hotta

এই লিখাটা যখন লিখছি এই ক্ষুদ্র সময়কালের মাঝেই দেশের কোন নগর কিংবা অঞ্চলে আরও কোন শিশু হত্যা সংঘটিত হচ্ছে কি না তা আগামীকালের পত্রিকাগুলিই জানান দিবে। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশ সামষ্টিক সহিংসতা নামক যে ভয়াবহ এক ব্যাধিতে আক্রান্ত তার নয়া শিকার হচ্ছে এই শিশুরা। নিউজ চ্যানেলের পিক আওয়ার-পত্রিকার কলাম সব ছেয়ে থাকে আজ এইসব রোমহর্ষক সংবাদে। মানুষের বিবেককে কাঁপিয়ে দেয়া একেকটি হত্যাকান্ডের পর জনসাধারণ সজাগ হয়ে ওঠলেও ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাচ্ছে না। এতো প্রতিবাদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সত্বেও পৈশাচিক হত্যাকান্ড ঘটেই চলছে।

সামষ্টিক সহিংসতার বিস্তার আমাদের দেশে কিন্তু এই প্রথম নয়। সামষ্টিক সহিংসপ্রবণ মানসিকতার উদ্ভব অনেক আদিমকালে, যখন থেকে মানুষ সমাজবন্ধ/জাতিবন্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে তখন থেকেই। মানষ যখন সামষ্টিক সিদ্ধান্ত নেবার মতো সংগঠিত হয়ে ওঠলো তখন সেই সিদ্ধান্তগুলো আদিম প্রবৃত্তির(ইড) দ্বারা ব্যাপকহারে প্রভাবিত হতো। জাতিগত সহিংসতা, যুদ্ধ, ধর্মীয় সহিংসতা, দাঙ্গা এ সবেই মানুষের আদিম বাসনা চরিতার্থকরণের একেকটি রূপ। সভ্যতার যত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে মানুষের আদিম প্রবৃত্তির উপর বিবেক নামক এক চেতনার প্রলেপ পড়েছে। মানুষ শারীরিক চাহিদা-লালসা-ধ্বংসবৃত্তি দ্ধারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে বিবেক দ্বারা ভাবতে শিখলো। এভাবেই আদিম পশুবৃত্তি থেকে আধুনিক মানুষ হয়ে ওঠা। কিন্তু প্রবৃত্তি নিঃশেষ হয়ে যায়নি, মানুষের মনের সবচাইতে অচেতন স্তরে সে আজও বসবাস করে চলেছে এবং বিবেক নামক চেতনাকে উপেক্ষা করে প্রবৃত্তির অস্তিত্ব প্রকট হয়ে ওঠে। যে ব্যক্তির বিবেক যতো ঠুকনো তার আচরণে প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ততো বেশী।

