বিজ্ঞানের একখানা বই পড়ে মণ্ডল গ্রামের সামান্য কৃষক খবির শিকদারের সব কিছু ওলোট পালোট হয়ে যায়। রাতে চাঁদ উঠলে একা একা ভাবতে থাকে, এ কেমন কথা, অন্যের আলো নিয়ে এতোটা উজ্জ্বল কি করে হয়! এতোটা স্নিগ্ধতা কিভাবে ছড়ায়! তা-ও তো এক দুই দিন নয়, বছর বছর ওভাবে ধার করে চাঁদের কেমনে চলে! আমি তো মাতুব্বর সাবের থেকে কয়টা ধান ধার করলেও সময় মতো ঠিক তা ফেরত দিয়ে দেই, আর যদি দিতে দেরী হয় তার লোকজন এসে যে মারধর শুরু করে সেটা ঠেকানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। আর, তুমি, শালা চাঁদ, প্রতিদিন ওই উত্তপ্ত গরম আলো থেকে ধার করে এতো মিহি-মোলায়েম-আকর্ষণীয় হও কি করে!
দাওয়ায় বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এসব ভাবে।
সেকি কথা, চাঁদ ওঠেও না, ডোবেও না! নিজের মতো করে পৃথিবীর চারদিকে আপন কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ সবই হয় চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবীর অবস্থানের উপর নির্ভর করে। অথচ আমরা ঈদের চাঁদ দেখে কতো না আনন্দ করি। কিন্তু কি মজার ব্যাপার, পৃথিবীর বাধা পেরিয়ে সূর্যের আলোতে চাঁদ যতোটুকু আলোকিত হয় ততোটুকুই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে!
খবির তেমন লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত স্কুলে যাবার পর সব চুকেবুকে যায়। বাবার ডাকেই ক্ষেতের কাজ শুরু করে। বাবা বলেছিলেন, “সংসারের অবস্থা তেমন ভাল্না, আমার সাথে চাষবাস করলি ধানি জমিতে ভালো ফলন দিবি, কলাই তিসি এটটু বেশীই হবি। আর এতো লেহাপড়া কইরে কি করবি। তুই তো ঢাহা শহরে যাইয়ে চারকি করবি না, তয় ওইসব বইখাতা নিয়ে স্কুলি না গিয়া আমার সাথে কাজে লাইগে যা।”
অতএব খবিরের আর লেখাপড়া হয় না। চাষবাস, সংসার দেখাই হয়ে ওঠে জীবনের প্রধান ব্রত।
সে তো আজকের কথা নয়, দুই যুগের বেশী। এর মধ্যে বাবা গেছে, মাও গেছে। তার আগে পাশের গাঁয়ের এক কুচকুচে কালো মেয়ের সাথে তার বিয়েও হয়েছে। তিন তিনটি সন্তানের জনক হয়েছে খবির। ওদের অবশ্য স্কুলে দেবার ব্যবস্থা সে করেছে এবং তা চালিয়েও যাচ্ছে। স্কুলের খরচ আর সংসারের ঘানি এক সাথে টানতে তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। বছরে এক দুই বার ধার দেনা করে তাও ফসল উঠলে শোধ করে দিয়ে মোটামুটি চলে যায়। বিলে বর্ষার পানি এসে গেলে একটা দীর্ঘ সময় কিছু করার থাকে না। তখন ছেলেমেয়েদের বই ঘেঁটে, গ্রামের সম্ভ্রান্ত বাড়িতে টিভি দেখে, বাজারে চা খেয়ে মোটামুটি কাটে। তাছাড়া খবিরের বাল্যবন্ধু, সহপাঠী আফজালের সাথে ওর সম্পর্কটা বেশ ভালোই রয়ে গেছে। আফজাল স্কুল পাশ দিয়ে কলেজে, সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই দুটো ডিগ্রী নিয়ে আনবিক শক্তি কমিশনে ভালো চাকরি করছে। তার কাছ থেকে দেশ বিদেশের খবরাখবর রাখা, মাঝে মধ্যে দুই একটা বই পাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে গাঁয়ের কৃষক হলেও খবির মোটামুটি ভূগোল বিজ্ঞান দর্শনের কিছু হালচাল রাখার চেষ্টা করে। আরজ আলী মাতুব্বরের একখানা বই আফজালের মাধ্যমে পেয়ে ধর্মের গোঁড়ামি সম্পর্কেও অনেক কিছু জেনেছে। কিন্তু ওসব নিয়ে একমাত্র আফজাল ছাড়া কারো সাথে আলাপ আলোচনা তেমন করেনি। শুধু স্ত্রীকে একদিন দুপুরে ভাত খেতে খেতে বলেছে, “দেখো ধর্মে কয় আমাদের আল্লা বানাইছে, কিন্তু আল্লারে কে বানাইছে তা কি আমরা জানি!” স্ত্রী শুনে তো তাজ্জব, “শোনো কথা, তালেবের বাপে কয় কি!” খবিরের বড়ো ছেলের নাম তালেব। ওই নাম ধরেই স্ত্রী তাকে সম্বোধন করে। “মানষি শুনলি তুমার বারোটা বাজাইয়ে দিবি। এইগুলান তুমারে আফজাল ভাইজান শিখাইয়া দিছে না! তুমি আমারে কইছো কইছো, এই কথা আর কাউরে কইতে যাইও না কিন্তু! নিজের বিপদ নিজি টাইনা আইনো না!”
