অভিজিৎ রায়ের জন্মদিন উপলক্ষে মুক্তমনায় আলোকিত হবার গল্প আহবান করা হয়েছে। আমি একজন আলোকিত মানুষ হয়ে গেছি এমন দাবি করা অসম্ভব ব্যাপার। আলোকিত হওয়া কোন এক স্থিতাবস্থাও নয়। আমার আজকের যে চিন্তা ক্রমাগত শান না দিলে আগামীকাল সে চিন্তায় মরচে ধরতে পারে। মরচে মানেই পিছিয়ে পড়া, পিছিয়ে পড়া মানেই অন্ধকার। কোন একটা মুহূর্তের জন্য আলোকিত হওয়া যায় হয়ত কিন্তু আলোকিত হয়ে থাকতে পারাটা সহজসাধ্য বিষয় নয়। অভিজিৎ রায় সত্যিকারের একজন আলোচিত মানুষ ছিলেন। প্রতিনিয়ত পুরানো চিন্তায় শান দিয়ে নতুন চিন্তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে দেখেছি তাকে। সেসব হিসাবে নিলে নিজেকে আলোকিত মানুষ ভাববার কোন কারণ পাইনা বড়জোর আলোকিত হবার চেষ্টারত এক মানবসন্তান মনে হয়। সেক্ষেত্রে এটি আমার আলোকিত হবার কোন কাহিনী নয়, জীবনের নানান পর্যায় এবং তাঁর থেকে উত্তরণের বর্ণনা বলা যেতে পারে।

আমার জন্ম সিলেট শহরে হলেও শৈশব ও কৈশোরের একটা বড় অংশ কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। মুসলিম পরিবারে জন্মের পর বদ্ধমূল সংস্কার, প্রথা দেখে দেখে শিখেই বড় হওয়ার প্রথম পর্যায় কাটে। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ওখানেই পড়াশোনা করি। সপ্তম শ্রেণী পাশ করার পর পরিবার সহ সিলেট শহরে চলে আসি। এরপর ঘটে জীবনের প্রথম ছন্দপতন। গ্রামের স্কুলে আমার খুব বেশি বন্ধু ছিল এমন না কিন্তু শহরে আমাকে যে স্কুলে ভর্তি করা হল সেটাই ছন্দপতনের মূল কারণ । ভালো মানের ২/৩ টি স্কুলে ভর্তির সময় পেরিয়ে যাওয়ায় আমাকে ভর্তি করা হয় জামায়াতে ইসলামী নিয়ন্ত্রিত একটি স্কুলে। গ্রামের স্কুলে পড়াকালীন একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা প্রভাত ফেরি করতাম, ছেলেমেয়েরা একসাথে বসে ক্লাস করতাম। কাজেই মোটামুটি উদার ও স্বাভাবিক একটি পরিবেশ থেকে হঠাৎ করে কঠোর রক্ষণশীল পরিবেশে এসে শুরুতেই প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা খাই। এখানে এসে দেখতে পাই ছেলেমেয়েদের ক্লাস কেবল আলাদাই নয়, সময়ও আলাদা। এমনকি মেয়েদের তলার বারান্দাগুলো পর্যন্ত নিশ্ছিদ্র ভাবে ঢেকে দেয়া। ছেলেদের ক্লাসগুলোতে পুরুষ শিক্ষক, মেয়েদের নারী শিক্ষিকা। কোন অমুসলিম শিক্ষার্থী নেই এমনকি কোন অমুসলিম শিক্ষকও নেই।

পরিবেশটাই কেমন জানি ভীতিকর। এই মারি, এই মরি অবস্থা। শুরুতেই কুঁকড়ে যাই, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পিছিয়ে পড়ি। কেউ আমার মত ভাবে না, কারো সাথে মিল হয়না । নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ হয়ে প্রতিটা দুঃসহ দিন কাটাতে থাকি। ওই স্কুলে নবম শ্রেণি থেকে বোর্ডের বইয়ের বাইরে অন্য কোন পাঠ্যবই না থাকলেও অষ্টম শ্রেণীতে আবশ্যিক থাকা আরবি শিক্ষা বইটি আমার যন্ত্রণার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুণ । আরবিতে কোরান শিক্ষার অভিজ্ঞতা থাকলেও পাঠ্যবই হিসেবে এমন একটি বই কোনভাবেই সহজবোধ্য হয়ে উঠছিল না। সহপাঠীরা যারা কিনা আগে থেকেই সে স্কুলে পড়ে আসছে তারা আরবি কবিতা দোলে দোলে সুরে সুরে পড়ত। আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকত সব। যেকোনো ভাষাতেই কবিতা নিঃসন্দেহে শিহরণ জাগানিয়া, কল্পনার চিত্রপটে দোলা দেয়া বিষয়। কিন্তু উপস্থাপনের কারণে কিংবা পরিবেশের কারণে দুর্বোধ্যতার ভীতি ছাড়া কিছুই প্রতিভাত করত না তা। আর আরবি লেখার করুন অভিজ্ঞতা তো অবর্ণনীয়! তার উপর শিক্ষকদের পিটুনির ভয় যোগ হয়ে স্নায়ু-চাপে ভোগা প্রচণ্ড কাহিল একটি পরিস্থিতি হত আমার। কোনমতে অষ্টম শ্রেণী পার হয়ে ‘আরবি যন্ত্রণা’ থেকে রক্ষা পাই।

