(১)

প্রকাশ্য দিবালোকে শ’শ’ মানুষের সামনে নিরীহ মহিলাদের ছেলে ধরা গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। সারাদেশে ইতিমধ্যেই অনেক নিরীহ মানুষ গনপিটুনি নামক দানবীয় তান্ডবে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেক মানুষ আতঙ্কে আছে কিন্তু সরকারের আইন-শৃংখলাবাহিনী ব্যর্থ।

ঢাকা শহর এখন এক ভয়াবহ আতঙ্কের শহর। ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে। সরকার মশা নিধণ করতে ব্যর্থ।

দেশের উত্তরাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভয়ঙ্কর বন্যার পানিতে বসবাস করে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ত্রাণ নেই। আশ্রয় নেই। সরকার এখানেও ব্যর্থ।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রকাশ্য দিবালোকে কিছু গুণ্ডাবাহিনী একটি ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ছেলেটির সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করেও স্বামীকে রক্ষা করতে পারেনি। আমরা সবাই জানি, প্রশাসন ও সরকারী দলের আশীর্বাদ ও প্রশ্রয় ছাড়া কোথাও গুণ্ডাবাহিনী তৈরী হয় না। এখানেও সরকার দলীয় এমপির পুত্র এবং সরকার দলীয় নেতারা জড়িত ব’লেই সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ সেই স্বামীহারা মেয়েটিকে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার ক’রে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেয়া হয়েছে ব’লে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। উদ্দেশ্য একই, সরকার দলীয় নেতাদের রক্ষা করা। প্রশাসন এবং সরকার এখানেও ব্যর্থ; অন্তত পাব্লিক পারসেপ্সন সেটাই ব’লে।

ঘুষ-দুর্ণীতিতে দুর্বীনিত প্রশাসন এবং সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। অথচ কোথাও প্রতিবাদ নেই। সচেতনতা নেই। প্রচার নেই। শুদ্ধিকরণের জন্য জনমত গঠনের প্রয়াসও নেই।

অথচ জনৈকা প্রিয়া সাহার এক বিচ্ছিন্ন অভিযোগকে সামনে নিয়ে এসে সরকার ও তার আজ্ঞাবহ কিছু মিডিয়া দিনরাত প্রচারণা করেই চলেছে। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, সরকার ও প্রশাসনের সব ব্যর্থতাকে আড়াল করা।

এক্ষেত্রে সরকার আমজনতার দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে চরমভাবে সফল হয়েছে ব’লে আপাতত মনে হচ্ছে।কারণ, প্রিয়া সাহার এ ঘটনায় দু’টো রসালো বিষয় আছে। এক, ধর্ম। দু্‌ই, নারী।

সরকার ও মিডিয়া সাথে যোগ করেছে, রাজনীতি। চায়ের কাপ গরম করার এর চেয়ে আর কোনো উত্তম উপাদানের প্রয়োজন আছে?

(২)

কিন্ত প্রিয়া সাহার অভিযোগ সরকারকে দীর্ঘমেয়াদে বিপদেই ফেলবে। আর সরকার সেটা অনুধাবন করেছে ব’লেই চটজলদি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

আমরা যতোই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়ার এ নালিশকে হালকা করে দেখি না কেনো, বিষয়টি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ারও নয়। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে বলা সকল বক্তব্য মার্কিন প্রশাসনের নথিভুক্ত থাকে। ফলে, প্রিয়া সাহার সকল বক্তব্যকে সংখ্যাধিক্যের বালখিল্যতা এবং অতিরঞ্জনের অভিযোগ তুলে দূরে সরিয়ে রাখাও সম্ভব নয়।

এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যে কেউ এ অভিযোগে বর্তমান সরকারকে কাঠগড়ায় তুলতে চেষ্টা করতে পারে। সর্বোপরি, পাশের দেশ ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্যগুলোতে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন(এনআর সি) জুজু তো আছেই। ইতিমধ্যেই আসামে প্রায় ১ কোটি মানুষকে ভারত অবৈধ নাগরিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। সম্প্রতি পশ্চিমবংগেও এন আর সি বা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের ঘোষণা দিয়েছে বিজেপি সরকার।

প্রিয়া সাহার ৩ কোটি ৭০ লাখ কিংবা আবুল বারাকাতের ১ কোটি ১৩ লাখ সংখ্যাগুলো বাংলাদেশ সরকারকে ভবিষ্যতে বেকায়দায় ফেলতে পারে। বিশেষকরে পানি বন্টন, সীমান্ত, বানিজ্য এবং অন্যান্য কূটনৈতিক দর কষাকষিতে এ অভিযোগগুলো বাংলাদেশের বিপক্ষে কাজ করতে পারে। সরকারের শঙ্কা এবং ভয়ের কারণও সম্ভবত এটাই।

(৩)

প্রিয়া সাহার নিজের সংগঠন “হিন্দু -বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ” ( নামটি নিয়েও আমার চরম আপত্তি) প্রিয়া সাহাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে। এটিও চরম অন্যায় এবং স্ববিরোধী। কারণ, এ সংগঠনটি প্রতিদিন ঠিক এ অভিযোগটিই করে থাকে সংবাদ সম্মেলন করে। তাই প্রিয়া সাহা সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন, যা তিনি নিজেও বলেছেন। তাহ’লে কেনো এ বহিষ্কার?

