যাকে দেখা যায় না, ধরা যায় না, স্বাদ বা গন্ধ কোনটাই নেয়া যায় না, অথচ আপনার জীবদ্দশায় প্রতিনিয়ত আপনি তাকে হাড়ে হাড়ে অনুভব করছেন, তার সম্মিলিত আক্রমণের মুখোমুখি হচ্ছেন। পৃথিবীর অন্য কোন শক্তি কি আছে, যে এতটা নাটকীয়ভাবে আপনার উপরে প্রভাব ফেলতে পারে? হ্যাঁ, এই শক্তির নাম মাধ্যাকর্ষণ শক্তি।
যখন একটা আপেল বিজ্ঞানী আইজাক নিউটনের মাথার উপরে পড়েছিল, তখন থেকে তিনি ধারণা পেতে শুরু করেন এই শক্তি কিভাবে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের কক্ষপথকে প্রভাবিত করে। মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের উপরে এই মহাকর্ষের প্রভাব কি হতে পারে, সেই ধারণা হয়তো তখনও তার মাথায় আসেনি।
আপনি কি কখনও লক্ষ করেছেন, দিনের শেষে আপনার কোমরের বেল্টটা একটু টাইট হয়ে গেছে? আপনি কি প্রায়ই আপনার গাড়ির ব্যকভিউ মিরর সকালে একটু উঁচুতে আর রাতে একটু নিচুতে এডজাস্ট করে থাকেন? আপনি কি জানেন চল্লিশের পরে প্রতি বিশ বছর পরপর আপনি আধা ইঞ্চি করে বেটে হচ্ছেন? আপনি কি মাঝেমাঝে শিরা ফুলা রোগ, পা ফোলা, পিঠে ব্যথায় ভুগছেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি হা হয়, তবে বুঝতে হবে আপনি মাধ্যাকর্ষণের সংকোচক শক্তির শিকার।
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্রমুখী টান, যা আমাদের মুখ, কাঁধ, পিঠ, ঘাড়, বুক, ভিতরের প্রত্যঙ্গ, পা প্রভৃতি অংশের উপরে যে যন্ত্রণাদায়ক প্রভাব ফেলে তা অনুভব করে না এমন মানুষ নেই। মাধ্যাকর্ষণ কাউকে ছাড়ে না, কারো প্রতি বৈষম্যও করে না। বৃদ্ধ, যুবা, অলস, ক্রীড়াবিদ, সবাই এই পৃথিবীতে জীবন ধারণের ফলে অভিজ্ঞতা নেয়, কিভাবে ধীরে ধীরে তাদের প্রিয় দেহখানা বদলে যায়।
শরীরচর্চা আমাদের সুস্থ, সুঠাম রাখে ঠিকই, কিন্তু ব্যায়াম একই সাথে আমাদের উপকার ও অপকার দুইই করে। সেটা কিভাবে হয়? এটাকে বলে সংকোচন জনিত অবসাদ। যত তুমি দৌড়বে, ততো তুমি ভার বইবে, গ্রাভিটীকে তোমার দেহ তত বেশী খাজনা দিবে।
মাধ্যাকর্ষণের সবচেয়ে লক্ষণীয় প্রভাব দেখা যায় আমাদের দেহের মেরুদণ্ডের উপরে। শিরদাঁড়াকে সে সংকুচিত করে। সবাই জানে আমাদের শিরদাঁড়া ছোট ছোট তেত্রিশখানা কশেরুকা, এবং তাদের মাঝেমাঝে স্পঞ্জের মতন ডিস্ক দিয়ে গঠিত। সারাটা দিন মাধ্যাকর্ষণের নিন্মমুখী ক্রিয়ার ফলে ডিস্কগুলো প্রচুর পানি হারায়। ফলাফল হচ্ছে দিনশেষে শিরদাঁড়া ছোট হয় আধা ইঞ্চি থেকে সোয়া এক ইঞ্চি। রাত পেরলে পানি আবার ডিস্কে ফেরত আসে, তবে শতভাগ আসে না। এইসব কারণে পুরা জীবদ্দশায় মানুষের মেরুদণ্ড খাটো হয় আধা ইঞ্চি থেকে দুই ইঞ্চি।
উচ্চতা হারালে আমাদের পিঠের স্বাস্থ্যই যে শুধু নষ্ট হবে তা না, এর একটা সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া হবে সারা দেহে, যাকে ইংরেজিতে ‘ডমিনো ইফেক্ট’ বলা যেতে পারে। এই সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোও সংকোচনের শিকার হবে এবং প্রকৃত ওজন না বাড়লেও মোটা হবে কোমর। কোমর মোটা হয়ে যাওয়াকে ‘ভালবাসার চাকা’ বললেও বলা যেতে পারে, তবে এটাকে সংকোচন চাকা বলাই শ্রেয়, কারণ এটা তৈরিই হয় শিরদাঁড়ার প্রত্যক্ষ সংকোচনের ফলশ্রুতিতে। এই বস্তু আমাদের নড়াচড়া ও বাঁকা হয়ে কিছু করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কমিয়ে দেয় আমাদের সাধারণ দৈনন্দিন কাজ সম্পাদন করার দক্ষতাও।
