পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে বোমা হামলায় ২০০১ সালে ১০জনকে লোককে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১৪ সালে বিচারিক আদালত ৮ জঙ্গীকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয় জঙ্গীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ) ও আপীল দায়ের করা হলেও কবে এই মামলার শুনানি শুরু কবে সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।

সুপ্রীমকোর্টের মামলাজট বর্তমানে যে অবস্থায় সে ক্ষেত্রে এ মামলাকে বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনা না করলে সাধারণ নিয়মে এই ডেথরেফারেন্স ও আপীল শুনানি শুরু হতে হয়ত তিন থেকে চার বছর সময় লাগতে পারে। কারণ সিরিয়াল অনুযায়ি সুপ্রীমকোর্টে এখন ২০১০ সালে দায়ের করা ডেথ রেফারেন্সে মামলাগুলোর শুনানি হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে মামলার বছরওয়ারি হিসেবে এটা আছে এখনও কমপক্ষে তিন বছর পিছিয়ে।

পহেলা বৈশাখের ছায়ানটের সে অনুষ্ঠানে যারা বোমা হামলা করেছিল তারা আদতে বাঙালি সংস্কৃতি ও কৃষ্টি বিরোধি। তাদের চুলকানির জায়গা স্পষ্ট। আগে ওরা প্রকাশ্যে বোমা মেরে সে সব অনুষ্ঠানে আক্রোশের প্রতিফলন ঘটাত আর এখন নারীকে আক্রমণ করে। আগে ওরা ছিল প্রকাশ্য সংস্কৃতিবিরোধি চক্র আর এখন একইভাবে বিরোধিচক্র হলেও আলখেল্লার রূপবদলে কখনও বা প্রগতিশীলদের নাম নিয়ে।

শত্রু তারা আগেও ছিল এখনও আছে। পার্থক্য হলো আগে দেখলেই চেনা যেত কিন্তু এখন দেখে চেনার উপায় নাই। বেশভূষায় বেশ বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে মানুষের সমাজে মিশে যেতে। মানুষের সমাজে মিশেছে তারা কিন্তু চরিত্র বদল হয়নি এক ফোঁটাও!

খুন করেও তাদের আদর্শধারীদের বিচার হয়নি, এখনও কী হবে- আমি নিশ্চিত না। তবে আশাবাদের জায়গা হলো আগে মানুষজন প্রতিবাদ করতে গেলেও আগপিছ ভাবত নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। এখন এই মুহুর্তে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি কিন্তু মানুষজনের সাহসিকতা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এই প্রবণতা অবিশ্বাস্য রকমের উৎসাহব্যঞ্জক।

গত কয়েক বছরে জঙ্গিদের অপতৎপরতা প্রকাশ্যে কমেছে কিন্তু থেমে থাকেনি। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপারসেল সহ অগণন জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী তাদের উপস্থিতির প্রমাণ রেখেছে। অভিজিৎ হত্যা, ওয়াশিকুর বাবু হত্যা, রাজিব হত্যা, জগতজ্যোতি হত্যাসহ বিভিন্নভাবে তারা তৎপর। অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনির মধ্যে প্রথমে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্যণিয়। অথবা প্রথমে তৎপর হলেও পরে এক সময় তারা তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। এটা হতাশার সন্দেহ নেই।

এবারের পহেলা বৈশাখে টিএসসিসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে পুলিশ সে সময় নিষ্ক্রিয় ছিল। টিএসসিতে নারী নিপীড়নের যে ঘটনা ঘটেছে সেটা নিয়ে সারা দেশ উত্তাল অথচ অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ রকম কোন ঘটনা ঘটেনি বলে সাফাই গেয়ে অপরাধীদের অপরাধকে উৎসাহ দিয়ে বসলেন। কেন- এর জন্যে কিছু সময় নিলে কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপরই এই নারী নিপীড়নের অভিযোগ আসত? আসত না! তাহলে কেন তারা এমন অভিযোগ সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করলেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগের প্রথম প্রহরেই সেটা অস্বীকার কারণ হতে পারে, ঘটনার অব্যবহিত পর অভিযোগের তীর ওঠেছিল ছাত্রলীগের ওপর। ছাত্রলীগকে রক্ষা করতে গিয়ে তারা অস্বীকার করল। ছাত্রলীগের ওপর এই অভিযোগ ওঠার কারণ ছিল কিছু অনলাইন মিডিয়া কোন ধরণের সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই অভিযুক্ত করে বসে ছাত্রলীগকে কিন্তু ঘটনার প্রতিবাদকারি এবং প্রত্যক্ষ্যদর্শি হিসেবে যারা ছিল তারা তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে ছাত্রলীগকে সরাসরি অভিযুক্ত করেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যতটা না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধ তারচেয়ে বেশি দলীয় ভাবধারায় আচ্ছন্ন এটা প্রমাণ হয় তাদের তাৎক্ষণিক মিথ্যা বিবৃতিতে। এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্যে একদিকে যেমন অশনি সংকেত ঠিক একইভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পচে যাওয়া নৈতিকতার নির্দেশক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পহেলা বৈশাখের দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা অনাকাঙ্খিত, দুঃখজনক। এই ঘটনাগুলোর পর সামাজিক জীব হিসেবে পরিবার-সমাজের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। আমরা লজ্জ্বিত হই, আমরা অপমানিত হই, আমরা নিজেদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে উৎকণ্ঠিত হই।

