১৯৮১ সালে পার্বত্য গরিলার সংখ্যা একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছিলো। মানুষের আক্রমনে কোণঠাসা হয়ে গিয়ে শিকার এবং গৃহযুদ্ধের প্রভাবে এরা আফ্রিকার একটি ছোট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিলো। এই সময় এরা সংখ্যায় ছিলো মাত্র ২৫৪ টি। সবাই মিলে একটি মাত্র বোয়িং ৭৪৭ বিমানে এঁটে যায়!
বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে। ২০১২ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে এদের সংখ্যা ৮৮০ তে পৌঁছেছে। এটি বড় ধরনের উন্নতি কিন্তু তারপরও পৃথিবীর সবগুলো গরিলা মাত্র দুটি বোয়িং ৭৪৭ বিমানে এঁটে যাবে। গরিলা এখনো অতিবিপন্ন প্রজাতি।
আমরা একই ধরনের গল্প সারা পৃথিবীতেই এবং সমসময়ই শুনতে পাই। সেটি বাঘ হোক, কিংবা পান্ডা, ক্যালিফোর্নিয়ার শকুন বা প্রবাল প্রাচীর, পৃথিবীর প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের একটি বিরাট অংশ আজ হুমকীর মুখে। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি উদ্বেগের আর চুড়ান্ত পরিণতিতে বাকরূদ্ধকর।
এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর আসলেই কি প্রয়োজন আছে? অস্বীকার করা যায় না, সুন্দর তুলতুলে পান্ডা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে তাতে আমাদের খারাপ লাগবে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা এদের উপর নির্ভরশীল। আর তাছাড়া মানুষের নিজের প্রতি যত্ন নেওয়াইতো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ- যার যার সমস্যা সে নিজেই মোকাবেলা করুক না- আমাদের কিসের ঠেকা কোটি কোটি ডলার খরচ করে এদের রক্ষা করতে যাওয়ার? আমরা কেন অন্য জীবপ্রজাতি সংরক্ষণ করতে যাব?
খোলা চোখে দেখলে এদের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়ারই বরং অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। সবচেয়ে স্পষ্ট কারণটি হলো এদের রক্ষা করতে গিয়ে বিপুল পরিমান পয়সা খরচ করতে হয়। ২০১২ সালের একটি আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী বিপন্ন স্থলভাগের প্রানীগুলোকে রক্ষা করার জন্য প্রতি বছর ৭৬০০০ কোটি ডলার খরচ হয়ে যায়। এই পরিমান অর্থ খরচ করে আমরা তো মানুষকে না খেয়ে মরার হাত থেকে বাঁচাতে পারি কিংবা সবার জন্য চিকিৎসা নিশ্চিত করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। কেন বন্যজীবজগতের পেছনে আমরা এই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছি?
বিশেষ করে যেই নেকড়েটি মানুষ এবং গৃহপালিত পশুর প্রতি হুমকী তাকে রক্ষা করতে চাওয়া ঠিক বোধগম্য না-ও হতে পারে। বোঝাই যায় কিছু কিছু প্রজাতির জীব না থাকলেই বরং আমাদের জন্য ভালো। জীব প্রজাতিগুলো এমনি এমনিই প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হচ্ছে। এককভাবে যেমন বিলুপ্ত হয় তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসে পাঁচটি গণবিলুপ্তির মাধ্যমে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাতি একযোগে বিলুপ্ত হয়েছে। সবচেয়ে সাম্প্রতিক গণবিলুপ্তিটি হয়েছে সাড়ে ছয়কোটি বছর আছে, এতে ডায়নোসরসহ ইঁদুরের চেয়ে বড় অধিকাংশ প্রানী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো।
