এক
বৃহস্পতিবার বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে এক শুভেচ্ছা বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন,

“আমার ধর্ম সম্পর্কে কেউ যদি নোংরা কথা লেখে, সেটা কেনো আমরা বরদাশত করবো? ফ্যাশন দাঁড়িয়ে গেছে ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই তারা মুক্তচিন্তার ধারক! কিন্তু আমি এখানে কোনও মুক্ত চিন্তা দেখি না। আমি দেখি নোংরামিএত নোংরা নোংরা কথা কেন লিখবে? আমি আমার ধর্ম মানি, যাকে আমি নবি মানি তার সম্পর্কে নোংরা কথা কেউ যদি লেখে সেটা কখনোই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ঠিক তেমনি অন্য ধর্মের যারা তাদের সম্পর্কে কেউ কিছু লিখলে তাও কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। যারা এগুলো করে তা তাদের সম্পূর্ণ নোংরা মনের পরিচয়, বিকৃত মনের পরিচয়। এটা পুরোপুরিই তাদের চরিত্রের দোষ এবং তারা বিকৃত মানসিকতার। একজন মুসলমান হিসেবে আমি প্রতিনিয়ত আমার ধর্মকে অনুসরণ করে চলি। কাজেই সে ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ লিখলে আমি কষ্ট পাই। এসব লেখার জন্য কোনও অঘটন ঘটলে তার দায় সরকার নেবে না। সবাইকেই সংযমতা নিয়ে চলতে হবে, শালীনতা বজায় রেখে চলতে হবে। অসভ্যতা কেউ করতে পারবে না। আর তা করলে তার দায়িত্ব আমরা নেবো না”।

দুই
প্রধানমন্ত্রীর ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ লিখলে তিনি জানিয়েছেন, তিনি কষ্ট পান; কিন্তু কারো উপর চাপাতি চললে প্রাণবায়ুই নিভে যায়। অথচ, এই কষ্ট পাওয়া, ধর্মীয় অনুভূতি আহত হওয়া, বা আক্রান্ত হওয়া ঠেকানোতে প্রধানমন্ত্রী বা সরকার যতখানি যচেস্ট, ঠিক ততখানিই দায়িত্বহীন শারীরিক আঘাত আক্রমণ ঠেকানোর ব্যাপারে। “ভিকটিম ব্লেমিং” এর মাধ্যমে লেখককে প্রথমে নোংরা, বিকৃত, অসভ্য, অশালীন এসব বলে, তারপরে এসব লেখার জন্যে কোনও অঘটন ঘটলে কোন দায় সরকার নিবে না বলার মাধ্যমে বাস্তবে, এই বার্তাই দেয়া হয় যে, এরকম অসভ্য, অশালীল, নোংরা, পর্ণ টাইপের লেখার জন্যে, লেখককে যেকোন অঘটনের সম্মুখীন হওয়ার দায় নিজেকেই নিতে হবে (বাস্তবে লেখক খুন হত্যা আর অঘটন নয়- নৈমত্তিক ঘটন হয়ে দাঁড়িয়েছে), অর্থাৎ প্রকারান্তরে এই বলে প্রধানমন্ত্রী জঙ্গী খুনীদের উৎসাহিতই শুধু করলেন না- নিজেদেরকেও এইসব খুনের সমর্থক, উৎসাহদাতা, পরামর্শদাতা, ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন, শেখ হাসিনা সরকার নিজেদের খুনী সরকার হিসাবেই পরিচিত করলেন।

তিন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে রক্ত লেগে আছে!
আহমেদ রাজীব হায়দারের রক্ত!
অভিজিৎ রায়ের রক্ত!
ওয়াশিকুর বাবুর রক্ত!
অনন্ত বিজয় দাসের রক্ত!
নীলয় নীলের রক্ত!
ফয়সাল আরেফিন দীপনের রক্ত!
নাজিমুদ্দিন সামাদের রক্ত!

এই রক্ত কিভাবে দূর করবেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী!

