মনে হচ্ছে আমরা আবার একটা আক্রান্ত সময়ের মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এই কথা কেন বলছি? কারণ মানুষ মাঝে মাঝে নিজেকেই ধ্বংস করার পথ তৈরি করে। ধরে নিই আমার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বিষয় প্রত্নতত্ত্ব। একই সাথে আমি ইতিহাস এবং নৃবিজ্ঞান নিয়েও পড়েছি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমার মনোজগতে ইতিহাসের গঠন, ধরণ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় বেশিরভাগ মানুষই তার বাপ-দাদার আমলের ৫০ থেকে বড়জোর ১০০ বছরের ইতিহাস জেনেই ক্ষান্ত দেয়। তার থেকেও অতীত ইতিহাস জানতে হলে ইতিহাসের নির্মোহ পাঠ খুব জরুরী। সংক্ষেপে যদি বলি, ধরুন আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং পড়েন, আপনার পছন্দের বিষয় ব্র্যান্ডিং। তাহলে কয়েকটি ব্র্যান্ডের মধ্যে যদি তুলনামূলক আলোচনা না করেন তবে ব্র্যান্ডিং জিনিসটা কী জিনিস সেটা বুঝতে পারার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। একটা বই পড়লে ৩৬০ ডিগ্রি বৃত্তের একটা ব্যাসে আটকে থাকতে হবে অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার মত। এই কারণেই হুমায়ুন আজাদ স্যার বলে গেছেন, “এক বইয়ের পাঠক থেকে সাবধান”।
আসুন, ইতিহাসকে একটু কাছে থেকে দেখি। কী দেখতে পাচ্ছি? সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের স্বভাব হলো সময়ের নির্দিষ্ট আবর্তনে নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনা। কয়েকটি যুদ্ধের দিকে তাকালেই দেখতে কিভাবে মানুষ নিজের স্বজাতির মূলোৎপাটন করে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ও দখলদারিত্ব বজায় রাখতে যুদ্ধ করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু কিছু কিছু যুদ্ধ মানুষকে নির্মূল করে দেয়। যুদ্ধ ছাড়াও প্রকৃতির বিচারে মানুষ অনেক সময় সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যেমন ‘ব্ল্যাক ডেথ’ প্লেগ আক্রান্ত হয়ে ইউরোপ একসময়ে জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মানুষের সৃষ্টি করা যুদ্ধে মানুষ হত্যার তুলনায় প্রাকৃতিকভাবে মারা যাওয়ার মানুষের পরিমাণ কত সেটা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
কেন আক্রান্ত সময়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ট্রাম্প পুরাদস্তুর একজন ক্যারিশম্যাটিক নারসিসিস্ট ব্যবসায়ী এবং অধুনা রাজনৈতিক মানুষ। যিনি আমেরিকার জনতাকে জাতীয়তাবাদের আফিম খাইয়েছেন। আমেরিকা নামের শক্তিশালী রাষ্ট্রকে আরও গৌরবান্বিত করার এক এক টোপ দিয়েছে। আমেরিকার মানুষ গিলেছেও খুব। এখন তার চারপাশে আবর্তিত হচ্ছে ক্ষমতা কেন্দ্রিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠী।
মানুষের স্বভাব এবং বৈশিষ্ট্য এত পরিবর্তনশীল যে পূর্বাভাস দেয়া খুবই কঠিন কাজ। প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মরে গিয়েও টিকে ছিল বহাল তবিয়তে, ভবিষ্যতেও পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থা বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে। সত্যি কথা হলো, ‘ব্ল্যাক ডেথ’ প্লেগের কারণে একদিক থেকে ইউরোপের মঙ্গল হয়েছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে শত শত হাজার হাজার শিশু, কিশোর, যুবা, বৃদ্ধ মরে গেল প্লেগ মহামারীতে। হয়ত ‘ব্ল্যাক