Mrinalini Devi

 

অনন্ত মহালোক আশ্বিন ১৪২০

আমার রবীন্দ্রনাথ

আমার জীবনে তুমি ধরেছ জীবন

ওঁ
সংসার, কলকাতার ভিড়, আত্মীয়বর্গের কলহ কোলাহল সব ছেড়ে দূরের নির্জনতায় তোমার মনে মুক্তি ও আনন্দের স্বাদ, তোমার মনে হয়েছে ডাঙ্গায় তোলা মাছ যেন জলে পড়ে প্রাণ ফিরে পেল। ‘কলকাতার ভিড়ে জীবনটা নিষ্ফল হয়ে থাকে।’

আমি তখন জোড়াসাঁকোয়, তুমি শিলাইদহ, সময়টা জুন ১৯০১ সন। নির্ভার মুক্ত মনে তুমি বসে আছ খোলা জানালার পাশে, সামনে প্রকৃতি অবারিত। লিখলে, ‘এখন এখানকার নির্জনতা আমাকে আশ্রয় দান করেছে, সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটি আমাকে স্পর্শ করতে পারচে না।’ কিন্তু আমি কবি নই। স্বামী সন্তান সংসার কাতর নারী। নির্জনতার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারি না, আমার দরকার মানুষের ভালোবাসা। প্রকৃতি মানুষের অন্তরে বসে ভালোবাসা শেখায়, যন্ত্র ভালবাসা শেখায় না। বরাবর তাই আমি একাকী নির্জনতার চেয়ে কলকাতার বৃহৎ সংসারে স্নেহ ভালবাসায় থাকতে পছন্দ করেছি। মানুষের ভিড়ে খুব একটা অসহ্য ঠেকে না। সব সময় তা পারিনি। এখন আমি মহাকালের শেষহীন পথে নির্জন একাকী। তোমার সঙ্গে একান্তে পত্রালাপের ইচ্ছে মনে জেগে উঠতে শত কথার ভিড়, আনন্দ বেদনার স্মৃতি মহালোকের অনন্ত শূন্যতায় বুকের ওপর চেপে বসেছে! দু’চোখে মনে স্মৃতির ঘোর… ‘কোথায় আলো কোথায় ওরে আলো’… চরণটি মনে খুব ভাসছে !

মহাকালের এই নির্জনতা আমার কাম্য ছিল না। মুক্তির আনন্দে এই একাকী জীবন বেছে নেইনি। মৃত্যু আমাকে নিয়ে এসেছে। এই শূন্যলোক যদি নির্বাচন করে নিতাম তাহলে হয়তো তোমার মতো মনের মাধুরী ভাষার জাদু দিয়ে হৃদয়মুগ্ধ চিঠি লিখতে পারতাম। চিঠি লিখতে বসে তোমার সেই চিঠির কথাই মনে এলো প্রথমে-

‘…সমস্ত আকাশ অন্ধকার করে নিবিড় মেঘ জমে এসে বৃষ্টি আরম্ভ হল ‘… নীচের ঘরের চারিদিকের শার্সি বন্ধ করে এই বর্ষণদৃশ্য উপভোগ করতে করতে তোমাকে চিঠি লিখচি। তোমাদের সেখানকার দোতলার ঘরে থেকে এ রকম চমৎকার ব্যাপার দেখতে পেতে না। চারিদিকের সবুজ ক্ষেতের উপরে  স্নিগ্ধ তিমিরাচ্ছন্ন নবীন বর্ষা ভারি সুন্দর লাগচে। বসে মেঘদূতের উপর একটা প্রবন্ধ লিখচি। প্রবন্ধের উপর আজকের এই নিবিড় বর্ষার দিনের বর্ষণমুখর ঘনান্ধকারটুকু যদি এঁকে রাখ্তে পারতুম, যদি আমার শিলাইদহের সবুজ ক্ষেতের উপরকার এই শ্যামল আবির্ভাবটিকে পাঠকদের কাছে চিরকালের জিনিষ করে রাখতে পারতাম তাহলে কেমন হত ! আমার লেখায় অনেক রকম করে অনেক কথা বলচি-কিন্তু কোথায় এই মেঘের আয়োজন, এই শাখার আন্দোলন, এই অবিরল ধারাপ্রপাত, এই আকাশপৃথিবীর মিলনালিঙ্গনের ছায়াবেষ্টন ! কত সহজ ! কি অনায়াসেই জলস্থল আকাশের উপর এই নির্জন মাঠের নিভৃত বর্ষার দিনটি-এই কাজকর্মছাড়া মেঘেঢাকা আষাঢ়ের রৌদ্রহীন মধ্যাহ্নটুকু ঘনিয়ে এসেছে অথচ-আমার সেই লেখার মধ্যে তার কোন চিহ্নই রাখতে পারলুম না – কেউ জানতে পারবে না কোন্দিন কোথায় বসে বসে সুদীর্ঘ অবসরের বেলায় লোকশূন্য বাড়িতে এই কথাগুলো আমি আপনমনে গাঁথছিলুম। খুব এক পসলা বর্ষণ হয়ে থেমে এসেছে।…’ (চিঠিপত্র ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬০-৬১, চিঠি নম্বর ৩০)।

মেঘদূতের জলভরা মেঘ প্রেমের আবেগ নিয়ে উত্তর দক্ষিণ করছে না এখানে, যদিও সাদা পেঁজা পেঁজা মেঘের নানা আকৃতির ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশের ছবি শুধু শূন্যতার কথা মনে করিয়ে দেয়। যদি কবি হতাম তাহলে নিশ্চয় এ নিয়েও নির্জনতায় জমিয়ে কাব্য রচনা করতে পারতাম। যেমন তুমি বৃষ্টিমুখর প্রকৃতির মুখোমুখি বসে মেঘদূতের ওপর প্রবন্ধ লিখছ। তার কোনো অবসরে প্রিয়ার মুখের মতো আমার কথা তোমার মনে এল। আমি সংসারী নারী, একাকী চলার পথে দীর্ঘদিন পরে মনের ভাব তোমাকে জানাতে বসলাম। কিন্তু সে অন্য কবির মেঘদূত নয়, তোমার আমার সংসার জীবনের একান্ত কিছু কথা মাত্র। যখন তুমি দেশে-বিদেশে থাকতে আর তেমন বাতাস হিল্ললিত বর্ষণমুখের সন্ধ্যা হলে মনে আসত, ‘আজ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’-এর স্মৃতি।

অনেক দিন পর এই চিঠি লিখছি। শত বৎসর পেরিয়ে গেল, আরও যেতে পারে, এখন তো কেউ চিঠি লেখার জন্য তাড়া করে না। চিঠি পেতে দু’একদিন দেরি হলে অভিমান করে বলবে না ‘তোমাদের মতো এত অকৃতজ্ঞ আমি দেখিনি।’ আমি এখন অপরলোকের বাসিন্দা। কাল এখানে সময় নিরপেক্ষ, মহাকালে সবই অনন্ত, অনন্ত শূন্যে অন্তহীন সময়। বিলম্ব ঘটার জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে না। তবুও কোথাও কারও কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রয়োজন হয়। আমার এই চিঠি সেরকম এক দায়বোধ থেকেও রচনা। মাত্র উনত্রিশ বছরের জীবনে খুব হলে উনিশ বছর তোমাকে দেখেছি। এর মধ্যে তোমার অনুপস্থিতির দিনও অনেক, দেশের ভিতর আর বাইরে কত জায়গায় তোমাকে একাই যেতে হয়েছে, থাকতে হয়েছে। তোমাকে খুব কাছ থেকে পাওয়ার সময় খুবই অল্প। যদিও এখন জানি শত বছর আয়ু পেলেও আমি তোমাকে জানতে পারতাম না, জানা মানে বোঝা, উপলব্ধি করা, তোমার প্রকাশ বৈভবের সমগ্রটুকুর আস্বাদন করা। সেজন্য উনিশ বছরটি কোনো আক্ষেপ করে বলা নয়। মহাকালের যাত্রায় আমার নবজীবন নবীন আলোয় আলোকিত, প্রজ্ঞাবান। এই জন্মে শুরু হয় তোমাকে পাঠ ও উপলব্ধি, বিচার করে দেখা। মর্তের সংসার সময়ে আনন্দের মাঝে কখনো কখনো দুঃখের মেঘও যে জমেছে তার খোঁজ খবর করা। ওইসব মেঘ কতটা শুধুই বাষ্প কতটা শীতল জলকণায় পূর্ণ ছিল ! বিচারশক্তি দীর্ঘকালে জন্মে, তার সম্পূর্ণ বিকাশ বিলম্বে ঘটে। এমন কথা শুধু সাহিত্যের জন্য কেন সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দীর্ঘ শতবছর হয়তো উপলব্ধির ক্ষমতা সহ তোমাকে বোঝা ও পাঠ করতে লেগে গেল। এই খোলা চিঠিতে সেই একান্ত বিচারবোধেরই প্রকাশ ঘটবে। তোমার ভাষা ধার করে বলি, ‘লেখকের মনের সহিত পরিচয় করাইয়া দেওয়াই সমালোচনার সৌন্দর্য।’ আলোচনা নতুন করে সৃজন করে, অন্য একজনের বিচার ও চিন্তা যোগ হয়ে এক প্রকার নতুন সৃজন। তো এই লেখক-মন শুধু মূল লেখকের নয়, আলোচকেরও মনের পরিচয় তাতে মিলে। এই পত্রে গুরুদেব তোমার মনের পরিচয়ের সঙ্গে আমার মনেরও প্রকাশ হবে।

আঠারো উনিশ বছর সংসারের আয়ু হিসেবে খুব লম্বা না হলেও তোমার সঙ্গে সেই সময়টাই কারও জন্য শত বছরের আয়ুর সমান হতে পারে। কাজেই আমার কাছে মনে হয় না, অল্প কিছু বছরের সংসার করেছি। মনে হয় ফুলতলার ফুলি যেদিন ঠাকুরবাড়ি এল সেদিন থেকে যে সংসার যাত্রা শুরু হলো তার বুঝি শেষ নেই। মহাকালের পথেও তোমার সঙ্গে একরকম সংসারযাত্রা। মর্তজীবনের সবকিছু ছেড়ে এলেও তোমাকে ছাড়তে পারিনি, আরও শক্ত করে তোমার সঙ্গে মরণোত্তর সংসারে আটকা পড়েছি। তবে এই সংসারে তুমি আমার ধর্ম সাক্ষী স্বামী নও, আমার গুরুদেব। গুরুদেবের সমালোচনা হতে পারে না, শুধু তাঁর মনের সঙ্গে আমারও মনের পরিচয় ও সম্পর্ক সূত্রসমূহ খুঁজে দেখা, একদা জমে ওঠা মেঘগুলোর ম্লান রূপের অন্তরে রবির আলো খোঁজা। আলোর হদিস করতে না পারলে সে হয়তো আমারই অক্ষমতা, সে কারণে দীর্ঘশ্বাসের দায়ও আমার। এমন কিছু একান্ত আলাপ ছাড়াও আরও একটি বিষয়ে কথা বলে নিব, তোমাকে কাছ থেকে, শরীর দিয়ে প্রেম ও শ্রদ্ধা দিয়ে একসময় চেনার চেষ্টা করেছি, আজ শতবছর পেরিয়ে মহাকালের চেতনা ও প্রজ্ঞার আলোয় তোমাকে শুধু চেনা নয় উপলব্ধি করতে পারছি। এই তুমি আমার গুরুদেব, আমার মানুষ রবীন্দ্রনাথ। মর্তলোকে কবিতা গান গল্প নাটক উপন্যাস ছাড়াও নানারকম সামাজিক ভাবনা, ধর্ম, দর্শন ও অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে দেখেছি, কিন্তু তা বুঝতে পেরেছি সামান্যই অথবা পারিই নি, আমার মর্তত্যাগ করবার পরে আরও বহু ঘটনা, সাফল্য, সৃষ্টি, কীর্তি, স্বীকৃতি ঘটেছে তোমার জীবনে, সঙ্গে মিত্রের মতো শত্রুও বেড়েছে, প্রশংসার সঙ্গে প্রচুর নিন্দা অপবাদও জুটেছে। ছিল একের পর এক মৃত্যুশোক। হয়তো অনেক কিছুই ধারাবাহিক ভাবে ঘটেছে, যা হয়তো ওভাবেই ঘটে। এ সবের বাইরে তোমার সৃষ্টি বৈভবে যে নতুন একটি মাধ্যমের জোয়ার এল তার কোনো খবর আমার কাছে দুনিয়ায় বসতকালে ছিল না। আর তা হলো চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের ছবি ও জীবন। দেশে বিদেশে তোমার ছবির ব্যাতিক্রমী প্রকাশ, রঙ ব্যবহারে স্বতন্ত্র ভঙ্গি, রূপ নির্মাণে কিছু আনাড়িপনা সত্ত্বেও খুব আলোচনার বিষয় হলো। তোমার এই শিল্পীসত্তা সাহিত্যিক সত্তার পাশাপাশি জোরাল আসন পেয়ে গেল। তোমার সব রচনার সঙ্গে সকল ছবির পাঠেও মনোনিবেশ করতে হলো। অ্যাকাডেমির অনুগত কিছু আলোচক ছবির ভিতর অশিক্ষিত পটুত্বের সমালোচনা করলেও দেখতে পাচ্ছি তার তুলনায় শিল্পীদের বিচারে প্রশংসাসূচক মূল্যায়ন অনেক অনেক বেশি। এইসব আলোচনার মধ্যে একটি ভিন্নরকমের সমালোচনা, বলবো ত্রুটির কথা এল, কেউ কেউ গবেষণাও করল, তোমার রঙ দেখার ক্ষমতা নিয়ে। তোমার একটি কথাকে সাক্ষী মেনে তোমাকে রঙকানা প্রমাণিত করতে ব্যস্ত হলো। লাল আর সবুজ রঙ দেখার ক্ষেত্রে তোমার অক্ষমতা তাদের বিষয় হলো। তোমার রঙ উপলব্ধি আর অন্যের ব্যাখ্যা নিয়ে এই পত্রে কিছু বলার দায়বোধ করলেও এখন সেসব নয়। চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের বিশাল সম্রাজ্য আমার জীবদ্দশাতেই ঘটেছে। অথচ শিল্পী রবীন্দ্রনাথের তখন খবরই ছিল না। শিল্পী পর্বের পূর্ণ বিকাশ আমার মৃত্যুর পরে ঘটে। ফলে শুধু মৃত্যুর পর মহাকালের চৈতন্যে তোমার ছবি বোঝার সুযোগ আমার হয়। সংসারী, প্রায় অশিক্ষিত মৃণালিনীর ছবি দেখা নয়, এ অপরলোকের মৃণালিনী দেবীর উপলব্ধি। যাইহোক, কবির রঙ নিয়ে কথা বলা নয়, এই চিঠির বিষয় হোক তোমাকে পাঠ শেষে অভিজ্ঞতা মিলিয়ে সংসার জীবনের একান্ত কথা উপলব্ধি করা।

