ফেব্রুয়ারি মাস একসময় আমার খুব প্রিয় ছিল। এই মাস আমাদের ভাষা আন্দোলনের মাস, অমর একুশে বইমেলার মাস। পুরো মাসটাই উৎসব-উৎসব মনে হতো। জানুয়ারীর মাঝামাঝি থেকেই আসন্ন মাসব্যাপী উৎসবের আনন্দে মন নাচতে থাকতো। বইমেলা আসছে, বইমেলা আসছে, আহা কী আনন্দ মন জুড়ে! কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! বই তো সারা বছরই কিনতে পাওয়া যায় বইয়ের দোকানে। তবুও বইমেলার আনন্দ অন্য রকম। একমাস ব্যাপী একটা মেলা চলবে। শুধুই বইয়ের মেলা। কতো নতুন নতুন বই বের হবে মেলা উপলক্ষ্যে। নতুন নতুন বই উল্টে-পাল্টে দেখতেও কী বিষম আনন্দ! নতুন কাগজের সৌরভ ফুলের সৌরভের চেয়ে কম যায় না। একমাস যেন আসতে না আসতেই ফুরিয়ে যায়। মেলা শেষ হয়ে যায় কোন দিক দিয়ে টেরও পাওয়া যায় না। শেষের দিকে মনটা খারাপ হয়ে যায়। আহা, শেষ হয়ে যাবে বইমেলা?

ফেব্রুয়ারি মাস বইমেলাকে ঘিরে সেই ভীষণ আনন্দ এখন আর আমার নেই। সেই আনন্দ পরিণত হয়েছে এখন মহা-ভয়ে। এখন বইমেলার কথা মনে পড়লে আমি ভয়ে কাঁপি, বেদনায় নীল হই। ২০০৪ সনে এই ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলার ফুটপাতে নাস্তিক লেখক হুমায়ূন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে কুপিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল ইসলামিস্টরা। এই ফেব্রুয়ারি মাসে নাস্তিক লেখক থাবা বাবাকে জবাই করে হত্যা করেছে ইসলামিস্টরা। এই ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলার ফুটপাতে নাস্তিক লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে ইসলামিস্টরা।

কী ছিল খুন হয়ে যাওয়া এই লেখকদের অপরাধ? তারা অমানবিক, বর্বর, বানোয়াট, ভুয়া ধর্মগুলি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। এবং নিজেরা অন্ধকারমুক্ত হয়েই ক্ষান্ত হননি। সমস্ত মানুষকে অন্ধকারমুক্ত করার দৃঢ় অঙ্গিকার নিয়ে লিখে যাচ্ছিলেন। লেখার জন্য মানুষ মানুষকে খুন করতে পারে? কারুর লেখা পছন্দ না হলে তার সমালোচনা তারা লেখা দিয়ে করতে পারে। যুক্তি খণ্ডন করতে পারে। তা না করে ওরা লেখককে খুন করে। মানুষ খুনের উৎসব করে। এই এক-বিংশ শতাব্দী এসে ওরা ধর্মের সমালোচনার জন্য মানুষ খুন করছে আনন্দিত চিত্তে। এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য? হ্যাঁ, শুধু বিশ্বাস্যই নয় এটা বাস্তব, সত্যি। ধর্ম কী এবার একটু শান্ত মনে ভাবুন প্লিজ।

নাস্তিক লেখক অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে ইসলামিস্টরা অফিসে যাবার পথে। সে তাদের ধর্মের সমালোচনা করেছে এই অপরাধে। তার লেখার জবাব দেবার মত জ্ঞান বা সামর্থ যে তাদের নেই। কী করবে তারা? তাদের সামর্থ আছে শুধু মানুষ জবাই করার, মানুষ জবাই করে করে আনন্দ-উৎসব করার। খুনিরা জানে, ওদের চিরসাথী যেমন অজ্ঞতা, চাপাতি, ও মরণাস্ত্র তেমনি নাস্তিকদের চিরসাথী কবিতা, গান, শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান আর বই। জ্ঞান-বিজ্ঞান এইসকল খুনীদের চির জীবনের শত্রু। শিল্প সাহিত্য ও সমস্ত সুন্দর এদের চির জীবনের শত্রু।

