শুরু করতে চাই একটি ইংরেজি শব্দের ব্যাখ্যা দিয়ে। শব্দটি হল- ‘LUDDITE’ । মূলত যারা নতুন টেকনোলজিকে ভয় পায় তাদেরকে বোঝানোর জন্যে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তবে এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। ১৮১১-১৬ সালের দিকে ইংল্যান্ডে একদল পোশাকশ্রমিক বেকারত্বের সম্ভাবনায় নতুন যন্ত্র ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল। মূলত অটোমেটেড মেশিন দিয়ে নির্মিত একটা কারখানায় দক্ষ শ্রমিকের কর্মশূন্যতার ভয়েই Ned Luud নামে এক তরুণ শ্রমিক এই বিপ্লব শুরু করে। কিন্তু এটা যে ফলপ্রসূ হয়নি, তার প্রমাণ বর্তমান বিশ্ব। তাই আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লব পৃথিবীর জন্যে কতটা কল্যাণকর কিংবা অকল্যাণকর, তা নিয়ে শান্তিময় বিতর্ক আর জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন চলাকালেই শিল্পোন্নয়ন পৌঁছে গেছে চরম শিখরে, আর তার সমাপ্তিবিন্দু থেকেই শুরু হয়েছে আরেক নতুন অধ্যায়, যাকে আমরা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব’ বলছি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের ফলে ভবিষৎ পৃথিবীতে অর্থনৈতিক ভারসাম্য কতটা পরিবর্তিত হবে, সেটা নিয়ে আমাদের উদ্বেগকে প্রশমিত করার জন্যে গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া অর্থনীতিক বিভিন্ন দিক আলোকপাত করাই এই আর্টিকেলের মূল উদ্দেশ্য। তবে সেটা প্রকাশের জন্য অ্যানিকডৌটাল (anecdotal) আলোচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না। বরং পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তই আমাদেরকে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গোটা বিশ্বজুড়ে চাকরিচুত্যির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বলা যায়, ইউরোপে ২০১২ সালের পূর্বে ১৯৪৫ সালই ছিল সবচেয়ে বেশি পরিমাণ চাকরি হারানো মানুষের সংখ্যা। যদিও পরবর্তীকালে বিশ্ব তার অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৫৩ সাল থেকে ইউরোপে প্রোডাক্টিভিটি এবং ইমপ্লোয়মেন্ট সমান্তরাল হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতিক উন্নয়ন নির্দেশক হিসেবে GDP ( একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের ভিতরে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মোট বাজারমূল্য ), labour productivity ( এক ঘন্টা শ্রমে উৎপাদিত পণ্য বা সেবা ), ইনকাম এবং ইমপ্লয়মেন্টের দিক থেকে বিবেচনা করলে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইউরোপের অর্থনীতিক ব্যবস্থা ছিল সবচেয়ে অনুকূলে। যাকে অর্থনীতিবিদরা Great Coupling বলে থাকেন।
US productivity (blue), GDP (grey), employment (red) and income (green) from 1953 to 2011. Figure reproduced from a chart on Andrew Mc Afee’s blog.
উপরের গ্রাফটিতে লক্ষ্য করলে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। ১৯৫৩ সালে পূর্বলিখিত চার সূচকের অবস্থান একটি বিন্দুকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ এখানে সহবস্থানের পরিমাণ সর্বোচ্চ। কিন্তু এর পরবর্তীকালেই ক্রমান্বয়য়ে চারটি নির্দেশকের আপেক্ষিক অবস্থানের পরিবর্তন হতে শুরু করে। এবং ১৯৮০ সালের পরবর্তি সময়ে তার মাত্রা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। যাকে Great Decoupling পয়েন্ট বলা হয়ে থাকে। খেয়াল করলে দেখা যায়, এখানে প্রোডাক্টিভিটি এবং জিডিপির পরিমাণ উর্ধ্বগতির ( পজিটিভ ) কিন্তু এমপ্লয়মেন্ট এবং ইনকাম নিম্নগতির ( নেগেটিভ )। শ্রমিকের মজুরি হ্রাস এবং উৎপাদন বৃদ্ধির এই গরমিলটির পেছনে তাহলে কী কারণ থাকতে পারে ?
