প্রয়াত নাস্তিক সাংবাদিক, লেখক ও দার্শনিক ক্রিস্টোফার হিচেন্সের বক্তৃতায় বারবার উঠে এসেছে উত্তর কোরিয়ার কথা। এশিয়া মহাদেশের এই দেশটির শাসনভার ‘ওয়ার্কার্স পার্টি অফ কোরিয়া’-র হাতে। ১৯৭২-এর পর থেকে দেশটির রাজনৈতিক অভিমুখ ‘সমাজতন্ত্র’ থেকে ক্রমে ‘Juche’-তে স্থানান্তরিত হয়। পশ্চিমা মিডিয়ার সৌজন্যে উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ভুরিভুরি প্রশ্ন উঠলেও, সেগুলোর অর্ধেকই অতিরঞ্জিত। কিন্তু, ক্ষমতাতন্ত্র? দেশটির একটি অদ্ভুত প্রশাসনিক পদ আছে – ‘সুপ্রিম লিডার’। শুনেই বোঝা যায় পদটির গুরুত্ব। এই পদে বর্তমানে আসীন কিম জং-উন। কে তিনি? না, না। তাঁর যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলছি না। শুধু মনে করিয়ে দিই, কিম-জং-উনের বাবা কিম-জং-ইল ছিলেন আগের সুপ্রিম লিডার, আর দাদু কিম-ইল-সুং ছিলেন পূর্বের সর্বোচ্চ শাসক। বেশ বিপ্লবী পরিবার আর কি! সবাই বড় হয়ে দেশনেতা হয়ে যান। তো, এই কিম-ইল-সুং-এর মৃত্যু হয় ১৯৯৪ সালে। তাঁকে এখন উত্তর কোরিয়ার সংবিধানে ‘Eternal President’-এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর পর ‘President’? ব্যাপারটা যেন ক্যামন-ক্যামন শোনাচ্ছে! কিন্তু এটাই সত্যি! হিচেন্স একে বলেছেন, “It’s a necrocracy. A thanatocracy. A mausolocracy.”। তাহলে দেখা যাচ্ছে, উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতাতন্ত্র একটি ‘cult’-এর হাতে। এ-ও এক ধরনের ধর্ম। পশ্চিমী মিডিয়ার অতিরঞ্জন বাদ দিয়েও বলা যায়, সরকারিভাবে ‘নাস্তিক’ দেশ উত্তর কোরিয়া আসলে ‘ধর্ম’-শাসিত। কিম সাম্রাজ্য-ই সেই ধর্ম, সেই ‘cult’। ‘পরিবারতন্ত্র’ এখানে ধর্মের আকার নিয়েছে। হয়ে উঠেছে সর্বগ্রাসী, কর্তৃত্ববাদী চিন্তার আঁতুড়ঘর। উত্তর কোরিয়ায় কোনো ‘ঈশ্বর’ নেই, একমাত্র কিম ছাড়া।
পরিচিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর বাইরেও যে ধর্মীয় পরিমণ্ডল গড়ে উঠতে পারে, তার উদাহরণ হিসেবেই উত্তর কোরিয়ার কথা টেনে আনলাম। ধর্ম আসলে একটা কাল্ট। যে কোনো বদ্ধ সিস্টেম ধর্মে রূপান্তরিত হয়। আর তাতে যদি ‘universal morality’-র প্রসঙ্গ চলে আসে, তাহলে তো আর কথাই নেই! আসুন, এমনই সব ‘ধর্ম না হয়েও’ শেষ পর্যন্ত ‘ধর্ম হয়ে যাওয়া’-র ঘটনাগুলোয় চোখ বোলানো যাক।
