[মুভি রিভিউ]

লিখেছেন: রাজেশ পাল

“ তোমার কোন বাধন নাই,তুমি ঘরছাড়া যে তাই,
এই আছো ভাটায় আবার এইতো দেখি জোয়ারে’’

একদিন বাংলা গানের কিংবদন্তী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এভাবেই নিবেদন করেছিলেন তাঁর প্রিয় নদীটির প্রতি হৃদয়ের সুষুপ্ত ভালোবাসার শ্রদ্ধার্ঘ্য “নীল আকাশের নীচে” (নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত’টি নয়) ছবিতে। আর নদী ও নারীর প্রতি সেই সুরের সিম্ফনি ফের শোনা গেলো তৌকির আহমেদ এর শিল্পীত চিত্রায়ণে সেলুলয়েদের ফিতায়।

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, তৌকির আহমেদ এর ‘হালদা’র কথাই লিখতে বসলাম। অভিনেতা তৌকির আমার কাছে যতটা প্রিয় ছিলেন এবং আছেন, পরিচালক তৌকির তার চেয়ে অনেক বেশী মুগ্ধতার সৃষ্টি করেছে আমার মাঝে। এর আগে তাঁর নির্মিত আরো দুটি চলচ্চিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। একটি ‘জয়যাত্রা’ , অপরটি ‘অজ্ঞাতনামা’। ‘জয়যাত্রা’ ছবিটি যখন মুক্তি পায়, আমার প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রজীবন তখন প্রায় শেষ প্রান্তে। ঠিক সেই সময়েই গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার অধিকারী হুমায়ুন আহমেদ নির্মাণ করেছিলেন ‘শ্যামলছায়া’। কাকতলীয়ভাবে দুটি ছবির উপজীব্যই ছিলো মুক্তিযুদ্ধ এবং দু’দল নৌকাযাত্রী পলায়নপর মানুষের গন্তব্যে পৌঁছার ‘দ্য লংগেস্ট হাণ্ড্রেড মাইলস’ এর কাহিনী। আর বিস্ময়কর ব্যাপার যে দুটি ছবিরই সমাপ্তি ঘটে মুক্তিসংগ্রামের মহামন্ত্র ‘জয় বাংলা’ শঙ্খনিনাদের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সুশীল আর জটিল “যদি কিন্তু তবে” টাইপ’এর বিশ্লেষণে না গিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে যদি সত্য স্বীকারে ব্রতী হই , তবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, মানের দিক দিয়ে ‘জয়যাত্রা’র অবস্থান ‘শ্যামলছায়া’র চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে। হুমায়ুন যেভাবে একটি রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের সময়টিকে চিত্রায়িত করতে গিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ ‘সেন্স অফ হিউমার’ প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন, তৌকির তাঁর ধারেকাছেও যাননি। বরং ফুটিয়ে তুলেছিলেন যুদ্ধকালীন সিভিলিয়ানদের জীবন বাঁচানোর জন্মযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র। ফলে ছবিটিও হয়ে উঠেছিলো অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য। জানিনা, এই কথাটি বলার ফলে কারো হুমায়ুনাভূতি আহত হলো কিনা। কিন্তু আপন মনের প্রকৃত ভাবনাটুকুই অকপটে তুলে ধরলাম। এরপরে ‘অজ্ঞাতনামা’তেও শুনতে পেলাম আরেক তারেক মাসুদ’এর আগমনের পদধ্বনি যেন। ফারুকী জেনারেশনের ভিড়ে তৌকিররাও যে হারিয়ে যাননি সেটি পরিষ্কারভাবেই জানান দেন ‘অজ্ঞাতনামাতে’
আর এবার সবাইকে কাপিয়ে দিলেন ‘হালদা’ দিয়ে। ‘হালদা’ চলচ্চিত্রের মূল নাটকটি প্রকাশ করেছিল লিটল ম্যাগাজিন ‘নোঙর’। তা-ও চার বছর আগের কথা। তখন অর্ধশতাধিক পৃষ্ঠার এ লেখাটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘মৎস্যগন্ধা’। পরবর্তীতে ‘হালদার হাসি’ নামে চিত্রনাট্যের আমূল পরিবর্তন করে জমা দেওয়া হয় সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের জন্য। কিন্তু সেটি অনুমোদন পায়নি। সর্বশেষ তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় আলোর মুখ দেখল ‘হালদা’।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীকে উপজীব্য করে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়েছে এর আগে। অদ্বৈত মল্ল বর্মণের কাহিনী অবলম্বনে ঋত্বিক ঘটক নির্মাণ করেছিলেন, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, যেমন গৌতম ঘোষ নির্মাণ করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর কাহিনী নিয়ে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ । এ’ছাড়া তানভীর মোকাম্মেল এর ‘নদীর নাম মধুমতি’, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’ও নির্মিত হয়েছিলো নদী আর মানুষের মিথস্ক্রিয়াকে আবর্তন করেই।

