লিখেছেন: ফাহিম আহমেদ

খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৮ অব্দে প্রাচীন গ্রিসে সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। এ ব্যবস্থার অভ্যন্তরে সর্বপ্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়। তবে গ্রিকদের এ নির্বাচন আধুনিক সময়ের মতো সার্বজনীন ছিল না। শুধুমাত্র ভূস্বামীরাই এ নির্বাচনে ভোট দিতে
পারত। গ্রিসের এ নির্বাচন ছিল নেতিবাচক এবং এর মধ্য দিয়ে ভূস্বামীরা একজন রাজনৈতিক নেতা অথবা প্রার্থীকে
নির্বাসনে পাঠাতো। এসময়ে ব্যালট হিসেবে ব্যবহৃত হতো মাটির ভাঙা পাত্রের অংশ যা গ্রিক ভাষায় Ostraka নামে
পরিচিত (এ থেকেই Ostracize বা একঘরে শব্দটির উদ্ভব)।

এতে ভূস্বামীরা তাদের সবচেয়ে ঘৃণিত প্রার্থীটিকে ১০ বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠানোর জন্য নির্বাচন করতেন। কোন প্রার্থী
৬০০০ বা তার অধিক ভোট পেলে তাকে নির্বাসিত করা হতো এবং একজনের প্রাপ্ত সর্বোচ্চ ভোট ৬০০০ এর কম হলে
অথবা দুইজন প্রার্থী সমান সংখ্যক ভোট পেলে সেক্ষেত্রে কাউকেই নির্বাসিত করা হতো না। শুধুমাত্র ভূস্বামীরাই ভোটাধিকার
পাওয়ার ফলে এ নির্বাচনগুলোতে ভোটারের সংখ্যা ছিল খুবই কম।

বৈদিক যুগে ভারতীয় সমাজে গোষ্ঠীর মধ্য থেকে “গণ” নামক সংগঠনের ভোটে রাজা নির্বাচিত হতেন। রাজা অধিকাংশ
ক্ষেত্রে ক্ষত্রিও (জাত প্রথায় যোদ্ধা) শ্রেণির এবং পূর্বের রাজার পুত্র হতেন। তবে এসকল নির্বাচনে “গণ” এর সিদ্ধান্তই ছিল
চূড়ান্ত। পাল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা গোপাল (শাসনকালঃ ৭৫০-৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ) মধ্যযুগে সামন্ত প্রধানদের দ্বারাই নির্বাচিত
হয়েছিলেন। ৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের চোলা সাম্রাজ্যের উঠিরামেরুরে (বর্তমানে তামিলনাড়ু) পাম গাছের পাতায় ভোটদানের
মাধ্যমে গ্রাম পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করা হতো। মাটির তৈরি একটি পাত্রে প্রার্থীদের নাম লেখা পামপাতাগুলো রাখা
হতো। কুডাভোলা নামক এ ব্যবস্থায় একজন বালককে গ্রাম পরিষদের যতজন সদস্য ততোটি পাতা তুলতে বলার মধ্য দিয়ে
প্রার্থী নির্বাচন করা হতো।

তের’শ শতকে ভেনিসিয়ান রাষ্ট্র (বর্তমান ফ্রান্সের ভেনিস) আরো সুগঠিত হয় এবং ৪০ জন সদস্যের একটি কাউন্সিল
গঠিত হয়। ভেনিসিয়ানরা “অনুমোদন ভোট” নামক একটি ব্যবস্থার প্রচলন করে যেখানে নির্বাচকেরা তাদের যতজন প্রার্থী
পছন্দ ততোজনকে একটি করে ভোট দিতে পারতেন। এভাবে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীই নির্বাচিত হতেন। মার্কিন ইতিহাস
হল অধিকারের ক্রম বিকাশের ইতিহাস। স্বাধীনতার পর নবীন মার্কিন দেশে ২১ বা তার চেয়ে বেশি বয়সের শ্বেতঙ্গ
পুরুষরাই কেবল ভোট দিতে পারত। মার্কিন গৃহযুদ্ধের পর সংবিধানের ১৩, ১৪ ও ১৫ তম সংশোধনীর মাধ্যমে দাসপ্রথার
বিলোপ, নাগরিক অধিকারের সম্প্রসারণ ও সার্বজনীন পুরুষ ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয়। আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য
এসময়ে আইনগতভাবে ভোটদানে কোন বাধা না থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ১৯৬০ সালের ভোটাধিকার আইনের
পূর্বে তাদের ভোট দেয়া সম্ভব হয়নি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিংশ শতাব্দীতে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের নূন্যতম বয়স ছিল ১৮ বছর। ১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ
চলাকালীন সময়ে মার্কিন নাগরিকরা উপলব্ধি করে যে একজন নাগরিক যে বয়সে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে সেই
বয়সটিই তার ভোট দেয়ার জন্য যোগ্য। ফলে সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ২১ থেকে কমিয়ে ভোট দেয়ার
বয়স ১৮ করা হয়।

১৮৯৩ সালে সর্বপ্রথম নারী ভোটাধিকার নিশ্চিত করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখায় নিউজিল্যান্ড। রাশিয়া ১৯১৭,
ইংল্যান্ড ও জার্মানি ১৯১৮, মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র ১৯২০ ও ফ্রান্স ১৯৪৪ সালে নারী ভোটাধিকার স্বীকৃতি দেয়। উল্লেখ্য,
সুইজারল্যান্ড ১৯৭০ ও কুয়েত ১৯৯০ সালে নারী ভোটাধিকার স্বীকৃতি দেয়।

বর্তমান সময়ে রোমান ক্যাথোলিক চার্চের প্রধান কেন্দ্র ভ্যাটিকান সিটিই হল একমাত্র দেশ যেখানে নারী ভোটাধিকার
নিষিদ্ধ। তবে ভ্যাটিকানে আসলে সকল পুরুষেরও ভোটাধিকার নেই। কেননা পোপ নির্বাচনের ক্ষেত্রেই এ ভোটাধিকার
প্রয়োগ করা যায় এবং শুধুমাত্র কার্ডিনালদেরই (চার্চের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা) এ অধিকার আছে। তবে, পুরুষরাই কেবল
কার্ডিনাল হতে পারে বিধায় পোপ নির্বাচনে নারীদের মতামত এক্ষেত্রে উপেক্ষিত রয়ে যায়।

আধুনিক যুগে নির্বাচন বলতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্বাচনকেই নির্দেশ করা হয়। কার্যত এটি ভুল নয়। কেননা, বর্তমান যুগে
নির্বাচনকে আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষসহ যে সকল বিশেষণে বিশেষায়িত করি তা কেবল গণতান্ত্রিক শাসনের মাধ্যমেই
নিশ্চিত করা সম্ভব। একারণে রাজতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্রে যেসকল নির্বাচন হয় তার চেয়ে গণতান্ত্রিক শাসনের
নির্বাচনই অধিক জনকল্যাণ, নাগরিক সন্তুষ্টি ও ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অধিক কার্যকর ভুমিকা পালনে
সক্ষম।