সম্প্রতি অভিজিৎ রায়ের জঘন্য হত্যাকাণ্ড নিয়ে এতটাই বিমর্ষ ছিলাম যে কি লিখব ভেবে পাচ্ছিলাম না, কিভাবে লিখলে বা বললে যথাযথ হবে সেটাও ছিল ভাবনার বাইরে; কিন্তু কিছু একটা লেখার তাড়া অনুভব করছিলাম ভেতরে, যদিও এ লেখায় হয়ত অনেকের কথার সুর অনুরণিত হবে, মনে হবে পুনর্বার উচ্চারণ, তবুও এ অনুভূতি একান্ত আমার সেই পরম পূজনীয় জ্ঞান সাধকের প্রতি। বলা বাহুল্য আমি একজন অতি নগণ্য মানুষ, ব্যক্তি অভিজিৎ রায় সম্পর্কে বিন্দু বিসর্গও জানিনা, বলতে পারেন মুক্তমনার সদস্য হবার সুবাদে সেই ব্লগের জনকের নামের সাথে পরিচয় মাত্র; যিনি এই ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা, যুক্তিবাদী, উদার-বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক-প্রগতিশিল চিন্তার ধারক-বাহক-গবেষক ও বিশ্লেষক বলেই আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তাকে ধারণ করতাম। তাকে এই নৃশংসভাবে হত্যার পরেই জানতে পারলাম তিনি মুসলমানদের প্রিয় নবীজির সম্পর্কে এহেন খারাপ কথা লিখেছেন তার বইয়ে যা যেকোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অন্তকরণে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করবে এবং তা সহ্য করা অসম্ভব। আর তাই আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ তার পেয়ারে দোস্তের অবমাননা যারা করবেন বা করেন তার বা তাদের দেহের সাথে মস্তক রাখার কোন বিধান রাখেন নাই।

এখানে পাঠকের উদ্দেশ্যে বলছি আমি যেমন মৃত অভিজিৎ রায় কতটুকু উঁচু কিম্বা কতখানি নাফরমান সেসবের কিছুই জানিনা তেমন আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে তার মোমিন বান্দাদের দায়িত্ব সম্পর্কে কি ফরমাইয়াছেন সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র অবগত নই। তবে আমার এই ক্ষুদ্র জ্ঞানের বহরে যা অনুমান করি তা হল; পৃথিবীতে কি কারণে কেন ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল সেটিও বহুল আলোচনা ও গবেষণার দাবি রাখে; সেটিও আমাদেরকে আরো বেশি জানতে হবে। যদিও আজকের আলোচনার বিষয় নয় সেটি; তবে এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে সৃষ্টির শুরু থেকেই ধর্ম সামাজিক স্থিতিশীলতা তথা মানবতার কল্যাণেই ব্যবহৃত হবে সেই বিশ্বাসই ছিল সকল ধর্মের ধর্মপ্রাণদের। যুক্তি বিবর্জিত অন্ধকার কূপমণ্ডূকতাকে কোন ধর্মই উৎসাহিত করেনি বরং সব ধর্মই জ্ঞান চর্চাকে, স্ব স্ব ধর্ম পালনে স্বাধীন চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে কিভাবে তাকে মানবতার কল্যাণে আরও বেশি ব্যবহার করা যায় সেকথাই বলেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে; বিজ্ঞানের আবিস্কার ও ধর্মের উদ্ভব এই দুইয়ের উদ্দেশ্যই যদি মহৎ হবে তবে এই দুইয়ে এত বিরোধ কেন? জবাব একটাই, একটি যুক্তিপ্রমাণ ছাড়া কোন কিছুকে বিশ্বাস করে না অন্যটি শুধু বিশ্বাস দিয়ে সব প্রতিষ্ঠা করতে চায় । ধর্ম বনাম বিজ্ঞানের আলোচনা আপাততঃ ক্ষান্ত করে আবার আসি অভিজিৎ রায় হত্যা বনাম ইসলাম সুরক্ষার সেই পুরনো প্রসঙ্গে;

প্রথমতঃ আমি যদি অভিজিৎ রায়ের যুক্তিবাদী বিশ্লেষক হওয়াটাকে অপরাধ মনে না করি তবে বলব তার জ্ঞান চর্চার সীমানা সে অব্দি পৌঁছেছে যেখানে গিয়ে তিনি ঈশ্বরবাদকে অস্বীকার করতে পেরেছেন, প্রকৃতিবাদকেই যথার্থ বলে মেনেছেন এবং সে সম্পর্কে তার আলোচনা-প্রচারণা-গবেষণা চালিয়ে গেছেন । আমি অত্যন্ত নগন্য এবং জ্ঞানে ক্ষুদ্র একজন মানুষ তার এই জ্ঞানের পরিমাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আমার বিরোধিতা করার ধৃষ্টতা ও নেই।
¬
দ্বীতিয়তঃ যদি আমি মনে করি তিনি যা বলেছেন তা নিতান্তই জ্ঞানশূন্য, সারবত্ত্বাহীন, বেকুবের উক্তি, তাতেও এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন ক্ষতি হচ্ছে বলে আমি দেখছিনা, বরং আমি এই পাগলের প্রলাপ নিয়ে কোন আলোচনায়ও যেতে রাজি নই, পাত্তা না দিয়ে এসব আলোচনাকে উড়িয়ে দিই ফুঁ দিয়ে। পৃথিবীতে যত মত তত পথ, নবীর সংখ্যাই দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার, কিতাবের সংখ্যাও কেবল একটি নয়। সুতরাং যার বিশ্বাস তার কাছে, আমার ঘুম হারামের কিছুই দেখিনা আমি ।

