কতোদিন গীতবিতান খুলি না। অথচ গেল ক’বছরে এমনটি হয়নি যে, গীতবিতানের একটি গান পড়া হয়নি কোনোদিন।
কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায়ের কবিতার বই খুলি না কতোদিন। নীরোদ চন্দ্র চৌধুরীর কয়েকটি বই আবার পড়ব ব’লে বেডের পাশে রেখেছিলাম। বইগুলো খোলাই হয়নি।
গ্রন্থ ডট কম থেকে অনেকগুলো দুস্প্রাপ্য বই ডাউনলোড ক’রে রেখেছিলাম। একটি পাতাও খোলা হয়নি।
গত ৪-৫ বছরে এমন কোনো সপ্তাহ নেই “উত্তরের গান”-এ রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কিছু না কিছু লিখিনি। কোনো প্রিয় শিল্পীর গান পোস্ট করিনি। গত দু’সপ্তাহে দায়সারা গোছের দু’একটি মৃত্যু সংবাদ ছাড়া তেমন পোস্ট নেই।
মার্চ ব্রেক এ ছুটি নিয়েছিলাম আগেই। কোথাও যাব না, ছুটি বাতিল করে প্রথম দিন অফিস গেলাম। বিরাট সুপারমলের উপরে অফিস। সবাই কেমন যেনো ভীত-সন্ত্রস্ত। অফিসেও কেমন থমথমে ভাব। নিজেও ভয় পেয়ে “ছুটি বাতিল” আবার বাতিল করলাম। পরের দিন থেকেই “ওয়ার্ক ফ্রম হোম”। বোঝো ঠ্যালা! ছুটি তো আর পূনর্বার বাতিল করতে পারি না!
বাসায় থাকি। টিভি দেখি, সোস্যাল মিডিয়া দেখি। সবখানেই “করোনা”। যতো দেখি, ততো ভয় হয়। ভয়ে সকালে দাড়ি-গোঁফ কামাই না। ভয় নিয়ে ঘুমাই, ভয় নিয়ে উঠেই আবার সেই মিডিয়ার ভয়ের বাক্স দেখি।ইতালিতে মৃত্যু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। স্পেন, ইরান,বিশ্ব-মোড়ল আমেরিকা ছাড়িয়ে নিজের শহরে, নিজের পাড়ায় করোনা এসে গেছে। ভয়ে কাঁপতে থাকি।
বাড়ির ( দুই বাড়ির) একমাত্র ছেলে। আদরের ধন। ‘বাপ মায়ের এক পুত, মইর্যা গেলেই ফুসুৎ”। তাই মোটা্মুটি বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা নিয়েই বড় হয়েছি যেন বজ্রপাতেও না মারা যাই। ফলে যা হবার তাই। রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতাও কম। বৃষ্টিতে ভেজার বড় শখ। কাব্যিক রাতের আকাশ দেখার শখ শীতের রাতে কুয়াশায় মাথা ভিজিয়ে। অথচ বৃষ্টির জল মাথায় নিলেই জ্বর। অথচ তখনো জানিনা, বিধাতা অদৃশ্যভাবে হাসছেন ভবিতব্যের কথা ভেবে।
কানাডা নামের একটি দেশ আছে, জানতাম। আলাস্কা কিংবা উত্তর মেরুর কাছের এই দেশে মানুষ কিভাবে বাস ক’রে সে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতাম। খুব সহানুভূতিও হ’তো এদের দুর্দশার কথা চিন্তা ক’রে। কিন্তু অদৃশ্য বিধাতা সেখানেই আমার বাস নির্ধারণ করে রেখেছেন স্বপ্নেও চিন্তা করি নি। অথচ সেখানেই আছি প্রায় দেড়-দুই দশক। বছরের অর্ধেকের বেশী শীতের আবহাওয়া। তাই প্রায় শীতকালই ঠান্ডায় কাবু থাকি। দেড় দশকের প্রায় প্রতিটি শীতেই দু’একবার “সিকলিভ” নেইনি এমন উদাহরণ নেই।
এবার যোগ হয়েছে নতুন উপদ্রুপ, করোনা ভাইরাস। যত টিভি দেখি, ততো ভয় পাই। মনে হয় প্রায় সব লক্ষণই তো আমার বিদ্যমান। থারমোমিটার দিয়ে জ্বর মাপি। না জ্বর নেই। কাশি তিন সপ্তাহ। বুকে ব্যথা নেই। হয়ত বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেও একটু টান লাগলো। চিন ক’রে ব্যথা। করোনা লক্ষণের কথা মনে হয়। একি তবে শ্বাস কষ্টের লক্ষণ? ডাক্তারকে টেলিফোন করি। ডাক্তার আশ্বস্ত করেন, তোমার তো প্রতি শীতেই এরকম হয়। কিছু ওষুধ লিখে দেন। তবুও ভয় যায় না। লবন-লেবু-মধু্র সাথে গরম জল মাইক্রো ওভেনে ফুটতেই থাকে। পারলে মৃত্যুর এপিটাফ লিখে রেখে “মি-ওনলি” ক’রে রাখি- যেনো “করোনা” হ’লেই “পাবলিক” করে দেবো।
