The all-female al-Khansaa Isis police brigade in Syria. Women played a variety of roles that went beyond those of ‘jihadi brides’. Photograph: unknown/Syriadeeply.org

যেসব নারী এবং শিশু আইসিসে যোগ দিয়েছিল তাদেরকে কখনো দেশের জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হয় নি। জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, সিরিয়া, ইরাক থেকে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসা নারী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক আইসিস সদস্যরা দেশের নিরাপত্তা হুমকি বাড়িয়ে তুলছে এবং যারা ফিরে এসেছে তাদেরকে খুব আমলে নেয়া হয় নি এবং তারা রয়ে গেছে লোক চক্ষুর অন্তরালে। কিংস কলেজের প্রতিবেদন মতে, সরকারের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণের অভাব এবং অস্ত্র হাতে নারীর যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করতে পারার নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নে আইসিসের নমনীয় মনোভাব নারীদেরকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে সরকারও আঁচ করতে পারেনি।

কিংস কলেজের ‘আন্তর্জাতিক মৌলবাদ এবং রাজনৈতিক সংঘাত অধ্যয়ন কেন্দ্রের’ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে পৃথিবীব্যাপী জঙ্গি হামলার পরিকল্পনার ছকে নারীরা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস নাগাদ ব্রিটেনের ৪১,৪৯০ জন বিদেশী নাগরিকের মধ্যে ৪,৭৬১ জন নারী ইরাক এবং সিরিয়াতে আইসিসের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ১২ শতাংশ অর্থাৎ ৪৬৪০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক।

‘আন্তর্জাতিক মৌলবাদ এবং রাজনৈতিক সংঘাত অধ্যয়ন কেন্দ্রের’ ঊর্ধ্বতন গবেষক ডঃ জোয়ানা কুক এবং জিনা ভেল বলেন, ৮৫০ জন ব্রিটিশ নাগরিক ইরাক এবং সিরিয়াতে আইসিসে যোগ দিয়েছে এরমধ্যে ১৪৫ জন নারী এবং ৫০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। আইসিসের হয়ে যুদ্ধ করা ৪২৫ জন আবার যুক্তরাজ্যে ফিরে এসেছে কিন্তু মাত্র দুইজন নারী এবং চারজন অপ্রাপ্তবয়স্কের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের কাছে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে আইসিস ফেরত এই বিপুল সংখ্যাটা লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে।

যেসব ব্রিটিশ নাগরিক আইসিসের হয়ে যুদ্ধ করে যুক্তরাজ্যে ফিরে এসেছে তাদেরকে বয়স বা লিঙ্গের ভিত্তিতে আলাদা করা সম্ভব হয়নি জোয়ানা কুক বলেন, যদিও ইরাক এবং সিরিয়াতে আইসিসের যুদ্ধরত বিদেশি যোদ্ধাদের মধ্যে ২৩ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক।

আমাদের মনে হয় কিছু নারী কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর নিরাপত্তার ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এই ঝুঁকিগুলো হতে পারে অনেকটা শারীরিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত এবং আইসিসের দখলকৃত অঞ্চলে থাকার সময়ে তারা যে জঙ্গি প্রশিক্ষণ পেয়েছে সেগুলো তারা স্থানীয় নিরীহ মানুষ বা তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের উপর প্রয়োগ করে ফেলতে পারে বা তাদের অর্জিত প্রশিক্ষণ অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে।

আইসিসের অভ্যন্তরীণ বয়ানে অস্ত্র হাতে নারীদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের তাগিদ উঠে এসেছে। যুদ্ধের মাত্রা ও পরিধি বাড়াতে নারীদেরকে অস্ত্র হাত তুলে নিতে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি নারীরা আইসিস পরিচালিত ফ্রান্স, মরক্কো, কেনিয়া, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনার ছকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে আইসিসে যোগ দেয়া নারীরাও সমান সম্ভাব্য জঙ্গি হুমকি।

