অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতে এই মুহূর্তে আমরা শোকাহত। কিন্তু, খুব বেশিদিন এভাবে চললে আমাদেরই বিপদ। অভিজিতের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদ হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দারদের খুন করেছে। আর সেই মৌলবাদীদের জাতভাইরা ভারতে হত্যা করেছে যুক্তিবাদী আন্দোলনের কর্মী নরেন্দ্র দাভোলকর-কে। কিছুদিন আগেই এদের হাতে গোভিন্দ পানসারে খুন হন। অভিজিতের মৃত্যুও একই ধারার ঘটনা। অভিজিতের মৃত্যুর পর অদ্ভুত কয়েকটা মত দ্যাখা যাচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়। এই মতগুলো আগেও ছিল। কিন্তু, এখন পোশাক পালটে গ্যাছে। এই মতগুলোর মোকাবিলা না করলে মুক্তমনা মানুষ কথা বলার সুযোগ হারাবেন। তাই, একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

প্রথম মত – যারা অভিজিতকে হত্যা করেছে, তারা আসলে ধর্মকে ভালোবাসে না। তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে। এরা ধর্মপ্রেমী নয়।

এ তো আমরা বহুযুগ ধরে শুনছি। একটি তথাকথিত কমিউনিস্ট দলের শাখা-সংগঠনের ডাকে অভিজিতের হত্যাকারীদের ধিক্কার জানিয়ে মিছিলের আয়োজন করা হল। “ঝান্ডার তলায় এবার থেকে ডান্ডাও রাখতে হবে”, “এবার প্রতিরোধের সময় এসেছে” জাতীয় বক্তব্য শুনলাম। বামপন্থীদের শীতঘুম কাটলো তবে! কিন্তু, তারপরেই আবার সেই ‘এরা ধর্মকে ভালোবাসেনা’-মার্কা বুলি। যারা এগুলো বলছেন, তারা কি আদৌ ‘পবিত্র’ বইপত্রগুলো পড়ে দেখেছেন? ধর্মকে যদি সত্যি কেউ ভালোবেসে থাকে, তাহলে তারা এই জঙ্গিরাই। কারণ তারা ধর্মের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। সাধারণ ধার্মিক মানুষ এসব মানেন না, তাঁরা কেবল ধর্মীয় কিছু সংস্কারেই আবদ্ধ। তাঁদের মুক্ত করতেই মুক্তমনার জন্ম। অভিজিতের লেখা পড়ে বহু মানুষ মানবতাবাদকেই ধর্ম(property) হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ধর্মের(religion) কোনো প্রয়োজন তাঁদের নেই। যারা ‘এই হত্যাকারীরা ধর্মকে ভালোবাসে না’-জাতীয় বুলি আওড়াচ্ছেন, তারা পরোক্ষভাবে অভিজিতের বিরোধিতা করছেন। কারণ, অভিজিতের সংগ্রাম ছিল বিশ্বাসের ভাইরাসের বিরুদ্ধে। ধর্ম এই ভাইরাসকে সযত্নে লালন করে।

দ্বিতীয় মত – এসব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত। তারাই ধর্মীয় মৌলবাদ সৃষ্টি করেছে।

ধর্মের ক্ষমতাতন্ত্র কর্তৃত্ববাদী (authoritarian), বিশ্ব-দর্শন সর্বগ্রাসী(totalitarian)। ফলে, ধর্মের নিয়মকানুনে আবদ্ধ হয়ে পড়লে আর বদ্ধ-ঘরের বাইরের দুনিয়াটা দেখা যায় না। মার্কসবাদের প্রতি অন্ধিবিশ্বাস (দ্বান্দিক বস্তুবাদ চুলোয় যাক) রেখে যারা মার্কস-কে ‘পীর’ মনে করেন, কিংবা, ‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান কারণ ইহা বিজ্ঞান” কপচান, তাঁরা প্রত্যেকেই বিশ্বাসের ভাইরাসের শিকার। এই অন্ধবিশ্বাসটাই মৌলবাদের জন্ম দেয়। অরওয়েলের ‘বিগ ব্রাদার’ ঠিক যেমনটা চেয়েছিলেন। এই তথাকথিত ‘মার্কসবাদী’-রা সবেতেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূত দ্যাখেন। অভিজিৎ যখন মার্কসবাদের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখলেন, একদল মার্কসবাদী সেদিন অভিজিতকে ‘পুঁজির দালাল’, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি’ ইত্যাদি বলে গাল পাড়লেন। আজ যদি তাঁরাই অভিজিতের জন্য চোখের জল ফ্যালেন, তাহলে আশ্চর্য হব না। এই ভাইরাস-আক্রান্তদের জন্য বলে রাখি, মুক্তমনায় অভিজিৎ রায়ের অজস্র যুদ্ধবিরোধী লেখা পাবেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারে মুক্তমনার অবদান যদি স্বীকার করতে না পারেন, তাহলে চোখে ঠুলি পড়েই বসে থাকুন। খোলার প্রয়োজন নেই। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একটা সময়ে অস্ত্র জুগিয়েছে মৌলবাদীদের। কিন্তু, মৌলবাদের বীজ বপন করেছে ধর্মই। যে কোনো বদ্ধ সিস্টেম রাতারাতি ধর্ম হয়ে উঠতে বাধ্য। সে একটা কমিউনিস্ট দল-ই হোক, কিংবা ডেস্ট্রাক্টিভ কাল্ট।