যারা সে দিনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা সমাজের মুলধারার মানুষ বলে স্বীকার করিনা। এরা বিচ্ছিন্ন, এরা পারভার্ট, সমাজ এদের স্থান দেয়নি, দেয় না এবং দেবেও না। কিন্তু এসব আশাবাদের কথার বিপরিতে যখন উঁকি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নারী নিপীড়কদের পক্ষে দাঁড়ায় তখন আমাদের উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কার মাত্রা তীব্র হতে থাকে। এর সঙ্গে আছে বরাবরের মতো কুম্ভকর্ণের মতো থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কর্তাগণ যারা নিজেরা দায়িত্বে অবহেলা করেছে এই ভেবে প্রথমেই সব কিছু অস্বীকার করে বসে।

আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারি বাহিনীর দায়িত্বে যারা তারা অনেক সময় অনেক কিছুই এড়িয়ে যেতে পারে সেটা হয়ত স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ধরে নেওয়া যেত কিন্তু পুরো বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে বসে তারা বিভিন্ন মিথ্যা ছুতোয়। এরপর আগেকার মিথ্যাচারকে ধামাচাপা দিতে বারংবার মিথ্যার আশ্রয় নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক নারী নিপীড়নের ঘটনা এটা আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে না আসলে প্রকৃতপক্ষে সামাজিক পরিবর্তনের ধারণা রূপকল্প হিসেবেই পরিগণিত হবে।

আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারি বাহিনী প্রথমে অস্বীকার করলেও তারা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে, হয়ত এ তদন্তকাজ আরও এগুবে। কয়েকদিনের মধ্যে হয়ত দেখা যাবে অপরাধীদের কেউ গ্রেফতার হচ্ছে। এই অবস্থা হবে জনমতের চাপে পড়ে অস্বীকার তত্বের মিথ্যাচারভিত্তিক অস্বীকারের পরে বাস্তবতায় ফিরে আসা। অথচ তারা প্রথমেই অস্বীকার না করলে এটা তাদের অর্জন হিসেবেই গণ্য হতে পারত কিন্তু তা আর হবে না বলেই অনুমেয়।

একই অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রেও। এটা জানা কথা যে, ছাব্বিশ মার্চ, একুশ ফ্রেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ কিংবা অন্যান্য জাতীয় দিবসগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অগণন মানুষের উপস্থিতি থাকে। এসব ক্ষেত্রে ঢাবি কর্তৃপক্ষের কিছুই করার নেই। তারাও এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ নয় যে সর্বোত শৃঙ্ক্ষলা বজায় রাখার। এর জন্যে প্রশাসন কাজ করবে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে যেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণই থাকার কথা না সেখানে কেন তারা আগবাড়িয়ে সব কিছু অস্বীকার করতে গেলো সেটার একমাত্র কারণ প্রাথমিক অবস্থায় ছাত্রলীগের ওপরে ওঠা অভিযোগকে হালকা করা। কিন্তু এই বালখিল্য আচরণ করতে গিয়ে তারা যে ছেলেমানুষি অস্বীকার তত্ব কপচালো তার দায় গিয়ে পড়ে তাদের নিজেদের ওপরই। যে শিক্ষকগণ অস্বীকার তত্ত্ব কপচালেন তারা নারী নিপীড়কদের কেউ নন কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে নিলেন নিজেদের ওপরই, এটা দুঃখজনক নিঃসন্দেহে।

