১৮৯৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জগদীশচন্দ্র ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বিদ্যুত-তরঙ্গ সম্পর্কে বক্তৃতা দিলেন। “Complete apparatus for studying the properties of electric waves” শীর্ষক বৈজ্ঞানিক বক্তৃতাটি বিপুল সমাদৃত হয়। দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্যার জে জে থমসন, লর্ড কেলভিন, স্যার অলিভার লজ প্রমুখ পদার্থবিজ্ঞানী। প্রথম বক্তৃতাতেই জগদীশচন্দ্র পৃথিবীবিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হলেন। বক্তৃতা শেষে লর্ড কেলভিন মঞ্চে উঠে জগদীশচন্দ্রকে অভিনন্দন জানান। শুধু তাই নয়, তিনি জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসুকে তাঁর গ্লাসগোর বাসভবনে নিমন্ত্রণ করেন। প্রফেসর অলিভার লজও বসু দম্পতির সম্মানে পার্টি দিলেন।

ইংল্যান্ডের প্রথিতযশা পদার্থবিজ্ঞানীরা জগদীশচন্দ্রের যন্ত্রপাতির সূক্ষ্মতা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। যন্ত্রপাতি তৈরিতে আশ্চর্য রকমের ইঞ্জিনিয়ারিং স্কিল ছিল জগদীশচন্দ্রের। তিনি বক্তৃতায় যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন তা নিম্নরূপ:

বক্তৃতায় ব্যবহৃত মাইক্রোওয়েভ যন্ত্র

বক্তৃতায় ব্যবহৃত মাইক্রোওয়েভ যন্ত্র

R: radiator; S: spectrometer-circle; M: plane mirror; C: cylindrical mirror; p: totally reflecting prism; P: semi-cylinders; K: crystal-holder; F: collecting funnel attached to the spiral receiver; t: tangent screw, by which the receiver is rotated; V: voltaic cell; r: circular rheostat; G: galvanometer.

জগদীশচন্দ্রের যন্ত্রটি ছিল মাইক্রোওয়েভের এতদিনকার যন্ত্রপাতিগুলোর তুলনায় খুবই ছোট। আকারে ছিল মাত্র ১৫ x ১২ x ৭ সেন্টিমিটার। যে কন্ডেন্সারের ভিতর বিদ্যুৎ জমা হয়ে দুটি ধাতব গোলকের মধ্যে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে, তিনি তার বেশ পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। দুটি পাতলা টিনের পাতকে মোম মাখানো কাগজের দুপিঠে লাগিয়ে তা ভাইব্রেটার বাদ দেয়া ইন্‌ডাকশন কয়েলের চারপাশে জড়িয়ে দিলেন। ফলে যন্ত্রটির আকার বেশ ছোট হয়ে যায়। বাঁদিকের বাক্সটির মধ্যে মাইক্রোওয়েভ সৃষ্টির ব্যবস্থা, যা থেকে চৌকামুখ রেডিয়েটিং-ফানেল বেরিয়েছে। এই ফানেলটি হলো পৃথিবীর প্রথম ওয়েভ-গাইড। ডানদিকে প্রিজম-টেবিল-সংযুক্ত হর্ন-অ্যান্টেনার মতো কানেক্টিং ফানেল ও তার সঙ্গে যুক্ত গ্যালভানোমিটার।

মাইক্রোওয়েভ যন্ত্র

মাইক্রোওয়েভ যন্ত্র

জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষার আরো আশ্চর্যজনক দিক ছিলো এর সাহায্যে তিনি সেই সময়ের সবচেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাইক্রোওয়েভ তৈরি করতে পেরেছিলেন। যা ছিল মাত্র ৫ মিলিমিটার দীর্ঘ। এই অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ-দৈর্ঘ্যের বিদ্যুৎ-তরঙ্গ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছিলেন জগদীশচন্দ্র।

