১৬১৬ সালে ভ্যাটিকান থেকে কোপার্নিকাসের বই সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকার ঘোষণা আসার পর সদা আশাবাদী গালিলেও একটুও হতোদ্যম হননি। কারণ প্রথমত, তার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা তখনও জারি হয়নি, এবং কোপার্নিকাসের বইয়ের তথাকথিত সংশোধনগুলোও আসলে অত গুরুতর ছিল না। ঘোষণাটির পরও গালিলেও তিন মাস রোমে ছিলেন এবং সেই সময়টাতে ঠিক আগের মতোই মুখে যা আসত তাই বলে গেছেন। এক পর্যায়ে তুস্কানি’র সরকার বিচলিত হয়ে গালিলেওকে “ঘুমন্ত কুকুরকে আর বিরক্ত না করতে” অনুরোধ জানায়। ততদিনে গালিলেওর কি হতে পারে না পারে সে নিয়ে কিছু গুজব রটে গিয়েছিল।
ধূমকেতু, ইশতেহার, সংলাপ
রোম থেকে এ যাত্রায় ফ্লোরেন্স ফেরার পর আবারো অসুস্থ হন গালিলেও। ১৬১৭ ও ১৬১৮ সালের অধিকাংশ সময়টাতেই অসুস্থ ছিলেন। এর মধ্যে ঘটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা ছিল ১৬১৮ সালের শেষ চার মাসে রাতের আকাশে তিন তিনটি ধূমকেতুর আবির্ভাব। গালিলেওর অবশ্য এ নিয়ে কিছু বলার মতো শরীরের অবস্থা ছিল না। কিন্তু কোলেজো রোমানো’র গণিতের অধ্যাপক পাদ্রি ওরাৎসিও গ্রাস্সি যখন এই ধূমকেতুগুলোকে কোপার্নিকান বিশ্বতত্ত্বের বিরুদ্ধে একটি শক্ত প্রমাণ হিসেবে উত্থাপন করে একটি বই লিখে বসেন তখন গালিলেও মুখ খুলতে বাধ্য হন। প্রথমে অবশ্য এতই অসুস্থ ছিলেন যে নিজে জবাবটি না দিয়ে দেয়ান তার ছাত্র, কোলেজো রোমানোর স্নাতক আইনজীবী মারিও গুইদুচ্চি কে দিয়ে। গুইদুচ্চির নামে ধূমকেতু বিষয়ক আলোচনা নামক পুস্তিকাটি বের হয় যার যুক্তিগুলো ছিল স্পষ্টতই গালিলেওর মস্তিষ্কপ্রসূত।
গ্রাস্সি এই পুস্তিকার একটি কড়া সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন। আর সহ্য করতে না পেরে ১৬২১ ও ১৬২২ সালে গালিলেও সাবলীল ভাষায় তার বিখ্যাত ইশতেহার ইল সাজ্জাতোরে ((ইতালীয় ভাষায় Il Saggiatore (১৬২৩), ইংরেজি ভাষায় The Assayer (Stillman Drake ও C. D. O’Malley এর অনুবাদ, ১৯৬০) )) (শুদ্ধতা নিরূপণকারী) লিখেন। এতে দৃপ্তভাবে বলেন,
আমাদের দৃষ্টি সম্মুখে সদা প্রকাশিত এই মহাবিশ্ব নামক মহাপুস্তকে লেখা রয়েছে দর্শন। কিন্তু সে বই যে ভাষায় লেখা হয়েছে তা শিখতে না পারলে, যে বর্ণমালায় তা গ্রন্থিত তা পড়তে না পারলে কোনোদিন বইটি বুঝে উঠা সম্ভব নয়। এটা লেখা হয়েছে গণিতের ভাষায়, আর তার বর্ণমালা হচ্ছে ত্রিভুজ, বৃত্ত এবং অন্যান্য জ্যামিতিক আকৃতি, যেগুলো ছাড়া বইটির একটি শব্দও কোনো মানুষের পক্ষে বুঝা অসম্ভব। এগুলো ছাড়া আমাদেরকে অন্ধকার গোলকধাঁধায় চক্করই খেতে থাকতে হবে।
সাজ্জাতোরে ভ্যাটিকানের স্বীকৃতি পেয়েছিল, এবং যে কার্ডিনাল বার্বেরিনি কোলোম্বে’র সাথে বিতর্কে গালিলেওকে সমর্থন করেছিলেন তিনি তাকে লিখেছিলেন, “আমরা আপনার সেবায় সদা প্রস্তুত।” বার্বেরিনির এমন সহৃদয়তা গালিলেওর জন্য খুব উপকারী হতে পারত, কারণ ইনিই আর কিছুদিন পর, ১৬২৩ সালে, পোপ হন এবং আরবান-৮ম নাম ধারণ করেন।
শীতের অসুস্থতা কাটিয়ে উঠে ১৬২৪ সালের বসন্তে গালিলেও আবার রোমে যান। এবার সাথে করে নতুন একটি যন্ত্র নিয়ে যান, নাম তার অণুবীক্ষণ যন্ত্র। দূরবীক্ষণের মতোই অণুবীক্ষণও প্রথম উদ্ভাবিত হয়েছিল হল্যান্ডে, কিন্তু এটার কর্মদক্ষতাও গালিলেও অনেকগুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন, বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক কাজের জন্য। রোমান পণ্ডিতেরা কীটপতঙ্গদের বড় করে দেখতে পেরে যারপরনাই প্রফুল্ল হয়েছিল।
রোমে আসার পরপরই নবনির্বাচিত পোপ আরবান-৮ম গালিলেওকে দেখা দেন। গালিলেও ধরে নিয়েছিলেন আগের মতোই বার্বেরিনি তাকে সমর্থন করবেন, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বার্বেরিনি দেখার পর আর আশাবাদী থাকতে পারেননি। স্বজনপ্রীতিতে নিমজ্জিত নতুন স্বৈরাচার পোপের প্রিয় বিষয় ছিল সামরিক অভিযান। তারপরও রোম ছাড়ার সময় গালিলেওর মনে হয়নি যে ভবিষ্যতে তার কাজে কোনো ঝামেলা হতে পারে। চেসি কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “কোপার্নিকাস প্রসঙ্গে পোপ বলেছেন যে, তার কাজকে চার্চ শাস্তিযোগ্য বলে বাতিল করেনি বা করবেও না, বরং সেটাকে কেবল তাড়াহুড়া করে টানা সিদ্ধান্ত বলা হয়েছে। যতদিন না এই ধারণা সত্য হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে ততদিন তার মতে এ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।”
