প্রতিস্পর্ধী (প্রথম পর্ব) এখানে

লিখেছেন: কৌশিক চন্দ

দৃপ্তর মৃত্যুর পর অন্তত ১৫টা দিন কেটে গেছে। কিন্তু পুলিশের তরফ থেকে মাধব কিছুই জানতে পারেনি। অথচ অফিসার নিজেই সেদিন বলেছিলেন, সন্দেহভাজন কাউকে পেলেই উনি জানাবেন। তার মানে আজ এই এতদিন পরেও কাউকেই পাওয়া গেল না? নাকি ওনারা শুধু কথার কথাই দিলেন? মাধব এ ক’দিনে বেশ কিছু কাজ করেছে। বিশেষ করে বাবার ঐ লেখাগুলো পড়েছে। বাবা যে গোলাপ পছন্দ করত না সেখানে শুধু সেই কথাই নেই, বরঞ্চ দীপঙ্করের মত আর অনেকের কথা সেখানে লেখা আছে যারা তারই মত ছিল গোলাপ বিরোধী। বাবা তাদের জন্য কাজ করতে চেয়েছিল। আসলে অপছন্দ করবার জন্য কাউকে যে খুন হতে হবে, এটা বাবা মেনে নিতে পারেনি। তাই সে তার নিজের এই অপছন্দটাও জোরদার করে প্রচার করতে চেয়েছিল। তার সে কাজ অসমাপ্তই রয়ে গেল। তাই মাধব ঠিক করেছে, পুলিশের কাছে গিয়ে আগে সে জানবে ইনভেস্টিগেশন কতদূর এগিয়েছে। যদি সম্যক উত্তর পায় তো ঠিক আছে, না হলে সে নিজেই বাবার কাজগুলো করবার দায়িত্ব নেবে।

মাধব যখন পুলিশের সাথে দেখা করতে গেল, বড়সাহেব তখন টিফিনে। তাই আধঘন্টা বাইরে অপেক্ষা করে তবে সে ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেল।

– স্যার, আমার বাবার কেসটা কতদূর এগোল জানতে পারি? মাধবের প্রথম সরল প্রশ্ন।
অফিসার সাহেব তখন সিগারেট ধরানোয় নিমগ্ন। চোখ তুলে মাধবকে দেখে ধোঁয়া ছেড়ে উত্তর দিলেন, ‘হবে হবে। তদন্ত চলছে। প্রয়োজনমত সব ঠিকই জানিয়ে দেওয়া হবে। আর এইভাবে হঠ করে অফিসারের ঘরে ঢুকে পড়বে না। এটা একটা অফিস, এখানে একটা নিয়ম আছে’।

মাধব সেসবে উত্তর না করে বলে, ‘কিন্তু আমি আমার বাবার খুনীদের পেতে চাই। যে করে হোক, যা করতে হয় আমি করব’।

অফিসার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, তুমি সিওর এটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়। খুন?

– হ্যাঁ স্যার, আমি সিওর। মাধবের স্বর কঠিন হয়ে আসে।

– তবে আর কি, নিজেই লেগে যাও সার্চে। সবই তো জেনে বুঝে গেছ দেখছি। মনে হচ্ছে, নিজেই সব করে নিতে পারবে। তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বলে অফিসার মাধবকে ভাল করে পড়ে নেন একবার। তারপর বলেন, ‘শোন, তোমার বয়স বেশি নয়, তাই বলছি। তুমি এসব ব্যাপারে আর নিজের নাক গলিও না। কেমন? তোমার বাবার কেসটা যখন আমাদের হাতে পড়েছে, তখন একটা কিছু হবেই। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা নিয়ম থাকে। এটা বাচ্চার আবদার নয় যে হুটহাট করে চাইবে আর অমনি খুনীরা নিজেরাই এসে ধরা দেবে। কিছু বুঝলে? আর পকেটে গোলাপ নেই কেন? অ্যাঁ?