বর্তমান সময়ে যারা নতুন টেকনোলজির বিপক্ষে অবস্থান নেয়, সেসব Neo-Luddite মানুষজন টেকনোলজিকেই এর জন্যে দোষারোপ করবে। শিল্প বিপ্লবের পরের দু’শো বছরে পৃথিবী প্রযুক্তিগতভাবে যতটা এগিয়েছে, তার চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেছে গত কয়েক দশকে। ফলে, দোষটা যৌক্তিক কি-না তা বিবেচনার অগ্রাধিকারে সবার প্রথমে থাকবে। একসময় কোনো দ্রবের উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করত মানুষ। যন্ত্রপ্রকৌশলের অবদানে তা মানুষ এবং যন্ত্রের মিশ্র নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত হয়। কিন্তু একুশ শতকের সূচনাকালে যন্ত্রের অভাবনীয় স্বয়ংক্রিয়তা মানুষকে শ্রম প্রদানের হাত থেকে মুক্তি দিতে শুরু করেছে। যেহেতু যন্ত্রগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট হচ্ছে, তাই অদক্ষ এসব শ্রমিকের কাজের ক্ষেত্র হ্রাস পাচ্ছে। যদিও এই সরলীকরণের পেছনে ত্রুটি আছে বলে মনে করেন নতুন প্রজন্মের অর্থনীতিবিদরা। প্রযুক্তির ফলে যদি কারখানায় চাকরি চলে যায়, তাহলে মানুষ অবশ্যই অন্য পথ খুঁজবে উপার্জনের। হার্ভার্ডের অধ্যাপক Kenneth Rogoff এ নিয়ে একটা কৌতুহলপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তার মতে, পূর্বের তুলনায় বর্তমান সময়ে প্রফেশনালি ‘দাবা’ খেলোয়াড়ের পরিমাণ অনেক বেশি। ইউরোপের শহরগুলোতে একজন ভালো দাবা প্রশিক্ষকের উপার্জন ঘণ্টায় ১০০-১৫০ ডলার। আর এই দাবা খেলার প্রচলন কিন্তু আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে শুধুমাত্র কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনে ‘চেস অ্যাপ’ তৈরির মাধ্যমে। তাহলে, এক্ষেত্রে আমরা কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি- আসলেই প্রযুক্তি কতটা দায়ী চাকরি হারানোর ক্ষেত্রে ?
তাত্ত্বিক কম্পিউটার প্রকৌশল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক, অ্যালান টুরিং ১৯৫০ সালে তার COMPUTING MACHINERY AND INTELLIGENCE প্রবন্ধে বলেছিলেন, “ “I believe that at the end of the century the use of words and general educated opinion will have altered so much that one will be able to speak of machines thinking without expecting to be contradicted” । আজ ২০১৬ সালের শেষে এসে আমরা অনুধাবণ করছি ট্যুরিং কতটা সঠিক অনুমাণ করেছিলেন। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক শেষেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় সাফল্য আমাদের সামনে আসে। ১৯৯৭ সালে আইবিএম এর কম্পিউটার Deep Blue বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু Garry Kasparov কে হারিয়ে দেয়। ২০০৫ এবং ২০০৭ সালে, পৃথিবীর অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ রোবট রেস কম্পিটিশন ‘DARPA Grand Challenge’ এ স্বচালিত গাড়িগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শহরের রাস্তা এবং অসমতল বালিযুক্ত স্থানে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন কুইজ কম্পিটিশনেও এ ধরণের কম্পিউটার চালিত যন্ত্রগুলো এগিয়ে থাকছে। ২০১১ সালে আইবিএম এর একটি কম্পিউটার ‘Watson’, আমেরিকার বিখ্যাত টিভি গেম শো ‘Jeopard !’ তে অভাবনীয় সাফল্য দেখায়। এছাড়া ঠিক গতবছরের মার্চেই বিশ্বের অন্যতম কঠিন বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা Go এর একটা চ্যাম্পিয়নশিপে AlphaGo নামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একটা কম্পিউটার হারিয়ে দেয় এই খেলায় সর্বোচ্চ পয়েন্ট অর্জনকারী খেলোয়ার Lee Sedol কে। এরকম বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি, যান্ত্রিক দিক থেকেও রোবটের উন্নতি খুব দ্রুত গতিতে বাড়ছে। নিচের ভিডিওতে দেখা যায়-
