ইনছন হাগিক চার্চের সম্মানিত পেষ্টর মিঃ পার্কের আমন্ত্রনে গত শনিবার ১৫ই জুলাই দারুণ এক কর্মযজ্ঞের প্রত্যক্ষ্যদর্শী হলাম। সকাল সাড়ে ন’টায় ইনহা ইউনিভার্সিটির প্রধান ফটক হতে শুরু হয়েছিলো যাত্রা। বিগত বৃষ্টি বিধৌত সারা রাতের পর বৃষ্টিহীন গম্ভীর সকালে কৌতুহল নিয়েই আমার যাত্রা শুরু। দলে আরোও ছিলো ইনহা ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন বিভাগে পড়ুয়া কিছু বিদেশী ছাত্র এবং গবেষক! যাওয়া আসার সাত ঘন্টা যাত্রা আর মাঝে দেড় ঘন্টার দুপুরের খাবারের সময় মিলিয়ে মোট সাড়ে আট ঘন্টা বাদ দিয়ে আড়াই ঘন্টার ঝটিকা সফর ছিলো এটি।
দক্ষিন চুংছনের বোনগুনস্থ সান ওইমিয়ং-এ এ সমবায় সংগঠনটির আবস্থান, নাম বোনাকম সমবায় কমিউনিটি! বোনা শব্দের মানে হলো ‘শুভ’, বোনাকম শব্দটি এসেছে বোনা কমিউনিটি থেকে , অর্থাৎ শুভ কমিউনিটি! শুরুতে মাত্র পাঁচটি সমমনা পরিবার মিলে এ সংগঠনের জন্ম হলেও পরবর্তীতে তা বেড়ে আঠারেোয় উন্নীত হয়। শুরুতে যে পাঁচটি পরিবার মিলে এর সূচনা ঘটিয়েছিলো এরা মূলতঃ জাপান থেকে এক বিশেষ প্রকৃয়ায় মুরগী লালনের পদ্ধতি রপ্ত করে সেই একই পদ্ধতিতে গড়ে তুলে সমবায় পদ্ধতির মুরগীর ফার্ম! কালক্রমে সে ফার্ম বিস্তৃত হয়ে এখন এক পুর্নাঙ্গ কৃষি ব্যবস্থাপনা ফার্মে রূপান্তরিত! অত্যন্ত অজ-পাড়াগাঁয়ে পাহাড়ের কোল ঘেঁসে নিজস্ব সামান্য একফালি জমিতেই তাদের সূচনাকালীন কার্যক্রমের শুরু! পরবর্তীতে দরকার আরোও জায়গা, আরোও জনবল। অতএব আরোও সদস্যের যোগদান, সাথে সাথে সবার জমির অংশগহন, শ্রমের অংশগ্রহন, সাথে মেধা। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বর্তমানের রূপ পরিগ্রহন, অভাবনীয়! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্ভবতঃ একই ধরনের কৃষি সমবায়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষে!
সদস্য সংখ্যা যখন বেড়ে হলো আঠারো, তখন স্বভাবতঃই নানা মতের-অমনতের দ্বন্দ্বও হলো শুরু। শুরুতে যদিও ভাবা হয়েছিরো যে সব কার্যক্রম কমিউনিটির সাধারন মতামতের ভিত্তিতেই হবে, কিন্তু পরবর্তীতে একাংশ বাধ সাধলো যে না, সব নয়, কিছু কিছু বিষয় আছে যা প্রতিটি পরিবারের তাদের নিজস্বতার উপড়েই ছেড়ে দেয়া উচিৎ। এ বিতর্কে কমিউনিটির প্রায় ভগ্ন দশা। এমতাবস্থায় আকষ্মিক সরকারী প্রসংশা ও অনুদানে সে যাত্রায় ভাঙ্গন রক্ষা পায়! কিন্তু তার পর পর কমিউনিটির সবাই মিলে অতীতের এ বিতর্ক যাতে ভবিষ্যৎকে বাধাগ্রস্থ না করে সে লক্ষ্যে গঠিত হয় নীতিমালা। প্রতিটি পরিবার কিছু কিছু বিষয় আছে যে সব বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে আর বাকি বিষয় গুলো কমিউনিটির সাধারন মতামতের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। যেমন, পারিবারিক আয়-ব্যায় , বিয়ে ও সামাজিক কার্যক্রম, পারিবারিক নির্মান, ও নতুন কোন সিদ্ধান্ত, কোন ব্যবসা, কোন চাকুরী, বিনিয়োগ কিংবা কমিউনিটি ত্যাগ ইত্যাদি পারিবারিক সিদ্ধান্তের আওতায ছেড়ে দেওয়া হয়, আর আবাদ, নতুন কৃষিকার্যক্রম, নীতিমালা পরিবর্তন, সহযোগী সংগঠন গঠন, কমিউনিটি প্রধান নির্ধারনী নীতিমালা, আয়-ব্যায, মুনাফা নির্ধারন, বিস্তৃতি ও পরিসেবা মূলক কার্যক্রম সবই কমিউনিটির সাধারন সিদ্ধান্তের উপড়ে নির্ভরশীল।
