বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা! শুভেচ্ছা জানানোর সাথে আমি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সবাই জানি হয়তো- আবারো বলিঃ গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা এক বুক কষ্ট নিয়ে দেখি যে- মুক্তযুদ্ধের প্রতিটা মূল চেতনাই দূর পরাহত! ফলে, চেতনাজীবীরা যখন বিজয় দিবসের গর্ব, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব গাঁথা, সেই সময়ের ত্যাগ তীতিক্ষা নিয়া মাতম করে, তাদের মহান নেতার কৃতিত্ব জাহির করতে দিন রাত ভাষণ সম্প্রচার করে, তখন ভাবি- দেশ মানে কি আসলে তাদের কাছে? মুক্তিযুদ্ধ মানেই বা কি? যখন কেবল মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশ্বাসঘাতকদের নিয়া তারা চিল্লাফাল্লা করে, তখন ভাবি- ৪৫ বছর ধরে যারা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো- তারা কি এতটুকু কম যায়?
অনেকরেই অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা নিয়েও হা-পিত্যেশ করতে দেখি। ৭২ এর সংবিধানের ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খা জানান। কিন্তু তারা বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসটি শুরু করেন- ৭৫ পরবর্তী সময় থেকে। ফলে, এখনকার আমলে আওয়ামীলীগের বিশ্বাসঘাতকতাকে একটু প্রলেপ দেয়া যায়- বলা যায়, চাইলেই কি আওয়ামীলীগ পারবে? চাইলে কি পারে? আওয়ামীলীগ অপারগ! দেশটাই পচে গেছে … ইত্যাদি। এতে করে দেশটাকে পচায় ফেলার রাজনীতির যে দায়- সেইটা নিজেদের ঘাড় থেকে সরাতে পারে। ৭৫ থেকে শুরু করলেও- তারা মোশতাক দিয়ে শুরু করে না, শুরু করে জিয়া থেকে।
কিন্তু আমাদের এই পচনের শুরু, আমাদের পিছিয়ে যাওয়ার শুরু যে সেই ১৯৭১ সাল থেকেই … সেইটা কেমনে ভুলি? বিশ্বাসঘাতকতার শুরু ৭৫ এ না, সেই ৭১ এই … এই ইতিহাস কি জোর করে ভুলাতে পারবে চেতনাবাজরা? ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরে আলবদর- রাজাকাররা একদিকে যখন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছিল, অন্যদিকে বাঙালি আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধারা নিরস্ত্র আদিবাসীদের হত্যার উৎসবে মেতেছিল। বিজয়ী হওয়ার পরেও নিরস্ত্র বিহারিদের মারার কথা বললে তো অনেকেই তেড়ে এসে বলবেন- বিহারীরা মুক্তিযুদ্ধে কি কি করেছিল! ভারত ত্যাগে বাধ্য হওয়া হিন্দু- আদিবাসীদের বাড়ি ঘর- জায়গা জমি দখল সবচেয়ে বেশি করেছে আওয়ামীলীগাররা- এই তথ্যটি যখন জানি, জামাতিদের সাথে পার্থক্য করতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামাত – আলবদর- রাজাকাররা হিন্দু বাড়ি লুটপাট- দখল শুরু করেছিল, বিজয়ের প্রাক্কালে সেগুলো পুনর্দখল নিয়েছে আওয়ামীলীগ নেতারা। অসংখ্য জায়গা আছে, যেখানে জামাতী দখলও থেকে গিয়েছিল। সেই জামাতী দখলের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ নিশ্চুপ থেকেছে, জামাতের পক্ষে দাঁড়িয়েছে- কেবলমাত্র জামাতী দখলের বিরুদ্ধে দাড়ালে নিজের দখলে থাকা হিন্দুদের সহায় সম্পত্তি না ছেড়ে দিতে হয় এই ভয়ে … এই দখলদারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে লিগালাইজ করে দেয়- মুজিবের করা অর্পিত সম্পত্তি আইন।