তোমার মনের অসহায় অবস্থার কথা অনেক পরে আমার ভাবনায় আসে। তবে সেই অসহায় নিরুপায় দশা কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই অতিক্রম করে গেলে নিজের গ্রহণ ক্ষমতা আর কর্মপ্রয়াসের শক্তিতে। ঠিক ঠিক তারিখ বলতে পারব না, জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে কোনো এক দুপুরের কথা, খুব গরম পড়েছিল। তোমরা দল বেঁধে এলে আমাদের দক্ষিণডিহির ফুলতলা গ্রামে। সময়টা জুন ১৮৮৩, নতুন বউঠান সহ দলে তুমি ছিলে বটে আমি কিন্তু তোমাকে তখন চোখ তুলে দেখিনি, দেখলেও বুঝতে পারতাম কি কে আমার ভাগ্যবিধাতা ? কোন্ সে রাজপুত্র! অল্প পরেই যে এক গ্রাম্য কুমোরের গড়া এবড়ো খেবড়ো কাঁচা মাটির পুতুলকে সোনা মুড়িয়ে ভাষা ও সাহিত্যের বড়ি গিলিয়ে ফুলি ওরফে পদ্ম ওরফে ভবতারিনীকে গড়ে তুলবে মৃণাল মৃণালিনী দেবী রূপে! তখন সত্যিই বুঝতে পারিনি, পরে অন্যদের কথায় আমার ঠাকুরকে চিনে নিতে চেষ্টা করেছি। চিনতে চিনতে শতাব্দী পেরিয়ে গেল। যাক, তোমার মন খারাপ হওয়ার কথাটা বলি, তোমার জাগায় আমি হলে মন খারাপ করে অসহায় অবস্থায় বসে থাকতে পারতাম না, মনের অপছন্দকে আর সকলকে জানিয়ে দিতে দ্বিধা করতাম না। দুঃখে জেদে পা ছড়িয়ে কাঁদতাম, গলায় কলসি বেঁধে জলে ঝাপ দিতাম, তবুও তোমার মতো ক’রে ভালো ছেলেটি সেজে বসে থাকতে পারতাম না। এ কি কাণ্ড বল, বিলাতে প্রায় দুই বছর থেকে এলে ফর্সা, স্কট রমণীর স্মৃতি তখনও খুব তাজা। তোমার রূপ ও সুরে বিলাতবাসী মুগ্ধ, তার আগে সুন্দরী স্মার্ট নব যৌবনা আনা তড়খড়ের মদির প্রেম নিবেদন, নতুন বউঠানের সঙ্গে স্নেহ প্রেম ভালবাসার কথাটা আমি না হয় বাদই দিলাম-সব ভুলে সব ছেড়ে এই গ্রাম্য, ফুলতলা গ্রামের পাঠশালায় যার প্রথম বর্ণ পর্যন্ত বিদ্যার দৌড়, দশ বছর বয়সও হয়নি, যৌবন আসেই নি, দেখতেও ভারি পচা তাকে বধু হিসেবে সঙ্গিনী অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে মেনে নিলে, গ্রহণ করতে হলো ! একুশ বাইশ বছরের সুদর্শন রাজপুরুষ শুধু তুমি নও, তখনই চিরায়ত সাহিত্যের মহাপালে আসন পাওয়ার মতো অনেক সাহিত্য সৃষ্টি ক’রে ভারতের সাহিত্যের প্রধান প্রতিভাবান পুরুষ হয়ে উঠেছো। ভানু সিংহের পদাবলী তো চৌদ্দ পনের বছরেরই লেখা শেষ ! তারপর কবিতা, বাল্মীকি’র মতো গীতিনাট্য সহ কত অমর রচনা, এমনকি ‘সঙ্গীতের ভাব’ নিয়ে সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিতের মতো লেখা শেষ। একটা অশুভ কথা বলি, ফুলতলা গ্রামে পাত্রী দেখার দলে নৌকায় চড়ে যেদিন এলে সেদিন যদি ঝড়ে তোমার সলীল সমাধি হতো, তাহলেও তুমি বাংলা সাহিত্যে ওই সময়ের সৃষ্টি দিয়েই অমর ও প্রধান একজন হয়ে থাকতে। আজও ভানুর পদাবলীর যেমন তুল্য রচনা নেই, তেমন বাল্মীকির মতো নতুন আঙ্গিকের পথিকৃত হয়ে থাকতে, তাহলে বলো গুরুদেব এ তোমার অন্যায় নয় ? এতো বিশাল ওজন আর বিমূর্ত সব রূপ সৃষ্টি নিয়ে পাঠশালার বালিকাকে স্ত্রীর দায়িত্ব পালনের জন্য বাধ্য করানোটা ঠিক কাজ হলো ! বাবা মশাই মহর্ষিদেব শিরোধার্য, তুমি অমত করতে পারলে না, হয়তো কিছু ঠাট্টা রসিকতা করে এই বিয়ে সম্পর্কে তোমার মনোভাব দূর থেকে বোঝাতে চেয়েছো। কে তখন বুঝবে বলে ! পিরালী ঠাকুরদের গোত্র মিল যখন পাত্রীর একমাত্র যোগ্যতা হয় তখন অন্য কিছু কেউ দেখে না। তবু তোমার মন খারাপ হয়েছিল, সে কথা অন্তত ইন্দিরা দেবী তোমার প্রিয় বিবি লিখেছে, পাত্রী দেখার দলে কিশোরী বিবি তখন সুরেন ভাইটিকে নিয়ে সেখানে ছিল। অনেক পরে, বাবা মশাই দুনিয়ায় আর নেই, তখন বিবি অতি সামান্য কথায় লিখেছে, বউঠানদের দল দেখতে ভালো না হলেও মন্দের ভালো জ্ঞান ক’রে আমার প্রতি বলা ভালো তোমাদের কাচারি ঘরের কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীকে কৃতার্থ করে গেলে। তোমার আদরের বিবি ভাইঝি ইন্দিরা দেবী লিখেছেন :

“… যশোর জেলা সেকালে ছিল ঠাকুর বংশের ভবিষ্যৎ গৃহিণীদের প্রধান আকর। কারণ সে দেশে ছিল পিরালী সম্প্রদায়ের কেন্দ্রস্থল। শুনেছি সেখানকার মেয়েদের রূপেরও সুখ্যাতি ছিল, যদিও পুরনো দাসী পাঠিয়ে তাদের পছন্দে নির্বাচন করে আনা হত। পূর্ব-প্রথানুসারে রবিকাকার কনে খুঁজতেও তাঁর বউঠাকুরানীরা, তার মানে মা আর নতুন কাকিমা, জ্যোতিকাকামশায় আর রবিকাকাকে সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যশোর যাত্রা করলেন। বলা বাহুল্য, আমরা দুই ভাইবোনেও সে-যাত্রায় বাদ পড়ি নি। … যদিও এই বউ-পরিচয়ের দলে আমরা থাকতুম না, তা হলেও শুনেছি যে তাঁরা দক্ষিণডিহি চেঙ্গুটিয়া প্রভৃতি আশেপাশের গ্রামে যেখানেই একটু বিবাহযোগ্যা মেয়ের খোঁজ পেতেন সেখানেই সন্ধান করতে যেতেন। কিন্তু বোধ হয় তখন যশোরে সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়েছিল, কারণ এত খোঁজ করেও বউঠাকুরানীরা মনের মতো কনে খুঁজে পেলেন না। আবার নিতান্ত বালিক হলেও তো চলবে না। তাই অবশেষে তাঁর জোড়াসাঁকোর কাছারির একজন কর্মচারী বেণী রায় মশায়ের অপেক্ষাকৃত বয়স্থা কন্যাকেই মনোনীত করলেন। তাঁর বাপের বাড়ির নাম ছিল ভবতারিণী। শ্বশুরবাড়ি এসে তাঁর নাম বদলে মৃণালিনী রাখা হল, বোধ হয় বরের নামের সঙ্গে মিলিয়ে। রূপে না হলেও গুণে তিনি পরবর্তী জীবনে শ্বশুরবাড়ির সকলকে আপন করতে পেরেছিলেন।” (রবীন্দ্রস্মৃতি, পৃষ্ঠা ৫৪)

আমি সত্যিই দেখতে সুন্দর নই, তখন ওই বালিকা বয়সেও নয়, পাঁচ সন্তানের মা হওয়ার পরও না। গোপনে বলি, গ্রামে আমার আরও একটি নাম ছিল-পচা। তাহলেই দেখো, অশিক্ষিত অপ্রাপ্তবয়স্ক গ্রাম্য ছুকরিটাকে নিয়ে আসা হলো ঠাকুর-বাড়ির সবচেয়ে উজ্জ্বল পুরুষটির জন্য। একি আমার ভাগ্য না কি তোমার দুর্ভাগ্য, একেই কি বলে নিয়তি! তোমার ও আমার! এখন বলব এ তোমার ভাগ্যের কথা নয়, ভাগ্য দুর্ভাগ্য নিরপেক্ষ নির্দেশ ও পারিবারিক প্রথা মানতে তোমাদের মতো সকল আধুনিক যুবাপুরুষদের বিশেষ করে তোমাদের পরিবারের নিয়মিত ঘটনা। তোমার দাদীমা, তোমার মা, দাদাদের স্ত্রী এমনকি তোমার প্রধান সহায় নয়াদা জ্যোতিমশায়ের স্ত্রী বাজার সরকার, নিচ শ্রেণীর কর্মচারী শ্যামলালের কন্যা কাদম্বরী দেবী সবার ক্ষেত্রে এই একই কথা। খেয়াল করে দেখো এইসব গুরুজনেরা সকলেই নারী, সকলেই অকাল বয়সে ইহলীলা সঙ্গে করে তোমাদের সাংসারিক বন্ধন থেকে একরকম মুক্তি দিয়ে গেছেন। সবাই তোমাদের ছুটি দিয়েছেন।

তুমি কবি, দূরদ্রষ্টা এই জন্যই কি আমাকে বলতে ছুটি, ভাই ছুটি ? বউকে কেউ ভাই বলে কি স্নেহ করে ! ছোট বউ বলে। ছুটি বলে কেন ডাকলে এই আমি বুঝতে চাই। তবুও কত কথা কাজ জটিলতার ভিড়ে মনে হয় এই ছুটি হয়তো তোমার আকাঙ্খিত ছুটির বাসনা, ছোট থেকে ছুটি নয়। কী করব বলো আমার ভাগ্য এমনই, স্বামী যিনি হলেন তিনি প্রভু, পিতা, বড়দাদা তুল্য, নারীর স্বাভাবিক প্রেম আবেগ নিয়ে সুদর্শন স্বামীর দখল নিতে পারলাম না, তিনি দেশ থেকে বিশ্বদেশের হলেন। বড় থেকে আরও বড়। কিন্তু আমার সোহাগের স্বামীটি কই ? আমার এই বড় কপাল, খুব বড় কপালের কথা বিয়ের সময়ই প্রকৃতি হয়তো ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন। না হলে ওই সময়েই কেন বড়দিদি সৌদামিনির স্বামী ভালো মানুষ মরে গেলেন। তিনি অবশ্যই প্রথা মতো ঘর-জামাই, ঠাকুর বাড়ির অসাধারণ কন্যারা কেন সাধারণদের ঘিরে গিয়ে ঘরকন্না করবেন, সাধারণের কন্যা এসে শিখেটিখে ঠাকুর বাড়ির বউ হবে। যাইহোক, তো বড় জামাই বাবু সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় তখনই মারা গেলেন। আমার দুর্ভাগ্য, জামাইবাবুকে দেখলাম না। এই মানুষটির কথা শুনেছি অনেক, পরে আমিই মহাকালের জ্ঞানজগৎ থেকে অনেক কিছুই জানলাম, বিশেষ করে ঠাকুরবাড়ির অন্দরে যে উচ্চমার্গের সংস্কৃতি প্রবাহ তার সৃষ্টি ও সংগঠনে সারদা বাবুর ভূমিকা অনেক। ১৮৫৬ সালে মহর্ষির বড় কন্যার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর বাড়ির ভিতরে নাট্যশালা স্থাপনের পরিকল্পনা তিনি করেন, ‘কমিটি অব্ ফাইভ’ নামে নাট্যসমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। মজার ব্যাপার তিনি ‘নবনাটক’-এ স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বিয়ের আগেই এই নাট্যমোদী মানুষটির সঙ্গে জ্যোতিদা’র বন্ধুত্ব ছিল। ঠাকুরবাড়ির জীবনযাত্রায় তিনি নানা ধরনের আধুনিকতার প্রবর্তন করেন। সেতার বাজাতেন ভালো, আর এসবের চেয়ে তোমার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনেও তার কিছু ভূমিকা আছে, হয়তো সে-কারণেই আমি এই গুণী মানুষটির প্রতি আগ্রহী হই-তোমার বালক বয়স শেষে মহর্ষি তাকেই চিঠি লিখে তোমার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করতে বলেন। মহর্ষি তাকে খুব বিশ্বাস ও পছন্দ করতেন। আর্থিক বিষয়ে ছেলেদের চেয়ে তার ওপরে তার আস্থা ছিল বেশি। মাসোহারা বরাদ্দ ছাড়াও তোমার ‘ইউরোপ প্রবাসীর পত্র’ গ্রন্থের শুধু প্রকাশকই নন, গ্রন্থের প্র“ফ দেখা সহ মুদ্রকের দায়িত্বও পালন তিনি করেন। এমন একজন মানুষ আমাদের বিয়ের রাত্রেই চির বিদায় নিলেন। দুঃখ আরও একটু হয় যখন দেখি, সারদাবাবুকে একজন কর্মচারী হিসেবে দেখা হতো, ঘরজামাইরা বাজার কর্তা থেকে অনেক ফর্মাস পালন ক’রে যেতেন। বুঝতে পারি না, বাড়ির ছেলে মেয়ের তুল্য মর্যাদা যখন ঘর জামাইদের থাকে না, তখন শিক্ষিত মর্যাদাবান কন্যার জন্য কেন তাহলে কর্মচারী তুল্য ঘরজামাই খুঁজে নিতে ! জামাতার তেমন সম্মান না থাকলে কি কন্যার সম্মান রক্ষা হয়! বউমা প্রতিমার বাবা কত নাম করা অ্যাটর্নি শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়, সেও ছিল ঘরজামাই। তোমাদের মতো বড় ঘরের জন্য রেওয়াজটা বেশ সুবিধার ছিল, অতি সাধারণ দরিদ্র ঘরের নাবালিকাদের ঘরের বউ ক’রে এনে নিজেদের কাজ চালাবার মতো তৈরি করে নেও, নিজেদের গড়া মূর্তিতে যে রূপ ফোটাতে চাও শুধু সেই রূপই ফুটবে, তারপর সেই মেয়েটির জন্মস্থান, মা-বাবা’র সংসারের সঙ্গে শৈশবের খেলার সাথীদের সঙ্গে প্রায়ই আর কোনো যোগ থাকবে না। শিকড় কেটে দামী টবে সাজিয়ে রাখা আর কী, এজন্যই দিগম্বরী দেবী সারদা দেবী কাদম্বরী দেবী থেকে আমি মৃণাল যথাক্রমে তোমার দাদীমা, মা, প্রিয় বউদি ও নিজের বউটি আলগা টবে বেশি দিন প্রাণ ধরে রাখতে পারল না। যাক, আমার বড় ভাগ্যের কথা বলতে যেয়ে কিছু আবেগ প্রকাশ এখানে হয়ে গেল। তবে পত্র লেখকের মনের কিছু পরিচয় তো এখানে মিলল। রূপ না থাকলেও সাংসারিক যে গুণের কথা বিবি লিখলেন তা এই জন্য সত্যি যে আমার হাতের রান্নার গুণ ও সর্বক্ষণের পরিশ্রমের ফলেই গুণের প্রকাশ ঘটেছে। তোমার দিদিদের মতো সাহিত্য সমাজ ও মহিলাদের উন্নতি নিয়ে ভাবনার অখণ্ড অবসর ছিল না। অতিথি এলেই রান্নার সঙ্গে নানাধরনের মিষ্টি তৈরি করতে হতো, আমারও বেশ ভালো লাগত জানো, এত সব বড় বড় মানুষ ভদ্রজনেরা আমার রান্নার সুখ্যাতি করছে ভালো লাগবে না ! এই রান্নার শখ ও সুখ্যাতির মোহ গোপনে আমাকে পেয়ে বসেছিল এর পরিণতিতেই হয়তো চির বিদায়ের রোগ বাঁধালাম।