এবার তাই গালিলেও ভাবলেন তিনি সৌরকেন্দ্রিক ধারণাটি কেবল অনুকল্প (হাইপোথিসিস) হিসেবে পেশ করবেন, পরম সত্য হিসেবে নয়। আর এটা উপস্থাপনের জন্য বেছে নিলেন সংলাপভিত্তিক রচনাপদ্ধতি। এর জন্য তিনটি চরিত্র তৈরি করেন যারা কোপার্নিকাস ও এরিস্টটল এর বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক করবে, কিন্তু পরিশেষে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হবে না। একটি চরিত্রের নাম রাখেন তার ভেনিসের বন্ধু সাগ্রেদো’র নামে, এবং আরেকটির নাম রাখেন ফ্লোরেন্সের বন্ধু সালভিয়াতি’র নামে যারা দুজনই ততদিনে মারা গিয়েছিলেন। সংলাপে সালভিয়াতির মুখ দিয়েই গালিলেও নিজের কথাগুলো বলান, সাগ্রেদো কাজ করেন একজন বুদ্ধিমান অবিশেষজ্ঞ হিসেবে। তৃতীয় চরিত্রটি এরিস্টটলের ধারণায় বিশ্বাসী যার নাম রাখেন সিম্প্লিচো (Simplicio)। দিয়ালোগো সোপ্রা ই দুয়ে মাসিমি সিস্তেমি দেল মোন্দো ((ইতালীয় ভাষায় Dialogo sopra i due massimi sistemi del mondo (১৬৩২), ইংরেজি ভাষায় Dialogue Concerning the Two Chief World Systems (Stillman Drake এর অনুবাদ, ১৯৫৩) গালিলেওর সবচেয়ে বিখ্যাত বই যা ১৬৩৩ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ভ্যাটিকানের “নিষিদ্ধ বই” এর তালিকায় ছিল।)) (দুটি প্রধান বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে সংলাপ) লিখতে গালিলেওর পাঁচ বছর লেগেছে—১৬২৪ থেকে ১৬২৯। শেষ করার পর অনুমতি আদায়ের জন্য বইটি নিয়ে রোমে গিয়ে পোপ আরবানের সাথে দেখা করেন, এবং আরবান তাকে আশ্বস্ত করেন যে, বইটি প্রকাশের ব্যাপারে বড় কোনো বাধা নেই।
কিন্তু এরপরই গালিলেও কয়েকটি খারাপ খবর পান। রোমে তার প্রধান প্রতিনিধি চেসি মারা যান, যার আকাদেমিয়া দেই লিঞ্চেই থেকে তিনি সংলাপটি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। যখন কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না তখন কাস্তেল্লি একটি চিঠির মাধ্যমে তাকে সংলাপটি দ্রুত ফ্লোরেন্স থেকে প্রকাশ করতে অনুরোধ করেন। রোম থেকে প্রকাশের ইচ্ছা থাকলেও তখন যেহেতু প্লেগের কারণে রোম এবং ফ্লোরেন্সের মধ্যে যাতায়াত ও যোগাযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল, সেহেতু গালিলেও অবশেষে ফ্লোরেন্স থেকেই বইটি ছাপার কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু তা সর্বসাধারণ্যে প্রকাশ করার জন্য ভ্যাটিকানের অনুমতি দরকার ছিল। অনুমতি আসে আরো দুই বছর পর, এবং তখন রোমান ইনকুইজিটর দের লেখা মুখবন্ধ ও উপসংহার সহ বইটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বেশ ইতিবাচক ছিল। গালিলেওর সংলাপ সাজানোর দক্ষতা দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয় এবং এমনকি সিমপ্লিচো’র বিদ্রুপাত্মক চরিত্রটিও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে।
কিন্তু ১৬৩২ সালের অগাস্টে সব যায় পাল্টে, বইটি ছাপানো ও বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আসে ভ্যাটিকান থেকে। আর নিষেধাজ্ঞাটি জারি করেন স্বয়ং পোপ আরবান, কারণ সালভিয়াতি ও সাগ্রেদো’র চতুর যুক্তি আর সিমপ্লিচো’র দুর্বল জবাব তিনি একেবারেই পছন্দ করতে পারেননি। এমনকি যে সিমপ্লিচোকে নিয়ে গালিলেও ব্যঙ্গ করেছেন তারই কিছু কথার মধ্যে পোপ নিজের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন। আরবান তার ভাইপো কার্ডিনাল ফ্রাঞ্চেস্কো বার্বেরিনি কে প্রধান করে বইটি পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি করেন। সেপ্টেম্বরে কমিটির জবাব আসার পর ব্যাপারটি ইনকুইজিশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বিচার
অসুস্থতা ও প্লেগের কারণে গালিলেওর এবারও রোম যেতে দেরি হয়। ১৬৩৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইনকুইজিশনের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে রোমে পৌঁছান। এপ্রিল মাসের ১২ তারিখ বিচার শুরু হয়। ইনকুইজিটর রা প্রথমেই ১৬১৬ সালে বেলারমিনোর পক্ষ থেকে গালিলেওর প্রতি যে স্থগিতাদেশ জারি করা হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। রোমে তুস্কানির রাজদূত ফ্রাঞ্চেস্কো নিক্কোলিনি ব্যাপারটি ফ্লোরেন্সের দপ্তরে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে,
প্রধান সমস্যা হচ্ছে: এই ভদ্রলোকেরা [ইনকুইজিটর] মনে করছেন, ১৬১৬ সালে তাকে [গালিলেও] পৃথিবীর ঘূর্ণন বিষয়ক প্রশ্ন নিয়ে অনুসন্ধান বা আলোচনা করতে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বলছেন, স্থগিতাদেশটির শর্ত মোটেই এমন ছিল না, বরং তার মূলকথা ছিল সেই মতবাদটি ধারণ করা বা সমর্থন করা যাবে না। আর এক্ষেত্রে তিনি নিজের কাজকে ন্যায্য দাবী করতে পারেন, কারণ তার বইয়ে এমন কোনো কথা নেই যা থেকে মনে হয় তিনি মতবাদটি ধারণ বা সমর্থন করছেন… বা এ বিষয়ক বিতর্কে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছেন।
