ধরুন আমি আপনাকে একটি সংখ্যা দেখালাম ৫৫। এই ৫৫ দেখে আপনি কি বুঝবেন? আপনি বুঝতে পারবেন আপনাকে আমি ঠিক কি পরিমান কোনো বস্তু বা কোনো কিছুর মান বা অন্য কোনো একটি সংখ্যাবাচক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছি। যেমন: আমি যদি বলি ৫৫ টি আম, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন বা কল্পনা করতে পারবেন কি পরিমান আমের কথা আমি বলতে চাইছি। হয়তোবা আপনি কল্পনার মানসপটে এক ঝুড়ি আম দেখতে পাবেন যাদের সবগুলো মিলে ৫৫ টি আম হবে। আবার আমি হয়তো বললাম ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। আপনি এর মাধ্যমেও কল্পনায় একটি নির্দিষ্ট পরিমান উষ্ণতা অনুভব করতে পারবেন। কিন্তু ৫৫ কি একটি সংখ্যা? ৫৫ আসলে সংখ্যার একটি প্রতীক, এটি কিন্তু আদৌ কোনো সংখ্যা নয়। আমি এভাবে না লিখে ‘পঞ্চান্ন’ লিখলেও আপনি একই সংখ্যা উপলব্ধি করেত পারতেন যদিও এই ক্ষেত্রে প্রতীকটি সম্পুর্ণ ভিন্ন।

৫৫ প্রতীকটির একটি সুবিধা আছে। আপনাকে যদি এই প্রতীকের নির্দেশক সংখ্যাটির সাথে একই সংখ্যা যোগ করতে বলা হয় আপনি চট করেই তা করে ফেলতে পারবেন এবং সেই প্রতীকটিও লিখে ফেলতে পারবেন। প্রতীকটি হলো ১১০। কিন্তু কেমন হতো যদি একটি প্রতীক থেকে তার সাংখ্যিক মানটি বের করা দুঃসাধ্য হতো? আজ মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেকদূর এগিয়েছে। সবকিছুতেই তার আধুনিকায়ন হয়েছে। সংখ্যার প্রতীকের ক্ষেত্রেও তাই সে সহজ একটি ব্যবস্থার প্রচলন ঘটাতে পেরেছে যে ব্যবস্থায় কোনো প্রতীকের দিকে তাকালেই সেই প্রকৃত সাংখ্যিক মানটি কল্পনা করে নিতে পারে। শুধু তাই নয়, একাধিক সংখ্যার প্রতীকটি দেখেই সে খুব সহজেই নানাবিধ হিসেব-নিকেষ, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি করে ফেলতে পারে।

কিন্তু মানুষের সভ্যতা সবসময় এমন উন্নত ছিলো না। সভ্যতার উষালগ্নে তাই মানুষের সংখ্যা-ব্যবস্থাও এত সহজ ও উন্নত ছিলো না। এমনকি মানুষ একসময় শূন্য সংখ্যাটিও ব্যবহার করতে জানত না, ক্রমে তাকে শূন্য সংখ্যাটির ব্যবহার শিখতে হয়েছে এবং সংখ্যা ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটাতে হয়েছে। প্রথম যখন মানুষ গুনতে শিখেছে তখন এখনকার মতো বড় বড় সংখ্যা ব্যবহারেরই প্রয়োজন হতো না। এমনকি বর্তমান সময়েও কিছু কিছু সভ্যতায় বড় সংখ্যা ব্যবহারের প্রচলন নেই। মনোবিজ্ঞানী জেয়ার্ড ডায়মন্ডের লেখা হতে পাওয়া যায়, নিউগিনির কিছু গ্রামে কেবল দুটি সংখ্যা প্রচলিত। ‘এক’ বোঝানোর জন্য আইয়া (iya)’ এবং ‘দুই’ বোঝানোর জন্য ‘রারিডো (rarido)’! এর চেয়ে বড় সংখ্যার জন্য স্থুলভাবে ‘অনেক’ বলে দেওয়া হয়। আর, সুস্পষ্ট করতে হলে এই দুটি সংখ্যার নানাবিধ সমষ্টি ব্যবহার করা হয়। যেমন: চার বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয় রারিডো-রারিডো এবং পাঁচ বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় রারিডো-রারিডো-আইয়া।