যাক, তোমার মন খারাপ হওয়ার কথা বলেছিলাম। পাত্রী তোমর পছন্দ হওয়ার কথা নয়, খুব স্বাভাবিক। মাদ্রাজে এক মেয়ে দেখতে গিয়েছিলে। বিশাল জমিদারের জমকালো ঘরে বসে তার কন্যাকে দেখার স্মৃতিচারণ করছিলে মৈত্রেয়ীকে; অবাক লাগে জীবনের শেষ প্রান্তে, ১৩৪৫ সালে ওই মেয়েটির অসহায় অবস্থার কথা না ভেবে অবলীলায় বলছ ‘জড়ভরতের মত এক কোণে বসে রইল মেয়েটি। আচ্ছা বলো তো, ওই নাবালিকা মেয়েটিকে বাবা মা শরীরের তুলনায় বিশাল ও ভারী শাড়ি গহনা পরিয়ে পাত্রী দেখার আসনে এনে বসিয়েছে। মেয়েটির কি কিছু করার ছিল ? মেয়েটি কি সত্যিই জড়ভরত ! নাকি তখন জড়ভরত বানানো হলো ? তোমার পুরুষরা কেন জড়ভরত কন্যা দেখতে যাও ? বাবার আদেশ ! রেওয়াজ ! তাহলে কতরকম আধুনিকতা, অগ্রবর্তী ভাবনা, নাবালিকা বিবাহ বন্ধের কথা বলা শুধু অন্যদের জন্য, আর ঠাকুর বাড়ির আলোকপ্রাপ্ত মানুষ চলতি প্রথার সুবিধা গ্রহণ করে যাবে! নবী ঋষি থেকে সাহিত্যিক শিল্পী দার্শনিকদের ভিড়ে এমন সুবিধা গ্রহণের উদাহরণ প্রচুর। মৈত্রয়ী তোমার খুব ভক্ত ছিলেন, তুমি তাকে খুব স্নেহ করতে। সুন্দরী বিদুষী নারীরা অনেকবার তোমাকে মুগ্ধ করেছে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে শুরুর আনা তড়খড় ভাতিজি ইন্দিরা থেকে ভিক্টোরিয়া হেমন্তবালা মৈত্রেয়ী দেবী পর্যন্ত অনেকে। কিন্তু তোমার প্রধান ভরসা জ্যোতিদা’র মতো তোমাকেও আর অনেকের মতো তেমন জড়ভরত বিয়ে করতে হলো। ওই জড়ভরত মেয়েটির তুলনায় শুদ্ধ ইংরেজি বলা, চটপটে, পিয়ানো বাজানোতে পারদর্শী মা’কেই বেশি পছন্দ করেছিলে। আচ্ছা মৈত্রেয়ীর লেখা থেকে তোমার সরস কথাগুলোই পড়ে দেখা যাক-

“জানো একবার আমার একটি বিদেশী অর্থাৎ অন্য province (? মাদ্রাজ)-এর মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল। সে এক পয়সাওয়ালা লোকের মেয়ে, জমিদার আর কি, বড় গোছের। সাত লক্ষ টাকার উত্তরাধিকারিণী সে। আমরা কয়েকজন গেলুম মেয়ে দেখতে, দুটি অল্পবয়সী মেয়ে এসে বসলেন-একটি নেহাৎ সাদাসিদে, জড়ভরতের মত এক কোণে ব’সে রইল ; আর একটি যেমন সুন্দরী, তেমনি চটপটে। চমৎকার তার স্মার্টনেস্। একটু জড়তা নেই, বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ। পিয়ানো বাজালে ভালো, তারপর music সম্বন্ধে আলোচনা শুরু হ’ল। আমি ভাবলুম এর আর কথা কি ? এখন পেলে হয়!- এমন সময় বাড়ির কর্তা ঘরে ঢুকলেন। বয়েস হয়েছে, কিন্তু সৌখীন লোক। ঢুকেই পরিচয় করিয়ে দিলেন মেয়েদের সঙ্গে-সুন্দরী মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন-‘ Here is my wife’এবং জড়ভরতটিকে দেখিয়ে ‘Here is my daughter’!… আমরা আর ক’রব কি, পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি ক’রে চুপ ক’রেই রইলাম।” (রবি জীবনী ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ১৭৭)

তোমার  স্নেহে ধন্য আর এক নারী সীতা দেবী। অবশ্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সীতা নিজেও একজন সুসাহিত্যিক। তোমার স্মৃতিচারণ করে ওর লেখা “পূণ্যস্মৃতি” বইটি আমার ভালো লেগেছে। সীতা দেবীও পুণ্যস্মৃতিতে তোমার মাদ্রাজে মেয়ে দেখার গল্পটি উল্লেখ করেছেন। মানে জড়ভরত মেয়েটিকে দেখার গল্প বলে অনেককেই আনন্দ দিয়েছ ! সীতা দেবীর স্মৃতিতে অবশ্য আরও দু’-একটি মাত্রা পাওয়া যায়। যেমন, তা হলো মাদ্রাজের জমিদার বাবাটি মেয়েটিকে গছিয়ে দেয়ার জন্য কীরকম ব্যস্ত হয়েছিল তার উল্লেখ আছে, সীতার ‘পুণ্যস্মৃতি’তে আছে এরকম-

“এক মাদ্রাজী জমিদার কিরকম তাঁহাকে কন্যাদান করিবার চেষ্টায় ব্যন্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন, সে গল্প শুনিলাম। গল্প শেষ করিয়া বলিলেন, ‘সে বিয়ে যদি করতুম তা হলে কি আর আজ কাছে দাঁড়াতে পারতে? সাত লাখ টাকা আয়ের জমিদারির মালিক হয়ে, কানে হীরের কুণ্ডল প’রে, মান্দ্রাজে বসে থাকতুম, তা না এখন two ends meet করাতে পারি নে, ব’সে ব’সে কবিতা লিখছি।” (ঐ)

দীর্ঘ জীবনের শেষ অংকে এসে যখন নিজের বিয়ের কথা ওই মৈত্রেয়ীকে বলো তখনো লুকানো অসন্তোষের চাপ কিছু প্রকাশ হয়ে যায়। সেজন্যই হয়তো ভুল করে বলে ফেল, কণে দেখার সেই যাত্রায় তুমি ছিলে না। তোমার হয়ে বাড়ির বউরা সব দেখে এসেছিল। তুমি তো গিয়েছিলে তখন। মৈত্রেয়ীকে বলছো,

“আমার বিয়ের কোনো গল্প নেই। বৌঠানরা যখন বড় বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করলেন, আমি বল্লুম ‘তোমরা যা হয় কর, আমার কোনো মতামত নেই।’ তাঁরাই যশোরেও গিয়েছিলেন, আমি যাইনি।”

‘বৌঠানদের পীড়াপীড়ি’, ‘মতামত নেই’, ‘আমি যাইনি’, এসব হয়তো তোমার স্বভাব ভুলে যাওয়া থেকেও যেমন, তেমন, কিছু মন খারাপ হওয়ার বহিঃপ্রকাশও। তবে আমাকে দেখে যাওয়ার পর তুমি কিছুই বলোনি। হ্যা, না, কিছুই না। কিন্তু মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন সবাই। সেজন্য মহর্ষি তোমাকে চিঠি লিখে মুসৌরীতে ডেকে পাঠালেন। মহর্ষির ৭ সেপ্টেম্বর ১৮৮৩ চিঠির আদেশ মতো তুমি ১৭ সেপ্টেম্বর মুসৌরী যাত্রা করলে। পারিবারিক হিসেবের খাতায় মুসৌরী যাত্রার খরচ তারিখ সহ উল্লেখ আছে। আর তারপর থেকেই শুরু হলো তোমার বিয়ের আয়োজন। মহর্ষিই তোমাকে এই বিয়েতে সম্মত হতে বলেছিলেন। জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে সম্মত করা যে সম্ভব হযেছিল, তার প্রকাশ তিনি মুসৌরীতে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই ৮ আশ্বিন ক্যাশবহিতে রবীন্দ্রবাবুর বিবাহের হিসাব লেখা শুরু হয়।’ সেরেস্তার কর্মচারী অভয়চরণ ঘোষকে ১৭ই আশ্বিন আমাদের বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। মহর্ষির ছোট চিঠিটিতে স্নেহের সঙ্গে অলংঘনীয় নির্দেশ, বাৎসল্যের সঙ্গে শাসনের সুর, এবং আরও কিছু জাদু আছে, এ এড়ানো কঠিন :

প্রাণাধিক রবি,
‘তুমি অবিলম্বে এখানে আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। অনেকদিন পরে তোমাকে দেখিয়া আমার মন অত্যন্ত আনন্দ লাভ করিবে। তুমি সঙ্গে একটা বিছানা এবং একটা কম্বল আনিবে। তুমি এই পত্র জ্যোতিকে দেখাইয়া সরকারি তহবিল হইতে এখানে আসিবার ব্যয় লইবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর রেলগাড়ির Return Ticket লইবে। আমার স্নেহ ও আশীর্বাদ গ্রহণ কর।’ ইতি ২২ ভাদ্র ৫৪ [ব্রাহ্মসংবৎ, ১২৯০]

শ্রীদেবেন্দ্রনাথ শর্ম্মণঃ
মসুরী
-মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। (রবি জীবনী ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ১৯৫-৯৬)

তোমাকে তিনি ‘প্রাণাধিক’ বলছেন, প্রাণাধিক রবিকে দেখে মহর্ষির মতো বিশাল মহৎ, কঠিন মানুষটির মনও অত্যন্ত আনন্দে ভরে যাবে। আমার সংসার জীবনের উনিশটি বছরেই তাঁকে দেখেছি। তাঁর মতো মানুষের কাছ থেকে এমন চিঠি পেলে মন ভরে যায়। নির্দেশ আর নির্দেশ না থেকে অবশ্য পালনীয় আইন হয়ে ওঠে। তোমাদের পরিবারেও তাই ছিল, ছিল বলে সব কিছুর ভিতর একটা শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ ছিল। যুগের চলতি হাওয়া থেকে তোমরা দূরে সরে যেতে চাইলেও পার না, ঐতিহ্য, পারিবারিক প্রথা ও সংস্কারের দাবি ঘোড়ার পিঠে চড়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খাওয়া নারীরা মিটিয়েছে মাত্র, পুরুষরাও। কেননা মহর্ষির শাসনের বাইরে কিছু ঘটাতে পারে না। বাহিরমুখী, বলা যায় ইয়োরোপমুখী তোমাদের মনের গতিকে ভারতীয় শিকলে আলগা গিঁঠে হলেও তিনি বেঁধে রেখেছিলেন। পিয়ানোতে হিন্দুস্থানী রাগ বাজিয়ে ভারতের আধুনিক নাটকের জ্যোতিদাকে কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তে তোমার মতো কর্মচারীর অশিক্ষিত অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকেই বিয়ে করতে হয়। বিলাত ফেরত ডাক্তার বাবুর সুশিক্ষিত ইংরেজি জানা মেয়েকে নয়, সেই মেয়ে বিলাত ফেরত বউদি জ্ঞানদা ইচ্ছে করলেও নয়। ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের সমন্বয় পথে মহর্ষি যে যাত্রা শুরু করেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সেই যাত্রার গতি তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুব সহজে বেগ পেতে শুরু করলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে মহর্ষিকেই উদ্যোগী হতে হয়। নিজে একদা উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণের প্রতীক পৈতা জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, ব্রাহ্ম্য সমাজ প্রাচীন হিন্দু সমাজের অনেক ধর্মীয় সংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস নেয়, তিনি তাদের একজন নেতা ছিলেন, আগে ছিলেন রাজা রাম মোহন। কিন্তু মহর্ষি শেষ পর্যন্ত মুক্ত হওয়ার দৌড়ে খুব এগোতে চাইলেন না। ফলে প্রবল সংস্কারমুখীদের সঙ্গে বিভেদ ও ব্রাহ্ম্য সমাজের বিভক্তির ইতিহাস তৈরি হলো। মহর্ষির ব্রাহ্ম্য সমাজ আদি ব্রাহ্ম্য বা হিন্দু ব্রাহ্ম্য সমাজ বলে পরিচিত হলো। এ আমি কেন বলছি, তোমাকে এ কথা লেখা মানে পুরনো কথা–মায়ের কাছে মাসির গল্প করা। কিন্তু এ পাঠ যে আমার জন্য জরুরি। তোমাকে বোঝার পথে ইতিহাসের এই পটভূমি আমাকে বুঝে নিতে হয়েছে। বিশেষ করে যখন দেখি তুমিই পিতার বিশেষ অনুগত ছিলে, তাঁর শাসন মান্য করে চলেছ অন্তত তিনি যতিদিন বেঁচে ছিলেন, এবং তোমার মন তৈরিতে তাঁর ভূমিকাকে উপেক্ষা করা যায় না কখনো। বড় পণ্ডিত, গবেষক সুকুমার সেনও যখন ‘পরিজন-পরিবেশে রবীন্দ্র-বিকাশ’ গ্রন্থে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬২, পৃষ্ঠা ১০-১১) মন্তব্য করেন, ‘দেবেন্দ্রনাথের ধর্মীয় আদর্শের প্রতিফলন রবীন্দ্রনাথে যতোটা গভীরভাবে পড়েছিলো, পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর ততটা পড়েনি’ তখন আমিও আমার মতের পক্ষে সমর্থন পেয়ে যাই। তবে একথা সত্য তুমি জীবনের শেষ পর্যন্ত নানা কাজ ও ভাবনায় ওই প্রভাবের গণ্ডি অতিক্রম করার চেষ্টা করে গেছ। একটা ঘটনা স্মরণ করি, ঘটনাটা অমিতাভ চৌধুরী (একত্রে রবীন্দ্রনাথ) পরে চিত্রাদেব (ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহল) উল্লেখ করেছেন, তোমার ৪র্থ দাদা বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে বলেন্দ্রনাথের মাত্র ২৯ বছর বয়সে মৃত্যু হলে তার তরুণী বিধবা সাহানা দেবীর বিবাহের আয়োজন হয়। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহরীতি প্রচলনের তখন মধ্যযুগ। সাহানা দেবী চলে গেছেন পিতার গৃহে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হয়েও বিধবা বিবাহের পক্ষে কখনো কথা বলেননি তা নয়, বিপক্ষেই ছিলেন। আর তখন তো তিনি পরিচিত হিন্দু ব্রাহ্ম হিসেবে। তাঁর পক্ষে বিধবা বিয়ে মেনে নেয়া অসম্ভব। হাজার হোক ঠাকুর বাড়ির বিধবা, তার সম্মান নেই ! মহর্ষি বড়ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথকে বললেন এই বিয়ে যাতে না হয় তার ব্যবস্থা নিতে। হিন্দুমেলার পৃষ্টপোষক হলেও সংস্কৃতিবান দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ অপারগ হলেন পিতার এই অমানবিক নির্দেশ মান্য করতে। আই সি এস সত্যেন্দ্রনাথের পক্ষে তো সম্ভবই নয়। তিনি এই বিয়ের ঘোর সমর্থক, উপরন্তু তিনি তখন নারীবাদী হয়ে উঠেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও পিতার ইচ্ছ পূরণে অসমর্থ হলেন, কারণ তিনিও চান তরুণী সাহানা দেবী অকাল বৈধব্যের অভিশাপ মুক্ত প্রাণভরপুর সংসারে ফিরে আসুক। তখন মহর্ষি ডাকলেন কনিষ্ঠপুত্র রবিকে, মানে তোমাকে। মহর্ষির আদেশ যেভাবেই হোক এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে। তুমি পিতার আদেশ শিরোধার্য করে সাহানা দেবীর পিত্রালয়ে গিয়ে বিয়ে বন্ধের ব্যবস্থা করে ঠাকুরবাড়ির কিশোরী বিধবা সুন্দরী সাহানা দেবীকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরিয়ে আনলে। এলাহাবাদ যেদিন গেলে সেই ৩১ অক্টোবর ১৯০০ সন, সেদিনই সাহানার মা পরিবারবর্গকে বুঝিয়ে, সাহানাকে বুঝিয়ে কলকাতায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে ফেলে। পরের দিন এলাহাবাদ থেকে আমাকে লেখা এক চিঠিতে বিনা বাধায় সাহানাকে জোড়াসাঁকোয় ফিরিয়ে আনতে পেরেছ বলে একরকম স্বস্তি প্রকাশ করে এক চিঠিতে অকাল বৈধব্যের অনিশ্চিত জীবনে ১৬/১৭ বছরের সাহানাকে ঠেলে দেয়ায় তোমার ভূমিকার জন্য কোনো অনুশোচনা করলে না। তুমি লিখছ-

