-আল্লাহ’র মাল আল্লায় নিয়ে গেছে — প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
-ধর্মের নামে খারাপ কথা লিখলে যদি কেউ খুন হন, আমরা সেই দায় নেব কেন? — প্রধানমন্ত্রী
-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আকারে-ইঙ্গিতে বলছে, ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে আপনি খুন হলে সেই দায় আমরা নেব কেন?
-কারো বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে পারবো না — প্রধানমন্ত্রী
-প্রশ্নফাঁস কিভাবে সামলাবো? আমরা তো স্কুলে স্কুলে পাহারা বসাতে পারবো না — শিক্ষামন্ত্রী
-নিজেদের লোকের কারণে ব্যাংক লুটের বিচার করা যাচ্ছে না — অর্থমন্ত্রী
-যানযট সৃষ্টির দায়দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না — যোগাযোগমন্ত্রী
-সন্ধ্যার পর কিছু হলে তার দায়দায়িত্ব পুলিশের নয় — পুলিশের আইজিপি
-ফেসবুকীয় মোরাল পুলিশ বলছে, হিজাব না পরে (অথবা উগ্র / অশালীন পোষাক পরে) রাস্তায় বেরুনোর কারণে আপনি ধর্ষিতা হলে সেই দায় আমাদের নয়।
-আমজনতা অনেক আগে থেকেই বলছে (মৌন সম্মতির মাধ্যমে হলেও বলছে), আপনি সন্ত্রাস করে ক্রসফায়ারে মরলে সেই দায় আমাদের নয়। নিজেরা এটার শিকার না হওয়া পর্যন্ত অনেকে বরং খুশী যে, এই ক্রসফায়ার ব্যবস্থাটা চালু আছে। তাতে নাকি দেশে আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভাল হয়েছে।
প্রতিটি সিস্টেমই কিছু মৌলিক স্বীকার্যের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে থাকে সৌধ কিম্বা প্রাসাদ। ক্রিকেট খেলার কিছু নিয়মকানুন আছে, যা মেনেই সেটা খেলতে হয়। জ্যামিতি বা রসায়নশাস্ত্র বা ব্যাংকিং ব্যবস্থা, সব কিছুই তাদের নিজ নিজ ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে, নইলে সেগুলো অর্থহীন কৌতুকে পরিণত হবে। আম্পায়ার বা অন্য কারুর অঙ্গুলিহেলনে যদি ক্রিকেটের এক ওভার ছয় বলে এবং পরের ওভার চার বা সাত বলে হয়, তবে খেলে আপনি কখনোই জিততে পারবেন না, তারা না চাইলে। দশ টাকার নোটের মূল্যমান যদি আজকে দশ টাকা, কালকে ছয় টাকা এবং পরের দিন আরো অনিশ্চিত কোন পরিমাণের টাকার সমান হয়, তাহলে কাগজের ওই টুকরাতে আপনি আর ভরসা রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না।
ধরা যাক, টাকার সবগুলো নোটের মূল্যমানই কাল থেকে আর ঠিক থাকবে না, আমরা জেনে গেলাম। সেক্ষেত্রে দেশের অর্থব্যবস্থায় একটা অরাজকতা লেগে যাবে। কেউই আর টাকার উপরে ভরসা না করে রিয়েল এসেট বা ধরা-ছোঁয়া যায় এমন জিনিসের উপরে ভরসা রাখবে। ব্যাংকে দশহাজার টাকা রাখলেন – সেই টাকার আসল দাম আসলে দশহাজার নাকি দুই হাজার সেইটা যদি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তাহলে ব্যাংকে টাকা রাখবেন কেন? এক কাপ চা খেতে গেলে একটা দশটাকার নোটে আর চলবে না, যদি না দোকানী নিশ্চিতভাবে জানে যে, ওই কাগজের নোটের আসল দাম দশ টাকাই। সে হয়তো একটা নোটের বদলে আপনার কাছে এক কাপ চা এর সমমানের অন্যকোন জিনিস চাইবে মূল্য হিসেবে। আমরা ফিরে যাব সেই বার্টার বা দ্রব্য বিনিময়ের প্রাগৈতিহাসিক যুগে।