এ নিয়ে লেখক ও নারীমুক্তি অ্যান্দোলনের কন্ঠস্বর তসলিমা নাসরিনের একটা লেখার কথা মনে পড়লো। তসলিমা লিখেছেন, এক বিখ্যাত নারীবাদী সংগঠনের নেত্রী টেলিফোন করে তাকে এ রকম বলেছিলেন, “ আমরা সারাজীবন আন্দোলন করলাম, অথচ কেউ আমাদের চিনে না। তুমি এমন কী করে ফেললে যে, একদিনেই তুমি বিখ্যাত হয়ে গেলে”।

“হিন্দু -বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ”-এর নেতাদের সেই অবস্থা। তারা সারাজীবন সংগঠন ক’রে যা করতে পারেননি, প্রিয়া সাহা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে দেখা করে একদিনেই সেটা ক’রে ফেলেছেন। বাঙালির ঈর্ষাকাতরতা সার্বজনীন এবং সর্বজনবিদিত।

(৪)

অধ্যাপক আবুল বারাকাত নিজেও প্রিয়া সাহার বক্তব্য নিয়ে কথা বলেছেন। অধ্যাপক আবুল বারাকাতের বক্তব্যকে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অসংলগ্ন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হয়েছে। কারণ, প্রিয়া সাহা এবং আবুল বারাকাতের বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য শুধুমাত্র সংখ্যায় এবং শব্দচয়নে।

আবুল বারাকাত বলেছেন ১৯৬৪ পর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ ভূখন্ড থেকে ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু “ নিরুদ্দিষ্ট” হয়েছে। প্রিয়া সাহা বলেছেন, এ ভূখন্ড থেকে ৩ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ “ ডিসএপেয়ার বা নিখোঁজ বা নিরুদ্দিষ্ট” হয়েছে। পরে প্রিয়া সাহা সংখ্যাটির পেছনের যুক্তি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এটি বর্তমান জনসংখ্যার শতকরা হিসেব। দু’জনের হিসেবটি সংখ্যাতত্ত্বে সঠিক কী বেঠিক, সে আলোচনা করা যেতেই পারে। কিন্তু দু’টো বক্তব্যের বিষয়বস্তুতে কি কোনো পার্থক্য আছে?

প্রিয়া সাহাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে আবুল বারাকাতসহ আরও অনেককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। যতদূর জানি, হিন্দুদের দেশত্যাগে নিয়ে আরও কিছু গবেষণাপত্র এবং পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে।

(৫)

বাংলাদেশের পার্লামেন্টের প্রসেডিংস ঘাটলে প্রিয়া সাহার বক্তব্যের মতো অনেক বক্তব্য পাওয়া যাবে, যা আওয়ামী লিগের নেতারা বিভিন্ন সময়ে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন। এমনকি ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-০৬ বিএনপি-জামাতের ক্ষমতাসীন সময়ে তখনকার বিরোধী দলীয় নেতাও বহুবার দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার এবং দেশত্যাগের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

যতদূর মনে পড়ে, এ ব্যাপারে সবচেয়ে প্রতিবাদমুখর ছিলেন আওয়ামী লিগ নেতা প্রয়াত শুধাংশু শেখর হালদার। ১৯৯২ সালে ভোলা, বরিশাল, মানিকগঞ্জসহ সারাদেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংস পরবর্তী ধর্মীয় সহিংসতা এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি অসংখ্যবার বক্তব্য দিয়েছেন। ২০০১ এ বিএনপি-জামাতের নারকীয় অত্যাচারের পরেও সুশীল সমাজসহ আওয়ামী নেতারা হিন্দুদের দেশত্যাগের বিষয়টি তুলে ধরেছেন কূটনৈতিকদের কাছে ,এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছেও।

শুধাংশু শেখর হালদার একবার দেশের বিভিন্ন গ্রাম-শহর-রাস্তাঘাট-প্রতিষ্ঠানের নাম বদলের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়েছিলেন। হঠাৎ ক’রেই বিএনপি-জামাত সরকারের মদদে প্রায় সকল কৃষ্ণপুর ও রামপুর হয়ে গেল মোহাম্মদপুর, কালীগঞ্জ হয়ে গেল আলীগঞ্জ, জয়দেবপুর হয়ে গেল গাজীপুর। এ রকমভাবে সারাদেশে জনপদে নামবদলের হিরিক পড়ে গেল।

শুধাংশু শেখর হালদার অত্যন্ত বেদনা নিয়ে তখন নাকি সংসদে বলেছিলেন, “ মাননীয় স্পিকার, সবই যখন বদল হয়ে গেল, তখন “রামছাগল” আর বাকী রইল কেনো? এ নামটিও যুতসইভাবে বদল করে ফেলুন”।

(৬)

আওয়ামী লীগ এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার এবং দেশত্যাগের বিষয়টি অস্বীকার করতে চাইলেও নানা সময়ে তারাই কিন্ত সোচ্চার এবং উচ্চকণ্ঠ ছিল। ভারত উপমহাদেশের এ গভীর ক্ষতচিহ্নে একটু সহানুভূতির প্রলেপ লাগাতে এপারে বংগবন্ধুর আওয়ামী লিগ এবং ওপারে নেহেরুর কংগ্রেস সুখে-দুঃখে, বিপদে-সম্পাতে দুই দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশে থেকেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও ভারত ভাগের পর থেকে তাই এ দল দুটিকেই দিয়েছে নিঃশর্ত সমর্থন- যা অদ্যাবধি চলছে।

প্রিয়া সাহার অভিযোগের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে। এমনকি, যার কাছে অভিযোগ করেছেন সেটা নিয়েও চরম বিতর্ক আছে। তাই ব’লে প্রিয়া সাহার অভিযোগটি যারা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছেন, তারা হয়ত প্রকাণ্ড দেশপ্রেমের জন্য অপ্রিয় সত্যটি ঠিকমতো অনুধাবন করতে চাইছেন না কিংবা অনিচ্ছাসত্বেও ভিতরের “সুপ্ত সাম্প্রদায়িক” মনোভাবটি তাদের বেরিয়ে পড়েছে।