প্রতিবেদনে প্রকাশ, দায়েশের সংস্পর্শে এবং বিভিন্ন দেশের জঙ্গির সহাবস্থানে দেখা যাচ্ছে ইসলামিক স্টেটের নারী এবং শিশু জঙ্গিরা ক্রমাগত সন্ত্রাসী হামলায় তাদের অংশগ্রহণ বেড়ে চলছে। নারী এবং শিশুদের নিয়ে তিন ধরণের আক্রমণভাগ তৈরি করা হয়েছে সেগুলো হলো: শুধু নারীদের নিয়ে গঠিত জঙ্গিদল, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত জঙ্গিদল অথবা একজন নারী একাই জঙ্গি হামলা পরিচালন করবে।
২০১৬ সালের অক্টোবরে মরক্কোতে সেদেশের সংসদ নির্বাচনের সময় জঙ্গি হামলার পরিকল্পনার দায়ে ১০ জন নারীকে আটক করা হয় এবং তাদের মধ্যে চারজন অনলাইনে ইরাক এবং সিরিয়াতে জিহাদে অংশগ্রহণকারী আইসিস জঙ্গিকে বিয়ে করেছে।

গত বছর যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তাবাহিনী লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়। সেই পরিকল্পনাতে অংশগ্রহণকারী সবাই ছিল আইসিসের নারী সদস্য। তাদেরকে আটক করা হয় এবং তাদের শাস্তিও হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে।যুক্তরাজ্যের তরুণী সাফা বাউলার ইতিমধ্যে সিরিয়াতে আইসিসে যোগ দেয়া অস্ট্রেলিয়ার নারী সদস্যের কাছে কিছুটা মৌলবাদের দীক্ষা পায় আর সেটার পূর্ণতা পায় অনলাইনে আইসিসের জঙ্গিকে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে।

গবেষকগণ বলছেন, যখনি আইসিসের কথা মনে আসে তখনি দেখা যায় “কিছু মানুষ আইসিসের কালো পতাকা নাড়াচ্ছে, তারা যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করছে, অথবা কেউকে জবাই করে নৃশংসতার নাটক মঞ্চস্থ করছে।” এইসব দৃশ্য কোন বিশেষ পেশায় দক্ষ যেমন বিচারক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীদেরকে উদ্বুদ্ধ করে এবং তারা মনে করে যুদ্ধের ময়দানে তাদের উপস্থিতি দরকার। এক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের অংশগ্রহণ আইসিসের কার্যক্রমকে সমর্থন করে এবং আইসিসের লক্ষ্যকে নৈতিক এবং আইনগত ভিত্তি এনে দেয়।

ইসলামিক স্টেটে নারীরা তাদের “জিহাদি বরের” থেকেও অধিক এবং বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন করে। তারা অন্য নারীদেরকে আইসিসে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য দারুণ কার্যকর, তারা জঙ্গিবাদ প্রচার প্রসারে ভালো ভূমিকা রাখে এবং খেলাফতের জন্য অর্থের যোগান খুঁজে বের করে। কানাডার এডমন্টনে এক নারী অনলাইনে কুরআন শিক্ষার দাওয়াত দেয় এবং তরুণীদেরকে মৌলবাদে দীক্ষা দেয় এবং তাকে সিরিয়া ভ্রমণে সাহায্য করে। স্পেনের কুয়েটাতে দুই বন্ধু নিজেরা আইসিস নিয়ন্ত্রিত ইরাক এবং সিরিয়া যাওয়ার আগে কয়েকজন নারীকে আইসিসে যোগদান করাতে সক্ষম হয়।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেসব নারীরা সিরিয়া এবং ইরাকে আইসিসে যোগ দিয়েছে তারা হল আইসিসের সোনার ডিম পাড়া হাঁস এবং তাদের থেকে আইসিসের অর্জন অনেক বেশী। বৈষম্য, নির্যাতন, সমাজের অবহেলিত ছাপিয়ে আইসিস নারীদেরকে মানসিকভাবে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে এবং নারীর ক্ষমতায়নকে সবার সামনে উপস্থাপন করেছে। ফলে আইসিসে নারীর ক্ষমতায়ন বয়ানটি পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দেশের নারীদের মাঝে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। যেমন ২০১৫ সালে খোদ যুক্তরাজ্যের বেথনাল গ্রিন এলাকার চারজন স্কুল বালিকা আইসিস জঙ্গি যোদ্ধাকে বিয়ে করতে সিরিয়াতে পাড়ি জমায়। বেথনাল গ্রিনের চারজন মেয়ের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া পূর্ব লন্ডনের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটা বড়সড় ধাক্কা ছিল এবং মানুষ বুঝতে পেরেছিল আইসিসের প্রলুব্ধ করার ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী।