যদি বিলুপ্তি একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হয় তাহলে আমরা একে থামাতে যাই কেন? একটি উত্তর হতে পারি, বিলুপ্তি এখন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক উচ্চ হারে ঘটছে। একটি সাম্প্রতিক গবেষনায় ধারনা করা হচ্ছে বিলুপ্তির হার গত একশতাব্দীতে প্রায় শতগুণ বেড়েছে এবং এর জন্য তিরষ্কার মানুষেরই প্রাপ্য।
তবে এর বাইরে বিলুপ্তি রোধ করার জন্য আরো সরল কারণ রয়েছে; আমরা স্রেফ প্রজাতিগুলোকে বাঁচাতে চাই।
আমরা অনেকেই প্রাকৃতিক জগৎ পছন্দ করি। আমরা মনে করি, প্রানীজগৎ সুন্দর, রাজকীয় কিংবা স্রেফ মনোমুগ্ধকর। আমরা চুঁইয়ে আসা সূর্যের আলোয় প্রাচীন একটি বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে, কিংবা প্রবাল-প্রাচীর ঘেঁষে ডুব দিতে পছন্দ করি। পার্বত্য গরিলা দেখে মুগ্ধ হয় না এমন কেউ আছে? প্রকৃতি সুন্দর, এবং এর সৌর্ন্দর্যের মূল্য একে সংরক্ষণের একটি ভালো কারণ। একই কারণে আমরা বিশ্বনন্দিত চিত্র শিল্প যেমন: মোনালিসা বা দ্যা স্টারি নাইট সংরক্ষণ করি।
এই বিষয়টিকে কারণ হিসেবে ধরলে শুরুতেই যে সমস্যা হতে পারে তাহলো আমরা যেই উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোকে সুন্দর মনে করি না বা কুৎসিত, দুর্গন্ধময় বা ভয়ঙ্কর মনে করি সেগুলোর ধ্বংস অনিবার্য করে তুলি। যদি কেউ আকর্ষনীয় না হয় তাহলে সে বাদ।
আরো মৌলিকভাবে বিষয়টি আসে সুবিধাবাদ ও বিলাসিতা থেকে। পশ্চিমা একজন ধনী ব্যক্তি বাঘ সংরক্ষণের জন্য পয়সা খরচ করতেই পারেন কারণ তাঁর এর দিকে তাকাতে ভালো লাগে (মোনালিসার দিকে তাকানোর মতো)। কিন্তু একজন ভারতীয় গ্রাম্য দরিদ্র মানুষ যিনি বাঘের আক্রমনের শিকার তাঁর কাছে এটি কোনো আবেদন তৈরি করে না। কাজেই আমাদের কিছু কিছু মানুষের কাছে প্রকৃতি সুন্দর মনে হলেও তাতে কাজ হবে না। প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য আমাদের আরো গুরুত্বপূর্ণ অযুহাত লাগবে।
আপনি হয়তো শুনে থাকবেন প্রায়শঃই বলা হয় রেইন ফরেষ্ট বা বাদল বন জাতীয় বাস্তুসংস্থান রক্ষা করা প্রয়োজন কেননা সেগুলো অনেক প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহ করে; যেমন: ঔষধ। যদি এমন কোনো উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যায় যাতে হয়তোবা ক্যান্সারের প্রতিকার আছে তাহলে বিপদের কথা নয়?
প্রকৃতি উদ্ঘাটন করে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বস্তু খুঁজে বের করার একটি প্রচলন পৃথিবীতে আছে। এটি মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় বস্তুটি খুঁজতে কাজে আসে, কিন্তু এতে নানাবিধ সমস্যাও আছে। প্রথমত, আমাদের নতুন ঔষধ তৈরির জন্য অনেক পদ্ধতি আছে। আমাদের প্রয়োজন হয় না, হাজার হাজার মাইল বিপদসংকুল জঙ্গল পাড়ি দিয়ে ক্ষীণ আশা নিয়ে একটি ধন্বন্তরী গাছ খোঁজার।
তাছাড়া জ্ঞানের স্বত্তাধিকারের বিষয়ও এতে জড়িত। প্রায়শঃই দেখা যায় স্থানীয় লোকজন ইতিমধ্যেই তাঁদের এলাকার উদ্ভিদের ঔষধিগুণের বিষয়ে অবগত থাকেন এবং বহিরাগতদের প্রতি তাঁদের বঞ্চিত করে নিজেদের সম্পদ অধিকার করার অভিযোগ করেন। এসব নিয়ে আইনি ঝামেলাও আছে বিস্তর। তাছাড়া এই ক্ষেত্রেও বলা যায়, যদি একটি প্রজাতির বিশেষ কোনো ঔষধি গুণ না থাকে তাহলে কি হবে? পার্বত্য গরিলার রক্তে ক্যান্সারের নিরাময় থাকার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই এই যুক্তি যদিও আমাদের কিছুটা বন্য প্রানী সংরক্ষণে উদ্ধুদ্ধ করে কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না।
