লিখেছেনঃ সুমন চৌকিদার

বদরুদ্দীন উমর সাহেব,

“বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?” (যুগান্তর ৫/৬/১৬)। লেখাটি পড়ে কিছু কথা না লিখে পারলাম না। প্রধানত,
আপনি জাতিগত ও ভাষাগতদের প্রকৃত সংখ্যালঘু বলেছেন, হিন্দুদের নয় এবং সামপ্রদায়িকতার জন্য বিজেপিকেই দায়ী
করছেন। আপনি বলেছেন, “বাংলাদেশে সাঁওতাল, গারো, হাজং, রাখাইন, উর্দুভাষী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি জাতিগত
সংখ্যালঘুর ওপর যে অবর্ণনীয় নির্যাতন হয়, তার কথা সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে বিশেষ পাওয়া যায় না। অথচ নীরবে
তাদের ওপর নির্যাতনের শেষ থাকে না।”

জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুরা যে অত্যাচারিত হচ্ছে না, অস্বীকার করছি না। তবে আপনি তাদের উপর যে
নিরব অত্যাচারের কথা বলেছেন, সেরূপ নিরব অত্যাচারে সব সংখ্যালঘুরাই অত্যাচারিত, যা অস্বীকার করায় বিক্ষুব্ধ হয়েছি।
জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের কথা মিডিয়ায় যেটুকু আসে, সেটুকুই কী যথেষ্ট নয়? কারণ, এদের
বেশিরভাগই বাস করে দেশের প্রত্যন্ত এবং দুর্গম অঞ্চলে। আর বৃহত্তর সংখ্যালঘুরা (হিন্দু) বাস করে দেশের সর্বত্রই। আরো
বলছেন, হিন্দুদের উপর অত্যাচার হলে ভারত এদেশের সরকারকে হুমকি দেয়। কয়টা হুমকি দিয়েছে নির্দিষ্ট করে বলেননি।
হুমকি দিলেও বা, তাতে কোনো লাভ হয়েছে কী? হয়নি। কারণ ধারাবাহিকভাবেই নিরবে এবং প্রকাশ্যে সব সংখ্যালঘুরাই
নির্যাতিত হয়েই চলেছে। মনে রাখবেন, ভারতের দাদাগিরিতে আর যাইহোক সংখ্যালঘু নির্যাতন ঠেকানো যাবে না। ওরা
দাদাগিরি করে সম্পদের জন্য, সংখ্যালঘুদের জন্য নয়। যাহোক, শতকরা হিসেবে বৃহত্তর সংখ্যালঘুদের চাইতে জাতিগত
সংখ্যালঘুরা এখনো অনেক ভালো আছে বলেই মনে করি। অতএব, আপনার বক্তব্যটি মিথ্যা। কারণ অন্য সংখ্যালঘুরা যদি
শতকরা ১০ জন অত্যাচারিত হয়, হিন্দুরা হয় ৯০ জন।

আপনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের অত্যাচারের খবর রাখেন না। ৭১এর পর আমার গ্রামের ৩০/৪০টি সংখ্যালঘু পরিবার
উধাও হয়ে গেছে। মূলত উধাও করা হয়েছে। যেহেতু তারা অত্যাচারিত হলে বিচার পায় না, বিচারপ্রার্থী হলেই পুলিশ এবং
প্রশাসনের পোয়াবারো, এমনকি আদালতেও হয়রানি হতে হয়, সেহেতু তারা অন্য দেশের কাছে নালিশ করতেই পারে। এতে
যদি সম্মান হানি হয়, তাহলে তাদের উপর ধারাবাহিকভাবে অত্যাচারে কী আপনাদের মানসম্মান বাড়ে? মানুষ চাপে বা
বিপদে পড়লে, একটু আশ্রয়ের জায়গা, সান্ত্বনা পাবার আশায় খড়কুটো আঁকড়ে ধরবেই, এটাই তো স্বাভাবিক। যেহেতু
পুলিশ, প্রশাসন, মন্ত্রী, এমপিরা পর্যন্ত তাদের নালিশ শুনেও শোনে না, দেখেও দেখে না, বরং রামু-উখিয়ার ন্যায় ধ্বংসযজ্ঞ
ঘটাতে পেছন থেকে ইন্ধন দেয়… কারণ সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনে ওরাই বেশি লাভবান হয়। বাস্তবে দেশে যতো
সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘটে এর সিংহভাগই প্রকাশ পায় না। যেমন, প্রথমত সংখ্যাগুরুরা (রাজনৈতিকসহ সব শ্রেণিপেশার) আস্তে
আস্তে
অত্যাচার শুরু করে, সংখ্যালঘুদের বাড়ির তুলসি গাছ কেটে ফেলে, চিতা ধ্বংস করে, মূর্তি ভাঙ্গে, ঘরের দরজায় গরুর
মাথা, ভূড়ি ফেলে রাখে, গরু-ছাগল ছেড়ে ফসল খাওয়ায়, গরু-খাসি চুরি করে খেয়ে ফেলে, প্রতিবাদে মাথা ফাটায়, গ্রাম্য
মাতবর, এমনকি থানা-পুলিশের কাছে গেলেও লাভ হয় না…। এরূপ প্রাথমিক নির্যাতনগুলোর অধিকাংশই পত্রপত্রিকায়
প্রকাশ পায় না এবং আপনাদের দৃষ্টিতে তা মোটেও সামপ্রদায়িকতা নয়। অথচ এসবই দেশের প্রতিদিনকার চিত্র। কেবলমাত্র
রামু-উখিয়ার মতো বড় বড় ঘটনা ঘটলেই সকলের টনক নড়ে এবং সামপ্রদায়িকতা বলে কিছুটা উহ্‌-আহ্‌ করেই ক্ষান্ত দেই,
আবার ঘটে আবার উহ্‌-আহ্‌। এমন ঘটনা যতো ঘটে, আপনাদের কুম্ভীরাশ্রুও বাড়ে, লেখালেখির খোরাক পান, ফলে আয়ও
বাড়ে। এই তো চলছেই…। মূলত আপনারা কুয়োর ব্যাঙ, তাই পত্রিকার খবর পড়েই উহ্‌-আহ্‌ করেন, বাস্তবতার সাথে
যোগাযোগ নেই।

বাস্তবতা বড়ই কঠিন। সংক্ষেপে এর ১টি উদাহরণ (আমার গ্রামের ঘটনা)। ১৯৮০ বা ৮২ সালের কথা। একদিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি প্রতিবেশি তিনটি ঠাকুরবাড়ির সবচেয়ে বড় ঠাকুর পরিবারটি নেই, সেখানে এক গ্রাম্য মাতুব্বর
(সংখ্যাগুরু) এসে উঠেছে। উঠেই পার্শ্ববর্তী অন্য দুই ঠাকুর পরিবারের প্রতি অত্যাচার শুরু করলেন। এর প্রতিশোধ নিতে
(বাকি দুই ঠাকুর পরিবারের) এক সাহসী যুবক মাতুব্বরের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মাতুব্বর তার দুই
ছেলেকে ঢাকা পাঠায়। বহুদিন খোঁজাখুঁজি করে তাদের বোনকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এর বছরখানের মধ্যেই ঠাকুরের ওই
ছেলে গুম হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ তার পরিবার বা প্রতিবেশিরা জানে না। এ নিয়ে তারা কোনো মামলাও
করেনি এবং পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশ হয়নি। হলে, হয়তো বাকিরাও গুম হয়ে যেতো। এভাবেই সারা দেশের বহু সংখ্যালঘু
নির্যাতনের খবরই আমরা জানি না। উমর সাহেব এসব যদি সামপ্রদায়িক না হয়, তাহলে সামপ্রদায়িকটা কী জিনিস, বুঝিয়ে
বলবেন কী?