কোন সন্দেহ নাই, মোশতাক- জিয়া- এরশাদ – খালেদা জিয়া জঘণ্য বিশ্বাসঘাতক। তারা মিলে (শেখ হাসিনাও কম যান না) দেশটাকে একদম পচনের শেষপ্রান্তে নিয়ে গেছে। কিন্তু, প্রথম রাষ্ট্রনায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে প্রথম বিশ্বাসঘাতক বললে কি ভুল হবে? কেননা, তার আমলেই- তার হাতে ধরেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবকটি মূল চেতনা ধ্বংস করা হয়, ভুলন্ঠিত হয়।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১- ২৪ বছরের বড় সময় জুড়ে আমাদের লড়াই করতে হয়েছে গণতন্ত্রের জন্যে, স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। এমনকি ৭০ এর নির্বাচনের ফলাফল মেনে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। ফলে- এই মুক্তিযুদ্ধ এবং পুরা পাকিস্তান পিরিয়ডেই গণতন্ত্রের আকাঙ্খা প্রধান ছিল, ফলে এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রধান চেতনা। অথচ, ৭২ এ শেখ মুজিব দ্রুতই গণতান্ত্রিক রীতি নীতি থেকে দূরে সরতে লাগলেন। ৭২ এর সংবিধান রচনার প্রকৃয়া, গণ পরিষদের হাতে ক্ষমতা না দেয়া, নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষীগত করা, দলের বিরুদ্ধে মত দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সংসদকে দলীয় আস্তানায় পরিণত করা- এভাবে শুরু। তারপরে সেই ৭২ এর সংবিধানকে চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে একদম গণতন্ত্রের পাকাপাকি কবর রচনা করলেন শেখ মুজিব নিজেই। ফলে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আইয়ুব- ইয়াহিয়া শেখ মুজিব নিজে- এমনটা বলার মধ্যে কি ভুল আছে কোন?
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। এই পাকিস্তান আমাদের দেশের লোক চেয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষে মুসলীম লীগকে আমাদের পূর্ববঙ্গের লোক ভোট দিয়েছিল। ফলে, ১৯৪৭ সালে আমাদের মাঝে ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ- ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধই প্রধান ছিল। ১৯৪৭ এই বা তার আগে- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে এক পাকিস্তান হওয়া নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলি নাই, আমরা দুই ভাগ এত দূরত্বে থাকলেও আমরা মুসলিম সত্ত্বার কারণে এক- আমরা পাকিস্তানী, এটার সাথে কেউ বিরোধ পাইনি শুরুতে। ফলে- সেই পাকিস্তানকে পরাস্ত করতে- ধর্মীয় জাতীয়তাবোধকে পরাস্ত করতে হয়েছে। সেটা পাকিস্তান হওয়ার কিছুকালের মধ্যেই শুরু করতে পেরেছি এবং পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে আমরা দেখিয়েছে- ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ বাস্তবে কোন জাতীয়তাই নয়- এবং শেষে ১৯৭১ সালে এসে এই ধর্মীয় জাতীয়তাবোধের মুখে কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছি। এই পুরা ব্যাপারটাই হয়েছে- ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধের (মুসলিম ব্রাদারহুড) কথিত আহবানকে ছিন্ন করেই। পাকিস্তানের যাবতীয় আক্রমনের ইডোলজিকাল ফ্রেমওয়ার্ক দেখলেই বুঝবেন- সেখানে ধর্ম কতখানি প্রবল। বাংলাদেশের গোড়া ধার্মিকরা- ধর্মবাদী দলগুলো সেকারণে সেই ইডোলজিকাল ডাকে সাড়া দিয়েছে, যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। আর- এর বিরুদ্ধে যারাই দাঁড়িয়েছে- তাদেরকে অতি আবশ্যকয়ীয়ভাবেই সেকুলার হতে হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জন্ম- ঘটনাটি ইটসেলফ সেক্যুলার ঘটনা। সে কারণে দেখবেন- পাকিস্তান চাওয়া মুসলীম লীগের সেই নেতারা আর মুসলিম লীগ করতে পারলেন না, তারা আওয়ামী মুসলিম লীগ করলেন। সেই আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে “মুসলিম” খসে পড়তেও আর সময় লাগলো না! আজকের যুগে- কোন কিছুর নামে একবার মুসলিম বা ইসলাম উঠে পড়লে সেটা সরানো অসম্ভব মনে করা হয়- অথচ, ঐ সময়ে “মুসলিম” খসে পড়ার মধ্য দিয়েই আওয়ামীলীগকে জনগণের কাছাকাছি আসতে হয়েছে। সুতরাং- পুরা পাকিস্তান পর্বের আন্দোলন- আমাদের মুক্তিযুদ্ধ- চেতনাগতভাবে ভীষণ সেক্যুলার। এটা কেবল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই নয়, সেক্যুলারিজমের উপরে ভিত্তি করেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইডোলজিকাল ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। অথচ, স্বাধীন বাংলাদেশে একদম শুরু থেকেই একে- এর মর্মমূল্যে আঘাত দেয়ার কাজটি শুরু হয়ে যায়। শেখ মুজিব শুরু করেন- সেক্যুলারিজমের তথাকথিত এক ব্যাখ্যা দেয়ার মাধ্যমে (যেটি এখনো শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগাররা বলে বেড়ান)। শেখ মুজিব জানান- ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বরং সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার। এটা হচ্ছে সেক্যুলারিজমের সবচেয়ে বোগাস সংজ্ঞা। হ্যাঁ, সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞানুযায়ী- রাষ্ট্র- প্রতিষ্ঠান ধর্মহীন। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়, রাষ্ট্রের নয়। মুসলমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সেক্যুলারিজমের মানে এমনটাই ছিল। পাকিস্তান পিরিয়ডে হিন্দুদের উপরে আক্রমণ ছিল- অন্য ধর্মের প্রতিও আক্রমণ ছিল; কিন্তু পাকিস্তান নামক আদর্শের সাথে ফাইটের মূল স্পিরিট এটা ছিল না- যে আমাদের দেশের অমুসলিমদেরও সমান অধিকার দিতে হবে। মূলত আমরা দাড়িয়েছিলাম- ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক আইডেনটিটির বিরুদ্ধে, এবং আমরা শ্লোগান তুলেছিলাম- আমরা বৌদ্ধ- হিন্দু-মুসলমান হতে পারি, কিন্তু তার আগে আমরা বাঙালি, আমরা মানুষ। রাষ্ট্রের কাছে এই ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধে উঠে স্বীকৃতি চাওয়া- এটাই হচ্ছে সেক্যুলারিজম, অথচ শেখ মুজিব শুরু করলেন- মুক্তিযুদ্ধের এক্সাক্ট এই চেতনাকে আঘাত করার মধ্য দিয়ে। তারপরে, তিনি যেটি সংজ্ঞা হিসেবে বললেন- সেটিকেও বাস্তবে আঘাত করার মধ্য দিয়ে ষোল কলা পূর্ণ করলেন। ওআইসি’তে বাংলাদেশ “ইসলামী” রাষ্ট্রের পরিচয় নিয়ে যোগদান করেছিল- সেটিই যে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ এর প্রাথমিক সোপান, অন্তত আকাঙ্খার দিক থেকে হলেও- সেটি কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? হিন্দুদের সম্পত্তি মেরে কেটে খাওয়ার লক্ষে করা অর্পিত সম্পত্তি আইন- যেটা পাকিস্তান আমলে ছিল শত্রু সম্পত্তি আইন- সেটিকেই বা কি বলবেন? ইসলামিক ফাউন্ডেশন করা, মাদ্রাসা ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া- এসবই তো উল্টো পথে তথা পাকিস্তানের পথে বাংলাদেশের যাত্রার শুরু বলা যায়। ৮০ এর দশক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সৌদি ওয়াহাবি ফান্ড, মাদ্রাসাগুলোতে ওয়াহাবি ফান্ড ও ওয়াহাবি ধ্যান ধারণা যারা দেখেন, তারা কি শেখ মুজিবের সৌদি আনুকূল্য পাওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেস্টাগুলো দেখবেন না? সৌদি শর্ত মানতে এমনকি পাকিস্তান ও ভুট্টোকেও বুকে জড়িয়ে ধরতে পিছ পা যে হননি- সেটিই কি ভুলা সম্ভব?