আমরা সকলে মিলে স্বীকার করে নিয়েছি যে, আমাদের ছাপানো কাগজগুলো স্রেফ কাগজ নয়, তার উপরে লেখা সংখ্যাটা অনিবার্যভাবে তার আর্থিকমূল্য নির্দেশ করে, ফলে তাতে আস্থা রাখতে পারে যে কেউই। এই কাগজ কোথায় ছাপানো হবে, কে ছাপাবে, তাও আমরা সকলে জানি। পিকে সিনেমার সেই কৌতুকময় দৃশ্যটির মতন পত্রিকার পাতায় গান্ধীর ছবি থাকলেই তা রুপি’র মর্যাদা পাবে না, তাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে নির্দিষ্টভাবে ছাপানো হয়ে আসতে হবে। একবার যদি ছাপানো হয়েই আসে, তখন ব্রাহ্মন-চন্ডাল-মন্ত্রী-মুচী যে-ই এই কাগজের মালিক হোক না কেন, তার মূল্য সবখানে একই থাকবে। যদি এই আস্থার জায়গাটি আর না থাকে, তাহলে এই পুরো আর্থিক ব্যবস্থা ভোজবাজির মতন উড়ে যাবে এক মুহূর্তেই।
মানুষ যত উন্নত হয়েছে, তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যত জটিল হয়েছে, ততই বিনিময় প্রথা তার উপযোগিতা হারিয়েছে। তা থেকে উত্তরণের জন্য আমরা ঠিক করেছি, কিছু কাগজ ছাপিয়ে তাতে মূল্যমান নির্ধারণ করে দেব, সেই অনুযায়ী লেনদেন চলবে। নইলে আপনি একটা গরু বেচে দুই কেজি চাল, এক কেজি তেল কিনে, বাকী টাকা থেকে ছেলের স্কুলের বেতন দিয়ে অবশিষ্টের উপরে আগামী দু’মাস চলবেন, সেটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তো যদি দ্রব্য বিনিময় প্রথাতেই আমরা আটকে থাকতাম। আমরা সকলে মিলে স্বীকার করে নিয়েছি যে, আমাদের ছাপানো কাগজগুলো স্রেফ কাগজ নয়, তার উপরে লেখা সংখ্যাটা অনিবার্যভাবে তার আর্থিকমূল্য নির্দেশ করে, ফলে তাতে আস্থা রাখতে পারে যে কেউই। এই কাগজ কোথায় ছাপানো হবে, কে ছাপাবে, তাও আমরা সকলে জানি। পিকে সিনেমার সেই কৌতুকময় দৃশ্যটির মতন পত্রিকার পাতায় গান্ধীর ছবি থাকলেই তা রুপি’র মর্যাদা পাবে না, তাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে নির্দিষ্টভাবে ছাপানো হয়ে আসতে হবে। একবার যদি ছাপানো হয়েই আসে, তখন ব্রাহ্মন-চন্ডাল-মন্ত্রী-মুচী যে-ই এই কাগজের মালিক হোক না কেন, তার মূল্য সবখানে একই থাকবে। যদি এই আস্থার জায়গাটি আর না থাকে, তাহলে এই পুরো আর্থিক ব্যবস্থা ভোজবাজির মতন উড়ে যাবে এক মুহূর্তেই।
যে কোন সিস্টেমের গোড়াতেই কিছু মৌলিক স্বঃতসিদ্ধ ব্যাপারে আস্থা এনে তারপরে এগুতে হয়, সেটা বুঝানোর জন্যই এই টাকা-কাহিনী ফেঁদে বসলাম।
ব্যাপারটাকে অন্যদিকে নিয়ে যাই। হাইস্কুলে আমরা যে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি পড়েছি, তার গোড়াতেই আছে অল্প কয়েকটা এরকম সিদ্ধান্ত, যা সকলে মেনে নিয়েছে। সেগুলো নিয়ে কোন বাদানুবাদ নেই; সেগুলোর উপরে ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে গণিতের এই শাখাটি। সেই সব সিদ্ধান্ত যদি আমরা না মানি, তাহলে তা আর ইউক্লিডীয় জ্যামিতি থাকে না, অন্য কিছু হয়ে যায়। সেইখানে আর ত্রিভুজের তিন কোনের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রী হওয়ার দায় নেই, সমান্তরাল রেখার পরস্পর থেকে সমদূরত্বে অবস্থানের দরকার নেই। সে জগত ইউক্লিডীয় জ্যামিতির অচেনা।
মানুষ আদিকালে যে গোষ্ঠীভিত্তিক জীবন যাপন করত, তা থেকে নগর রাষ্ট্র হয়ে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমাদের উত্তরণ ঘটেছে। মানুষের প্রয়োজনেই তা হয়েছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ইতিহাসের নানা বাঁকবদলের মধ্য দিয়ে আমরা আজকের এই সময়ে এসে পৌঁছেছি। ফলে রাষ্ট্রের গঠন বা পরিচালনা পদ্ধতির নানা তত্ব ও তরীকা থাকলেও, মোটাদাগে রাষ্ট্রের কাজ কি, সেটা নিয়ে খুব বেশি মতানৈক্য নেই। মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য বা মানুষের মঙ্গলের জনই যেহেতু এই সব ব্যবস্থার উতপত্তি, ফলে মানুষের মঙ্গল না করলে সেই রাষ্ট্রকে সফল বলাটা কঠিন। এইখানে এসে আমরা একটা বড় সমস্যায় পড়ি – মানুষ মানে কোন মানুষ, মঙ্গল করাটা আসলে কোনটা, অমঙ্গলই বা কোনটা, তা নিয়ে নানা রাজনীতির মারপ্যাঁচ আছে। রাষ্ট্র তো আর কোন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র নয় – তাকে চালাতে হয়। মিলিয়ন-বিলিয়নের হয়ে অল্প কিছু মানুষ সে কাজটি করেন। ফলে তারা কাকে মানুষ মনে করছেন, কোনটাকে মঙ্গল বা অমঙ্গল ভাবছেন, তাতে অনেক কিছু এসে যায়। অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রে দশ টাকার নোটের মূল্যমান দশ টাকা হবে – সেই নিশ্চয়তা পেলেই চলে, ফুটবল খেলার জন্য সর্বজনস্বীকৃত অল্প কিছু আইন হলেই চলে, ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে বিন্দু-রেখার সংজ্ঞা পেলেই কাজ চলে, কিন্তু সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অনেক চলক বা ভ্যারিয়েবলস, তাতে অনেক সমস্যাসংকুল ধারণার আনাগোনা। সেই সব ধারণাকে নানাভাবে ব্যবহার/অপব্যবহার করে, নানা গ্রুপ-সাব গ্রুপ বানিয়ে এর সাথে ওকে সংঘাতে জড়িয়ে ফেলে রাজনীতি এগুতে থাকে। সব দেশে সব সমাজেই এই নিয়ম।
ব্যর্থ রাষ্ট্র নিয়ে জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম জার্তম্যানের দেওয়া সংজ্ঞাটিকে অনেকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র ব্যর্থ বলে প্রতিপন্ন হয় তখনই, যখন রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো আর কাজ করে না। এটি এমনই এক অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে, যেখানে কাঠামো, বৈধ কর্তৃত্ব, আইন এবং রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙেচুরে পড়েছে।
আমি বলছি, দাসপ্রথা খারাপ। প্রচীনকালে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষও তাদের সমাজে-রাষ্ট্রে দাসপ্রথা রেখেছিলেন। কেউ ভাবছেন, কাজের লোককে বাসায় আশ্রয় দিয়ে আমরা তাদেরকে উদ্ধার করছি, আবার কেউ কেউ ভাবছেন, আমরা তাদেরকে শোষণ করছি। কেউ ভাবেন, রাষ্ট্রের গ্যাঁটে বিদেশী মুদ্রার অংক দিয়েই উন্নয়ন মাপা যাবে, আবার অন্যরা ভাবছেন, রাম-রহিম-রহিমা-মালতী সবার কথা ভাবলে তবেই উন্নয়ন হবে। এই বিতর্ক চিরন্তন।