‘আজ এলাহাবাদে এসে পৌঁছেছি। সুসি (সাহানা) এবং মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সুসি যেতে রাজি হয়েছে, তার মা’ও সম্মতি দিয়েছেন। কলকাতা হয়ে শিলাইদহ যাওয়াই স্থির হলো। যেরকম বাধা পাব মনে করেছিলুম তার কিছুই নয়। ভালো করে বুঝিয়ে বলতেই উভয়েই রাজি হল।” (চিঠিপত্র প্রথম খণ্ড)

এই তুমি পরে মহর্ষির মৃত্যুর অল্প পরেই নিজের একমাত্র ছেলে আমার রথীর বিয়ে দিলে বিধবার সঙ্গে। অমিতাভ বাবু কথিত ‘মানসিক দ্বন্দ্বে জীর্ণ’ দশা থেকেই হোক অথবা রথীর জন্য আমার পছন্দের প্রতিমাকে আমার মৃত্যুর পর শোক ও একরকম অনুশোচনায় ক্ষত মনে ঘরের বউমা করে আনলে সে আলোচনার প্রয়োজন নেই। বলার কথা তো ওই, মহর্ষির আদেশ তুমি মান্য করেছ, তা খুব প্রশংসাযোগ্য না হলেও। বাবা তাঁর মৃত্যুর পর নিজের ছেলেকে বিয়ে দিয়েছ বিধবার সঙ্গে, তা যে কারণেই হোক, সেই বিধবা মেয়েটি তোমাদের ৫ নম্বর বাড়ির ঠাকুরদের হোক, তোমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হোক তাতে তোমার কাজের কোনো তারতম্য ঘটে না। এই সাহানাদেবী নিয়ে ইতিহাস কিন্তু এখানেই শেষ হলো না। তোমার বিধবা বউদি সাহানা দেবীর শাশুড়ি মা প্রফুল্লময়ী তোমাদের সহযোগিতায় সাহানাকে স্কুলে পড়ালেন, এমনকি টিচার্স ট্রেনিং নেবার জন্য বিলেতেও পাঠিয়ে ছিলেন, সেই সাহানা যখন চিঠি লিখে শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞান শিক্ষার আগ্রহের কথা তোমাকে জানিয়েছিলেন, তুমি তার কী উত্তর করলে! এই উত্তর লিখবার সময় কিন্তু মহর্ষি বেঁচে নেই তবে হয়তো তোমার মনে তাঁর স্মৃতি অন্তত সাহানা বিষয়ে তখনো কাজ করছে ! চিত্রাদেব ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের (পৃষ্ঠা ১৪৬) অন্দরে উদ্ধৃত তোমার লেখা চিঠি ২৫-এর থেকে পড়ি :

“আমাদের বিদ্যালয়ে Science পড়াইবার সুবিধা আছে বটে কিন্তু Laboratory -তে তোমাকে শিক্ষা দিতে গেলে সকলের সামনে তোমাকে বাহির হইতে হইবে। সে কি সম্ভব হইবে। এ-কথার অর্থ বুঝতে রীতিমত কষ্ট হয়। ”

কষ্ট হয় চিত্রা দেবের কিন্তু মহাকালের চির যাত্রায় কষ্ট নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক মনে আমি বুঝতে চাই অন্যভাবে, আমার অভিজ্ঞতা হয়তো তার সঙ্গে মিশে আছে। সাহানা যখন শান্তি নিকেতনের ছাত্র হবে তখন সে কিন্তু শুধু ছাত্র পরিচয়ে নয়, তার পরিচয় ঠাকুর বাড়ির বিধবা রূপে। এই সেই বিধবা, যার বাবা মা বিধবা বিবাহের আইন পাস ও সামাজিক সংস্কারের যুগে অকাল বৈধব্যের অভিশাপ মুক্ত করতে আবার বিয়ের আয়োজন করেছিলেন তা থেকে সাহানাকে চির বৈধব্যের বেশে ঠাকুর বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লোকে এই কথা মনে করবে তাকে দেখলে। ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা বাইরে গিয়েছে, কিন্তু তোমার মেয়েরা নয়, ঘরে গৃহ শিক্ষকের অধীনে তাদের পাঠের ব্যবস্থা হয়েছে। তার আগে মহর্ষির আদেশে নাবালিকা আমিও গৃহ শিক্ষার সকল আয়োজনে প্রবেশ করি, এমনকি লরেটোতে পর্যন্ত। লরেটোতে আমি অন্যদের মতো ক্লাস রুমের শিক্ষা পাইনি, আমার জন্য মহর্ষির ব্যবস্থা মতো আলাদা, মানে প্রাইভেট ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখন সাহানাকে কীভাবে তুমি আর সবার সঙ্গে বসাতে পার ! শান্তিনিকেতন তো তোমার সংসারের মতো তোমারই প্রতিষ্ঠান, মহর্ষির প্রতিষ্ঠিত যখন। তবে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ, মহর্ষির বিশেষ একটা উৎসাহ, আগ্রহ তোমার জীবনে বড় প্রেরণা হয়ে কাজ করেছে, সেটা হলো তোমার সঙ্গীত। এই সঙ্গীত আপামর শিক্ষিত বাঙালির মনে তোমার আসন চিরস্থায়ী শুধু নয়, সকল মুহূর্তের জন্যে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মানবীয় আবেগঘন সময়ে তুমিই স্মরিত, অনেক মানুষ ঈশ্বর নয় তোমার চরণ মনে হৃদয়ে পাঠ করে মৃত্যুর আগে, কেউ কেউ মৃত্যুর পর হরিনাম নয়, পবিত্র আয়াত শ্লোক নয় তোমার গান চলবে শুধু আর কিছু নয়। এতেই মৃত মানুষটির আত্মা শান্তি পাবে, আত্মা বা আত্মার শান্তির কথা আমি মরে যেয়েও জানি না, কিন্তু প্রাণময় মানুষটির অন্তিম ইচ্ছাই বড় কথা। তোমার চিরজীবী গানের কথাই বলছি। কথা সুর রচনায় তুমি ছোটবেলা থেকেই বড় হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। গান বিষয়ে ভাবনা নিয়ে গদ্য লিখেছ কুঁড়ি বছর বয়সেই। হয়তো সেই গদ্যের অনেক অনেক মত তুমি পরিণত শিল্পী বয়সে পোষণ করতে না, তবুও ‘সঙ্গীত ও ভাব’ নিয়ে তোমার গদ্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। তো এই সঙ্গীত সাধনায় মহর্ষির প্রেরণা চারা গাছে জল ও রোদের ভূমিকা পালন করে চিরকালের সুনিবিড় শান্তির বৃক্ষ গড়ে তোলে।

তোমার বিয়ে হয়েছে তখন, প্রিয় বউঠান অনন্ত শোকে ভাসিয়ে চলে গেছেন, প্রথম সন্তান মাধুরীলতার বাবা হয়েছ, মানে তুমি কিশোর প্রতিভাবান নও, রীতিমতো সাহিত্যিক যশ, সঙ্গীত যশসহ পূর্ণ যুবক-সেই ১৯৮৭ সনের কথা। জীবনস্মৃতিতে ঘটনাটা উল্লেখ আছে, তোমার কথাটাই পড়ি –

‘‘একদিন আমার রচিত দুটি পারমার্থিক’ কবিতা শ্রীকান্তবাবুর নিকট শুনিয়া পিতৃদেব হাসিয়াছিলেন। তাহার পরে বড়ো বয়সে আর-একদিন আমি তাহার শোধ লইতে পারিয়াছিলাম। …‘একবার মাঘোৎসবের সকালে ও বিকালে আমি অনেকগুলি গান তৈরি করিয়াছিলাম। তাহার মধ্যে একটা গান-‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে।’ ‘পিতা তখন চুঁচুড়ায় ছিলেন। সেখানে আমার এবং জ্যোতিদাদার ডাক পড়িল। হারমোনিয়মে জ্যোতিদাকে বসাইয়া আমাকে তিনি নূতন গান সব-কটি একে একে গাহিতে বলিলেন। কোনো কোনো গান দুবারও গাহিতে হইল। ‘গান গাওয়া যখন শেষ হইল তখন তিনি বলিলেন, ‘দেশের রাজা যদি দেশের ভাষা জানিত ও সাহিত্যের আদর বুঝিত, তবে কবিকে তো তাহারা পুরস্কার দিত। রাজার দিক হইতে যখন তাহার কোনো সম্ভাবনা নাই তখন আমাকেই সে-কাজ করিতে হইবে।’ এই বলিয়া তিনি একখানি পাঁচ-শ টাকার চেক আমার হাতে দিলেন।”(জীবনস্মৃতি)

‘বাঙ্গাল বেঙ্ক’-এর এই চেক মহির্ষির হিসাবের ক্যাশবহিতে লিপিবদ্ধ হয় ৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৭।’ মহর্ষির ছেলেমেয়েদের কৃর্তী যশ প্রচুর। কিন্তু তিনি আর কোনো সন্তানের জন্যই এমন পুরস্কার আর উচ্ছাস প্রকাশ করেন নি। তিনি ছিলেন সঙ্গীত প্রেমী, কিছু সঙ্গীত নিজে রচনাও করেছেন। জগত জীবন সম্পর্কে অন্বেষণ করেছেন আজীবন, হয়তো এই প্রজ্ঞা থেকেই তিনি তোমাকে চিনে নিয়েছিলেন।

বিয়ের আগে সাহানা দেবীর নাম ছিল সুশীলতা। সুশীলতাকে কেন সাহানা হতে হলো ! পুরাতন সবকিছু, বন্ধু, আত্মীয়, নিজের বিচরণের ভূমি, খেলার জগৎ নাবালিকার স্মৃতি থেকে মুছে তোমাদের কাজ চালাবার মতো গড়ে নিতে ব’লে নতুন একটা নামও প্রয়োজন। সেই নতুন নামই হবে আসল নাম। এই নামের কোনো পূর্ব স্মৃতি নেই, থাকতে পারে না। আমারও নাম ছিল, ফুলতলী গ্রামের ফুলি, ভবতারিনী। বন্ধু আত্মীয় কেউ কেউ বলত পচা, আর বাবা মা সহ বেশী জনেই ডাকতো পদ্ম নামে। ফুলতলীর ফুল পদ্ম ! পদ্মকে তুমি মৃণালিনী দেবী করলে। পদ্মকে মৃণাল বানানোর কেন প্রয়োজন হলো ! তোমরা সঙ্গীত পরিবার, সুশীলতাকে রাগিনীর নামে সাহানা রাখলে। ফার্সি এই শব্দটির অর্থ দুটি, রাগিনীর নাম ছাড়াও রাজকীয় খাবার ও জাকজমকপূর্ণ পোশাক অর্থেও সাহানা ব্যবহৃত হয় পারস্যে। সেজন্য হয়তো ভারতে মুসলমান পরিবার নামটি রাখবার চল থাকলেও বাঙালি হিন্দু পরিবারে এই নাম তেমন রাখার চল নেই। তবে তোমাদের পরিবারে বিশেষ করে তোমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ বাবু তাঁর ভাগিনেয়ীর নামও ছিল সাহানা দেবী। সাহানা খুব ভালো তোমার গান করতেন। তুমি তাঁর গানে মুদ্ধ ছিলে। সেজন্য ব্রাহ্ম সমাজের বেতনভূক হলেও অত্যন্ত সুগায়ক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠিয়েছিলে সাহানাকে গান শেখাতে। ও এক সঙ্গে দেড়শ পর্যন্ত গান না থেমে গাইতে পারতো বলে পরে জেনেছি। আমার শোনার ভাগ্য দুনিয়ায় থাকতে হলো না। সঙ্গীতশিল্পী সাহানার যদি তোমাদের পরিবারে বিয়ে হতো তাহলে তার কী নাম রাখতে ! যাক, আমাদের বলেন্দ্রের বিধবা বউ সাহানা দেবী থেকে শিল্পী সাহানা অনেক ছোট। শিল্পীর জন্ম ১৮৯৭-তে, বউমা’র জন্ম ১৮৮৩-তে। সাহানা প্রসঙ্গেই আর একটি কথা মনে হলো। সাহানাকে বাবার বাড়ি এলাহাবাদ থেকে বৈধব্যবেশে নিয়ে এসেছিলে ৩১ অক্টবর ১৯০০ সালে। ওর শাশুড়ি তোমার বউদি প্রফুল্লময়ী জীবনের এক পর্যায়ে জোড়াসাকো ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন সাহানাকে নিয়ে, সাহানার জীবনে শেষ পরিণতি কি হয়েছিল তা তোমরা খোঁজ রেখেছো ! শাশুড়ির মৃত্যুর পর তিনি কোথায় ছিলেন, কতদিন বেঁচে ছিলেন, তোমার গবেষকদের দলিলে তাঁর খোঁজ নেই। প্রফুল্লময়ীর সঙ্গেও কিছু অসম আচরণ করেছ একথা এখন নিশ্চিত করে বলতে পারি। তোমার দাদা বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের আগেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছিলেন, সেটা জেনেও প্রফুল্লময়ীর সঙ্গে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় এই ভেবে যে পাগলামি ভালো হয়ে যেতে পারে। পাগলামি ভালো হওয়া দূরের কথা বিয়ের দুই বছর পর থেকে খুবই খারাপ অবস্থায় কেটেছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ছেলে বলেন্দ্রনাথ মাত্র ২৯ বছরে মারা গেলে মহর্ষির উইলের শর্ত মোতাবেক অপুত্রক ছেলে বীরেন্দ্রনাথ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। তবে ১০০ টাকা ক’রে মাসোহারা বরাদ্দ ছিল। অন্যদিকে অপুত্রক জ্যোতিদা পেতেন ১২৫০ টাকা। এ কেমন বিচার হলো প্রফুল্লময়ী বউদি বা তোমার নবৌঠান কিন্তু এ নিয়ে তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, শান্তি বিঘœত হয়েছে তোমাদের তার কিছু কাজে। কিন্তু তার প্রতি সুবিচার হয়নি একথা তোমার মনেও এলো না, কারণ, মহর্ষির সিদ্ধান্ত যে সঠিক এর বাইরে তোমার ভাবনা প্রসারিত হতো না, অন্তত বাবা মশায়ের জীবদ্দশায়। তখন তুমি আমাকে এক চিঠিতে নবৌঠানের কথা লিখেছিলে। এখন বলতে দ্বিধা নেই, তোমার সে বক্তব্যে আমি খুশি হতে পারিনি। সম্পত্তির স্বার্থ নিয়ে মামলা মহর্ষিসহ তোমাদের পরিবারের অনেকেই করেছেন, অনেক পরে আমার রথীর সঙ্গে তোমার একদা প্রিয় দিনুঠাকুর (দ্বীজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে দীপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র ছেলে) অর্থকড়ি নিয়ে অশান্তি করে শান্তিনিকেতন ছেড়ে (১৯৩৪) কলকাতায় চলে আসে। দিনুঠাকুর ছিল তোমার গানের ভাণ্ডারী, স্বরলিপিকার, বিশেষ ভরসার পাত্র। নবৌঠানও অসম ব্যবহার পেয়ে বিব্রত ছিলেন। তুমি লিখেছিলে –

