ডিরোজিও এই বাংলায় অতি পরিচিত নাম | তিনি বাংলার নবজাগরণের স্রষ্টা ছিলেন | তার সম্বন্ধে অনেক কথা আমরা জানতে পারি যে তিনি ইয়ং বেঙ্গল দলের স্রষ্টা | তিনি হিন্দু ধর্মের প্রচলিত গোড়ামির বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছিলেন | তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার শিষ্যদের মধ্যে কেউ কেউ খ্রিষ্টান হয়ে গিয়েছিল যেমন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ইত্যাদি | কিন্তু কেমন ছিল তার শিক্ষাদান পদ্ধতি? কি ছিল তার ক্লাসে যা এত ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করেছিল গৃহত্যাগ এমনকি ধর্মত্যাগ পর্যন্ত করতে ? এইসব প্রশ্নের উত্তর বহুদিন ধরে আমার মনকে আলোড়িত করেছে | কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি |

হঠাত এই সম্বন্ধে গুগুল ঘাটতে ঘাটতে পেলাম এই অমূল্য বইটিকে | শান্তিরঞ্জন বসু মহাশয়ের লেখা এবং বাংলার মুখ প্রকাশনীর ছাপা | দৌড়ে গেলাম কলেজ স্ট্রীটে | বইটাকে দেজ পাবলিশিং-এ পেয়ে গেলাম | বাড়ি এসে হামলে পড়লাম বইটার উপর | ডিরোজিওর ক্লাসে একজন ফরাসী গবেষক উপস্থিত ছিলেন | নাম ভিক্তর জকম | তার লেখা থেকেই মূলত এই ক্লাস সম্বন্ধে জানা যায় |

ডিরোজিওর ক্লাসগুলো ছিল এক একটি বিতর্কসভা | বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের মাধ্যমে তিনি শিক্ষা দিতেন | ছাত্ররা নিজেরাই ঠিক করত বিষয়টির প্রকৃত রূপ কি | এই বইতে তেমনি একটি ক্লাসের বর্ণনা আছে | এই ক্লাসে ডুয়াল বা দ্বন্দযুদ্ধ ভালো না মন্দ : এই ছিল বিতর্কের বিষয় | দুটি ক্লাস নিয়ে এই বিতর্কের সিদ্ধান্ত হয়েছিল |

দিরজীয়র বিতর্কের পদ্ধতিটি ছিল বড় চমত্কার | তিনি বিতর্কের শুরুতে বিতর্কের বিষয় সম্বন্ধে বিস্তারিত বলেন | ডুয়াল কি , তা কত রকম হয় , তার নিয়মাবলী কি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বিস্তারিত বললেন প্রথমে | তার পর ডুয়ালের যত রকম প্রকারভেদ হয় ( তিন রকম: ঘৃনা থেকে ডুয়াল , সামাজিক সম্মানের ডুয়াল, কোনো অন্যায় অভিযোগের প্রতিবাদে ডুয়াল ) তার প্রত্যেকটির কিছু কিছু করে বাস্তব উদাহরণ দিলেন | বর্তমানের কেস স্টাডির সঙ্গে এর মিল আছে | ডিরোজিও সর্বমোট ৫২ টি ডুয়ালের বিবরণ দিয়েছিলেন গল্পের মত | বিষয়ের বিস্তারিত বিবরনদানে ডিরোজিওর মাহাত্ম্য বোঝাই যায় |

বিতর্কের বিষয়বস্তু বলার পর বিতর্ক শুরু হয় | বিষয়টির বাস্তব উদাহরণ দেবার ফলে (কেস স্টাডি ) বিষয়টির ভালো ও মন্দ দুটো দিক ছাত্রদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায় | তারপর তারা তাদের মতামত জানাতে থাকে | ডিরোজিও ছাত্রদের পরস্পরের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমন বন্ধ করেছিলেন | বিতর্কের শেষে আমার মত পাঠকদের কাছে ডুয়ালের ভালো মন্দ জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায় আর এক নতুন দৃষ্টিকোণের জন্ম হয় | থাক সেসব |

অনুমান করতে পারি হিন্দু ধর্মের ব্যাপারেও ডিরোজিও একই পদ্ধতিতে এগিয়েছিলেন | সেই জন্যই তার শিষ্যদের জ্ঞান ও স্বাধীন চেতনার এতটা স্ফুরণ সম্ভব হয়েছিল | সমসাময়িক শিক্ষাদান পদ্ধতি যেখানে গুরুর আর সমাজের দাদাগিরি আর ছাত্রদের মুরগিগিরী , সেখানে ডিরোজিও এক ঝলক স্বাধীনতার মুক্ত বাতাস এনেছিলেন | এই জন্যই তিনি ছাত্রদের এত প্রিয় হয়েছিলেন | এইবার তা অনুমান করা গেল |

এই ধরনের বিতর্কের মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রাচীন গ্রিসে দেখা যায় | প্লেটোর একাডেমিতে এইধরনের শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু ছিল | ভারতেও যে এটা একেবারে নতুন তা নয় | নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল | এই ধরনের শিক্ষাদান শুধু চালু ছিলনা একটা জায়গায় | তা হলো মাদ্রাসায় |সেখানে সবই কুরানে আছে | মাঝখানে মুসলিম শাসন আমাদের অনেক কিছু নষ্ট করেছে | তার মধ্যে একটা হলো শিক্ষা তথা স্বাধীন চিন্তার বিকাশ | ডিরোজিও সেটার কিছু ঘাটতি পূরণ করেছিলেন | বর্তমানেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই পুরনো মাদ্রাসাপন্থী পদ্ধতি চলে আসছে |

আজকের বিতর্কসভা ডিরোজিওর ক্লাস থেকে একটা জিনিস শিখতে পারে | তা হলো বিতর্কের বিষয় সম্বন্ধে কিছু বলা | এটা প্রায় সব বিতর্কসভা থেকেই অদৃশ্য | বিতর্কের বিষয়ের বাস্তব পরিস্থিতি কি তা যদি বাস্তব উদাহরণ বা কেস স্টাডি দিয়ে না বুঝানো যায় তাহলে কিভাবে সেই বিতর্কের কোনো ভালো ফলপ্রসু সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে ? এটা আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে | বিতর্কের বিষয় সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার পরামর্শ আরো একজন দিয়েছেন | তিনি হলেন এরিস্টটল | তার রেটরিক গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে বিতর্কের বিষয়বস্তুর সাধারণ আর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি বক্তাকে জানতে হবে নাহলে তিনি কিভাবে বক্তৃতা দেবেন ? কিভাবে ভালো ও মন্দ জানবেন ? ডিরোজিও হয়ত এটা থেকে শিক্ষালাভ করেছেন |

শেষে বলতে চাই যে বাংলার নবজাগরণের যথার্থ কারিগর ছিলেন ডিরোজিও | ব্যক্তিত্ব , শিক্ষাদান পদ্ধতি সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন বাংলার সেরা ব্যক্তিত্ব | হিন্দু ধর্ম ও তত্কালীন সমাজ তার যতই বিরোধিতা করুক না কেন কিছুতেই তার শিক্ষাকে আর চিন্তার স্বাধীনতাকে দমাতে পরেনি আর পারবে না | তিনি আমাদের মনের মনিকোঠায় অমর হয়ে থাকবেন |