তবে রাষ্ট্রের মূল কাজ কি, সেই প্রশ্নের উত্তর তাতে পালটায় না, কিম্বা সেই প্রশ্নের প্রয়োজনও ফুরায় না। রাষ্টের কাজ কি, তা উপরে বলেছি। তার মানে এই নয় যে সব রাষ্ট্রই সেটা করছে – সক্ষমতা বা সামর্থ্যের প্রশ্ন আছে, ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার আছে, স্বার্থের সংঘাত আছে, বিশ্বাস-দর্শন-সংজ্ঞার ঘাপলা আছে, এবং সর্বোপরি, রাজনীতি আছে। তবে একটা জনগোষ্ঠী যখন ‘রাষ্ট্রের কাজ কি?’ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই ছেড়ে দেয়, তখন সেই রাষ্ট্রে আক্ষরিক অর্থেই সব কিছু ভেঙে পড়ে। মানুষ পালিয়ে বাঁচতে চায়। আমার ধারণা, আমরা সে দিকে হাঁটা শুরু করেছি অনেককাল আগেই। এখন যা হচ্ছে, তা নিয়ে মন্তব্য করা বা না করাটা অর্থহীন। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলতে হবে, সব কিছু ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়েছে যে ঠিক কবে, তাও আমরা ভুলতে বসেছি। সন্দেহ হলে শুরুতেই যে কয়েকটা বাণী চিরন্তনী উদ্ধৃত করেছি, ওগুলো আরেকবার দেখুন – আপনার সন্দেহ উবে যাবে।
ভারতীয়/অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক ও বুকারজয়ী লেখক অরবিন্দ আদিগা সেই ২০০৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলায় আমাদের জাতিগত অহম আহত হয়েছিল ব্যাপকভাবে। টাইম ম্যাগাজিনের সেই সংখ্যাটিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যদিও তার কয়েক সপ্তাহ আগেই চট্টগ্রামে ধরা পড়েছিল বহুল আলোচিত সেই দশট্রাক অস্ত্রের চালান। ব্যাপক চাঁদাবাজি, মুক্তিপণের বিনিময়ে ব্যবসায়ী অপহরণ, সাংবাদিক নিপীড়ন ও নিধন, হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা, বাংলা ভাইয়ের ফাটাকেষ্টগিরি, আরো কত কি! সেখান থেকে আমরা এগিয়েছি নাকি পিছিয়েছি, সে প্রশ্নও এখন অবান্তর।
অনেক দিন আগে থেকে ব্যর্থ বা অকার্যকর রাষ্ট্র নিয়ে বিভিন্ন সূচকের সাহায্যে জরিপ চালু হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংগঠন ফান্ড ফর পিস ব্যর্থ রাষ্ট্রের বছরওয়ারি যে তালিকা প্রকাশ করে, তাতে জনসংখ্যার চাপ, পরিবহন ব্যবস্থা, শরণার্থী কিংবা ভাসমান জনগোষ্ঠী এবং তার কারণে সৃষ্ট খাদ্য ও পানিসংকট, মহামারি ইত্যাদির সঙ্গে মানবিক বিপর্যয়, অতীত কিংবা ঐতিহাসিক কোনো নিপীড়নের প্রতিশোধপরায়ণ গোষ্ঠীর সহিংসতা, বহির্গামী অভিবাসন বা দেশান্তরি হওয়া, বিভিন্ন মানুষ ও গোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, দ্রুত অর্থনৈতিক অধোগতি ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সরকারি দল বা শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপক দুর্নীতি, জনগণকে সেবা দেওয়া কিংবা সন্ত্রাস থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যর্থতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যক্তিমানুষের রাজনৈতিক বা সামাজিক অধিকার হরণ ইত্যাদি ক্রাইটেরিয়া ব্যবহার করে। বিশ্বব্যাংকওয়ালারা আরেক কাঠি জটিলতর জিনিস মাপে – অধিকার ও জবাবদিহি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতা, সরকারের কার্যকারিতা, নিয়ন্ত্রণের গুণগত মান, আইনের শাসন এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ।
জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম জার্তম্যানের দেওয়া সংজ্ঞাটিকে অনেকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র ব্যর্থ বলে প্রতিপন্ন হয় তখনই, যখন রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো আর কাজ করে না। এটি এমনই এক অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে, যেখানে কাঠামো, বৈধ কর্তৃত্ব, আইন এবং রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙেচুরে পড়েছে।
আমি এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই, ফলে আমাদের রাষ্ট্র সফল নাকি ব্যর্থ, সেই রায় দিতে অপারগ। আশা করি পাঠকেরা নিজেরাই সেই সিদ্ধান্ত নেবেন যার যার মতন করে।
শেষে এসে একটা কাল্পনিক ধারণা নিয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া করা যাক। এই ধারণাটির নাম ভেইল অফ ইগনোরেন্স।
ধরুন, এমন একটা ট্যাবলেট আছে, যা খেলে আপনি আপনার আসল পরিচয় ভুলে যাবেন। আপনার নাম, পিতামাতার নাম তথা বংশ পরিচয়, লিঙ্গ, ধর্ম, সামাজিক অবস্থান, এ সবের কিছুই আর আপনার মনে থাকবে না। তবে আপনার মাথা ঠিক আগের মতই কাজ করতে থাকবে। এই নতুন সত্বাটিকে বলা হোক, আদি-মানুষ অবস্থান বা জিরো পয়েন্ট। একই সাথে আরো একটি ট্যাবলেটের কথা ভাবুন, যা খেলে আপনি আবার সেই আদি-মানুষ অবস্থান থেকে আপনার বাস্তব অবস্থানে ফিরে যাবেন। সেই অবস্থানে কেউ নাস্তিক ব্লগার, কেউ ইমাম-মুয়াজ্জিন, কেউ মন্ত্রী-আমলা, কেউ বস্তিবাসী, কেউ গার্মেন্টস মালিক, কেউ রিকশা চালক।
আমেরিকান দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস বলেছেন, একটা সমাজ তখনই ন্যায়ভিত্তিক সমাজ হয়, যখন সেখানে আইন ও পলিসিগুলো প্রণয়নের সময় প্রণয়নকর্তারা যতখানি সম্ভব ‘ভেইল অফ ইগনোরেন্স’ পরিধান করে নেন, অর্থাৎ তারা তাদের নিজস্ব নৃতাত্বিক পরিচয়, লৈঙ্গিক পরিচয়, আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং জীবনের অন্য নানা পরিচয়ের উর্ধে উঠে আদি-মানুষ অবস্থান থেকে সেটা করতে পারেন। একটা রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া ঠেকাতে বা অকার্যকর হয়ে পড়া আটকাতে এই ভেইল অফ ইগনোরেন্সের খুবই প্রয়োজন।
সমাজের নানা অবস্থান থেকে এরকম কয়েকজন মানুষকে বেছে নিয়ে তাদেরকে ট্যাবলেট খাইয়ে আদি মানুষ অবস্থানে পাঠিয়ে দিন। এর পরে তাদেরকে কোন একটা বিষয়ে সমবেতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বলুন। ধরুন, ড়েব বিনা-বিচারে অপরাধী বা হালকা-অপরাধী মানুষকে গুম-খুন করার অধিকার রাখে কি-না, এই হলো আলোচ্য বিষয়। যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তারা প্রত্যেকেই জানেন যে, তারা