চার
‘ভিকটিম ব্লেমিং’ কেবল প্রধানমন্ত্রীই নন! আরো অনেকেই করছেন। ৬ এপ্রিল নাজিমুদ্দিন সামাদ খুনের পরে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আমাদের পুলিশমন্ত্রী বলেছেনঃ

“নিহত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর লেখালেখি করতেন কিনা তা দেখা প্রয়োজন”।

আপত্তিকর লেখা লিখলেই কি হত্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে? এই প্রশ্নে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেনঃ

“আমি সে কথা বলতে চাইনি… আগের যে হত্যাকাণ্ডগুলো হয়েছে তাদের ব্লগ যদি দেখেন, এভাবে মানুষের ধর্মে আঘাত দেওয়া, বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া, পৃথিবীর কোনো দেশেই তা গ্রহণযোগ্য নয়”।

এ নতুন কথা নয়! এর আগেও নীলয় নীল হত্যাকান্ডের পরপরেই তিনি বলেছেনঃ

“ব্লগে বা অন্য কোনো মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যাবে না৷ দিলে তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

পুলিশের আইজি সে সময়ে বলেছিলেন,

“ব্লগারদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনারা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেন না৷ লিখতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করবেন না”।

পাঁচ
সীমা লঙ্ঘন প্রসঙ্গে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের আইজি এ-ও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে ১৪ বছরের শাস্তির বিধান আছে বাংলাদেশে। এই ১৪ বছরের যে সাজা, সেটা তিনি তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর কুখ্যাত ৫৭ ধারা প্রসঙ্গে বলেছেন। ২০০৬ সালে করা এই আইনটিতে এই সাজা ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর (এবং ন্যুনতম কোন সীমা ছিল না), সে সময়েই এই আইনকে কালো কানুন আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে দেশের প্রগতিশীল অংশ অবস্থান নিলে আওয়ামীলীগও নির্বাচনী ওয়াদা দেয় সমস্ত কালো কানুন বাতিল করার। অথচ, ক্ষমতায় গিয়ে তা তো করেই না, উল্টো ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামী সহ ইসলামবাদী দল ও গোষ্ঠীগুলোর দাবীর মুখে এই আইনকে সংশোধন করে সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর করে।

৫৭। (১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

এই আইনের বলেই মন্ত্রী আমলা থেকে শুরু করে কর্তাব্যক্তিরা ঘনঘন হুমকি দেন। একদিকে একের পর এক মুক্তমনা, সেক্যুলার লেখক- ব্লগার খুন- হত্যা- আক্রমণ, অবিরাম হত্যার হুমকি বা পরোয়ানা, অন্যদিকে রাষ্ট্র কর্তৃক সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও ন্যুনতম ৭ বছরের সাজার চোখ রাঙ্গানি; এমনকি খুন হওয়া লেখক- ব্লগারের লেখাকেও সেই তদন্তের আওতায় আনা হবে বলে হুংকার- সবই আসলে আমাদের রাষ্ট্র তথা সরকারের একটি বিশিষ্ট চরিত্রই উন্মোচন করে! সেই খুনী, জঙ্গী, অসহিষ্ণু চরিত্রই নববর্ষের দিনে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবানীতে প্রকট হয়! এটা শুধু এই সরকারের অগণতান্ত্রিক চরিত্রের প্রকাশ নয়, অগণতান্ত্রিক সরকার তো আরো আছে- এটা আসলে প্রমাণ করছে আমাদের সরকার একটা খুনী, ফ্যাসিস্ট, মধ্যযুগীয় বর্বর সরকার হওয়ার পথে আছে, বা হয়েই গেছে।

ছয়
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এই শুভেচ্ছাবানীর সাথে সাথে আমরা এই শুভদিনটিতে আরেকটি শুভেচ্ছাবানীর কথা পত্রিকা মারফত জানতে পারি। ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর মুখপত্র দাবিক এর রজব ১৪৩৭ (এপ্রিল ২০১৬) সংখ্যায় (১৪ তম সংখ্যা) আইএস তথা ইসলামি খেলাফতের বাংলাদেশ শাখার আমির শায়খ আবু ইব্রাহীম আল হানিফের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের তার যোদ্ধারা নাস্তিকদের কল্লা কাটার জন্যে চাপাতিতে শান দিচ্ছে। “বাংলাদেশে কোন অস্তিত্ব না থাকা” আইএস এর আমির আবু ইব্রাহীম “বাংলাদেশে নবীকে বিদ্রুপ করা নাস্তিক ও সেক্যুলারদের স্তব্ধ করতে ও সন্ত্রস্ত করতে খেলাফতের যোদ্ধারা কতখানি প্রভাব তৈরি করেছে?” এই প্রশ্নের জবাবে বলেনঃ

“Alhamdu lillah, the emergence of the soldiers of the Khilafah has terrified the kuffar in the region in general and in particular the atheists and secularists who mock Islam and our beloved Prophet (SM). This became evident when some of the leading atheists in the region claimed to have received death threats from the soldiers of the Khilafah in Bengal. But it is not the methodology of the Khilafah’s soldiers to send mere threats to the enemies of Allah. Rather, we let our actions do the talking. And our soldiers are presently sharpening their knives to slaughter the atheists, the mockers of the Prophet (SM), and every other apostate in the region, bi idnillāh. We say just as Shaykh Usamah Ibn Ladin said, “If there is no limit to the freedom of your words, then let your hearts be open to the freedom of our actions”.”