শান্ত স্বরে মাধব বলে, ‘গোলাপ আমার ভাল লাগে না স্যার’।

কথাটা যে অফিসারের মনপসন্দ হল না তা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। তবে মুখে তিনি প্রথমেই কিছু বললেন না। কিন্তু কথা বলতে বলতেই তাঁর মেজাজ গেল চড়ে, ‘বেশ ঠিক আছে। যা ভাল লাগে কর। তবে আমাদের আর এসব ব্যাপারে জ্বালিও না। অনেক সহ্য করেছি। অন্য কেউ হলে এখনই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতাম। নেহাত তোমার বাবা মারা গেছে। আমাদের ভেবেছো কি তোমরা বলতে পারো? বয়স কত তোমার? এই বয়সে পুলিশকে তাগাদা দিতে এসেছো? সাহস তো কম নয়। বেরোও এখান থেকে। গেট আউট’। উত্তেজনার পারদ চড়তে চড়তে অফিসার একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাধব প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, অফিসার অত রেগে গেলেন কেন?
সে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল পুলিশ স্টেশন ছেড়ে। আর এ কথাও সে বুঝে গেল এখানে আর তার আসা হবে না। এদের কাছ থেকে কোন সাহায্যই সে পাবে না। সে তাই ঠিক করল নিজেই যা করার করবে। আইন যদি এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য না করে, তবে সে নিজেই আইনকে নিজের হাতে তুলে নেবে। বাবার শেষ না করতে পারা কাজগুলো শেষ করবার সংকল্প নিল সে। কিন্তু ভয়ঙ্কর সেসব কাজ। সেখানে প্রতি মূহুর্তে জীবনের ঝুঁকি। হয়ত বাবার মতই মৃত্যু তাকেও ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারেযে কোন দিন।

এরপর থেকে আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন দেখা গেল মাধবের মধ্যে। তার চোখদুটো আজকাল কেমন যেন চিতাবাঘের মত ঘোলাটে আর হিংস্র হয়ে উঠছে। নিজের নাম সে বলতে শুরু করেছে – স্বাধীন। বস্তুত এটাই তার প্রকৃত নাম। স্বাধীন কুমার সান্যাল। স্কুলে ভর্তি নেওয়ার সময়ে হেডস্যার এই নাম দেখে ভর্তি নিতে চাননি। সরাসরি না বললেও রাশভারী স্বরে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমি দুঃখিত, আমাদের স্কুলে ‘স্বাধীন’-এর কোন জায়গা নেই। সিট খুব কম’। শেষে মাধবের এক কাকা চরণদাস ওর এই নাম রেখে ওকে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। যদিও দৃপ্তর এতে আপত্তি ছিল বিস্তর।

মাধব এখন প্যামফ্লেট সাঁটে, চিরকুটে লিখে ছড়িয়ে দেয়, ‘গোলাপ চাই না’, ‘গোলাপ ভালবাসি না’ ইত্যাদি। অশ্বত্থের গুঁড়িতে, বটের ঝুড়িতে, পুকুরের শানবাঁধানো পাড়েতে, দেওয়ালের গায়েতে ছড়িয়ে পড়েছে অজস্র কাগজে লেখা ভয়ঙ্কর সব কথা। সমাজের শান্তিপ্রিয় ভদ্রজনেরা বেজায় চটেছে এতে। ‘কিছু লোকের পাগলামিতে আমাদের দেখছি বাঁশ হবে। জানটা আর থাকবে না’। মন্তব্য পাড়ার লোকেদের। তবু বন্ধ করা যায় না, উত্তরোত্তর বেড়েই চলে এই পাগলামি।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা। মাধব সেদিন বাড়িতেই ছিল। কোন চিন্তায় আটকে ছিল সে সেদিন। হঠাৎ কলিংয়ের ঘণ্টায় ভাবনার সুতোটা গেল ছিঁড়ে। দরজা খুলতেই দেখা গেল সিধুবাবুকে। সৌম্য, শান্ত চেহারা। পরনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী। আজ সিধুবাবুকে যেন কোন সাধুপুরুষ মনে হচ্ছে। সঙ্গে এসেছে শ্যামলকাকু।

‘আরে আসুন, আসুন। বসুন জেঠু’। ঘরেতে ডেকে চেয়ার টেনে সিধুবাবু আর শ্যামলকাকুকে বসতে দেয় মাধব। তার এই দূর্লভ আতিথেয়তা দেখে একটু বিশেষ বিস্মিত হলেন দৃপ্তর অন্যতম সম্মানীয় এই মানুষটি।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমিও বোসো। চেহারাটার কি হাল হয়েছে তোমার? বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে নাওয়া খাওয়াও ভুলেছ দেখছি’। একটু থেমে সিধুবাবু আবার বলেন, ‘আরে অত চিন্তার কি আছে? আমরা তো তোমার মাথার ওপরে আছিই। আর তাছাড়া পুলিশ অনুসন্ধান চালাচ্ছে’।