(আমার ধারনা), সামপ্রদায়িকতা মূলত দুই প্রকার। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান। অদৃশ্য সামপ্রদায়িকতার শিকার সব
সংখ্যালঘুরা; তবে দৃশ্যমান সামপ্রদায়িকতা শিকার সব সংখ্যালঘু। উদাহরণস্বরূপ, খৃস্টানরা দৃশ্যমান সামপ্রদায়িকতার
শিকার হয় না বললেই চলে (যদিও বর্তমানে চলছে), তবে অদৃশ্য সামপ্রদায়িকতার শিকার (নিচে দেখুন)। সামপ্রদায়িকতা
প্রায় ১০০% ধার্মিকের মনে সুপ্ত অবস্থায় থাকে, যা সামান্য উষ্কানিতে আগ্নেয়গিরির রূপ নেয়। এর বহু উদাহরণের মধ্যে
অন্যতম রামু-উখিয়া। অদৃশ্যমান সামপ্রদায়িকতা সম্পর্কে আপনাদের কোনো ধারনা নেই, কারণ আপনারা সংখ্যাগুরু
সমপ্রদায়ের প্রতি দুর্বল।

আপনি দাবি করছেন, “…বিজেপির প্রতিনিধি দলের এসব কথাবার্তা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং সাম্প্রদায়িক
উসকানিমূলক এতে সন্দেহ নেই। কারণ বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের ওপর এ ধরনের কোনো নির্যাতন বাস্তবত
নেই।”
সবিনয় প্রশ্ন, আপনি কী বাস্তব বাংলাদেশে বাস করেন নাকি অন্য গ্রহে বাস করছেন? আমাদের জাতিয় ক্যান্সার কী
জানেন? দায় চাপানো সংস্কৃতি। অর্থাৎ নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানো। এটা রাজনীতিতে যেমন সত্য, সমাজে-সংসার
এবং ধর্মেও তেমনি সত্য। লক্ষ্য করলে দেখবেন, এক ধর্মজীবি একটা ব্যাখ্যা দিলে, অন্য ধর্মজীবি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান
করবেই। অর্থাৎ আমি ঠিক অন্য সকলেই ভুল, এমন এক সংস্কৃতিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ভাববেন না, যে বিজেপিকে
সমর্থন করছি। বিজেপি সামপ্রদায়িক কিংবা অসামপ্রদায়িক কিনা, সবাই জানে। সামপ্রদায়িক দল বা গোষ্ঠিগুলো নিজের
দেশেসহ অন্য দেশে সামপ্রদায়িক বিরোধ লাগবে এটাই তো স্বাভাবিক। না হলে সামপ্রদায়িক দল বা গোষ্ঠি হতো না। প্রশ্ন
হলো, আমরা নিজেরাও কী সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি চাই? নাকি বাস্তব অর্থে এদেশে তা কোনোদিন ছিলো? আপনারা
(বুদ্ধিজীবীরা) বলছেন, বাংলাদেশ একটি অসামপ্রদায়িক দেশ! আসলে কী তাই? যে দেশের ধর্মরাষ্ট্র আছে, সেই দেশ
অসামপ্রদায়িক হয় কীভাবে? ধর্মরাষ্ট্র না থাকলেও, যে দেশে ধর্মের এতো উম্মাদনা, ধর্ম অবমাননার কথা শোনামাত্রই প্রায়
শতভাগ মানুষ দিকবিদ্বিগ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে… সেই দেশ কীভাবে অসামপ্রদায়িক হয়? ধর্মের মধ্যেই যখন সামপ্রদায়িকতার
বীজ, বেড়ে ওঠা এবং নিজ নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ দাবি করাই যখন ব্রত, তখন অসামপ্রদায়িক হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা
যদি অসামপ্রদায়িকই হবো, তাহলে দেশবিভাগের সময়কার ২৮ ভাগ হিন্দু কেন ৮ ভাগে ঠেকলো (মতান্তরে ৭ ভাগ), এ
প্রশ্নের উত্তর কী উমর সাহেব? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝি, অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ বলতে আপনারা যা বোঝান, সেটা
একধরনের ভন্ডামি। ঢাকা শহরের আংশিক অসামপ্রদায়িকতা দেখে আপনি পুরো দেশের চিত্র বোঝাতে চেয়েছেন, যা
আপনার অজ্ঞতা বা ভন্ডামি। এটা ঠিক সামপ্রদায়িকতা ঘটায় কিছু লোক কিন্তু নিরব সমর্থন দেয় প্রায় শতভাগ ধার্মিক
(যেহেতু এদেশে প্রায় শতভাগই ধার্মিক), না হলে প্রকাশ্যে এবং বাসায় ঢুকে দিনদুপুরে হত্যা করার মতো সাহস ওরা পেতো
না। তাছাড়া পরিবার এবং সমাজের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া সামপ্রদায়িকতা বাঁচতে পারে না। অর্থাৎ সামপ্রদায়িকতার প্রাণকেন্দ্র
হলো- পরিবার, সমাজ ও ধর্মালয়।

এছাড়া, বিজেপির সন্ত্রাসের যে প্রতিবাদ ভারতে হয়, এর একটি প্রমাণও কী বাংলাদেশে দেখাতে পারবেন? যেমন,
কয়েক মাস পূর্বে ভারতে এক বৃদ্ধকে (ঘরে গরুর মাংস রাখার অপবাদে) পিটিয়ে মেরেছে মৌলবাদিরা। এর প্রতিবাদে
ওদেশের বহু বুদ্ধিজীবি জাতীয় পদক ফেরত দিয়েছে (তারা প্রায় সবাই হিন্দু), এরা হিন্দুর সন্তান হয়েও, প্রকাশ্যে রাস্তায়
গরুর মাংস খেয়ে প্রতিবাদ করেছে। অথচ আপনারা এদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনে কী প্রতিবাদটা করেন? মানববন্ধন, বক্তৃতা,
বিবৃতি, পত্রিকায় কলাম লিখে টু-পাইছ কামানো… ইত্যাদিতেই তো সীমাবদ্ধ, যা ধার্মিকদের কাছে হাস্যস্কর এবং সরকারের
কাছে স্বন্তিদায়ক। পারবেন কী, ভারতের বুদ্ধিজীবিদের ন্যায় রাস্তায় নিষিদ্ধ খাবার খেয়ে প্রতিবাদ করতে? পারবেন কী, ওদের
মতো পদকগুলো ফেরত দিতে? জানি, পারবেন না, পারলে বুঝতাম আপনারা সত্যিকারের বুদ্ধিজীবি! আসলে আপনার ভন্ড,
তাই এসব পারেন না। বরং কীভাবে আরো বেশি পদক পাওয়া যায় সেজন্য লবি করছেন, পা চাটছেন। এটাই আমাদের
সবচেয়ে বড় দুভার্গ্য।