দেখে এলাম মুরগীর ফার্ম, পাঁচটি ইউনিট। প্রতি ইউনিটে দুটি ভাগ এবং এক একটিতে ৪০০ করে মুরগী। মুরগী ও মোরগের সাধারন সংমিশ্রন! মুরগী-মোরগের অনুপাত ১২ বনাম ১। প্রতিটি ইউনিটের মুরগীর স্থায়ীত্ত্বকাল ২০ মাস। এখানে মুরগী লালনে কোন ধরনের ঔষধ, টিকা কিংবা ভিটামিন ব্যবহার হয় না। সম্পূর্ন প্রকৃতিক উপাযে এর লালন ব্যবস্থা। খোলা হাওয়ায়। এমনকি মুরগীদের গান শোনানোর ব্যবস্থা পর্যন্ত আছে! গায়কও তারাই! এদের খাবারও প্রস্তুত হয় নিজস্ব খামারে যেখানে ৭০ ভাগ উপাদান নিজস্ব এবং বাকী ৩০ ভাগ বাড়তি খাবার বাইরে থেকে এনে মিশিযে ফার্মেন্টেড করে পরিবেশন করা হয়। এ ৩০ ভাগের মধ্যে আছে মাছের হাড়, হাড়ের গুড়া, কিছু ভেষজ ও সব্জীগুড়ো। সাধারনতঃ লেয়ার ধরনের মুরগী-চাষই প্রধান। মাংস ও ডিম উৎপাদনই লক্ষ্য। উৎপাদন খরচ স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশী বলে দামও বেশী। কিন্তু উৎপাদন মানসম্পন্ন হওয়ায় বাজারে চাহিদা ব্যাপক। বর্তমানে চাল, ডাল, গম, ভুট্টা, বার্লি, নাশপাতি, আপেল, পিচ, টমেটো, আলু, পেয়াজ, রশুন, সহ নানান ধরনের শতাধিক খাদ্য-দ্রব্য তাদের উৎপাদন তালিকা ভূক্ত!
৫০টিরও বেশী দেশে তারা খাদ্য-দ্রব্য রপ্তানী করছে, নিজেরাই! একটি প্রশিক্ষন ইন্টিটিউট গড়া হয়েছে সেখানে, যেখানে বিদেশী ছাত্ররা স্বল্পকালীন প্রশিক্ষনে আসে। বিশেষ করে মধ্য এশিয়া এবং অফ্রিকার দেশ গুলো থেকে প্রশিক্ষনার্থীদের ভীড় বেশী। প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব বাড়ি এবং গাড়ি আছে একাধিক। বিগত বছর গুলোতে তারা নিজস্ব আয়ে নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন রাস্তা, কালভার্ট এবং সেচ পদ্ধতি। বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকারী সহযোগীতা পেযেছে, সরকার গ্যাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সিলিন্ডারের মাধ্যমে। এ দুটিই সরকারী সেবা পরিশোধিত বাণিজ্যিক বিলের মাধ্যমে তারা নিয়ে থাকেন। বাকী সব ধরনের উন্নয়ন মূলক কাজ নিজেদের অর্থায়নেই হয়েছে বলে তাদের দাবী! তবে আবাক হয়েছি শুনে যে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তারা সরকারের বিদ্যুৎ ও গ্যাস গ্রহন বন্ধ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তার যোগান দেবেন। সে লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছে এক ওয়ার্কশপ। যেখানে তারা নিজস্ব উদ্যোগে উইন্ডমিল ও সোলার বিদ্যুৎ প্যনেল নির্মানে ব্রতী হয়েছেন। প্রশিক্ষনও দিযে থাকেন এসব বিষয়ে আগ্রহীদের। এতে তাদের নিজস্ব জনবল যেমন বাড়ে তেমনি বাড়ে যোগ্যতাও।
সম্প্রতি তারা এক বাণিজ্যকেন্দ্র গড়েছেন, যেখানে কমিউনিটি বহির্ভূত গ্রামের অপরাপর জনগোষঠীর ভালো হাতের কাজ ও পারিবারিক উৎপাদন এ সমবায়ের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকেন। এতে করে স্থানীয়দের হয়েছে বাড়তি সুবিধা, বিশেষ করে বাজার প্রাপ্তির সুবিধা। তারা মনে করেন, এ উদ্যোগে অর্থনীতির সুষম বন্টন একটি বাড়তি উপযোগ, যা স্বয়ংক্রীয়ভাবে তারা পেয়েছেন। এ গ্রামের উৎপাদিত পণ্য এখন দূর-দূরান্তে এমনকি দেশের বাইরেও রপ্তানীর সুযোগ পাচ্ছে!
