লিখেছেনঃ অনুসন্ধানী আবাহন
১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে যেসকল লোক পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে গিয়ে বসবাস করছিল তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পাকিস্তান সরকার শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে। মোটামুটি পুরো আইয়ুব এর আমল (৬৫-৬৯) জুড়ে প্রচুর হিন্দুকে খেদিয়ে দেয়া হয় ভারতে, তাদের সম্পত্তি দখল করে ফেলা হয়। সেই আমলে সম্পত্তিগুলো গিলে ফেলে আইউব খান এর পোষা ৪০০০০ “বেসিক ডেমোক্রেট” এর গুন্ডারা।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করে। এ অধ্যাদেশের ৩ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে একই তারিখে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এ বিধিমালার ১৮২ বিধির (১) উপবিধির (খ) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর একটি আদেশ জারি করেন। এ আদেশে উক্ত বিধিমালার ১৬৯ (৪) বিধির সংজ্ঞানুসারে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত সকল জমি ও তাতে অবস্থিত ভবনসমূহ ও অস্থাবর সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তির উপ-তত্ত্বাবধায়ক বরাবর ন্যস্ত হবে বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে উপ-তত্ত্বাবধায়ক বরাবর ন্যস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়, বিনিময়, দান, উইল, বন্ধক, ইজারা, দর-ইজারা বা অন্য কোনো প্রকারে হস্তান্তর নিষিদ্ধ করা হয় এবং এ আদেশের পরিপন্থী যেকোন প্রকার হস্তান্তর অবৈধ ও অকার্যকর ঘোষণা করা হয়।
১৯৬৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ এবং পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার কার্যকারিতা ও বৈধতা রহিত হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শত্রু সম্পত্তি (জরুরি বিধানসমূহের ধারাবাহিকতা) অধ্যাদেশ (১৯৬৯ সালের ১নং অধ্যাদেশ) জারি করা হয়। এ অধ্যাদেশ শত্রু সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে” (১)
এটা কাটতে না কাটতেই এসে যায় সেই ভয়াল ১৯৭১। হিন্দুরাই সবার আগে দেশ ছাড়ে যাদের পক্ষে সম্ভব হয়। কেউ জলের দরে বিক্রি করে দিয়ে, কেউ আবার সব ফেলেই। সেই ৭১ এ আমাদের সবার ফ্যামিলির খুব ভালো মানুষেরাও টুক করে পাশের হিন্দু সম্পত্তি দখল করে ফেলেছিলো। মানে, এরা আদৌ আর ফিরবে কি’না, তাই, কেউ না কেউ তো খাবেই। স্বাধীনতার পরে প্রচুর হিন্দু ফিরে এলো দেশে। এসে দেখলো, অনেক প্রভাবশালি লোক, অনেক মুক্তিযোদ্ধা’র ফ্যামিলি, অনেক লিগের ক্যাডার তাদের সম্পত্তি দখল করে বসে আছে। তাদের মোট সম্পত্তির অন্তত ২৫% উধাও, বাকিটা ছাড়ে তো ছাড়ে না। শত্রু সম্পত্তি আইন পার্লামেন্টে তুলে পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলে রাখতে অর্পিত সম্পত্তি আইন করে নেয়া হলো ৭৪ সালে। হিন্দুরা ফেলে চলে গেছিলো, পরিত্যক্ত ছিলো, আগে আসিলে আগে পাইবেন ভিত্তিতে দখলস্বত্ব।
