লিখেছেন: কাজল কুমার দাস
কয়েকদিন থেকেই বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশের মানুষের মূখ্য আলোচ্য বিষয় হচ্ছে- রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা…. বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে যোগ্য কিনা। এবং এর পক্ষে আর বিপক্ষে বহু আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনা অফিস টেবিল ছাড়িয়ে সোস্যাল মিডিয়া থেকে টং এর চায়ের দোকানব্দি গড়িয়েছে। কোথাও এ আলোচনা তুলেছে তুমুল ঝড়। কারণ, সম্প্রতি বাংলাদেশে মাঈনুল আহসান নোবেল নামের একজন উদীয়মান সংগীত শিল্পী পুরনো এ বিষয়টাকে আবার নুতন করে আলোচনায় আনেন। আমি নোবেলের এই বাক স্বাধীনতাকে কখনোই অন্যায় বলে দেখি না। প্রতিটি মানুষেরই নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। একজন অতি সাধারন মানের শিল্পী হিসেবে বা আবেদনটির গ্রহন যোগ্যতার বিচারে সম্প্রদায়িক মানদণ্ডে বা রুচির প্রশ্নে হয়ত নোবেলের এই রুচির সাথে কোন সাহিত্যিক বা বিদগ্ধজনের রুচি মিলবে না; সে প্রশ্নটি ভিন্ন। আচ্ছা এবার মূল বিষয়ে ফেরা যাক। এবার আপনি হয়ত ভাবছেন “পুরনো এ বিষয়টাকে আবার নুতন করে আলোচনা” এ শব্দগুলো কেন? হ্যা! বিষয়টা পুরনোই। এর পূর্বেও বহুজন-বহুভাবে-বহুস্থানে-বহুসময়ে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদ্যেগ নিয়েছিলেন। এসব বহুজনের মধ্যে প্রখ্যাত-অখ্যাত-বিখ্যাত অনেক বিশিষ্ট আর অবশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গও আছেন। যেমন ধরুন- ১৯৭৫ এ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে ওই কমিটির চেয়ারম্যান করেন। কমিটিকে নির্দেশ দেয়া হয় নতুন কোনো সংগীতকে ‘জাতীয় সংগীত’ হিসেবে প্রস্তাব করতে। দ্বীন মুহাম্মদ কমিটি এ বিষয়ে তিনটি বৈঠক করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতার মধ্যে একটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু ক্যু পাল্টা ক্যুতে ওই প্রস্তাব আর পাশ হয়নি।
দ্বিতীয় উদ্যোগটি নেয়া হয় ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান এর শাসনামলে। সে সময় ‘আমার সোনার বাংলা’ কে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়। ওই সময়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে লেখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’ ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন শাহ আজিজুর রহমান। প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে। এসময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুতে পাথর চাপা পড়ে সেই নিদের্শনা।
তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করে।
এ সবতো গেল রাষ্ট্রীয় আর সাম্প্রদায়িক শক্তির সম্মিলিত আগ্রাসন। একবার ভাবুনতো, ম্যাংগো পিপলের মনস্তাত্বিক অবস্থাটা কি হবে? অবাক হবার কিছুই নেই- এ দেশের শিক্ষা আর জ্ঞানহীন সাধারন ধর্মাসক্ত মানুষ সেটাই ভাবে যেটা তাদেরকে ভাবানো হয়, মাহফিলে, মাদ্রাসার শিক্ষায় আর খুদবায় যা শোনানো হয়। ওর বাইরের কোন খবর তাদের কাছে নেই। আরে ভাই, থাকবেই বা কি করে- ওসব জানতে হলে বই পড়তে হয় ইতিহাসের খবর-টবরও নিতে হয়। বই না পড়া; ইতিহাস না জানা মানুষগুলোকে যখন লক্ষ-লক্ষ মাইকে বোঝানো হয়, ইউটিউবে দেখানো হয় “রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন” তখন