তড়িৎ-তরঙ্গের গ্রাহক-যন্ত্র বা রিসিভার নিয়ে অনেকবছর ধরে অনেকেই গবেষণা করছিলেন। হার্টজের পর প্রফেসর অলিভার লজ-কেই গ্রাহক-যন্ত্র “কোহেরার”-এর গবেষণায় সবচেয়ে সফল বলে মনে করা হতো। কোহেরার নামটি অলিভার লজেরই দেয়া। কোহেরেন্স বা সংযোজন বোঝাতেই এই নামটা দিয়েছিলেন তিনি। নাম দিলেও যন্ত্রটার প্রথম উদ্ভাবক ছিলেন অধ্যাপক ভার্লে। ১৮৬৬ সালে তিনি দেখেন যে ধাতব-চূর্ণ কোন পাত্রে ভরে তার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ চালনা করলে তার ভেতরের রেজিস্ট্যান্স খুব বেড়ে যায়। কিন্তু তার ভেতর যদি বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গ চালনা করা হয়, তবে রেজিস্ট্যান্স হঠাৎ কমে যায়। ১৮৮৪ সালে অধ্যাপক ওনেস্টি, ১৮৯০ সালে প্যারিসের অধ্যাপক ব্রাঁলি এ সম্পর্কিত আরো অনেক পরীক্ষা করেন। ব্রাঁলি দেখেন যে ধাতব-চূর্ণের ভেতর দিয়ে তো বটেই কাছেও যদি কোন বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গ ঘটে তখনও রেজিস্ট্যান্স হঠাৎ কমে যায়। অলিভার লজ এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে যে বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গের কারণে পাত্রের ভেতরের ধাতু-চূর্ণগুলির কিছুটা গলে গিয়ে পরস্পর খুব কাছে চলে আসে তাই রেজিস্ট্যান্স কমে যায়। পাত্রটিকে তখন ঝাঁকিয়ে নিলে ধাতু-চূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। তখন রেজিস্ট্যান্স আবার বেড়ে যায়। এই কোহেরারের এটাই ছিল সমস্যা। কিছুক্ষণ পর পর রেজিস্ট্যান্স কমে যাবার পর এটাকে ঝাঁকিয়ে নিতে হয়।

জগদীশচন্দ্র কোহেরারের এই সমস্যাটা দূর করে একটা স্বয়ংক্রিয় কোহেরার উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিলেন। তিনি ধাতব-চূর্ণের বদলে ব্যবহার করলেন ছোট ছোট অনেকগুলো (প্রায় এক হাজার) লোহার স্প্রিং এবং সেগুলোকে এমনভাবে সাজালেন যেন খুব সামান্যভাবে লেগে থাকে একে অপরের গায়ে। এই কোহেরারের মধ্যেও একই রকমের ফল পাওয়া গেলো। তবে এটার সুবিধা হলো রেজিস্ট্যান্স কমে গেলে ঝাঁকুনি দিতে হয় না, স্প্রিং-এর চাপ বাইরে থেকে সামান্য একটু বাড়ালেই স্প্রিং-গুলো আবার সজ্জিত হয়ে যায় এবং রেজিস্ট্যান্স আবার বেড়ে যায়। পরে ধাতব স্প্রিং-এর বদলে সেমিকন্ডাক্টর ক্রিস্টাল – লেড সালফাইড বা গ্যালেনা ব্যাবহার করে বিস্ময়কর রেজাল্ট পেয়েছিলেন জগদীশবসু যা জন্ম দেয় তাঁর বিখ্যাত গ্যালেনা-ডিটেক্টরের।

জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতায় লর্ড কেলভিন এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি ভারত-সচিবকে জগদীশ প্রসঙ্গে একটা চিঠি লেখেন। চিঠিতে জগদীশচন্দ্রের জন্য একটা আধুনিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করে দেবার অনুরোধ করে লর্ড কেলভিন লেখেন, “আমি বিশ্বাস করি অধ্যাপক বসুর পরিচালনাধীনে প্রেসিডেন্সি কলেজে একটি আধুনিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হলে তা কলকাতায় বিজ্ঞানশিক্ষার সহায়ক হবে এবং ভারতবর্ষের খ্যাতি বৃদ্ধি পাবে।”

ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানে জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতার প্রশংসা বেরোয় লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় পরবর্তী কয়েক মাস ধরে। লন্ডন টাইম্‌স লেখে:

“এই বছরে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের সম্মেলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বিদ্যুৎ তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট, কেমব্রিজের এম এ, ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রিধারী এই বিজ্ঞানী বিদ্যুৎ-রশ্মির সমবর্তন (polarisation) সম্পর্কে যে মৌলিক গবেষণা করেছেন তার প্রতি ইওরোপের বিজ্ঞানকর্মীদের আগ্রহ সঞ্চারিত হয়েছে। রয়্যাল সোসাইটি বিদ্যুৎ-রশ্মির তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য ও প্রতিসরাঙ্ক সম্বন্ধে তাঁর গবেষণাপত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।”

ডেইলি ক্রোনিকল লিখলো:

“অদৃশ্য বিদ্যুৎ-তরঙ্গ নিয়ে অধ্যাপক বসু নানারকম পরীক্ষা দেখিয়েছেন – ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তার নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্যসমূহের একাধিক সার্থক প্রয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। দূরদূরান্তে সঙ্কেত বার্তা প্রেরণ তাদের অন্যতম। ঘন কুয়াশার মধ্যে জাহাজ থেকে জাহাজে বা বাতিঘর থেকে জাহাজে সঙ্কেত প্রেরণের সমস্যা যদি দূর হয় তবে মানবজাতির অশেষ কল্যাণ হবে।”

পিয়ার্সন্‌স ম্যাগাজিন জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ ছাপে। সেই প্রবন্ধে তাঁর প্রশংসা করে লেখা হয়:

“মানুষের জাতীয়তা নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে, তর্ক বিতর্ক হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেশ ও কালের উর্ধ্বে, তাঁরা বিশ্ব-নাগরিক। ভারতবর্ষকে এতদিন আমরা একটা রহস্যময় দেশ বলে ভেবে এসেছি। মনে করেছি ভারতীয়রা নিছক কল্পনাপ্রবণ – যুক্তি ও বাস্তবতাবোধ কী জিনিস তারা জানে না। কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছিলাম তাদের দূর অতীতের সমৃদ্ধ শিক্ষায়তনের কথা, ভুলে গিয়েছিলাম প্রাচীন ভারতের দার্শনিকদের প্রজ্ঞা ও বোধের কথা – গণিত ও জ্যোতিষশাস্ত্রে যাদের গবেষণা ও চিন্তাধারা আরব ও গ্রিকদের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছিল। বিদেশীদের আক্রমণ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে ভারতবর্ষে জ্ঞানের গতি ব্যাহত হয়েছে অনেক বছর ধরে। রাজনৈতিক শান্তি ও শৃঙ্খলা এবং আধুনিক শিক্ষার সুযোগে ভারতবাসীদের মানসিক উৎকর্ষের পুনর্জাগরণ দেখা যাচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একজন ভারতীয় অধ্যাপক প্রবল বাধা-বিপত্তির মধ্যেও গবেষণা করে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে প্রদত্ত বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বিষয়ে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা অনেক প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করেছে। তড়িৎ-বিজ্ঞানে কয়েকটি কঠিন বিষয়ের গবেষণায় তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে যে সাফল্য লাভ করেছেন সে কথা স্মরণ করে আমরা অধ্যাপক বসুর ধৈর্য ও অসাধারণ শক্তির প্রশংসা না করে পারছি না। তার চেয়েও বড় কথা এসব গবেষণা তিনি করেছেন তাঁর কর্মব্যস্ত অধ্যাপনার কাজের দুর্লভ অবসরে। একজন সামান্য মিস্ত্রীর সাহায্য নিয়ে তাঁকে অতি জটিল সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরি করে নিতে হয়েছে। ইংল্যান্ডের প্রতিটি বিজ্ঞানকর্মীর মতো তিনি যদি আধুনিক উপকরণসমৃদ্ধ গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ পেতেন, তাঁকে ঘিরে যদি বিজ্ঞান-সচেতন মানুষ ও উৎসাহী সহকর্মীর পরিবেশ গড়ে উঠতো, যেখানে তিনি নিজেকে একান্তভাবে নিঃসঙ্গ মনে না করতেন, তবে আজ আমরা তাঁর আরো অসীম সাফল্য দেখতে পেতাম।”

ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী সমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন জগদীশচন্দ্র বসু। বিজ্ঞানীরা ব্যক্তিগতভাবে জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসুকে নিমন্ত্রণ করছেন নিজেদের বাড়িতে এবং সেখানে আন্তরিক আলোচনা করছেন ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে। বিখ্যাত রসায়নবিদ প্রফেসর গ্ল্যাডস্টোনের বাড়িতে এক ভোজসভার বর্ণনা দিয়েছেন অবলা বসু তাঁর এক প্রবন্ধে:

“শুনিলাম একজন নিমন্ত্রিত ভদ্রলোক (যাহাকে ভারতসচিব বিশেষজ্ঞরূপে ভারতবর্ষে প্রেরণ করিয়াছিলেন) পার্শ্বস্থ বন্ধুকে বলিতেছেন – ‘এই চন্দ্র বসু লোকটি, যাহার কথা আজকাল লোকে এত বলিতেছে, সে কে হে? ভারতীয় লোক আবার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করিবে? অসম্ভব! তাহাদিগকে ছোটো টেস্ট টিউব দিয়া পরীক্ষা করাইয়া তাহার স্থানে বড় টেস্ট টিউব দিলে আর তাহারা সেই পরীক্ষা করিতে পারে না – ভারতবাসী নকলে মজবুত, কিন্তু বিচারবুদ্ধি খাটাইয়া হাতে কলমে ব্যবহার তো কখনো করিতে পারে না!’

পাশের লোকটি বিখ্যাত রাসায়নিক র্যা মজে। তিনি বলিলেন, ‘চুপ কর, তুমি কিছু জান না- ভারতবাসী বহু শতাব্দীর সাধনায় তাহাদের চিন্তাশক্তি এত প্রখর করিয়াছে যে, চিন্তাশীলতায় তাদের সমকক্ষ হইতে আমাদের বহুদিন লাগিবে। আমাদের সৌভাগ্য যে, ইহারা এ-পর্যন্ত নিজের হাতে পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করে নাই। যখন শিখিবে, তখন ব্রিটেনের আধিপত্য চলিয়া যাইবে। তবে এই ‘চন্দ্র বসু’ দৈবক্রমে এইরূপ সার্থকতা লাভ করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার সিদ্ধিতে আমাদের ভয়ের কারণ নাই।”

ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের বক্তৃতা এবং বিজ্ঞানীদের সাথে জগদীশচন্দ্রের যোগাযোগের পর রয়্যাল ইন্সটিটিউশানে শুক্রবারের সান্ধ্য বক্তৃতা-মালায় বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রিত হন। রয়্যাল ইন্সটিটিউটে আমন্ত্রণ পাওয়া সোজা কথা নয়। মহান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো নিয়ে রয়্যাল ইন্সটিটিউটে আলোচনা করা হতো। জগদীশচন্দ্র বসুর জন্য এই আমন্ত্রণ ছিল বিশেষ সম্মানের এবং তাঁর আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ। ভারতের শিক্ষাবিভাগ এই আমন্ত্রণের খবর পেয়ে বক্তৃতার প্রস্তুতি নেবার জন্য জগদীশচন্দ্রের ডেপুটেশানের মেয়াদ আরো তিন মাস বাড়িয়ে দিলো।