খবির স্ত্রীর কথা শুনেছে এবং বিষয়টা যেহেতু ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই অন্যান্য হেলেচাষা বা গ্রামের আর কারো সাথে এ নিয়ে কখনোই আলাপ করেনি। আরজ আলী মাতুব্বরের উপরে হামলার কথাও সে আফজালের কাছ থেকে জেনেছে। ফলত, স্ত্রীর ভাষায় ‘উল্টা পাল্টা’ প্রশ্ন করে নিজের ও সন্তানের ক্ষতি সে ডেকে আনেনি। মসজিদের ইমামের কথাই তার কানে বার বার ধ্বনিত হয়েছে, “আমরা অতীব না-বুঝ বান্দা, আমাদের জ্ঞানের পরিমাণ অত্যন্ত সামান্য। তাই আল্লাহ আমাদের প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছেন। বলেছেন, বেশী প্রশ্ন করলে তোমরা বিপথগামী হবা। তোমাদের জায়গা হবে হাবিয়া দোজখ।”
আকাশের দিকে হাত তুলে ইমাম সাহেব আরো বলেছেন, “ওই যে অনন্ত অসীম আসমান দেখছো মিয়ারা, ওর সপ্তম আসমানে আমার প্রিয় নবীজি গিয়েছিলেন আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে। মাত্র একটি পর্দার আড়াল থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কথা বলেছিলেন আমার নবীর সাথে।” ইমাম সাহেব সুর মিলিয়ে বলেন, “ও মিয়ারা মহানবী তাঁর উম্মতের জন্যে আল্লার কাছে কেঁদে জারে জার হয়েছিলেন। চোখের পানিতে বুক তাঁর ভেসে গিয়েছিলো। আল্লাহকে বলেছিলেন আমার উম্মতের কি হবে, ওরা তো না-বুঝ। আল্লাহ তখন বলেছিলেন, হে আমার পিয়ারা দোস্ত, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আপনার উম্মতের জন্যে ছয় মাস রোজা ও দিনে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজের ব্যবস্থা করেছি। ওরা যদি পালন করে, ওদের কোনো অসুবিধা হবে না।” ইমাম সাহেবের গলার জোর আরেকটু বাড়ে, “এই ফরমান নিয়ে নবীজি ফিরে আসছিলেন, কিন্তু মিয়ারা, চতুর্থ আসমানে দেখা হজরত ইসা আলাইহে আসসালাতু আসসালামের সাথে। নবীজি খোদার দেয়া উপহারের কথা তাকে জানালেন। ইসা নবী বললেন, হে আখেরি নবী আপনি এটা কি করেছেন, এখনি আল্লাহর কাছে ফিরে যান, আপনার উম্মত এতোগুলো রোজা আর দিনে এতো এতো ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারবে না। আপনি খোদার কাছে ফরিয়াদ করুন, রোজা ও নামাজের পরিমাণ কমিয়ে দিতে।”
এটুকু বলে ইমাম সাহেব নির্দেশ দেন, “পড়–ন আল্লা হুম্মা সল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মাদ।”
উপস্থিত মুসল্লিরা পড়তে থাকেন, ইমাম সাহেব ওদিকে তাঁর জন্যে রাখা গরম দুধে চুমুক দেন। তারপর মুসল্লিদের সাথে আবার সুর ধরেন, “ওলায় আলে সাইয়ে দিনা সাফিয়ানা মুহাম্মাদ।”
হাত তুলে সবাইকে থামতে ইশারা করে বলেন, “এইতো আমার পিয়ারা নবী, উম্মতের সাফির জন্যে যিনি সারাটা জীবন ব্যয় করে যান, এখনও কবর মুবারকে শুয়ে শুয়ে তিনি তাদের জন্যে কাঁদছেন। তিনি রফরফে চড়ে আবারও চলে গেলেন সপ্তম আসমানে। আল্লাহ বললেন, হে আমার দোস্ত আপনি কেনো এসেছেন তা আমার জানা। এবং আমিতো সর্বজ্ঞানি, আপনি যে ফিরে আসবেন তা-ও আমি আগেই জানতাম। যান আমি আপনার উম্মতের জন্যে চারমাস রোজা আর তিরিশ ওয়াক্ত নামাজের ব্যবস্থা করে দিলাম।”
“হে খাদেজাতুল মজলিস, আমার নবীজি আবারো ফিরে আসেন চতুর্থ আসমানে যেখানে আমাদের আরেক প্রিয় নবী, ইসা আলাইহে আসসালাম, অন্যান্য নবীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাললেল্লাহু আলাইহে আসসালামকে স্বাগত জানান। কিন্তু চার মাস রোজা ও তিরিশ ওয়াক্ত নামাজের কথা শুনে উপস্থিত নবীরা আঁতকে ওঠেন। আমার প্রিয় নবী আবারও আল্লাহর কাছে যান।”
এই পর্যায়ে মুসল্লিদের কেউ কেউ সুর ধরে কাঁদতে শুরু করে।
ইমাম সাহেব বলেন, “আমার নবী এইভাবে বারবার আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে উম্মতের জন্যে শেষ পর্যন্ত একমাস রোজা আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আর্জি নিয়ে আসেন।” ইমাম প্রশ্ন করেন, “কি মিয়ারা, পারতা চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ আর ছয়মাস রোজা রাখতে?”
উত্তরের আশায় না থেকে তিনি নিজেই বলেন, “পারতা না। কিন্তু দেখো এখন কি সুবিধা হয়েছে। মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, আর বছরে মাত্র তিরিশ দিন রোজা।”
কিন্তু আফজালের এনে দেয়া বই ‘মহাবিশ্ব’ খবিরের মাথার সব কিছুতে তালগোল পাকিয়ে দেয়। কোথায় সাত আসমান? কোথায় চতুর্থ আসমান? অসংখ্য নক্ষত্র খচিত এই মহাবিশ্ব যে সীমানাবিহীন তা স্পষ্ট। এখানে এক দুই তিন চার পাঁচ করে তো আকাশকে ভাগ করা যায় না। বরং প্রত্যেক নক্ষত্রের একটি বলয় রয়েছে। যেমন আমাদের সূর্য, ওর বলয়কে সৌরজগত বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে রয়েছে গ্রহ উপগ্রহ। পৃথিবী তারই একটি গ্রহ আর চাঁদ হলো পৃথিবীর উপগ্রহ। ইমাম সাবের কথার সাথে এই সবের কোনো মিলতাল দেখা যাচ্ছে না। অত্যাধুনিক রকেটে চড়ে মানুষ মহাকাশে যাবার সুযোগ সৃষ্টি করেছে, গেছে তাও মাত্র আমাদের কাছের গ্রহ মঙ্গলে, কিন্তু রফরফটা কি জিনিস যাতে চড়ে নবী সাত আসমানে উঠে গেলেন। খবির ভাবলো, এ নিয়ে আফজালের সাথে কথা বলা দরকার। এর পর ঢাকা থেকে এলে ওর সাথে বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে একটা ভালো আলাপ জমাতে হবে।
এই মুহূর্তে তার মাথায় আরো একটা বিষয় খেলা করে, এই যে আমরা বলি সূর্য ওঠে সূর্য ডোবে, এটাও তো একপ্রকার মিথ্যা কথা। কারণ সূর্য তো তার জায়গায় থেকে নিজের কক্ষপথে ঘোরে, ওর তো ওঠা বা ডোবার প্রশ্নই আসে না। পৃথিবীর ঘুর্ণনের ফলে আমরা কখনো বেশী আলো কখনো কম আলো পাই, কখনো একেবারে পাই না। তার মানে চাঁদের আলো, আর চাঁদ-সূর্যের ওঠা বা ডোবা এর কোনোটাই সত্য নয়।
২.