হালদা চট্টগ্রাম জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৩৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। হালদা খালের উৎপত্তি স্থল মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ী গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ী র্ঝণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে হালদা নামকরণ হয়। সালদা নদী নামে বাংলাদেশে আরো একটি নদী আছে যেটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপন্ন ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

প্রতিবছর হালদা নদীতে একটি বিশেষ মূহুর্তে ও বিশেষ পরিবেশে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস ও কার্প জাতীয় মাতৃমাছ প্রচুর পরিমাণ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে ‘তিথি’ বলা হয়ে থাকে। মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত শুধু অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা ‘জো’ বলে। এই জো’র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হতে হবে, সেই সাথে প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে; এই বৃষ্টিপাত শুধু স্থানীয় ভাবে হলে হবে না, তা নদীর উজানেও হতে হবে। ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। এতে পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। জো’এর সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হল নদীর জোয়ার ভাটার জন্য অপেক্ষা করা। পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলক ভাবে অল্প ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে দেয়। ডিম সংগ্রহ করে জেলেরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন। এই হালদা নদীর দুই পাড়ের মানুষগুলোর প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের সুখ, দুঃখ আর আনন্দ বেদনার গল্প নিয়েই রচিত হয়েছে হালদা চলচ্চিত্রের কাহিনী।

হালদা সিনেমার গল্প শুরু হয়েছে হালদা নদীতে নয়, সমুদ্রে! যেখানে প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় জেলে মনু মিয়া মাছ ধরছেন, এমন সময় তার ট্রলারে ডাকাত আসে, ডাকাতি হয় । ডাকাতদের আক্রমনে একজন মাঝি মারা গেলেও মনু মিয়া কোন রকমে বেঁচে যায় বদির বদৌলতে । বদি মনু মিয়ার বাড়িতে আসে । পরিচয় হয় মনু মিয়ার মেয়ে হাসুর সাথে। পিতার জীবন রক্ষাকারী বদির সাথে হয় হাসুর মন বিনিময় । এদিকে মহাজন ক্ষতিপূরণ দাবি করে ডাকাতি হওয়া ট্রলারের জন্য । তখন তাকে মহাজনের কাছের একজন লোক পরামর্শ দেয় সে যেন হাসুকে পাশের গ্রামের নাদের চৌধুরীর সাথে বিয়ে দেয় । তাহলে নাদের চৌধুরী ট্রলারের ক্ষতিপূরণ মহাজনকে দিয়ে দিবে । মনু মিয়াকে আর টাকা দিতে হবে না । মনু মিয়া তখন বিপাকে পড়ে যায় । অনেক ভাবার পর মনু মিয়া হাসুকে নাদের চৌধুরীর সাথে বিয়ে দিতে প্রথমে রাজি হয় না । কারণ হাসুর স্বামীর আগে একটা বিয়ে হয়েছিল । সন্তান হয়নি তাই সে হাসুকে সন্তানের জন্য বিয়ে করেছে । অন্যদিকে হাসু ও বিয়ে করতে অসম্মতি জানায় । এরপর যখন গ্রাম্য সালিশের কথা শুনে মনু মিয়া অসুস্থ হয়ে পরে তখন হাসু নাদের চৌধুরীকে বিয়ে করতে রাজি হয় । হাসু চলে যায় অন্যের বাড়িতে । এখান থেকেই শুরু হয় হাসুর আরেক অধ্যায়। সতীন, শাশুড়ি আর কাজের মেয়ে কুলসুমকে নিয়ে আগায় হাসুর গল্প। যে গল্প স্ত্রী নিপীড়ন, নিষ্পেষণ আর স্বামীর অপরাগতার।