তাদের বাস্তব অবস্থা ভুলে গেছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ হলে তারা তাদের সেই অবস্থানে ফিরে যাবেন, এবং সেখানে গিয়ে কেউ নিজেকে আবিস্কার করবেন মন্ত্রী-আমলা হিসেবে, কেউ ড়েব-পুলিশ হিসেবে, কেউ সন্ত্রাসী হিসেবে, কেউ ব্যবসায়ী-শিক্ষক-বস্তিবাসী-পাটের আড়তদার হিসেবে। ফলে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিতে চাইবেন না, যাতে করে বাস্তব অবস্থানে ফিরে গিয়ে তাদের নিজেদের নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে তাদেরকে ভুক্তভুগী হতে হয়। অর্থাৎ সেই সমবেত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কেউই অন্যায্য কোন সিদ্ধান্তে আসতে চাইবেন না, কেননা তারা তখনো জানেন না, বাস্তবে তারা কোন অবস্থান থেকে এসেছেন। তারা এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন, যেখানে ন্যায্যতা নিশ্চিত হয়, অথবা কারিগরি কারণে সর্বাবস্থায় ন্যায্যতা নিশ্চিত করা না গেলেও যেন তার প্রতিকার-প্রতিবিধানের সুযোগটি থকে। তাদের সমবেত সিদ্ধান্তে ইংরেজীতে যেটিকে বলে ডিউ প্রসেস বা ফেয়ার ট্রায়াল, সেটার সুযোগ তারা রাখবেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। এই আদি-মানুষ অবস্থানকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং দর্শনে বলা হয় ‘ভেইল অফ ইগনোরেন্স’ পরিহিত অবস্থা – যে অবস্থায় আপনি আপনার আত্নপরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন। এটি একটি ধারণামাত্র। এর প্রবক্তা আমেরিকান দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রলস বলেছেন, একটা সমাজ তখনই ন্যায়ভিত্তিক সমাজ হয়, যখন সেখানে আইন ও পলিসিগুলো প্রণয়নের সময় প্রণয়নকর্তারা যতখানি সম্ভব ‘ভেইল অফ ইগনোরেন্স’ পরিধান করে নেন, অর্থাৎ তারা তাদের নিজস্ব নৃতাত্বিক পরিচয়, লৈঙ্গিক পরিচয়, আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং জীবনের অন্য নানা পরিচয়ের উর্ধে উঠে আদি-মানুষ অবস্থান থেকে সেটা করতে পারেন। একটা রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া ঠেকাতে বা অকার্যকর হয়ে পড়া আটকাতে এই ভেইল অফ ইগনোরেন্সের খুবই প্রয়োজন।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নানা পর্যায়ের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদেরকে যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এই ভেইল অফ ইগনোরেন্স পরানো যেত, তবেই হয়তোবা এই ভেঙে পড়া থামানো যাবে।
উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসছে , মিয়া- আর আপনি এইসব কিতা লেইখছেন …
৫৭ ধারায় আপনার ফাসী দাবি করলাম …
মামলা করবেন আর কই – সেইখানেও ঘাপলা। আমাদের বিচার বিভাগ নামেই স্বাধীন – তার চেয়ে এমনকি পাকিস্তানের বিচার বিভাগের মেরুদণ্ডও বেশি মজবুত। অভিজিত-অনন্তের বিচারের কোন নামগন্ধ নেই, ওদিকে জয়ের হত্যার ষড়যন্ত্রের অপরাধে কয়েকজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার!