‘‘… নবোঠানের এক ছেলে সংসারের একমাত্র বন্ধন নষ্ট হয়েছে তবু তিনি টাকাকড়ি কেনাবেচা নিয়ে দিনরাত্রি যে রকম ব্যাপৃত হয়ে আছেন তাই দেখে সকলেই আশ্চর্য্য এবং বিরক্ত হয়ে গেছে-কিন্তু আমি মনুষ্যচরিত্রের বৈচিত্র্য আলোচনা করে সেটা শান্তভাবে গ্রহণ করতে চেষ্টা করচি-এক একমসয় ধিক্কার হয় কিন্তু সেটা আমি কাটিয়ে উঠতে চাই। আমাদের বাইরে কে কি রকম ব্যবহার করচে সেটাকে নির্লিপ্তভাবে সুদূরভাবে দেখতে চেষ্টা করা উচিত। … ” (পত্র সংখ্যা ১৭, চিঠিপত্র ১ম খণ্ড)

রাগিনীর নাম হোক, রাজকীয় ব্যপার হোক দুই হয়তো সাহানাকে মানায়। পদ্মকে বর্জন করে মৃণাল নামের প্রয়োজন শুধু পদ্মের সঙ্গে মিল রাখার জন্য নয় বলেই মনে হয়। পদ্ম শব্দ উচ্চারণের সময় আমাদের মানস পটে ভেসে ওঠে পরিস্ফুটিত ভাসমান উজ্জ্বল পদ্মের রূপ। মৃণাল উচ্চারণে তা মোটেও নয়, বরং কাব্যিক মায়া জড়ানো শব্দটিতে পদ্মলতার ভাবটিই মনে হতে পারে, পরিস্ফুটিত পদ্ম নয়। কে জানে হয়তো এই তোমার অভিপ্রায়। স্বামী সংসার সন্তান এবং সংসারের সকল ভাবনায় আমি জড়িত থাকব, সেখানেই হবে মৃণালের সার্থক পরিস্ফুটন। যদিও মৃণাল মানেও পদ্ম।

সত্যিই, তখন তোমাদের ইচ্ছা, তোমাদের অভিপ্রায় মতো চলা ছাড়া আমার আর করণীয় ছিল না, ভাবনাতেও অন্য কিছু আসতে পারেনি। দরকার বা কি ! বুদ্ধি, বয়স, অভিজ্ঞতা ও বিবেচনা শক্তিতে তুমি কত বড়, বিশাল একজন মানুষ, যদিও বয়স কেবল এক কুড়ি অতিক্রম করেছ, বরাদ্দ আয়ুর চার ভাগের এক মাত্র কাটিয়ে ২য় কুড়ির পথে পা পড়েছে, এরই মধ্যে সেই পায়ের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বুদ্ধিমান লোকদের জানা হয়ে গেছে। বঙ্কিম বাবুর সঙ্গে কলম বাহাসে ভীত নও, মাইকেলকে কড়া সমালোচনা শেষ বালক বয়সেই। অন্যদিকে কালিদাসে মুগ্ধ, বৈষ্ণব কবিদের গীতলতা প্রেম ও ভাব দর্শনের মধ্যে নিজের কবি সত্তার সুর মিলিয়ে দিচ্ছ সহজেই। সবকিছুতেই আছে পাকা মুন্সিয়ানা। তো পদ্মকে মৃণাল নামের মোড়কে গড়ে তোলার দায়িত্ব তুমি নিতেই পার গুরুর মতো করে। মজার ব্যাপার হলো তোমার জীবনীকারগণ মৃণালিনী নামের উৎস নিয়ে বেশ কিছু সময় ব্যস্ত গবেষণা করেছেন। প্রধান দুই জীবনীকার দুইরকম অনুমান করছেন, গবেষণার ফল অনুমান নির্ভর, ঠিক প্রমাণিত সত্যে বাধা নয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ভাবছেন, ‘মনে হয় এই মৃণালিনী নাম রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া, তাঁহার অতিপ্রিয় ‘নলিনী’ নামেরই প্রতিশব্দ।’ আর প্রশান্তকুমার পালের ধারণা, ‘যৌতুক কি কৌতুক’ কাব্যে দ্বিজেন্দ্রনাথ ‘অনিন্দিতা স্বর্ণ-মৃণালিনী হোক্’ বলে যে আশীর্বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তারই সূত্রে এই নাম-পরিবর্তন।

গবেষকরা এর বাইরে এসে খোঁজ করছেন না, কেন পদ্মকে মৃণালিনী নাম দিতে হবে! বড় বাড়ির এইসব ছোট রেওয়াজ নিয়ে কেউ ভাবে না, আমি খুব ছোট বলে ছোট বিষয় মাথায় এল, কিছু মনে কর না। তোমার বিয়ের যিনি ঘটকালি করেছিলেন, তিনিও যশোহরের মেয়ে সারদা দেবীর পিসি আদ্যা সুন্দরী। তাঁকে আর ইহ জীবনে দেখতে পাইনি তোমাদের এই কোলকাতা শহরের বড় বাড়িতে আসবার পর। তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে খারাপ লেগেছিল। তখন মাসিক ১২ টাকা বেতনের জমিদারি শেরেস্তার কর্মচারী আমার বাবাকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলাম তাঁর খোঁজ করতে। উনিই তো তোমার মতো রাজপুত্রের ঘরের জন্য ঘটকালি করেছেন। তবে তিনি পদ্ম বা ভবতারিনীর বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন, মৃণালকে তিনি কি চিনতেন ! আমি, এই মৃণাল তাঁর অচেনা। বাবাকে তবুও লিখেছিলাম,-‘আদু দিদির অবস্থা শুনে বড় দুঃখিত হলুম, তিনি কেমন আছেন লিখবেন। তিনি মরবার আগে তাঁকে একবার দেখতে পেলুম না সেইটি ভারি দুঃখের বিষয়-আপনার যতটা সাধ্য তাঁর সেবা করবেন, তিনি আপনেদের অনেক করেছেন …’ । আচ্ছা, দেখো আমি বাবাকে বলছি-‘আপনাদের অনেক করেছেন ! হয়তো কিছু ভেবে লিখিনি, আমার কি উপকার কেেরনি-এমন একটি অসাধারণ বিয়ে ঘটিয়ে ! নিশ্চয়ই করেছেন। তবু অবচেতন কখনো সচেতন মনের খোঁজ না রেখে গোপন কোনো কুঠুরির অব্যক্ত কথা প্রকাশ করে ফেলে। খুব বড় ঘরে অসম ছোটঘরের মেয়ে এসে অনেক জৌলুশ শান শওকতে থাকতে পারে হয়তো, কিন্তু মনে কি খুব শান্তি সুখ থাকে ! নিজেকে খুব ছোট, কাতর, করুণাযোগ্য মনে হতে পারে তো। তা প্রকাশের সুযোগ না থাকলেও অবচেতনে তার আঁচর কাটার ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। কন্যাদায়গ্রস্ত নি¤œপদস্থ পিতা বড় ঘরে মেয়ে পাঠিয়ে নিজের মনে শান্তি ও বৈষয়িক প্রাপ্তির যোগ ঘটাতে পারে। রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর মশায়ের সে-রকম প্রাপ্তি হয়েছিল নিশ্চয়। এজন্যই হয়তো লিখে ফেলেছিলাম বাবার অনেক উপকার হওয়ার কথা।

আমার অশান্তি ছিল এ-কথা মোটেই নয়, সে-কথা বলতেও চাইনি, অনেক বড় লেখক, বড় মানুষ রবীন্দ্রনাথকে হয়তো তখন স্বাভাবিক ভাবেই দূরের ভেবেছি, কিন্তু স্বামীর শরীর ও জৈবিক উপস্থিতি আমার চারপাশে ও অস্তিত্ব জুড়ে ছিল, বড় সুখের ছিল, স্বপ্নেও এতো সুখ কেউ হয়তো ভাবতে পারে না। বউ হিসেবে, গৃহিনী হিসেবে আমি সত্যিই সুখী ছিলাম। তোমাদের কারণে যখন কিছু পড়া লেখা হলো, তখন হয়তো মনে নিজেকে শুধু বউ ছাড়াও অন্য বোধের সৃষ্টি হওয়ায় ব্যক্তি সত্তার অহংকার গোপনে হলেও তৈরি হয়েছিল। তোমার বিয়ের স্মৃতি, ঘটনা কতজন লিখেছেন। আত্মীয় বন্ধু থেকে গবেষকরা। সেই সব পড়ে কত কিছুই জানলাম। তোমার বিয়ে তো আমারও বিয়ে ছিল ! আশ্চর্য ! মনে হয় এমন কারো বিয়ের কথা পড়ছি, যে বিয়ের যেন অন্যপক্ষ নেই। বর থাকলে বধূর খবর হয়ই। কিন্তু তোমার বিয়েতে মনে হয় বধু ছিল না। তোমার পোশাক, বরযাত্রা, সম্প্রদান, দুষ্টমি, রহস্যময় কথা ইত্যাদির ভিড়ে বউটিকে খুঁজে নিতে হয়। তাই হয়তো তোমার বিয়ের গল্প যে আমার বিয়েরও গল্প তা মনে হয় না। আমি কখনো চোখ বন্ধ করে নিজেকে কল্পনা করে নেই, ওই আসরে আমিও ছিলাম। বহু গয়না, ভারী শাড়ির ভিতর শ্যামলা শুকনা ভিতু বিমূঢ় এক বালিকা জড়ভরত হয়ে বসে ছিল। বিয়ের এই আয়োজনে কখন কী ঘটবে কী ঘটছে কিছুই অনুমান করতে পারছিলাম না। শুধু আদেশ মতো চলেছি, চলার অর্থ গতি ও গন্তব্য বুঝিনি, শেষ জীবন পর্যন্ত কি বুঝেছি ?

তোমার সঙ্গে কতবার কত জাগায় সংসার পাতলাম, এর পেছনে আমার ইচ্ছা আগ্রহ ভালো লাগার বিষয়টি কখনো জড়িত ছিল না। বাবার পত্রাদেশে তুমি যেমন জমিদারি দেখাশুনার জন্য বিনা বাক্যে চলে যাও, আমিও তোমার আদেশানুগত দাসী, অচেনা ঠিকানায় অজানা দিনের জন্য চলেছি তোমার সঙ্গে। প্রায় ১৯ বছরের সংসারে সাত-আটবার শুধু শান্তিনিকেতনে গিয়েই সংসার গোছাবার চেষ্টা করেছি। শিলাইদহ ও গাজীপুর কয়েকবার, এবং এর সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাড়ি, জ্ঞানদা বউদির বাড়ি থাকা। আমার বয়স কতটুকু বলো, নতুন নতুন জায়গা মানুষ চিনে বুঝে উঠতে উঠতে বিদায় নেওয়া। যেমন আমার শরীর ঠিক আমার করে বুঝে ওঠার আগেই অন্তসত্ত্বা হয়ে পড়ে। মাত্র ১১ বৎসর ৮ মাস বয়সে বেলা আমার পেটে আসে। সাড়ে ১২ বছর বয়সে মা হই; তারপর মোট পাঁচ ছেলেমেয়ের মা হতে হলো আট বছরের মধ্যে। একদিকে ঘনঘন জায়গা বদল অন্যদিকে শরীরের নাজুক অবস্থা। এর মধ্যে কত রকম রান্নার আব্দার, মিষ্টি বানানোর সঙ্গে তোমার সব বিখ্যাত অতিথিদের আতিথেয়তা ! ঠিক সময় করে নিজেকে ভাববার, তোমার জগৎজোড়া প্রশংসাধন্য সৃষ্টিসম্ভার পড়ে উঠবার সময় হলো না। মৃত্যুর পর পরকালের অনন্ত অবসরে আমার নিজের দিকে তাকাবার সুযোগ যেমন এল, তেমন তোমার সৃষ্টির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় হলো। দুনিয়ার বুকে এই সময় আমার কখনো হতো না, হয়ও না।

পেছন দেখার অবসরে আমার আশ্চর্য বিয়ের দিকে তাকালে যে ভাবে যেমন দেখতে পারছি তেমন ইহজন্মে সম্ভব ছিল না। আমার বিয়ের ছবি দেখতে গিয়ে শুধু তোমার বিয়ের গল্পেই আটকে থাকছি। তোমাদের মতো বড় মানুষদের নিয়ে এই এক বিড়ম্বনা, রবির প্রখর আলোতে তৃণলতার মতো বেঁচে থাকার ছায়াটুকুও কোথাও পাওয়া যায় না। শুধু দগ্ধ হওয়াই নিয়তি, এবং নির্বিঘেœ দগ্ধ হওয়া গর্বের বিষয় বৈকি। তোমার বিয়ের গল্পে ফিরে আসবার আগে আমার জীবনপঞ্জির একটি খতিয়ান চোখের সামনে রেখে নিলে ভালো, বিশেষ করে যখন অনেকগুলো আগে-পিছের ঘটনার কথা বলে ফেললাম তখন তারিখ সমেত সাজিয়ে নেয়া ভালো। আসলে অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য ও অপর্ণা ভট্টাচার্য আমাকে লেখা তোমার কিছু চিঠি যেগুলো আমি তুলে রেখেছিলাম সেগুলি চিঠিপত্রের ১ম খণ্ড থেকে সম্পাদনা করে যে বইটি করেন ‘ভাই ছোটবউ’ নাম দিয়ে সেই বইটিতে ব্যবহৃত জীবনপঞ্জি বলা ভালো আমার একমাত্র জীবনপঞ্জিই তুলে দিচ্ছি। হ্যা, আমি জানি তোমার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তোমার সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছুই তো জগতের জন্য জরুরি দলিল। তোমাকে ঘিরে থাকা সবকিছুই তোমার ইতিহাসের সঙ্গে রক্ষিত হয়ে আসছে, ফলে যাদের জন্য এবং যে সময় ও কালের জন্য রক্ষা করা সেই সময় কালের কৌতূহল মেটাতে আমার জীবনের কিঞ্চিৎ সারণীটুকু না হয় এই চিঠির সঙ্গে সেটে রইল, রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীও গবেষকদের জন্য আগ্রহের বিষয় হবে নিশ্চয়।