তাদের রবীন্দ্র বিদ্বেষ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে আপনার-আমার মত ভাবতে চাইবেই বা কেন? মাদ্রাসার বন্ধ কুঠরীতে সে তো অন্ধ। আমি কিন্তু এতে মোটেও অবাক হই না, কারন এটাই স্বাভাবিক। বরঞ্চ অবাক হই তখন, যখন দেখি এ শহরের রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদের প্রাক্তন কোন এক সভাপতি বলেন- “আরে সত্যিই রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলো। তুমি জানো না?” তখন। তার কাছে কিন্তু কোন প্রমান বা দলিল নেই। তবে যেটা আছে তা হলো- “এত মানুষ বলছে তুমি শোননি? আরে সত্যি তাই”। একটা মফস্বল অঞ্চলের একটা অতি সাধারন মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম; তাই বলে এসব অসাধারনদের কথা এড়িয়ে যাব কি করে? কি তীব্র বরীন্দ্র ঘৃণা ভাবা যায়! এরা কিন্তু আপনাদের প্রগতিশীলদেরই একটা অংশ। যাক্ ওসব কথা এবার দেখা যাক যার সম্বন্ধে এতবড় একটা অভিযোগ তার সত্যতা কতটুকু।
মূল অভিযোগটি হোল- “১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয় যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।” খুব অদ্ভুত ভাবে এ দাবীর পক্ষে বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের একটা বই ভিন্ন আর কোন রেফারেন্স কারো কাছেই নেই। পরে যদিও এই বইটিকে রেফারেন্স করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল এম.এ. মতিন বীরপ্রতীক ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ নামে একটা বই লেখেন যেখানে তিনিও এই একই কথা উল্লেখ করেন।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে- এতটুকুও কারো ভাবনায় এলো না! রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সেই সব মানুষদেরই একজন যার প্রতিটি দিনই ঠাই পেয়েছে ইতিহাসে। গবেষকদের ছুরির নিচে গিয়ে সেই ইতিহাসকে সত্যাসত্য নির্ণয় করে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়েছে। আর তাই, খুব হাস্যকর হলেও সত্যি এটাই যে, সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিতই ছিলেন না। ইতিহাস আছে এর। তখন তিনি ছিলেন শিলাইদহে। ১৯১২’র ১৯ মার্চ তার কলকাতা থেকে ইংল্যান্ড যাবার কথা ছিল, জাহাজের কেবিনও ভাড়া করা ছিল। কিন্তু যাবার দিন সকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যান তিনি। অগত্যা, যাত্রা বাতিল। ২৪ মার্চ তিনি বিশ্রামের জন্য শিলাইদহে রওনা হন। ২৮ মার্চ গড়ের সে কথিত জনসভাটি যখন হয়- তিনি তখন শিলাইদহে। তিনি কলকাতায় আসেন ১২ এপ্রিল। এর পক্ষে রেফারেন্স হচ্ছে ঐ সময়কার রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠি, কবিতা যার নিচে তারিখ ও সন লেখা ছিলো। একই সাথে রবীন্দ্র পুত্রের স্মৃতিকথা থেকেও আমরা জানতে পারি তিনি কবিকে নিয়ে ২৮ মার্চের আগেই কোলকাতা ত্যাগ করে শিলাইদহ গিয়েছিলেন। ইতিহাস বলছে আগের দিন অনেক রাতব্দি রবীন্দ্রনাথ তার রচিত নাটক বাল্মীকি প্রতিভা মঞ্চস্থ দেখে শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে পরদিন ১৯ মার্চ ‘সিটি অব প্যারিস’ জাহাজে বুকিং থাকার পরও বিলেত যাত্রা করতে পারেননি। পরবর্তীতে ডাক্তারদের চিকিৎসায় ২৪ তারিখ পর্যন্ত কোলকাতা কাটিয়ে সেদিনই শিলাইদহ উদ্দেশ্যে কোলকাতা ছাড়েন। উল্লেখিত ২৮ মার্চ তারিখে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ বোটে বসে কবিতা লিখছেন!