ডেথ’ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ইউরোপের দুর্বল মানুষ মেরে বাঁচিয়ে রাখল শুধু তাদেরকে যারা বৈরি প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারবে। ‘ব্ল্যাক ডেথ’ দৃশ্যমানভাবেই ইউরোপের সামাজিক কাঠামোর খোল নলচে বদলে দিলো। এত যে হৃদয় বিদারক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু কিন্তু সেটা বাস্তবে দেখা গেল শাপে বর হয়ে গেছে। ইউরোপ-জুড়ে কর্মী মানুষের সংকটে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে গেল, আর পণ্যের দাম গেল কমে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়ে গেল। মানুষ অল্প খরচে অধিক মানসম্পন্ন পণ্য, খাদ্যদ্রব্য ভোগ করার সুযোগ পেল।
‘ব্ল্যাক ডেথ’ থেকে যারে বেঁচে গেল আর যাপন করতে লাগল উন্নত জীবন তারা আসলে পর পর দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত রাশিয়ার দুর্ভিক্ষ, হলোকাস্ট ইত্যাদি মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগে মরার জন্য বেঁচে ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের পতন, স্পেনের অরাজকতা, ইউরোপে জুড়ে ত্রিশ বছর ব্যাপী আন্তঃ-গৃহযুদ্ধ, ইংল্যান্ডের জনযুদ্ধ মানুষ হত্যার এরকম বিশাল তালিকা। এরকম গণহত্যার পরেও মানুষ ঠিকই টিকে আছে বরং আগের থেকে আরও ভালো অবস্থায় আছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ মনে করে সবকিছু ঠিকঠাক আছে, কিন্তু ঘুণে খাওয়া সমাজে, প্রতিক্রিয়াশীলগোষ্ঠী চক্রাকারে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় পুরো মানব জাতিকে কিন্তু তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন মানবজাতি নিজেই ডেকে আনে নিজের বোধনে বিসর্জন অকাল। ঘটনার মধ্যে যারা আছে তারা বিষয়টা বুঝতে পারে না আসলে কি ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে। ইতিহাসবিদগণ অনেক পরে ঘটনার পরম্পরা সাজিয়ে বুঝতে পারেন ঠিক কি ঘটেছিল সেই অতীতে এবং মানবজাতিকে ভবিষ্যতের পথ দেখান।
বসনিয়াতে আততায়ীর হাতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফারডিনান্ড নিহত হলে ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের যৌথ বাহিনীর সাথে জার্মানির যুদ্ধ শুরু হয় আর সেটাই ধীরে ধীরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেয়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর সাম্রাজ্যবাদের কি আজব লড়াই! ইউরোপের এক অগুরুত্বপূর্ণ যুবরাজের মৃত্যু ১৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে গেল।
যুদ্ধের জন্য আসলে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ হত্যা উপলক্ষ মাত্র। এটাই মানুষ হত্যার একটা বৃত্তাকার চর্চা, ফিরে আসে বার বার বিভিন্ন কারণে, যুদ্ধবাজরা বার বার কারণ তৈরি করে। ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই বিগত ৫০ থেকে ১০০ বছরের ঘটনার প্রেক্ষিতে ইতিহাস দেখতে পছন্দ করেন। তাই সাধারণ মানুষ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখতে পান না। যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ উদ্ঘাটিত হলো তখনই কিছু মেধাবী মানুষ সতর্ক করে দিয়েছিল এই বলে যে, যুদ্ধ থামানোর জন্য আন্তঃদেশীয় সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি ইউরোপকে পুনরায় যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেই মেধাবী মানুষেরা অতিদেশপ্রেমী, জাতীয়তাবাদী, ক্ষমতা উন্মাদ নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্ব পায়নি, তেমনি এখন যারা পুতিন, ব্রেক্সিট, হিলারি, আইসিস বা ট্রাম্পদের নিয়ে দুশ্চিন্তিত তারাও গুরুত্ব পাচ্ছে না। যদি মানুষকে ভালবাসে এমন উদ্বিগ্ন মেধাবী মানুষদের কথা ক্ষমতাবাদীরা একটু গুরুত্ব দিত তাহলে হয়ত মানুষ হত্যার অপচয় থামানো যেত।