৭৫ এ শেখ মুজিব ও পরিবারবর্গ হত্যাকাণ্ডের পরে হিন্দুরা চরম ইনসিকিউরিটিতে চলে গেলো। ট্রেন্ড শুরু হলো, বিশেষ করে পয়সাওয়ালা হিন্দু ফ্যামিলিগুলোর, যাদের অনেকেই সমস্ত টাকা পয়সা হুন্ডি মারফতে ইন্ডিয়া পাঠানো শুরু করে দেয় , ভাবে নিরাপদে থাকবে সেগুলো। ৭৫ পরবর্তি সময়েও এসব চলছিলো, টুকটাক। এরপরে ‘৯২ সালে, বিএনপির আমলে এলো বাবরি মসজিদ ভাঙার ছুতো। হিন্দুদের উপরে ৪ মাস ধরে চলা এই তান্ডবে, ২৮০০০ ঘরবাড়ি, ২৭০০ দোকানপাট, ৩৫০০ মন্দির ও উপাসনালয় ধ্বংস ও লুট করা হয়। কত খুন, জখম ধর্ষন তা আসলে হিসাবের বাইরে। এক ঝটকায় অন্তত কয়েক শতাংশ হিন্দুকে তাড়িয়ে দেয়া হয় দেশ থেকে। সাহা, কুন্ডু, দত্ত, রায় এদের মধ্যে প্রায় সব এলাকাতে, ইন্ডিয়াতে একসময় চলে যেতে হবে জেনারেল মেন্টালিটি তৈরী হয়। কেউ স্বর্ণকার, কেউ বিশাল ব্যবসায়ী, কেউ সাবেক জমিদার, ইত্যাদি। আস্তে আস্তে দেখা যেতে লাগলো এই পসাওলারা রাতের অন্ধকারে ইন্ডিয়া চলে যাওয়া শুরু করলো। প্রতিটা এলাকায়। আমার মামাবাড়ি এলাকায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার ছিলো প্রবল। সেখানে যেমন হয়েছে; আমরা যেখানে থাকতাম, সেই এলাকায় পারসিকিউশন দেশের মধ্যে অন্যতম লোয়েস্ট। ব্যাঙ্গালোরে পড়াশুনার সময়, আমরা বিভিন্ন জেলার হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে ছেলেরা একসাথে এক বাড়িতে থাকতাম। আমাদের থার্ড ইয়ারের আমার চাঁদপুরের সাহা বন্ধুর ফ্যামিলি চলে গেল বারাসাত। ওদের এমন কোন প্রব্লেম ছিলো না, কিন্তু এমনটাই হয় । খুলনার কয়রা এলাকায় আমার এক বন্ধুর বাড়ি, ওরা বহু আগে থেকেই এই জেনারেশনের সবাইকে ইন্ডিয়া সেটেল করাচ্ছে। ওদের লোকালিটিতে হিন্দুরা অত্যাচারিত নয়। পয়সাওলা হিন্দুদের উপরে বাংলাদেশে কখনোই আঁচ লাগেনি তেমন, কিন্তু তারাই নিজেদের সুবিধামত, নিজের সব ব্যবসা জমি বিক্রি করে আগে চলে গেল। পড়ে রইলো মধ্যবিত্ত থেকে গরীব হিন্দু। এরাই মেজরিটি, কিন্তু এদের মুভমেন্টের ফ্লেক্সিবিলিটি নেই। পয়সাওলা হিন্দু এখনো অনেক আছে, কিন্তু নিশ্চিত, তারাও কেউ থাকবে না, সবার আগে নিজের সুবিধামত তারাও চলে যাবে। এই ছায়া হয়ে থাকা ফ্যামিলিগুলো চলে যাওয়ায়, পলিটিকাল লোকজন পেয়ে গেল বড় সুযোগ। অনেক বড় সুযোগ।
ব্লগার আদিল মাহমুদ এর একখানা পোষ্টের কিয়দংশ উদ্ধৃত করছি:
====প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ’৯৭ সালে ‘Inquiry into Causes and Consequences of Deprivation of Hindu Minorities in Bangladesh through the Vested Property Act’ নামের একটি গবেষনা মূলক গ্রন্থতে এসব তথ্য প্রকাশ করেন। ওনার গবেষনায় বেরিয়ে আসে যে মোট ৯২৫,০৫০ হিন্দু বসতবাড়ি (বাংলাদেশের শতকরা ৪০% হিন্দু পরিবারের) এই আইনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। চাষাবাদের জমি হারায় ৭৪৮,৮৫০টি পরিবার। মোট জমির পরিমান ১.৬৪ মিলিয়ন একর, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের মালিকানাধিন মোট ৫৩% ভূসম্পত্তি। এই সম্পত্তির পরিমান সমগ্র বাংলাদেশের ৫.৩% ভাগ। অন্যদিকে সম্পত্তি দখল করে লাভবান হয়েছে মাত্র ০.৪% লোক। ======= ((https://www.amarblog.com/adilmahmood/posts/146595)
২০০১ সালের এপ্রিলে “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইন” (২) পাশ হবার পর ক্ষমতায় আসার আগেই বিএনপি প্রায় পাগলা কুকুরের মত হয়ে যায় এর লোভে। কারণ, “আইন ও শালিস কেন্দ্র” ’৯৫ সালে প্রকাশ করে যে মোট সম্পত্তির ৭২% বিএনপির লোকজনের ভোগে চলে গেছে। যদিও ’৮৮ সালে ৪৪% আওয়ামী লোকদের ভাগে ও ৩২% বিএনপির ভাগে ছিল। ২০০১ সালেই বিএনপি সরকার এই “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইন”কে একদফা সংশোধন করে। বিএনপি-জামাত আমলে মোট