পুরো দেশ একাট্টা হয়েছে নারী নিপীড়কদের বিরুদ্ধে। নেতিবাচক এক ঘটনার বিপরিতে এটা ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। তবে এর বাইরেও আছে কিছু লোক যারা এই মুহুর্তে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারীর পোষাক-পরিচ্ছদ নিয়ে ইঙ্গিত করছে। অদ্ভুত এমন মানসিকতা যারা নারী নিপীড়কদের চরিত্র আর মানসিকতা নিয়ে না ভেবে ভাবে নারীর পোষাক নিয়ে। এ ধরণের মানুষদের হয়ত যৌনসন্ত্রাসী বলা যাবে না তবে তাদেরকে মৌনসন্ত্রাসী বললে কী অত্যুক্তি হবে? হয়ত না! সন্ত্রাস, যৌনসন্ত্রাস যারা করে তাদের সংখ্যা থাকে হাতেগোনা কিন্তু পেছনে যারা মৌনভাবে সমর্থন দিয়ে যায় তাদেরকেও গুনতির মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। এরা সে সব যৌনসন্ত্রাসীর চাইতে কম অপরাধি নয়!

টিএসসির ঘটনার পর পাল্টা আঘাত হানার কথা বলা হচ্ছে। নারীকে নারী হিসেবে নয় মানুষ হিসেবে দেখতে হবে- এটা সহজাত প্রতিবাদ। এ ধরণের প্রতিবাদ যত জোরালো হবে মানুষ হিসেবে আমাদের মানবিক বিষয়টি আরও উচ্চে তুলে ধরা হবে। মানবিক এ দ্রোহ যত শক্তিশালি হবে মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচয় আরও শক্ত হবে।

তারুণ্যের যে শ্রেণি অমানুষদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তাদেরকে ধন্যবাদ। তারাই আমাদের শক্তি, তারাই আমাদের ভবিষ্যত। তাদের প্রতিবাদি স্পৃহা আর সামাজিক দায়বদ্ধতা আমাদেরকে আশাবাদি করে। এই প্রতিবাদকারীদের অনেকেই আবার নারীর ব্যবহার্য চুড়ি-শাড়িকে প্রতিবাদের উপকরণ হিসেবে পুলিশকে পরিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি। এটাকে সমর্থন করা যায়না যৌক্তিকভাবেই।

আবহমান কাল থেকে চুড়ি-শাড়ি নারীদের ব্যবহার্য এবং এতে তারা সহজ হয়েছে সৌন্দর্য প্রকাশের উপকরণ হিসেবে, তাঁর ফ্যাশন-স্টাইল হিসেবে। একে আমরা দূর্বলতার প্রতীক কিংবা অপমানের বিষয় বলে মনে করতে পারি কী? পারি না!

হাতে চুড়ি পরা কী অবমাননার কিছু? এমনই এক ইঙ্গিত দেওয়া হয় সব জায়গা থেকে। হাতে চুড়ি মানে শৃঙ্খলিত কিছু কী? যদি হয়ে থাকে যুগ যুগ ধরে এ শৃঙ্খলকে সযতনে কেন ধরে রাখে নারী, আর যেহেতু একে ধরে রাখা হলো তাহলে নারী-পুরুষ কেন বলবে এটা শৃঙ্খলের প্রতীক?

চুড়ি শৃঙ্খলের প্রতীক নয়, চুড়ি হতে পারে স্টাইল-ফ্যাশন। তাই একে ঘিরে শৃঙ্খল মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। প্রতিবাদি কর্মসূচিতে থানায় এই চুড়ি প্রদান-প্রদর্শন আমাদের ভোগবাদি মানসিকতাকে নির্দেশ করে, যেমনটা পোষাক-পরিচ্ছদ নিয়ে যৌনসন্ত্রাসীরা ইঙ্গিত করে থাকে।

পোষাক-পরিচ্ছদ, চুড়ি নির্দেশ এসব নারীকে শৃঙ্খলিত করার ভোগবাদি মানসিকতার পরিচয় নির্দেশক। এ থেকে উত্তরণের জন্যে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। এই পরিবর্তন এমনি এমনি আসবে না, পাল্টা আঘাতের মাধ্যমেই আসতে পারে।

পাল্টা আঘাত কীভাবে দেওয়া যাবে? যৌনসন্ত্রাসী, মৌনসন্ত্রাসী যারা তাদের কাছে অসহনীয় যা তাই দিয়েই হবে আঘাত- এ আঘাতের মাধ্যমেই আসতে পারে কাঙ্খিত ফলাফল! নারী নিপীড়কদের বিরুদ্ধে মানবিক দ্রোহের যে ডাক এসেছে তাকেই ছড়িয়ে দিতে হবে, এখানে-ওখানে; সবখানে!