রোগা পটকা মুস্তাফিজকে কনুই মারার অপরাধে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক এমএস ধোনির ম্যাচ ফির পচাত্তর ভাগ অংশ জরিমানা করা হয়েছে। সেই সাথে ধোনির যাত্রাপথের সামনে এসে কনুই এর গুঁতো খাবার অপরাধে বাংলাদেশের সদ্য অভিষিক্ত পেসার মুস্তাফিজেরও ম্যাচ ফির পঞ্চাশ শতাংশ কেটে নিয়েছে আইসিসি।

আইসিসির এই বিচার দেখে গ্রাম্য সালিশের কথা মনে হলো আমার। গ্রামে মাতব্বরের ছেলে কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করে হাতে নাতে ধরা পড়ে গেলে, তার বিচার না করে উপায় থাকে না। নইলে জনরোষের কবলে পড়তে হতে পারে। এই আশংকায় বিচার হয় বটে, তবে যতো দূর সম্ভব কম শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তাকে। শুধু যে কম শাস্তি দেওয়া হয় তা নয়, বরং তারপর তার অপরাধকে লঘু করার জন্য কাজের মেয়ের অপরাধেরও খতিয়ান নেওয়া হয়। মাতব্বরের ছেলে ঘরে একা আছে জেনেও সে কেনো ওই ঘর ঝাড়ু দিতে গেল? নিশ্চয় মনে তার নষ্টামি ছিলো ভরা। এই অপরাধে তাকেও শাস্তি দেওয়া হোক। চুল কেটে, গালে মুখে চুনকালি মেখে, পিঠে দুই ঘা লাগিয়ে দিয়ে ভাগিয়ে দেওয়া হোক এই নষ্টা মেয়েকে গ্রাম থেকে।

বাচ্চা একটা ছেলে সবে মাত্র তার প্রথম ম্যাচে নেমেছে। তাও যেই সেই ম্যাচ নয়। দুই দুইবারে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের বিপক্ষে। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অন্যায়ভাবে বাংলাদেশকে হারানোর কারণে এটি পরিণত হয়েছিলো এক হাই ভোল্টেজ ম্যাচে। এখানে তার মতো নবীন খেলোয়াড়ের এরকম উত্তেজনার ম্যাচে ভুলচুক করাটাই স্বাভাবিক। সেটাই করেছে সে। ভুলক্রমে ব্যাটসম্যানের লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভুল মুস্তাফিজ যে ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম করেছে, তা নয়। অনেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ও খেলার উত্তেজনায় এমন ভুল অতীতে বহুবার করেছে। কিন্তু, বহু খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্যাপ্টেন কুল যে কাজটি করেছেন, সেটি রীতিমতো গর্হিত একটা কাজ। তিনি খুব সযত্নে কাছে এসে অত্যন্ত সচেতনভাবে মুস্তাফিজকে কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে আহত করে মাঠছাড়া করেছেন। অনিচ্ছাকৃত ধাক্কায় মুস্তাফিজ মাঠে পড়ে গেলেও কোনো আপত্তি ছিলো না। কিন্ত, সেরকম কিছু এখানে ঘটে নি। মারটা ছিলো ইচ্ছাকৃত এবং পরিকল্পিত। খেলায় না পারার হতাশা থেকে উদ্ভূত গভীর রাগ, হিংসা এবং দ্বেষের ফসল এটি। তা না হলে মুস্তাফিজ যখন তাঁর পেশীবহুল পেটানো শরীরের মার খেয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে, উদ্বিগ্ন ধোনির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হতো ছুটে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়া, স্যরি বলা। ধোনি এর কোনোটাই করেন নি, বরং মুস্তাফিজের বিরুদ্ধে নালিশ করাতেই ব্যস্ত ছিলেন তখন তিনি। ভদ্রলোকের খেলা বলে পরিচিত ক্রিকেট যে আর ভদ্রলোকের খেলা নেই, এটা থেকেই তা বোঝা যায়।

মাঠের দুই আম্পায়ার এবং ম্যাচ রেফারি পুরো ঘটনার জন্য দায়ি করেছিলেন ধোনিকে। ক্রিকিনফোর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, শুরুতে শুধুমাত্র ধোনিকেই শাস্তি দিয়েছিলেন ম্যাচ রেফারি এন্ডি পাইক্রফট। তখনই ভারত তাদের শক্তি দেখানোর ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেয়। আইসিসিতে ভারত মোড়লিপনা করছে অনেক বছর ধরেই। তাদের ঘাটানোর সাহস কারোরই নেই। ফলে, ভারসাম্য বজায় রাখতে মার খাওয়া মুস্তাফিজকেও ধরে এনে শাস্তি দিয়ে ধোনির বর্বর আচরণকে হালকা করে দেওয়া হয়েছে।