গ্রামের মাতুব্বর বারেক চৌধুরীর বাড়ির ঠিক পশ্চিমে প্রাইমারি স্কুলের দক্ষিণমুখি তিনটি টিনের ঘর, তারও পশ্চিমে আরেকটি ঘরে এলাকার পোষ্ট অফিস, আর এই অফিসটির সাথে লাগোয়া বিশাল বটগাছের তলায় কয়েকশ’ লোকের সমাগম। একদিকে বেশ কয়েকটি চেয়ারে বারেক চৌধুরী, মসজিদের ইমাম, ইউনিয়ন বোর্ডের একাধিক মেম্বর, স্থানীয় গণ্যমান্য দু’জন ব্যবসায়ী ও এই অঞ্চলের মুক্তারসাব নামে খ্যাত আদিল মৃধা; অনতিদূরে একটি বাঁশের খুঁটির সাথে হাত মোড়া দিয়ে বাঁধা খবির শিকদার, আর এদের ঘিরে আছে উৎসুক মানুষ। এইসব মানুষের মধ্যে এলাকার কৃষক, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মি, তাঁতি পাড়ার তাঁতি, জেলে পাড়ার জেলে, মাতুব্বর সাহেবের লাঠিয়াল বাহিনী, একজন মোল্লার নেতৃত্বে টুপি পরা এবাদত পার্টির বেশ কিছু নেতাকর্মি যারা নিজেদের আল্লাহওয়ালা বলে দাবী করেন, কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার, বেশ কয়েকটি টিভি ক্যামেরা ও পরিস্থিতিকে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ ও কার্যকরী (যদিও তা সামান্য) ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে আফজাল শরীফ ও তার কিছু বিজ্ঞানমনস্ক বন্ধু।
যে খুঁটির সাথে খবিরকে বাঁধা হয়েছে তার গোড়ার দিকে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবে যে দু’এক ঘণ্টার ভেতর বাঁশটি ওখানে এই বিশেষ কার্য সম্পাদন করার জন্যে পোঁতা হয়েছে, কারণ পা দিয়ে পাড়িয়ে যে ওটার গোড়া শক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে সেই দাগগুলো এখনো স্পষ্ট এবং দু’একটি ঢেলা এর-ওর পায়ের নিচে এমন কি গণ্যমান্যদের চেয়ারের নিচ দিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খবিরকে অবশ্য অতোটা বিমর্ষ দেখাচ্ছে না, বটপাতার ফাঁক দিয়ে কোত্থেকে একটু রোদ ওর মুখের উপর চিকচিক করছে। উচ্চতায় পাঁচ ফুট চারইঞ্চি এই মানুষটির শক্তিশালী শরীর, বেশ বড়োসড়ো বাবরি চুল ঘাড়ের দুইপাশে ঝুঁকে পড়েছে, যারা তার পিছনে দাঁড়ানো তারা অবশ্য মাথার তালুর ঠিক পশ্চাৎ দিকটায় একটি টাকও আবিস্কার করে থাকবেন। অল্পবয়স থেকে বড়ো চুল রাখার জন্যে হয়তো চল্লিশ পেরোনোর আগেই খবিরের কিছু কিছু চুল ওঠা শুরু করেছিলো, এখন পঞ্চাশের কোঠায় ছুঁই ছুঁই হয়ে সেখানে একটি বড়ো সড়ো খেলার মাঠ তৈরী হয়েছে। তবে সামনে থেকে ওকে দেখলে কেউই বুঝতে পারবে না যে ওর বয়স ত্রিশের উপরে।
ওদিকে আফজাল শরীফের পাশেই খবিরের স্ত্রী দাঁড়ানো, যার চোখে সমুদ্রের সব জল একত্রিত হয়ে আছে, যা থেকে অঝোর ধারায় ঝরেই যাচ্ছে। স্ত্রীর ডান ও বা পাশ ঘেঁষে একেবারে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে তিন সন্তান, যাদের মধ্যে তালেবের বয়স পনেরো, সে স্থানীয় হাইস্কুলে দশম শ্রেণীর কৃতি ছাত্র, বারো বছরের মেয়ে ও সাত বছরের ছেলেটির চোখেও বিস্তর জল।
স্বভাবতই ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়া আর সেলফোনের যুগান্তকারী বিপ্লবের ফলে এই বটতলায় খবিরের বিচার প্রক্রিয়ার কথা সারা দেশে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় দৈনিক পত্রিকা ও টিভি চ্যানোলগুলো এই সংবাদ আগেই পেয়ে গেছে। তাই তারাও সরেজমিনে রিপোর্ট করার জন্যে এসেছে। চ্যানেল চুরাশি সরাসরি সম্প্রচার করছে এই অনুষ্ঠান। অন্যদিকে চ্যানেল শূন্যশূন্য দুই বিশেষ প্রতিবেদন করবে বলে পুরো অনুষ্ঠানটি ভিডিও করছে। বটগাছের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দু’টি ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে ক্যামেরাম্যান ও প্রযোজকেরা সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছেন। চ্যানেল চুরাশির একটি বিশাল স্ক্রীনও কাছাকাছি বসানো হয়েছে। ইতিমধ্যে ক্যামেরা দু’বার খবিরের স্ত্রীকে ফোকাসও করে ফেলেছে। এই সম্প্রচার আকর্ষণীয় করার জন্যে চ্যানেলটি ওদের স্ক্রীনের বামপাশে উপরের দিখে একটি বক্স করে খবিরের হাতবাঁধা ছবিটি সার্বক্ষণিক ভাবে সেঁটে রেখেছে।
ইতিমধ্যে স্লোগান দিতে দিতে আরো একটি টুপিমাথা দল এসে হাজির হয়। এটা তেঁতুল পার্টি। ওদের স্লোগান, “খবিরের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই। খবির তোমার চামড়া, তুলে নেবো আমরা! সরকারের দালালেরা, খবিরের বন্ধু। খবির তুমি কৃষকের, কলঙ্ক কলঙ্ক।”
ওরা বটতলায় এসে গেলে আফজাল শরীফের ছোট্ট দলটি এবং সাংবাদিকরা ছাড়া উপস্থিত অন্যান্যরাও ওদের সাথে গলা মেলায়। মসজিদের ইমাম চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজেই স্লোগান ধরেন, “এই খবিরের ঠিকানা, হাবিয়া হাবিয়া। চাঁদ-সূর্যের অপমান, সইবো না সইবো না। যেই চাঁদে আমার ভাই, সেই চাঁদই আমরা চাই।”
ইমাম সাহেবের স্লোগান শেষ হলে চারিদিক বেশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মাতুব্বর সাহেব ডান হাত তোলেন। দর্শনার্থীরা হাতের দিকে তাকায়। তিনি বলেন, “আমরা এখানে সমবেত হয়েছি একটি জঘন্য অপরাধের বিচার করতে।” খবিরের দিকে তর্জনি নির্দেশ করে বলেন, “আমাদের অপরাধী এখানে বাঁধা আছে। আপনারা ধৈর্য ধরে দেখুন ও শুনুন চাঁদ-সূর্যের নামে অপবাদ দেবার কি বিচার আমরা করি। আপনাদের এই বলে আশ্বস্ত করছি যে এই ক্ষমাহীন অপরাধের আমরা এমন একটি কঠিন শাস্তি খুঁজে বের করবো যাতে আর কেউ কোনো দিন এমনতর মিথ্যা বানোয়াট উদ্ভট কিছু বলে আমাদেরকে, আমাদের কৃষক ভাইদেরকে, গ্রামের আপামর জনগণকে বিভ্রান্ত করার সাহস না পায়।”
মাতুব্বর বারেক চৌধুরী এবার ইমাম সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “আপনি অভিযোগ উত্থাপন করুন।”
ইমাম উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমে তার টুপি, এর পর পাগড়ি ঠিক করেন। পকেট থেকে ছোটো একটি আতরের শিশি বের করে ডান হাতের তর্জনিতে লাগিয়ে দুই ঘাড়ে ছোঁয়ান। তারপর শিশিটিকে যথাস্থানে রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বলতে শুরু করেন, “নাহমাদুহু অনুসাল্লিয়ালা রাসুলুহুল কারিম, আম্মা বায়াদ; হে উপস্থিত হাজেরানে মজলিস, আমরা এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম দূর দূরান্ত থেকে আমাদের ভাইদের আসার জন্যে। ইতিমধ্যে আমাদের এখানে সর্বশেষ কাক্সিক্ষত কাফেলা, তেঁতুল পার্টির ভায়েরাও উপস্থিত হয়েছেন। অতএব, আল্লাহর নামে ও আমাদের প্রিয় মাতুব্বর সাহেবের অনুমতিক্রমে আমরা বিচারকার্য শুরু করছি। আপনারা জনেন যে, এই বিদাত নাফারমান, এই কমবক্ত, (কমবক্ত বলার সাথে সাথে হুজুরের চোখ দু’টি খুলে যায়। তিনি এমন একটি ভাব করেন যে আকাশ থেকে অজস্র আলো এসে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।) গুনাহগার, বলেন নাউজবিল্লাহ, প্রথমে প্রচার করেছে যে চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। আপনারা জানেন আমার প্রিয় নবী হযরতে মুহাম্মাদ মোস্তফা সাললেল্লাহু আলাইহে আসসালাতু আসসালাম শুধু মাত্র অঙ্গুলি নির্দেশ করে এই চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করে ইহুদিদেরকে তাঁর মজেজা দেখিয়ে আবার খণ্ড দু’টি মিলিয়ে দিয়েছিলেন, আর আজ এই নাফারমান প্রচার করছে যে সেই চাঁদের নিজস্ব আলো নেই। আরো বলেছে যে চাঁদ-সূর্য কোনোটাই ওঠেও না ডোবেও না।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ও মিয়ারা তোমরা কি আকাশে সূর্য দেখতেছো?” সবাই সমস্বরে বলেন, “জ্বী হুজুর।” “তাইলে ওই কমবক্ত কি করে বলে যে সূর্য ওঠে না, ডোবে না। এই মিথ্যা দিয়ে ও আসলে আমাদের ধর্মকেই আঘাত করেছে। আমাদের নবীর চাঁদ-সূর্যকে আঘাত করেছে। আবার কৃষকের মধ্যে সেইসব প্রচারও করে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞানের কথা বলছে। আদতে বিজ্ঞান হলো শয়তানের পাঁচ পা; আমাদের এই খবির শয়তানের পাঁচ পা দেখেছে। যে শয়তান সারা জীবন ধর্মের শত্র“, তার সাথে হাত মিলিয়ে এই গুনাগারও আমাদের শত্র“ হয়ে গেছে।”
স্লোগান ওঠে, “বিচার হবে বিচার হবে, খবির খবিসের বিচার হবে। খবির তুমি যে-ই হও, বাংলা তোমার জন্যে নয়। খবির তোকে দেবো বলি, রক্ত দিয়ে খেলবো হোলি।”
যখন স্লোগান চলে, খবিরের স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে এক হয়ে কাঁদতে শুরু করে। ওদের কান্নার সুর যদিও স্লোগানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। তারপরও ওদের কান্না যেনো পুরো পরিবেশটাকেই ব্যঙ্গ করে যায়।