বলতে পারেন, অতি সমপ্রতি যেসব সংখ্যালঘু নিহত ও আহত হয়েছে, হুমকি পাচ্ছে, এর মধ্যে কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ
বা খৃস্টান… কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলো? আপনি শিক্ষক শ্যামল কান্তির কথা উল্লেখ করেছেন।
সামপ্রদায়িকতা যদি বেশিরভাগ মানুষের মগজে ও মননে সুপ্তভাবে না-ই থাকবে, তাহলে কীভাবে একজনের ডাকে এলাকার
প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ লাঠি-সোটা, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একযোগে, বিদ্যুৎ গতিতে, সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই না করে ঝাপিয়ে
পড়ে? কীভাবে ওই তথাকথিত জনপ্রতিনিধির পক্ষে সাফাই গায়? আপনি কারো বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চান, কাউকে
শায়েস্তা করতে চান… অন্য কোনোকিছুর প্রয়োজন নেই, কেবলমাত্র তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলুন। দেখবেন
মুহূর্তেই বিচার শেষ। এতে যাচাই-বাছাই, সময় ক্ষেপণ, বিচার-আচার, জিজ্ঞাসাবাদের… কোনোই প্রয়োজন নেই। এখানে
কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে কেউ দাঁড়াবে না (পুলিশ, প্রশাসন, মন্ত্রি, এমপিরাও নয়), কারণ দাঁড়ালেই সমাজ তাকে
একঘরে করবে, ভোট কমে যাবে, ক্ষমতাচ্যুত হতে হবে…। আর যদি এ নিয়ে মামলা হয়, তাহলে তদন্তকারী অফিসার এবং
বিচারক পর্যন্ত কয়েকবার ভাববে কারণ মিথ্যা হলেও এখানে ধর্মের সেন্টিমেন্ট জড়িত এবং ধার্মিকরা আগেই হুমকি দিয়ে
রাখে, যদি কথিত অভিযুক্তের শাস্তি না হয় তাহলে দেশে আগুন জ্বলবে, আরো হত্যাকাণ্ড ঘটবে… ইত্যাদি। এ হুমকি যে
কোনো সরকার অতীব গুরুত্বের সাথে নেয়, ফলে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃত্যে কাঁদতেই থাকে। একই ভয়ে আপনাদের
মতো তথাকথিত মতলবাজ বুদ্ধিজীবি এবং মডারেটগণও চুপ থাকে। ইদানিং যেসব সংখ্যালঘুরা নিহত বা আহত এবং হত্যার
হুমকি পাচ্ছেন (ব্লগার বাদে), তা কী ধর্ম অবমাননার কারণে, নাকি ভিন্ন ধর্মী হওয়ার কারণে? এদের মধ্যে একজনও কী ব্লগ
লেখে বা ইন্টারনেট চেনে? এরপরও কী বলবেন, এগুলো সামপ্রদায়িকতা নয়? নাকি দুর্বৃত্তদের কাজ! দুর্বৃত্ত কাদের বলে?
আপনি বোধকরি গুলিয়ে ফেলেছেন। বলবেন কী, এদেশে কোন সংখ্যালঘুর সাধ্য, প্রকাশ্যে সংখ্যাগুরুদের ধর্মকে আঘাত
দিয়ে কথা বলে? অথচ সংখ্যাগুরুরা প্রকাশ্যেই বলে, এখানে ৫৭ ধারাও নিরব, নিঝুম! নিজেও যতোদিন ধর্ম বিশ্বাসী ছিলাম,
ততোদিন বুঝিনি, আমার চারপাশে কীভাবে সংখ্যালঘুদের কুটুক্তি করা হয়, কোনো সংখ্যালঘুকে এর প্রতিবাদ করতেও
দেখিনি। কারণ প্রতিবাদ করলে তাদের জীবন নিয়ে ঘরে ফেরাই দায়। আজ সম্পূর্ণ ধর্মমুক্ত হতে পেরেছি বলেই বুঝি।
এরপর আপনি বলেছেন, “দেশে সাধারণভাবে যে নৈরাজ্য এবং আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, তাতে
সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে, অনেকে আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারি
লোকদের দ্বারা অপহৃত ও নিহত হচ্ছেন। এদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাটি সব থেকে বেশি, কারণ দেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের
মধ্যে তারাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু হিন্দুরা বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশ, শতকরা নয়-দশ ভাগের মতো।”

নৈরাজ্য ও আইনশৃংখলা পরিস্তিতির অবনতি ঘটলে সব সমপ্রদায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সংখ্যাগুরুরাই বেশি হয়, এসব দুধের
শিশুও জানে। সরকারি লোকজন যা করছে তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, ধারাবাহিক সংখ্যালঘু নির্যাতন ভিন্ন কারণে। তবে
আওয়ামী লীগ যে সংখ্যালঘু নির্যাতনে এগিয়ে সেকথা মূর্খ সংখ্যালঘুরা স্বীকার করে না, এটাই দুঃখ। তবে খালেদাকে ভোট
দিলেও যে এরা নিশ্চিন্তে থাকবে এর তো কোনো গ্যরান্টি নেই। কারণ এ দুটি দলের বাইরে দেশ কখনোই যেতে পারবে না,
তাই সংখ্যালঘুরা কখনোই নিরাপদ থাকবে না। যাহোক, আপনি বলছেন, বিজেপি সামপ্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে। সেহেতু প্রশ্ন,
ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে কিছুদিন হলো, এর মধ্যে তো ২৮ ভাগ হিন্দু, ৮ ভাগে ঠেকতে পারে না! তাই নয় কী? মূলত
হিন্দু নির্যাতন অন্য সংখ্যালঘুদের চাইতে সব সময়ই বহু গুণ বেশি ধারবাহিকভাবে হচ্ছে বলেই এ অবস্থা।