ভারত- বাংলাদেশের প্রথম খেলার পর থেকে ক্রিকইনফো এবং ডন পত্রিকার কমেন্ট সেকশন ফলো করছি। বেশিরভাগ ভারতীয় দেখলাম এই ঘটনায় ধোনির কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছে না, তাদের কাছে সব দোষ মুস্তাফিজের। সেই পথ আগলেছে ধোনির। তার যাতে আঘাত না লাগে সেই জন্য ধোনি তাকে মোলায়েম করে, আদরের ছোঁয়া দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। মানুষ কতোখানি অন্ধ হতে পারে, সেটা এদের আচরণ দেখলে বোঝা যায়। আগে আমার ধারণা ছিলো যে, শুধুমাত্র পাকিস্তানি সমর্থকইরাই অন্ধ হয়। এবার টের পেলাম এ বিষয়ে ভারতীয়রাও কম যায় না। এই অন্ধত্ব থেকে তাঁদের উচ্চশিক্ষিত ধারাভাষ্যকারী কিংবা সেলিব্রিটি প্রাক্তন খেলোয়াড়রাও মুক্ত নয়। ধোনি যা করেছে, সেটি হচ্ছে শারীরিক আক্রমণ। মুস্তাফিজ যতো বড়ো অপরাধই করুক না কেনো, ধোনির কোনো অধিকার নেই মাঠে তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করার। এটি যে কোনো পরিস্থিতিতেই মারাত্মক অপরাধ বলে গণ্য। তিনি মাঠেই মুস্তাফিজের বিরুদ্ধে আম্পায়ারদের কাছে নালিশ করতে পারতেন, মাশরাফিকে ডেকে বিষয়টা জানাতে পারতেন, মুস্তাফিজকে ডেকে বুঝিয়ে দিতে পারতেন, কিংবা ম্যাচ শেষে অফিসিয়ালি নালিশ জানাতে পারতেন ম্যাচ রেফারির কাছে। কিন্তু, সেগুলো কিছু না করেই অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে বাচ্চা ছেলেটাকে আঘাত করেছেন তিনি। সেই আঘাত পেয়ে প্রায় এক ঘণ্টা মাঠের বাইরে শুশ্রুষা নিতে হয়েছে মুস্তাফিজকে।

পুরোনো একটা প্রবাদ আছে যে, তোমার খুব রাগ হলে বৃদ্ধ একজন লোককে লাথি মারতে পারো। কারণ, তুমি জানো সে কী। কিন্তু, একজন বাচ্চাকে কখনো ভুলক্রমেও মেরো না, কারণ তুমি জানো না সে একদিন কী হবে। মুস্তাফিজের ওই রোগা পটকা শরীরে কী অমিত শক্তি, কী অসীম সম্ভাবনা, আর কী বিপুল পরিমাণ তেজ লুকিয়ে আছে, সেটা ধারণাই করতে পারেন নি ধোনি। বারো ওভার পরে মাঠে ফিরে এসে মুস্তাফিজ তার উপরে করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েছে বিপুল বিক্রমে। না, শারীরিকভাবে আক্রমণ করে নয়, কিংবা গালিগালাজ করেও নয়। বোলিংটাকে ধারালো ছুরি বানিয়ে বিশ্বের সেরা ব্যাটিং লাইন আপকে কুচি কুচি করে কেটেছে সে। আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, “যে মুস্তাফিজকে ধোনি ধাক্কা দিয়ে মাঠের বাইরে যেতে বাধ্য করেছিলো, সেই মুস্তাফিজই ফিরে এসে ভারতকে ধাক্কা দিয়ে ম্যাচ থেকে বের করে দিয়েছে।”

আমাদের ছোট ভেবে দিনের পর দিন যারা অন্যায় করে যাচ্ছে, অবহেলা আর অপমান করে যাচ্ছে, তার সব মনে রাখছি আমরা। চিরদিন ছোট থাকবো না আমরা। একদিন না একদিন বড়ো হবোই। সেইদিন কড়ায় গণ্ডায় সব কিছুর হিসাব বুঝিয়ে দেবো আমরা। সেই বোঝাতে গিয়ে খেলায় জেতার জন্য তিন আম্পায়ারকে বশ করবো না আমরা, আইসিসিকে পকেটে পুরবো না, মাঠে পেশী ফুলিয়ে গুঁতোগুঁতি করবো না। তার বদলে যা করবো তা হচ্ছে সতেরো বছরের তেজী কিশোর তামিম ইকবালকে ছেড়ে দেবো। মুনাফ প্যাটেলের বুলিং এর বিরুদ্ধে যে আগুন চোখ নিয়ে ফিরে তাকাবে, তারপর ফার্স্ট বোলিং এর বিরুদ্ধে ড্যান্সিং ডাউন দ্যা উইকেট করে মাঝ পিচে এসে বলকে পিটিয়ে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেবে। সবুজ চোখের কমান্ডো সাব্বিরকে ছেড়ে দেবো। কব্জির মোচড়ে বলকে অনায়াসে মাঠের বাইরে ফেলে দেবে সে। অমিত সাহসের নাসিরকে ছেড়ে দেবো, বোলার বল করার আগেই স্টান্স বদলে ফেলবে যে নিমেষেই। ছেড়ে দেবো সৌম্যকান্তি সৌম্যকে। বাউন্সারের বিরুদ্ধে ব্যাট উঁচু করে যে দাঁড়িয়ে থাকবে অবিচল। যে মুহুর্তে বল মাথায় আঘাত আনবে বলে মনে হবে, ঠিক তখনি সোনালি সৌন্দর্য নিয়ে ব্যাটের আলতো ছোঁয়ায় বলকে পাঠিয়ে দেবে দড়ির ওপাশে। ছেড়ে দেবো রোগা পাতলা মুস্তাফিজকে, যার সুইং সাপের মতো ছোবল দেবে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটের কানায়। ছেড়ে দেবো হারকিউলিসের মতো শক্তিমান এবং হিরণ্ময় সৌন্দর্যের তাসকিনকে। যে প্রতিটা বিজয়ের পরে আকাশে উড়ে চেস্ট বাম্প করবে মাশরাফির সাথে। তার সাথে সাথে আকাশে উড়বে ষোল কোটি বাঙালিও।

বড়ো হবার শুরুটা সবে শুরু হয়েছে মাত্র। সামনে পড়ে আছে অনাগত সম্ভাবনার দিন, উজ্জ্বল সূর্যের সোনালি রোদের সময়। সব বর্বরের মাথাই একদিন ঘুরিয়ে দেবো আমরা।

এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে।