আজ সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ, অভিজিৎ রায়ের জন্মদিন। আজকের দিনটি আমাদের মুক্তমনা পরিবারের সদস্যদের জন্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন কারণ ধর্মান্ধ, মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হবার পর এটাই অভিজিতের প্রথম জন্মদিন। আজকের এই বিশেষ দিনে আমরা অভিজিতের জীবন এবং তাঁর লেখক সত্বাকে স্মরণ করবার জন্য কলম তুলে নিয়েছি। অনুধাবন করার চেষ্টা করছি আমাদের মননে এবং চিন্তা ভাবনায় অভিজিতের কোন প্রভাব আছে কিনা বা থাকলে কিভাবে আছে?
খুব ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আমার আগ্রহ ছিল খুব বেশী। সব কিছুর পিছনেই যে বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাখ্যা আছে, থাকতেই হবে এটা ছিল আমার বদ্ধমূল ধারণা। কিভাবে আমার মনে এই ধারণা গেড়ে বসেছিল সে কথা আজ আর তেমন করে মনে করতে পারি না। তবে মনে আছে খুব ছোট থাকতেই প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল আমার, নাওয়া খাওয়া ভুলে সুযোগ পেলেই শুধু বই পড়তাম। আর ধর্মের কল্প কাহিনী গুলো কখনই আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতনা। পরিষ্কার বুঝতে পারতাম ধর্মীয় অনুশাসন, নিয়ম-কানুন গুলো সব মানুষেরই সৃষ্টি। তবে নিজের ধারনার প্রতি অতটা প্রত্যয় ছিল না।
২০০৫ সালের কথা, কিভাবে কিভাবে যেন সদালাপ নামক একটা অনলাইনে ফোরামে গিয়ে হাজির হই। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয় অভিজিতের লেখার সাথে। অভিজিতের কোন লেখাটা প্রথম পড়েছিলাম আজ আর সেটা মনে নেই। বিজ্ঞানের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ থাকায় অভিজিতের লেখার ভক্ত হতে সময় লাগেনি এক মূহুর্তও। সেখান থেকেই মুক্তমনার খোঁজ পাই এবং নিয়মিত মুক্তমনায় লেখা পরতে শুরু করি। মুক্তমনা সাইটটি তখন ফোরাম হিসাবেই চলত, ব্লগ হয়ে ওঠেনি। অভিজিৎ সহ অন্যান্য লেখকদের বিজ্ঞান এবং ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের এবং স্বাদের লেখা পড়তে পড়তে এতদিন আমি মনে মনে যা ভাবতাম সেগুলো সব প্রত্যয়ে পরিনত হয়। বুঝতে পারি আমার চিন্তা ভাবনা ঠিকই আছে। এতদিন আমার ভিতরে যে আস্হার অভাব চিল তা ঘুচে গেছে।আর আমার অত্যন্ত আগ্রহের বিষয় – বিবর্তন তত্ত্ব – নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি তত্দিনে পেয়ে গেছি। শুধু তাই না আমি আরও বেশী আগ্রহী হয়ে উঠি বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত জীব বিজ্ঞানীদের অনেকেরই বই পড়ার ব্যাপারে।
মুক্তমনায় লেখা পড়তে পড়তেই প্রথমে খোঁজ পাই সচলায়তন, এবং সামহয়্যার-ইন ব্লগের, এরপর আমারব্লগের। এই তিন ব্লগেই ছিল অভিজিতের পদচারনা। এতদিন সব দেখে শুনে আমার নিজেরও লেখার আগ্রহ একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। তবে মুক্তমনায় কখনো লিখব সেটা কখনো ভেবে উঠিনি, যা পরবর্তীতে অভিজিতের উৎসাহেই সম্ভব হয়ে ওঠে। প্রথমে আমার ব্লগ এবং পরে সামহয়্যার ইন ব্লগকে বেছে নিয়েছিলাম লেখালেখির জন্যে। আমারব্লগেই অভিজিতের সাথে কমেন্ট, পাল্টা কমেন্টে আস্তে আস্তে পরিচয়ের সূত্রপাত। এরপর একদিন অভিজিত আমাকে আমন্ত্রণ জানায় মুক্তমনায় লেখার জন্যে। তারপর থেকেই মুক্তমনার সাথে আমার পথ চলার শুরু।
অভিজিতকে যতটুকু চিনেছিলাম তাতে করে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় সে ছিল আপাদমস্তক একজন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ। এই জগৎ সংসারের সব কিছুকেই সে বিচার করত একজন খাঁটি বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভংগী থেকে। একজন প্রকৃত বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ এবং সত্যিকারের একজন প্রাকটিসিং বিজ্ঞানীর চিন্তা ভাবনায় কোন তফাৎ থাকার কথা না। স্পষ্টতই বিজ্ঞান মনস্কতার খুব জোড়ালো প্রভাব ছিল তার লেখালেখিতে, জীবন সম্পর্কিত ধ্যান ধারনায়। অভিজিত কখনই অযৌক্তিক ধর্মীয় রীতিনীতি, কিংবা সামাজিক নিয়মকানুনের সমালোচনায় পিছপা ছিলনা। আর এ কারনে আস্তিক, নাস্তিক, সুশীল সব তরফ থেকেই তাকে ট্যাগিং করা হয়েছিল উগ্র নাস্তিক হিসাবে।