একটা যুদ্ধ থেমে গেলে ক্ষমতাবাদীদের আর একটা যুদ্ধের দরকার হয়। কারণ যুদ্ধ মানেই জেনারেলদের ফিল্ড মার্শাল খেতাব প্রাপ্তির সুযোগ। যুদ্ধ মানেই দেশপ্রেমের সস্তা ব্যবসা ও জনপ্রিয়তা। যুদ্ধ মানেই অনন্ত ক্ষমতা। ছোট যুদ্ধ সর্বাত্মক বড় যুদ্ধে রূপ নেয়, একযুদ্ধ শেষ করে আমরা নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করি। এবং তখনই ইতিহাসবিদ বলেন, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে ইতিহাসের এমন করুন পুনরাবৃত্তি ঘটত না। যুদ্ধ নিরীহ মানুষের মনে দেশের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় দেখায়, নিরাপত্তাহীন করে তোলে, তাদের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে অজানা আশংকায় ভোগে, তখন দেশের মানুষ খুঁজতে থাকে পরিত্রাণের উপায় আর ক্যারিশম্যাটিক নেতা পেয়ে যান বলির পাঠা। নেতাকে খুঁজে বের করতে হয় কিভাবে ব্যবহার করবেন নতুন আবিষ্কৃত বলির পাঠাকে। তিনি কথা বলতে থাকেন দেশপ্রেম নিয়ে, ঘৃণা আর বিদ্বেষের মাঝে মিশিয়ে দেন অলংকার। মানুষ অভিভূত হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত নেতার কথা শুনতে থাকেন। জনতা ঘৃণার আগুনে জ্বলে ওঠেন, কোন কারণ ছাড়াই ফুঁসে ওঠেন এবং অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেন অনিবার্য ধ্বংসের দিকে।
এভাবেই ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেগে আছে রক্তের দাগ। হত্যার রাজনীতিতে হিটলার শুধু একা নন, আরও অনেক বিগ শট আছেন যেমন ধরুন মুসোলিনি, স্ট্যালিন, মুগাবে, আরও অনেকে। সবার নাম লিখতে গেলে মুল আলোচনা থেকে হত্যাকারীর নামের তালিকা দীর্ঘ হয়ে যাবে। এখানে মুগাবে খুবই ভালো উদাহরণ। মুগাবে অসাধারণ বাগ্মিতায় জিম্বাবুয়ের জমির মালিক সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ বিরুদ্ধে কালোদের জাতিগত বিদ্বেষ ও হিংসা জাগিয়ে তুললেন। শ্বেতাঙ্গদের দখলকৃত জমি কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। এই অঞ্চলে শ্বেতাঙ্গরাই মূলত জমি চাষ, কৃষিকাজ করত এবং তাদের কাছে কৃষির জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ছিল। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের হাতে দখল করা জমি আসলেও তারা জানত না কিভাবে চাষাবাদ করতে হয়। এমন উর্বর জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে তাতে ফলত সোনা, কিন্তু সেখানের কৃষ্ণাঙ্গরা কৃষিকাজ জানে না। ফলাফল জমির মালিক হয়েও অনাহারে, দুর্ভিক্ষে মানুষ মরতে লাগল, কারণ জমি তো আর খাওয়া যায় না। মানবতার মুক্তির দিশারি সাম্যবাদের কারণেও মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা নেহাত কম নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, কিউবা এবং চায়নার সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বিগত শতাব্দীতে ৪০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এটা কোনভাবেই বোধগম্য নয় কেন মানুষ বারে বারে মানুষের মৃত্যুর কারণ তৈরি করে। শুধু একবার হত্যা করেই ক্ষান্ত হয় না, মানুষ বার বার মানুষ হত্যার পরিবেশ এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে।