সাথে প্রমাণ হিসেবে গালিলেও বেলারমিনোর কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠি দেখান যা তার ব্যাখ্যাকেই সমর্থন করে। অনেক আইনজ্ঞ এই মামলার যথার্থতা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং অধিকাংশের মতে, কেবল বিশুদ্ধ আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে গালিলেওর প্রমাণই বেশি জোরালো ছিল। হাজার হোক ১৬১৬ সালের স্থগিতাদেশের কোনো স্বাক্ষরিত দলিলও ছিল না, বা কোনো সাক্ষীও ছিল না। কিন্তু বেকসুর খালাসের কথা কোনো ইনকুইজিটর ভাবতে পারতেন না। তাদের শেষ সিদ্ধান্ত ছিল: গালিলেওকে অপরাধ স্বীকার করতে হবে, নিজের কথা সংশোধন করতে হবে, এবং একটা লঘু শাস্তিও পেতে হবে। তিনি রাজি হয়ে যান। কিন্তু জুনের ২২ তারিখ যখন আনুষ্ঠানিক দণ্ডাদেশ আসে তখন দেখা যায় সেটা মোটেই লঘু নয়, গালিলেও তা একেবারেই আশা করেননি। তার বইটিকে ভ্যাটিকানের “নিষিদ্ধ বই” এর তালিকায় যুক্ত করা হয়েছিল এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
শেষ অঙ্ক
গালিলেওর শত্রুর চেয়ে বন্ধুর সংখ্যা সবসময়ই অনেক বেশি ছিল। শত্রুদের কাছে হেরে যাওয়ার পর এবার তার বন্ধুরা ক্ষতিপূরণে এগিয়ে আসতে শুরু করেন। রাজদূত নিক্কোলিনি যাবজ্জীবন কারাবাসের বদলে তার জন্য সিয়েনা’র আর্চবিশপ আস্কানিও পিক্কোলোমিনি’র তত্ত্বাবধানে গৃহবন্দিত্ব আদায় করে নেন। তাই গালিলেওর কারাগার হয় পিক্কোলোমিনি’র প্রাসাদ যেখানে নিয়মিত অনেক কবি, বিজ্ঞানী ও সঙ্গীতজ্ঞ আসত তাকে সম্মান জানাতে, তার সাথে আলাপ করতে। এক পর্যায়ে বন্দিত্ব ভুলে তিনি আবার গবেষণায় মেতে উঠেন এবং এবার ধর্মীয় দিক দিয়ে কম বিতর্কিত বিষয়ে হাত দেন। “দুইটি নতুন বিজ্ঞান” নিয়ে একটি সংলাপ লেখার পরিকল্পনা করেন; একটি বিজ্ঞান হলো প্রাকৃতিক গতি নিয়ে তার নতুন গবেষণা এবং অন্যটির বিষয় বিভিন্ন বস্তুর শক্তি। সংলাপের চরিত্র একই রেখে দেন, কিন্তু এবার সালভিয়াতি, সাগ্রেদো ও সিমপ্লিচো গালিলেওর তিন বয়সের প্রতিনিধিত্ব করে। বৃদ্ধ ও বিজ্ঞ গালিলেও হয় সালভিয়াতি, পাদোভা’র মধ্যবয়স্ক গালিলেও হয় সাগ্রেদো, আর তরুণ, উচ্ছল গালিলেওর প্রতিনিধত্ব করে সিমপ্লিচো।
কিন্তু সিয়েনাতে বেশিদিন থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অচিরেই তার মেয়ে ভার্জিনিয়া’র—বর্তমানে আর্চেত্রি শহরের মঠের ধর্মযাজিকা সিস্টার মারিয়া চেলেস্তে—চিঠি পেয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তার আরেক মেয়ে লিভিয়াও একই মঠের সিস্টার ছিল, এবং তিনি আরচেত্রি’র কাছেই একটা বাড়ি নিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে যেতে পারেননি। এইবার পোপের কাছে আরচেত্রি যাওয়ার অনুমতি চান। পোপ প্রথমে রাজি না হলেও যখন ভার্জিনিয়ার অসুস্থতার খবর আসে এবং যখন তিনি শুনতে পান যে ধর্মদ্রোহীটা সিয়েনাতে খুব আয়েশের জীবন যাপন করছে তখন অনুমতি দেন। কিন্তু শর্ত হলো, তার বাড়ির সামনে প্রহরী থাকবে এবং তিনি ঘরের বাইরে বেরোতে পারবেন না।
১৬৩৩ সালের শেষদিকে গালিলেও আরচেত্রি যান এবং কয়েক মাস মেয়ের সেবা করেন। কিন্তু মেয়েটিকে বাঁচাতে পারেননি; ১৬৩৪ সালের বসন্তে সে মারা যায়। এতে একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন, কিন্তু আবারও কর্মস্পৃহা তাকে জাগিয়ে তুলে। দুই বছর দুয়ে নুওভে শেন্ৎসে ((ইতালীয় ভাষায় Discorsi e dimostrazioni matematiche, intorno à due nuove scienze (১৬৩৮), ইংরেজি ভাষায় Dialogue Concerning Two New Sciences (Henry Crew ও Alfonso de Salvio এর অনুবাদ, ২০০০) গালিলেওর শেষ মাস্টারপিস।)) (দুটি নতুন বিজ্ঞান) এর উপর কাজ করেন। ১৬৩৭ সালে বইটির কাজ শেষ হয় এবং তার ভক্তরা তা গোপনে ইতালি থেকে হল্যান্ডে পাচার করে। দূরবীক্ষণ আর অণুবীক্ষণের দেশ হল্যান্ড থেকেই ১৬৩৮ সালে গালিলেওর শেষ মাস্টারপিসটি প্রকাশিত হয়। ততদিনে তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, এবং তাকে চিকিৎসার জন্য আরচেত্রি থেকে সামান্য দূরে ফ্লোরেন্সে যেতে দিতেও পোপ দোনামনা করেছিলেন, যদিও শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেন।
কিন্তু গালিলেও নিজের বিশ্বাস থেকে কখনো সরে আসননি; তিনি নিজে ধার্মিক ক্যাথলিক ছিলেন। গালিলেওর বই ইংরেজিতে অনুবাদ এবং তার জীবন নিয়ে গবেষণা করার জন্য বিখ্যাত স্টিলম্যান ড্রেইক (১৯১০–৯৩) লিখেছেন,