‘মেয়েদের পোশাকই ধর্ষণের জন্য দায়ী’ – এমনটা আমরা সবাই অন্তত একবার হলেও শুনেছি। আদর্শ ‘মডারেট’-মার্কা কথা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে পণ্য হিসেবেই দ্যাখা হয়, কখনো বা যৌন-সামগ্রী হিসেবে। ঐ একই তত্ত্ব ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, একটু রঙ চড়িয়ে প্রকাশ করা হয় এভাবে –
নারীরা উত্তেজক পোশাক পড়ে ফিল্মে-বিজ্ঞাপনে আসছেন। তাই দেখে বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেরা সেটাকেই বাস্তব ঠাওরাচ্ছে, তাদের ‘ইয়ে’-টা ‘ইয়ে’ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা ‘ইয়ে’ করে ফেলছে। এসব হল গিয়ে পুঁজিবাদীদের চক্রান্ত।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. শুভংকর চক্রবর্তী তাঁর ‘সাজপোশাকের শালিনতা মূল্যবোধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে’ পুস্তিকায় লিখলেন(১),
“সাজগোজ করার, পোশাক নির্বাচন ও পরিধান করার স্বাধীনতা ও অধিকার ব্যক্তির নিজের। অবশ্যই। কিন্তু এই স্বাধীনতা যেন যথেচ্ছ হয়ে কখনোই শোভনতা ও সঙ্গতিবোধের মাত্রা অতিক্রম না করে। বাজারব্যবসায়ী ও মৌলবাদীর বিবেকহীন খেলার শিকার যেন তা না হয়।”
খেলো খেলো। পুঁজিবাদের ভূত আমায় খেলো। সে খাক গে। বাজার যদি আমার চিন্তাভাবনায় ভাগ বসায়, তাহলে আমাকে সচেতন হতেই হবে। সে তো বুঝলাম। কিন্তু, বাজার মানেই ‘ভয়ানক রকমের খারাপ’? ‘মূল্যবোধের বাপ-ঠাকুরদা’-দের দাবিটা হল – বাজার আমার বিবেক-কে কলুষিত করছে, আমি টের-ও পাচ্ছি না। কিন্তু, সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাভাবনার এন্টি-থিসিস যদি বাজার তৈরি করে দেয়, তাহলে সেটার-ও বিরোধিতা করতে হবে বুঝি? নীতি-পুলিশদের অভিযোগটা কি আদৌ ‘বাজারি’ হাওয়ার বিরুদ্ধে? না, তা তো নয়। লক্ষ্য করুন। এঁরা কিন্তু মূল্যবোধের প্রশ্ন তোলেন। মূল্যবোধ, বিবেকের একটা সামন্ততান্ত্রিক মাপকাঠি তৈরি করে ফেলেছেন নীতি-পুলিশরা। আমি অন্য কারোর ক্ষতি না করে কি পোশাক পরবো, তা-ও ঠিক করে দেবেন নীতি-পুলিশরা। এখানেই অবশ্য নীতি-পুলিশরা থেমে নেই। মেয়েরা শীতকালেও ক্যানো ছোটো পোশাক পরে? ক্যানো ‘যৌন সুড়সুড়ি’ দেয়? ছিঃ বাজার, ছিঃ! এই তোমার শিক্ষা! তোমার এই বাজারি-মূল্যবোধের পাল্লায় পড়ে যে নারীরা ভিক্টিম হচ্ছে, সেটা ক্যানো তোমার চোখ এড়িয়ে যায়? ক্যানো? ক্যানো? ক্যানো?