-পুলিশের ওপর আমার কোন আস্থা নেই জেঠু। মাঝখান থেকে কথাটা বলেই থেমে গেল মাধব। তার পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার ব্যাপারটা কৌশলে এড়িয়ে গেল, ‘আমি আমার বাবার কিছু কাজ করে চলেছি মাত্র। এতে আমার শরীর ভাঙলেও কিছু করার নেই। আমাকে এ করতেই হবে’। শেষ কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে কঠিন একটা সুর বেজে উঠল।

সিধুবাবু সেই ইঙ্গিতটা পড়তে পারলেন কিনা বোঝা গেল না। মাধবকে বললেন, ‘দেখো আমি তোমার বাবার মত। তোমায় একটা ভাল কথা বলি। কিছুদিনের জন্য বাইরে কোথাও ঘুরতে টুরতে যাও। তাহলে দেখবে মনটা অনেক হালকা হয়ে গেছে’।

শ্যামলকাকু জুড়ে দেয়, ‘উনি না হয় তোকে একটা থাকার ব্যবস্থাও করে দেবেন। কি রে যাবি বল?
মাধব অবাক হয়ে সিধুবাবুর দিকে তাকায়। ‘জেঠু, আপনি ভাবতে পারছেন? আমার বাবা খুন হয়েছে। আর আমি এখন ঘুরতে যাব? ফুর্তি করব?’

সিধুবাবু বলেন, ‘তোমার কি এটা খুন ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয় না? হতেও তো পারে এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট?’

– একথা আপনি বলছেন জেঠু? আপনি তো আমার বাবাকে ভালমতই চিনতেন। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না এটা খুন না হয়ে পারে না। বিজনুরে যারা গোলাপ ভালবাসে না, তাদের যে বেঁচে থাকারও অধিকার কেউ দেয় না।

– জানি না, ভাই। আমি তো শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বললাম। বাকী কাজ, আমার বিশ্বাস, পুলিশই করবে। তবে আমি বলব, তুমি এখন কিছুদিন বিশ্রাম নাও। এটাই তোমার পক্ষে ভাল হবে।

– পরামর্শ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি যেটা করছি, সেটা আমার কর্তব্য। আমার বাবার শেষ না করতে পারা কাজ আমি করছি। এতে ভুল কিছু নেই।

শ্যামলকাকু এবার বলে ওঠে, ‘নাঃ মাধব। তোকে দেখছি আর ঠিক করা গেল না। তোর ভাল জন্যই বলা হল। এবার ভেবে দেখ তুই কি করবি। সারাদিন প্যামফ্লেট সেঁটে বেড়ালেই যদি তোর বাবার খুনীরা ধরা পড়ে তো সাঁট। আমরা আর বারণ করব না’।

এবার সিধুবাবু নিজের উরুতে একটা হাল্কা চাঁটি মেরে উঠে দাঁড়ালেন, ‘নাঃ শ্যামল চলো এখন। আসি মাধব। ভাল থেকো। আর শরীরের ওপর যত্ন নিও’।

সিধুবাবু সেদিন বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে মাধব যেন আরো হতাশায় ডুবে গেল। সে একটা ভাল লোকের খোঁজে ছিল যে তাকে সুপথ দেখাবে। তাই বাবার শ্রদ্ধেয় হিসেবে সিধুবাবুকে সে একটা আশ্রয়স্থল ভেবেছিল। কিন্তু তার কাছ থেকেও সে কোন আশার কথা শুনতে পেল না, এর থেকে দুঃখের আর কি হতে পারে? মাধব দেখেছে, এই সিধুবাবুই তার মায়ের অসুস্থতার সময়ে তাদের কত সাহায্য করেছে। সিধুবাবুর এক ডাকে পাড়ার ছেলেরা এসে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া, হাসপাতালে ভাল ডাক্তারের খোঁজ দিয়ে দেওয়া – সব দেখেশুনে সিধুবাবুকে ওদের ভগবান বলে মনে হয়েছে। কিন্তু আজ তিনিই কেন তার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন? অঙ্কটা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না মাধবের।