ক্যাথলিক এবং বিজ্ঞানী দুই দিক দিয়েই গালিলেও নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার ছিলেন। প্রায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে একবার তিনি লিখেছিলেন যে, তার নিজের বিজ্ঞানের সব কাজ পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু কখনো নিজের ধর্মবিশ্বাস থেকে মুখ ফেরানোর কথা মাথায় আসেনি। চার্চ গালিলেও থেকে মুখ ফিরিয়েছিল এবং তার জন্য তাদেরকে কম খেসারত দিতে হয়নি; কিন্তু সেটার জন্য গালিলেও দোষ দিয়েছিলেন কেবল চার্চের কিছু বিপথগামী লোককে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
গালিলেওর হাতে আধুনিক গণিতের কোনো হাতিয়ারই ছিল না। আজকের স্কুলের একটি শিক্ষার্থীও এ বিষয়ে তার চেয়ে বেশি জানে। তিনি বীজগাণিতিক সংকেত দিয়ে কোনো সমীকরণ লিখেননি, এবং একমাত্র ট্যানজেন্ট ছাড়া ত্রিকোণমিতির আর কিছু ব্যবহার করেননি। তার সংখ্যা ছিল সবসময় ধনাত্মক এবং পূর্ণ, দশমিক কখনো ব্যবহার করেননি। নিউটন ও লাইবনিৎসের হাতে নির্মীত ক্যালকুলাসও তার ছিল না। ইউক্লিডের যুগান্তকারী গ্রন্থ “এলিমেন্টস” এ উল্লেখিত অনুপাত ও সমানুপাত দিয়ে তিনি হিসাব করতেন, এবং ইউক্লিডের জ্যামিতির ভাষাতেই চিন্তা করতেন।
সমসত্ত্ব এবং ত্বরিত গতি নিয়ে গালিলেও যে উপপাদ্যগুলো তৈরি করেছিলেন সেগুলো তার ভাষায় শুনলে এবং তারপর তাদের আধুনিক বীজগাণিতিক রূপ দেখলেও দুই যুগের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। তার একটা উপপাদ্য ছিল,
যদি সমবেগে, সমসত্ত্বভাবে গতিশীল কোনো কণা দুইটি দূরত্ব অতিক্রম করে, তাহলে সেগুলো অতিক্রম করার সময় দুটির অনুপাত সেই দূরত্ব দুটির অনুপাতের সমান হবে।
আমাদের কাছে এই উপপাদ্যের অর্থ হচ্ছে [latex]s=vt[/latex] যেখানে s অতিক্রান্ত দূরত্ব, v দ্রুতি (দিকহীন বেগ), এবং t সময়। যেমন, t=৩ ঘণ্টা ধরে v=৬০ মাইল/ঘণ্টা বেগে চললে অতিক্রান্ত দূরত্ব হবে, s = ৩ × ৬০ = ১৮০ মাইল। গালিলেও কিন্তু এভাবে চিন্তা করতেন না। তার চিন্তাটা উদ্ধার করার জন্য দুটি দূরত্ব [latex]s_1[/latex] এবং [latex]s_2[/latex] এর কথা ভাবা যাক, যে দূরত্ব দুটি v বেগে অতিক্রম করতে যথাক্রমে [latex]t_1[/latex] ও [latex]t_2[/latex] সময় লাগে। তাহলে উল্লেখিত সমীকরণটি অনুসারে দুটি সমীকরণ পাওয়া যাবে, [latex]s_1=vt_1[/latex] এবং [latex]s_2=vt_2[/latex]। একটি সমীকরণের উভয় পক্ষকে অপরটির উভয় পক্ষ দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায়,
[latex] displaystyle frac{t_1}{t_2} = frac{s_1}{s_2} .[/latex]
এটাই হচ্ছে গালিলেওর উপপাদ্যে উল্লেখিত সেই অনুপাত। এবার আরো জটিল একটি উপপাদ্যের কথা ভাবা যাক:
সমান হারে কিন্তু অসমান দ্রুতিতে দুইটি কণা যদি দুইটি অসমান দূরত্ব অতিক্রম করে, তাহলে অতিক্রান্ত সময় দুটির অনুপাত হবে দূরত্ব দুটির অনুপাতের সাথে দ্রুতি দুটির অনুপাতের বিপরীতের গুণফলের সমান।
এখানে কিন্তু শুধু দূরত্ব আর সময় দুটিই আলাদা নয়, বেগ দুটোও আলাদা। তাহলে সমীকরণ দুটি হবে যথাক্রমে [latex]s_1=v_1t_1[/latex] এবং [latex]s_2=v_2t_2[/latex]। এবারেও আগের মতো একটির উভয় পক্ষকে অন্যটির উভয় পক্ষ দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যাবে,
[latex] displaystyle frac{s_1}{s_2} = frac{v_1}{v_2} frac{t_1}{t_2} .[/latex]
এবারে ঠিক গালিলেওর উপপাদ্যটি পেতে চাইলে উপরের সমীকরণের উভয় পক্ষকে [latex]frac{v_2}{v_1}[/latex] দিয়ে গুণ করলেই হবে:
[latex] displaystyle frac{t_1}{t_2} = frac{s_1}{s_2} frac{v_2}{v_1} .[/latex]
এই সমীকরণের ডান পক্ষে এখন দুটি দূরত্বের অনুপাত [latex]frac{s_1}{s_2}[/latex] এর সাথে দুটি বেগের অনুপাতের বিপরীত [latex]frac{v_2}{v_1}[/latex] এর গুণফল পাওয়া যাচ্ছে, যেমনটা গালিলেও বলেছিলেন। আমাদের কাছে গালিলেওর কথা থেকে এই সমীকরণে আসাটা যত স্পষ্টই হোক না কেন, সেটা তৈরি করতে মানুষকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