আমার জ্ঞান, বুদ্ধি, বিদ্যা অতি সামান্য, তারপরও প্রত্যক্ষভাবে যা দেখেছি, যেটুকু মনে পড়ে, ভারতে তখন
বিজেপি ক্ষমতায় (১৯৯২ সাল)। তারা তাদের কাজই করছিলো, যা সব মৌলবাদিরাই করে। তখন একটা মসজিদ ভাঙ্গার
প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রায় সব মন্দির ভাঙ্গা হয়েছিলো। হিন্দু সম্পত্তি দখল, লুটপাট, ধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া
হয়েছিলো। এরপর ২০০১ সালে, যখন এক মা সন্ত্রাসীদের এমন আকুতি করেছিলো যে “বাবারা আমার মেয়টা ছোট, একজন
একজন করে যাও।” তখন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংখ্যালঘু নির্যাতন ধামাচাপা দিতে বরিশালের আগৈলঝাড়া যান এবং
টাকা-পয়সা বা ভয়ভীতি দিয়ে কিছু দরিদ্র হিন্দু ভাড়া করে এনে, তাদের দিয়ে বলিয়ে নিতে চান যে,
আগৈলঝাড়া-গৌরনদীতে তেমন কোন হিন্দু নির্যাতন ঘটেনি। সেখান উপস্তিত এক লোকের মুখে শুনেছি, এক হিন্দু নারী
(মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য রাজী করিয়ে আনা) মঞ্চে উঠে মিথ্যা না বলে, সত্যটাই বলে দিয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন, “কার
কী ক্ষতি হয়েছে জানি না, তবে আমার চোখের সামনে এক মা ও মেয়েকে ওরা ধর্ষণ করা হয়েছে, বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে
দিয়েছে ওরা…।” এর বেশি তিনি বলতে পারেননি, মন্ত্রীর চামচিকারা তাকে মঞ্চ থেকে মানিয়ে দিয়েছিলো। সুতরাং হিন্দু
নির্যাতনের কাহিনী যেটুকু শুনি ও দেখি তা পত্রিকার পাতায়, যা ২০%ও নয়। বাকি ৮০%ই ধামাচাপা পড়ে সংখ্যাগুরুদের
ভয়ে, কারণ নির্যাতনের কথা (কোনো হিন্দু) প্রকাশ করলে, মামলা করলে, কারো কাছে নালিশ করলে… তাদের উপর
অত্যাচার-নির্যাতন বেড়ে যায়। এ লেখা যখন লিখছি (২৬ জুন/১৬) দৈনিক ইত্তেফাকে দেখলাম, শিবগঞ্জ উপজেলার হিন্দুদের
একমাত্র মৃতদেহ সৎকারের স্থান, ‘বানাইল মহাশ্মশান’ বেদখল হয়ে গেছে এবং সেখানকার হিন্দুরা এর প্রতিবাদ করছে।
অতএব, সামপ্রদায়িকতা যদি না-ই থাকে তাহলে এখনো কীভাবে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও, হিন্দুদের
মন্দির, বাড়িঘর এবং শ্মশানের উপর হামলা হচ্ছে?

বিদ্যা-বুদ্ধিতে ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বলছি, ধর্মবিশ্বাসী তো বটেই, বড় হয়ে যারা নিজেদের জ্ঞান্তবুদ্ধি দিয়ে ধর্মের
অসারতা বুঝতে পেরেছে, তারাসহ প্রায় প্রতিটি মানুষই কমবেশে সামপ্রদায়িক। কারণ ছেলেবেলা আমরা সর্বপ্রথম যে
জ্ঞানার্জন করি, তার নাম ধর্ম। মুখে বুলি ফোটার আগে, মাতৃভাষা উচ্চারণ ঠিকভাবে শোখার আগেই ধর্ম শিখি। অথচ ধর্মের
মধ্যেই যে সামপ্রদায়িকতার বীজ, তা বুঝি না, জানি না, পরবর্তীতে কেউ কেউ বুঝলেও ধর্ম, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দাপটে, তা
স্বীকার করি না। ধর্ম যদি সামপ্রদায়িক না-ই হবে, এক ধর্ম যদি অন্য ধর্মকে সম্মানই করবে, ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে,
তাহলে কী করে এতো ধর্মের সৃষ্টি হলো? অর্থাৎ এক ধর্ম অন্য ধর্মকে আঘাত করে, দোষারোপ করে, খারাপ, এমনকি
জঘন্য-ঘৃণ্য… প্রমাণ করেই তো নতুন নতুন ধর্ম সৃষ্টি করেছে। যদি দ্বিতীয় ধর্মটি সৃষ্টির সময় এর সৃষ্টিকর্তা পূর্বের ধর্মেকে
খারাপ বা জঘন্য বা ঘৃণ্য ইত্যাদি প্রমাণ করতে না-ই পারতো, তাহলে কী প্রথম ধর্মটির অনুসারীরা দ্বিতীয় ধর্মটি গ্রহণ
করতো? প্রশ্নই ওঠে না। পূর্বেরটার চেয়ে নতুনটা ভালো প্রমাণ করতে প্রতিটি ধর্মই পূর্বের ধর্মগুলোকে যে যতো পেরেছ
আঘাত করেছে, দোষ দিয়েছে, এমনকি সাধারণ, অসাধারণ সব মানুষের মনেই প্রচণ্ড ঘৃণার সৃষ্টি করতে হয়েছে। যে ঘৃণার
জাল ছিঁড়ে সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে আসা বাঙালির সংখ্যা হাতে গোনা। নতুন ধর্ম সৃষ্টিকারীরা শুধু ঘৃণা ছড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি, খুন
করেছে, যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধবন্দি হিসেবে কঠোর শাস্তি দিয়ে নতুন ধর্ম গ্রহণের বাধ্য করেছে, ধর্ষণ করেছে, দাস্তদাসী বনিয়েছে,
যুদ্ধের মতো নিকৃষ্ট একটি ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ীভাবে বৈধতা দিয়েছে… (ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষ
এসবই বেশি ছিলো, যা এখনো আছে, ধর্মগুলো ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত চিরকালই থাকবে)। অতএব কম আর বেশি, ধর্ম
পালনকারীরা সবাই সামপ্রদায়িক। হয়তো কারো মনে এটি সুপ্ত, কেউ সহজে উত্তপ্ত হয় না, অধিকাংশই অতি সামান্যতেই
উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া কোনোদিন কী শুনেছেন, একটি ধর্ম অন্য একটি ধর্মকে প্রশংসা করছে? শুনেছেন, নিজের ধর্মের
চেয়ে কেউ অন্য ধর্মকে বেশি শ্রদ্ধা করে (ভালো হলেও)…? একটি ধর্মের ভালো দিকগুলোকেও অন্য একটি ধর্ম মেনে নেয়
না, প্রশংসা করে না, অথচ খারাপ দিকগুলো নিয়েই যতো পারে কুৎসা রটায়, বানিয়ে বানিয়ে গল্পকারে তা ব্যাখ্যা করে…
এবং এটা সর্বত্রই, পার্থক্য হলো- কেউ করে প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে। অথচ ৫৭ ধারা শুধু ব্লগারদের বেলায় ওদের বেলায় নয়,
কেনো? অতএব ধর্ম যখন সামপ্রদায়িক, তখন প্রায় শতভাগ ধার্মিকদের এই দেশের মানুষ কীভাবে অসামপ্রদায়িকতা হয়, এ
বোকার বোধগম্য নয়। সুতরাং সম্পূর্ণরূপে ধর্মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত না হতে পারলে, তিনি অসামপ্রদায়িক হতে পারেন না।
মনের মধ্যে ধর্মের প্রতি সামান্য একটু টান থাকলেও সম্ভব না, কারণ ছেলেবেলার ওই শিক্ষার বাইরে যেতে অবচেতন মন
বারবার বাধা দেবেই। যা আপনার বেলায় ঘটেছে।