তৌকির আহমেদ ‘হালদা’র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার পুরো চলচ্চিত্রে নারীকে তুলনা করেছেন নদীর সঙ্গে। চলচ্চিত্রটির ‘নোনা জল’ গানে হয়তো তাই বলতে চেয়েছেন তিনি। যেখানে শিল্পী পিন্টু ঘোষ আর সুকন্যা মজুমদার ঘোষ সুরে সুরে গেয়েছেন-

‘যার বুকে ঢেউ থাকে তার বুকে ঘর।
জোয়ার ভাটার খেলা করে নাতো পর।।’

নদী যেমন জোয়ার ভাটার টানে নিত্য যাওয়া-আসা করে নারী নামক নদীর বুকেও তেমনি প্রতিনিয়ত চলে সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচল। তবুও নারী একবার যাকে মন দেয় সে দূরে চলে গেলেও তাকে পর করে দিতে পারেনা। যেমনি করে নদীর তল যতোই দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করুক না কেনো নদীকে ছেড়ে সে কখনোই যেতে পারে না।

গানের পরের লাইনেই আবার তৌকির বলেছেন,

‘জীবন নদীর মতো ঢেউ থামেনা।
কেউ তার পাড় পায় কেউ পায় না।’

এর পরের লাইন দুটি হচ্ছে-

‘আহা জীবন, কত ভালবাসাবাসি।
নোনা জলে, নোনা জলে কত হাসাহাসি।।’

অমাবস্যা বা পূর্ণিমার রাতে প্রচন্ড বজ্রপাত সহ বৃষ্টি হলে ‘জো’ আসে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলকভাবে অল্প ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট করে ফেলে। সে চায় না তার অনাগত সন্তানেরা প্রতিকূল কোনো পরিবেশের সম্মুখীন হোক। আর সেই একইভাবে হাসুও চায়না তাঁর সন্তান বেড়ে উঠুক একটি বৈরী পরিবেশে। ছবির একটি দৃশ্যে চৌধুরী যখন হাসুকে কটাক্ষ করে বলে যে,

– ‘হালদার মাছ ডিম ছাড়লো কি ছাড়লো না সেটি নিয়ে তোমার ভাবার দরকার নেই। তোমার কাজ হচ্ছে সন্তান জন্ম দেয়া।’

প্রত্যোত্তরে হাসুকে তাই বলতে শোনা যায়,

– …………. ‘ইট ভাটার ধোয়া আর হালদার নষ্ট পানিতে তার সন্তান কিভাবে বাঁচবে?’

পরিবেশ দূষণের শিকার হালদা আর ভাগ্যের বিপর্যয়ের শিকার হাসুর জীবন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই মহেন্দ্রক্ষণে। মনের গহীনে তাই অবচেতন মনেই উচ্চারিত হয়,

“হালদা বাঁচলে হাসুও বাঁচবে”

অত্যাচারী, ইটভাটা মালিক চৌধুরীদের বিরুদ্ধে হাসুদের অসম সংগ্রামে তাই ধ্বনিত হয় ‘নদী বাঁচাও , দেশ বাঁচাও’ আন্দোলনের প্রতিধ্বনি।

চলচ্চিত্রটির কুশীলবদের প্রত্যেকের অভিনয় ছিলো মুগ্ধ করার মতোই। জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, তিশা, ফজলুর রহমান বাবু প্রত্যেকেই অসাধারণ অভিনয় করেছেন নিজ নিজ চরিত্রে। কারিগরী দিকগুলোতেও ছিলো যথেষ্ঠ মুন্সিয়ানার ছাপ। সব মিলিয়ে, হালদা দেখার মতো, ভালোলাগার মতোই একটি ছবি। গতানুগতিক ‘তুমি আমি’ প্রেমকাহিনীর বাইরে গিয়ে গণমানুষের কথা, তাদেরই যাপিত জীবনের ছবি।

পরিচালক তৌকির আহমেদকে আবারো ধন্যবাদ আরেকটি চমৎকার চলচ্ছিত্র আমাদের উপহার দেয়ার জন্য।