মৃণালিনী দেবীর জীবনপঞ্জি

১২৮০ ফাল্গুন। ১৮৭৪ মার্চ। জন্ম : খুলনা জেলার দক্ষিণডিহির ফুলতলা গ্রামে। পিতা বেণীমাধব রায়চৌধুরী। মাতা দাক্ষায়ণী দেবী।
(?) ১২৮৭। ১৮৮০।। শিক্ষারম্ভ : গ্রামের পাঠশালায়। প্রথম বর্গ পর্যন্ত পড়াশুনা।
১২৯০ অগ্রহায়ণ ২৪। ১৮৮৩ ডিসেম্বর ৯।। বিবাহ : দশ বৎসর বয়সে বাইশ বৎসর বয়স্ক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনে শুভকার্য সম্পন্ন হয়।
১২৯০ ফাল্গুন ১৯। ১৮৮৪ মার্চ ১।। ইংরেজি শিক্ষা : মহর্ষির আদেশে ইংরেজি শিক্ষার জন্য নববধূকে লরেটো হাউসে স্বতন্ত্রভাবে ভর্তি করার ব্যবস্থা।
১২৯১ বৈশাখ-চৈত্র। ১৮৮৪-৮৫।। এক বৎসর কাল লরেটোতে শিক্ষা লাভ।
(?) ১২৯২ বৈশাখ-চৈত্র। ১৮৮৫-৮৬।। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে মহর্ষিভবনে পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারতেœর নিকট সংস্কৃত শিক্ষার ব্যবস্থা।
১২৯৩ কার্তিক ৯। ১৮৮৬ অক্টোবর ২৫।। প্রথম সন্তান বেলা বা মাধুরীলতার জন্ম।
(?) ১২৯৩। ১৮৮৭।। স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘সখিসমিতি’ও ‘ শিল্পমেলা’র কর্ত্রীসভার ‘সখী’ রূপে নির্বাচিতা।
(?) ১২৯৪ চৈত্র। ১৮৮৮ মার্চ-এপ্রিল।। স্বামী ও শিশুকন্যাসহ গাজিপুরে গমন ও বাস। এখানে রবীন্দ্রনাথ বৈশাখ থেকে আষাঢ় এই তিন মাসে ‘মানসী’র ২৮টি কবিতা রচনা করেন।
১২৯৫ অগ্রহায়ণ ১৩। ১৮৮৮ নভেম্বর ২৭।। দ্বিতীয় সন্তান রথীন্দ্রনাথের জন্ম।
(?) ১২৯৬ পূজার ছুটি। ১৮৮৯ অক্টোবর-নভে¤র।। কবির সদ্য-প্রকাশিত ‘রাজা ও রানী’ নাটকের প্রথম মঞ্চাভিনয়ে মৃণালিনী দেবীর ‘নারায়ণী’র ভূমিকায় সার্থক অভিনয় (সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বির্জিতলার বাড়িতে)।
১২৯৬ অগ্রহায়ণ। ১৮৮৯ নভেম্বর-ডিসেম্বর।। স্বামী ও পুত্রকন্যা সহ শিলাইদহে পদ্মাবক্ষে ‘পদ্মা’ বোটে বাস।
১২৯৭ মাঘ ১১। ১৮৯১ জানুয়ারি ২৩।। তৃতীয় সন্তান রানী বা রেণুকার জন্ম।
১২৯৮ গ্রীষ্মকাল। ১৮৯১ এপ্রিল- মে।। স্বামী ও সন্তানসহ প্রথম শান্তিনিকেতনে আগমন ও ‘শান্তিনিকেতন’ বাড়ির (আদি বাড়ি) দোতলায় বাস।
১২৯৮ জ্যৈষ্ঠ। ১৮৯১ মে-জুন।। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা গমন।
১২৯৯ জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়। ১৮৯২।। দ্বিতীয়বার শান্তিনিকেতনে আগমন।
১২৯৯ অগ্রহায়ণ ৩। ১৮৯২ নভেম্বর ১২ ।। শিশুসন্তানদের ও কুমারী ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে সোলাপুরে জ্ঞানদানন্দিনীর নিকট গমন।
১২৯৯ পৌষ ২৯। ১৮৯৩ জানুয়ারি ১২।। চতুর্থ সন্তান মীরার জন্ম।
১৩০১ অগ্রহায়ণ ২৮। ১৮৯৪ ডিসেম্বর ১৩।। পঞ্চম ও সর্বশেষ সন্তান শমীন্দ্রনাথের জন্ম।
১৩০৪ কার্তিক-পৌষ। ১৮৯৭-৯৮।। তৃতীয়বার শান্তিনিকেতনে আগমন।
১৩০৬ ভাদ্র-১৩০৭ চৈত্র। ১৮৯৯-১৯০১।। শিলাইদহে বাস।
১৩০৮ বৈশাখ। ১৯০১ এপ্রিল-মে।। চতুর্থবার শান্তিনিকেতনে আগমন।
১৩০৮ আষাঢ় ১। ১৯০১ জুন ১৫।। বিহারীলালের পুত্র শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রথম কন্যা বেলা বা মাধুরীলতার বিবাহ। বিবাহের পূর্বে ২৮ জ্যৈষ্ঠ তারিখে বর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
১৩০৮ শ্রাবণ ২৪। ১৯০১ আগস্ট ৯।। ডাঃ সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দ্বিতীয় কন্যা রানী বা রেণুকার এগারো বৎসর ছয় মাসে বিবাহ।
১৩০৮ ভাদ্র। ১৯০১ আগস্ট-সেপ্টেম্বর।। পঞ্চমবার শান্তিনিকেতনে আগমন।
১৩০৮ আশ্বিন-কার্তিক। ১৯০১ সেপ্টম্বর-নভেম্বর।। ষষ্ঠবার শান্তিনিকেতনে আগমন ও বসবাস।
১৩০৮ চৈত্র। ১৯০২ মার্চ-এপ্রিল।। সপ্তম ও সর্বশেষবার শান্তিনিকেতনে আগমন ও বাস। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্রদের তত্ত্বাবধানের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ।
১৩০৯ আষাঢ়। ১৯০২ জুন-জুলাই।। শান্তিনিকেতনে রোগাক্রান্ত।
(?) ১৩০৯ ভাদ্র ২৭। ১৯০২ সেপ্টেম্বর ১২।।চিকিৎসার জন্য কলকাতায় স্থানান্তরিত।
১৩০৯ অগ্রহায়ণ ৭। ১৯০২ নভেম্বর ২৩। জোড়াসাঁকো মহর্ষিভবনে দেহাবসান।

ভাই ছোট বউ, স্ত্রীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি, সম্পাদনা : অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, অপর্ণা ভট্টাচার্য, পূর্বা ১২১১

জ্যোতিদা’র মতো তোমার বিয়েও হয় সাদাসিধে ভাবে। হবে না কেন বলো ! একজন করেছেন বাড়ির নিচতলায় আশ্রিতদের সঙ্গে থাকেন বাজার সর্দার শ্যামলালের মেয়ে, অন্যজন মানে বেণীমাধব ১২ টাকা মাইনের কাচারির কর্মচারীর মেয়ে। তো দু’টি মেয়েই গরিব অতিসাধারণ ঘরের অপ্রাপ্তবয়স্ক, প্রায় অশিক্ষিত। দুটি মেয়েই বরের বাড়িতে আগে থেকেই উপস্থিত যখন তখন কোনো বর যাত্রীর বালাই নেই। বর যাত্রীর সাজগোজ, ব্যাণ্ড মিউজিক, কত রকম ফুলে সজ্জিত হাতিঘোড়া বা গাড়ির যে আয়োজন হয় তার দরকার হলো না, সাদাসিধে তো হবেই। তাছাড়া পাত্রীপক্ষ পাত্রপক্ষের পয়সায় চলে, তাদের দিক থেকে জাঁকজমকের আয়োজনের কথা ওঠে না। তোমাদের দিক থেকে আরও সুবিধে হলো অপর পক্ষের সম্মানজনক আসন, মেহমানদারি, উপহার উপঢৌকনের সামাজিকতার জন্য ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। কর্মচারীর মেয়ে বলেই তো নিজেদের বাড়িতে ফুলতলা থেকে আনিয়ে বিয়ে করলে, ছোটঠাকুরকে কোথাও যেতে হলো না। যদি একান্ত কর্মচারী না হতো তাহলে যেমন অনেকের বেলায় ঘটেছে, কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে কনেকে নিয়ে তার বাবা মা উঠেছে। জ্ঞানদা-বঊদি’র ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছে। তবে বাড়ি ভাড়া করে উঠলেও মহর্ষিদেব সেই ভাড়া সরকারি খরচ থেকে মিটিয়েছেন। তোমাদের দুই ভাইয়ের বেলায় বাড়ি ভাড়াটুকুও গুণতে হলো না। বাড়ি ভাড়া না গুণতে হলেও খরচ তোমাদের হয়েছেই। বিয়ের পর আমার ভাইটি জোড়াসাঁকো বাড়িতে এসে উঠল, ইংরেজি স্কুলে পড়ল,পড়ে বাবার মতো তোমাদের এস্টেটের শেরেস্তায় কাজও করল। তবে ভাই নগেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী তোমাদের কাজেও লেগেছে বেশ। নিজেদের নির্ভরযোগ্য লোক হিসেবে পাতিসর এস্টেটের ম্যানেজার বা কালীগ্রাম কৃষি ব্যাঙ্কের কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও তোমার নিজের পারিবারিক কাজেও শালাবাবুকে পেয়েছ। বিশেষ করে আমার রেণু যখন খুব অসুস্থ, আমি মরেছি বেশি দিন হয়নি, শোক, সংসার, শান্তিনিকেতন আশ্রমের মেলা কাজের মধ্যে তুমি নগেন্দ্রকে পেয়েছ নিজের লোকের মতো করে। রেণুকে নিয়ে আলমোড়ায় গেলে, সঙ্গে নগেন্দ্র। গুরুতর যক্ষায় আক্রান্ত রেণুকে আলমোড়ায় নগেন্দ্রের কাছে রেখে শান্তিনিকেতনের ঝামেলা মেটাতে তোমাকে চলে আসতে হয়েছিল। তার আগে আমি জীবনের শেষবারের মতো বেশি অসুস্থ হলে এই ভাই নগেন্দ্রই আমাকে ছেলেমেয়ে সহ শান্তি নিকেতন থেকে কলকাতায় নিয়ে আসে তোমার কথা মতো । তুমি তখন কলকাতায় ছিলে। আমার বাবা মারা (১৩০২) যাবার পর অন্যদিকে মহর্ষিদেব আমার মা দাক্ষায়ণী দেবীর জন্য ২০ টাকা মাসোহারা বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। তো আমাদের গরিব পরিবার তোমাদের জন্য কাজ করবার চেষ্টা করেছে, বিত্তবান তোমরা আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছ। তোমরা পেয়েছ সম্মান, বিনিময়ে তোমাদের অসম শ্বশুরকুল সম্মানের বদলে সাহায্য, আশ্রয় পেয়েছে। তারা যে কেউ কেউ সম্মানের যোগ্য ছিলেন-জ্যোতিরবি’র শ্বশুর, দাদাশ্বশুর প্রমুখ যে সম্মানিত আত্মীয় তা অনেকের মনে হতো না। বড়দি’র বিখ্যাত স্বামী সত্যপ্রসাদ জামাইবাবুর কথা একবার বলেছি, জ্যোতিদা’র দাদা শ্বশুর জগমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা খেয়াল কর-উনার বিশেষ একটি গুণের জন্যই কিন্তু দ্বারকানাথের মামা কেনারাম রায়চৌধুরীর মেয়ে শিরোমণি দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়। সেই গুণটি আর কিছু নয়, মহর্ষিদেব যা খুব পছন্দ করতেন, তোমার ঠাকুরদাও করেছেন তা হলো সঙ্গীত। জগমোহন খুব ভালো হিন্দুস্থানি রাগ গাইতেন, সেজন্য মহর্ষি তাদেরকে বদনামযুক্ত হারকাটা গলি থেকে এনে জোড়াসাঁকোয় এনে রাখলেন, যদিও ওই গলিতে বাড়ি তোমরা কিনে দিয়েছিলে। এই বাড়ির রেওয়াজ মতো সঙ্গীত শিল্পী জগমোহন হয়ে গেলেন বাজার করা থেকে বাবুর্চিগিরি, দারোয়ানে কাজ থেকে কামার ছুতোরের কাজের মানুষ। তোমার দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণ গ্রন্থ ‘আমার বাল্যকথা’য় জগমোহন সম্পর্কে কোন স্মৃতিচারণ করলেন ! মনেই হয় না, উনি যে একজন বড় শিল্পী ছিলেন, একইভাবে পরে, অবনীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজৈবনিক স্মৃতিগ্রন্থ ঘরোয়া’য় নি¤œ শ্রেণীর একজন কর্মচারীর বেশি আর আর কিছুই মনে হয় না। শিল্পী জগমোহনকে মনে হয় একটা ভাড় ! জগমোহনের ছেলে শ্যামলালের কন্যা কাদম্বরী দেবীকে জ্যোতিদা’ বিয়ে করলেন। আর জগমোহনের স্ত্রী তোমাদের জ্ঞ্যাতি আত্মীয় শিরোমাণি দেবীই কিন্তু তোমার বিয়ের অনুষ্ঠানে তোমাকে বরণ করেছিলেন। শিরোমণি দেবীকে তোমাদের বাড়ির ছোট বড় সবাই বলত বড়ো গাঙ্গুলীর স্ত্রী। মজার ব্যাপার হলো শিরোমণি দেবী, জগমোহন ঠাকুর, সত্যপ্রসাদ বাবু, বেণীমাধব বা নগেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর নাম লোকে জানবে, ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে রবি জ্যোতি ঠাকুরদের বিশেষ আত্মীয় কুটুম হিসেবে। খোঁজ নিলে জানবে তারা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেও কর্মচারীর দায়িত্বই পালন করেছেন, আত্মীয়ের সম্মান তাঁরা পেয়েছেন এমন খোঁজ গবেষকদের তথ্যে অনুপস্থিত। এতো কথা যখন হলো তখন ‘বাল্যকথা’ ও ‘ঘরোয়া’ থেকে জগমোহন সম্পর্ক স্মৃতিটুকু পড়ে দেখা যাক :

‘‘… তখন ১১ই মাঘের উৎসব খুব ধুমধামে সম্পন্ন হত। … ঐ উপলক্ষে একবার এক দল মিলে পলতার বাগানে গিয়ে বড়ই আমোদ আহ্লাদ করা গিয়েছিল; সেদিনের ব্যাপার আমার বেশ মনে পড়ে। ভোজের কর্মকর্তা ছিলেন জগমোহন গাঙ্গুলী। লোকটি বিলক্ষণ হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ, তাঁর ভুঁড়িটিও অতুলনীয়। এমন সৌখীন আমুদে অথচ কর্মিষ্ঠ মানুষ আমি কখনো দেখিনি। খাওয়া, পরা, ওঠা, বসা, প্রত্যেক কাজে তাঁর কারিগরি প্রকাশ পেত। রান্নাবান্না ঘরকন্না, পোষাক সাজসজ্জা, কারুকার্য, ছুতরের কামারের কাজ, সকল কর্মেই তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমরা ছেলের দল তাঁর বড় নেওটা ছিলুম, তাঁর ঘরে গিয়ে খেলা করতুম, তাঁর কাছে গল্প শুনতুম; তাঁর অসংখ্য খুঁটিনাটি জিনিষের মধ্যে কোনওটা আবদার করে আদায় করতুম; তাঁর মুখের পান কি মিষ্টি লাগত। … তাঁর ভুঁড়িটি আমাদের আদরের সামগ্রী ছিল আর তিনি সকালে যে নাকডাকানী গম্ভীর আওয়াজে ˜িগি¦দিক প্রতিধ্বনিত করতেন আমরা ভোরে উঠে তাই শুনতে যেতুম। তিনি একপ্রকার আমাদের বাড়ির দ্বারপাল ছিলেন। একবার একদল পুলিশ ওয়ারেন্ট নিয়ে এসে বলপূর্বক আমাদের একটা গাড়ি টেনে নিয়ে যাবার যোগাড় করেছিল। তিনি একলা সেই গাড়ি টেনে রেখে তাদের হটিয়ে দিয়েছিলেন। এ আমার নিজের চোখে দেখা। . . .” (আমার বাল্যকথা, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

এবার ‘ঘরোয়া’য় অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতির অংশবিশেষ দেখ, এখানে তাঁর চরিত্রের আর এক কৌতুকর রূপ !