উপরের দুটি উপপাদ্যেই একটি নির্দিষ্ট বেগ v এর কথা ভাবা হয়েছে। এই v এর কোনো পরিবর্তন, যেমন ত্বরণ (বেগ বৃদ্ধি) নেই। বিজ্ঞানের ইতিহাসে গালিলেওর সবচেয়ে মৌলিক অবদান ছিল এই সমত্বরণ যুক্ত বেগ। মুক্তভাবে উপর থেকে নিচে বা কোনো অবনত তল বেয়ে পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে এই ত্বরণ নিয়ে তিনি ভেবেছিলেন। এখানে সমত্বরণ, বা সমসত্ত্ব ত্বরণ বলতে বুঝানো হচ্ছে, বেগটি সমান সময়ে সমান পরিমাণ বাড়ে। তো এই সমত্বরণকে [latex]a[/latex] অক্ষরটি দিয়ে চিহ্নিত করা যাক। তাহলে t সময়ে v বেগটির পরিবর্তনকে [latex]v=at[/latex] সমীকরণটি দিয়ে হিসাব করা যায়। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরা যাক, a হচ্ছে ৫ মাইল/ঘণ্টা/সেকেন্ড, মানে প্রতি সেকেন্ডে বেগটি ৫ মাইল/ঘণ্টা করে বৃদ্ধি পায়; আর ধরা যাক t=১০ সেকেন্ড। তাহলে ১০ সেকেন্ড পরে চূড়ান্ত বেগ হবে, v = ৫ × ১০ = ৫০ মাইল/ঘণ্টা। এক্ষেত্রে আরেকটি সমীকরণ আছে যা দিয়ে ঐ t সময়ে a ত্বরণে অতিক্রান্ত দূরত্ব হিসাব করা যায়। সমীকরণটি হলো [latex]s=frac{at^2}{2}[/latex]। আগের গুলোর মতো এই সমীকরণের সত্যতা অত সহজে উপলব্ধি করা যায় না, এবং এর জন্য ক্যালকুলাসের সাহায্য নিলে সবচেয়ে ভালো হয়। সেই চিন্তা না হয় নিউটন আসা পর্যন্ত তোলা থাকুক।
এবার উপর থেকে নিচের দিকে মুক্তভাবে, অর্থাৎ একেবারে বাধাহীনভাবে পড়ন্ত একটি বস্তুর বেগ বৃদ্ধি অর্থাৎ ত্বরণ নিয়ে ভাবা যাক। এই বিশেষ ত্বরণটিকে সাধারণত [latex]g[/latex] অক্ষরটি দিয়ে প্রকাশ করা হয়, যার মান পৃথিবীর সবখানে প্রায় সমান। তো উপরের সমীকরণগুলোতে যদি আমরা a এর জায়গায় g বসিয়ে দেই তাহলে পাবো, [latex]v=gt[/latex] যা নির্দিষ্ট সময়ে বেগ বৃদ্ধির পরিমাণ বের করে দিবে, এবং [latex]s=frac{gt^2}{2}[/latex] যা দিবে দূরত্বটা।
গালিলেও [latex]s=frac{gt^2}{2}[/latex] সমীকরণটা জানতেন না, কিন্তু কেবল পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি এই সমীকরণে যে [latex]t^2[/latex] বলে একটা রাশি থাকবে তা বুঝতে পেরেছিলেন। তার নিজের মুখ থেকেই সেই উপলব্ধির কথা শোনা যাক,
স্থির অবস্থা থেকে সমত্বরণবিশিষ্ট গতিতে পড়ন্ত কোনো বস্তুর অতিক্রান্ত দুটি দূরত্বের অনুপাত সেই দূরত্ব দুটি অতিক্রম করতে প্রয়োজনীয় সময় দুটির বর্গের অনুপাতের সমান।
আধুনিক গণিতের ভাষায় এই উপপাদ্য প্রমাণ করতে গেলে আমাদেরকে প্রথমেই মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর অতিক্রান্ত দুটি দূরত্বের জন্য দুটি সমীকরণ লিখতে হবে,
[latex]s_1=frac{gt_1^2}{2}[/latex] এবং [latex]s_2=frac{gt_2^2}{2}[/latex]।
আর তারপর আগের মতোই একটি দিয়ে অপরটিকে ভাগ করতে হবে, যাতে আমরা পাবো
[latex] displaystyle frac{s_1}{s_2} = frac{t_1^2}{t_2^2}. [/latex]
ঠিক এই কথাটাই কিন্তু গালিলেও বলেছিলেন।
সমসত্ত্ব এবং ত্বরিত বেগ নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করার পাশাপাশি গালিলেও দুটোর সমন্বয় নিয়েও কাজ করেছিলেন। ক্ষেপনাস্ত্রের গতিতে এই দুটোর সমন্বয় পাওয়া যায়। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ পরাবৃত্ত অনুসরণ করে। জটিল জ্যামিতি ব্যবহার করে তিনি একটা কামানের গোলা যেকোনো কোণে নিক্ষেপ করলে তার গতিপথ কেমন হবে তা হিসাব করে বের করেছিলেন। আমাদের আজকের ত্রিকোণমিতিক সমীকরণের তুলনায় তার সমীকরণটা অনেক জটিল ছিল, কিন্তু নৈখুঁত্যের বিচারে কোনোটি কোনোটির চেয়ে কম নয়। নিজের সমীকরণ ব্যবহার করে গালিলেও ১ থেকে ৮৯ ডিগ্রি পর্যন্ত যেকোনো কোণে কোনো গোলা নিক্ষেপ করলে তার যে পরাবৃত্তরূপী গতিপথ পাওয়া যায় তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছিলেন।
জ্যামিতিক হিসাব নিকাশের চেয়ে গালিলেওর পরীক্ষণ পদ্ধতি আমাদের কাছে বেশি আপন মনে হয়, যেহেতু সেটা আধুনিক বিজ্ঞানের বেশি কাছাকাছি। পেন্ডুলাম বা সরল-দোলকের গতি মাপার জন্য তিনি এককের যে পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছিলেন তা আমাদের বর্তমান পদ্ধতির মতোই। তার ক্ষুদ্রতম একক ছিল ‘পুন্তো’ (punto) যা আমাদের ০.০৯৪ সেন্টিমিটারের সমান। ব্রাসের তৈরি একটা রুলারের সবচেয়ে কাছাকাছি দুটো দাগের মধ্যবর্তী দূরত্ব এমন হয়ে থাকে। আর সময় মাপার জন্য গালিলেও এক আধার থেকে আরেক আধারে সমান হারে (সেকেন্ডে ৩ আউন্স করে) পড়তে থাকা পানি ব্যবহার করতেন। যতটুকু পানি পড়েছে তার ওজন নেয়ার মাধ্যমে তিনি সময় বের করতেন। পানির ওজন মাপতেন ‘দানা’ (grain) দিয়ে, ১ আউন্স সমান ৪৮০ দানা। ১৬ দানা পানি পড়তে যে সময় লাগে সেটুকুই ছিল তার সময়ের ক্ষুদ্রতম একক, যার নাম দিয়েছিলেন ‘তেম্পো’ (tempo)। ১ তেম্পো প্রায় ১/৯২ সেকেন্ডের সমান। এককগুলো এত ছোটো হওয়ার কারণে গালিলেওর হিসাবকৃত দূরত্ব ও সময় গুলো অনেক বড় সংখ্যা হতো। আসলে সচেতন ভাবেই তিনি এমনটা করেছিলেন। কারণ তার কাছে যেহেতু ভগ্নাংশের ধারণা ছিল না, সেহেতু সংখ্যা ছোটো হয়ে যাওয়াটা বিপজ্জনক, যত বড় হোক সমস্যা নেই।