এইবার সামষ্টিক সহিংতার প্রশ্নে আসি। মানুষ কি শুধু ব্যক্তি বিশেষেই সহিংস আচরণ করে? নাকি সামষ্টিক ভাবে কিংবা জাতিগতভাবে সহিংস আচরণ করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের বেশীদূরে যেতে হবে না, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকেই উত্তর খোঁজে পাওয়া সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর সহযোগীতায় বিহারীরা বাঙালীরদের উপর যে পাশবিক গণহত্যা চালায় এটা তার বড় উদাহরণ। পাকবাহিনী বাঙালীর মাথা প্রতি যখন মূল্য নির্ধারণ করে দিলো, এমনও অনেক বিহারী-দালাল গোষ্ঠী ছিলো যারা স্রেফ কিছু টাকা কামানো লোভে অসংখ্য বাঙালীকে জবাই করে হত্যা করে তাদের মাথা বস্তা বোঝাই করে পাক ক্যাম্পে জমা দিয়ে অনেক টাকা পুরষ্কার নিয়ে গেছে। যে বিহারী যুবক কখনও মানুষ হত্যার কথা জীবনে কল্পনা করেনি সেও কসাই হয় ওঠেছিল, রক্তের এই হোলিখেলা তার একমাত্র চরম আনন্দের বিষয় ওঠেছিল। মানুষের এই জাতিগতভাবে পাশবিক হয়ে ওঠার ঘটনা সমগ্র মানব ইতিহাসের প্রতিটি পাতায়-প্রতিটি দশকে/যুগে পাওয়া যাবে।
এই প্রশ্নটা বরাবর থেকেই যায়, হঠাৎ করেই সমাজের একশ্রেণীর মানুষ নির্দিষ্ট কোন ব্যাক্তি-শ্রেণী-বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে সহিংস হয়ে ওঠে কেন? এটি অপরাধবিজ্ঞান/সমাজবিজ্ঞানের খুবই আলোচিত একটি দিক। এই ধরনের চেইন রিএকশানের মূল মানুষের মনের অনেক গভীরে প্রোথিত। এই ধরনের সামষ্টিক সহিংসতার শিকার হন মূলত একটি সমাজ বা জাতির দুর্বল/অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর/সংখ্যালঘু/প্রান্তিক মানুষজন। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া এই ধরনের সামষ্টিক সহিংসতার ভিকটিম মূলত,
• নারী ও শিশু
• বিভিন্ন ধর্মীয়-নৃতাত্বিক সংখালঘু গোষ্ঠী
• সংখালঘু মতামতাধারী(ধর্মসমালোচক ব্লগারগণ, সমাজসমালোচকগণ)
• গরীব জনগোষ্ঠী
পরিসংখ্যান ঘাটলেই খেয়াল করবেন কোন একধরনের সহিংস ঘটনা যদি ব্যাপক আলোচিত হয়ে ওঠে তখন একটা সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে ঠিক একই মোটিভের সহিসংতা ঘটতে থাকে। যদিও লক্ষ্য করবেন একটি ঘটনার অপরাধী সাথে ঘটে যাওয়া অপর একটি ঘটনার অপরাধীর কোন সম্পর্ক নেই কিন্তু সহিংসতার ধরন/ভিকটিম/মোটিভ একই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় দেশের ২০০৩-২০০৫সালের মধ্যবর্তী সময়কাল, যখন ভিকটিমকে হত্যার পর টুকরু টুকরু করে ফেলার এক নারকীয় উন্মতত্তায় মেতেছিল অপরাধীরা। এই সহিংসতার প্রথম শিকার ছিলো একটি শিশু, পরবতীতে অন্যান্য স্তরের মানুষও এর শিকার হতে থাকে। প্রতিদিনেই বস্তাবন্দী-ড্রামবন্দী খন্ডিত লাশ উদ্ধার হতে থাকে।

আমাদের দেশের সামষ্টিক সহিংসতার সবচাইতে বড় একটি নির্মমতার উদাহরণ এসিড সন্ত্রাস। সমাজে এই অপরাধের ব্যাপ্তী এতোটাই বেড়েছিল যে সারা বিশ্বে ধিক্কার পড়ে যায় নারীর উপর এমন বিভৎস্য সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায়। ইভটিজিং এবং পরবর্তীতে আত্মহত্যা ছিল নারীর উপর সামগ্রিক সহিংসতার আরেকটি ভয়বহ রূপ। যদিও ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়া সীমা, শোভা, অর্পিতাদের মতো নারীদের কথা আমরা খুব দ্রুতই ভুলে যাই।
কেন অপরাধীদের অপরাধ সংঘটনের পদ্ধতি/ভিকটিম/মোটিভ একটি নির্দিষ্ট সময়কালে একই থাকে এটা আজও রহ্স্যাবৃত প্রশ্ন। অপরাধীদের মানসিক গঠন চিন্তা করলে দেখতে পাবেন তারা প্রচন্ড মাত্রায় আদিম প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত। মানুষ মাত্রই সে প্রবৃত্তির তারিত, কিন্তু সামাজিক প্রাণী হিসেবে তার সহনশীলতা-বিবেক-মুক্তচিন্তার সুযোগ সহজাত আদিম প্রবৃত্তিকে সংকোচিত করে রাখে অথবা অন্য কোন সমাজ-গ্রহনযোগ্য উপায়ে পরিবর্তন করে দেয়। মানুষের এই বিবেক-চিন্তা-সহনশীলতার অভাবেই তার অপরাধী হয়ে ওঠার কারণ, এদের প্রবৃত্তিকে লাগাম দেয়ার মতো নিজস্ব মানসিক শক্তি থাকে না। খেয়াল করে দেখবেন যে মানুষ যতো বেশী বিবেক বর্জিত সে ততো বেশী হিংস্র্র।