ওই স্কুলের আরও কয়েকটি বিষয় আমার কিশোর মনে রেখাপাত করত বলে মনে হয়। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন কলেজ থেকে ছাত্র শিবিরের ‘বড় ভাই’রা আসত। তাদের হাতে থাকত কিশোর কণ্ঠ ম্যাগাজিন এবং সমর্থক ফরম। তারা সাংঘাতিক রকমের ভদ্র আচরণ করত, এমন একটা স্বরে কথা বলত যেন কোন কিছুর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ১০ টাকা দামের কিশোর কণ্ঠ ফ্রি দিচ্ছে এমনভাবে হাতে ধরিয়ে দিয়ে কৌশলে টাকা নিয়ে নিত তাতেও খুব বড় কোন সমস্যা না থাকলেও সমস্যা বাঁধত সমর্থক ফরম নিয়ে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পরই সমর্থক ফরম ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করত। কোন কিছু বোঝার আগে সমর্থক কেন হব এমন প্রশ্ন করার সাহস না থাকলেও নানান অজুহাতে ওই ফরম পূরণ না করার সংগ্রাম যোগ হওয়ায় যন্ত্রণার মাত্রা বেড় গিয়েছিল। এই একটা বিষয়ে দেখতাম আমার সাথে বেশিরভাগেরই মিল। হয়তবা এই ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে পড়ে যাওয়ার কারণে শিবিরের সমর্থক ফরম উপেক্ষা করা সহজ হয়েছিল।

জোহরের আযানের সময় দেয়া হত টিফিনের বিরতি। নামাজ পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। ওই বয়সে সাধারণ মধ্যবিত্ত ছেলে যতটুকু ধার্মিক হয় আমিও তখন ঠিক ততটুকুই ধার্মিক কিন্তু টানা ক্লাস করে হাঁপিয়ে উঠার পর টিফিন বিরতিতে তো স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলার দিকেই মন ছুটে যাওয়াটাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মাঝেমাঝে পালিয়ে ওইসময় বিভিন্ন ইনডোর খেলায় মগ্ন থাকতে পারলেও বেশিরভাগ সময় তা যেত না। শিক্ষকরা যেন ষাঁড়ের মত ছুটে এসে গুঁত দিত। তাদের গুঁতর ভয়ে আমরা স্কুলের মসজিদে জড়ো হতাম, নামাজ পড়ার ভান করে পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে নব আবিষ্কৃত খেলাতেই মত্ত থাকতাম অনেকে। এভাবেই চলছিল। মানুষ একসময় যেকোনো কিছু সয়ে যায়। আমিও বিরুদ্ধ পরিবেশের অস্বাভাবিকতা সয়ে যাচ্ছিলাম। উল্লেখ্য করতে চাই, ওই স্কুলে প্রাতঃ সমাবেশে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হত না। জাতীয় দিবসগুলোতে ছুটির নোটিস পড়ার সময় প্রায় সব শিক্ষকই তাচ্ছিল্যতার ভঙ্গি করতেন। এমনকি একবার কোন এক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের খেলার দিন স্কুল এক ঘণ্টা আগে ছুটি দেয়া হয়েছিল। এসবই খুব স্বাভাবিকভাবে দেখা হত তখন। আমার আগের স্কুলের সাথে অমিল টের পেলেও বড় কোন প্রশ্ন আমার মধ্যেও দেখা দিত না তখন।

আগের স্কুলে বিজয় দিবসে নাটক হত, গান হত আবার ঈদ-এ মিলাদুন্নবীও পালন হত। একবার তো আমি ঈদে মিলাদুন্নবীতে হযরত মোহাম্মদের উপর উপস্থিত বক্তব্য দিয়ে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিলাম, সেটি আমার জীবনের পাওয়া প্রথম কোন পুরষ্কার ছিল। কিন্তু এই স্কুলে কোন অনুষ্ঠান পালন হত না।

দশম শ্রেণীতে উঠার পর কয়েকজন সহপাঠী দেখলাম শিবিরের সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠেছে। এরমধ্যে একজন শিবিরের রীতিনীতি দারুণ দক্ষতার সাথে পালন করে ‘সাথি’ হয়ে গেল। কেন জানি তার সাথেই নানান কারণেই বিরোধ লেগে থাকত। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে তাদের ক’জনের হামলার শিকার হই আমি। লজ্জায়, অপমানে কাউকে তখন বলা হয় না এসব। বাসায় তো অবশ্যই না। আমার পক্ষে ওদের মত কোন গ্যাং তৈরি করা সম্ভব না হওয়ায় এড়িয়ে চলতে লাগলাম। এড়িয়ে যাবার সীমানা এসএসসি কোচিং পর্যন্ত গড়ালে পরীক্ষায় কিছুটা প্রভাব পড়েছিল বটে। কয়েক বছর পরে এই ছেলেকেই হিন্দু পৌরনিক কাহানির উপর একটি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে দেখে অবাক হয়েছিলাম। শুনেছিলাম শিবিরের সেই বেপোরয়া ‘সাথি’র চিন্তা ভাবনাও নাকি পাল্টেছে। খবর নেয়া হয়নি আর।

যাইহোক এভাবে নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমি এসএসসি পাশ করলাম। শিবিরের সমর্থক ফরম এড়িয়ে গেলেও নিয়মিত মসজিদের দিকে যাতায়াত বাড়তে লাগল। নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্বের কারণেও প্রার্থনা করা তখন খুব শান্তির বিষয় হয়ে উঠল।

কলেজে ভর্তি হয়েই ঘটে জীবনের দ্বিতীয় ছন্দপতন। পরবর্তীতে যা আমার কাছে উত্তরণ মনে হয়েছিল। গ্রামের বাড়ি গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাম পা ভেঙ্গে ফেললাম। একাধিক অস্ত্রোপচারের পর প্রায় আড়াই মাস একটানা বিছানায় এবং প্রায় চারমাস পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবার কারণে গৃহবন্দি হয়ে পড়লাম। (এই লেখাটি যখন লিখছি তখনও আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁহাতের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় আছি। )
শারীরিক ক্ষতি হলেও এই সময়টায় মানসিক উত্তরণের একটা পর্যায় পার করি। পাঠ্যবইয়ের বাইরে আমার তখনো পড়ার গণ্ডি বলতে ফেলুদা, তিন গোয়েন্দা ইত্যাদি পর্যন্ত। এই সময়েই গড়ে উঠে সিরিয়াস বই পড়ার অভ্যাস। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি, অপরাজিত, তারাশঙ্করের কবি, মৈত্রেয়ী দেবীর ন হন্যতে, মির্চা এলিয়াদের লা নুই বেঙ্গলি ইত্যাদি উপন্যাসে ডুবে থাকি। বইয়ের মধ্যে খুঁজে পাই নতুন বন্ধু, নতুন স্বজন। সচরাচর প্রাত্যহিক চিন্তার বাইরেও যে বিপুল পৃথিবীর বিচিত্র আবেগ, নিরাবেগ। ঘটনা, দুর্ঘটনা, নানা মুখী জীবনদর্শন আছে টের পেয়ে অভিভূত হতে থাকি। ছোট্ট গণ্ডিতে পড়ে থাকা আগের অনেক ভাবনাকে তুচ্ছ লাগে। বিশাল এক জগতের হাতছানি পাই। মনের মধ্যে তৈরি হয় অনেক প্রশ্ন, অনেক দ্বিধা, অনেক রকমের চিন্তা।

দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় বিভিন্ন বইয়ের নাম পেতাম। টাকা জমিয়ে কিনতাম। তখনো আমি ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ। একদম না মানতে পারা কুসংস্কারগুলো ধর্মের অংশ নয় এমন একটা মডারেট ভাবনা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। তবে নতুন কোন কিছু পড়ে জানবার সাহস ছিল। সেভাবেই প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ বইটির প্রথম খন্ড হাতে পেলাম। এক নাগাড়ে পড়ে বদ্ধমূল অনেক ধারনা পাল্টে গেল। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে বিভিন্ন কেস স্টাডি মিলিয়ে দেখতাম। নতুন কিছু চিন্তা, নতুন যুক্তি পেয়ে চমৎকৃত হতে লাগলাম। এতদিনের বয়ে বেড়ানো হাস্যকর অনেক ভাবনার সাথে ইতি টানার সিদ্ধান্ত নিলাম। ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদ যখন হামলার শিকার হন তখনো আমি মডারেট ধার্মিক মানুষ। তাঁর কোন বই তখনো আমার পড়া হয়নি। হুমায়ুন আজাদময় ইস্যুতে যখন দেশব্যাপী তোলপাড় হচ্ছে আমার এক প্রাইভেট শিক্ষক যিনি ছাত্র শিবিরের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি হুমায়ুন আজাদ নিয়ে তীব্র আক্রোশ দেখাতেন। তাঁর উপর হামলা কেন উচিত কাজ সেটা বোঝাতে চাইতেন। আমি তখন আগ্রহ নিয়ে হুমায়ুন আজাদের সব বই পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। লাইব্রেরীতে গিয়ে তখনকার সময়ে তুমুল আলোচিত ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বইটির খোঁজ করি। কিন্তু বইটি প্রতিদিন অসংখ্য কপি বিক্রি হওয়ায় বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল না , না পেয়ে কিনে আনলাম ‘লাল নীল দীপাবলি’ আর ‘কতো নদী সরোবর’ বই দুটি। এই দুটি বই আমি তিনবার করে পড়লাম। এত দারুণভাবে কেউ লিখতে পারে ভেবে বিস্মিত হয়ে যাচ্ছিলাম। বাংলা ভাষা আর বাংলা সাহিত্য নিয়ে ভীষণ ভালোবাসা তৈরি হল, সেই সাথে হুমায়ুন আজাদের প্রতিও অন্যরকম টান তৈরি হল। একে একে পড়া হয়ে যায় ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’, ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’, ‘শুভব্রত এবং তাঁর সম্পর্কিত সুসমাচার’। কিনে আনি হুমায়ুন আজাদের কবিতা সমগ্র। হুমায়ুন আজাদে ডুবে থেকে কেটে যায় বেশ কিছুদিন। তাঁর ‘নারী’ বইটি পড়া হয়েছে আরও অনেক পরে। ২০০৪ সালের আগস্ট যখন জার্মানিতে গিয়ে মৃত্যুও হয় হুমায়ুন আজাদের ভীষণ খারাপ লেগেছিল এই ভেবে যে আর কোন নতুন বই বের হবে না তাঁর!

ততদিনে আমি ধর্মচর্চার অনেক বাইরে চলে এসেছি। আগের অনেক ধ্যান ধারনা পাল্টে যেতে শুরু করেছে। আগে ধর্মসংক্রান্ত যেসব বিষয়ে মনে প্রশ্ন আসলে নিজের মনে গিলে ফেলতাম সাহসের অভাবে এখন সাহস নিয়ে তা ঘাঁটাতে শিখে যাই। এমনি করতে করতে কোরান শরিফের বাংলা অনুবাদ পড়ে ফেলি। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আরও উঠে যায়। কোরান পড়ে মনে হয় কেবল মুসলিম পুরুষ মানুষদের প্রয়োজনেই গোটা পৃথিবী তৈরি হয়েছে বাদ বাকি সবকিছু তাদের ব্যবহার্য। এমন সংকীর্ণ, অস্বাভাবিক চিন্তা কীভাবে মানুষ গ্রহণ করতে পারে আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা উঠে গেলেও শুক্রবারের জুম্মা ও বছরে দুইবার ঈদের নামাজে আমাকে যেতে হত, পরবর্তী সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে মা কে ম্যানেজ করতাম। অনেক পরে একটা পর্যায়ে এসে ধর্ম কর্ম না করার ব্যাপার বাসায় প্রতিষ্ঠা করতে পারি।

যেহেতু তখন আমার চিন্তাধারা বুঝবে এমন কোন বন্ধু ছিল না তাই সেরকম বন্ধু-সঙ্গ, আড্ডা কোথায় পাওয়া যায় খুঁজছিলাম। এইচএসসি পাশ করার পর সিলেট প্রথমআলো বন্ধুসভার আড্ডাই যাই। ওখানে পেয়ে যাই আমার মত অনেককে। একসাথে মিলে অনেক সাংস্কৃতিক, সামাজিক উদ্যোগে জড়িয়ে পড়ে দারুণ সময় কাটতে থাকে। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সাথে এখান থেকেই পরিচয়। সৃজিতা মিতুর সাথেও তখনি পরিচয় হয়। আমার ধারণা মিতুর চিন্তার জগতে অবিশ্বাসের কিছু রসদ ঢুকিয়ে দেয়ার পেছনে আমারও ভূমিকা ছিলো।