ইমাম সাহেব বসলে খবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে কৃষক নেতা রতন বিশ্বাস। রতন বলে, “আমরা কৃষক। জমি চাষ করি। একবেলা খাই এক বেলা না খেয়ে থাকি। থাকলে খাই, না থাকলে উপোস দেই। আমরা লেখাপড়া জানি না। কিন্তু আমাদের খবির লেখাপড়া না জেনেও নিজে নিজে বইপত্র পড়ে অনেক কিছু শিখেছে। বছর বছর ধরে বিজ্ঞানের নানা পদ্ধতির কথা বলে সে আমাদের উপকার করেছে। জমিতে ফলন বাড়ানোর জন্যে কি সার দিতে হবে, কিভাবে দিতে হবে খবিরই বলে দিয়েছে। আমাদের জমিতে শ্যালোম্যাশিন দিয়ে কতোটুকু পানি দিলে ভালো হবে তাও খবিরের কাছ থেকে শেখা। আমরা ওকে ভাই বলে জানি। আমরা ওকে বন্ধু বলে জানি। কিন্তু এই ভাই, এই বন্ধু এমন একটি কাজ কেনো করলো বুঝে উঠতে পারছি না। ও কেনো প্রচার করতে লাগলো সূর্য ওঠে না ডোবে না, চাঁদ ওঠে না ডোবে না, চাঁদের কোনো আলো নেই। না না আমরা এটা মেনে নিতে পারি না, আমরা এটা মানিনি, তাই খবিরের বিচার চাই, ও আমাদের কৃষক সমাজের কলঙ্ক।”
এরপর সুযোগ দেয়া হয় এবাদত পার্টির নেতাকে কিছু বলার জন্যে। তিনি দাঁড়িয়ে গলা পরিস্কার করে বলেন, “হাজেরানে মজলিস, এই জালেম সরকারের আমলে কতো কিছুই হচ্ছে! আমাদের নেতাদের হাজতে রাখা হয়েছে। একজন মোল্লাকে এমনকি ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। ট্রাইবুনালের নামে সারা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আমাদের নেতাদের বিচার করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে তারা মানবতাবিরোধী। এই জালেম সরকার এইসব কার্যকলাপ শুরু না করলে দেশে খবিরের মতো খবিসদের উত্থান হতো না। হাজেরানে মজলিস, খবির যে বই পড়ে চাঁদ-সূর্যের নামে কলঙ্ক লেপন করেছে, সেই বইয়ের লেখক হুমায়ুন আজাদকে আমরা বইমেলাতেই কতল করার চেষ্টা করেছিলাম, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমাদের কর্মিরা আল্লাহু আকবার বলে পিছন থেকে কোপ বসিয়েছিলো, তাকে ফালাফালা করার আর্জি নিয়ে আরো দুই কোপ বসানো হয়, কিন্তু লোকজন ছুটে আসার কারণে তাকে আমরা তখন সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ করে দিতে পারি নাই। তারপরের ইতিহাস আপনারা সবাই জানেন, তাকে বিদেশে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্যে, কয়েকমাস পরে কিছুটা ভালো হয়ে ফিরে আসলে আমাদের নেতারা কায়দা করে জার্মানির একটা স্কলারশিপ দিয়ে সেদেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু জানেন, আল্লাহর মাটি সব এক, জার্মানির মাটি আর বাংলাদেশের মাটি সেই অর্থে আলাদা কিছু নয়। তাই আমরা ওই মাটিতেও তাকে একদিনও নিশ্বাস নিতে দেইনি। আমাদের কর্মিরা সারা জাহানে ছড়িয়ে গেছে, তারাই ওখানে তাকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে, যার কোনো ট্রেস আমরা রাখিনি। আমাদের কাজ সূক্ষ্ম, আমরা ধর্মের সৈনিক, আমরা জালিমদের খতম করে এই দেশকে পূর্ণ ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করবো। এই জালিম সরকার ও তার দোসরদের উৎখাত করবোই ইনশাআল্লাহ!”
এবাদত নেতার বক্তৃতা শেষ হলে তার দলের কর্মিরা স্লোগান দেয়, “জালিমের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। সরকারের তাঁবেদার, খবিরের রক্ষা নেই। বিজ্ঞানের সব বই, পুড়িয়ে দাও পুড়িয়ে দাও। আল্লাহর এই মাটিতে, আমরাই থাকবো।”
উঠে দাঁড়ান মাতুব্বর সাহেব। বলেন, “প্রিয় ভাইয়েরা আপনারা তো সব শুনলেন। খবিরের অপরাধ গুরুতর, তার একটা কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু আমরা বিচার সুষ্ঠু করতে চাই। খবিরের পক্ষের কেউ থাকলে হাত তোলেন, তাকেও আমরা কথা বলতে দিতে চাই।”
বলা বাহুল্য যে এক আফজাল শরীফ ছাড়া ওই আসরে খবিরের পক্ষে আর কেউ হাত তোলেননি। অতএব আফজালকে সুযোগ দেয়া হয়। আফজাল কিছু বলার আগেই খবিরের স্ত্রী জোর গলায় কেঁদে উঠে বললেন, “ভাইজান আমার স্বামীরে বাঁচান, ভাইজান উনারে বাঁচান।” সাথে সাথে তার তিন ছেলেমেয়েও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। অদূরে বসা লঠিয়াল বাহিনীর সর্দার ধমক দিয়ে তাদের থামায়, “আর একটুও টুঁ শব্দ করলে এই লাঠির বাড়িতে তোদের খুলি ভেঙে দেবো। চুপ থাক!” অতএব প্রাণের ভয়ে ওরা চুপ করে ঠিকই কিন্তু ওদের চোখের ধারা কেউ বন্ধ করতে পারে না।