ক্রমে কৃষি এবং পশুপালনক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে সাথে বড় বড় সংখ্যার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকল; চালু হলো দাগ টেনে সংখ্যা প্রকাশ করার। খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০ বছর আগে সুমেরীয় এবং অন্যান্য সভ্যতার মানুষেরা লাঠি বা মাটির ব্লকে দাগ টেনে পশুর সংখ্যা বা ফসলের পরিমান ইত্যাদির হিসেব রাখত। এধরনের টানা দাগকে বলা হয় টালি চিহ্ন। পরবর্তীতে চারটি দাগ পাশাপাশি দেওয়া হলে পঞ্চম দাগটি দিয়ে বাকী চারটি দাগ কেটে দিয়ে পাঁচ বোঝানো হতো। এভাবে পাঁচটি দাগের একেকটি গ্রুপ করে সংখ্যা প্রকাশে গণনা করা অনেক সহজ হয়ে গেলো। একটি একটি করে গণনা না করে পাঁচটি করে দাগ একবারে গণনা করতে সময় অনেক কম লাগে এবং ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। দাগ না কেটে অনেক সময় নুড়ি ইত্যাদির স্তুপ করেও এধরনের সংখ্যার গ্রুপ তৈরি করা হতো। এই টালি ব্যবস্থা দুনিয়াতে বিভিন্ন স্থানে এখনো প্রচলিত আছে।

প্রাচীনসভ্যতা থেকে উদ্ধারকৃত নমুনা যাতে দাগ টেনে হিসেব রাখার নিদর্শন রয়েছে।

প্রাচীনসভ্যতা থেকে উদ্ধারকৃত নমুনা যাতে দাগ টেনে হিসেব রাখার নিদর্শন রয়েছে।

বোঝাই যাচ্ছে, সংখ্যা কিঞ্চিৎ বড় হয়ে গেলে এই পদ্ধতিতে কাজ চালানো দুষ্কর। মিশরীয়রা তাই আরেকটু উন্নত পদ্ধতি গ্রহন করেছিলো। তাদের চিন্তাধারায় ছিলো বিশালতা, পিরামিডের মতো বিশাল স্থাপনা নির্মান থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাই তাদের বড় বড় সংখ্যাও ব্যবহার করতে হতো। তারা প্রতিটি পুর্ণসংখ্যার জন্য একটি করে চিহ্ন না নিয়ে, দশগুনোত্তর হারে ভিন্ন ভিন্ন চিহ্ন নিত। যেমন: ১ এর জন্য ׀, ১০ এর জন্য ∩, ১০০ এর জন্য ⱷ ইত্যাদি। এভাবে আধুনিক দশমিক ব্যবস্থার ৩৭৬,২৪৮ সংখ্যাটি লিখতে হলে তাদের প্রতীকটি হতো নিন্মরূপ:
egiptian hyarogliphics

এটি আপতদৃষ্টিতে দুর্বোধ্য দেখালেও এই পদ্ধতি অন্ততঃ বড় বড় সংখ্যা প্রকাশ করা যায়। এই পদ্ধতিতে চিহ্নের ক্রম গুরুত্বপুর্ণ নয় তবে হিসেবের সুবিধার জন্য বড় সংখ্যাসূচক চিহ্নটিকে বাঁয়ে এবং ক্রমান্বয়ে চোট সংখ্যার চিহ্নটিকে ডানে রাখা হয়। দুটি সংখ্যা যোগ করতে হলে স্রেফ সংখ্যাদুটির চিহ্নগুলোকে একীভুত করে নিলেই চলে। বিয়োগের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