কেবলমাত্র ১৯৯০ এর দশকেই জীববিজ্ঞানীগণ প্রথমবারের মতো বিপুলভাবে অনুধাবন করতে পারেন যে উদ্ভিদ এবং প্রাণী স্রেফ নিজ নিজ পরিবেশে অবস্থান করেই আমাদের নানাভাবে উপকার করছে। এই উপকার যা অধিকাংশ গোষ্ঠীই বর্তমানে মেনে নিয়েছে তার নাম হলো “বাস্তুসংস্থান সেবা”। এই সেবাসমূহের কিছু কিছু সুস্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, কিছু কিছু উদ্ভিদ এবং প্রাণী আমরা আহার করি। অপরদিকে সমুদ্রে সালোকসংশ্লেষণকারী প্ল্যাংকটনা জাতীয় জীব এবং গাছ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন যোগায়।
এগুলো প্রত্যক্ষ উপকার, কিন্তু মাঝে মাঝে এই সেবা অধিকতর সূক্ষ হতে পারে। পরাগায়নের পতঙ্গ যেমন: মৌমাছি একটি যথাযথ উদাহরণ। আমাদের উৎপাদিত শস্যের বিরাট অংশ মৌমাছির উপর নির্ভরশীল-এবং এরা যে শুধু আমাদের খাবার দেয় তাই নয়, মৌমাছির অস্তিত্ব না থাকলে আমাদের নিজের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে।
বাস্তুসংস্থানের সেবার উপর আমরা কতটা নির্ভরশীল তা বোঝার জন্য একটি জগৎ কল্পনা করুন যেখানে শুধুমাত্র মানুষই রয়েছে- যেমন হতে পারে সেটি এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে একটি মহাশূন্যযান। অক্সিজেন ছাড়ার জন্য সেখানে কোনো উদ্ভিদ নেই, কাজেই আপনাকে প্রযুক্তির সাহায়তা নিয়ে সেখানে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে। সোজাসুজি ভাষায়, আপনাকে মহাশূন্যযানে একটি রাসায়নিক প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে। এই প্ল্যান্টে আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান পানি উৎপাদনের ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
সেখানে আপনার খাওয়ার কিছু নেই, তাই আপনাকে কৃত্রিমভাবে খাদ্য তৈরি করতে হবে। আপনি হয়তো চিনি এবং চর্বিজাতীয় বস্তু তৈরি করতে পারবেন তবে এটিকে ভোজ্য করা হবে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। ২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী আমরা সর্বসাধারণের কাছে পছন্দনীয় একটি বার্গারও তৈরি করতে পারি নি।
এভাবে যেতে যেতে আমরা আমাদের অন্ত্রে বিদ্যমান অণুজীব পর্যন্ত যেতে পারব যার অনেকগুলো আমাদের পরিপাক তন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয়। সার্বিকভাবে বলা যায় তাত্ত্বিকভাবে হয়তো একটি একটি করে চিন্তা করলে সবগুলো সমস্যা সমাধানের কৃত্রিম পদ্ধতিই বের করা যাবে, কিন্তু কাজটি হবে খুব কঠিন। আমাদের জীবন ধারনের সাথে হাজার হাজার প্রক্রিয়া জড়িত যা নানাবিধ জীবপ্রজাতির মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। কাজেই এই প্রক্রিয়াগুলো কৃত্রিমভাবে নিষ্পন্ন করার ব্যবস্থা করার চেয়ে বিদ্যমান প্রাণবৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করা অনেক বেশী সহজ। যখন আপনি বাস্তুসংস্থানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেবাগুলো একত্রে যোগ করবেন তখন এগুলো বিপুলাকার ধারন করবে।