আমরা চলচ্চিত্র নিয়েও অনেক আয়োজন করতে থাকি। তারেক মাসুদের সাথে পরিচয় হয়, তাঁর সিনেমা নিয়ে বিশাল প্রদর্শনী আয়োজন করি। এক সময় প্রথমআলো আমাদের স্বাধীন কর্মকাণ্ড পছন্দ না করে তাদের লেজুড়বৃত্তি করার আহবান করলে সকলে মিলে ওই সংগঠন ছেড়ে দিয়ে প্রান্তিক পর্ষদ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলি। শহর সিলেটে এই প্রান্তিক পর্ষদই বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক আমলের বিরুদ্ধ সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে কর্মসূচি দেয়ার সাহস করেছিল। পরবর্তী সময়ে সিলেট গণজাগরণ আন্দোলনে এই সংগঠনের সংগঠকরাই মূল চালিকা শক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রান্তিক পর্ষদের সভাপতি দেবাশিষ দেবু সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র হন। রাজীব রাসেল, কবির য়াহমদসহ আমরা আরও বিভিন্ন সংগঠনের সমমনা বন্ধুদের জড়ো করে এক সার্কেলে নিয়ে আসতে পারি।

এসব সংগঠন করার ফলে বই পড়ার চর্চাটা বেড়ে যায় পাশাপাশি চিন্তাভাবনার আদান প্রদান জোরালো হতে থাকে। ওইসময়েই আরজ আলী মাতুব্বরের রচনা সমগ্র পড়া হয়ে যায়। চিন্তা ভাবনার জগতে খুলতে থাকে একটার পর একটা জট। ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বাংলা কমিউনিটি ব্লগের সাথে পরিচয় ঘটে। ২০০৮ সাল থেকে ব্লগিং শুরু করি। সত্যি কথা বলতে তক্ষুনি বিপ্লব করে ফেলব এমন একটা চিন্তা কাজ করতে থাকে মাথায়। হঠাৎ করে ধর্মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে ধার্মিকদের সাথে যুক্তি তর্ক আর প্রশ্নের সমুদ্র বইয়ে দেয়ার বাসনা পেয়ে বসে। এটাকে আমি একটা মনস্তাত্ত্বিক পর্যায় হিসেবে দেখি এখন। একটা খুব বদ্ধ পরিবেশে থাকার পর হঠাৎ মুক্ত হাওয়া পাওয়ার স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। আজকাল এটাকে ‘উগ্র নাস্তিকতার’ ট্যাগ দিয়ে ব্লগার খুনের কারণ হিসেবে দায়ী করতে চান অনেকে। মানুষের চিন্তা দিনে দিনে পরিশীলিত হয়। ধর্ম ও ঈশ্বরে অবিশ্বাস একই থাকলেও ৮ বছর আগের বহিঃপ্রকাশের ধরন আর এখন থেকে ৫ বছর পর বহিঃপ্রকাশের ধরন ভিন্নতর হবে। বলার ভঙ্গিতে আরও উন্নততর পন্থা আত্মস্থ করব এটাই স্বাভাবিকতা।

২০০৮ সালে অনন্ত বিজয় দাশ ও বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল, সিলেটের নাম শুনি। অনন্তদার সাথে প্রথম দেখা হয় সম্ভবত ২০০৯ সালের প্রথমদিকে। সিলেট জেলা স্টেডিয়াম এলাকায় একদিন তাঁর সাথে দুর্দান্ত কিছু সময় কাটাই। যুক্তিশীল চিন্তা ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাবার সাহস পাই। এরপর থেকে অনন্ত দার সাথে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠে। তবে ব্লগের বাইরে আমি খুব বেশি লেখালেখি করতাম না বরং ঝোঁক ছিল যেকোনো কিছু সংগঠিত করার প্রতি। দেশেও একটার পর একটা ইস্যু আসতে থাকে। কখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি কখনো বাউল ভাস্কর্য স্থাপনের দাবির আন্দোলন সংগঠিত করতে জড়িত থাকি আমরা। শহরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখা, যেকোনো ধরনের নৃশংসতা, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নানান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সমমনা একটা সার্কেল গড়ে উঠে। এই সার্কেল থেকে একটা বড় কোন স্যাকুলারিষ্ট মুভমেন্ট হয়ত ভবিষ্যৎ করতে পারব এমন বিশ্বাস জন্ম নেয় সবার মনে।