‘…জগমোহন গাঙ্গুলি মশায়ের ছিল রান্না আর খাবার শখ। পাকা রাঁধিয়ে ছিলেন, কী বিলিতি কী দেশী। গায়ে যেমন ছিল অগাধ শক্তি, খাইয়েও তেমনি। ভালো রান্না আর ভালো খাওয়া নিয়েই থাকতেন তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা ইস্তিক। অনেকগুলো বাটি ছিল তাঁর, সকাল হলেই তিনি এবাড়ি ওবাড়ি ঘরে ঘরে একটা করে বাটি পাঠিয়ে দিতেন। যার ঘরে যা ভালো রান্না হত, একটা তরকারি ওই বাটিতে করে আসত। সব ঘর থেকে যখন তরকারি এল তখন খোঁজ নিতেন, দেখ্ তো মেথরদের বাড়িতে কী রান্না হয়েছে আজ। সেখানে হয়তো কোনোদিন হাঁসের ডিমের ঝোল, কোনোদিন মাছের ঝোল, তাই খানিকটা এল বাটিতে করে। এই সব নিয়ে তিনি রোজ মধ্যাহ্নভোজনে বসতেন। এমনি ছিল তাঁর রান্না আর খাওয়ার শখ।’

তুমি অনেক লিখেছ, এতো লেখা এক জীবনের পক্ষে অসম্ভব। অনেক কথা বলেছ জীবন ভর। এতো কথা এক জীবনেই যেখানে সেখানে বলেছ তাও অসম্ভব ব্যাপার। সেই সব লেখা কথার ভিড়ে আকস্মিক ভাবে হলেও তোমার অসম বিয়ের জন্য কখনো অনুশোচনার প্রকাশ হয়ে গেছে। যেমন মনে কর বিয়ের অনুষ্ঠানের কথাই, ভাঁড়কুলো খেলার একটা আচার আছে। আর তুমি বাসর ঘরে এই খেলায় এমন একটি রসিকতা করলে, তা অনেক পরে, বিশেষ করে এই মৃত্যুত্তোর জীবনে এসে বুঝতে পারি। তোমার অন্তর্গত কষ্টের কথা। কষ্টের অনেক স্তর। এক স্তরে আছে নতুন বউঠান কাদম্বরীর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক, অন্যদিকে জড়ভরতগোছের এক নাবালিকাকে বিয়ে করার অন্তর্গত বেদনা। কনে দেখার দলে কাদম্বরী নতুন বউঠানও ছিলেন, কনে শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেলে বিয়ের আয়োজনের আগেই বউদি অসুস্থ হয়ে গেলেন, অনির্ণয় যোগ্য একরকম অসুস্থতা। আমি এই অনন্ত কালে এসে জীবনের সকল পিঠ, সকল রকম পাঠ শেষে এটুকু বুঝতে পারি তোমার সঙ্গে কাদম্বরী বউদির নারী পুরুষের জৈবিক প্রেম ছিল না, কিন্তু দুটি জৈবিক সত্তার গভীর বন্ধুত্ব, ও অবলম্বন ছিল। তুমি তার প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছিলে। তোমার দুনিয়া অনেক বড়, অনেক মানুষ, অনেক ব্যস্ততা দিন দিন বাড়ছিল, বাইরের টান হচ্ছিল প্রবল। কিন্তু বউদির কী ছিল বল ? তুমিও বিয়ে এবং দুনিয়ায় ব্যস্ত হলে ভয়াবহ একাকিত্বের ভয়ে আবেগী, খুব সংবেদনময়ী বউদি অস্থির হয়ে পড়েন, আত্মহননের মতো ভয়ঙ্কর কাজটি তিনি করেন। আমি বলব, এখানে তোমার কোনো কিছু করার ছিল না, দায় ছিল কর্তব্য ছিল জ্যোতিদা’র। বরং উল্টো হয়েছে। তিনি বুদ্ধিমান, আধুনিক জ্ঞানদা বউদি’র সঙ্গ এমনকি নটি বিনোদিনির সঙ্গও সাহিত্যিক বন্ধুদের সাহচর্যের মতো উপভোগ করেছেন। ব্যস্ত হয়েছেন নাটক রচনায়, মঞ্চায়ন, সঙ্গীত, ছবি আঁকা আর জাহাজের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। বউদি ভিতরে ভিতরে একদিকে একা, নিঃসঙ্গ, নিঃসন্তান বলে আরও একা হয়েছেন। অন্যদিকে অবহেলা উপেক্ষার বোধ দিনে দিনে কুড়ে খেয়েছে। জ্ঞানদা বউদি এতো জ্ঞানী হয়েও নানা সময়ে এমন কি তোমার মেজদা পর্যন্ত বাজার সর্দার শ্যামলালের মেয়ে বলে অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন আড়ালে হলেও। সংবেদনশীল নতুন বউঠান এসবই বুঝতে পারতেন। মহর্ষি যখন শ্যামলাল গাঙ্গুলীর কন্যা প্রায় নিরক্ষর, ৯ বছরও বয়স হয়নি কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন তখন সত্যেন্দ্রনাথ আহমদনগর থেকে স্ত্রী জ্ঞানদা নন্দিনীকে এক চিঠিতে লিখছেন : ‘শ্যাম গাঙ্গুলীর ৮ বৎসরের মেয়ে, আমি যদি নতুন হইতাম তবে কখনোই এই বিবাহে সম্মত হইতাম না। কোন হিসাবে যে এই মেয়ে নতুনের উপযুক্ত হয়েছে জানি না।’ আর এক চিঠিতে আছে -‘শ্যামবাবুর মেয়ে মনে করিয়া আমার কখনোই মনে হয় না যে ভাল মেয়ে হইবে, কোনো অংশেই জ্যোতির উপযুক্ত তাহাকে মনে হয় না।’ ঠিক আছে, উপযুক্ত নয়, এ ভুল কথাও নয়, কিন্তু ভারতের প্রথম আই. সি. এস. সংস্কৃতিবান, ভালো গান কবিতাও লিখেছেন, তিনি কোন বুদ্ধি যুিক্ত বিবেচনা করে মনে করেন শ্যামলালের মেয়ে বলে ভালো হবে না ? ভালো হবে না মানে কি ? প্রথমত শ্যামলাল ছিলেন তোমাদের উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল। যদিও বসে খেতেন না। বাজার সর্দার থেকে বাড়ির সকল কাজই করতেন তাঁর বাবা জগমোহনের মতো। তাঁর চরিত্রে কোনো দোষের কথা কেউ বলেনি, লোকে গরিব হলেই খারাপ হয়, খারাপ হলে তার মেয়েও খারাপ ! আট বৎসরের মেয়ে কি শিক্ষিত হবে ? আর তোমাদের বাড়ির শিক্ষা পেয়ে কাদম্বরী কোন অংশে কম পারদর্শী ছিলেন ? তুমি আজ রবীন্দ্রনাথ। এর পেছনে বালক বয়সের প্রেরণা উৎসাহ আর আগুন জ্বেলে দেওয়ার মন্ত্রণাদাত্রী ছিলেন কাদম্বরী বউঠান, মেজদা বা দিদিরা নয়। তাঁর প্রতি আমার হাজার শ্রদ্ধা। আমার দুর্ভাগ্য আমি তাকে সে ভাবে পাইনি, বিয়ের চার মাসের মধ্যে উনি চির বিদায় নিলেন। তবে তাকে ঘিরে অনেক গল্প শুনেছি, এখনো অনেকে ব্যবসার মতলবে গল্প বানিয়ে চলেছে, সে সবই গল্প, কেউ বউঠানকে বুঝতে চায়নি, তোমার সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতাও বুঝতে অপারগ। তুমি যখন বলো, ‘আত্মার সত্য তথ্যে নয়. আত্মার আত্মীয়তায়’। একথা মুনাফা লোভী প্রকাশক লেখক বুঝবে ! জ্যোতিদা ছিলেন তোমার সবচেয়ে বড়ো সহায়, বউঠান ছিলেন আত্মার আত্মীয়।

সত্য’দা যে এভাবে স্ত্রীকে লিখলেন, লোকে জানলো, তখন দেখতে হয় শুধু জ্যোতি-রবি কেন তোমাদের সকল ভাইদের শ্বশুরকুলের কৌলিন্যের অবস্থা কেমন ছিল। মহর্ষি তাঁর বিখ্যাত ছেলেদের সবারই বিয়ে দিয়েছেন আর্থিক সামাজিক ভাবে বেশ নিম্ববর্গের পরিবারে, কেউই জোড়াসাকো ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তুলনীয় তো নয়ই, অনেকেই নিচের তলার মানুষ, এমনকি সত্যদার শ্বশুরকুল মানে জ্ঞানদা’র পরিবারও এর ব্যতিক্রম নয়।

বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী সর্বসুন্দরীর বাবা তারাচাঁদ চক্রবর্তী ছিলেন যশোহর জেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের একেবারে গ্রাম্য গৃহস্থ। এই নরেন্দ্রপুর গ্রাম থেকেই এসেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী হয়ে ৬ বৎসর বয়সে দিগম্বরী দেবী এবং মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী। তাঁর বাবা অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায় বাস করতেন গ্রামেই। তিনি এক গ্রাম্য জমিদারের পুত্র হলেও পিরালী ঠাকুর বংশে বিয়ে হওয়ায় সমাজচ্যুত শুধু নয় পরিবার চ্যুত হয়েছিলেন। বাবা তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন ‘নির্বংশ হও’। কোন শিক্ষিত, সংস্কৃতবান ভালো মানুষ প্রাপ্ত বয়স্ক পুত্রকে বিখ্যাত দ্বারকানাথ ঠাকুরের বংশ ভালো নয় বলে নির্বংশ হওয়ার অভিশাপ দেয়! অভয়চরণ নির্বংশ ছিলেন না। অভিশাপ এখন বুঝি এসব শুধু অন্ধকারাচ্ছন্ন মনের অভিলাষ, কখনো সত্য নয়, পুরাণের দেব দেবীর কথা আলাদা। তারা কবি কল্পনার, কল্পনাতেই বিরাজ করেন। মেজদা যখন লেখেন ৮ বৎসরের মেয়ে’ তখন কি তিনি জ্ঞানদানন্দিনী বউদি’র বিয়ের সময়ের বয়স ও শিক্ষার কথা ভুলে যান! জ্ঞানদা বউদির দুধ দাঁত পড়েছে শ্বশুর বাড়ি এসে, সেই দাঁত লুকাবার ইঁদুরের গর্ত তিনি এই দালানের ইট সিমেন্টের বাড়িতে খুঁজে পান না। তিনি এসে ছিলেন গ্রামের কাঁচা বাড়ি থেকে। স্মৃতিচারণ করছেন জ্ঞানদা বউদি-

‘যখন দুধে দাঁত পড়তে আরম্ভব হল, তখন দাঁতটি হাতে করে নিয়ে একটা ইঁদুরের গর্ত খুঁজে “ইঁদুর, পড়া দাঁত তুমি নাও, তোমার দাঁত আমায় দাও” বলে সেই গর্তে ফেলে দিতে হত। … বিয়ের পরে যখন বাকি দুধের দাঁতগুলি পড়ত তখন কলকাতার সেই পাকা ইটচুনের বাড়িতে দাঁত ফেলতে ইঁদুরের গর্ত কোথায় খুঁজব ভেবে পেতুম না।’

‘জ্ঞানদা বউদি’র বিয়ের সময় বয়স ছিল সাত বছরের কিছু বেশি, কাদম্বরীর থেকেও এক বছরের বেশি ছোট। সেই সময়ে এমনই রেওয়াজ ছিল, সেই রেওয়াজের সম্পূর্ণ চল ছিল তোমাদের বাড়িতে। তোমরা খুব আধুনিক শিক্ষিত বলে অন্যরকম ঘটেনি কিন্তু।

বাল্য বিবাহ পুরোদমে চলেছে। যদিও তখন ভারতে উদার শিক্ষিতজনের ভিতর প্রবল সচেতনতা তৈরি হয়েছে এই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে। বিবাহের নি¤œ বয়স বেঁধে দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়নের কথা হচ্ছে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নেতৃত্বে। তোমার অন্য দুই দাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী ছিলেন দুই সহদোরা- নীপময়ী ও প্রফুল্লময়ী। তাদের বাবা হরদেব চট্ট্যোপাধ্যায় ছিলেন বাশবেড়ে গ্রামের নি¤œ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ এবং ব্রাহ্ম ধর্মের দীক্ষা নিয়ে হয়েছিলেন মহর্ষির ‘ভক্তবন্ধু’। প্রমথ চৌধুরীর দিদি প্রফুল্লময়ী (বউদি প্রফুল্লময়ী নন) স্মৃতিকথায় হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভক্তবন্ধু’ কথাটি নিয়ে বিশেষ ভাবে কটাক্ষ করেন, কারণ, তখন তিনি দেখেছেন সামাজিক মর্যাদায় হরদেব সম্পূর্ণ নিচুতলার মানুষ, জ্ঞান বুদ্ধিতেও সাধারণ। তিনি মহর্ষির ভক্ত হতে পারেন, বন্ধু নন, প্রফুল্লময়ী লেখেন-

‘[ভক্তবন্ধু] শব্দটির অন্তর্নিহিত স্ববিরোধটি লক্ষণীয় ‘বন্ধু’ শব্দে যে সমানধর্মের হাওয়া আছে ‘ভক্ত’ শব্দে তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। শব্দটিতে হরদেবের সামাজিক নিচু স্থানই সূচিত করে।’

হরদেব বাবুর মৃত্যুর পর তাঁর শ্রাদ্ধও হয় মহর্ষির অর্থে। জ্যোতিদা’র বিয়ের খবর তো জানাই। তোমার শ্বশুর কুলের খবরও বটে। তবে, একটা কথা এখানে বলা যায়, জোড়াসাঁকোর শেরেস্তার কর্মচারী তোমার শ্বশুরের মাসিক বেতন যখন ১২ টাকা তখন তোমার অর্থাৎ ১২টা বেতনের কর্মচারীর জামাতার শুধু হাত খরচ ছিল মাসে ২০০ টাকা, এছাড়া জামা কাপড়, খাওয়া দাওয়া, যাতায়াতের খরচ আসতো জমিদারি এসেস্টের সরকারি খরচ থেকে।

আমাদের বিয়ের ভাঁড় কুলো খেলার কথা হচ্ছিল। তুমি নিয়ম মতো না খেলে ভাঁড়গুলো সব উল্টে দিচ্ছিলে, ছোট কাকিমা যখন তোমার দুষ্টমি দেখে বিস্মিত হন, তখন তুমি সম্ভবত সেই প্রথম মনবেদনার কথা প্রকাশ্যে বললে। বললে জীবনটা যখন উল্টেপাল্টে গেছে তখন আর ভাঁড়কুলো। হেমলতা দেবীর তখনো বিয়ে হয়নি, পরে তোমার বড়দা’র ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথের স্ত্রী মারা গেলে ২য়বার এই হেমলতাকে বিয়ে করেন, তিনি তোমার বিবাহ বাসরের যে বর্ণনা ‘সমকালীন’ বৈশাখ ১৩৬৪ সংখ্যায় ‘রবীন্দ্রনাথের বিবাহ-বাসর’ নামে যে স্মৃতিচারণ করেন তা থেকেই সব জানতে পারি। তোমার জীবনীকার, গ্রন্থ প্রণেতারা এই রচনার নানা অংশ উদ্ধৃত করে আসছেন। এখন আমিও একবার অংশ বিশেষ পড়ে নিতে চাই।

‘ঘরের ছেলে নিতান্ত সাধারণ ঘরোয়া-ভাবে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়েছিল। ধুমধামের সম্পর্ক ছিল না তার মধ্যে। পারিবারিক বেনারসি শাল ছিল একখানি-যার যখন বিয়ে হত সেইখানি ছিল বরসজ্জার উপকরণ। নিজেরই বাড়িতে পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে এলেন অন্দরমহলে-স্ত্রী-আচারের সরঞ্জাম যেখানে সাজানো। বরসজ্জার শালখানি গায়ে জড়ানো রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন পিঁড়ির উপর। নূতন কাকিমার আত্মীয়া যাঁকে সবাই ডাকতেন ‘বড়ো গাঙ্গুলীর স্ত্রী’ [? শিরোমণি দেবী, জগম্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী] বলে রবীন্দ্রনাথকে বরণ করলেন তিনি। তাঁর পরনে ছিল একখানি কালো রঙের বেনারসির ডুরে।