আচ্ছা, আপনাদের মগজে একটিবারের জন্যও এই ভাবনাটি এলো না যে- রবীন্দ্রনাথ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরোধীতাই করে তবে তাকে সে বিশ্ববিদ্যালয় সংবর্ধনা দিতে চাইবে কেন? আসলে, স্বাভাবিক চিন্তাহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, তীব্র রবীন্দ্রদ্বেষ, ভারত ও হিন্দুদের প্রতি চরম ঘৃণার অন্ধত্ব না থাকলে এরকম গুজব কেউ মেনে নিতে পারে না।
আর এ অন্ধত্ব ছড়িয়ে গেছে দেশজুড়ে-হৃদয়জুড়ে-মগজজুড়ে…
কাজল কুমারের লেখায় তিন নোক্তা।
১)
“বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশের মানুষের মূখ্য আলোচ্য বিষয় হচ্ছে- রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা…. বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে যোগ্য কিনা। ”
পুরাই অবাস্তব কথা। ফেসবুকের উঠতি বুদ্ধিজীবীদের বাইরে এই নিয়ে তেমন আলোচনা দেখি নাই।
তাও বরগুনায় প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে খুন, ডেংগুতে প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু ও আসামের নাগরিকপঞ্জির প্রসংগে জাতীয় সংগীতের ফেক বিতর্ক এরই মধ্যে মাঠে মারা গেছে।
২)
“সম্প্রতি বাংলাদেশে মাঈনুল আহসান নোবেল নামের একজন উদীয়মান সংগীত শিল্পী পুরনো এ বিষয়টাকে আবার নুতন করে আলোচনায় আনেন।”
দলিল লেখক যেমন শেষ বিচারে আদৌ লেখক নন, তেমন জি-বাংলার সৃষ্টি জেমসের কপিবাজ নোবেলও কোনো মৌলিক শিল্পী নন, নো-বেল!
লক্ষ্যনীয়, দাঁতের মাজন বা ক্লোজআপ চ্যাম্পিয়ন শিল্পীরা রাতারাতি তারকা হয়ে অধিকাংশই গানের জগৎ থেকে খসে গেছেন। নো-বেলের পরিনতি একই রকম হলে খুব অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
৩)
মূল অভিযোগটি হোল- “১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয় যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
ডাহা মিথ্যা, কাঠমোল্লাদের প্রচার। ওই জনসভায় ররবীন্দ্রনাথ উপস্থিতই ছিলেন না! রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন, এই উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা বিপক্ষে একটিও তথ্য প্রমাণ মোল্লাদের কাছে নাই।
কাজেই এসব ছেঁদো জ্ঞান খণ্ডন করতে গিয়ে পরোক্ষ প্রচারের কোনো যুক্তি দেখি না। তবু ভাবনাটিকে উস্কে দেওয়ায় লেখককে সাধুবাদ।
মুক্তমনায় স্বাগতম।
ভয়টা আসলে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানে না। ভয়টা রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দু’ বলে। পাকিস্তান নামক অদ্ভুত একটি দেশ, যার কিনা মূল ভিত্তি ছিল শুধু ধর্ম। বাকি সবই ছিল আলাদা, ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস-জীবনযাপন-খাদ্যাভ্যাস। সুতরাং এই অবস্থায় পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল এমন কিছু মানুষকে যাদের আদর্শকে সামনে রেখে ধর্মীয় প্রোপ্যাগান্ডায় এই অদ্ভুত রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা যায়। যাদের মধ্যে ছিলেন কবি ইকবাল। আর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। সুতরাং ইকবালকে প্রতিষ্ঠিত করে রবীন্দ্রনাথকে দমিয়ে রাখলেই যে তাদের সাংস্কৃতিক এজেন্ডা তথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব সেটা বোঝার মত ঘিলু পাকি সামরিক জান্তার ছিল।
দেশ স্বাধীন হবার পরও সেই আদর্শের লোকেরা বারবার রবীন্দ্রনাথকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। সেটারই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে নোবেলদের মানসকাঠামো।
রবীন্দ্রনাথ এতো বড় মাপের একজন মানুষ যে তাঁকে টেনে নিচে নামানোর সাধ্য কারো নাই।