মহোদয়, ধর্ম এমন এক মারাত্মক এবং অদ্বিতীয় ভাইরাস, যা অধিকাংশ ধার্মিকের মনে নয়, মগজে থাকে। যারা
কম ধার্মিক বা তথাকথিত মডারেট তাদের মগজে না থাকলেও, মনের মধ্যে থাকে। মানুষের মগজ এবং মননই এর প্রধান
খাদ্য। অন্য ভারাইসগুলো তা নয়। এ এমনই মারাত্মক ভাইরাস, যা বংশগতই শুধু নয় স্বভাবজাতও বটে। যার কোনো
প্রতিকার নেই, কোনো ওষুধ নেই, আছে শুধু মলম। ধর্মীয় সমপ্রতী রক্ষার জন্য মাঝে মাঝেই বিজ্ঞজনেরা আন্তঃধর্মীয় সম্মেলন
করেন, যা মলমের মতো এক-আধটু উপশম দেয়। অতএব, ধর্ম এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না করে কীভাবে
ধর্মীয় সমপ্রীতি রক্ষা করা সম্ভব? একদিকে মলম লাগাবেন, অন্যদিকে ক্যান্সারের বিষ ঢোকাবেন (যা চলছে হরদম), এ
কেমন খেলা? এরূপ বিষাক্ত, অপ্রতিরোধ্য ভাইরাসটিকে দমন করার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বা প্রচেষ্টা কোনোটাই বিশ্ববাসীর
নেই। বিশ্বের প্রায় সবাই বলেন ধর্ম, বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠি নিয়ে সমালোচনা করা উচিত নয়, তারা এগুলোকে বৈষম্যের মধ্যে
ফেলেন। তবে বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠি এসব নিয়ে কুটুক্তি করা বৈষম্য হলেও, ধর্ম নিয়ে কুটুক্তি করা কীভাবে বৈষম্যের মধ্যে পড়ে?
কারণ ধর্ম নিজেই তো বৈষম্যের আতুরঘর এবং সর্বোচ্চ শিখর। কারণ প্রতিটি ধর্মই অন্য ধর্মকে নগ্নভাবে বৈষম্য করে।
অতএব, ধর্ম সমালোচনায় কোনো অপরাধ হতে পারে না। যারা এসব বলেন, তারা ভন্ড, প্রতারক, মতলবাজ, স্বার্থপর…। ধর্ম
বা সামপ্রদায়িকতা কী কঠিন, মারাত্মক, অপ্রতিরোধ্য, চিরঞ্জীবি… ভাইরাস এর উদাহরণ প্রতিদিন দেখছি ও শুনছি। এমনকি
একই ধর্মালম্বীরাও নিরন্তন খুনাখুনিতে লিপ্ত। ধর্মশিক্ষা কতোটা বৈষম্যের, কতোটা ভয়ংকর, কতোটা সামপ্রদায়িক হলে
নিজেদের জন্মদাত্রীকে পর্যন্ত খুন করতে পারে? কতোটা উলঙ্গ হলে (অনার কিলিং-এর নামে) পিতা-মাতারা আপন সন্তানকে
হত্যা করতে পারে? এর প্রচুর উদাহরণের মধ্যে একটি দেখুন:- “মাকে কুপিয়ে খুন করল দুই আইএস জঙ্গি ভাই! …যমজ
দুই ভাই তাদের বাবা-মা এবং ভাইয়ের উপর হামলা চালায়। প্রথমে ভাইকে ধাওয়া করে ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে ধারাল
অস্ত্র দিয়ে তাকে একাধিক বার কোপানো হয়। …এর পর মাকে কুপিয়ে হত্যা করে। বাধা দিতে গেলে বাবাকেও জখম করে।
…বহু দিন ধরেই তারা আইএসের মতাদর্শে বিশ্বাসী। …বছরখানেক আগেও রিয়াধে এইরকমই একটি হত্যার ঘটনা
ঘটেছিল। সে বারও দুই ভাই প্রথমে তাদের অন্য এক ভাইকে হত্যা করে। বাধা দিতে গেলে আরও তিন জনকে খুন করে
তারা।”
আনন্দবাজার (২৫ জুন/১৬)। এবার বলুন, ধর্মীয় সন্ত্রাবাদের প্রধান শিকড়টি কোথায়! এরা সরাসরি আইএস যোদ্ধা
নয়, সমর্থক মাত্র। এরপরও কী বলবেন, ধর্মে সামপ্রদায়িকতা এবং সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় নেই? কোনো হিংস্র
জানোয়ারকে দেখেছেন কী, নিজের বাচ্চা মেরে ফেলে অথবা বাচ্চারা জন্মদাত্রীকে মেরে ফেলে? অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ জীবেরাই
এটা করে (যদিও কতিপয়)! কারণ, সর্বনাশ মহাশক্তিশালী ওই ভারাস যাদের মগজে বাস করে তারাই কেবল আত্মজকে
এভাবে খুন করতে পারে। ভাইরাসটি যাদের মনে বাস করে, তারা খুন না করলেও নানারূপ বিদ্রুপ করে, ভয়ভীতি দেখায়,
মারধোর এবং কড়া শাসন করে, মামলা-মোকদ্দমা করে, কখনো কখনো ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুনও করায়…। কিন্তু পশুর
মজগে ও মননে ধর্ম নামক কোনো ভাইরাস নেই, তাই তারা এসব করে না। অতএব এক্ষেত্রে মানুষের চাইতে পশুরাই উত্তম।
আপনি হিন্দু হেডমাস্টারের কান ধরা নিয়ে বলেছেন। তবে যারা সরাসরি ধর্মীয় সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত তারা সংখ্যায়
কম হলেও সমাজের বেশিরভাগ মানুষেরই সমর্থন পায় (যদিও প্রকাশ্যে নয়)। এর প্রমাণ, কোনো ব্লগার খুন হলে কেউ
প্রতিবাদে সামলি হয় না, অতি সামান্য কয়েকজন ছাড়া, যা আঙ্গুলেই গণনাযোগ্য। উমর সাহেব, পূর্বে ঘোষণা দিয়ে কেউ
সামপ্রদায়িকতা চালায় না, এটা হঠাৎ করে ঘটায় (পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ থাকে বহুদিনের)। হেডমাস্টারের ওই ঘটনার এক
মুহূর্তে পূর্বেই মাইকে ঘোষণা দিয়ে, এলাকার প্রায় সব মানুষকেই উত্তেজিত করা হয়েছিলো। যে ৯৫ ভাগ শিক্ষক
হেডমাস্টারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন তারা দেশের (১৭ কোটির) কতোভাগ? তাদের প্রতিবাদের ফলটাই বা কী? অন্যদিকে যারা
তথাকথিত জনপ্রতিনিধির পক্ষে স্বরব, তারা কতোজন? অথচ কেনো সর্বস্তরের মানুষ শিক্ষকের পক্ষে দাঁড়াতে পারেনি,
নিজেকে এ প্রশ্নটি করেছেন কী? যারা ওই এমপির পক্ষে ছিলো, তাদের মধ্যে সর্বস্তরের মানুষই ছিলো কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে
কেবলমাত্র শিক্ষরাই ছিলো। তবে কতোজন শিক্ষক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছিলো, নাকি লোকচক্ষুর ভয়ে বা পদ-পদবীর
মর্যাদার কারণে যোগ দিয়েছিলো, সেটাও প্রশ্ন! এবার বলুন, এটাকে কী সামপ্রদায়িকতায় ফেলবেন নাকি সন্ত্রাসের খাতায়
ফেলবেন? তবে প্রকাশ্য সামপ্রদায়িকতার চেয়ে নিরব সামপ্রদায়িকতা কমপক্ষে ৯০% বেশি। ফলে হিন্দু ২৮ থেকে ৮
ঠেকেছে। যাকে আপনি দুর্বৃত্তদের কাজ বলছেন। আসলে মোটেও তা নয়, দুঃখ এটাই, আপনারা সব বুঝেও মিথ্যা বলছেন।
আপনি আরো বলেছেন, “…মিরপুরে বিহারিদের একটি শরণার্থী শিবিরে স্থানীয় এমপি ও পুলিশের উপস্থিতিতে
বস্তি উচ্ছেদ অভিযানের সময় দশজনকে একঘরে বদ্ধ রেখে পুড়িয়ে মারা হলেও তার কোনো মামলা নিতে স্থানীয় পল্লবী থানা
রাজি হয়নি। তার কোনো প্রতিকারও আজ পর্যন্ত হয়নি। কোনো হিন্দুবাড়ি এভাবে আক্রান্ত হলে এবং দশজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে
মারলে ভারতজুড়ে তার কী প্রতিক্রিয়া হতো এটা বলাই বাহুল্য।”
বিহারিদের এমন ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না কিন্তু হিন্দু
অত্যাচার প্রতিদিনই ঘটে। তাদের ৯০% মামলাই পুলিশ নেয় না, অনেক সময় আদালতও নেয় না, নিলেও কালক্ষেপণ ও
হয়রানীতে দফারফা। আপনার বক্তব্যের উত্তরে বহু উদাহরণ দেয়া যায় কিন্তু লেখা এমনিতেই বড় হয়ে গেছে। আপনি
বলেছেন, “…দশজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারলে ভারতজুড়ে তার কী প্রতিক্রিয়া হতো এটা বলাই বাহুল্য।” দুটি ঘটনার কথা
বলছি। তবে মাফ করবেন আমার স্মরণশক্তি কম, তাই স্থান দুটির নাম মনে নেই। তবে আপনাদের মতো বিদ্বানদের নিশ্চয়ই
মনে আছে। অনেক বছর আগে (সম্ভবত বাঁশখালিতে) সম্পত্তির লোভে হিন্দু এক পরিবারের ২/৩ জন শিশুসহ ১০/১২ জনকে
ঘরের চালে ও চারিদিকে গানপাউডার ছিটিয়ে গভীর রাতে আগুন দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলো। বিহারিদেরটা মোটেও
ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো নয়, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে এসব হত্যাযজ্ঞ অবশ্যই ভয়ংকর ও
অগ্রহণযোগ্য। ভয় পাবেন না, এর চেয়েও লোমহর্ষক হিন্দু হত্যার কথা বলছি, (সম্ভবত কিশোরগঞ্জ জেলায়) এক হিন্দু
ভদ্রলোকের প্রচুর সম্পত্তি। তিনি কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ (তার স্ত্রীর একটি পা ছিলো না), তথাপিও তিনি স্বামীকে উদ্ধারের
জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে কোনো বিচার পাননি। এরপর তিনি নিজের ছোট তিন সন্তানের মুখ চেয়ে বিচারের আশা ছেড়েই
দিয়েছিলেন, তারপরও সম্পদ লোভীরা তাদের ছাড়েনি। এক রাতে দুটি নৌকায় কয়েকজন এসে দরজা ভেঙ্গে ওই মহিলাকে
এবং ৩ সন্তানকে তুলে নিয়ে যায়। বিলের গভীরে নিয়ে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সামনেই মহিলাকে উলঙ্গ করে, প্রথমে
নাভি বরাবর রামদা দিয়ে কেটে দুভাগ করে। পরে বড় মেয়েকে এবং এরপর ছোট দুছেলেকে একইভাবে কেটে টুকরো
টুকরো করে, চুন ও লবণ মাখিয়ে (যাতে তাড়াতাড়ি পচে) ২/৩টি ড্রামে ভরে বিলের অগাধ পানির মধ্যে খুঁটি পুতে ড্রামগুলো
বেধে রেখে আসে কিন্তু বিধিবাম, কিছুদিন পর এক মাঝি সেখান দিয়ে নৌকা বেয়ে যাবার সময় তার লগিতে ঠন করে একটি
আওয়া হলে, তিনি বারে বারে লগি ঢুকিয়ে একই আওয়াজ পেয়ে কয়েকজনকে নিয়ে ডুবিয়ে ওই ড্রামগুলো তুলে দেখেন প্রায়
পচে যাওয়া লাশগুলো। এরপর পুলিশ তদন্তে বেরিয়ে আসে, বেশ কয়েক বছর পূর্বে ওই পরিবারের কর্তাকে তুলে নিয়ে খুন
করে বর্ডারের কাছে একটি পরিত্যাক্ত কুয়ায় ফেলে এসেছিলো খুনিরা। পুলিশ সেখান থেকে হাড়গোড় উদ্ধার করেছিলো। এ
দুটি ঘটনায় ভারতে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো বলতে পারেন উমর সাহেব? আমার জানামতে কোনো প্রতিক্রিয়ই হয়নি।
অতএব আপনি যে উদাহরণ দিয়েছে এতে হাসবো না কাঁদবো, আপনিই বলুন। যাহোক, বিহারিরা হিন্দুদের ন্যায় প্রতিদিন
অত্যাচারিত হওয়ার প্রমাণ আছে কী? অর্থাৎ হিন্দুরা যে বিহারীদের চাইতে বেশি এবং সর্বক্ষণ ও প্রতিকারহীনভাবে নির্যাতিত
হচ্ছে সেই খবর আপনি জানেন না, জানলেও ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যাচ্ছেন। হিন্দু মারলে বা মরলে ভারতজুড়ে কী প্রতিক্রিয়া
হয় তা আমরা জানি। অর্থাৎ বদলা নিতে সেখানে তেমন কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতন হয় না। তবে এদেশে হিন্দুরা একটা
সংখ্যাগুরুর বাড়িতে হামলা চালালে, তাদের ধর্মালয় ভাঙ্গলে একটাও হিন্দু বাড়ি ও মন্দির আস্ত যে থাকবে না সেটা বলাই
বাহুল্য। ওপাড়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন হলে এপাড়ের সংখ্যাগুরুরা যেভাবে উম্মাদ হয়ে আক্রমণ চালায় এর উদহারণ বহু। যা
দেশবিভাগের সময় থেকেই চলছে, যে ইতিহাস আপনিও জানেন। যে তুলনাটি দিয়েছেন তা নিতান্তই বালখিল্য ও হাস্যস্কর,
ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছু নয়।