বাবার আর বন্ধুরা শ্যামলকাকু, নিশুদা – এদের তো আরোই ভরসা করা যায় না। যতই মাধব এসব ভাবে, আরো একা মনে হয় নিজেকে। সে শুধু একা কি করবে? কিভাবে করবে? কিচ্ছু মাথায় আসে না তার। টেবিলে কনুই রেখে ভর দিয়ে হাতের তালুদুটো দিয়ে মাথাটাকে ধরে রাখে সে। পিছনে দরজা হাট খোলা। কোন খেয়াল নেই।

আর সেই খোলা দরজা দিয়েই ওরা এল। ওরা, মানে কতকগুলো লোক। মাধব তাদের চেনে না। কোনদিন দেখেওনি তাদের বিজনুরে। সবথেকে আশ্চর্যের কথা, ওদের কারুর কাছে গোলাপ দেখতে পেল না সে।

* * *

কয়েকদিন ধরে বিজনুরে দেখা যাচ্ছে এক আশ্চর্য্য কাণ্ড। গোলাপফুলগুলোকে কে বা কারা যেন ছিঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে। চারিদিক ভরে উঠছে ফুলের টুকরোয়। সবার মধ্যেই এতে বেশ একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কারণ গোলাপফুল ছিঁড়ে দেওয়ার মত সাহস এখানে এর আগে কখনও কেউ দেখায়নি। বিজনুরে গোলাপকে অপমান করবার স্পর্ধা কারুর হয়নি এর আগে। কারা আছে এর পেছনে? মাধব? ওর সাহস এত বেড়ে গেল? রাস্তা দিয়ে চলতে গেলেই পায়ে মাড়াতে হচ্ছে গোলাপের ছিন্ন অংশ। ছিঃ! এও বিজনুরের লোকেদের সহ্য করতে হল! পুকুরে কচুরীপানার মত ভেসে বেড়াচ্ছে গোলাপের লাল, নীল, হলুদ পাঁপড়ি। রাস্তার ধারগুলো সুশোভিত হয়ে উঠেছে ছেঁড়া গোলাপের বোঁটায়, ডালে, পাঁপড়িতে, পরাগে। এভাবে তো চলতে পারে না। কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। মত অনেকেরই।

সেদিন বিকেলের শেষবেলায় বিজনুরের রাস্তায় দেখা গেল থানার ওসিকে। সাথে দুজন কনস্টেবল নিয়ে সার্চে বেরিয়েছেন। রাস্তার ধারে গোলাপের টুকরো তারও নজর এড়ালো না। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টার, প্যামফ্লেটে লেখা শব্দগুলোও পড়লেন তিনি। তারপর বুক পকেট থেকে নোটবুক বার করে কিসব লিখে রাখলেন তিনি।

তাঁর পেছন থেকে একটা পরিচিত কন্ঠ ভেসে এল, ‘আর দেরী করাটা মনে হয় ঠিক হবে না’।
পিছন ফিরে তাকিয়ে সম্মতির ভঙ্গীতে ঘাড় নাড়ালেন ওসি।

* * *

আজ অনেকদিন পর লাইব্রেরীতে এসেছে মাধব। বইয়ের ঘরে এসে আবার তার পুরোনো মেজাজটা যেন ফিরে এসেছে। ভাল লাগছে আজ বইয়ের ছোঁয়া পেয়ে। তার সামনে আজ খোলা – বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ। বইয়ে নিজেকে নিমগ্ন রেখেই বেজে গেল রাত আটটা।

লাইব্রেরীর বিশাল হলঘরে ওপার থেকে লাইব্রেরীয়ানের গলা পাওয়া গেল, ‘লাইব্রেরী এখনই বন্ধ হবে’। মাধব এতক্ষণে লক্ষ্য করল লাইব্রেরীতে সে শুধু একা। বই জমা দিয়ে সে ধীর পায়ে লাইব্রেরী থেকে বেরোতেই হঠাৎ থমকে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে সিধুবাবু। তবে আগের মত আর শান্ত সৌম্য চেহারা নয়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে উদ্বেগ স্পষ্ট। আর সন্ধ্যেরাতের এই অন্ধকারে বেশ অস্পষ্টও দেখাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ এভাবে সিধুবাবুর সাথে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি মাধব। ‘আপনি এখানে, হঠাৎ এভাবে?’ কথাগুলো মাধব ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারল না।