পুঁজিবাদ নিপাত যাক, সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা দীর্ঘজীবী হোক। অতএব, এই ‘puritan’-দের মুখেও আসলে একই বুলি, ধান্দাবাজির ‘পোশাক’-টা অবশ্য আলাদা। অর্থাৎ, সেই ‘universal morality’-র প্রসঙ্গ। আর সেই কারণেই এটাও মৌলবাদ। এটাও ধর্ম, ক্ষতিকারক সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ।
নভেম্বর ২০১৪। মুক্তমন, মুক্তচিন্তার পথে নতুন শপথ নিয়ে ‘কিস অফ লাভ’ আন্দোলন শুরু করে ভারতের একদল ছাত্রছাত্রী।উপমহাদেশে এখনো প্রকাশ্যে চুম্বন একটি নিষিদ্ধ কাজ। পেন, পেন্সিল আর চুম্বনকে ধর্ম প্রচণ্ড ভয় পায়। ফলে, চুম্বনরত প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রকাশ্যে দ্যাখা গেলে (থুড়ি, সামন্ততান্ত্রিক ‘ভাবাবেগ’-এ প্রেমিকা-প্রেমিকারা লাথি কষালে) তাদের উপর আঘাত নেমে আসা অস্বাভাবিক নয়। নীতি-পুলিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সরাসরি রাস্তায় নেমে চুম্বন করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রগতিশীল ছাত্রছাত্রীরা। তাদের উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, নীতি-সন্ত্রাস। সাধারণ নীতি-পুলিশ থেকে ‘বুদ্ধিজীবী’ নীতি-পুলিশ – সবারই ‘ভাবাবেগে আঘাত’ লাগে। মার্কসবাদের তথাকথিত ঠিকাদাররা ‘কিস করে বিপ্লব – এটা একটা ফালতু ব্যাপার’, ‘ভাত জোটে না আদ্দেকের, আর এরা চুমু খেয়ে বিপ্লব করছে’-মার্কা কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। সিপিআই(এম) দলের যুবক নেতা এম. বি. রাজেশ অবশ্য সরাসরি এই আন্দোলনকে সমর্থন জানান। মুক্তচিন্তার বাতাবরণ যে গেরুয়া-সন্ত্রাস এবং তার ছদ্ম-লাল সহযোগীরা কেড়ে নিতে পারবেন না, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু, একটা প্রসঙ্গ উঠতেই থাকে। সামন্ততান্ত্রিক বিভিন্ন চিন্তাধারা আজো আমাদের মনে ক্রিয়াশীল। হয়তো আমাদের অজান্তেই তারা আমাদের ব্যবহার করে চলেছে। কিন্তু, যাঁদের মুখে সর্বক্ষণ প্রগতিশীল বুলি, তাঁরা নিজেরাই যদি সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণায় বুঁদ হয়ে থাকেন?
এবার চোখ রাখি ‘এই সময়’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরে। কিছুদিন আগে ম্যাঙ্গালোরের এক কলেজের এক ছাত্র তার চার বান্ধবীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে একটি সেলফি পোস্ট করে ‘Whatsapp’-এ। ছবিটি ভাইরাল হতেই তান্ডব শুরু করে নীতি-পুলিশরা।(২)
তাহলে যা দ্যাখা গেল, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ‘ধর্ম’-ই ধর্ম নয়। মৌলবাদ অনেকগুলো ফ্রন্টে ক্রিয়াশীল। সর্বগ্রাসী মনোভাব ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করতে চাইলে সেটা ধর্মীয় মৌলবাদেরই নামান্তর। একদল নিজেদের গায়ে সরাসরি ‘সামন্ততান্ত্রিক’ পোশাক চড়িয়ে গলা ফাটান, আর অন্যদল সেই পোশাকের উপর একটা ‘পুঁজিবাদ-বিরোধী’ পোশাক-ও চড়িয়ে নেন। তসলিমাকে রাজ্যছাড়া করেছিলেন একদল ‘বাম’-নামধারী ধার্মিক। না, এঁরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মোহে আচ্ছন্ন নন। এঁরা মতান্ধতায় আচ্ছন্ন। তাই, এঁদের চিন্তাভাবনাও ধর্মের মতোই মৌলবাদের ব্রিডিং-গ্রাউন্ড। মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করতে যেসব বামপন্থীরা তসলিমাকে রাজ্যছাড়া করেছিলেন, তাঁরা ‘ধর্মীয় অনুভূতি’-তে আঘাত দিতে চান না। তাঁদের অনুরোধ করি, আপনাদের এই অ্যাপ্রোচে কারা লাভবান হচ্ছে ভেবে দেখুন। মৌলবাদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলে, সাময়িকভাবে তার দৌরাত্ম্য বন্ধ থাকে ঠিক-ই। কিন্তু ছাই-চাপা-আগুনের ছাইটা সরে গেলে সেই ‘শান্তি’ টেকে কি?