আপনি ভুল বলছেন, সংখ্যায় হিন্দুরা এখন আর ৯/১০ নেই। দেশবিভাগের সময় ছিলো প্রায় ৩০, ৭১এ ছিলো প্রায়
১৮ আর এখন ৮, কারো কারো মতে ৭ ভাগের কিছু বেশি। আপনি বলছেন, তাদের চাকরি ৯/১০ ভাগের বেশি। এ তথ্য
আপনি কোথায় পেলেন? যদি আপনার কথা সত্যও হয়, তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, হিন্দুরা যে হারে উচ্চশিক্ষা লাভ
করে, সেই হারে উচ্চপদে এবং সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ পাচ্ছে না। কারণ, এদেশের সংখ্যাগুরুরা দেশবিভাগের পূর্ব
থেকেই শিক্ষায় পিছিয়ে, পক্ষান্তরে হিন্দুরা এগিয়ে। এছাড়া স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ফলাফল
নিয়ে যে অদৃশ্য বৈষম্য চলছে তা কেবল সংখ্যালঘুরাই জানে, আপনারা জানেন না, জানলেও প্রতিবাদ করবেন না। যাহোক,
এবার ক্ষমতায় টিকে যাওয়ার পর, বর্তমান সরকার হিন্দুদের বেশ কিছু পদে নিয়োগ দিয়েছেন, কারণ জানি না, তবে সেটাই
হচ্ছে সংখ্যাগুরুদের চুক্ষশূল। এ নিয়ে বহু সামপ্রদায়িক মন্তব্য চলছে, বিশেষ করে ফেইসবুকে যা দেখা যায়, তা অত্যন্ত
লজ্জাজনক। এমনকি হিন্দু ক্রিকেটার লিটন দাস ফেইসবুকে দূর্গা পূজার শুভেচ্ছা পাঠালে সেখানে বহু কুৎসিত মন্তব্য এবং
প্রধান বিচারপতি হিন্দু, এজন্যও বহু সমালোচনা দেখা গেছে। এগুলোকে কী বলবেন, অসামপ্রদায়িকতা?
আপনি বলছেন, “…গান, নাচ, নাটক, সিনেমা, সাহিত্য, প্রচারমাধ্যম, রাজনীতি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের
অবস্থান উল্লেখযোগ্য।”
যাতে আপনার হীন্যমন্যতা ও অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন রাজনীতি ছাড়া
এর সবগুলোই সংখ্যাগুরুদের ধর্মে নিষেধ। তবে রাজনীতিতে আপনি হিন্দুদের উল্লেখযোগ্য অবস্থানটা পেলেন কীভাবে?
নিষেধ সত্ত্বেও বহু সংখ্যাগুরুরা এখন সংখ্যালঘুদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুরা যেহেতু প্রত্যন্ত
অঞ্চলে বাস করে এবং তাদের পরিবার বা সমাজে, হিন্দু পরিবার বা সমাজের ন্যায় এসব চর্চা হয় না, সে হিসেবে তারা তো
এসব স্থানে সুযোগ না পাওয়ারই কথা। তাই নয় কী? তাহলে কেনো এসব অবান্তর প্রসঙ্গ? মাথাটা কী ঠিক আছে তো?
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন যেহেতু সর্বপ্রথম শুরু হয় হিন্দু দিয়ে কারণ জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুরা
প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং সেখানে পূর্বে কখনো বাঙালি ছিলো না, অর্থাৎ তারা এতোদিন সংখ্যাগুরুদের নাগালের বাইরে ছিলো,
সেহেতু এতোদিন নিরাপদ ছিলো। যোগাযোগ ব্যবস্থা যতোই উন্নত হচ্ছে ততোই তাদের জায়গাজমি দখলের জন্য তাদের
উপর সংখ্যাগুরুদের অত্যাচার বাড়ছে। যেহেতু এখনো ততোটা নাগালের মধ্যে নয় এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল বিধায় তাদের
নির্যাতনের কথা কম প্রকাশিত হচ্ছে।