১৯৯৭ সালে বাস্তুতন্ত্রবিদ রবার্ট কোষ্টানজা এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ আনুমানিকভাবে হিসেব করে দেখেন যে প্রতিবছর জৈবমন্ডল ৩৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সেবা প্রদান করে। তুলনা বোঝানোর জন্য তাঁরা উল্লেখ করেন যে সেই বছর সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক উৎপাদন ছিলো ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার।
পাঁচ বছর পরে সেই গবেষকদলটি বিষয়টিকে একধাপ এগিয়ে চিন্তা করেন। তাঁরা গননা করে দেখেন জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে আমরা কতটা লাভবান হতে পারি। তাঁরা গবেষনা করে বের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষনে যে পরিমান খরচ হবে তারচেয়ে শতগুণ বেশী মূল্যের উপকার পাওয়া যাবে। অন্য ভাষায়, প্রকৃতি সংরক্ষণ একটি অত্যন্ত লাভবান বিনিয়োগ।
এর বিপরীতে, কোন রকমের প্রজাতি সংরক্ষনের উদ্যোগ না নিয়ে বিলুপ্ত হতে দিলে তা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হবে। ২০১০ সালের একটি গবেষনায় দেখা যায় নিয়ন্ত্রনহীন প্রজাতি বিলুপ্তিতে ২০৫০ সাল নাগাদ সারা পৃথিবীর অর্থনীতি ১৮% ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
আপনার হয়তো এই পর্যায়ে মনে হতে পারে আমি কেবল কাটখোট্টা অর্থনীতির হিসেব দিয়ে যাচ্ছি হৃদয়হীনভাবে। আমি প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার বিষয়টি উপেক্ষা করছি যেই বিষয়টি শুরু করেছিলাম একেবারে গোড়াতেই। বেশ, অনেক পরিবেশবাদী এই দৃষ্টিকোণ থেকেই চিন্তা করেন। পরিবেশবিদ সাংবাদিক জর্জ মনবিয়ট এমনই একজন সমালোচক।
মনবিয়ট মনে করেন আর্থিক মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য নয় কেননা ক্ষমতাসীনরা এসব হিসেব-নিকেশ নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বদলে দিতে পারে। যদি কেউ একটি প্রাকৃতিক বাসস্থানের মধ্য দিয়ে রাস্তা বানাতে চায় তাহলে তারা স্রেফ রাস্তার উপকারীতা বন্য জীবকুলের উপাকারীতার চেয়ে বাড়িয়ে তুলে ধরতে পারে। ২০১৩ সালের একটি লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, “বন, মাছের মজুদ, জীববৈচিত্র্য, জলজ চক্র এসবই মালিকানায় পর্যবসিত হতে পারে। কর্পোরেশন, জমিদার, ব্যাংক এসবের আওতাধীন হতে পারে এই বিষয়গুলো। অথচ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অতিরিক্ত ক্ষমতাই আবার এই বিষয়গুলোর জন্য হুমকী।”
মরবিয়টের ধারনায় সম্ভবতঃ যুক্তি আছে; যে কেউ এধরনের ব্যবস্থার অপব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এর বিপরীত যুক্তিতে বলা যায়, এই অপব্যবহার আমরা মূল্যনির্ধারন না করে দিলেও হতে পারে। তাই অনেক সংরক্ষণবাদী সংস্থা বাস্তুসংস্থানের মূলনির্ধারণের পক্ষে মতামত দেন। প্রকৃতপক্ষে, বাস্তুসংস্থান সেবার ধারনাটি কোনো ভাবেই বাতিল বা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ফলস্বরূপ, অপেক্ষাকৃত দুর্বল যুক্তিগুলো যেসব দিয়ে আমরা লেখাটি শুরু করেছিলাম, সেসব আমরা এই পরিসরে আরোপ করতে পারি।
আমরা ধরে নিই প্রকৃতি সুন্দর এবং এর সৌন্দর্য এবং বিস্ময় ধরে রাখার জন্য আমাদের একে সংরক্ষণ করা উচিৎ। সুন্দর প্রকৃতি আমাদের যে আনন্দ দেয় তাকে আমরা এখন একটি বাস্তুসংস্থান সেবা হিসেবে তাই ধরে নিতেই পারি। প্রকৃতি আমাদের সৌন্দর্য সরবরাহ করে। আপনি হয়তো এখন জিজ্ঞেস করবেন, আমরা সৌন্দর্যকে কিভাবে মূল্য দিয়ে নিরূপন করব? কিভাবে সৌন্দর্য বস্তুগত ভাবে পরিমাপ করা যায়?