একি শুধু আমার? সারা পৃথিবী থমকে আছে “ করোনা” আতঙ্কে। অনেকের মতো আমিও ভুলে আছি প্রাত্যহিক দিনলিপি। ভুলে আছি উৎসব, আনন্দ-আয়োজন। ছেলে কয়েকটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। নিজেও আরেকটি বড় প্রকল্পে নিয়োগ পেয়েছি। এরকম ছোটো ছোটো সফলতাগুলোও উদযাপন করতে ভুলে গেছি। এমনি এক দুঃসময়ের মধ্যে কেটে যাচ্ছে দিন। টিভি, সংবাদপত্র, সোস্যাল মিডিয়া সে দুঃসময়কে দুঃসহ করে তুলছে দিনে দিনে। এ থেকে মুক্তি আসবে, কিন্ত ততোদিনে বিশ্বের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। অর্থনীতিসহ সামাজিক মানবিক বিপর্যয় কতো দূর গিয়ে ঠেকবে কে জানে?
উন্নত বিশ্ব এতোদিন ধন-সম্পদ-প্রযুক্তির দম্ভে বিশ্ব কাঁপিয়ে বেড়িয়েছে। অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে অন্যকে মারার হুমকি দিয়ে এসেছে, তারাই এখন “করোনা ভাইরাস”-এর ভয়ে কাঁপছে। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে, প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে নষ্ট ক’রে যাঁরা এতোদিন তথাকথিত সভ্যতা গড়ার দিকেই শুধু নজর দিয়েছে, এবারের এই মহাদুর্যোগ থেকে তারা শিক্ষা নেবে কি?
নিজেই মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষ একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের ভয়ে নিজেদের বিলুপ্তির ভয়ে সন্ত্রস্ত। অথচ এই মানুষই যে যুগের পরে যুগ কতো জীব-অনুজীব-প্রাণী-উদ্ভিদকে ধ্বংস করেছে, সে হিসেব কি করেছি আমরা কখনো? ছোটবেলায় বানর দেখেছি প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়। শেয়ালের ডাকে ঘুমিয়ে যেতো গ্রামের প্রতিটি শিশু। প্রজাপতি, ঘাস ফড়িংসহ কতো রকমের পোকামাকড় ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কতো রকমের ব্যাংগ ছিল। ছিল অসংখ্য সরীসৃপ। সেগুলোর কিছুই অবশিষ্ট নেই। হয়ত মানুষ মেরে ফেলেছে, খেয়ে ফেলেছে কিংবা নানান রকমের রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাবে নিজেরাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্ত মানুষকে বেঁচে থাকতে হ’লেও এ সকল জীব-অনুজীব বা প্রাণীকুলের দরকার আছে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষিত না হ’লে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ ক’রে ক’রে মানুষও কি রক্ষা পাবে?
মানুষ রক্ষা পাক। সভ্যতা -মানবিকতা রক্ষা পাক। রক্ষা পাক প্রকৃতি, প্রাণীকূলসহ প্রাকৃতিক ভারসাম্য। বিশ্ব-উষ্ণায়ণের ফলে কতো উদ্ভিদ-প্রাণীর জীবন বিপন্ন হ’তে চলেছে এই পৃথিবী থেকে। আজকের বিপন্ন মানুষ একদিন এই বিপন্ন প্রকৃতি রক্ষায় তাদের মেধা-বুদ্ধি খাটাবে কি?
ভালো থাকুক সবাই। মানুষ শুধু নয়, এ বিশ্বের প্রাণী-উদ্ভিদকূল সবাই ভালো থাকুক।
( হ্যামিল্টন, কানাডা, মার্চ ২৬,২০২০)
প্রিয় লেখক, আমাকে করোনা দিন লেখাটা পড়লাম। খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন এই সময়ের দৈনন্দিন ভীতিগুলো।