সিলেটে ২০১৩ সালের গণজাগরণ আমাদের এই সার্কেলকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে। একসময় মনে হয়েছিল এই আন্দোলনকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার আন্দোলনে রূপ দিতে পারব। দেশ থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্ম, ধর্ম বানী সরিয়ে প্রগতিশীল, সাম্য ও মানবিকতার ভিত্তিতে সংবিধান ও আইন প্রণয়নের দাবিও জোরালো করতে পারব। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারির পর সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। রাজীব হায়দারকে হত্যা করার পর আমাদের প্রতিপক্ষ যে চাল দেয় তাঁর জবাবে আমাদের পাল্টা চাল ছিল দুর্বলতার নিদারুণ বহিঃপ্রকাশ। নাস্তিক রাজীবকে আমরা অস্বীকার করি। আমরা পড়িমরি করে প্রতিষ্ঠা করতে থাকি সে নাস্তিক ছিল না। যেন আমরা মৌলবাদীদের কথা মেনেই নেই যে নাস্তিক হলে হত্যা করা যাবে। সিলেটে যদিও বা এসব বিষয়ে আপোষ করতে চাইনি কিন্তু ঢাকার প্রভাব এড়ানো যায়নি। ‘নাস্তিক রাজীব’ এর লাশ শাহবাগে আন্দোলন মঞ্চে নিয়ে জানাজা করা, ‘আমার দেশ’র প্রোপাগান্ডা হজম করে পরবর্তী বেশ কয়েকটি সমাবেশ ধর্মবানী পাঠ করে শুরু করা অর্থাৎ নিজেদের অযতা আস্তিক প্রমাণে ব্যস্ত রেখে আন্দোলনের মূল গতিপথ থেকে দূরে সরে যাই আমরা। উগ্রবাদী প্রতিপক্ষ বুঝে যায় আমাদের দুর্বলতা আর এই জায়গায় বারবার আঘাত করতে থাকে তারা। আমরা গলা ফাটিয়ে বলতে পারিনি – ‘আমি নাস্তিক কিন্তু আমাকে হত্যা করার অধিকার কে দিয়েছে?’ নাস্তিক কাউকে হত্যার পরই তাদের আস্তিক প্রমাণে চেষ্টা করে পরোক্ষভাবে নাস্তিক হত্যা জায়েজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। না হলে এই বাংলাদেশে অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশদেরকে হত্যা করার সাহস ওরা পেত না।

আমাদের জন্য বর্তমান সময়টা খুব বন্ধ্যা। সেই ফেব্রুয়ারি থেকে একের পর এক সহযোদ্ধার নৃশংসভাবে খুন হয়ে যাওয়া, নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার সংকট মিলিয়ে সৃজনশীল, মননশীল সবধরনের চিন্তা শক্তি স্থবির হয়ে আছে। এই সময়ে আমাদের নতুন অনেক বিষয় নিয়ে লেখার কথা ছিল, অনেক নতুন চিন্তা নিয়ে মগ্ন হবার কথা ছিল কিন্তু কিছুই করতে পারছিনা। নিজেদের স্বাভাবিক কর্মকান্ড থামিয়ে দিয়েছি।

আরও একদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারব? আর কোন বন্ধুর খুন হয়ে যাবার খবর পাব না তো? এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। আতঙ্কে আশঙ্কায় কাটছে জীবন। আমার মনে হয় আমাদের ফের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আগের মতই মুক্তবুদ্ধির চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। উগ্রবাদীরা আমাদের চিন্তা, যুক্তির কাছে নিদারুনভাবে হেরে গিয়ে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। তাদের এই উন্মত্ততা পরাজয়ের বহিঃপ্রকাশ। তাদের দর্শনে খুন করা ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই।

অভিজিৎ রায়ের এবারের জন্মদিনের দিনই অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার চারমাস পূর্ণ হচ্ছে। আমার এই এলোমেলো লেখা অনন্তদার স্মৃতির প্রতি, তাঁর চমৎকার সব বিশ্লেষণের প্রতি, তাঁর শরীর দুলিয়ে হাসির প্রতি। যে হাসিতে বাংলাদেশকে একটি মানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সত্যিকারের প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে দেখার প্রত্যাশা ছিল।