সাত
বাংলাদেশে আইএস বা এরকম কোন জঙ্গী নেই এটা সরকার অসংখ্যবার বলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছিলেন, এখানে আইএস বা এরকম কোন জঙ্গী নেই। আছে জামাতে ইসলাম। আর আছে বিদেশী ষড়যন্ত্র। অথচ, আইএস বাংলাদেশ শাখার আমির আবু ইব্রাহীম একই সাক্ষাৎকারে জামাতে ইসলামকেও দোষারোপ করছে ইসলামের শত্রু হিসাবে, শিরকের অভিযোগে তাদেরকে অভিযুক্ত করছে। গণতন্ত্র নামক শিরকে বিশ্বাসী, ক্ষমতায় থাকা কালে শরিয়া আইন প্রণয়নে উদ্যোগী না হওয়া, ‘হিন্দু’ ভারতনীতিতে নতজানু থাকা- এরকম অনেক অভিযোগ!

দাবিক এর সর্বশেষ সংখ্যায় বাংলাদেশ শাখার আমিরের সাক্ষাৎকার প্রকাশের পরে ১৫ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আবারো সংবাদ মাধ্যমের সামনে বলেছেন,

“আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আইএসের কোনো ঘাঁটি বাংলাদেশে নেই। কোনো সংগঠন বাংলাদেশে নেই। আইএসকে হয়তো অল্প দু-একজন বিশ্বাস করতে পারে। কোনো বিদেশি মতাদর্শের লোক এই দেশে ঘাঁটি গেড়ে অন্য দেশে আক্রমণ করবে, সেটা হবে না। দেশের জঙ্গি সংগঠনের সহযোগিতায় পার্শ্ববর্তী দেশের আক্রমণের সুযোগ দেওয়া হবে না। সংখ্যালঘুদের আক্রমণ আমাদের ইসলাম ধর্ম প্রশ্রয় দেয় না। কাজেই যারা এগুলো বলে, তারা ইসলাম ধর্মের তো নয়ই, এরা মানবতার শত্রু। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, এগুলো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র”।

সরকারের তরফ থেকে বেশ স্পষ্টভাষণ শুনে আমরা আস্বস্ত হলাম! হলাম কি?

আট
সরকার জানাচ্ছে, দেশে কোন আইএস নাই। কোন জঙ্গী নাই। আল কায়দা নাই। তালেবান নাই। বিচ্ছিন্নভাবে সমর্থক থাকতে পারে, তাদের আদর্শে বিশ্বাসী এই অর্থে, কিন্তু এইসব জঙ্গীদের সংগঠিত কোন অবস্থান নাই, সংগঠিত রূপ নেই! কিন্তু, ধারাবাহিকভাবে “বিচ্ছিন্ন” হত্যা খুনের ঘটনাগুলো ঘটছে। নাস্তিক খুন হচ্ছে। হিন্দু পুরোহিত, ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান, শিয়া, বিদেশী নাগরিক খুন চলছেই। খুবই “অসংগঠিত” ও “বিচ্ছিন্ন”ভাবেই এসবের দায় স্বীকার করছে, নানাভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, আইএসের মুখপত্রেও খুব অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্নভাবে এবং ষড়যন্ত্র করতে বাংলাদেশ শাখার আমির সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। আসলেই সংগঠিত জঙ্গী নেই! বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত জঙ্গী থাকলে এদের ধরা যেত, ধরে বিচারের আওতায় আনা যেত! কিন্তু, খুন হামলাগুলো হচ্ছে যেহেতু, খুনী নিশ্চয়ই আছে। তারা খুনী, কিন্তু জঙ্গী নয়! আইএস নয়। আল কায়দা নয়। আনসার আল ইসলাম নয়। কেননা এসবের কোন অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব আছে, ওলামা লীগের- যারা তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল। অস্তিত্ব আছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের! অস্তিত্ব আছে, সরকারের, সরকার প্রধান- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। যিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন- ধর্ম নিয়ে অসভ্যতা নোংরামি করলে- যেকোন অঘটন ঘটলে তার দায় সরকারের না। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট গলায় জানিয়েছেন, তিনি মুসলমান- তার নবীকে নিয়ে নোংরা কথা বললে- তিনি কষ্ট পান, মুসলমান মাত্রই কষ্ট পায়! তিনি দেশের প্রধান হিসাবে সমূহ ক্ষমতার অধিকারী, ফলে- তিনি হুংকার ছুড়েছেন- তিনি সহ্য করবেন না! ‘বরদাস্ত’ করবেন না! অনেকদিন ধরেই ‘বরদাস্ত’ করা হচ্ছেও না! এক্কেবারে চাপাতি দিয়ে মেরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া হচ্ছে। হ্যা, দেশে কোন জঙ্গী নেই। আছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।