১৮৯৭ সালের ২৯ জানুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যায় জগদীশচন্দ্র রয়্যাল ইন্সটিটিউটে বক্তৃতা দেন “On the polarisation of electric rays” সম্পর্কে। জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতায় আবারো সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বক্তৃতা শেষে লর্ড র‍্যালে মন্তব্য করলেন:
“এরূপ নির্ভুল পরীক্ষা কখনো হয়নি। দু’একটি ভুল হলে মনে হতো জিনিসটা বাস্তব, কিন্তু এ যেন মায়াজাল।”

বক্তৃতারত জগদীশচন্দ্র

বক্তৃতারত জগদীশচন্দ্র

এ প্রসঙ্গে ধারণা করা যায় যে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল প্রদর্শন করার সময় জগদীশচন্দ্র শুধু ভালো উপাত্তগুলিই দেখাতেন, ভুল বা অসংলগ্ন উপাত্তগুলি বাদ দিতেন – যা বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণার নীতিমালার বিরোধী। কিন্তু আগে অনেক বিজ্ঞানীই এরকম করেছেন, যেমন গ্যালিলিও।

পরের মাসজুড়ে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন পত্রিকায় জগদীশচন্দ্রের গবেষণার প্রশংসামূলক লেখা প্রকাশিত হতে লাগলো। মেইল, গেজেট, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, স্পেক্‌ট্যাটর প্রভৃতি পত্রিকা প্রতিবেদন প্রকাশ করলো জগদীশচন্দ্রের ওপর। স্পেক্‌ট্যাটর পত্রিকা আগের সবসময় ভারতীয়দের সমালোচনা করতে ছাড়তো না। কিন্তু এবার দেখা গেলো সম্পূর্ণ উল্টো। জগদীশচন্দ্রকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের প্রতিবেদনে লেখা হলো:

“একজন তরুণ বাঙালি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এক জটিল বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন লন্ডনে, আর ইওরোপের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা তা তন্ময় হয়ে শুনছেন, আমাদের অভিজ্ঞতায় এ দৃশ্য বিরল। তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও অসীম ধৈর্যের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির গূঢ় রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছেন, তাদের সঙ্গে এক নতুন সত্যানুসন্ধানীর সংযোগ ঘটার সম্ভাবনার সূচনা হয়েছে আজকের সান্ধ্য অধিবেশনে। প্রাচ্যের মানুষের আছে সেই কল্পনাশক্তি যেটা দিয়ে আপাত অসংলগ্ন ঘটনার মধ্য থেকে সত্য খুঁজে পায়, আছে সেই মননশক্তি – যা মনকে বিক্ষিপ্ত হতে দেয় না, আছে একাগ্রতা – যা ধৈর্য থেকে কিছুটা আলাদা – যে গুণ ইওরোপীয়দের মধ্যে দেখা যায় না। অধ্যাপক বসু যদি তাঁর বিজ্ঞান-সাধনায় মানুষের অজ্ঞাত কোন বিস্ময়কর রশ্মির সন্ধান পেয়ে থাকেন, তবে তার স্বরূপ ও প্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য তিনি নিরন্তর গবেষণা করে যাবেন এবং যোগ্য উত্তরসূরীর কাছে তাঁর অসমাপ্ত কার্যভার তুলে দিয়ে যাবেন। … … … তিন হাজার বছরের ভারতীয় সংস্কৃতি এমন এক বৈজ্ঞানিক প্রতিভারূপে আজ বিকশিত হয়েছে, পাশ্চাত্য দেশে যার তুলনা নেই। জৈবক্রিয়ার গবেষণায় অধ্যাপক বসু বর্তমান যুগে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।”

লন্ডন থেকে ইওরোপের অন্যান্য শহরে যাওয়া হয়নি তখনো। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ফ্রান্স ও জার্মানিতে যাবার। লন্ডন ছাড়ার একেবারে পূর্ব-মুহূর্তে ইম্পেরিয়াল ইন্সটিটিউটে বক্তৃতা দেবার জন্য আমন্ত্রিত হন জগদীশচন্দ্র। ১৮৯৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি সেই বক্তৃতা দেন। লন্ডন ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি স্যার হেন্‌রি রস্‌কো উপস্থিত ছিলেন সেই বক্তৃতায়। রস্‌কো জগদীশচন্দ্রের গবেষণার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। বোম্বাইয়ের প্রাক্তন লাট লর্ড রিয়ে ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। তিনি জগদীশচন্দ্রের যে একটা ভালো গবেষণাগার নেই তা শুনে খুব অনুশোচনা করে বললেন:

“বিজ্ঞান আন্তর্জাতিক ও সর্বজনীন। সেখানে ব্রিটিশ বিজ্ঞান ও ভারতীয় বিজ্ঞান বলে পার্থক্য সৃষ্টির কোন যুক্তি নেই। জগদীশচন্দ্রকে তাঁর গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও স্বাচ্ছন্দ্য দেয়া উচিত।”

শুধুমাত্র মৌখিক উচ্ছ্বাস ও আশ্বাসেই থেমে থাকলেন না ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা। তাঁরা একটা কমিটি করলেন এবং কমিটির প্রতিনিধিদল ভারতসচিবের সাথে দেখা করে একটা স্মারকলিপি দিলেন। সেই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি লর্ড লিস্টার। ভারতে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার উন্নতির জন্য কলকাতায় অধ্যাপক বসুর পরিচালনায় একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেন লর্ড লিস্টার, লর্ড কেলভিন, স্যার হেনরি রস্‌কো, স্যার উইলিয়াম র‍্যামজে, স্যার জি জি স্টোক্‌স প্রমুখ বিজ্ঞানী। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বহু প্রভাবশালী সদস্য এই দাবি সমর্থন করেন।

স্মারকলিপি গ্রহণ করেন ভারতসচিব। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী ও প্রভাবশালী মহলের সমর্থন আছে দেখে তৎকালীন চল্লিশ হাজার পাউন্ড খরচ করে কলকাতায় একটা আধুনিক গবেষণাগার স্থাপন করে জগদীশচন্দ্রকে তার পরিচালক নিয়োগ করার সুপারিশ করে ভারতসচিব চিঠি লেখেন ভারত সরকারের শিক্ষাবিভাগে। সুপারিশ লাল-ফিতেয় আটকে রেখে জগদীশচন্দ্রের জন্য প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে বার্ষিক আড়াই হাজার টাকা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বার্ষিক দু’হাজার টাকা মঞ্জুর করা হয়েছিল।

ইংল্যান্ড ভ্রমণ শেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে বক্তৃতা দিতে যান জগদীশচন্দ্র। ১৮৯৭ সালের ৫ মার্চ বার্লিনের বিজ্ঞান পরিষদে বক্তৃতা দেন তিনি। সেখান থেকে হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে যান। সেখান থেকে যান প্যারিসে। ৯ মার্চ প্যারিসের সরবোঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন। বিদ্যুৎ-রশ্মির প্রতিফলন, প্রতিসরণ ও সমবর্তন বিষয়ে জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতা এতটাই মনোজ্ঞ হয়েছিল যে ২২ মার্চ তারিখে ফ্রান্সের পদার্থবিজ্ঞান সমিতির আমন্ত্রণে সেই বক্তৃতা আবার দিতে হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তেজষ্ক্রিয়তার আবিষ্কারক হেনরি বেকোয়ারেল। তিনিও জগদীশচন্দ্রের গবেষণার ব্যাপক প্রশংসা করেন।

ইওরোপের বিজ্ঞানীদের অকুন্ঠ প্রশংসা ও সমর্থনে সীমাহীন আশা ও উৎসাহ নিয়ে ভারতে ফিরলেন জগদীশচন্দ্র।

রেফারেন্স:
Philisophical Magazine, January 1897.
Times, London, 5 October, 1896.
Daily Chronicle, 28 November, 1896.
Pearsons Magazine, December, 1896.
অবলা বসু, ‘বাঙ্গালী মহিলার বিলাত ভ্রমণ’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৩২।
Spectator, February 6, 1897.