অম্লান কীর্তি
প্লেটো এবং এরিস্টটলের স্কুলে ‘ফিসিকা’ (physics—পদার্থবিজ্ঞান) পড়া শেষ হলে ছাত্ররা ‘মেতাফিসিকা’ (metaphysics—অধিবিদ্যা) পড়ত; গ্রিক ভাষায় ‘মেতা’ শব্দের একটি অর্থ ‘পরে’। গালিলেওর প্রধান কীর্তি হচ্ছে তিনি সেই মেতাফিসিকা থেকে মেতা সরিয়ে দিয়ে মেতাফিসিকার অনেক কিছুকে ফিসিকার বিষয়ে পরিণত করেছিলেন, আর ফিসিকা কে সব মেতাফিসিকা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। স্টিফেন হকিং লিখেছেন,
আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের পিছনে একজন একক ব্যক্তি হিসেবে অন্য যে কারো তুলনায় বেশি অবদান রেখেছেন গালিলেও… বিশ্ব কিভাবে কাজ করে তা মানুষের পক্ষে বুঝা সম্ভব এটা দাবী করা প্রথম কয়েকজনের মধ্যে গালিলেও একজন, এবং, আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তিনি এই বুঝার কাজটা বাস্তব বিশ্বটাকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই করেছিলেন।
গালিলেওর উপদেশ, গালিলেওর তৈরি হাতিয়ার ছাড়া কোনো পদার্থবিজ্ঞানীর পক্ষে কাজ করা সম্ভব না।
বলবিদ্যায় গালিলেওর অবদান বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো, কারণ এর মাধ্যমেই তিনি তার উত্তরসূরির জন্য পথ তৈরি করে দিয়ে গেছেন। ১৬৪২ সালের জানুয়ারিতে তিনি মারা গিয়েছিলেন, আর সেই বছরেরই ক্রিসমাসের দিনে জন্মেছিলেন আইজাক নিউটন। গালিলেওর বলবিদ্যার মূল আলোচ্য বিষয় ছিল সমবেগ বা সমত্বরণ, বিশেষ করে অভিকর্ষজনিত সমত্বরণ। দুটি সমীকরণ দিয়েই তার বলবিদ্যাকে তুলে ধরা যায়, [latex]v=gt[/latex] এবং [latex]s=frac{gt^2}{2}[/latex], কিন্তু অবশ্যই গালিলেও কোনো বীজগণিত জানতেন না। তবে তিনিই প্রথম ক্ষেপণাস্ত্রের তির্যক গতিকে দুটি উপাংশে ভাগ করার চিন্তা করেছিলেন, একটি উল্লম্ব এবং একটি অনুভূমিক উপাংশ। উল্লম্ব উপাংশটি চালিত হয় অভিকর্ষজ ত্বরণ দিয়ে, আর অনুভূমিকটি চালিত হয় নিক্ষেপ করার সময় তার মধ্যে যে বেগ সঞ্চার করা হয়েছিল তা দিয়ে। দিকযুক্ত ভৌত রাশিকে (এখন আমরা যাকে ‘ভেক্টর’ বলি) যে এভাবে দুটি আয়তাকার উপাংশে ভাগ করা যায় এটা প্রথম উপলব্ধি করা লোকদের মধ্যে গালিলেও অন্যতম।
তবে আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণার জন্য আমরা তার কাছে ঋণী, সেটি হচ্ছে “জড়তার নীতি”। এক জায়গায় তিনি নীতিটি এভাবে উল্লেখ করেছিলেন,
ভূমির সমান্তরাল, ঘর্ষণহীন একটি তল দিয়ে গতিশীল একটি কণার কল্পনা করা যাক; তাহলে আমরা জানি… যে, যদি তলটির কোনো শেষ সীমা না থাকে তাহলে কণাটি সেই তল দিয়ে অনন্তকাল ধরে সমসত্ত্ব গতিতে চলতে থাকবে।
প্রকৃতির একেবারে স্বাভাবিক কোনো সত্যকে বিমূর্ত কোনো ধারণা দিয়ে আদর্শ রূপে উপস্থাপন করাটা পদার্থবিজ্ঞানে খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং নিঃসন্দেহে এই বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনাশক্তির নমুনা আমরা প্রথম গালিলেওতেই পাই। অবশ্যই প্রকৃতিতে মসৃণ কোনো তল বা কণা নেই, কিন্তু অনুভূমিক তল দিয়ে বিভিন্ন বস্তুর যাওয়া আমরা সব সময়ই দেখি। এই দেখা বস্তু আর দেখা তল থেকে ঘর্ষণ উঠিয়ে দিলে কি হবে সেই কল্পনা, আর আইনস্টাইনের আলোর কণার পিঠে চড়ে বসার কল্পনার মধ্যে ফারাক কিন্তু খুব বেশি না। বাস্তবে কোনো অনুভূমিক তলের উপর রাখা একটি ফুটবলকে লাথি দিলে সেটা যেতে যেতে একসময় থেমে যাবে, কারণ ফুটবল আর মাঠের মধ্যে ঘর্ষণ। গালিলেও এখান থেকে ঘর্ষণ উঠিয়ে দিয়ে একটি আদর্শ নীতি বের করলেন এবং সেই নীতিকে ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ হিসাবের কাজে লাগালেন। কোনো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পর তার বেগের অনুভূমিক উপাংশটি বাতাসের ঘর্ষণ না থাকলে ধ্রুব থাকবে, আর উল্লম্ব উপাংশটি অভিকর্ষ দ্বারা প্রভাবিত হবে। এভাবে ঘর্ষণের মতো জাগতিক সব ক্রিয়া (যেমন বাতাসের ঘর্ষণ) দূর করে তিনি বিশুদ্ধ বলের (যেমন অভিকর্ষ) প্রভাব নিয়ে কাজ করার উপায় বের করেছিলেন।
তবে গালিলেও কিন্তু ‘বল’ (force) বা ‘শক্তি’ (energy) কোনো ধারণার সাথেই পরিচিত ছিলেন না। এগুলো তার উত্তরসূরিদের উদ্ভাবন। এগুলো মাপার উপায় জানা না থাকায় তিনি কেবল এগুলোকে গুণগতভাবে ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমানে আমরা যাকে ‘সৃতিবিদ্যা’ (kinematics) নামে চিনি তার অধিকাংশ উপকরণ গালিলেওর সরবরাহ করা। সৃতিবিদ্যায় সৃতি অর্থাৎ চলন নিয়ে আলোচনা করা হয়, কিন্তু সেই সৃতি কোন বলের প্রভাবে হচ্ছে সে বিষয়ে সে নিরব। যেমন, গালিলেও মহাকর্ষ বলের কারণে সৃষ্ট অভিকর্ষজ ত্বরণ নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু সেই ত্বরণ কিভাবে সৃষ্টি হচ্ছে সে নিয়ে কিছু বলেননি। এই কাজটা করবেন নিউটন এসে। নিউটনের ‘বল’ এর ধারণা যোগ হওয়ার পরই সৃতিবিদ্যা পরিণত হয় ‘গতিবিদ্যায়’ (dynamics)।