২০১৭ সালে আইসিসের পতনের পর আইসিসে যোগ দেয়া নারীদের বর্তমান অবস্থান এবং অবস্থা এখনো অজানা রয়ে গেছে। যদিও ইসলামিক শরিয়া মতাদর্শে অনুপ্রাণিত আইসিস মূলত যুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণের ঘোর বিরোধী কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আইসিস তাদের মূলনীতি থেকেও সরে যাচ্ছে এবং ২০১৫ সাল থেকে নারীদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিরোধিতার নীতি থেকে সরে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আইসিস প্রথমবারের মত একটা ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে যুদ্ধের মাঠে অবতীর্ণ হয়েছে। এটা সম্ভবত কোন জঙ্গি দলের জন্য একেবারে স্বতন্ত্র পদক্ষেপ।

ইউরোপোল তাদের বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে তারা ২০১৪ সালে ৯৬ জন, ২০১৫ সালে ১৭১ জন, ২০১৬ সালে ১৮০ জন এবং ২০১৭ সালে ১২৩ জন নারীকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের দায়ে আটক করেছে। ইউরোপোলের প্রতিবেদনে জানা যায়, আইসিস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদীর আনুষ্ঠানিক ঘোষণামতে, ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে আগত আইসিসের জঙ্গি নারী পুরুষ জিহাদিদের মিলনে আইসিস খেলাফতে ৭৩০ জন শিশুর জন্ম হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি তথ্যসূত্র, ব্যক্তি, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম বাগদাদীর এই দাবীকে সত্য বলে মনে করছেন।

গবেষকগণ সরকারকে বলছেন, সরকারের এখন দরকার দেশের স্থানীয়, আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করা যাতে আইসিস ফেরত জঙ্গি নাগরিকদের অবস্থান এবং বর্তমান অবস্থা কী খুঁজে বের করা এবং আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক তাদের প্রতি সদয় কিন্তু সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিতে হবে, তাদেরকে শাস্তি না দিয়ে সুস্থ মূলধারার জীবনে পুনর্বাসনের জন্য সময়োপযোগী নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।

গবেষক ভেল বলেন, “যদিও স্বপ্রণোদিত অপ্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা জঙ্গি হামলার ঘটনা এখন পর্যন্ত সামান্য কিন্তু বিদেশি অপ্রাপ্তবয়স্কদের ইসলামিক স্টেটের জন্য মতাদর্শ-গত দায়বদ্ধতা আছে এবং দেশে ফিরে যুদ্ধের মাঠের তরতাজা অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর মত তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে যেটা দেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।

ইসলামিক স্টেট অঞ্চলে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা শিশুদেরকে জঙ্গিবাদ মনোযোগ সরাতে, তাদের মনের ভিতর থেকে মৌলবাদের মূলোৎপাটন করতে এবং তাদেরকে পুনর্বাসন করতে বিশেষভাবে উপযোগী মহা-পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এরকম সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া এই শিশুদের গা থেকে ‘আইসিস তকমা’ কলঙ্কের দাগ মুছে যাবে না এর ফলে ভবিষ্যতে তারা একাকী হয়ে যাবে, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে এবং ফের মৌলবাদী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে অথবা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে ইসলামিক স্টেটের পুনর্জন্ম হবে।

‘আন্তর্জাতিক মৌলবাদ এবং রাজনৈতিক সংঘাত অধ্যয়ন কেন্দ্রের’ পরিচালক সিরাজ মাহের বলেন, “গবেষণার ফলাফলে বড়দাগে সিরিয়া এবং ইরাকের বিদেশি আইসিস জঙ্গিদের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পতনোন্মুখ আইসিস খেলাফতের মতাদর্শ জারি রাখা এবং সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে নেয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিচালনার জন্য নারী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদেরকে বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। সুতরাং এটা অতীব জরুরী যে সরকারকে পুরুষ এবং নারী-অপ্রাপ্তবয়স্ক জঙ্গিদেরকে সম্মান গুরুত্বের সাথে চিহ্নিত করে তাদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা নিতে হবে।”

মূল প্রবন্ধ: Number of women and children who joined Isis ‘significantly underestimated’ by Nadia Khomami
আগ্রহীদের জন্যে- আইসিসে নারী জঙ্গির আত্মপ্রকাশ