বেশ, আপনি হয়তো তা পরবেন না, কিন্তু তাতে এর মূল্যায়ন বন্ধ থাকবে না। আমরা চিত্রশিল্প, সঙ্গীত কিংবা অন্য যেকোন ধরনের শিল্পেরই মূল্য নির্ধারন করে থাকি। আমরা যদি কোনো কিছুর মূল্যায়ন করি এবং সেটি পাওয়ার জন্য পয়সা খরচ করতে প্রস্তুত থাকি তাহলেই কিন্তু তার একটি মূল্য নির্ধারণ হয়ে যায়। প্রকৃতির ক্ষেত্রেও এই কাজ করার জন্য আমাদের একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন আমরা একে উপভোগ করার জন্য মূল্য পরিশোধ করতে পারি।
একটি সরল উদাহরণ হলো সাফারি ভ্রমন। একে ইকোট্যুরিজম বলা হয়। এই ধরনের ভ্রমনে পর্যটকদের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। পার্বত্য গরিলাগুলো এই ক্ষেত্রে আমাদের জীবিকা এবং এই ইকোট্যুরগুলো কৃষি বা অন্যান্য পেশার চেয়ে বেশি লাভজনক। তবে, অবশ্যই এই ধরনের ব্যবস্থার সমস্যাও আছে। পর্যটকেরা নিজের সাথে করে রোগ-ব্যাধি নিয়ে আসতে পারেন যা গরিলার প্রতি হুমকী হিসেবে দেখা দিতে পারে; যদিও প্রতিরোধের উপায় অবলম্বন করা সম্ভব। তাছাড়া অধিকসংখ্যক পর্যটকের উপস্থিতি গরিলাদের স্বাধীন সমাজিক জীবন-যাপনের অন্তরায় হতে পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে চিন্তা করলে ইকোট্যুরিজম প্রকৃতির সৌন্দর্যের মূল্য পরিশোধের একটি কার্যকর ব্যবস্থা।
এ ধরনের চিন্তাভাবনা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমাদের ভাবনা-চিন্তাগুলোকে বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে রীতিমতো বাধ্য করে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জীবসংরক্ষণবিদ জর্জিনা মেইস এমনটিই মনে করেন। তিনি বলেন, ১৯৬০ এর দশকে আমাদের বলা হতো প্রকৃতির নিজের স্বার্থে একে সংরক্ষন করা দরকার। কিন্তু ২০০০ সাল নাগাদ এসে পরিস্থিতি বদলেছে। এখন বলা হয়, “মানুষের জন্য প্রকৃতি”। এর কৃতিত্ব বাস্তুসংস্থান সেবার। যদি আপনার “বন্যপ্রাণের এবং বনাঞ্চলের নিজস্ব অনির্দিষ্ট মূল্য রয়েছে” এই নীতিবাক্য মেনে নিতে আপত্তি থাকে তারপরও এসব রক্ষাকরার জন্য আপনার নিজেরই স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কারণ রয়েছে। আপনি যদি বাস্তুসংস্থানের শিল্প বা অর্থনীতিতে গুরুত্ব দেন তাহলে আর আপনাকে আলাদাভাবে পার্বত্য গরিলার প্রতি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে না।
তবে তথাপি, প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে এই বাস্তুসংস্থান সেবা সুনির্দিষ্টভাবে আমাদেরকে বন্যপ্রানী সংরক্ষণের জন্য উৎসাহীত করছে না। কিন্তু এই বিষয়টিকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে পার্বত্য গরিলার কথাই ধরা যাক। এরা এমন একটি পার্বত্য সীমায় বসবাস করে যেখানে গাছপালা ঘন জঙ্গল দ্বারা আবৃত। আমাদের যদি এই গরিলাগুলোকে সংরক্ষণ করতে হয় তাহলে তাদের বাস্তুসংস্থানটিকেও সংরক্ষণ করতে হবে।
