন ফ্রাই আর মাটন চাপও খাওয়াতে হবে। মধুতে যিনি মদেও তিনি। বলিও পাঠায় যিনি গরু আর শুকরেও তো তিনিই। অসুখ ভালো হওয়াটা যদি তার ইচ্ছেতেই হয় তবে মায়ের গর্ভে শিশুর মৃত্যু, বাবার কোলে সন্তানের মৃত্যু, মায়ের সামনে কন্যাকে ধর্ষনও তার ইচ্ছেতেই হচ্ছে।
কি মনে-প্রানে-চিন্তায় আর কর্মে মানছেন তো, কত্তাকে আর তার সর্বব্যাপীত্বকে? যদি মানতেই হয় তবে পুরোটা মানবেন- ভালোটা তিনি আর মন্দটা; কে?
যাই হোক, আপনি মানলেও এই সত্বাকে আমি মানছি না- প্রকাশহীন, অনুভুতিহীন, আকারহীন, স্বাদ-গন্ধহীন, বোধ-বুদ্ধিহীন, হিংস্ত্র এই সত্বাটি আমার কাছে কখনই সৃষ্টিকত্তা ছিলো না। যে সৃষ্টিকর্তাকে তুষ্ট করতে দিনব্যাপী, কখনো বা মাসব্যাপী না খেয়ে থাকতে হয়। যিনি নিরিহ প্রানীর রক্তে তুষ্ট হন তিনি আর যাই হোক সৃষ্টিকর্তা নন। তিনি কি করে আপনার মঙ্গল কামনা করেন! আর এরকম সব হাস্যকর বিষয়কে আপনি বিশ্বাস করেনইবা কি করে? সত্যি বলতে কি- বিশ্বাস কখনোই যুক্তিকে মানতে চায়নি; যেকোনো বিষয়ে ভাবতে আর প্রশ্ন করতে শেখায়নি। সব কিছুকেই যেন অন্ধের মত মেনে নিয়ে অন্ধকারকে অনুসরন করতে বলেছে।
Oshadharon
আসলে ‘বিশ্বাস’ শব্দটির মধ্যে ‘বিশ্ব’ শব্দটি ঢুকে বসে আছে।আর বিশ্ব শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘যাতে সবকিছু ঢুকে বসে আছে’ (সংস্কৃত ‘বিশ ধাতু থেকে জাতা)। বৈজ্ঞানিক ভাবে সব ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকাটা স্বাভাবিক বলেই ধার্মিকের বিশ্বাসের সংগে অধার্মিকের বিশ্বাস,রাজনৈতিক বিশ্বাসের সাথে অরাজনৈতিক বিশ্বাস,সামাজিক বিশ্বাসের সমরেখায় অসামাজিক বিশ্বাসগুলিও প্রাকৃতিকভাবেই তরঙ্গায়িত। এখন তবে ‘সবকিছু কত্তার ইচ্ছেতে হচ্ছে’ এমনটা না বলে যদি বলা হয় ‘সবকিছু বিশ্বাসের ভিত্তিতে হচ্ছে’ তাহলে বোধহয় বিতর্কের অবকাশ কম। আর ক্ষয়ক্ষতির প্রসঙ্গ?
কে জানতো বলুন আমাদের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক/যুক্তিপূর্ণ বিশ্বাসগুলো আমাদের এমন একটা পৃথিবীতে পৌঁছে দেবে যেখানে ‘বিশ্বাস’ কথাটাই অপাঙক্তেয় ব্রাত্য হয়ে যাবে। ইংরেজী territory শব্দটি যে terror শব্দটির ভ্রাতৃপ্রতিম তা ভাষাবিদগণের অজানা নয়।আর এই টেরিটরিকেই দেশ বা রাষ্ট্র নামে ‘বিশ্বাস’ করার ফল ভুগতে হচ্ছে গোটা মানবসমাজকে, আমাদের যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসগুলি আজ পরমাণু বোমায় পরিণত আর তা নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। অতএব কোনটি ধর্ম আর অধর্মই বা কি এ নিয়ে নোতুন করে ভাবার প্রয়োজন আছে বৈকি?
পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম
ভাই আপনি বলতে চাচ্ছেন ভালো কাজের প্রশংসা যেমন সৃষ্টিকর্তা পাবে সেরূপ খারাপ কাজেরো দায়ভার উনার নিতে হবে বিষয় টাকা আমার কাছে এমন ই মনে হলো….
বর্তমান করোনা পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ সর্বত্র… ধরুন আপনি এমন কিছু আবিষ্কার করলেন যা দিয়ে করোনা নিরাশন করা সম্ভব একটি লোক পাঠালেন একটা রিজিয়নে,উনি ও-ই এলাকার সবাইকে আপনার আবিষ্কৃত জিনিস টি সার্ভ করলো…সবাই করোনা থেকে বেচে গেলো…এখন সারা দেশের মানুষ নিশ্চয়ই আপনার প্রশংসা করবে…এটাও ধরুন যেই লোকটিকে আপনি পাঠিয়েছিলেন উনার ওই এলাকায় একজন শত্রু ছিলো…তাই তিনি আপনার আবিষ্কৃত জিনিস ও-ই লোক কে উনি সার্ভ করেন নি….এবং লোকটি করোনায় মারা গেলো…
এখন প্রশ্ন হলো যেই লোকটি মারা গেলো তার জন্য আপনি দায়ী কতোটুকু..?
অসাধারণ লেখা। অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী লেখার।
ধর্ম কিংবা বিশ্বাস অবিশ্বাস এগুলো অন্ধদের কর্ম। অন্ধের লেখাতে দ্বন্ধ থাকবেই। সমস্যা হল সত্যের সন্ধানে কেউ নেই।
ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে বা নেই সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ। তবে প্রচলিত ধর্মগুলো ঈশ্বরের যে ধারণা আমাদের দেয়, সে ঈশ্বর অন্তত নেই। যে ঈশ্বর প্রতিনিয়ত হিংসার আগুনে পুড়ে নিজের সৃষ্টিকে অনন্তকাল আগুনে পোড়ানর হুমকি দেন, রক্ত-পুঁজ খাওয়ানোর ভয় দেখান সে ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
ধন্যবাদ
চমৎকার যুক্তিপূর্ন লেখা !!