জহির রায়হান (১৯ আগস্ট ১৯৩৫ – ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২) একজন বাংলাদেশি উপন্যাসিক, লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নির্মিত প্রামণ্যচিত্র “স্টপ জেনোসাইড” নির্মানের কারণেই তিনি সম্ভবত সর্বাধিক পরিচিত। জহির রায়হান ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার মাঝে এত গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতা নির্ভর করে “জীবন থেকে নেয়া” কিংবদন্তীতুল্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের উপর “স্টপ জেনোসাইড” নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আটক এবং পরে নিহত জহির রায়হানের আপন ভাই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক শহিদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে জহির রায়হান রহস্যজনকভাবে নিজেই নিখোঁজ হয়ে যান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। পরে অবশ্য প্রমাণ মেলে কিছু সশস্ত্র বিহারী চক্রান্তকারী এবং ছদ্মবেশি পাকিস্তানি সৈনিক জহির রায়হানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ফজলুল হক নামের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং প্রযোজক জহির রায়হানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে রাষ্ট্রপতি মুজিবের কাছে একটা চিঠি লেখে। ফজলুল হক অভিযোগ করে জহির রায়হান তার “স্টপ জেনোসাইড” প্রামাণ্যচিত্রে শেখ মুজিব, আওয়ামীলীগ এবং ছয় দফা দাবীকে অবজ্ঞা করেছেন। ফজলুল হক আরও অভিযোগ করে জহির রায়হান তার প্রামাণ্যচিত্রে ভ্লাদিমির ইলিচ ইলিয়ানোভ লেনিনের ছবি ব্যবহার করেছেন। ফজলুল হক মুজিবনগর সরকারকে জহির রায়হানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ করে। কিন্তু ফলাফল ঘটে ঠিক উল্টো, ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ জহির রায়হানের প্রামাণ্যচিত্রের উচ্ছসিত প্রশংসা করেন। স্টপ জেনোসাইড ১৯৭২ সালে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কার জিতে নেয়। প্রামাণ্যচিত্রটি ১৯৭৫ সালে দিল্লির চলচ্চিত্র উৎসবে SIDLOC পুরষ্কার লাভ করে। জহির রায়হানের বিরুদ্ধে চিঠিটি ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিল’ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে যার তথ্যসূত্র নিচে দেয়া হলোঃ Memo No. PS/SEC/III/110, Dated 10th Sept., 1971
বরাবর
প্রধানমন্ত্রী,
বাংলাদেশ সরকার
বিষয়ঃ জনাব ফজলুল হকের চিঠি, জহির রায়হান নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী প্রসঙ্গে।
এখানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং পরিচালক ফজলুল হকের চিঠির সংযুক্তি সন্বিবেশিত হয়েছে। চিঠিটি নিজেই এই চিঠি লেখার প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করছে। আমি আপনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি জনাব ফজলুল হক যেসব অভিযোগ দায়ের করেছে সেগুলো খতিয়ে দেখা হোক এবং গুরুত্ব বিবেচনা করে দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুরোধ করা হইল।
এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটির প্রদর্শনী বাতিল করে আমাকে জানানো হোক।
(সৈয়দ নজরুল ইসলাম)
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি
সংযুক্তিঃ চিঠির একটা অনুলিপি।
স্যার,
যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, বিষয়টা গভীর উদ্বেগের এবং আমার জানামতে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ। জহির রায়হানের পরিচালনায় আমরা একটা প্রামাণ্যচিত্রের “স্টপ জেনোসাইড” প্রদর্শনী দেখলাম আজ কলকাতার এক ঘরোয়া আয়োজনে।
প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মানে আর্থের যোগান দিয়েছে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার এসোসিয়েশন এবং প্রযোজিত হয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি এবং বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অফ ইন্টেলিজেনশিয়ালের যৌথ উদ্যোগে। প্রামাণ্যচিত্রটি ভারত সরকারের কাছে বিক্রি হতে পারে যাতে ভারত তার নিজ দেশে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারে।
প্রামাণ্যচিত্রটি শুরু হয়েছে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের একটা ছবি এবং তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যেখানে ইন্ডিয়াতে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প নিয়ে তেমন কিছুই প্রদর্শিত হয় নি। আমার ধারণা এই প্রামাণ্যচিত্রের গুরুতর সমস্যা হলো এখানে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য বা তার কোন ছবি নেই বা আওয়ামীলীগ সম্পর্কে একটি শব্দও উল্লেখ করা হয়নি বা আমাদের ছয়দফা দাবী নিয়েও কিছু বলা হয়নি।