ধন্যবাদ কাজী রহমান। আমার মনে হয় আমি বুঝতে পারছি, লেখার শেষাংশে ঠিক কি থাকার কথা আপনি বলছেন। তবে সেটা ইচ্ছা করেই রাখি নি।
দেশে অনেক কিছু হয়ে গেছে; যাচ্ছে। আজও যদি বাংলাদেশের কাউকে বলে দিতে হয় যে, বাংলাদেশ ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে, তাহলে সেটা দুঃখজনক। ব্যাপারটা খুবই স্পষ্ট এবং প্রকাশ্য; চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাই নি। একেবারে শুরুতে যে বাণী চিরন্তনীগুলো দিয়েছি, সেগুলো দিয়েছিলাম বাস্তবতার সাথে আমাদের রাষ্ট্রের ব্যার্থতা/সফলতাকে মিলিয়ে দেখার জন্য।
আপনার পরামর্শটুকু মাথায় রাখলাম। ভালো থাকবেন।
🙂 ঠিক আছে। নিরাপদে থাকুন।
অসাধারণ একখানা লেখা। খুব জটিল কিছু ব্যবস্থা এত সহজ ভাবে লিখে দিয়েছেন, সত্যিই সাধুবাদ জানাচ্ছি। আজকের সভ্যতায় বেকায়দা রকমের স্বার্থপর অথচ কার্য্যকরী কিছু পদ্ধতি যেগুলোর ভিত্তি অনেক অনেক মৌলিক স্বীকার্য; এইসব যদি বেশ অনাগ্রহী অথবা বুঝে উঠতে পারবার মত অক্ষম কাউকে বোঝাতে চান তো সেটা বেশ কষ্টসাধ্যই বটে।
-মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য বা মানুষের মঙ্গলের জনই যেহেতু এই সব ব্যবস্থার উতপত্তি, ফলে মানুষের মঙ্গল না করলে সেই রাষ্ট্রকে সফল বলাটা কঠিন। এইখানে এসে আমরা একটা বড় সমস্যায় পড়ি – মানুষ মানে কোন মানুষ, মঙ্গল করাটা আসলে কোনটা, অমঙ্গলই বা কোনটা, তা নিয়ে নানা রাজনীতির মারপ্যাঁচ আছে। রাষ্ট্র তো আর কোন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র নয় – তাকে চালাতে হয়। মিলিয়ন-বিলিয়নের হয়ে অল্প কিছু মানুষ সে কাজটি করেন। ফলে তারা কাকে মানুষ মনে করছেন, কোনটাকে মঙ্গল বা অমঙ্গল ভাবছেন, তাতে অনেক কিছু এসে যায়।-
সুতরাং চমৎকার এই লেখাটির শেষাংশ বাংলাদেশের মানুষের বাস্তব জীবনছোঁয়া কিছু হলে ভালো হতো মনে হয়। কিছু সুন্দর আলোচনাও হতে পারত হয়তো।
ভালো থাকুন।
এই মহা উক্তি গুলোই আমরা নির্বাচনী ইস্তেহারে দেখতে চাই।
ইশতেহারে থাকে এমন সব কথা, যা বিজ্ঞাপনের ভাষায় লেখা। তার অনেকখানি আদতে অতিকথন, এবং সেটা আমরা জানি। সমস্যা হলো অন্যখানে। ইশতেহারে সরকার পদ্মাসেতু বানাতে চেয়েছিল। তারা বানাতে পারলে লোকে হাততালি দেবে, কিন্তু না বানালে কারো জীবনই থেমে থাকবে না। অন্যদিকে, সরকার যে মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেবে, সংবিধানকে সমুন্নত রাখবে, সেইটা ইশতেহারে থাকার বিষয় নয় – সরকারের কাজই এই। অর্থাত এই কাজটি না করলে সরকার তার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক ভিত্তিটি দুর্বল করে ফেলে।
ইতিমধ্যেই আমাদের সুখ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মহাক্ষমতাধারী মহানারী ও মহাপুরুষদের এইসকল কালজয়ী মহাউক্তি যদি আমরা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করি ও এভাবেই যদি দেশ চলে (দেশ তো এভাবেই চলছে) তাহলেই তো হবে জীবন পরম সুখের।
:good:
🙂
ইহা ইয়াহূদী না সা রা রা দের চক্রান্ত ।
অট্টহাসি!