প্রাচীর রোমানরা আরেকধরনের সংখ্যা ব্যবস্থা চালু করেছিলো যেটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। তারা সংখ্যা প্রচার করার জন্য বর্ণমালার বিভিন্ন বর্ণ ব্যবহার করত যার প্রচলন এখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে। যেমন: ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলো বোঝানো হয় যথাক্রমে I, II, III, IV, V, VI, VII, VIII, IX, X দিয়ে।

এই সবগুলো সংখ্যা পদ্ধতি সমসাময়িক প্রয়োজন মেটাতে পারলেও সংখ্যাটি একটু বড় হয়ে গেলে গণনা করা কমবেশী দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া দেখামাত্রই মূল সাংখ্যিক মানটি আন্দাজ করে নেওয়া সহজ হয় না। কিন্তু এই সবগুলো ব্যবস্থারই একটি বড় ধরনের ত্রুটি ছিলো যার ফলে চাইলেও সংখ্যা-ব্যবস্থাটি সহজসাধ্য করার সুযোগ ছিলো না। সেটি হলো শূন্যর অনুপস্থিতি! এবং এর জন্য আমাদের স্মরণাপন্ন হতে হবে ভারতীয় সংখ্যা-ব্যবস্থার প্রতি।

আমরা বর্তমানে সংখ্যা প্রকাশক যে চিহ্নগুলো ব্যবহার করি যেমন, 1, 2, 3, 4… ইত্যাদি এগুলোর উৎপত্তিমূলতঃ ভারতে। খ্রীষ্টপুর্ব ৫০০ অব্দ থেকে ভারতীয়রা ০-৯ পর্যন্ত অংকগুলো ব্যবহার করে নানাবিধ গণনার কাজ করত। হরপ্পা সভ্যতায় এই ধরনের গণনার নিদর্শন রয়েছে। ভারতীয়দের কাছ থেকে এই চিহ্নগুলো আরবে পৌঁছায় এবং ক্রমশঃ পশ্চিমা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। আরবদের কাছ থেকে পশ্চিমারা পেয়েছে বলে এই চিহ্নগুলোকে আরবীয় চিহ্ন বলা হয় যদিও চিহ্নগুলোর উৎপত্তি হয়েছিলো ভারতে। কিন্তু সংখ্যা ব্যবস্থায় ভারতীয়দের মুল অবদান হলো শূন্যের প্রচলন। ভারতীয়দের আগে কেউ শূন্য ব্যবহার করতে জানত না। যার ফলে তারা একটি সহজ সংখ্যা-ব্যবস্থার প্রচলন করতে ব্যর্থ হয়। অবশ্য শূন্য সংখ্যাটি যে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অজানা ছিলো তা নয়। কিন্তু তথাপি তারা তাদের সংখ্যায় শূন্য ব্যবহার করেনি কারন তারা শূন্যকে অপয়া এবং অভিশপ্ত ভাবত।
Num_hindu_arabic

পীথাগোরাস গ্রীকসভ্যতার একজন নামকরা গণিতবিদ ছিলেন কিন্তু তিনি শূন্যের ব্যবহার অনুমোদন করতেন না। এই বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। তাঁর বিরাট অনুচরের দল ছিলো তাদের কেউ কখনো শূন্য নিয়ে কথা বললে তিনি তাদের মৃত্যুদন্ড দিয়ে দিতেন! তিনি বিভিন্ন সংখ্যাকে মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে আরোপ করতেন এবং সংখ্যা-পুজা জাতীয় একটি বিষয় এখান থেকে চালু হয়েছিলো।