আফজাল শরীফ বলেন, “খবিরকে আমি চিনি সেই ছোটোবেলা থেকে। এখানে আপনারা যে ব্যাপারটিতে ওকে বিচারের জন্যে এনেছেন, সেটি সম্পূর্ণ হাস্যকর। ও নিজে থেকে কিছুই বলেনি, ও একজন কৃষক, কৃষিকাজে মানুষকে সহায়তা করা ওর নেশায় পরিণত হয়েছে। আপনারা অনেকেই যা করেন না তাই ও করে, সেটা হলো মানুষের উপকার, তাও বিনে পয়সায়। আরো একটা কাজ করে খবির, অবসরে বই পড়ে। এই দেশ যখন বই বিমুখ হয়ে পড়েছে, তখন খবিরের মতো একজন কৃষক বই পড়ে সময় কাটায়। এটা তো অন্যায় কিছু নয়। আজ পুব ও পশ্চিমের সমস্ত উন্নতির মূলে বই, বই হলো মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডার। খবির যা বলেছে তা তো বিজ্ঞানের কথা, ধ্র“ব সত্য। চাঁদ যে সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়, এবং সেই আলো আমাদের পৃথিবীতে এসে কোনো কোনো রাতে আঁধার তাড়ায়, রাতকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে, সেটা তো সত্য। অন্যদিকে আমরা যে সূর্য ওঠা ও ডোবার কথা বলি, তাও তো বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সত্য নয়। পৃথিবী আপন কক্ষপথে সর্বদাই পূব থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরছে, এটা তো আমরা ক্লাস ফাইভের বিজ্ঞান বইতেই পড়েছি। এই ঘূর্ণন ক্রিয়ায় পৃথিবীর যে অংশ সূর্যের উল্টোদিকে চলে যায় সেই অংশে আলো পড়ে না, নেমে আসে অন্ধকার, সেটা রাত। আর যে অংশে আলো পড়ে সেখানে হয় দিন। এই সত্য যারা জানে না, খবির তাদের কাছে এটা প্রচার করেছে, সেতো কোনো অন্যায় করেনি। একটি অন্ধ সমাজে আলো প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। আমি উপস্থিত সকলকে বলবো, আপনারা এই মুহূর্তে ওর হাতের বাঁধন খুলে দিন। এটা অন্যায়, একজন সম্পূর্ণ নির্দোষ ব্যক্তিকে, একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তিকে এভাবে অপমানের কোনো মানে হয় না।”
ইউনিয়ন পরিষদের একজন মেম্বার উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “বাবাজি আফজাল, তুমি লেখাপড়া শিখে শহরে থাকো, ওখানে চাকরিবাকরি করো। শহরের ও গ্রামের হালচাল এক নয়। গ্রামকে তোমরা শহর বানাতে পারো না। আমাদের বাপ-দাদারা যা শিখিয়েছেন আমরা সেই শিক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আমরা নিজেদের চোখে যা দেখি তাই-ই বিশ্বাস করি। আমরা দেখছি যে সূর্য উঠছে, মাথার উপরে আসছে আবার একসময় পশ্চিমে হেলে পড়ছে। এর তো ব্যতিক্রম হচ্ছে না। কেয়ামতের দিন সূর্য উঠবে কেবল মাথার উপরে।”
পাশে বসা অন্য মেম্বার শুধরে দেন, “একটু পশ্চিম দিকে হেলে।”
“হ্যাঁ, বাবা, কেয়ামতের দিন সূর্য উঠবে মাথার উপরে একটু পশ্চিম দিকে হেলে। সেদিন আমাদের হবে মহা বিপদ, যে যার মতো দৌড়াতে থাকবে ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি বলে। সেই কথা তো এখন খাটে না, এখন তো আর কেয়ামত হচ্ছে না যে সূর্য উঠবেও না ডুববেও না। অতএব তুমি যাই বলো না কেনো খবির শিকদারের বিচার হতেই হবে। নইলে ওর মতো আরো অনেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, আমাদের গ্রামগুলোকে ছারখার করে দেবে।”
দ্বিতীয় মেম্বার বলেন, “খবিরের তো বিচার হতেই হবে, তার আগে ওই বইখানা আমরা এই সভায়ই পুড়াবো।”
টুপি-দাড়িদের নেতা তার ব্যাগ থেকে বের করে বলেন, “এই যে ‘মহাবিশ্ব’।” মাতুব্বর সাহেব হুকুম দেন সবাইকে একটু সরে দাঁড়াতে। পায়ে পায়ে সরে গেলে বৃত্তটা বেড়ে গিয়ে মাঝে ফাঁকা জায়গা তৈরী হয়। টুপি-দাড়ির নেতা আর দুই মেম্বার এগিয়ে যান, লাঠিয়াল বাহিনীর সর্দার পকেট থেকে ম্যাচের কাঠি বের করে জ্বালিয়ে দেন, উপরে ধরা ‘মহাবিশ্ব’ নিমেষেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। স্লোগান শোনা যায়, “পাপীদের বইগুলো, জ্বালিয়ে দাও, জ্বালিয়ে দাও। বিজ্ঞানের বইগুলো, জ্বালিয়ে দাও জ্বালিয়ে দাও। যারা পাপী তাদেরকেও, ধ্বংস করো ধ্বংস করো।”