BigDog নামে একটা মিলিটারি রোবট খুবই দক্ষতার সাথে প্রতিকূলে পথ অতিক্রম করছে। এমনকি তার ভারসাম্যের উপর বাইরে থেকে কোন জোরপূর্বক বল প্রয়োগ করা হলেও এটি সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সুতরাং এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, এ শতকে এসে রোবটের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর শারীরিক দক্ষতা- এ দুটোই সমান ভাবে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যদিও পুরোপুরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহপোষণ করে থাকে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে, মানুষ নিজেও একটা উচ্চজ্ঞানসম্পন্ন জৈবিকযন্ত্র ছাড়া আর কী ? তাই এ সময়ে দাঁড়িয়ে এই প্রকৃত বাস্তবতা মেনে নেওয়া জরুরি যে, ভবিষ্যতে মানুষের মতই জৈবযন্ত্রের যুগ আসবে। তবে সেখানে মানুষের কর্তৃত কতটুকু থাকবে, সেটা নিয়ে স্টিফেন হকিং, বিল গেটসের মত মানুষেরাও চিন্তিত !
যাহোক। আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল চাকরির ক্ষেত্র। শারীরিক আর বুদ্ধিগত এই নির্ভুল দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এখন রোবটেরা মানুষের মত কারখানায় বা উৎপাদন শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। খাদ্য প্রতুতকারক শিল্পে, যেমন- মুরগির মাংস প্রস্তুতকরণ, বিভিন্ন পানীয় রেস্টুরেন্টে রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিচে দুইটা ভিডিওতে লক্ষ্য করা যায়-
শুধুমাত্র রোবটের যান্ত্রিক পারদর্শিতাই বিস্ময়কর নয়, এর পাশাপাশি মানুষ মোবাইলের অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমেও তাদেরকে নির্দেশনা দিতে পারছে। এছাড়া চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র এখন ডিজিটালাইড হচ্ছে। ওষুধের দোকানকর্মীর কাজটাও আজ রোবটের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে।
ইন্টারনেটে সার্চ করলে এরকম অসংখ্য রোবটের বিচিত্র কর্মযজ্ঞ চোখে পড়বে। যারা মানুষের কাজের জায়গাতে নিজেদেরকে প্রতিস্থাপিত করছে। এতে মানুষের কাজের জায়গা কতটুকু সংকুচিত হচ্ছে, সেটাই আমরা দেখব এখন।
উপরের চার্টটিতে দেখা যায়, ইউরোপে ১৯৫০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে উৎপাদন ( নীল দাগ ) সবসময়ই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ১৯৮০ সালের দিক থেকে ইমপ্লয়মেন্টের (লাল দাগ) পতন হচ্ছে। অনেকে বলে থাকে, মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে উন্নত দেশগুলো থেকে কাজ- স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। কারণ, সেখানে কম মজুরিতে একই কাজ করানো সম্ভব হয়। এতে ব্যবসায়ীর মুনাফা অধিক বাড়ে। কিন্তু প্রযুক্তিতে উন্নত এরকম অন্য দেশগুলোতেও একই ধরণের অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। যেমনঃ ১৯৯০ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে চায়নাতে ইমপ্লয়মেন্টের হ্রাস এবং উৎপাদনের বৃদ্ধি লক্ষ করা যায়।