সে যা-ই হোক, ভারতীয়রা সংখ্যা ব্যবস্থায় শূন্যের প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন এবং শূন্য ব্যবহার করে সংখ্যার আধুনিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করলেন যা স্থানীয়মান ভিত্তিক। খ্রীষ্টপূর্ব ৪৯৮ সালে প্রাচীনভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট-এর সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি কাব্যে এইরূপ নিদর্শন আছে। তিনি লেখেন “স্থানম স্থানম দশ গুণম” বা “স্থান হতে স্থান দশগুন” যা বর্তমান দশমিক স্থানীয় ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়। এই পদ্ধতিতে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত ভিন্ন সূচকে সংখ্যাগুলো লিখে তারপর আবার চিহ্নের পুনরাবৃত্তি করা হয়। যেমন: ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ এরপর পুনরায় ১ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এবার ১ এর ডানপাশে একটি শূন্য (০) যোগ করে দেওয়া হয়। ফলে একের স্থানীয় মান হয়ে যায় দশ। এই সংখ্যাটির বামপাশে যদি আরেকটি চিহ্ন বসানো হয় তাহলে তার মান হয়ে যাবে তার ডানপাশের সংখ্যাটির দশগুন, এবং প্রথম সংখ্যাটির একশ’ গুন। কাজেই ৫৬৭ এই সংখ্যাটির মান হবে: ৭ + (৬ X ১০) + (৫ X ১০০), অর্থাৎ প্রতিটি সংখ্যার মানকে তার স্থানীয় মান দিয়ে গুণ করতে হবে।

এভাবে স্থানীয় মানভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থার ফলে কেবল মাত্র দশটি চিহ্ন ব্যবহার করে আমরা অসীম পর্যন্ত যেকোন সংখ্যা লিখে ফেলতে পারি। এর ফলে একটি সংখ্যার প্রতীকটি দেখলেই আমরা সেই সংখ্যটির প্রকৃতমানটি কল্পনা করে ফেলতে পারি। শুধু তাই নয় বিভিন্ন ধরনের গণনার জন্যও এই পদ্ধতি খুব কার্যকর হয়। যখনই অঙ্কগুলো ব্যবহার করতে করতে একেবারে শেষে চলে আসব তখনই আরেকটি স্থানীয়মান যোগ করে তার পাশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শূন্য ব্যবহার করে নতুন স্থানে চলে যেতে পারব। এই পদ্ধতিতে তাই প্রতিটি অঙ্কের অবস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতির আরো বড় সাফল্য হলো এটি ভগ্নাংশ গণনা করা শেখায়। এর আগেও গণিতবিদগণ ভগ্নাংশ গণনা করলেও সেটি একটি মাত্র সংখ্যায় প্রকাশ করার সুযোগ ছিলো না। বরং ভগ্নাংশগুলোকে বিভিন্ন গাণিতিক অপারেটর ব্যবহার করে একটি স্থুল অবস্থায় রেখে দিতে হতো। ফলে তার প্রকৃত মান উদ্ধার করা দুরুহ হয়ে পড়ত। কিন্তু এই পদ্ধতিতে একক স্থানীয় অঙ্কের পরে একটি দশমিক বিন্দু ব্যবহার করে তার পরে দশমাংশ, তার পরে শতাংশ এভাবে খুব সহজ পদ্ধতিতে ভগ্নাংশ হিসেব করে ফেলা সহজ হলো। ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন এই বিষয়ক নানাবিধ নমুনা পাওয়া যায়।

সংখ্যা গণনার এ পদ্ধতিটি অত্যন্ত চমকপ্রদ ও আধুনিক হওয়ায় অল্পসময়ের মধ্যে তা পশ্চিমে ছড়িয়ে যায় এবং আরবদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে যায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, ৬৬২ খ্রীষ্টাব্দে ইউফ্রেতিস নদীর তীরে সেভেরাস সেভক্ট নামের একজন বিশপের লেখা থেকে। তিনি ভারতীয় পদ্ধতির উল্লেখ করে লেখেন, “… গ্রীক এবং ব্যবিলনীয়নের পদ্ধতির চেয়ে অনেক চৌকশ এবং এই নম্বর পদ্ধতি অনেক কম বর্ণনামূলক…..।” এই লেখনী থেকে ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতির আরবের অংশ ওঠার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং পরবর্তীতে এটি ইউরোপে পৌঁছায়।