তথাপিও “প্রকৃত সংখ্যালঘু” বলে যাদের আপনি চি‎িহ্নত করছেন তাদের অস্বীকার করছি না এবং তাদের নিয়ে
ভাবতে কেউ বারনও করছে না। তবে হাতের কাছে সংখ্যালঘুদের নিয়েই আগে ভাবতে হবে এবং এর প্রতিকার করতে
পারলে সকল সংখ্যালঘুই নিরাপদ হবে, অন্যথায় নয়। জানি না, হিন্দুদের অস্বীকার করে, দূরের ওদের কাহিনী নিয়ে
কুম্ভীরাশ্রুর অর্থ কী? সামপ্রতিক সংখ্যালঘু খুনগুলো ছাড়াও, প্রতিদিন নিরবে-নিভৃত্যে, নিত্য নতুন কারণে-অকারণে এদেশে
সংখ্যালঘুরা (কম বেশি সবাই) নির্যাতিত হচ্ছে। পূর্বেই বলেছি, সামপ্রদায়িকতা কখনো ঘটে প্রকাশ্যে, বেশিরভাগই
অদৃশ্যভাবে। এসব উপলব্ধি করতে হয়, যা কেবলমাত্র সংখ্যালঘু ছাড়া সংখ্যাগুরুর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অর্থাৎ সংখ্যাগুরু
সমপ্রদায়ের শারীরিক ভাষা, আচার-ব্যবহারে, আকারে-ইঙ্গিতেও বহু সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘটে। আইনের দৃষ্টিতে যা
আমলযোগ্য নয়। রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় অনেক কুটক্তি শোনা যায়, যা লিখতে গেলে বই লিখতে হবে। পরোক্ষভাবে
তারা প্রতিদিন কিভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, সেকথা তারা নিজেরাও প্রকাশ করতে পারে না।

উমর সাহেব, বলতে পারেন, ধর্ম নিজেই যখন সামপ্রদায়িক, তখন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ কী করে অসামপ্রদায়িক হয়?
ধর্ম মানুষের মনোজগতকে যেভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে, অন্য কোন মতবাদ বা দর্শন তেমনটা আচ্ছন্ন করতে পারে কী?
এছাড়া, ধর্মীয় সন্ত্রাস যে কোনো সন্ত্রাসের চাইতে হাজারগুণ মারাত্মক, যা আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিসম্পন্ন। জানি না,
ধর্মকে আঘাত না করে, মনোজগতকে পরিবর্তন না করে, কীভাবে ধর্মীয় সন্ত্রাস বা সামপ্রদায়িকতা দমন সম্ভব? আমার ক্ষুদ্র
জ্ঞানে বুঝি, এটা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। কারণ যা স্বভাবজাত তাতে সামান্য আঘাত লাগলেই মানুষ চরম উত্তেজিত হয়ে পড়ে
এবং এ সুযোগকে কাজে লাগাতে কিছু ধার্মিকরা (নাস্তিকরা নয়) সব সময়ই প্রস্তত থাকে। কারণ স্বভাবজাত অভ্যেসগুলো
মনোগজতকে ছেলেবেলা থেকেই এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে ইহজীবনেও সেখান থেকে কমপক্ষে ৯০%ই আর ফিরতে
পারে না। এমনকি এদেশে যারা নিজেদের অধার্মিক বা ধর্মহীন বলে দাবি করেন, তারাও পিতৃধর্মের প্রতি কিছুটা হলেও দুর্বল
থাকে। আপনিও যে পিতৃধর্মের প্রতি দুর্বল, তা আপনার লেখায় স্পষ্ট।