এবার কিছুটা সংগত, কিন্তু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে আলোচিত ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আমেরিকার নির্বাচন। মুক্তমনায় এ নিয়ে বন্যা আহমেদ ‘দু পর্বের একটা লেখা লিখেছিলেন। তার প্রথম পর্ব ‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও ‘ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা’’ থেকে উদ্ধৃত করছি,
“অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার আজকের মোট সম্পদের ৭৬ শতাংশের অধিকারী হচ্ছে সবচেয়ে ধনী, অর্থাৎ প্রথম সারির ১০% জনগোষ্ঠী। এর পরের ৪০ শতাংশের হাতে আছে ২৩ ভাগ সম্পদ। তাহলে নিচের ৫০ শতাংশের হাতে কী থাকল? পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্পদশালী এই রাষ্ট্রের নিচের ৫০% মানুষ তথা গরিবরা মাত্র ১% সম্পদের অধিকারী।
ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে দেখা যাক। শীর্ষ ১০ শতাংশের গড় সম্পদ অন্তত পক্ষে ৪ মিলিয়ন ডলার, পরের ৪০ শতাংশের তিন লাখ ১৬ হাজার ডলার আর নিচের ৫০ শতাংশের গড় সম্পদের পরিমাণ ৩৬ হাজার ডলার। কিন্তু আপনি যদি একেবারে নিচের ২৫% মানুষের সম্পদের হিসেব নেন তাহলে দেখা যাবে যে তাদের হাতে কোনো জমানো সম্পদ নেই, বরং গড়পড়তাভাবে তাদের কাঁধে তেরো হাজার ডলারের ঋণ।
ডেমোক্রেটিক দলের অন্যতম পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডারস– যাঁর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক বেশ কিছু নীতি কমবয়সী ‘উদার’ আমারেকিনদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, কিন্তু ডেমোক্রেটিক দলের প্রাইমারি ইলেকশানে হিলারি ক্লিনটনের কাছে হেরেছেন। কিছুদিন আগে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন–
“এখন আমেরিকার প্রথম ০.১ শতাংশের হাতে মোট ৯০ শতাংশ জনসমষ্টির সমান সম্পদ সঞ্চিত হয়েছে।”
বার্নির এই তথ্যকে আমরা আরেকটু ভালভাবে অনুধাবন করতে পারি এই গ্রাফ দুটির দিকে তাকালে।
হয়ত অনেকেই এক্ষেত্রে শ্রেণী সংঘাতকেই দোষারোপ করবে। যে, ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, তাতে আমাদের আপত্তি কোথায় ? কিন্তু সত্যিকার অর্থে বর্তামান সময়ে বিশ্বজুড়ে এই অর্থনৈতিক অসাম্যই কি সবচেয়ে বড় সমস্যা নয় ? আমেরিকার নির্বাচন ফলাফলের অসামঞ্জস্যতার একটা বড় কারণ এই অর্থনৈতিক অসাম্য। তাহলে, অর্থনীতিতে এই অপ্রত্যশিত-অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ফাংশনের কোন প্যারামিটার দ্বারা চালিত হচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি। এবং মোটামুটি সন্দেহের উর্ধ্বে গিয়েই বলা যায়, এর পেছনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
যান্ত্রিক সভ্যতার দ্রুতগতির উন্নয়নের ফলে মানুষের কর্মক্ষেত্র যে সবসময়ই হ্রাস পেয়েছে, ব্যাপারটা এমন নয়। শিল্প বিপ্লবের সময় বড় বড় কলকারখানাগুলোতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। ঐ বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ে যারা কৃষিকে প্রধান কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছিল, বিপ্লবের পরে তারাই অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে শহরে। সুতরাং আগামীতে আমাদের জন্যে যে সভ্যতা অপেক্ষা করছে, সেখানেও হয়ত কাজের অভাব হবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে যে, আমাদের সামনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটা বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। মানুষ এবং অন্যান্য জীবপ্রজাতির শারীরিক দক্ষতা পর্যাপ্ত পরিমানে উন্নত হলেও বৃহৎ দৃষ্টিতে দেখতে গেলে এগুলো নিঁখুত নয়। অন্যদিকে মেশিনেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যদিও সেটি নির্ভুলভাবে ও অনেক দ্রুত হিসাব নিকাশ করতে পারে, কিন্তু মানুষের মত স্বপ্রণোদিত চিন্তা করার ক্ষমতা কিন্তু এখনো যন্ত্রের মধ্যে সেভাবে বিকশিত হয় নি। ফলে, মেশিন শুধুমাত্র সেসব কর্মক্ষেত্রগুলোই দখল করতে পারছে, যেখানে উচ্চমানের শারীরিক দক্ষতারই বেশি প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রয়োজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারও। অন্যদিকে মানুষের জন্যেও রয়েছে বিপরীত সত্য কথা। এই শতাব্দীর শূন্য দশক থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন অনলাইন কেনাবেচার ওয়েবসাইটগুলো পরিচালনা করার জন্যে বিপুল পরিমাণ জনশক্তির প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়তই অ্যামাজন, ফেসবুক, গুগলের মত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিচের গ্রাফটিতে লক্ষ্য করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে-
আলোচনার এই ধাপে এসে আমরা একটা তুলনামূলক দৃশ্যপট উপস্থাপন করতে পারি। গত শতাব্দীতে খেয়াল করলে দেখা যায়, মানুষের চলাচলের জন্য ব্যবহৃত ঘোড়া এর পরিমাণ একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে কমতে শুরু করেছে। কারণ একটাই, মোটরগাড়ির উদ্ভাবন। তাহলে শ্রমিক হিসেবে পূর্বে ঘোড়ার যেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা এবং চাহিদা ছিল, বর্তমানে সেটা দখল করে ফেলেছে ইঞ্জিনচালিত গাড়ি।
উপরের গ্রাফ দুইটা ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, USA তে ঘোড়া জনসংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল ১৯২০ সালে। তারপর থেকে খুব দ্রুতহারে ঘোড়ার সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে পরের গ্রাফটিতে দেখা যায়, ১৯১০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে হঠাৎ করেই মোটরগাড়ির পরিমাণ অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং পরবর্তী সময়গুলোতে খুবই দ্রুতগতিতে মোটরগাড়ির বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাহলে, এই সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের বেগ পেতে হয় না যে, একসময় ঘোড়া মানুষের জন্য চলাচলের জন্যে অতীব প্রয়োজনীয় মাধ্যম হলেও বর্তমানে সেটি শুধুমাত্র পোষা প্রাণী হিসেবেই শোভা পাচ্ছে।
উপরে আলোচিত এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত নিশ্চয়ই আমাদেরকে হতাশ করে তুলতে পারে। কিন্তু হতাশার গভীরেও আমাদের বিস্ময় অপেক্ষা করে। নতুন পৃথিবীকে জানবার, দেখবার। তাই, একটা প্রশ্নই আমাদের সামনে থেকে যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এই আসন্ন ভবিষৎ আমাদের জন্যে কী নির্দেশ করে ? এর সবচেয়ে সহজ উত্তর হতে পারে বিস্ময় ! হয়ত তখন আমাদের আর কোনো কাজ করতে হবে না। প্রচুর অবসর যাপনই হবে আমাদের জীবনের কর্মব্যস্ততা। ‘ এরকম কাজহীন পৃথিবীকে আসলেই স্বর্গরাজ্য ভাবা কতটা সুখকর ?’