এরপরের কাহিনী সহজ। যদি গরিলাগুলোকে বাঁচাতে হয় তাহলে গাছগুলোকেও বাঁচাতে হবে, কারণ গরিলা খাদ্যের জন্য এদের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু গরিলার অখাদ্য যেসব উদ্ভিদ আছে সেগুলো দিয়ে সমগ্র এলাকাটি ভরে যাক তা আমরা চাই না, কাজেই গরিলার পাশাপাশি অন্যান্য প্রানীকেও সেখানে আমাদের থাকার সুযোগ দিতে হবে। এই সব প্রজাতি মিলে উদ্ভিদ সম্প্রদায়কে যথাযথভাবে বিন্যাস্ত রাখবে।
পার্বত্য গরিলা বিপুল প্রজাতির প্রানীর একটি শৃঙ্খলের একটি অংশ। এবং এদেরকে এসব প্রজাতি থেকে আলাদা করা দুষ্কর। একটি –দুটি প্রজাতিকে উৎপাটন করে খুব বেশি পার্থক্য হয়তো বোঝা না-ও যেতে পারে আবার হয়তো এতে একটি চেইন বিক্রিয়া শুরু হতে পারে যাতে সমগ্র বাস্তুসংস্থানই হুমকীর মধ্যে পড়তে পারে। একটি প্রানীকে সমূলে ধ্বংস না করে এর প্রভাব বোঝা যাবে না, কিন্তু বাস্তবে কাজটি করতে গিয়ে হয়তো আপনি সম্পূর্ণ বাস্তুসংস্থানকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারেন।
কাজেই আমরা যদি পার্বত্য গরিলাকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে বর্ধিত পরিসরে আসলে সমগ্র বাস্তুসংস্থানটিকেই রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। এই অবস্থায় অনেক মানুষ হয়তো বিলাপ করা শুরু করবেন। আপনি হয়তো শুধুমাত্র গরিলা সংরক্ষণ করার জন্য খরচ করতে আগ্রহী হয়েছেন কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছেন কীট-পতঙ্গ, আগাছাসহ যাবতীয় সবকিছুকেই রক্ষা করতে হচ্ছে। আপনি হয়তো ভাবছেন গরিলা সংরক্ষনের উপর আপনার অর্থলগ্নি লাভজনক নয়।
সেই ক্ষেত্রে জঙ্গল রক্ষার জন্য আরো ভালো কারণও রয়েছে। শুধুমাত্র গরিলা সংরক্ষণের জন্য আপনাকে জঙ্গল টিকিয়ে রাখতে হবে এমন নয়। পাহাড়ী ঢালের বন আমাদের এমন অনেক উপকারে আসে যেগুলো আমরা হয়তো ধর্তব্য মনে করি না। সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, এই বন আমাদের একটি নিয়মিত পানির উৎস সরবরাহ করে।
আমরা সবাই জানি আবহাওয়া পরিবর্তনশীল। মাঝে মাঝে অতিবৃষ্টি দেখা যায় যাতে সৃষ্টি হয় বন্যা। আবার মাঝে মাঝে বৃষ্টি কম হয়, এবং ক্ষরায় পুড়তে হয়। এই উভয়ই আমাদের জন্য ক্ষতিকর। পাহাড়ের উপর জন্মানো গাছপালা এই বৃষ্টিপাতের বিষয়টিকে সুষম করে এবং আমাদেরকে একটি নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্য পানির প্রবাহ সরবরাহ করে। নিচুভুমিতে বসবাসকারী মানুষের জন্য এটি একটি সুসংবাদ। এবং এটি যদি সত্যিই কর্মক্ষম রাখতে হয় তাহলে আমাদেরকে পাহাড়ী বনটিকে যথাযথ স্থিতিশীল রাখতে হবে।
বাস্তুবিদগণ যথেষ্ট পরিমান তথ্য সংগ্রহ করেছেন যাতে দেখা যায় একটি বাস্তুসংস্থানে যত বেশী বৈচিত্র্যময় প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বা অন্যান্য উপাদান থাকে ততোই এটি বেশি স্থিতিশীল হয় এবং ততোই এর হঠাৎ শুকিয়ে যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়। এর একটি উদ্দীপনায়ময় প্রয়োগ রয়েছে। একটি ক্ষুদ্র, অকিঞ্চিৎকর পোকা হয়তো মানুষের জন্য উপকারী তেমন কিছুই করে না, কিন্তু এটি এর বাস্তুসংস্থানটিকে নানাভাবে সাহায্য করছে- এবং সেই বাস্তুসংস্থানটি মানুষের জন্য সেবা তৈরি করছে।