গ্রাভিটি আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গের উপরও ধ্বংস যজ্ঞ চালায়। সময়ের সাথে সাথে প্রত্যঙ্গগুলোর স্থানচ্যুতি ঘটে, অথবা প্রকৃত অবস্থান থেকে এদিক ওদিক সরে যায়। এতে প্রত্যঙ্গসমূহের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। প্রত্যঙ্গসমূহের স্থানচ্যুতির কারণে মূত্রথলি, কিডনি ও পাকযন্ত্রের নানা সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া মোটেই বিরল নয়। এর বেশ কিছুটা সমাধান মেলে যোগব্যায়ামে। শতাব্দীর অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত ইওগাতে দেখা যায়, শরীর উল্টা করে, মাথা নিচে, পা ঊর্ধ্বে কিছু সময় রাখার অনুশীলন। এই ব্যায়ামে অভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গের স্থানচ্যুতির প্রবণতা কমে আসে।
উচ্চতা হারানো এবং মোটা কোমর শরীরের নমনীয়তা নষ্ট করে দেয়। সক্রিয় জীবনধারণ পদ্ধতির মূল কাজ হচ্ছে মানুষের নড়াচড়ার ক্ষমতাকে ধরে রাখা। আমাদের শেষ জীবনের সব স্বাদ-আহ্লাদ, গলফ খেলা, বাগান করা, নাতি-পুতিদের সাথে দৌড়ঝাঁপ করার সব ক্ষমতাকে আসলে ডাকাতি করে নিয়ে যায় এই মাধ্যাকর্ষণ।
পানিকে উপরে উঠতে যদি গ্রাভিটি বাঁধা দেয়, তবে দেহের রক্তও মাথার দিকে আসতে বাঁধা পাবে। সময়ের সাথেসাথে মানুষের সংবহনতন্ত্র মাধ্যাকর্ষণকে মূল্য চুকায়। এর ফলে শিরাস্ফিতি, মস্তিষ্কে রক্তস্বল্পতা, হাত-পা ফোলা ইত্যাদি নানা উপসর্গে ভুগতে হয় মানুষকে। চোখ, কান, চামড়া, করোটি, ও ব্রেইনে রক্ত কম সংবাহিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে আমাদের মূল্যবান অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
একটা খুব সাধারণ একটা পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের সংবহনতন্ত্রের উপরে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব কতটা, তা বুঝা যায়। দুইমিনিট ধরে ডানহাতটাকে খাড়া উপরে তুলে রাখুন, বামহাত থাকবে নিচে। তারপরে হাতদুটোকে পাশাপাশি রেখে রঙ পরীক্ষা করুন। দেখবেন বামহাত ডানহাতের চেয়ে বেশী লাল। এখন একবার চিন্তা করা যাক, সারাদিন দুইপায়ের উপরে যারা খাড়া হয়ে দাড়িয়ে থাকে, তাদের উপরে এই শক্তি কি প্রভাব ফেলে। আমাদের দেহ অবচেতনভাবে বুঝতে পারে নিন্মাঙ্গ থেকে হৃদযন্ত্রে রক্ত সংবহণের দরকার। আমরা কি একবারও গুণে দেখেছি, আমরা যখন ডেস্কে বসে থাকি, কতবার আমরা পা নাড়াই, বা পা দাপাই বা চেয়ার তুলে দেই। এসবই করি রক্ত সংবহনের দরকারে, গ্রাভিটি টানকে পুষিয়ে নেয়ার জন্যে।
এইসব শারীরিক সমস্যার জন্যে আমরা বার্ধক্যকে অনিবার্যভাবে দায়ী করি। আসল সত্য হচ্ছে, আমাদের দেহের এইসব বিচ্যুতি ঘটে শুধুমাত্র গ্রাভিটির কারণে এবং তা মোটেই অনিবার্য নয়। একেবারে না হলেও কিছুটা তো এই শক্তিকে এড়িয়ে চলা যায়।