-এই দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন ব্যাপার। কর্মবিরতি মানুষের জন্যে আবশ্যক হলেও কর্মহীনতা কতটুকু স্বস্তিদায়ক ? পাঠক নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে এক্ষেত্রে। আমি শুধু ১৯০৪ সালে Theodor Herzl এর একটি নাটক ‘Solon in Lydia’, এর ঘটনা বলতে পারি। এই নাটকে Eukosmos নামে এক ব্যক্তি গম ছাড়াই ময়দা তৈরির একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করে। যা অনেক মানুষকে কর্মশূন্য করে তোলে। Eukosmos যখন বুঝতে পারে তার উদ্ভাবিত এই যন্ত্র সমাজের জন্যে বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু না, তখন সে বিষ পানীয় পান করে মারা যায়। কিন্তু এরকম একটা কর্মশূন্য ভবিষ্যতের আসন্নতাকে আটকানো কি আদৌ সম্ভব ? তাই সত্যিকার অর্থে এরকম একটা স্বর্গরাজ্যের জন্যে আমাদেরকে যদি প্রস্তুত হতে হয়, তাহলে অর্থনীতিতে সমন্বয় সাধন করার প্রয়োজনীয়তা সবার আগে ভাবা উচিত। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর ভর করে চলা শিল্প বিপ্লবের সাথে আমাদের সমাজকে খাপ খাইতে নিতে গত দুইটা শতাব্দী সময় দিতে হয়েছে। এবং বলা যায় এখনো এটি পুরোপুরি সাম্যাবস্থা লাভ করেনি। বরং সেখানে বিচ্যুতির পরিমাণই বেশি। অর্থনীতিক অসাম্যের পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নও আমাদের চিন্তা করবার কারণ। তাই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে নিয়ে চিন্তা করার সময় এখনই। Center for Policy on Emerging Technologies (C-PET) এর লিডার Nigel Cameron এর কথাটি দিয়ে শেষ করতে চাই-
“Will a world without work be heaven or hell ? Now is the time to think it through.”
]
এরূপ লেখা যতই পড়ি ততই শিহরিত হয়ে ওঠি, কখনো আতংকে কখনো প্রত্যাশায়।
দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যন্ত্র এসেছে প্রধানত তিনটি কারনে। ১) মানুষকে শ্রমসাধ্য ও একঘেয়ে কাজ থেকে মুক্তি দেবার জন্য ২) যে কাজ মানুষ করতে পারে না সেই কাজ যন্ত্র করবে ৩) বিপদজনক কাজ থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার জন্য।
অতঃপর মানুষের অবসর সময় বাড়বে । মানুষ সৃজনশীল কাজে নিয়জিত হবে, অবসর বিনোদন বাড়বে এবং এই ভাবে মানুষের জীবন আর সুন্দর হবে।
ছোটবেলায় প্রবন্ধ শিখতাম – বিজ্ঞান আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? বিজ্ঞান এক হাতিয়ার । তার পেছনে যে হাতটি থাকবে সেটিই ঠিক করবে বিজ্ঞান আশীর্বাদ হবে না অভিশাপ।
কিন্তু আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞানের যা কিছু আবিস্কার বেশিরভাগই ক্ষমতাবানরা নিজেদের বাক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করছে। তা না হলে একশ বছরেরও আগে আট ঘণ্টা কাজের অধিকার অর্জন হয়েছে কিন্তু যন্ত্রের অভাবনীয় উন্নতি সত্তেও কাজের ঘণ্টা কমে না কেন ? সপ্তাহে মাত্র এক দিন কাজের সময় ধার্য হলেই বেকারত্তের সমস্যা দূর হতে পারত। কিন্তু তা তো হচ্ছে না । ইউরোপ এর কয়েকটি উন্নত দেশে সামান্য কাজের ঘণ্টা কমলেও আমাদের মত দেশে শ্রমিকদের কাজের সময় আরও বেড়ে যাচ্ছে।
আবার মানুষের হাতে যদি অফুরন্ত অবসর আসেও তা হলে সে ওই সময় কি করবে সেটাও এক প্রস্ন বটে। সবাই সৃষ্টিশীল কাজে থাকবে তা তো নয় । কথায় বলে, অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা। তাই অনেক মানুষই অবসর সময়কে খারাপ কাজে লাগাবে বলেই মনে হয় ।