আনন্ত খুন হবার পর ওর প্রতিবাদ সভায় গিয়েছিল নাস্তিক লেখক নিলয় নীল। তাকে অনুসরণ করে খুনীরা। নীল সেটা বুঝতে পারে। পরের দিন থানায় যায় জিডি করতে। পুলিস জিডি করে না। নীলকে উলটো তারা পরামর্শ দেয়, দেশের বাইরে চলে যেতে। ইসলামিস্টদের খুনের টার্গেট নীলকে কেন পুলিস নিরাপত্তা দেওয়ার পরিবর্তে বিদেশে চলে যাবার পরামর্শ দেয়? তার মানে পুলিস জানে এবং স্বীকার করে যে, বাংলাদেশে নাস্তিক লেখকদের কোনো নিরাপত্তা নেই এবং সরকারে এই ব্যাপারে কোনো দায়বদ্ধতা বা গরজ নেই। অথবা সরকারেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা ও সমর্থনেই হচ্ছে এইসকল নাস্তিক লেখক হত্যোৎসব। অভিদাকে তো কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল পুলিসের উপস্থিতিতেই। পুলিস অদূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিল ও খুনীদের নিরাপত্তা দিচ্ছিল। ওরা নির্বিঘ্নে খুন করে নিশ্চিন্তে চলে যাবার পরেও পুলিস এগিয়ে আসেনি। এগিয়ে এসেছিল ফটো সাংবাদিক জীবন বিশ্বাস।

অভিদা খুন হয়েছে এক বছর হয়ে গেল। এখনো এই হত্যা মামলার কোনো কূল-কিনারা দেখলাম না। দেখলাম না সরকারের কোনো সদিচ্ছা এইসকল খুনীদের বিচার করার। দেখলাম না সরকারকে কোনো উদযোগ নিতে এইরকম হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য। পুলিসের কর্মকর্তা বলেছেন, অভিজিৎ-হত্যার রহস্যের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। রহস্যই বটে। পুলিসের সামনে খুনীরা আরামে খুন করে চলে যায়, পুলিস তামাশা দেখে। খোলা রহস্যই বটে!

বইমেলা শুরু হবার আগে বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেছেন, প্রকাশকরা যেন উস্কানিমূলক বই না ছাপান। তাকে প্রশ্ন করছি, উস্কানি বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন? মানুষকে মানুষের হাত কেটে ফেলতে বলা উস্কানি? নাকি এই অমানবিকতার বিরোধিতা করা উস্কানি? পুরুষদেরকে তাদের স্ত্রীদের পিটাতে উপদেশ দেওয়া উস্কানি? নাকি এর বিরোধিতা করা উস্কানি? মানুষকে দোররা মারতে বলা উস্কানি? নাকি এর বিরোধিতা করা উস্কানি?

সরকার ও সরকারের বাঘা বাঘা লোকেরা সবাই মিলে খুনিদের রক্ষা করছে, পরম আদরে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে ওদের। আর ফতোয়া দিচ্ছে ভিকটিমদের বিরুদ্ধে, লেখার জন্য খুন হয়ে যাওয়াদের বিরুদ্ধে।

হ্যাঁ, আমি ভীত। আমি ভীষণ ভীত এই খুনীদের ভয়ে। দিনরাত ঠকঠক করে কাঁপি আমি এই খুনীদের ভয়ে। এদের ভয় পাওয়া ছাড়া আমার আর কী করার আছে। আমি তো রাষ্ট্রপ্রধান নই যে এই খুনীদের বিচার করবো। আমার তো ক্ষমতা নেই লেখকদের নিরাপত্তা দেবার। খুনীদের অক্ষম ভয় পাওয়া ছাড়া আমি আর কী করবো?