গ্রাভিটি আমাদের নিয়ে কী খেলা খেলছে, আশাকরি সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে নীচের আলোচনার উপর থেকে আলোটুকু চয়ন করতে পারলে। মহাশূন্যচারীরা যখন পৃথিবীর প্রভাবের বাইরে যায়, তখন তারা এক সপ্তাহেই বেড়ে যায় দুই ইঞ্চি। এই সময়ে তাদের মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলো রক্তস্রোত থেকে প্রচুর পানি শুষে ফুলে যায়। যেহেতু কোন গ্রাভিটির টান নেই, তাই মুক্তভাবে তারা বেড়ে গড় উচ্চতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। সেই কারণে মহাশূন্যচারীদের পোশাক দুই ইঞ্চি বড় করে ডিজাইন করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা সারা জীবনভর পৃথিবীতে সেটে থাকি এবং প্রাকৃতিকভাবে আমরা জীবনের কোন না কোন সময়ে গ্রাভিটির ক্ষতিটাকে পুষিয়ে নেই।
ক) শিশু মাতৃজঠরে পুরাটা সময় ফ্লুইডের বয়েন্সির কারণে প্রায় ওজনহীন অবস্থায় কাটায়। এবং ডেলিভারির শেষ পর্যায়ে শিশু মাথা নীচের দিকে রেখে উল্টা মানবের আকারে অবস্থান করে ব্রেইনের বর্ধনের জন্যে।
খ) বহু শিশু মাথার চেয়ে বস্তিদেশ উঁচুতে রেখে ঘুমাতে পছন্দ করে, মাথায় পর্যাপ্ত রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে।
গ) শিশুরা তাদের বর্ধন ত্বরান্বিত করতে অবচেতন ভাবে গ্রাভিটিকে ফাঁকি দিতে চায়। এই কাজের জন্যে তারা বানরের মতন মাথা নীচের দিকে রেখে ঝুলে থাকতে চায়। তারা দোলনা ভালবাসেও ঠিক এই কারণে।
ঘ) আমরা বড়রাও মাঝেমধ্যে চেয়ারে বা টেবিলে পা তুলে দিতে পছন্দ করি গ্রাভিটীর অনবরত টান থেকে মুক্তির জন্যে।
আমরা মাধ্যাকর্ষণ থেকে পালাতে পারি না, কিন্তু চালাকি করে তাকে কিছুটা আমাদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারি। সেটা কিভাবে? গ্রাভিটির ভিতরে ঠিক স্বাভাবিকভাবে যে অবস্থানে আমাদের শরীর থাকে, মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্যে তার উল্টা অবস্থানে রেখে আমরা সেই চালাকিটা করতে পারি। গ্রাভিটিকে ব্যবহার করে শরীরের সম্প্রসারণ ও দীর্ঘকরণের মাধ্যমেও সেটা করতে পারি। লম্বা হয়ে শুয়ে থেকেও কিন্তু মাধ্যাকর্ষণীয় সংকোচন থেকে রেহাই পাওয়া যায় না।
দেহের যে পরিমাণ সস্প্রসারণ ঘটালে গ্রাভিটি সংকোচনকে পুষিয়ে নেয়া যায়, তা কেবল মাত্র সম্ভব উল্টাসন বা মাথা নীচে, পা উপরে রেখে যোগ চর্চার মাধ্যমে। আমাদের শিখতে হবে, জানতে হবে কিভাবে গ্রাভিটির সাথে যুদ্ধ করে শিরদাঁড়ার যথাযথ দৈর্ঘ্য, দেহাভ্যন্তরের প্রত্যঙ্গসমূহের যথাযথ অবস্থান বজায় রাখা, রক্তপ্রবাহ বাড়ানো এবং শরীরে নমনীয়তা ধরে রাখা যায়। ম্যাকানিকাল ট্রাকশানের মাধ্যমে দেহটাকে ভার্টিকাল নরমাল বা লম্বের সাথে ৬০ ডিগ্রি কোনে নাড়াচড়া করতে পারলে গ্রাভিটির ব্যাড ইফেক্টকে বাইপাস করা যেতে পারে। কিন্তু মেকানিকাল ট্রাকশানের ব্যাপারটা বেশ জটিল ও কষ্টকর।
গ্রাভিটি মানুষকে বৃদ্ধ করে, দুর্বল করে এবং বিভিন্ন প্যথোজেনকে আমাদের সংক্রমিত করার পথকে সহজ করে দেয়। তাই মাধ্যাকর্ষণ আমাদের শত্রু, আবার তাকে না হলেও চলে না। আমাদের শত্রুর কোন শেষ নেই। চোর, ডাকাত, প্রতিক্রিয়াশীলতা, কুরাজনীতি, অপরাজনীতিও আমাদের শত্রু। তাই এইসব ধরাছোঁয়া শত্রুর পাশাপাশি আরেকটা অদৃশ্য শত্রুকে বিবেচনায় রাখতে দোষ কি? মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক অপঘাতের মতন গ্রাভিটিও আমাদের মৃত্যুর কারণ, অথচ তার নামে মানুষের কোন নালিশ নেই।
তথ্যসুত্রঃ গুগল ডট কম
Leave A Comment