তৃতীয় মত – অভিজিতের হত্যাকারীদের ধিক্কার। একই সঙ্গে, অভিজিতকেও। কারণ, তিনি ‘ভাবাবেগে’ আঘাত করেছেন।

‘ভাবাবেগ’ বস্তুটা কি? ধর্মপ্রেমীরা ধর্মের নির্দেশে আমার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ালে আমার মানবিক ভাবাবেগ আক্রান্ত হয়। সে বিষয়টা মডারেটদের ভাবায় না। তাদের ভাবাবেগ আক্রান্ত হয় তখন, যখন কেউ প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিছু কিছু ধর্মের চোখে তো আবার বিবর্তনবাদ-ও ‘blasphemy’। অভিজিৎ রায় ঠিক কোন ভাবাবেগে আঘাত করেছিলেন? ‘ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুঁড়ে হত্যা’ – এমন ফতোয়া যদি আপনার ভাবাবেগের প্রতীক হয়, তাহলে সেই ভাবাবেগের সমর্থন করা বিবেকবান মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অভিজিৎ সেই বিবেকের প্রতীক। আমি বামপন্থী। ভাবাবেগ ছিল। বামপন্থী ভাবাবেগ। ক্রিস্টোফার হিচেন্স এবং অভিজিতের লেখা পড়ার সময় সেই ভাবাবেগে ক্যাঁৎ করে লাথি কষিয়েছিল ‘মুক্তমনা’। আজও বামপন্থী হবার চেষ্টা করি। কিন্তু, ঐ উদ্ভট ভাবাবেগ আর নেই। অন্তত তাকে প্রশ্রয় দিই না। ধন্যবাদ, অভিজিৎ রায়।

চতুর্থ মত – অভিজিৎ হিন্দু ছিলেন। সেইজন্যই তাঁকে আক্রান্ত হতে হল।

মৌলবাদী শিবিরের জাতভাইদের পক্ষ থেকে এই আজগুবি তত্ত্ব প্রচার করা হচ্ছে। অথচ অভিজিৎ তো নাস্তিক ছিলেন! স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারার নির্মোহ বিশ্লেষণ করে তিনি বহু ধারমিকের বিরাগভাজন হন। অথচ, তাঁর যুক্তিকে খন্ডন করার ক্ষমতা কেউই দ্যাখাতে পারেননি। এরপরও অভিজিৎ-কে হিন্দু-তকমা দেওয়াটা বোধ হয় দূরদর্শী রাজনৈতিক চাল।

যারা একসময় ভোটবাক্সের মাথায় হাত বুলিয়ে তসলিমাকে রাজ্যছাড়া করেছেন, তাদের একটা অংশ এখন বাকস্বাধীনতার হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন। উদ্যোগটা নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু মাথায় রাখবেন, আমাদের বাকস্বাধীনতার পরিধিটা ক্রমশ কমে আসছে। তাহলে কি করা উচিত?

ধর্মের সাথে আপোস করে যুক্তিবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায় না। বরং, ওতে ধর্মের হাতেই অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। অভিজিতের লেখা বইপত্র, প্রবন্ধ ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। প্রয়োজন হলে মুক্তমনার মত পোর্টাল খোলা শুরু করতে হবে। অভিজিতের লেখা পড়ুন। মুক্তমনায় অভিজিতের লেখা প্রবন্ধগুলো সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন। জানি না ভবিষ্যৎ কি, জানি না আমরা আদতে কতটা সুরক্ষিত। কিন্তু, শোকসভা চুলোয় যাক। আসুন, অভিজিতের অস্ত্রাগারে চোখ রেখে কলমকে শক্তিশালী করার শপথ নিই। কলমের যুদ্ধ কদ্দিন চলবে, কিংবা তার শক্তি ঠিক কতটা, জানা নেই। কিন্তু, আমাদের জিততে হবে।

মুক্তমনা এগিয়ে চলুক।

1939679_678493535540253_921419242_o