বিচারকার্য শেষের দিকে, আর এই ধরনের সালিশি বিচারে হয়তো আগে থেকেই শাস্তি নির্ধারণ করে রাখা হয়। ফলে এই আলাপ আলোচনা, শুনানি, সব-ই লোক দেখানো। এই লোক দেখানো প্রক্রিয়ায়ই খবিরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়। চ্যানেল চুরাশির ক্যামেরা ফোকাস করা হয় খবিরের উপরে। ওকে এই মুহূর্তে ক্লান্ত দেখালেও, যখন কথা বলে ওঠে, ওর স্বর সবার থেকে পরিস্কার, সবার থেকে দৃঢ় ও স্পষ্ট শোনা যায়। খবির বলে, “আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমি বিজ্ঞানের কথা, জ্ঞানের কথা বলেছি। হ্যাঁ, আমি কৃষক, কৃষক হয়ে বিজ্ঞান পড়া যাবে না, বই পড়া যাবে না, সেটা ঠিক নয়। বরং আপনারা যারা আমার বিচারের নামে এই প্রহসন করছেন, তারাই ভুল করছেন। এই মাটিতে একদিন আপনাদেরই বিচার হবে। আরজ আলী মাতুব্বর মিথ্যা বলেন নি, তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, যার জন্যে তাঁকে নাজেহাল হতে হয়েছিলো। হুমায়ুন আজাদ মিথ্যা বলেননি, তিনিও মানুষকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন, তাঁকে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলো। আর এই সভায়, তাঁর লেখা সেই মহান বই পুড়ানো হলো, এই অন্যায় মানুষ মেনে নেবে না, এই অন্যায় দেশের শিক্ষিত সমাজ মেনে নেবে না। আপনারা ভুল করছেন, এই ভুলের থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনাদের এই ভুলের সুযোগ নিয়ে এই সভায় রাজাকারেরা টুপি পরে হাজির হয়েছে, তিরিশ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার পরে তারা কোনো অনুশোচনা তো করেইনি, বরং বিশেষ ট্রাইবুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারিক কার্যে আটকা থাকা রাজাকার নেতাদের সাফাই গাইছে। আর আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব, আমি যাকে সারা জীবন শ্রদ্ধা করে এসেছি, আজ তিনি বললেন, বিজ্ঞান নাকি শয়তানের পাঁচ পা, কি ভয়াবহ কথা, ইমাম সাহেব একটু হিসাব করে দেখুন তো বিজ্ঞানের কি কি সুযোগ সুবিধা আপনি ভোগ করছেন। মসজিদে যে বিদ্যুৎ বাতি জ্বলে সেটা কি বিজ্ঞানের অবদান নয়, যে পাখার নিচে দাঁড়িয়ে আপনি নামাজ পড়েন সেটা কি বিজ্ঞানের আবিষ্কার নয়, যে মাইকে আপনার কণ্ঠ ভেসে আসে, এমনকি যে বাথরুমে আপনি যান সেটাও তো বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বানানো। ধরুন সেটা বাদ দিলাম, ওই যে পাকা রাস্তা দেখছেন, যে রাস্তা দিয়ে শহরের ভাইয়েরা, সংবাদকর্মীরা এসেছেন আপনাদের এই বিচারকার্য দেখার জন্যে, সেই রাস্তাও তৈরী বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, আগে কাদায় এই রাস্তা দিয়ে হাঁটা যেতো না, এখন ইট-সুরকি দিয়ে কি চমৎকার পাকা করা হয়েছে, এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা কতো উন্নত হয়েছে, ঢাকা থেকে আমাদের গ্রামে চার ঘণ্টায় চলে আসা যায়, অথচ এই মণ্ডল গ্রাম এক সময় ছিলো অজপাড়াগাঁ, এখন বাজারের চেহারা ফিরে গেছে, এই গ্রামে বসে এখন সবকিছু পাওয়া যাচ্ছে, এটাকি বিজ্ঞানের অবদান নয়! ইমাম সাহেব, ঠিক আছে, ছাড়–ন ওসব, আপনার পকেটে হাত দিয়ে দেখুনতো, যে মোবাইলটা আছে, যার মাধ্যমে দূর দূরান্তে যোগাযোগ করছেন প্রতিনিয়ত, এটাও কি বিজ্ঞানের অবদান নয়! অতএব বিজ্ঞান শয়তানের পাঁচ পা নয়, বিজ্ঞান আমাদের উন্নতির প্রধান হাতিয়ার। বিজ্ঞান সামাজিক কুসংস্কারকে চিরদিনের জন্যে ছুঁড়ে ফেলে দেবার জ্ঞান আমাদের মগজে প্রবেশ করিয়ে দেয়। তাই বলছি, দয়া করে এই হাস্যকর প্রহসন বন্ধ করুন। সারা পৃথিবী হাসবে আপনাদের এই অপকর্ম দেখে, আপনাদের মধ্যযুগীয় পশু মনে করবে। আপনারা নিজেদেরকে বাঁচান।”
খবিরের কথা শেষ হতে না হতেই মাতুব্বর সাহেব বলেন, “ও আমাদের ভয় দেখালো, আমাদের পশু বললো, বললো নিজেদেরকে বাঁচান! কতো বড়ো সাহস! বলে কি এই শয়তানটা!”
ইমাম সাহেব বলেন, “আমার সাথে বেয়াদবি! এ্যাঁ, আমার সাথে বেয়াদবি, রাখ তোর মাথা থেকে শয়তান নামাচ্ছি।”
দাড়ি-টুপি তথা এবাদত পার্টির নেতা বলেন, “আমাদের নেতাদের এইভাবে অপমান, আমরা কিছুতেই মেনে নেবো না।”
এতোক্ষণ তেঁতুল পার্টির কেউ কিছু বলার সুযোগ পায়নি। এই মুহূর্তে ওদের ভেতর থেকে লম্বা গোছের একজন, যার সারা শরীর বিশাল আলখাল্লায় ঢাকা, মাথায় টুপি, বলেন, “মাইয়ালোক যখন দেশের ক্ষমতা দখল করে তখন এমনই হয়, সামান্য কৃষকের কাছ থেকে দেশকে অপমানিত হতে হয়। এই জন্যে আমাদের হুজুর তেঁতুল গাছের নিজ দিয়ে যেতে নিষেধ করেছেন। আর বিজ্ঞানের বইখাতা তো তেঁতুলের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আপনারা তা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়!”