তৃতীয়তঃ অভিজিৎ এর দর্শন তথা চিন্তা-চেতণার এই প্রচারনায় যদি আমি অনেক বেশি আহত হই; ধর্ম রক্ষার মহান দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়ে আমি তখন আরও বেশি জ্ঞানচর্চা করে অভিজিৎ রায়ের কথাকে ভুল প্রমাণিত করব, জ্ঞান দিয়ে যুক্তি খণ্ডন করে নবীজির কিম্বা ইসলামের মহত্ব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেব যাতে করে ইসলামের ভুল প্রচারণা আর কেউ না করতে পারে।
চতুর্থতঃ অভিজিৎ রায় যদি ঈশ্বরবাদকেই অস্বীকার করেন তবে শুধু ইসলাম কেন সকল ধর্মই অস্বীকার করেছেন, কিন্তু অবাক হবার বিষয় হল অন্য কোন ধর্মের কেউই এ পর্যন্ত এই নিয়ে উচ্চবাচ্চ্য করলেন না; একমাত্র এই আদ্যোপান্ত কূপমণ্ডূক বাঙালী জাতি ছাড়া । বোধ করি এর পেছনেও নিগুঢ় কোন সত্য লুক্কায়িত আছে যা আমার জানা নেই, তবে আন্দাজ করি যে আল্লাহ্‌র ধর্মপ্রাণ মুসলমান সদা জাগ্রত ধর্মের হেফাজতের লক্ষ্যে; আর সেকারণেই বাংলাদেশ তথা বিদেশে বসবাসরত অনেক বাংলাদেশি মমিন মুসলমান সবাই একবাক্যে এই কথাই আওরাইতেছেন যে অভিজিৎ রায় বহুত বড় নাফরমানী কাজ করেছেন, তার শাস্তি হওয়া উচিত ছিল, তিনি নাস্তিক।

কিন্তু এই ধর্মপ্রাণ মোমিনগণ একবারও স্বীকার করছেন না যে সকল অন্যায়ের শাস্তি দেবার একমাত্র মালিক আল্লাহ, যিনি আখেরাতের ময়দানে সকল পাপের বিচার করবেন; আর মানুষ হত্যা সেতো মহাপাপ । এ কথা অভিজিৎ না জেনেই মহাপাপ করেছিলেন কিন্তু মোমিন গণ জেনেও তা অস্বীকার করছেন নিজেদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করছেন, কিম্বা আখেরাতে বিশ্বাস করছেন না বলেই হত্যা করে ইসলাম কায়েম করছেন। প্রিয় পাঠক, ভেবে বলবেন কি কে ইসলাম তথা আল্লাহকে অস্বীকার করছে, কার কার্যকলাপ এবং আচরণে আল্লাহ কিম্বা ইসলামের প্রতি মানুষের ঘৃণা বাড়ছে কোন কাজটি ইসলাম বেশি নাপছন্দ করছে? যিনি বাস্তবে অধীত জ্ঞান অর্জন করে সে বিষয়ে উপস্থাপন করেছেন, তিনি? নাকি যারা শিরকি পাপ জেনেও নিজেদেরকে আল্লাহ্‌ বলে দাবি করছেন । তাদের ধৈর্য সহ্য এবং স্মরণ শক্তিও এত কম যে আমাকে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে মোমিনদের নবীজি ইসলাম প্রচারের জন্য কত লাঞ্ছনার স্বীকার হয়েছিলেন, পথের কাঁটাদানকারী বুড়ীকে খুঁজে বের করে সেবা দিয়ে মহানুভবতা দিয়ে তাকে সারিয়ে তুলেছিলেন……যেখানে সেদিন ধর্ম নয় মানবতার কলই বাতাসে নড়েছিল।

যুগে যুগে অভিজিৎদেরও জন্ম হয় মানবতার জয়গান গাইতে … অভিজিৎ একটি বিশ্বাসের নাম, যুক্তিবাদি বিপ্লবের নাম, সত্য দর্শনের নাম, বিপ্লবের-বিশ্বাসের মৃত্যু নেই। সৃষ্টির শুরু থেকেই যখনই কোন নতুন জ্ঞানের কিম্বা দর্শনের আবিস্কার হয়েছে তৎকালীন সমাজ-রাষ্ট্র-মানুষ কখনোই সহজে তা গ্রহণ করেনি বরং নতুন আবিস্কারের জন্য, চিন্তা-দর্শন প্রচারণার জন্য আত্মাহুতি দিতে হয়েছে এমন অনেক বিজ্ঞানী-মনীষীদের; সে দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে উপস্থিত। কিন্তু তাই বলে বন্ধ হয়নি আবিস্কার-বিজ্ঞান চর্চা, মরে যায়নি জ্ঞান-পিপাসা, থেমে থাকেনি বিপ্লব……………।

অভিজিৎ প্রকৃতির পূজারী ছিলেন, চর্চা করতেন বিবর্তনবাদের, বিশ্বাস করতেন প্রকৃতির বিবর্তনই সত্য, তাই বলছি, প্রকৃতিই একদিন শোধ নেবে এই অন্যায়-অবিচার আর জঘন্য হত্যার………ততদিন বাঁচবে অভিজিৎ, বিপ্লব হয়ে, বিশ্বাস হয়ে কোটি কোটি মুক্তমনার মুক্তবুদ্ধির জ্ঞানচর্চায়; কোটি মানুষের অন্ধকার থেকে আলোর পথের আলোকবর্তিকা হয়ে…………।