মাননীয় মুসলমান প্রধানমন্ত্রী! আপনার হাতে রক্ত লেগে আছে, দেখিয়ে দিলেন তো? আপনার ঠোটের কোণ দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে, মুছার প্রয়োজনবোধ করছেন না তো?

নয়
একটা রাষ্ট্র তখনই অসভ্য, বর্বর হয়ে ওঠে- যখন প্রতিবাদ করার কেউ থাকে না। যখন সেই রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, দেশ ও জাতির বিবেক বলে খ্যাতরাও খুনীদের ভাষায় কথা বলে, খুনীদের অপরাধকে ঢাকতে ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ এর আশ্রয় নেয়! খুনী রাষ্ট্রে রক্ত হাতে লাগবে না, মুখে ঠোঁটের কোণ দিয়ে বেরিয়ে পড়বে না- তা কি করে হয়? যতই মুছার চেস্টা করুন না কেন, আপনাদের ‘কিন্তু’, ‘তবে’র পরে যা বলছেন- তাতে রক্ত লুকাতে পারছেন না! আরো সুদক্ষ অভিনেতা হতে হবে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতো- প্রতিটা খুনের পরে একটু কান্না করুন, বিলাপ করুন জোরে জোরে, তারপরে সুযোগ মতে খুন হওয়ারা কত বড় আক্রমণ করেছে, অনুভূতি কিভাবে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে মানবতার কতখানি অপমান করেছে- সেই বিবরণ দিন; কিংবা অভিনয় টভিনয় বেশি কষ্টকর মনে হলে, প্রধানমন্ত্রীর লাইনে চলে আসুন- এককালের দক্ষ অভিনেতা যে করে আজ অভিনয়ের প্রয়োজন বোধ করছেন না যেভাবে, একই পন্থায় রক্ত মোছার চেস্টা বাদ দিন, কান্না কাটি আহাজারি বাদ দেন! নিশ্চয়ই বর্বর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রধানমন্ত্রীর হাতে যেমন রক্ত দেখতে ভালোবাসে, তেমনি আপনাদের হাতে রক্ত দেখলে- আপনাদের জনপ্রিয়তাও রাতারাতি অনেক বেড়ে যাবে।

দশ
এখনো যারা একদম বর্বর হননি, খুনীদের ভাষা নিজের মুখে তুলে নেননি- কিংবা চারদিকের প্রবল প্রচারণায় কিছুটা বিভ্রান্ত, তাদের উদ্দেশ্যে দু চারটি কথা বলে আমার এই “অসভ্য”, “নোংরা”, “পর্ণ” টাইপ লেখাটা শেষ করবো।

আজ নাস্তিক- মুক্তমনাদের এই হত্যা, খুনের মহোৎসবে তাদের মূল অপরাধ হিসাবে যেটা সকলে সামনে আনছে, তা হচ্ছে, এরা ধর্মের সমালোচনা করছে, ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, ধর্মপুরুষদের নামে আজেবাজে নোংরা কথা বলছে বা লেখছে। একটা শব্দ বহুল ব্যবহৃত- “হেট স্পিচ”। এরা হেট স্পিচ দেয়। হেট স্পিচের মাধ্যমে মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দেয়।

একটা সামান্য গণতান্ত্রিক, একটুখানি মুক্ত সমাজের যতটুকু নর্মস, ভ্যালুস থাকে- সেইখান থেকেও তারা ঘৃণা (হেট্রেড) আর সহিংসতা (ভায়োলেন্স) এর পার্থক্য করতে পারে এবং সেই সমাজ সহিংসতা নির্মূলকে প্রধান দায়িত্ব বা কাজ হিসাবে গণ্য করে।