ব্যক্তি, সমাজ, এবং রাস্ট্র প্রতিনিয়ত ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভর করে অন্যদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে। একবার যদি কোন অন্যায়কে ধর্মীয় বিশ্বাসের আবরনে মুড়ে দেয়া যায় তবে তা চলে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর এ কারনে প্রতিটি বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের উচিত সচেতন ভাবে এসব অপ্রমানিত, অপরিক্ষণীয় দাবীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস সম্প্রতি একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন “All Scientists Should Be Militant Atheists” নামে। তার আর্টিকেলের অধিকাংশ কথাই অভিজিতের বিরুদ্বে করা ট্যাগিং এর জবাব হতে পারে অনা্য়াসেই। লরেন্স ক্রাউসের মতে একজন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের কাছে সমালোচনার উর্ধ্বে কোন ধারনা নেই, থাকতে পারে না। কোন চিন্তা বা ধারনাকে যুক্তি দিয়ে আক্রমণ করা যাবে না এই ধারনাটাই বিজ্ঞানের মূল ভিত্তির সাথে সাংঘর্ষিক। বিজ্ঞান মূলত একটি নাস্তিকভাবাপন্ন প্রতিষ্ঠান। যে কোন কিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অঙ্গীকারের সাথে বিজ্ঞান নামক নাস্তিকভাবাপন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক খুবই গভীর । এ বিষয়ে জীব বিজ্ঞানী JBS Haldane এর একটি উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ “My practice as a scientist is atheistic, that is to say, when I set up an experiment I assume that no god, angel, or devil is going to interfere with its course and this assumption has been justified by such success as I have achieved in my professional career.”
ক্রাউস বলছেন, “I see a direct link, in short, between the ethics that guide science and those that guide civic life. …Whenever scientific claims are presented as unquestionable, they undermine science. Similarly, when religious actions or claims about sanctity can be made with impunity in our society, we undermine the very basis of modern secular democracy. We owe it to ourselves and to our children not to give a free pass to governments—totalitarian, theocratic, or democratic—that endorse, encourage, enforce, or otherwise legitimize the suppression of open questioning in order to protect ideas that are considered “sacred.” Five hundred years of science have liberated humanity from the shackles of enforced ignorance. We should celebrate this openly and enthusiastically, regardless of whom it may offend.
যেহেতু বিজ্ঞান কোন sacred ধারনায় বিশ্বাস করে না তাই বিজ্ঞান মনস্কতা একজন মানুষকে ধর্ম বিশ্বাস থেকে দূরে রাখতে বাধ্য। মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করছে এটা আমরা যত বেশী জানছি তত বেশী উদ্দেশ্যহীন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এছাড়া বিজ্ঞানমনস্ক যে কোন মানুষের দায়িত্ব হল কোন কিছু সম্পর্কে মিথ্যা না বলা, মিথ্যার প্রশ্রয় না দেয়া। আর সেটা করতে যেয়ে যদি কেউ উগ্র নাস্তিক ট্যাগিং পেয়েও যায় তবুও কোন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষেরই সেই ট্যাগিং নিয়ে লজ্জ্বিত হবার কোন কারন নেই। আর সেই অর্থে সব বিজ্ঞান মনস্ক মানুষেরই কিছুটা হলেও উগ্র হওয়া আবশ্যকীয়। আর স্বীকার করতে দ্বিধা নেই একজন প্রকৃত বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ হিসাবে অভিজিৎ ছিল কিছুটা উগ্র। আর অভিজিতের বন্ধু হিসাবে, সহব্লগার হিসাবে আমার নিজেকেও উগ্র হিসাবে পরিচয় দিতে কোন অসুবিধা নেই। মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই আমাদের সবার এরকম কিছুটা হলেও উগ্র হওয়া বাঞ্ছনীয়।
কেটে ফেলুক,
পিষে ফেলুক,
ফেলুক কুপিয়ে মেরে;
তবু মিথ্যাকে মিথ্যা বলে
হাসবো উচ্চ স্বরে।।