সব শেষে আর একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয উল্লেখ না করলেই নয়। তা হলো, কমিউনিটি সমবায় ব্যবসা। তারা উদ্যোগ নিয়েছেন নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে পূঁজি করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের সমবায় খামার গড়ে তোলার বিষয়ে বাণিজ্যিক ভাবে উদ্যোগী হবেন। সম্প্রতি এদের পাঁটি পরিবার অন্যত্র আরোও দুটি সমবায় খামার গড়ে তোলার জন্যে এ সমবায থেকে বিচ্চিন্ন হয়ে ভিন্ন একটি অঞ্চলে কাজ করছেন। তাদের লক্ষ্যও ভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে। যেমন মাছ কিংবা গবাদি পশু। চতুর্দিকে পাহাড় ঘেড়া উপত্যকায় এ যেনো এক স্বপ্ন পুরী! মনে পড়ে গেলো আমাদের বাউল সম্রাট লালন ফকিরের সেই গান, “বাড়ির পাশের আরশি নগর ……..” আশে পাশের চিরায়ত গ্রামীন আবাসের চিহ্ন থাকলেও এখন যেনো এটি একটি ছোট শহড়! চোখ জুড়ানো তো বটেই চিন্তার জগতে যে আলোড়ন তুলেছে সেটিই বা কম কোথায়? একান্ত সদিচ্ছা থাকলে যে এমন একটি প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব, না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন হতো।
নিজ চোখে দেখা এদেশের সাধারন কৃষককুলের এ ধরনের কার্যক্রম আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছে! যা সত্যিই প্রণিধান যোগ্য এবং একটি অভিজ্ঞতা। এরকম কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের মতো দেশের কৃষকেরাও ভাবতে পারেন, তবে সবার আগে বোধ হয় দরকার সৃজনশীল চিন্তাভাবনার সক্ষমতা অর্জন এবং সেরকম উপযোগী শিক্ষা।
জায়গাটা তো অসাধারণ । যেতে হবে দেখছি।
বেশ ক’দিন পর লিখলেন কেশব’দা। চমৎকার। অনেক আগে দেশে তো ভালোই সমবায় সমিতি বা ওই রকমের কাজ হাত। এখন খুব একটা শুনছি না। যা’ই হোক কয়েকজন মানুষ একসাথে হয়ে কিছু করতে পারলে তো খুবই ভালো কথা। দেশ এখন খুব’ই ঘটবসতি পূর্ন। তবু সমবায় করে একসাথে কিছু হলে তো খুবই ভালো। আরো লিখুন।
🙂 দারুন মজা পেলাম।
হ্যাঁ, কাজিদা। উত্তর দিতে দেরী হলো কারণ কাজে একটু বাইরে থাকতে হয়েছিলো। টেলিফোন ভরসা তখন আমার জন্যে! যাই হোক নিয়মিত বৈঠকে আসতে মন চাইলেও নিজের অসুস্থতা আর নানাবিধ ঝামেলায় হয়ে উঠে না প্রায়ই। আর মুরগীদের গান…! সে অভিনভ! এক একটা শেড এ ৪০০ কে মোরগ-মুরগী আছে! ১/১২ ভাগ মোরগ হলেও ওদেরও তো প্রেম বিরহ আছে, না কি বলেন ! তাই ত্বারস্বরে ওরা কখনো বিজয়ের গান গায় তো কখনো কাঁদেও! বিষন্নতায়ও নাকি ভোগে! সে জন্যে প্রতিটা শেডে লাগানো রয়েছে সাউন্ড সিস্টেম। ওদের বিজয়োল্লাস আর বিলাপের সাথে কিছুটা ডিজিটাল যান্ত্রিক বাদ্য মিশিয়ে ওদের শোনানোর ব্যবস্থা আছে! কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, এতে ওদের ভিন্নতর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বিষন্নতার মাত্রা কমে ও প্রেমে বিভোর হয়! তবে যান্ত্রিক বাদ্যের কোন নিয়ম নেই মনে হলো, সব ধরনের রিদমই ব্যবহার করে! আমাদের বিচিত্র পল্লী-প্রকৃতির মতো এতো ব্যপক নয়, এদের বিচিত্রতা কম। তাই আমাদের শ্যামা, কাওযালী, ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি, থেকে শুরু করে রবীন্দ্র, নজরুল, রজনীকান্ত মিরিযে হাজারো সুরের মুর্ছ্ছনায় বাংলা ভরপুর। ভেবেছিলাম একবার বলি কোন সুরে কি প্রতিক্রিয়া দেখলে হতো না….? আমাদের মুরগী শ্রেণীর চলচ্ছিত্রের গানের প্রতিক্রিয়া সম্ভবতঃ েক্ষেত্রে ব্যবসা সফল হতো!
হাহা হা আমি তা’হলে ঠিকই ভেবেছিলাম যে গায়ক গায়িকারা চাষী নন, তেনারা সব ওই মোরগ মুরগিই। হাও রোমান্টিক 🙂
ঝুঁটিওয়ালা দুষ্টু মোরগগুলোও মহা সুখেই আছে কি বলেন? আমি মোরগদের এই ১:১২ অনুপাতঃ শুনেছিলাম বটে কিন্তু ভাবিনি যে সত্যি সত্যিই এটা প্রাকৃতিক; হাহ, দুষ্টু দুষ্টু বেজায় দুষ্টু 🙂