– চমকে উঠলে বুঝি? আসলে আজকাল তো বাড়িতে তোমার দেখা মেলাই ভার। কাজে কম্মে থাকো। তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। সেই কারণেই এখানে আসা। চলো হাঁটতে হাঁটতে বলা যাবে’।

কথাগুলো মাধবের ঔৎসুক্য আরও বাড়িয়ে তুলল। সিধুবাবু নিজে থেকে যেচে এতদূর এসেছেন। তাও আবার এত রাতে। নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা। মাধব বলে, ‘বেশ তো বলুন’।

– দেখো তোমার বাবা মারা গেছেন বেশ কিছুদিন তো হল। এবার তার পারলৌকিক ক্রিয়াটা সারার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। চলো ঐ জোড়া বটতলার রাস্তাটা ধরি।

– কিন্তু ওদিক দিয়ে গেলে তো ঘুরপথ হবে।

– তা হোক, তোমার সাথে কথাগুলো আগে সারি। হাঁটাও হবে, কথা বলাও হবে। তা যেটা বলছিলাম …’

মাধব এর আগে যে তার বাবার শ্রাদ্ধের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেনি তা নয়। কিন্ত সে, তার বাবা, তার গোটা পরিবারই নাস্তিক। মাধব বাড়িতে না দেখেছে কোন বিগ্রহ, না দেখেছে মা-বাবাকে কোন আচার পালন করতে। কাজেই বাবার শ্রাদ্ধ না করে একটা স্মরণসভা করলেই তো হল। সিধুবাবুকে কথাগুলো সে নিজেও বলবে বলে ভেবেছিল। তবে এখন যা পরিস্থিতি তাতে মাধবের মাথা থেকে সব ঠাণ্ডা চিন্তাই গেছে উবে। না হলে বাবার একটা স্মরণসভা সে তো করতেই চেয়েছিল।

তবে সিধুবাবু যে এই ব্যাপারটা মন দিয়ে ভেবেছেন, ভেবে এতদূর তার জন্য এসেছেন। এতটা দায়িত্ববোধের পরিচয় পেয়ে তাঁর প্রতি মাধবের শ্রদ্ধা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

হাঁটতে হাঁটতে মেন রোড ছেড়ে তারা এসে পড়ল বটতলার রাস্তায়। ঢালাই রাস্তাটা যথেষ্ট সরু আর ভাঙাচোরা। দুধারে আগাছার ঝোপ আর নীচু জলা জঙ্গল। সিধবাবুর অবশ্য সেসবে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি অনর্গল বলে চলেছেন – কোন দিন কিভাবে অনুষ্ঠান করা যায়। কেমনভাবে সেসব ব্যবস্থা করতে হবে – সেসব নিয়ে। মাধব অপেক্ষা করছিল সিধুবাবুর কথা কখন শেষ হবে, আর সে তখন তার নিজের কথা পাড়তে পারবে।

ঠিক এমন সময় রাস্তায় থমকে দাঁড়াতে হল তাদের। সামনে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে তিন-চারজন ষণ্ডামার্কা লোক। প্রত্যেকের হাতে লাঠি, রড। একজনের হাতে দড়িও আছে। মাধব সভয়ে প্রশ্ন করে, ‘আপনারা কারা?’

– তোর যম। দড়ি হাতে লোকটা কর্কশ গলায় উত্তর দিল। তারপর একজন মাধবকে জাপ্টে ধরল আর সঙ্গে সঙ্গে দড়ি দিয়ে মাধবের হাত পা বাঁধা হল। তার মুখ বাঁধা হল ব্যাণ্ডেজ দিয়ে। মাধব ছটফট করতে থাকে ক্রমাগত।

সে প্রাণ পণে চেঁচাতে থাকে। যদিও মুখে ব্যাণ্ডেজের জন্য তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। সে সিধুবাবুর দিকে তাকায়। তিনি কি তাকে উদ্ধার করবেন না?