একটা পরিপূর্ণ মুক্ত সমাজ ঘৃণা করারও অধিকার দেয়। আমার ঢাকার রাস্তার যানযট দেখলে ঘৃণা হয়, আমার বুড়িগঙ্গার দূষণ দেখলে ঘৃণা হয়, আমার এই দেশের সংবিধানের অদ্ভুত গোজামিলে ঘৃণা, আমার সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতা- ধর্ষকামিতায় ঘৃণা হয়! সরকারের কথিত ‘বন্ধুরাষ্ট্রের’ প্রতি নতজানু নীতিতে ঘৃণা, ‘বন্ধু’রাষ্ট্রের আমাদের উপর খবরদারির প্রতি ঘৃণা, পানিতে- কয়লায়-তারকাটায়-সীমান্তে গুলিতে আমাদের মেরে ফেলার প্রতি ঘৃণা, আদিবাসী ও অন্য ধর্মের মানুষদের উপর সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প পরিচালনার প্রতি আমার ঘৃণা।

হ্যা, আমি ঘৃণার পক্ষে কথা বলছি, কেননা আপনারা আমার অবস্থানকে, আমার বক্তব্যকে ঘৃণা হিসাবে চিত্রিত করছেন। বিপরীতক্রমে যদি বলেন- ধর্মান্ধরা নাস্তিকদের যে ঘৃণা করে- সেটা কি ঠিক আছে, জবাবে বলবো- হ্যা, যতক্ষণ তারা মনে করবে, নাস্তিকতা মহাপাপ- ঘৃণিত কাজ, নিশ্চিত নরকবাস … ইত্যাদি। কিন্তু যখন তারা মনে করবে, নাস্তিকদের ধরে ধরে খুন করতে হবে, ইহুদীদের, পৌত্তলিকদের, খ্রিস্টানদের যেখানে পাওয়া যায় হত্যা করতে হবে, তখন সেটা আর ঘৃণা থাকে না- সেটা সহিংসতা হয়। সুস্থ রাষ্ট্র কখনো এই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না।

একজন নাস্তিক কতটুকু হেট স্পিচ দেয়? বড়জোর তারা বলে বা লেখে যে, “মুহাম্মদ একটা লুচ্চা, বদমাইশ, একটা মহা উন্মাদ!” বলতে পারে “আল্লা ফাক”, বলতে পারে “বালটার আকবর”- এগুলো গালাগালি, এই গালাগালিরও কি স্বাধীনতা চাচ্ছি? হ্যা চাচ্ছি। একইভাবে, একজন ধার্মিক ব্যক্তি বলতে পারে- সমকামীরা শুয়োরের বাচ্চা, নাস্তিকতা নিয়ে লেখার শুরু থেকে অসংখ্যবার শুনেছি- আমি, আমরা জারজ সন্তান। হ্যা, আমি মনে করি, এসব বলতেই পারে- কিন্তু বলতে পারে না, বেটা সমকামীটাকে বেত দিয়ে পিটায় পাছা লাল করে দিতে হবে, নাস্তিকটার কল্লা নামায় দিতে হবে … ইত্যাদি।

দাঁড়ান দাঁড়ান, চোখ আকাশে তুলবেন না! আমিও স্বীকার করি, ঘৃণা সহিংসতাকে আনে, সহিংসতার চাষ করে! কিন্তু, আপনি ঘৃণার চাষ বন্ধ করার নামে কেবল ধর্মের প্রতি ঘৃণা বন্ধ করতে বলবেন, আর সবার প্রতি ঘৃণা নিয়ে আপনার কোন চিন্তা থাকবে না, ধর্ম কর্তৃক ধর্মের অন্তর্নিহিত ঘৃণা নিয়ে কথা বলবেন না, এমনকি সেই ঘৃণা ও সহিংসতা নিয়ে কথা বলা, আপত্তি তোলাকে ঘৃণা বলে চিত্রিত করবেন- তাহলে কিভাবে হবে? আপনি কি স্বাভাবিক আচরণ করছেন?
ধর্মগ্রন্থের মধ্যকার সহিংসতা, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহিংস, নারীর প্রতি সহিংস অবস্থানের বিরুদ্ধে কথা বলাকে যারা ঘৃণা বলেন, বুঝতে কি পারছেন, আপনারা ঘৃণা ও সহিংসতাকেই অনুমোদন করছেন?

ঘৃণা দূর করতে চান, ভালো কথা। সমভাবে সব জায়গা থেকেই ঘৃণা দূর করেন। কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে বা সংখ্যাগুরুদের ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার বিরুদ্ধে কথা না বলে, সংখ্যাগুরুরা যে ক্ষমতার বলে আর সবার ধর্মীয়, মানবিক, যুক্তিবাদী অনুভূতি প্রতিনিয়ত আঘাত করেই শুধু না, ফিজিক্যালি সহিংস হামলাও করে- সেই ব্যাপারেও কথা বলেন!

না হলে, আপনাদের হাতেও রক্তের দাগ লাগবে বৈকি …