মানুষ যখন রাজনৈতিক খেলার ক্ষেত্র তৈরি করে তখন তারা বুঝতেও পারে না তাদের সামান্য কিছু ভুল সিদ্ধান্ত অদূর ভবিষ্যতে কত মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। তারা মনে তারা সঠিক, তখন তারা বারুদের মত উত্তেজিত জনতাকে নিয়ে ধ্বংসাত্মক খেলায় মেতে ওঠেন এবং যারা এই ধ্বংসযজ্ঞের আগুনের আঁচ আগে টের পান তাদেরকে নিগৃহীত করা হয়। ক্ষমতার দুষ্টচক্র এভাবেই চলতেই থাকে। যেমন ভরসাই চুক্তির মাধ্যমে দুই মুখি করাত হিটলারের জন্ম দেয় এবং এই চুক্তিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। দেখুন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কি আশ্চর্য! ঘটনা ঘটার সময় মানুষ ইতিহাস দেখতে পায় না কারণ- সাধারণ মানুষ শুধু বর্তমানের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারা অতীত এবং ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না। সাধারণ শুধু তার চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা দিয়ে বর্তমানকে বিচার করে, কিন্তু ভেবেও দেখে না ঘটনাগুলো কিভাবে বৈশ্বিকভাবে সম্পর্কিত। বেশিরভাগ মানুষ জ্ঞান চর্চা করে না, বই পড়ে না, চিন্তা করে না, চ্যালেঞ্জ নিতে জানে না এবং বিপরীত মতামত শুনতে পছন্দ করে না।
এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য চরিত্র ট্রাম্প আমেরিকাতে ঠিক একই পথে এগিয়ে যাচ্ছেন অন্তত ইতিহাস আমাদের সেই শিক্ষাই দিচ্ছে। ট্রাম্প বলছেন তিনি আমেরিকাকে পুনরায় মহান হিসেবে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করবেন। কিন্তু সত্যি কথা হলো, আমেরিকার নতুন করে বিশ্বের মাতব্বর হওয়ার কিছু নেই। যেকোনো পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকা এখন বিশ্বের মোড়ল অবস্থানে আছে। তবুও ট্রাম্প অতীতের জাতীয়তাবাদী নেতাদের মত হিংসা, বিদ্বেষ, জাতিগত ঘৃণা ছড়িয়ে আমেরিকাকে মহান করার জন্য বাগাড়ম্বর করে যাচ্ছেন। ক্যারিশম্যাটিক নারসিসিস্ট ট্রাম্প জনতাকে মহান আমেরিকার কথা বলে উত্তেজিত করে তুলছেন এবং তার চারদিকে ক্ষমতার বলয় তৈরি হচ্ছে। ট্রাম্পের উত্থানের জন্য আমরা হয়ত সমাজ, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী বা গণ মাধ্যমের দোষ দিতে পারি, কিন্তু ইতিহাসের চিত্রে দেখতে পাচ্ছি এটা শুধুই পুরনো ইতিহাসের নতুন মঞ্চায়ন।
আসুন, আমরা বর্তমানের বিশ্ব রাজনীতিকে আরও কাছ থেকে আরও বিস্তৃতভাবে দেখি। ইতিমধ্যে রাশিয়া পেয়ে গেছে ইতিহাসের কাঙ্ক্ষিত ক্যারিশম্যাটিক চরিত্র যিনি ইতিমধ্যেই নিজের চতুর্দিকে ক্ষমতার জ্যোতির্বলয় তৈরি করেছেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল তুরস্কও ঠিক একই পথে হাঁটছে। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়ার হাত ধরে ইউরোপ-জুড়ে আরও অনেক পুতিন, ট্রাম্প অপেক্ষা করছে।
এখন আমাদের নিজেদের খুঁজে দেখতে হবে কে হবে ভবিষ্যতের আর্ক ডিউক ফারডিনান্ড। কিভাবে ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা ডেকে আনবে ভয়াবহ ধ্বংস। ব্রেক্সিট, ট্রাম্প, পুতিনকে আলাদা আলাদা বিশ্লেষণ না করে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। বর্তমানের পৃথিবী আর কারো একক আধিপত্যে সীমাবদ্ধ নেই, ক্ষমতার বলয় একজনকে ঘিরে অন্যজন আবর্তিত। বিশ্বজুড়েই ক্রান্তিকাল চলছে। যারা বেঁচে আছি তাদের সামনে অপেক্ষা করছে কল্পনাতীত নারকীয় সময়। তখন আমরা মৃতদের হিংসা করব।