মৌলবাদী ফ্রন্টগুলোকে চিনতে হবে। মুক্তচিন্তার বিকল্প নেই। আসুন, দিশা খোঁজার চেষ্টা করি –
We have the same job we always had, to say, as thinking people and as humans, that there are no final solutions, there is no absolute truth, there is no supreme leader, there is no totalitarian solution that says that if you will just give up your freedom of inquiry, if you would just give up, if you will simply abandon your critical faculties, a world of idiotic bliss can be yours. We have to begin by repudiating all such claims – grand rabbis, chief ayatollahs, infallible popes, the peddlers of mutant quasi-political worship, the dear leader, great leader, we have no need of any of this. – Christopher Hitchens
অভিজিৎ রায়-দের সংগ্রাম চলতে থাকুক।
তথ্যসূত্র-
(১) সাজপোশাকের শালিনতা মূল্যবোধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে – ড. শুভংকর চক্রবর্তী – দীপ প্রকাশন
(২) এই সময়, ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০১৫
মৌলবাদের পোশাক বদল পোস্টটির সাথে একমত পোষন করছি।ধর্মকে অস্বিকার করছি না কিন্তু কোন কিছু বিস্বাস করার আগে কোনকিছু মেনে নেওয়ার আগে সেটার যথার্ততা যাচাই করা আবশ্যক।কারো বানানো কোরআন বা গীতা বা বাইবেল যাই হক না কেন সেগুলোর সত্যতা,প্রায়োগিক দিক যুক্তির মাধ্যমে অবতারন করা আবশ্যক বলে আমি মনে করি।ভারতীয় মুভী পিকে দেখলাম।সেখানে ধর্মীও ভাবমুর্তির যথার্ততা দেখান হয়েছে।যে কেও একটা কান্ডকে,মনগরা কাহীনিকে ধর্মের অংশ হিসেবে দেখালে আমরা সেটাকেই বিস্বাস করে ইবাদত করা শুরু করে দিই,এটাই কি ধর্ম? অনেক সময় শুনা যায় চাঁদে আল্লাহর ছবি দেখা যাচেছ, আবার নাকি মাঝে মধ্যে ভগবানকেও বা তার প্রতিচ্ছবি দেখাচ্ছে চাঁদে।এগুলো শুনলে মনে হয় ধর্ম কুন এলাহী কান্ড।আমাদেরকে এই ধর্মিও গোরামি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।আজকাল অনেকে ধর্মীও অনুষাসন গুলোকে ব্যাবহার করে রিতি মত ব্যাবসা শুরু করেছে।আর আমরা নির্দিধায় তাদের ঐ ভন্ডমিকে মনের মাঝে লালন করি।বিস্বাসের পাহার গড়ে তুলি, এগুলো কুন রকমের ধর্ম।।আমি এই সব ভন্ডামি থেকে সমগ্র মানবজাতিকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞান সম্মত যুক্তিগত ভাবধারাই চলতে আহব্বান জানাচ্চি
লেখাটি পড়ে নামকরনের সার্থকতা খুজে পেলাম। অসাধারন এবং তথ্যবহুল।
আসলে একটু কম সতর্ক প্রগতিশীল মানুষও বিভ্রান্ত হতে পারেন পোষাকের আড়ালের মৌলুবাদকে সনাক্ত করতে। আর ধর্মান্ধরা ওদের উদাহরন টেনে প্রগতিবাদীদের কলংকিত করার চেষ্টা করছে। তারপরেও মুক্তচিন্তাবিদরা বরাবরই স্বতন্ত্র থেকেছে। তাই এরা সমাজের অনেক গোষ্টির লক্ষবস্তুতে পরিনত হয়েছে।
আমিও বলব, জয় হোক সকল প্রগতিকামী মানুষের।