যাহোক, সংখ্যাপদ্ধতির ইতিহাস থেকে বর্তমান পদ্ধতির আবির্ভাব নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন সংখ্যার ভিত্তি দশ হলো। অর্থাৎ একটি অঙ্ক থেকে তার পার্শ্ববর্তী অঙ্ক কেন দশ করে বৃদ্ধি করা হলো। এটিতো অনায়াসে ৭, বা ৯ বা ১১ ইত্যাদি হতে পারত। এর একটি উত্তর পাওয়া যায় আমাদের হাতের দশটি আঙ্গুল থেকে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই হাতের দশটি আঙ্গুল ব্যবহার করে গণনা প্রচলিত থাকায় সেখান থেকেই এই দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছে। অবশ্য এর বাইরেও যে বিভিন্ন সংখ্যার ভিত্তিতে সংখ্যাগণনা প্রচলিত হয়নি তা নয়, তবে শেষপর্যন্ত এটিই প্রচলিত থেকেছে। তবে আধুনিক সময়ে এসে অনেকেই ধারনা করছেন আমাদের সংখ্যা ব্যাবস্থার ভিত্তি ১০ না হয়ে ১৬ হলে গণনা করা আরো সহজ হয়ে যেত। সে যাই হোক নিচে দশভিত্তিক সংখ্যাব্যবস্থার পাশাপাশি আরো কী কী বিভিন্ন সংখ্যা ব্যাবস্থার প্রচলন হয়েছিলো তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

১. ওক্সাপমিন (২৭ ভিত্তিক): নিউ গিনির ওক্সাপমিন মানুষেরা ২৭ ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা ব্যবহার করত। মানবশরীরের ২৭ অঙ্গের চিহ্ন থেকে তারা এই ২৭ ভিত্তিক সংখ্যাব্যবস্থার চিহ্নগুলো তৈরি করে নিয়েছিলো।
২. জটজিল (২০ ভিত্তিক): মায়া সভ্যতায় জটজিল ভাষায় ২০ ভিত্তিক গননা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো যার উদ্ভব ঘটেছিলো হাতের এবং পায়ের মোট বিশটি আঙ্গুল মিলিয়ে।
৩. ইয়োরুবা (২০ ভিত্তিক): নাইজার-কঙ্গো এলাকায় ইয়োরুবা ভাষাতেও ২০ ভিত্তিক গণনা পদ্ধতি চালু ছিলো। তবে এতে অন্য জটিলতা ছিলো। যোগমূলক পদ্ধতির সাথে এতে বিয়োগমূলক পদ্ধতিও ব্যবহার করা হতো, বিস্তারিত উপেক্ষা করছি।
৪. এনডম (৬ ভিত্তিক): পাপুয়া নিউগিনির আরেকটি ভাষা এনডমে ৬ ভিত্তিক গণনা ব্যবহার করা হতো।
৫. হুলি (১৫ ভিত্তিক): পাপুয়া নিউগিনিতে হুলি ভাষায় ১৫ ভিত্তিক গণনা চালু ছিলো।
এসবের বাইরেও আরো নানা আঙ্গিকের নানা ধরনের সংখ্যাব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। এসবের বিভিন্নটিতে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা, অভিনব গণনা কৌশল ইত্যাদি ছিলো।