ব্রেক্সিট হলো কিছু সংখ্যক হিংসাত্মক মানুষের সাময়িক বিজয় যারা হিংসা ছড়িয়ে দিয়েছে অন্য হিংসুটে মানুষের মাঝে। এই হিংসুটে মানুষেরা ভাবছে তারা হয়ত জিতে গেছে। কিন্তু এটা আসলে ভাঙ্গনের শুরু। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে শুধু একটা এটম ধ্বংসের জন্য দায়ী নয়, বরং একটা এটম অন্য একটা এটমকে ভেঙে ফেলে, ভেঙে যাওয়া এটম চেইন রি-একশনের মাধ্যমে ভাঙতেই থাকে। এই যে শুরু হয়ে গেল ভাঙার খেলা, এই খেলা ধ্বংস পর্যন্ত চলতেই থাকে। ভেঙে যাওয়া এটমের মিলিত শক্তিই আণবিক বোমা। ভাঙন দিয়েই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু একই পথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ব্রেক্সিটকে কিভাবে নিউক্লিয়ার যুদ্ধের দিকে ধাবিত করতে পারে সেটা একটু ভেবে দেখি।
ব্রেক্সিটের কারণে ইটালি বা ফ্রান্সে একই ধরণের দাবী উঠতেই পারে, গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী নেত্রী মারিয়ান লে পেন সম্প্রতি একটা নির্বাচনে জয় লাভ করেছেন, যিনি ইতিপূর্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমালোচনা করেছিলেন। অভিবাসী এবং শরণার্থী সমস্যা নিয়ে জার্মান বিস্ফোরণের মুখে আছে। সুইডেনও অভিবাসী ও শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা করছে। বিভিন্ন সমস্যা মিলে ইউরোপে এখন ভঙ্গুর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরাজ করছে। তবুও এই প্রতিষ্ঠানটিই ইউরোপকে দীর্ঘদিন যুদ্ধ থেকে বিরত রেখেছে। পুতিনের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটা বড় বাধা। ইউক্রেনে সামরিক আক্রমণের পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে যা রাশিয়ার অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। যার কারণে রাশিয়ার একটা ক্ষোভ আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাম্প। পুতিনের সাথে ট্রাম্পের সম্পর্ক মধুর এমন একটা রসালো গসিপ বাজারে ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার জোয়ারে পাল তুলে ট্রাম্প বলেছেন, বাল্টিক অঞ্চলে রাশিয়ার আক্রমণের মুখে ন্যাটো বাহিনীর কিছুই করার নেই। ফলে ন্যাটোর ক্ষমতা খর্ব হয়ে গেছে অনেকাংশে।
একদিকে দ্বিধা বিভক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যদিকে দুর্বল ন্যাটো। ইউরোপ-জুড়ে অর্থনীতি এবং সামাজিক সমস্যা এখন তুঙ্গে, পুতিনের তো পৌষ মাস। এখনই দরকার বিদেশি হস্তক্ষেপ। পুতিন ইতিমধ্যে লাটভিয়াতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরোধী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করেছেন। রাশিয়া এবং লাটভিয়া সীমান্তের আন্দোলন দমন করতে রাশিয়া ‘শান্তি রক্ষা এবং সাহায্যের নামে” ট্রাক বোঝাই সৈন্য অস্ত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। একই কাজ পুতিন জর্জিয়া, ওশেটিয়া, ইউক্রেন অঞ্চলে করেছিলেন। বিভক্ত ইউরোপের ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরোধী নেতারা এখন রাশিয়ার অনুগামী। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এদিকে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপে ন্যাটো সাড়া দিচ্ছে না। ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকা এই ঘটনায় নিজেকে আর জড়াতে চায় না। রাশিয়ার আগ্রাসনের সামনে সত্যিকার অর্থে কোন জোরালো প্রতিপক্ষ নেই। এই সুযোগে রাশিয়া লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুনিয়াতে সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী। বাল্টিক দেশগুলোর সামনে এখন রাশিয়ার আক্রমণের প্রতি উত্তর দেয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। সুতরাং যুদ্ধের দামামা শুরু হয়ে গেছে। অর্ধেক ইউরোপ এখন আক্রান্ত বাল্টিক দেশগুলোর পক্ষে, কেউ কেউ এখনো নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে, বাকিরা রাশিয়াকে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সংকটে তুরস্কের অবস্থান কি? ইউরোপের নতুন যুদ্ধে আইসিস কিভাবে রেসপন্স করবে, কে প্রথম নিউক্লিয়ার বোমা ব্যবহার করবে? সম্ভাব্য অনেক খেলোয়াড় এই বিশাল জটিল সমীকরণের অংশীদার। ইতিহাসের আলোকে দেখতে পাই, নতুন মানবিক বিপর্যয় ও ভয়াবহ ধ্বংস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ভয়াবহ ধ্বংসের সব উপাদান ধীরে ধীরে জড় হচ্ছে যেন আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে।
ধ্বংস আসছে তার সঠিক পথেই ঠিক যেমন এসেছিল অতীতে, কিন্তু খোলা চোখে আমরা তার আগমন দেখতে পাচ্ছি না। যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে তখন আর থামানো যাবে না। ভবিষ্যতের মানুষ আজকের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখবে এবং অবাক হয়ে দেখবে কেমন করে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু হয়েছিল। যদি সত্যিই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তাহলে আমি কেমন করে জীবনে বাঁচার তাগিদে না পালিয়ে শান্তিতে এই লেখা লিখতে পারব? কিভাবে মানুষ পড়বে আর যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করবে? অনলাইন, চ্যাটরুম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন জোরালো আলোচনা চলছে ট্রাম্প হতে যাচ্ছেন পরবর্তী হিটলার, ট্রাম্প ঘৃণার আগুনে হিংসার ঘি ঢালছেন এবং সেই আগুন নিয়ন্ত্রণভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে সহজেই আমরা ইতিহাসের নেতিবাচক দিক এড়িয়ে যেতে পারি এবং নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যেতে পারি এই আশায় যে আসলে আমাদের কিছুই হবে না। এগুলো অপপ্রচার এবং গুজব। কিন্তু মনে রাখতে হবে ট্রাম্প রাতারাতি ভোটের চেহারা বদলে দিয়ে বিপুল সমর্থনে বিজয়ী হয়েছেন। তারমানে হলো প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
ব্রেক্সিট পরবর্তী ইউরোপীয় ইউনিয়নের করুণ পরিণতি এবং ট্রাম্পকে সম্ভাব্য যুদ্ধবাজ মনে করা বিশ্লেষকদের নিয়ে তামাশা করে, উপেক্ষা করে হয়ত সাময়িক সুখ পাওয়া যাবে কিন্তু সেটা হবে ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও কেউ একজনের ধূমপান চালিয়ে যাওয়ার মত নির্বুদ্ধিতা এবং ফলাফলে কিছুদিন পরে দেখা যাবে লোকটি দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়েছে। যেকোনো সামান্য দুর্ঘটনা শুরুতেই সমাধান না করলে কিছুদিন পরেই হয়ত ভয়াবহ পরিণতি দেখা দিতে পারে। ঘটনা দুর্ঘটনায় পরিণত হওয়ার আগেই যদি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের প্রস্তাব ভেবে দেখা যেত তাহলে হয়ত মানুষের মৃত্যুর অপচয় থামানো