আপনি এটিকে অর্থনীতির আওতায় ফেলতে পারেন আবার নাও পারেন, কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের বলছে বাস্তুসংস্থান আমাদের এমন অনেক কিছুই সরবরাহ করছে যা অন্য কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব নয় এবং এটি যত বৈচিত্র্যময় হবে ততোই তা আমাদের জন্য মঙ্গলময়। কাজেই আমাদের নিজেদের মঙ্গলের জন্যই বাস্তুসংস্থান রক্ষা করা জরুরী। একদিকে এটি আমাদের মৌলিক চাহিদা যেমন: খাদ্য ও পানি সরবরাহ করে। আপরদিকে অপেক্ষাকৃত কম বস্তুগত বিষয় যেমন: নান্দনিকতা ইত্যাদির উৎস হিসেবে কাজ করে।
মানুষ নিজেও অবশ্যই বস্তুসংস্থানের উপাদান এবং এই বাস্তু হতে উৎখাত হতে চাইবে না কোনো মানুষই। ফলস্বরূপ সংরক্ষণবিদগণ এখন ভাবছেন মানুষের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে প্রকৃতিকে সংরক্ষণের উপায় খুঁজে বের করার উপর জোর দিতে হবে। কারণ সংরক্ষণের প্রচেষ্টাগুলো সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া বাস্তবায়িত করা মুশকিল। একইভাবে প্রকৃতিকে সংরক্ষণ না করে আমরা নিজেদের প্রতি যত্নশীলও হতে পারব না। কারণ আমরা অনেক বেশি পরিমানে এর উপর নির্ভরশীল। নির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতিতে আমরা হয়তো কোনো একটিকে বেছে নিতে পারি কিন্তু সার্বিকভাবে আমাদের উভয়ের দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে।
এটি সংরক্ষণের নতুন দৃষ্টিভঙ্গী। এটি প্রকৃতির নিজের জন্যই কাজ করা নয়, কেননা এটি হবে সার্বিকভাবে মানুষের নিজের প্রয়োজনের তাগিদেই। একই সাথে এটি মানুষের প্রয়োজনে প্রকৃতি সংরক্ষণ নয়, কেননা এটি সরাসরি বাস্তুসংস্থান আমাদের যেসব সেবা দিচ্ছে সেসবের উৎকর্ষ সাধনের জন্যও নয়। বরং এটি মানব সমাজ এবং বাস্তুসংস্থানকে সার্বিকভাবে অবিচ্ছেদ্য হিসেবে দেখার প্রয়াস। মেইস এই দৃষ্টিভঙ্গীকে নাম দিচ্ছেন “মানুষ ও প্রকৃতি”।
এর অর্থ এই নয় যে প্রতিটি প্রজাতিকে ধরে ধরে সংরক্ষণ করতে হবে, আমরা চেষ্টা করলেও তা পারব না। এর মানে এ-ও নয় যে প্রতিটি জিনিসকে যেভাবে আছে ঠিক সেভাবে রেখে দিতে হবে, এটিও মূলতঃ অসম্ভব। বরং এর অর্থ হলো বাস্তুসংস্থানসমূহকে যতটা সম্ভব বৈচিত্র্যময় করে রাখা। এটি অন্যদের জন্য ভালো, আমাদের জন্যও ভালো।
ব্লগটি পড়ে অনেক ভাল লাগল। অত্যান্ত গুরুত্বের সাথে তথ্যাদি তুলে ধরা হয়েছে। এমন রোমাঞ্চকর তথ্য আরও পড়তে চাই।
বন-জঙ্গল এত কমে না গেলে হয়ত উষ্ণতা বৃদ্ধি কম হত। হিমবাহ ও আন্টারটিকা বরফ গলে গেলে কিন্তু এই বাংলা অঞ্চলের অনেকটাই ডুবে যাবে – বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গ।