দুইবার এই আইন সংশোধন করা হয় কার্যকারীতা স্থগিত রাখতে। পাশাপাশি চলে ২০০১ সালে নারকীয় হিন্দু মুক্তকরণ প্রক্রিয়া। হিন্দু খেদালেই, সম্পত্তি পরিত্যক্ত, দাবী করার কেউ না থাকলে প্রত্যার্পনও করতে হবে না। আওয়ামী লিগ এই দফায় ক্ষমতায় আসার পরে , ২০১১, ’১২, ’১৩ ও ‘১৬ সালে ৩ দফা সংশোধন করে । ২০১২ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যার্পন আইনের কার্যকারীতা শুরু হয়, ২ মে তারিখে এস. আর. ও. নম্বর ১০৭-এর মাধ্যমে সরকার কর্তৃক অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তি বিধিমালা জারী করা হয় (৩)। এই প্রক্রিয়ায় সারা দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু একজন দাবিদারের কাছেও এখন পর্যন্ত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করা হয়নি(৪)।২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে পুনরায় প্রত্যাবর্তন আইন সংশোধন করা হয়। মোটামুটি ২০১০ থেকে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায় হিন্দু মুক্তকরণের। একযোগে শামিল হয়েছে বিএনপি-আওয়ামি লিগ-জামাত-জাপা সকল প্রভাবশালিরাই। প্রত্যার্পন কি কেউ করতে চায়।
বিভিন্ন ছুতো-নাতায় গত অর্ধশতাব্দী ধরে এই বাংলা বদ্বীপ এ হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বা পারসিকিউশন চলছেই। মুখ্য উদ্দেশ্য, এরা চলে গেলেই সম্পত্তি দখল হবে। বাবরি মসজিদ ছুতো, বিএনপি জেতার পরে লিগে ভোট দিয়েছিলো ছুতো, চাঁদে সাইদি দেখা যাওয়া ছুতো, ফেসবুকে ছবি ছুতো, ইসলামাইজেশন ছুতো……ছুতো গোজ অন। ৬৫’তে ভারতের ছুতো, ৭১’ এ পাকিস্তানের ছুতো, ৭৫’এ মুজিবের ছুতো, ৯২’এ বাবরির ছুতো, ২০০১’ এ ভোটের ছুতো, ২০১৩ সালের পর থেকে ফেসবুকের ছুতো, ১৬ সালে শোনা যাচ্ছে, নাসিরনগরে ইউনিয়ন ইলেকশনে মন্ত্রী যাকে সাপোর্ট দিয়েছিলো, হিন্দুরা তার বিপক্ষ লোককে সাপোর্ট করেছিলো সেই ছুতো। এটা নাকি তার জবাব। ছুতো হলেই হলো, মারো, খেদাও, দখল করো।
বিঃদ্রঃ অন্য ধর্মাবলম্বী ও আদিবাসী এবং ট্রাইবাল এদের উল্যেখ করলাম না, তাহলে বিশাল হত, বিশাল
সাহায্যকারী তথ্যসূত্রঃ
১) http://en.banglapedia.org/index.php?title=Vested_Property
২) http://bdlaws.minlaw.gov.bd/bangla_pdf_part.php?id=856
৩) https://bn.wikipedia.org/s/2g42
৪) http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=37105
‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’ ছোটবেলায় পড়া ভাবসম্প্রসারন টাই মনে পড়ে যাচ্ছে। ধর্মের নামে রাজনীতি যতদিন চলবে তা আরো কঠিনতরই হবে। পাকিস্তান বা আফগানিস্তান হতে আর বেশি অপেক্ষা করা লাগবে না।
মুক্ত মনের উদয় হোক,
মুক্ত চিন্তার উদয় হোক,
শুভ বুদ্ধির উদয় হোক,
যদি তা নয় বেশী দিন নাই বাংলাদেশের আফগানিস্তান হতে।।।।
ভৌগলিক এবং পারিপার্শ্বিক দুরকমভাবেই আফগানিস্তানের চাইতে পাকিস্তান আমাদের নিকটে
অমুসলিমদের স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি হচ্ছে মোসলমানদের গনিমতের মাল। লেখাটা পড়ে আমার এই অক্ষম প্রাণটা শুধু আর্তনাদ করে উঠলো।
ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাঘেঁসা লোকেরা , তা সে ক্ষমতা রাষ্ট্রীয়-ধর্মীয়-সামাজিক যাই হোক না কেন, তারা ছাড়া আমরা সকলেই অক্ষম। আর্তনাদ করা আর মাঝে মাঝে আহাজারি ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য নেই