শিশুর যেমন আতুর ঘর আছে, সামপ্রদায়িকতারও আছে। সামপ্রদায়িকতা মূলত আতুর ঘরে প্রতিটি শিশুর সাথেই
জন্ম নেয় এবং বেড়ে ওঠে প্রথমত পরিবার, পরে সমাজ এবং ধর্মজীবিদের পৃষ্ঠপোষকতায়। পরবর্তীতে যা রাষ্ট্র ছাড়িয়ে সারা
বিশ্বে বিস্তার লাভ করে। ধর্মজীবিদের সামপ্রদায়িকতা জ্বলন্তই থাকে, মাঝে মধ্যে শুধু উষ্কে দেয়। অন্যদিকে বেশিরভাগ
সাধারণ ধার্মিকদের মনেও এটা তুষের আগুনের ন্যায় থাকে, যখন ধর্মজীবিরা বরুদ ছিটায় তখন আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি করে।
আপনি চাইলে এই মুহূর্তেই তা পরীক্ষা করতে পারেন।

আপনারা সামপ্রদায়িকতা নির্মূলে যেসব পদক্ষেপের কথা বলছেন এবং সরকার যা করছে এতে সামপ্রদায়িকতা
দমানো সম্ভব নয়, এর জন্য প্রথমত ও প্রধানত দায়ী পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাথমিক ধর্মশিক্ষা।
কারণ সর্বপ্রথম শিশুর সাদা মগজে যে শব্দগুলো লেখা হয় তা ধর্মীয় বাণী বা ধর্মশিক্ষা, যা পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধন…
সর্বোপরি বন্ধ না করে মানুষের মন থেকে সামপ্রদায়িকতা দূর করবেন কীভাবে? যুগ যুগান্তরের এ শিক্ষাই তো
সামপ্রদায়িকতার প্রধান উৎস। অথচ এখানে কেউ হাত দিতে সাহস পাচ্ছেন না। অতএব তথাকথিত ক্রসফায়ার,
জেল-জরিমানাসহ যে কোনো আইন প্রয়োগ হোক না কেনো, ধর্মকে আঘাত না করে, নিরাপদে রেখে আর যাইহোক,
সামপ্রদায়িকতা বন্ধ অসম্ভব। কারণ হাজার হাজার বছরের গোড়ামিপূর্ণ ধর্মশিক্ষা বহু আগেই ক্রোনিক ডিজিজে পরিণত
হয়েছে। স্বীকার করুন আর না-ই করুন, …আমার ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ, আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ ঈশ্বরের অনুসারী, অন্যরা নয়, তার ভ্রান্ত,
পাপী, নারকী, ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য, শয়তানের উপাসক… ছেলেবেলার এসব শিক্ষা কে না পেয়েছে? এরূপ শিক্ষায় আমাদের
প্রত্যেকের কী হাতেখড়ি হয়নি? অতএব ধর্মশিক্ষার পীঠস্থান পরিবার, সামাজ ও ধর্মালয় থেকে এরূপ শিক্ষা দূরীভূত না করে,
সামপ্রদায়িকতা নির্মূল আর সোনার পাথর বাটি- এক কথা। এ মরণব্যাধি ক্যান্সার থেকে মুক্তি পেতে মলম লাগালে চলবে না,
প্রয়োজন কেমো থেরাপি। অথচ সকলেই মলম দিচ্ছেন!

সবশেষে, খৃস্টান সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে কটি কথা। এরা প্রায় সব সমপ্রদায়ের সাথে মিলেমিশে থাকায় পারদর্শী।
কারণ নির্যাতিত হলে প্রায়ই প্রতিবাদ করে না। এছাড়া এদের বিদেশি প্রভুরা এদেরকে যেমন প্রচুর দান করে, সরকারকেও
দান করে। সে কারণে এদের উপর সংখ্যাগুরুরা তেমন একটা মাতুব্বরি ফলাতে পারে না। তারপরও অনেক ছোটখাটো
অত্যাচার এদেরকেও সহ্য করতে হয়। যেমন, এরা যখন ধর্মপ্রচার করতে যায় তখন প্রায়ই ধাওয়া খায়, পিটুনি খায়,
গালাগাল শুনতে হয়…। এরা নতুন কোনো স্থানে গির্জা নির্মাণ করলে সেখানে গির্জা চলাকালীন সময়ে ঢিল ছোঁড়া হয়, কুটুক্তি
করে তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো হয়… যা প্রায়ই এরা প্রকাশ করে না। ফলে এরা যখন গির্জা করে তখন জানলা-দরজা
আটকে নেয় যাতে সংখ্যাগুরুরা তেমন একটা টের না পায় (বিশেষ করে শহর এলাকায়)। কারণ এরা সহজে বিরোধে যেতে
চায় না। ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে কোনো স্থানে বেশি বিপদে পড়লে, স্থানীয় নেতাদের টাকা-পয়সা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা
দিয়ে এরা টিকে থাকে। এছাড়াও এদের একটা বৈশিষ্ট্য হলে, যে কোনো স্থানে গির্জা নির্মাণ করার সাথে সাথেই স্কুল
বাধ্যতামূলক, পারলে ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করে। এতে স্থানীয় সংখ্যাগুরু ছাড়াও সব দরিদ্রদের ছেলেমেয়েরা ফ্রি
লেখাপড়া (কখনো কখনো খাদ্যসহ) ও চিকিৎসার সুযোগ পায়। এরপরও এরা সংখ্যাগুরুদের আচার-ব্যবহার, ভাবপ্রকাশ,
অঙ্গ-ভঙ্গি দ্বারা আহত হয়। এসব আপনাদের দেখার বা উপলব্ধি করার কথা নয়। সংখ্যালঘু না হলে এ অদৃশ্য অথচ
প্রতিদিনের সামপ্রদায়িকতা উপলব্ধি করা যাবে না। আমি সংখ্যালঘু না হয়েও পেরেছি, কারণ আমি এখন সংখ্যালঘুরও
সংখ্যালঘু অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে ধর্মের প্রভাবমুক্ত। আপনারা তা পারবেন না, কারণ সম্পূর্ণরূপে ধর্মের প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য
যতোখানি শক্ত মেরুদণ্ড এবং প্রচণ্ড মনোবল প্রয়োজন, তা আপনাদের নেই।

আসলে প্রকৃত বা অপ্রকৃত সব সংখ্যালঘুই নিগৃহীত হচ্ছে। তবে অধার্মিকরাই “প্রকৃত সংখ্যালঘু” এবং বড় বেশি
অসহায়, অন্যরা নয়!

ভালো থাকবেন, সুখে থাকবেন। মনে দুঃখ নেবেন না, কিছু কড়া কথা বললাম।

ধন্যবাদান্তে-

সুমন চৌকিদার।