গালিলেওর বলবিদ্যা (mechanics) নিউটন ও তার উত্তরসূরিদের জন্য আবশ্যক ছিল। তবে সকল বৈজ্ঞানিক অবদান ছাপিয়ে গালিলেওর যে কাজটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা দিয়েছে তা হলো, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ধারণে পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের উপর পরম নির্ভরতা। গালিলেওর বৈজ্ঞানিক অবদান নিয়ে স্টিলম্যান ড্রেইক এর মূল্যায়ন ছিল এরকম:
গালিলেওর জন্মের আগে দীর্ঘ দুই হাজার বছরের পদার্থবিদ্যা চর্চার পরও একটা সামান্য বাস্তব গতির কোনো স্থূল পরিমাপ হলেও মানুষ করে দেখাতে পারেনি। এই ব্যাপারটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, যেকোনো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রথম পরিমাপটি হওয়ার পর থেকে তার একটা অবিচ্ছিন্ন ইতিহাস পাওয়া যায়, কিন্তু তার আগে একমাত্র অধিবিদ্যা ছাড়া তার আর কোনো পূর্বসূরি থাকে না। এ থেকেই বুঝা যায় কেন গালিলেওর বিজ্ঞান তার সময়কার প্রায় প্রত্যেক দার্শনিকের প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিল, যেহেতু তিনি এটাকে অধিবিদ্যা থেকে যতটা সম্ভব মুক্ত করে ছেড়েছিলেন। আর সেটা করতে পেরেছিলেন পরিমাপের মাধ্যমে, তার হাতে থাকা সব উপকরণ দিয়ে যথাসম্ভব নিখুঁতভাবে, বা নতুন কোনো যন্ত্র তৈরি করে।
[সমাপ্ত]
বাহ। কি চমতকার বিষয়। খুবই তথ্যবহুল নোট। অনেককিছু জানছি। আরো লিখুন।
অনেকদিনের ব্যস্ততায় কমেন্ট করিনি। আসলেই একটি খুব চমৎকার লেখা। অভিদা ঠিক এইরকম লেখাগুলোকেই মুক্তমনার প্রাণ বলতেন।
বাপরে বাপ, তোমার লেখা পড়লে দেখি আবার অংক করতে হবে। ভাল লেগেছে। অনেক অনেক কিছু বিশদ ভাবে জানতে পারলাম। প্রিয় পোস্ট অপশান থাকলে সেখানে রেখে দেয়া যেতো।
ভাল থেকো।
চমৎকার একটা সিরিজ পড়লাম। গ্যালিলেওর সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়েছিলাম, কিন্তু এত বিস্তারিত ঘটনাবলী জানতাম না। বেশ নির্মোহভাবে বর্ণনা করে গেছো (বা মূল বইয়েও হয়ত সেভাবেই লেখা হয়েছে)।
ধন্যবাদ।
হ্যাঁ, মূল বইয়েই খুব নির্মোহভাবে সব বলা হয়েছিল, এবং আসলে এই কারণেই বইটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। উইলিয়াম ক্রপার এতে ৩০ জন পদার্থবিজ্ঞানীর জীবনী বর্ণনা করেছেন, এবং কাউকে মহামানব বানাননি, সবাইকে নিতান্তই মাটিতে গড়া মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। জীবনীতে নির্মোহ বর্ণনা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমার লেখাটা আসলে অনুবাদই হয়ে গেছে, কিন্তু মাঝে নিজের সামান্য কিছু কথা যোগ করেছি দেখে, আর অনুবাদের সময় অত সৎ থাকিনি বলেই অনুবাদ ট্যাগটা লাগাইনি। এ ধরণের অনুবাদ নিয়ে একটা পরীক্ষা চালাচ্ছি।
বলতেই হচ্ছে, পরীক্ষাটা সফল। এরকম অনুবাদ পড়লে কাঠখোট্টা মনে হয় না একেবারেই। আবার অতি ভাবাবেগ না ব্যবহার করে ঘটনার ওপর মূল নজর ছিল, বোঝাই যাচ্ছে।
ঐ বইতে কি আইনস্টাইনের জীবনী আছে? থাকলে তার বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই আছে। ওটা অনুবাদ করতে পারো।
জেনে ভাল লাগল। ভবিষ্যতে এই ধরণের ‘অনুবাদ’ বেশি করার চেষ্টা করব। এমন অনুবাদের অনুপ্রেরণাও আসলে এসেছে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর দুইটা অনুবাদ গ্রন্থ থেকে: ক্লাইভ বেলের ‘সভ্যতা’ আর বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘সুখ’।
আইনস্টাইনের জীবনী আছে বইটাতে। কিন্তু আইনস্টাইনের জীবনী ইন্টারনেটে বাংলায় প্রচুর। মুক্তমনাতেও অনেকে লিখেছেন এ নিয়ে। আইনস্টাইন ট্যাগের অধীনে দেখলাম অনেকগুলো লেখা। তারপরও হয়ত ক্রপারের বইয়ে অতিরিক্ত কিছু আছে। নিউটন আর আইনস্টাইন নিয়ে তার অধ্যায় দুইটা অনেক বড়। দেখি এক সময় শুরু করতে পারি।
মুগ্ধ হলাম।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বইয়ের কথা মনে এলো ডাভা সোবেল এর গ্যালিলিও’স ডটার।
ধন্যবাদ। বইটার কথা জানতাম না। গালিলেওর বড় মেয়েকে নিয়ে আসলেই কিছু গবেষণা দরকার ছিল। এরকম একটা বই আছে জেনে ভাল লাগল।
হঠাৎ মনে হলো আবার অভিদাকে যেনো পেলাম! দারুন তথ্যবহুল একটি লেখা। বিজ্ঞানবাদীতা বুঝতে সহায়ক হবে অনেকের…!