আমি মনে করি যদি এই প্রামাণ্যচিত্র ভারতে বা বহির্বিশ্বে প্রচার হয় তাহলে দর্শকের মনে হতে পারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে অন্যকোন উদ্দেশ্যে যেটা আমরা নিজেরাও বিশ্বাস করি না। যদি এই প্রামাণ্যচিত্রটি ভারতের কোন পরিচালক নির্মাণ করতেন তাহলে হয়ত আমরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে পারতাম কিন্তু যেহেতু এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন আমাদের বাংলাদেশের একজন পরিচালক সেহেতু আমরা চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এই প্রামাণ্যচিত্রের বিরোধীতা করছি এবং আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ ভারতীয় সরকারের মাধ্যমে জনসাধারণ দেখে ফেলার আগেই প্রামাণ্যচিত্রটি বন্ধে অতিসত্ত্বর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
তা যদি না করা হয় তাহলে আমি একাই প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করব।
গভীর বিনয়াবনত,
ফজলুল হক
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রযোজক এবং পরিচালক
প্রযত্নে, জনাব বিনয় রায়, ১১৪/এ পার্ক স্ট্রিট
কলকাতা-১৭
রাষ্ট্রপতি
বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর
ধন্যবাদ লেখকদের (সুব্রত শুভ এবং বিকাশ মজুমদার) ইতিহাসের একটি অজানা অংশ জানার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। স্টপ জেনোসাইড প্রামান্যচিত্রটি আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মূল (এবং হয়তো একমাত্র) উদ্দেশ্য ছিল একাত্তরের ভয়াবহ গণহত্যার তথ্য বাইরের দুনিয়ার কাছে পৌঁছে দেয়া। নির্মাতা এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘণ, শরণার্থীদের দূরাবস্থা আর অসহায়ত্ব, দায়ী দখলদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির নির্মমতাকেই তাঁর ক্যামেরার ফোকাসে এনেছেন। জহির রায়হানের মাপের একজন মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতা যে গণহত্যার মতো সিরিয়াস টপিকের সাথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত তথ্য যোগ করে বক্তব্যের গুরুত্ব কমাতে চাইবেন না, তা অনুমিত। খুব সম্ভব এজন্যই বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর প্রাক-মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা এই প্রামাণ্যচিত্রটিতে সেভাবে আসেনি।
এখানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যে চিঠিটি ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে লিখেছেন, সেটিতে প্রথমে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। আবার পরের লাইনেই প্রামাণ্যচিত্রটির প্রদর্শনী বাতিল করে তাঁকে (ভারপ্রাপ্ত রাস্ট্রপতিকে) জানানোর কথা বলা হয়েছে। একই চিঠিতে দু’রকমের নির্দেশনা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
অভিযোগকারী ফজলুল হক যে একজন দলকানা ব্যক্তি তা তার চিঠিতেই পরিস্কার। একজন সংকীর্ণ দলকানা মানুষ নিজের বা গুটিকয়ের ক্ষুদ্র স্বার্থে কিভাবে একটি জনগোষ্ঠির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিসর্জন দিতে পারে এবং নিজ স্বার্থ কায়েম করতে কত দূর যেতে পারে চিঠিটি তারই প্রামান্য দলিল।
লেখাটি পড়ে বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী মহোদয় নিজে যা ভাল মনে করতেন তাই করতেন। এই দৃঢ়চেতা মানুষটি রাস্ট্রপতির চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রদর্শনী বাতিল দূরে থাক বরং এটির ‘উচ্ছসিত প্রশংসা করেন’। প্রামাণ্যচিত্রটি পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পায় যা তাজউদ্দীন সাহেবের দূরদৃষ্টিরই উদাহরণ দেয়। ইতিহাস বলে, দূরদৃষ্টির এমন আরও অনেক উদাহরণ তিনি তাঁর অসময়ে শেষ হয়ে যাওয়া জীবনে দিয়েছেন।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেন, তাঁদের অনেকেরই মতে মেধাবী রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন সাহেবের যথাযথ মূল্যায়ন এখনও হয় নি। এই মানুষটি সম্পর্কে যতই জানছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।
আসলে আমাদের ইতিহাস সেই ভাবে পড়ানো হয় নি।আপনার মন্তব্যে দৃষ্টিভঙ্গির নতুন দুয়ার খুলে গেলো।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ। জানতাম না এ-বিষয়ে।
তাই তো, এখানে ক্লিক করলেই সুব্রত শুভ’র লিঙ্ক দেখা যাচ্ছে ইংরেজি ব্লগে:
দরকারী পোস্ট। অনেকে এই বিষয়টা জানে না। একই বিষয়ে মুক্তমনায় ইংরেজী ব্লগে একটা ব্লগ পোস্ট করেছিলাম। বিকাশ দা’কে ধন্যবাদ, পাঠকদের জন্যে চিঠি’টা তিনি অনুবাদ করেছেন।
জহির রায়হানের জীবন আমাকে বিস্মিত করে।তাঁর প্রামাণ্যচিত্র টি সম্পর্কে এই সংযোগ আরো ভাবাচ্ছে।
মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। স্টপ দ্যা জেনোসাইড আগেই দেখেছি। আবার দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু যেহেতু পৃথক-আলাদা-স্বতন্ত্র নয় তাই সেখানে তাঁকে বা তাঁর নাম উল্লেখ করার প্রয়োজনটা অপ্রাসঙ্গিক বটে। তবে অবাক হয়েছি, তখনও দলকানা ছিলো। যাই হোক আমি জনাব তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে শতভাগ একমত। কোন দ্বিধা নেই জহির রায়হানের দেশপ্রেমের প্রশ্নে। তবে কষ্ট আছে, কেননা স্বাধিন দেশে তাঁকে আমরা হারিয়েছি।