কিন্তু সিধুবাবু! তিনি যে আগের মতই শান্ত। ধীর পায়ে মাধবের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। ‘আমি দুঃখিত মাধব। তোমায় অনেকবার ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম। তোমার বাবাকেও দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমারা শোননি আমার সেসব কথা। আজ যা হবে, তার জন্য আমাকে যেন দোষ দিও না। তোমরাই আমাকে এসব করাতে বাধ্য করালে’।

মাধবের চোখদুটো তখন বিস্ফারিত – ভয়ে বিস্ময়ে সে উন্মাদপ্রায় হয়ে গেছে। আর প্রাণপণে ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

সিধুবাবুর অর্ডার এল, ‘কাজ সেরে চলে এসো’। বলে তিনি সেখান ছেড়ে দ্রুত চলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাধবের মাথায় বাড়ি মেরে তাকে অজ্ঞান করে দেওয়া হল। তারপর তার শরীরটাকে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে অন্যত্র নিয়ে চলল ওরা।

এর মিনিট পনেরো বাদে সিধুবাবুর কাছে একটা পরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল। সিধুবাবুর এই ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ওপার থেকে গলা ভেসে এল, ‘চিন্তা নেই বস, কাম পুরা হো গয়া’।

* * *

মাধবের খোঁজ রাখবার মত বিজনুরে তেমন কেউ ছিল না। তাই পরের দিন থেকে তাকে দেখতে না পাওয়া গেলেও বিশেষ একটা শোরগোল পড়েনি। অনেকেই ভেবেছিল, যাক আপদ বোধহয় এবার ঠান্ডা হল। যারা এ নিয়ে কিঞ্চিৎ মাথা ঘামাতে শুরু করল অন্যেরা তাদের থামিয়ে দিল এই বলে, ‘আরে ছাড়ো তো পাগলের কথা। ওদের আবার থাকা না থাকার কোন ঠিক আছে নাকি? দেখো গে নিজে থেকেই ও কোন পাগলা গারদে ঠাঁই গেড়েছে। হাঃ হাঃ হাঃ’। এই বলে সমস্বরে হাসির রোল উঠল।

কিন্তু সেদিন শ্যামল বাজারে বেরোতে গিয়ে রাস্তায় দুটো লোকের সাক্ষাৎ পেল। লোকগুলো পরিচিত নয়। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা ওদের কাছে কোন গোলাপ দেখতে পেল না সে। তবে কি এরা বিদেশী? ভুল করে এখানে এসে পড়েছে? প্রশ্নাতুর হয়ে তড়িঘড়ি সিধুবাবুর বাড়িতে ছোটে শ্যামল। কিন্তু সিধুবাবুর বাড়ি সেদিন লোকে লোকারণ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেল সিধুবাবু নাকি ভয়ানক অসুস্থ। আর ভেতরের খবরটা সে পেল অনেক পরে। কারা যেন কাল রাত্তিরে গোলাপ বাগানে অর্ধেক গোলাপ নিকেশ করে দিয়েছে। সমস্ত মাটিও গেছে নষ্ট হয়ে। এখন সেখানে চাষ করাই বেশ মুশকিল। কিন্তু কি করে এমন হল তা কেউ বলতে পারে না। কেউ বুঝতে পারে না রাতের ঐ অতন্দ্র পাহারা টপকে কারা কিভাবে ঐ গোলাপের চারা নষ্ট করবার সাহস পেল। আরও জানা গেল শুধু শ্যামল নয়, আরো অনেকেই রাস্তায় ঘাটে বাজারে এমন লোককে দেখেছে যাদের কাছে কোন গোলাপ নেই। মাধবের মৃত্যুর পর থেকে এই উপদ্রবগুলো যেন আরো বেড়েছে।

এই সমস্ত শুনেই সিধুবাবু আপাতত গুরুতর অসুস্থ। ভীষণ অসুস্থ। শ্যামল ভাবে, তাহলে তারা যেটা ভেবেছিল সেটা ভুল! মাধব একা নয়? তার মত এমন আরও অনেকে আছে বিজনুরে যারা গোলাপবিরোধী? কিন্তু কিভাবে তাদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব? তারা সংখ্যায় কত? কিভাবে কাজ চালাচ্ছে তারা? ভাবতে ভাবতে শ্যামলের গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে। অসুস্থ বোধ করতে থাকে সে। তবু চিন্তা যায় না। এই কথাগুলোই যখন ওপর মহলের কাছে গিয়ে পৌছবে তখন কি হবে? কি জবাব আসবে সেখান থেকে? ধীরে ধীরে চিন্তারও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে শ্যামল। গোটা পৃথিবীটা যেন দুলে ওঠে তার সামনে। ধপ্ করে বসে পড়ে সে কাঁচা মাটির ওপর।

(সমাপ্ত)