একদম ঠিক বলেছেন,,,,,,
জয় মুক্তমনা ও জয় বাংলা।
অভিজিৎ দা শুধু নিজের রেখে যাওয়া লেখাই নয়, আমাদের সবার কলমের মাঝেও সজীব থাকবেন। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ…।
মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞানে বল ও গতির এই মৌলিক বিষয়গুলো আমরা পড়ে এসেছি, কিন্তু এখন এই বিষয়গুলো অনেক বেশি বোধগম্য এবং আকর্ষনীয় মনে হয়, এই আবিষ্কার এবং এর তাৎপর্যও বুঝতে পারি। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী এসব পড়ছে আর পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দিয়ে আসছে, তাদের মানসপটে গ্যালিলিও, নিওটন, নীলস বোর, মেন্ডেল… কতটুকু ছাপ রাকছে? হুমায়ুন আজাদ বলতেন ‘এই অচল গোত্রকে (বাঙালী মুসলমান) শিল্প সাহিত্য দিয়ে বদলানো সম্ভব নয়’, বিজ্ঞান দিয়েও কি সম্ভব?
দুটি পর্বই পড়লাম, খুব ভাল লেগেছে। বেশী করে এরকম লেখার অপেক্ষায় রইলাম…
ঠিক। আমিও উচ্চ মাধ্যমিকের বই পড়ে এই ব্যাপারগুলো ঠোঁটস্থ করতে পারলেও কখনও অন্তরস্থ করতে পারিনি, এখন যেমন পারি। আমাদের উচ্চ মাধ্যমিকের বইয়ের ব্যাপারে আরো বৈচিত্র্য থাকা উচিত। একটা চমৎকার প্রচেষ্টা দেখলাম সম্প্রতি ডেনমার্কে। ওরা ন কি স্কুল থেকে বিষয় উঠিয়ে দিচ্ছে, মানে পদার্থবিজ্ঞান, ইতিহাস, গণিত ইত্যাদি আলাদা আলাদা সাবজেক্ট থাকবে না। বরং থাকবে টপিক। যেমন এক ক্লাসে পড়ানো হবে এনলাইটেনমেন্ট এর ইতিহাস, আরেক ক্লাসে পরাবৃত্তের সমীকরণ, কিন্তু একটা যে গণিত আর আরেকটা যে ইতিহাস সেটা বলে দেয়া হবে না। সব হবে টপিকভিত্তিক, সাবজেক্টভিত্তিক নয়। ধারণাটা পছন্দ হয়েছে।
একেকটা বই লেখা আর তার প্রকাশের পিছনে কী পরিমান নিষ্ঠা কাজ করেছে ভেবে অবাক হই। তার উপরে এমন জিনিস নিয়ে লিখছেন যার আবিষ্কার, সেই আবিষ্কারের প্রিছনের তাত্ত্বিক অবকাঠামো, সবই নিজ হাতে গড়া! সে সময়ে ছোটোখাটো পরিমাপ আর গণনাও কী মুশকিলের ব্যাপার ছিল।
স্টিফেন হকিং এর সম্পাদনায় একটা বই আছে। অন দ্য শোল্ডার অফ জায়ান্টস। কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন এদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেপারগুলোর সংকলন। হকিং এর কমেন্ট্রি সহ।
বইটার কথা জানতাম। সংগ্রহ করলাম মাত্র। উল্টে পাল্টে দেখতে হবে।
গ্যালিলিও ছিলেন প্রথম সার্থক পরীক্ষণ-পদার্থবিজ্ঞানী। যে আকাশ নিয়ে হাজার বছরের সংস্কার ছিল (এখনো আছে অনেকের মনে) তার বেশিরভাগই অর্থহীন হয়ে যেতে শুরু করে যখন গ্যালিলিও’র দূরবীণ আকাশের দিকে তাক করা হয়েছিল। সেই থেকে পরের প্রায় চারশ বছরে সাফ হয়ে যায় চার হাজার বছর ধরে জমে থাকা অন্ধবিশ্বাস। দুটো পর্বে গ্যালিলিওকে সম্পূর্ণ তুলে আনা কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটাই করেছেন শিক্ষানবিস অনেক দক্ষতায়। কলম চলুক।
ধন্যবাদ।
গালিলেওকে নিয়ে আপনার পর্বগুলো খুবই চমৎকার। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ। গালিলেওকে নিয়ে এটাই কিন্তু শেষ পর্ব।
হ্যা, সমাপ্ত দেখলাম। বিজ্ঞানীদের নিয়ে এমন লেখার প্রত্যাশায় থাকলাম।
বিজ্ঞান এ গালিলেও এর অবদান সম্পর্কে জানার সুযোগ হল আপনার লেখনির মাধ্যমে। বিজ্ঞানীদের জীবনির প্রতি আগ্রহ তৈরি হল গালিলেওর ঘটনাগুলী পড়ে। বিজ্ঞানী চরিত বিভাগে আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ। আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন উইলিয়াম ক্রপার, আর আমি করে দিলাম আপনাকে। ভবিষ্যতে আরো বিজ্ঞানী চরিত আসবে। অদূর ভবিষ্যতে আসছেন লুডভিগ বোল্টস্মান।