সমাজ যখন কোন নতুন মাত্রার সহিংসতা সাথে পরিচিত হয় তখন বিবেকমান সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠলেও একজন অপরাধীর মনোজগৎতে ঘটে তার উল্টো। অপরাধের মাত্রা-তীব্রতা-ভিকটিম-প্রচার অপরাধীর মনে একধরনের সাবলিমিনাল মেসেজ প্রেরণ করে যা তাকে একই কায়দায় অপরাধ সংঘটনের জন্য কিংবা একই শ্রেণীর ভিকটিমের উপর সহিংস আচরণের জন্য তারিত করে। প্রবৃত্তি প্রকাশের এই বিকৃত পথ অপরাধীকে অপরাধ করতে উৎসাহ দেয়। এই ব্যাপারটা ঘটে অবচেতন মনে যার কোন ক্লু সচেতন মনে থাকেনা। এভাবেই সহিসংসতা সামষ্টিক আকার ধারণ করে সমাজে ছড়িয়ে যায়। মানুষের মনে এইরনের সাবলিমিনাল ম্যাসেজের আদান-প্রদাম হরহামেশাই ঘটছে। সমাজব্যাপী সেলফিআসক্তি এর একটি উদাহরণ, ঠিক একই কারণে প্রকাশ্যে খুন হতে থাকা একটি মানুষের সাহায্যে মানুষ এগিয়ে আসেনা। জনাকীর্ণ সেই রাস্তায় মানুষগুলি এক অদৃশ্য প্রভাব বলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা থেকে বিরত থাকে, সেটা আরকিছুই না, তার বেঁচে থাকার তাড়না। নিজেকে বিপদমুক্ত রাখার যে তাড়না তাই অদৃশ্যভাবে মানুষগুলোকে ঘটনাকে এড়িয়ে যেতে বলে, সামষ্টিকভাবে তারা তাই পালন করে।
সাম্প্রতিক শিশু রাজন হত্যা, রাকিব হত্যাকান্ড, রাহাত হত্যাকান্ড সামষ্টিক সহিংসতার অংশ। প্রতিটি হত্যাকান্ড ঘটেছে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের ভেতর এবং এখনও এই সহিংসতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। অপরাধীদের মধ্যে শিশুহত্যার যে পৈশাচিক আনন্দের লিপ্সা তাই বরংবার একই ধরনের অপরাধ সংঘটনের মোটিভ হয়ে ওঠছে। সমাজে সামষ্টিকভাবে সহিংস ঘটনা ঘটানোর এক নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে দিল্লীতে বাসে গণধরণের ঘটনাটি। এরপর সারা ভারতবর্ষে আরও কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে এমনকি খোদ রাজধানী ঢাকাতেই ঘটে যায় একই ঘটনা কাছাকাছি সময়ের মধ্যে। কদিন আগে আমেরিকায় নির্বিচারে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার যে নিশংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল তা এখনও কারো ভুলে যাবার কথা নয়। ঘটনাগুলো স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিচ্ছিন্ন হলেও কাকতালীয় নয়। প্রত্যেকটি ঘটনাই পরবর্তী ঘটনাটিকে ঘটতে উৎসাহ যুগিয়েছে প্রত্যক্ষভাবে হোক অবচেতন মনেই হোক।

আমাদের দেশে শিশু হত্যার এই যে নয়া ট্রেন্ড এর শেষ কোথায় যেয়ে ঠেকে বলা কঠিন। আমাদের দূর্নীতিগ্রস্থ সমাজব্যবস্থা-বিচারকার্যের দীর্ঘসূত্রতা অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়। মানুষের বিবেকবান হয়ে ওঠাই কেবল এই ধরনের সহিংসতা কমাতে পারে। দরকার আইনের কঠোরতা, গত দুইদশকের তুলনায় এইদশকে এসিড সন্ত্রাস কমিয়ে সম্ভব হয়েছে আইনের কঠোরতা আরোপের মাধ্যমে। এসিড নিক্ষেপকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা এবং অনেক অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার কারণে অপরাধ দমন অনেকটা সম্ভব হয়েছে।

মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ অর্জন তার বিবেক, একজন বিবেকসম্পন্ন কখনই অপরাধী হয়ে ওঠতে পারেনা। প্রতিটি শিশুহত্যার ঘটনার সঠিক বিচার দাবী করছি।