তবে শুধু প্রাচীন বিভিন্ন ব্যবস্থা নয় বর্তমান সময়েও দশভিত্তিক ব্যবস্থার সাথে সাথে আরো কিছু ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অক্টাল (৮-ভিত্তিক), হেক্সাডেসিমাল (১৬-ভিত্তিক) বাইনারী (২-ভিত্তিক), ইত্যাদি। এই তিনটি ব্যবস্থাই কম্পিউটারসম্পর্কিত বিভিন্ন গণনায় ব্যবহৃত হয়।
প্রথমে অক্টাল ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা যায়। যেহেতু আট-ভিত্তিক তাই এতে অঙ্ক রয়েছে আটটি। ০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭। ৭ এর পরে যেহেতু এর অঙ্ক শেষ তাই এর পরবর্তী সংখ্যাটি হবে ১০। অর্থাৎ দশমিক পদ্ধতিতে ৮ এর মানের সমান হবে অক্টাল পদ্ধতির ১০ এর মান। যেহেতু বিভিন্ন পদ্ধতির সংখ্যার মান বিভিন্ন হয়, তাই এগুলো একসাথে ব্যবহার করলে বন্ধনী ব্যবহার করে তার ভিতরে সংখ্যাটি লিখে বন্ধনীর বাইরে ডানদিকে সাবস্ক্রিপ্ট হিসেবে নিচে ভিত্তিটি লিখে দিতে হবে।

[এখানে যেহেতু সাবস্ক্রিপ্ট ব্যবহার করা যাচ্ছে না তাই ভিত্তিটি পাশে দেখানো হলো] অর্থাৎ, (৮)১০ = (১০)৮

অক্টাল পদ্ধতিতে তাই ১১ হবে দশমিক পদ্ধতির ৯ এর সমান। এভাবে যেতে যেতে অক্টাল পদ্ধতির (১৭)৮ হবে দশমিক পদ্ধতির (১৫)১০ এর সমান। কিন্তু এখন আমরা (১৭)৮ এ এককস্থানে শেষ অংকে চলে এসেছি। তাই এর সাথে এক যোগ করলে এককস্থানে ০ হয়ে যাবে এবং ডানপাশে হয়ে যাবে ২।
অর্থাৎ, (১৭)৮ + (১)৮ = (২০)৮ = (১৬)১০
কাজেই দশমিক পদ্ধতিতে যা ১৬, অক্টাল পদ্ধতিতে তাই ২০।

হেক্সাডেসিমাল পদ্ধতিতে মোট অঙ্ক ১৬ টি, তাই এতে চিহ্নেরও প্রয়োজন হবে ১৬ টি। প্রচলিত দশমিক পদ্ধতির ১০ টি চিহ্নের সাথে বর্ণমালার A, B, C, D, E, F চিহ্নগুলো মিলিয়ে মোট ১৬ টি চিহ্ন দিয়ে এই সংখ্যাগুলো প্রকাশ করা হয়। তাই ১৬ ভিত্তিক ব্যবস্থায় ৯ এর পরে ১০ না এসে, আসে A, তারপর B, তারপর C ইত্যাদি।
অর্থাৎ, (৯)১০ = (৯)১৬,
(১০)১০ = (A)১৬,
(১১)১০ = (B)১৬
এভাবে, (১৫)১০ = (F)১৬।

অর্থাৎ, দশমিকে যা ১৫, ষোলভিত্তিতে বা হেক্সাডেসিমালে তা F। F-ই হচ্ছে হেক্সাডেসিমালের সবচেয়ে বড় অঙ্ক। তাই এর সাথে ১ যোগ করলে তা দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাবে। এককস্থানীয় অঙ্কটি শূন্য হয়ে যাবে এবং এর বামপাশে ১ বসবে।
অর্থাৎ, (F)১৬ + (১)১৬ = (১০)১৬ = (১৬)১০ = (২০)৮