যেত। কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষ ধূমপান করে এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। রবি দা প্রেমকে উপজীব্য করে এরকম একটা গান লিখেছিলেন, “আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান, প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ”। কিন্তু এখন প্রেম পড়ে গেছে প্যান্ডোরার বাক্সের তলানিতে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে না এটাই মানুষের স্বাভাবিক চলা এবং চিন্তার পথ। যারা চিন্তা করে আর পথ দেখায় তারা অনাদৃত। তাহলে কি হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে জাদুর কাঠির স্পর্শে সব সমস্যা সমাধান হয়ে যেত? মোটেও না, হিলারি হলো জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক, বিশ্বজুড়ে জঙ্গিবাদের শুভেচ্ছা দূত। হিলারি আর ট্রাম্প দুজনেই আসলে মুদ্রার এপিঠ ও পিঠ। নির্বাচনে কে বিজয়ী হলো সেটা বিষয় না, বিষয় হলো যিনি নির্বাচিত হচ্ছেন তিনি আমেরিকা বিজনেস কর্পোরেশনের সিইও। তার কাজ হলো ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। আর নতুন নতুন যেসব মানব বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি হচ্ছে সেগুলো পরীক্ষা এবং কার্যক্ষমতা দেখার জন্যেও তো যুদ্ধ দরকার। আজ ট্রাম্প জিতেছে বলেই ট্রাম্পের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি, হিলারি জিতলেও একই কথা হয়ত লিখতাম, কিন্তু পৃথিবীতে যুদ্ধের সম্ভাবনা হয়ত আরও বেড়ে যেত।
মানুষের মুক্তির জন্য সমমনা কল্যাণকামী মানুষের ঐক্য দরকার। ক্রমেই মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে আলোকবর্ষ দূরত্বে। মানুষের এই পারষ্পরিক দূরত্বই পুঁজিবাদের একমাত্র পুঁজি। মানুষকে দ্বিধান্বিত করে দাও, তারপর কাছে নিয়ে যাও সমাধান। সমাধান কী? পুঁজিবাদের সমাধান হলো হিংসা। মানুষের ঐক্যের আশায় যতই আশাবাদী হই না কেন, এই আধুনিকতায় মানুষের ঐক্য আর সম্ভব না। বিভেদের যুদ্ধে যারা বেঁচে থাকব নরকের যন্ত্রণায়, আমাদের কল্পনাতীত হতাশায় তখনও আমাদের মাঝে থাকবে স্বার্থের বিভক্তি। মানুষের বাঁচার ক্ষমতা অসীম, শত ধ্বংসেও বেঁচে যাওয়া মানুষ এগিয়ে যাবে। অন্যকে হত্যা করে, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করে ভবিষ্যৎ মানুষ হয়ত আরও ভালভাবে বেঁচে থাকবে, জীবনযাত্রার মান যাবে বেড়ে। মানুষ তো সেই কবেই ভুলে গেছে সুখ আর স্বস্তির পার্থক্য।
আসলে স্বাধীন মুক্তচিন্তার মানুষই একমাত্র সংখ্যালঘু। যাদের যাওয়ার কোন যায়গা নেই। কেউ তাদের সহ্য করতে পারে না, কারণ ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রায় সব সিদ্ধান্তই মানব-মুক্তির পরিপন্থী। আর মুক্তমনের মানুষ এইসব অনাচারের ঘোর সমালোচক। যে মানুষেরা পাখির মত আকাশে ডানা মেলা মুক্ত স্বাধীন সমাজের বাস্তবায়ন চায়, যে মানুষ যেকোনো শ্রেণির মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ নেই, সর্বত্র যুদ্ধের বিরোধী, মানুষের কল্যাণ চায় তারাই যুদ্ধে হেরে যায়। পৃথিবীতে মানুষকে রক্ষা করতে দরকার ক্ষমতার লোভ এড়িয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়া। কিন্তু রাষ্ট্রনায়কদের কানে বাজে শুধু মুদ্রার নিক্বণ আর বারুদের ঝুনঝুনি।
(লেখাটি History Tells Us What Will Happen Next With Brexit And Trump আর্টিকেল এর আলোকে লেখা।)
Share this:
Leave A Comment