সবচেয়ে বড় আঘাত তো জাতীয়তাবাদের উপরেই। পাকিস্তান আমলে শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত বাঙালি জাতি যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করে দেশটিকে মুক্ত করে ফেললো (অপরাপর আদিবাসীরাও এই সংগ্রামে সামিল হয়েছিল), স্বাধীনতার পরপরেই আমাদের ঘাড়ে সেই পাকিস্তানের ভূতই এসে চাপলো! এর চাইতে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কি হতে পারে। যেভাবে পাকিস্তান আমাদের জাতিসত্ত্বার উপরে আঘাত করেছিলো, আমাদের ভাষা- আমাদের সংস্কৃতিকে অস্বীকার করতে চেয়েছিল- আমরা স্বাধীন হওয়ার পরে- একদম একই পন্থায় আমাদের আদিবাসীদের অস্বীকার করলাম! আমাদের প্রথম সংবিধানে বলা হলো- বাংলাদেশের নাগরিক বাঙালি! পাহাড়ী আদিবাসীরা আপত্তি করলে- শেখ মুজিব তাদেরও বাঙালি হয়ে যাওয়ার আহবান জানালেন! যে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাটি পাকিস্তানী হয়ে যাওয়ার আহবান উপেক্ষা করে- নিজের বাঙালি সত্ত্বার জন্যে প্রাণ দিলো- তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় নাই এর মধ্য দিয়ে? পাকিস্তান আমলে আমাদের জাতি সত্ত্বার উপরে আঘাতের মধ্য দিয়েই বাস্তবে আমরা আমদের চিনেছি, সেই আঘাত মোকাবেলা করতে করতেই আমাদের বাঙালি জাতিসত্ত্বার উন্মেষ ঘটেছে, ফলে পাকিস্তান আমল জুড়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান চেতনা জাতীয়তাবাদ। এটা ঠিক পাকিস্তান পিরিয়ডে এই চেতনার প্রধান ধারক বাঙালি জাতীয়তা- কেননা বাঙালি জাতিসত্ত্বাই ছিল পাকিস্তানের মূল আক্রমণের অভিমুখ। কিন্তু আমাদের এই চেতনাকে যখন “জাতীয়তাবাদ” এর বদলে “বাঙালি জাতীয়তাবাদ” বলা হয় বা লেখা হয়- তার মধ্য দিয়েই সেই পাকিস্তানি ভূত এসে ভর করে- কেননা তার মধ্য দিয়ে অপরাপর জাতিসত্ত্বাকে অস্বীকারের ঝোক বিদ্যমান। সেটাই পরবর্তীতে সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে এবং সবাইকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার আহবানের মধ্যে প্রকটিত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আরেক চেতনা হচ্ছে সমাজতন্ত্র। কারণ- পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের শোষণ- নির্যাতনের শিকার ছিলাম আমরা। আমাদের পাটের টাকায়, আমাদের কাচামালের উপর নির্ভর করে- পাকিস্তানি ধনীপতিরা অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়েছিল। পাকিস্তান আমলে ২২ পাকিস্তানী পরিবারের বিরুদ্ধে আমরা শ্লোগান দিয়েছিলাম। আমাদের সকল জনগণের জন্যে কাজ, খাবার, শিক্ষার দাবী আমরা তুলেছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছিল- বলেই আমরা এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। বাংলাদেশের মানুষের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রাম- মুক্তিযুদ্ধ করার অন্যতম প্রেরণাও তাই এই বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ। অথচ, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে- আমরা পেলাম একটা লুটপাটের অর্থনীতি। কলকারখানা- শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করার মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতাদের লুটপাটের মচ্ছবে মেতে উঠার সুযোগ দেয়া হলো! পাকিস্তান আমলে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধকালে যারা পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে- তাদের ও যুদ্ধকালে ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামীলীগকে নিয়ে প্রশাসন গড়া হলো। আর, অসংখ্য দেশপ্রেমী মুক্তিযোদ্ধা- যারা দেশের জন্যে জান বাজি রেখে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, যারা দেশের জন্যে কিছু করার জন্যে প্রস্তুত ছিল- তাদেরকে উপেক্ষা করা হলো। আওয়ামীলীগের – ছাত্রলীগের রেডিকেল অংশকে উপেক্ষা করে বিশ্বাসঘাতকদের সাথে হাত মিলালো শেখ মুজিব। মুক্তিযুদ্ধকালীন সবচেয়ে প্রধান সংগঠক তাজউদ্দিন তাই বেকার বসে থাকেন, আর মুক্তিযুদ্ধে সময়কালেই ষড়যন্তকারী খন্দকার মোশতাক- শেখ মনিরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান। রাষ্ট্রের এই ভয়ানক দুর্নীতি ও লুটপাটই হয়ে উঠলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাথমিক অর্থনীতির ভিত। এরকম ত্যাগ তীতিক্ষার মধ্য দিয়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণকে শায়েস্তা করার জন্য আর লুটপাটকারীদের জনরোষের হাত থেকে বাচানোর জন্যে করা হলো রক্ষীবাহিনী। সেই ফল হাতে নাতে পেল- স্বাধীন বাংলাদেশ বিজয়ের বছর দুয়েক পার হতে না হতেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে। আর- সেই ধারাবাহিকতায় আজ পর্যন্ত আমাদের অর্থনীতিতে কালো টাকার দৌরাত্ম্য।
যারা ঐ আমলের দুর্নীতিকে জায়েজ করতে রাষ্ট্রায়ত্ত্বকরণকে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেন- তারা সমাজতন্ত্র সম্পর্ক অল্পই ধারণা রাখেন। যে দুটো কাজ করার খুব দরকার ছিল- ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমিহীনদের মাঝে রাষ্ট্রীয় খাস জমি বিতরণ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটা শিশুর শিক্ষার ভার নেয়া; তার কোনটির ধারে কাছে যাননি শেখ মুজিবর রহমান। আজকের আওয়ামীলীগের পচে যাওয়া নেতা সুরঞ্জিত সেন ঐ সময়ে ন্যাপ থেকে আসা একমাত্র বিরোধীদলীয় সাংসদ ছিলেন (স্বতন্ত্র্য সাংসদের বাইরে)। তিনি সংবিধানের খসড়ার উপরে অনেকগুলো সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন (এম এন লারমাও দিয়েছিলেন)। একটিও শোনা হয়নি। শেষে তিনি বলেছিলেন- আর কিছু না, অন্তত এই স্বাধীন বাংলাদেশের উচিৎ তার সব জনগণের শিক্ষার ভার নেয়া। সংবিধানে এই বাধ্যবাধকতাটুকু রাখা হোক। না, শোনা হয়নি। পাকিস্তানীদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা – মুক্তিযুদ্ধ করা আমাদের জনগণ লক্ষ করলাম- স্বাধীন বাংলাদেশে আরেক ভয়াবহ বৈষম্যের স্বীকার। এই বৈষম্য- লুটপাটের, দুর্নীতির, চুরি চামারির মচ্ছবের!
বহুদিন পর লিখলেন। অনেক ধন্যবাদ সেজন্য। দেখলেন তো এমন পোষ্টে মন্তব্য করার মানুষেরও অভাব পড়েছে। আমাদের আবার নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। কি বেদনাদায়ক। এ চলা তবু থামবার নয়।
আগামী লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
ভালো থাকুন।