বাইনারি পদ্ধতি:
এই পদ্ধতির সংখ্যা ব্যবস্থায় অঙ্ক কেবল দু’টি, ০ এবং ১। অর্থাৎ এই সংখ্যা ব্যবস্থা প্রথমে ০ দিয়ে শুরু হয়, তারপরে আসে ১, তারপরে এর যেহেতু অঙ্ক নেই তাই লিখতে হবে ১০! অর্থাৎ দশমিকে যা ২, বাইনারিতে তা ১০। দশমিকে যা ৩, বাইনারিতে তা হবে ১১। এই সংখ্যাটির পরে বাইনারির পরবর্তী সংখ্যাটি হবে ১০০, যা দশমিকে প্রকাশ করলে হবে ৪।
অর্থাৎ, (৪)১০ = (১০০)২,
(৫)১০ = (১০১)২,
(৬)১০ = (১১০)২,
(৭)১০ = (১১১)২,
অতঃপর,
(৮)১০ = (১০০০)২,
অর্থাৎ, দশমিক পদ্ধতিতে যা ৮, বাইনারী পদ্ধতিতে তা ১০০০। এই বাইনারী পদ্ধতিই হলো আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতি। কম্পিউটারের অধিকাংশ গণনা সম্পর্কিত কাজ বাইনারী পদ্ধতিতে হয়। কম্পিউটারের কাজে এই পদ্ধতিটি বিশেষভাবে উপযোগী যদিও দেখা যাচ্ছে একটি সংখ্যা বড় হতে থাকলে খুবদ্রুতই এর অঙ্কের পরিমান বৃদ্ধি পায়। তবে এই পদ্ধতিতে যেহেতু কেবল দুটি অঙ্ক, তাই এগুলোকে ইলেক্ট্রনিক্সে সংকেতের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি এভাবে প্রকাশ করা যায়। এবং কেবলমাত্র দুটি দশা থাকায় গণনায় ভুলও হয় কম। বিভিন্ন লজিক গণনায় একে সত্যা/মিথ্যা এই দুটি দশায় উপস্থাপন করা যায় এবং গণনার পদ্ধতিটিকে বেশ সরলভাগে ভাগ করে ডিজাইন করা যায়। চার্জের উপস্থিতি/অনুপস্থিতি, চুম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতি/অনুপস্থিতি ইত্যাদি ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণ করেও রাখা যায় খুব সহজে।

উপরে যে চারটি আধুনিক সংখ্যা ব্যবস্থা আলোচনা করেছি সেগুলোকে এক ব্যবস্থা থেকে সহজেই অন্য ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করে ফেলা যায়। তবে বাইনারি থেকে অক্টাল বা হেক্সাডেসিমালে খুব সহজেই এমনকি, শুধু মাত্র চোখে দেখেই মুখে মুখে রূপান্তর করে ফেলা যায়। কেননা বাইনারি থেকে দ্বিগুণ করে বাড়ালে অক্টাল, হেস্কাডেসিমাল ইত্যাদি পাওয়া যায়। তাই একটি বাইনারি সংখ্যার তিনটি বা চারটি করে অঙ্ক নিয়ে সেগুলোকে যথাক্রমে অক্টাল বা হেক্সাডেসিমালে রুপান্তর করে পাশাপাশি সাজালেই সেই বাইনারী সংখ্যাটি অক্টাল বা হেক্সাডেসিমালে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই কারণেই ইদানিং অনেকে বলছেন আমাদের সংখ্যাব্যবস্থা দশভিত্তিক না হয়ে ষোলভিত্তিক হলে গণনা অনেক সহজ হতো। অপরদিকে এই সংখ্যাগুলোকে দশমিক পদ্ধতিতে প্রকাশ গেলেও মুখে মুখে তা করা দুষ্কর, বরং কিছুটা অতিরিক্ত গণনা করতে হয়।

সবশেষে ইন্টানেটে ঘুরে বেড়ানো একটি কৌতুক রইল সবার জন্য: “পৃথিবীতে মানুষ ১০ ভাগে বিভক্ত। এদের মধ্যে একটি ভাগ বাইনারি সংখ্যা-ব্যবস্থা জানে, আর অপর ভাগটি জানে না। “