পার্টির অন্যান্যরা স্লোগান ধরে, “তেঁতুল হুজুর তেঁতুল হুজুর, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। বাংলাদেশের মাটিতে, আমরাই থাকবো। মাইয়া লোকের শাসন, মানি না মানবো না।”
স্লোগান শেষ হলে সামনে থেকে উঠে দাঁড়ান একজন ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, “আমরা এলাকায় সুন্দর একটি বাজার করেছি যাতে এতদ অঞ্চলের মানুষের কোনো অসুবিধা না হয়, তাদের দরকারী জিনিসপত্র যেনো প্রয়োজনে হাতের কাছে পায়। বাজারে চায়ের দোকানে খবির প্রতিদিন চা খেয়েছে, ওর সব অপপ্রচার চালানোর সুযোগ পেয়েছে। আমরা এই মজলিসে ঘোষণা দিচ্ছি যে আজ থেকে খবির আমাদের এই পবিত্র বাজার মুবারকে অবাঞ্ছিত।” দ্বিতীয় ব্যবসায়ী নেতা বললেন, “কিন্তু আমরা অতোটা অমানবিক নই, তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে খবিরের ছেলেমেয়েদেরকে এই ফরমানের আওতা মুক্ত রাখছি।”
মুক্তারসাব বলেন, “আ হা হা, খবির, তুই হলি একজন কৃষক, তোর বাবা ছিলো হেলেচাষা, তুই কেনো বই পড়তে গেলি। গরীবের পেটে কি ঘি সহ্য হয়রে! হয় না।”
এবার রায় ঘোষণার পালা। পুরো সভায় পিনপতন নীরবতা, সাংবাদিকদের কলম থেমে গেছে, টিভি ক্যামেরা বিচারকদের উপর স্থির হয়ে আছে, দৈনিকের ফটোগ্রাফারেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। উঠে দাঁড়ালেন মাতুব্বর বারেক চৌধুরী। সবগুলো চোখ এখন তার দিকে, তিনি ডান হাত আকাশের দিকে তুলে তর্জনি টান করলেন, চোখগুলো তার তর্জনিতে স্থির হলো। মুখে বললেন, “ছিলো না।” বারবার ধ্বনিত হলো ছিলো না, ছিলো না, ছিলো না। তারপর তার হাত আস্তে আস্তে উত্তর-পশ্চিম দিকে নেমে যেতে থাকলো, তর্জনি তখনও একই ভাবে খাড়া, চোখগুলো হাতকে অনুসরণ করে নামতে লাগলো, হাতের সামনের দিকের জায়গাটা খালি হয়ে গেলো, লোকগুলো সরে দাঁড়ালে তর্জনি যেখানটায় স্থির হলো, সেখানে ভেসে উঠলো একটি পশুর খোঁয়াড়। বারেক চৌধুরী বললেন, “আমি বানিয়েছি। বহুদিন ধরে ভাবছিলাম এই অঞ্চলে খোঁয়াড়ের প্রচলন প্রায় উঠেই গেছে, একটা বানানো দরকার। আজকের এই বিচারিক কার্যের সুবিধার্থে ওটা আমি বানিয়েছি।” টিভি ক্যামেরা খোঁয়াড়ের উপর প্যান করা হলো, দৈনিকের ফটোগ্রাফাররা মুহুর্মুহু ছবি তুলতে থাকলেন, অসংখ্য মোবাইল ফ্লাসের পর ফ্লাস করে গেলো। মাতুব্বর সাহেব বললেন, “এই সভা রায় দিচ্ছে, চাঁদ ও সূর্যকে গুরুতর অপমানের দায়ে আগামি তিনদিন পাপিষ্ঠ খবির এই খোঁয়াড়ে আটকা থাকবে। আমরা রাতে তাকে চাঁদের আলো উপভোগ করতে দেবো, দিনে সূর্যের উত্তাপ পোহাতে দেবো। এই তিনদিন ওকে কোনো খাবার কিম্বা তৃষ্ণার পানি পর্যন্ত দেয়া হবে না। যদি কেউ সেই চেষ্টা করে পাহারারত লাঠিয়ালরা সাপ মারার মতো তাকে লাঠি দিয়ে এই জমিনের উপর শেষ করে দেবে। তিনদিন পরে ওকে বের করে, মুচি পাড়ার মুচিদের জুতা দিয়ে বানানো মালা ওর গলায় পরিয়ে বাদক দলের বাজনার তালে তালে এই গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হবে। এই কাজে কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে লাঠিয়াল বাহিনী তাদেরও বিষধর গোখরো মারার মতো মণ্ডল গ্রামের জমিনের সাথে মিশিয়ে দেবে।”
মাতুব্বরের রায় ঘোষণার সাথে সাথে লাঠিয়াল বাহিনী খবিরকে নিয়ে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয়।
(চলবে)
ভাই, সব জায়গায় ধর্মের লোকদের গোড়ামি কেন তুলে ধরছেন। আচ্ছা, ধরছেন ভাল কথা। সঙ্গে সঙ্গে ধর্মগ্রন্থের ভুলগুলোও ধরাই দেন না। এরকম কাচা কাজ করলে তো কেউ মান্তে চাইবে না
ভাইয়া, এখনও কি এরাম মসজিদ দেশে আছে, যারা কিনা এরকম অযৌক্তিক দাবি তোলে? ধর্মীয় গোঁড়ামি তুলে ধরার তো আরও উদাহরণ দিতে পারতেন। এইটা রিডিকুলাস হয়ে গেল না? 🙂
মেরাজের এই বর্ণণাটি বহুবার শুনেছি। মেরাজে গিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের পর প্রথমে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ এবং বছরে ছয়মাস রোজার আদেশ নিয়ে ফিরছিলনে মহাজ্ঞানী মহানবী মহম্মদ (সঃ)। পরবর্তিতে ঈসা(আঃ) ও অন্যান্য নবীদের পরামর্শে একাধিক বার ফিরে যান আল্লাহর কাছে, এবং শেষ মেষ দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং বছরে তিরিশ দিন রোজায় নামিয়ে আনা হয়। উম্মতের পক্ষে দিনে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ এবং ছয় মাস রোজা অসম্ভব এক দায়িত্ব হয়ে যাবে, এই কথাটি ঈসা (আঃ) এবং অন্যান্য নবীরা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেও নবীশ্রেষ্ঠ মহম্মদ (সঃ) সেটা কেন বুঝতে পারলেন না? কোথায় যেন মিলছে না!!!
@সুজন আরাফাত, অলীক আনন্দ:
আপনারা যে আমার গল্পটি পড়েছেন এবং আপনাদের ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন এর জন্যে অশেষ ধন্যবাদ। আমি অনুপ্রাণিত। দুঃখিত, আপনাদের অপেক্ষায় রাখতে চাইনি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় গল্পটি বেশ বড়ো হয়ে উঠেছে। তাই কয়েক কিস্তিতে পোস্ট করবো। …মুক্তমনার অন্যান্য যেসব বন্ধুরা গল্পটি পড়েছেন তাদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ।
ভাল লাগলো…
পরবর্তী প্রকাশের অপেক্ষায় রইওলাম…
বাস্তবতার আলোকে ধর্মীয় গোঁড়ামি কে গল্পে তুলে ধরার প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।ফোনের স্ক্রিন থেকে একবারো চোখ না সরিয়ে লেখাটা পড়ে শেষ করলাম।পরের পর্বের জন্য প্রতীক্ষায় রইলাম।