‘…কনে এনে সাত পাক ঘুরানো হল, শেষে বরকনে দালানে চললেন সম্প্রদান-স্থলে। বাড়ির অবিবাহিত বড়ো মেয়েগুলি সঙ্গে সঙ্গে চলল। আমিও জুটে গেলুম তাদের সঙ্গে। দালানের একধারে বসবার জায়গা ছিল আমাদের। দেখলুম সেখানে বসে স্বচক্ষে কাকিমার সম্প্রদান।’

‘সম্প্রদানের পর বরকনে এসে বাসরে বসলেন। রবীন্দ্রনাথের বউ এলে তার থাকবার জন্যে একটি ঘর নির্দিষ্ট করা ছিল আগে থেকেই। বাসর বসল সেই ঘরেই। বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ দুষ্টুমি আরম্ভ করলেন।

ভাঁড়কুলো খেলা আরম্ভ হল, ভাঁড়ের চালগুলো ঢালা-ভরাই হল ভাঁড়কুলো খেলা। রবীন্দ্রনাথ ভাঁড় খেলার বদলে ভাঁড়গুলো উপুড় করে দিতে লাগলেন ধরে ধরে। তাঁর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী বলে উঠলেন, “ও কী করিস রবি, এই বুঝি তোর ভাঁড় খেলা? ভাঁড়গুলো সব উল্টে পাল্টে দিচ্ছিস কেন?” রবীন্দ্রনাথের নিজের বাড়ি, নিজেই বর। তাঁকে শ্বশুড়বাড়ি যেতে হয়নি। তাই তাঁর লজ্জা সংকোচের কারণ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বললেন, “জানো না কাকিমা, সব যে উলটপালট হয়ে যাচ্ছে, কাজেই আমি ভাঁড়গুলো উলটে দিচ্ছি।” রবীন্দ্রনাথ বাকসিদ্ধ মানুষ, কথায় তাঁকে হারাতে পারবে না কেউ। তাঁর কাকিমা আবার বললেন, “তুই একটা গান কর। তোর বাসরে আর কে গাইবে তুই এমন গাইয়ে থাকতে?” রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর তখন কী চমৎকার ছিল, সে যারা না শুনেছে, বুঝতে পারবে না। আমরা যে কানে শুনেছি সে আমাদের কম সৌভাগ্য নয়। এখন সবই হারিয়ে গেছে, তবু যা পেয়েচি তাই রেখেছি মনে। বাসরে গান জুড়ে দিলেন-

আ মরি লাবণ্যময়ী
কে ও স্থির সৌদামিনী
পূর্ণিমা জ্যোছনা দিয়ে
মার্জিত বদন খানি।
নেহারিয়া রূপ হায়
আঁখি না ফিরিতে চায়
অপ্সরা কি বিদ্যাধরী
কে রূপসী নাহি জানি।

দুষ্টুমি করে গাইতে লাগলেন কাকিমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। বেচারি কাকিমা রবীন্দ্রনাথের কাজ দেখে জড়োসড়ো। ওড়নায় মুখ ঢেকে মাথা হেঁট করে বসে আছেন। আরও একটা গান তখন গেয়েছিলেন-সেটা আমার স্মরণে নেই। সেদিনকার পালা ওখানেই শেষ।” আমি কিন্তু অনেক পরে জেনেছি ‘আ মরি লাবণ্যময়ী’ গানটা তোমার লেখা নয়, বড়দি সৌদামিনীর লেখা, সুর ও শব্দচয়নের ভঙ্গি দিদির সঙ্গে তোমার মিল ছিল।

তোমার জীবনটা কি সত্যিই উল্টেপাল্টে গেল? সাহিত্য, সঙ্গীত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, জমিদারি দেখা, সভা সমাবেশ, স্কুল প্রতিষ্ঠা, বন্ধু আত্মীয় সম্পর্ক কোনো কিছুতেই আমি বা এই বিয়ে সমস্যা হয়েছিল কি? এখন বেশ ভালো করে দেখে বুঝতে পারি, কিছু তো উল্টেপাল্টে যায়নি, বরং বিয়ে করার পর বলা ভালো তোমার নিজের সংসার গড়ার পর আমার সঙ্গে তোমার মনের মিল না হলেও শরীরের যে সম্পর্ক হয়েছিল তাতে আনন্দের প্রকাশই ঘটেছে, কাজ করেছ দুই হাতে। তোমার সে সময়ের কবিতায় শরীরের কথা, রমন সুখের কথাও অবলীলায় এসেছ্,ে এর আগে কখনো তা ছিল না, পরেও আর নয়। গাজীপুর বা শিলাইদহের সংসারের দিকে এখন তাকালে যেমন আমি শিহরিত হই, কাজ আর আনন্দে ভরপুর কী সুখের সংসার। আমার সঙ্গে তোমার কথা আচরণও বড় মধুর ছিল। যৌবনের সুর ও সুখ তোমার ব্যবহারে বেশ প্রকাশ পেয়েছে। অতি সহজ সহৃদয় প্রেম। আমি দিনে দিনে তোমার অন্তত সংসারের কাজে বড়ো নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছিলাম। অনেক কিছুতেই ভরসা করতে পারতে। বাড়িতে হুটহাট দেশি বিদেশি অতিথি নিয়ে এলেও বিব্রত হতে হতো না। অনেক প্রজারা তাদের সুখ দুঃখের কথা আমার কাছে বলতো, কখনো কখনো সামান্য কিছু সমাধান পেয়ে খুশিই হতো, যেমন পরে ব্রহ্মাচার্যশ্রমের ছাত্রদের জলপানির ব্যবস্থাও আমি হাতে নিয়ে তোমার আশ্রমের কিছু কাজেই লেগেছি, উল্টেপাল্টে দেইনি, কিছুই আমার জীবিত কালে উল্টে যাচ্ছিল না, বরং বলতে পারি কোথাও কোথাও উল্টা যাওয়া অবস্থাকে সোজা সহজ করতে তোমাকে সাহায্য করেছি। এসব কথা ঠিক করে বলা কঠিন হলেও কিছু বলব। তার আগে সে সময়ে তোমার কবিতার আবেগ বিষয়ের কথাতে আসি।

কাইজার-ই-হিন্দ নামের যে জাহাজে করে তুমি ও ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ বিলাত যাত্রা শুরু করেছিলে, যদিও এই ২য় বারের মতো বিলাত তোমার যাওয়া হলো না, মাদ্রাজ থেকে ফিরলে কিন্তু লাভ হলো জাহাজে আশুতোষ চৌধুরীর (১৮৬০-১৯২৪) সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সহজ অকৃত্রিম বন্ধুত্বও সূচনা হয়েছিল ওই জাহাজেই। অত্যন্ত মেধাবী আশুতোষ চৌধুরী যিনি তোমার প্রিয় ইন্দিরাদেবীর স্বামী প্রমথ চৌধুরীর অগ্রজ। তোমার কবিতার অনুভূতির প্রকাশ বুঝে সে সময়ের লেখা কবিতাগুলি নিয়ে ‘কড়ি ও কোমল’ বইটি (১৮৮৬) সম্পাদনা করে দেন। এই বছরেই তোমার উৎসাহে আর মহর্ষিদেবের সমর্থনে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র প্রতিভা দেবীর সঙ্গে বারেন্দ্র শ্রেণীর আশুতোষ চৌধুরী তোমাদের রাঢী শ্রেণীর ব্রাহ্মণের বিয়ে হয়। শোক বিরহে কাতর মনের বিষণœ কবিতা, অন্যদিকে প্রেম, দৈহিক প্রেম ভালোবাসার কবিতা প্রধানত এই দুই মূলসুরের কবিতাকে এই গ্রন্থে জায়গা করে দিলেন। চমৎকার তার বিন্যাস। আর শুরুতেই প্রবেশক রূপে বসিয়ে দিলেন এমন একটি কবিতা যার অন্তরে রয়েছে দুই মূল ভাবের সার কথা, শোক বিরহ সত্ত্বেও জীবনের প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে প্রেমময় ভালোবাসার অসংকোচ প্রকাশে জীবনের প্রতি আকাঙ্খা অনুরণিত কবিতার মুখ হিসেবে বসিয়ে দিলেন ‘প্রাণ’ কবিতাটি-

মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।

শুধু ‘কড়ি ও কোমল’ নয় তোমার জীবন সাধনায়, জীবন চর্যায়ও এই কথাই আজীবন বেজেছে। অনেক পরে
নৈবেদ্যে (সংখ্যা ৩০) এসে এই কথাই অন্যভাবে জানালে,

বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়
— — —
ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসন, সে আমার নয়।

যাইহোক, ‘কড়ি ও কোমলে’র পর তোমার আরও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হলো, বিশেষ করে যাকে তুমি বিশেষভাবেই মর্যাদা দিয়ে বলেছ ‘কবিতাপদবাচ্য’ সেই ‘মানসী’ অল্প পরেই (১৮৯০) প্রকাশ হয়। যাই বলো, তোমার বিজ্ঞ কবি আলোচক বন্ধুগণ যে কথাই বলুক ‘কড়ি ও কোমলে’র মধ্যে আমি আমার রবীন্দ্রনাথকে পাই, আবেগ কাতর ও প্রেমাদ্র মনের সবচেয়ে বিজড়িত ও সৎ কাব্যবলি আমি এখানেই বেশি পড়ি। আর এর সঙ্গে যেহেতু আমার সম্পর্কও জড়িয়ে আছে সেজন্যও হয়তো এই বইটি অনেক বেশি আমার, এবং আমার রবীন্দ্রনাথের। বিয়ের মাত্র চার মাস পরেই নতুন বউঠান আত্মবিসর্জন করলেন, চির বান্ধব চির সখা আত্মার আত্মীয় বউঠানের মৃত্যু শোক তুমি ভুলতে পারো নি।

কড়ি ও কোমলের মধ্যে সেই শোক জর্জর আকুতি বহু কবিতার শরীর আর্দ্র করে দেয়।

কুসুমের গিয়েছে সৌরভ
জীবনের গিয়েছে গৌরব
এখন যাকিছু সব ফাঁকি,
ঝরিতে মরিতে শুধু বাকি।
… … …
আমি আমার কথা তারে জানাব কী করে,
প্রাণ কাঁদে মোর তাই যে !
কুসুমের মালা গাঁথা হলো না,
ধূলিতে পড়ে শুকায় রে !
নিশি হয় ভোর, রজনীর চাঁদ
মলিন মুখ লুকায় রে !
(গান)

এমন আরও অনেক কবিতা গীত পদ্যে ভারাতুর মনের ও অন্তর্গত জল প্রবাহের আর্তস্বর আছে। তবু জীবনের প্রতি প্রেম ভালোবাসা তুমি চিরতরে দূরে ঠেলে দিতে পার না। একদিকে তোমার জীবনাপোলব্ধি, অন্য দিকে, যৌবনের ডাক উপেক্ষা করা সহজ নয়, ফলে লিখতে হয় ‘যৌবন স্বপ্ন’ –

আমার যৌবনস্বপ্নে যেন ছেয়ে আছে বিশ্বের আকাশ।
ফুলগুলি গায়ে এসে পড়ে রূপসীর পরশের মতো।
পরানে পুলক বিকাশিয়া বহে কেন দক্ষিণা বাতাস
যেথা ছিল যত বিরহিণী সকলের কুড়ায়ে নিশ্বাস।
… … … … … …
কাঁপিছে গোলাপ হয়ে এসে মরমের শরমে বিব্রত।

গাজিপুরে আমাদের একান্ত নিজস্ব সংসার জীবন গড়ে ওঠার (১৮৮৮) আগে, বিয়ের মাত্র তিন মাস পরেই (মার্চ ১৮৮৪) লরেটোতে আমার ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয়। প্রায় এক বছর লরেটোতে পড়া চলে মেজবড়দি জ্ঞানদানন্দিনীর বাসা থেকে, তিনিও আমাকে ঠাকুর বাড়ির আচার ব্যবহার শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছিলেন। লরেটোর শিক্ষা আরও চলতে পারত, কিন্তু তোমার যে তখন যৌবনস্বপ্ন ছেয়ে গেছে বিশ্বের আকাশে, সেই আকাশে ওড়বার আমি ততদিনে হয়ে উঠেছি কমনীয় আধার। জোড়াসাঁকো বাড়িতে তখন পণ্ডিত হেমচন্দ্রকে ঠিক করে দিলে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য। বিদ্যারতœ আমাকে সংস্কৃত পদ্য পুরাণ শ্লোক পড়ান, আর তোমার হাতে খোলে আমার যৌবনের সূচনাকুড়ি। নারীকে পরিপূর্ণ করে পাওয়ার অভিলাষে, নারী দেহের রহস্য আবিস্কারে তুমি মগ্ন; সত্যি বলতে, তখন আমারও অবস্থা মরমে শরমে বিব্রত। নিজের শরীরের অনুভূতি বোঝার আগেই স্বাদ পাই পুরুষের, পরাণ তখন পুলকে বিকশিয়া। সে-সময় লেখা তোমার কবিতাগুলি এমন অসঙ্কোচ হয়ে উঠেছিল, এখন যখন পড়ি তখন তোমার কথা ভেবে লজ্জা পাই। এমন সব ‘ক্ষণিক মিলন’, ‘স্তন’, ‘চুম্বন’, ‘বিবসনা’, ‘দেহের মিলন’ ইত্যাদি নামের কবিতা পড়ে পাঠক তোমার ব্যক্তিজীবনের দিকে নিশ্চয় উঁকি দিয়েছিল !

মিলনের বাসনার মাঝে, আধখানি চাঁদের বিকাশ—
দুটি চুম্বনের ছোঁয়াছুঁয়ি মাঝে যেন শরমের হাঁস।
(ক্ষণিক মিলন)

নবীন স্তনের রূপ বিকাশ ছন্দে এঁকে দিতে চাও ‘স্তন’ কবিতায় –

নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল,
বিকশিত যৌবনের বসন্তসমীরে
কুসুমিত হয়ে ওই ফুটে বাহিরে,
সৌরভসুধায় করে পরাণ পাগল।
. . . . . . . . .
বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয়,
সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে
শরমে মরিতে চায় অঞ্চল আড়ালে।

‘চুম্বন’ কবিতায় তুমি আরও নির্লজ্জ, শরমের বালাই নেই-

দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙ্গিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে,
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা।
. . . . . . . . .
অধরতে থর থরে চুম্বনের লেখা।

বরং লাজহীনা পবিত্রতা শুভ্র বিবসনে তুমি মগ্ন

ফেলো গো বসন ফেলো ঘুচাও অঞ্চল।
পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ

অথবা

প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ তরে।
প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন।
হৃদয় আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভারে
মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ ‘পরে।
(দেহের মিলন)

তোমার এই মুরছি পড়ার হাতে নাতে ফল এল, মাত্র ১২ বৎসর বয়সের আগেই অন্তঃসত্ত্বা ! কী লজ্জা বলো, আমাদের সন্তান বেলা’র জন্ম হলো ১৮৮৬’র অক্টোবরে, মানে ১২ বৎসর ৭ মাস বয়সে আমি মা হলাম ! তোমার তো দিন তারিখ ঠিক মতো মনে থাকে না, এতো সব তারিখ ভেঙ্গে বলতে হলো আমার অবস্থা বোঝাবার জন্য। যৌবনস্বপ্নের মায়া তোমার বুদ্ধিমান মনটিকে বুদ্ধিতে, জ্ঞানের দড়িতে বেঁধে রাখতে পারোনি, নিজের কাণ্ডজ্ঞান বিষয়ে উদাসীন হয়ে পড়েছিলে হয়তো। না হলে তোমার ক্ষেত্রে এমন হবে কেন ! অন্য বাবুদের হতে পারে, তুমি তো তেমন সাধারণ নও। খেয়াল কর, ১১ বৎসর ৯ মাস বয়সে অন্তসত্ত্বা হলাম, আর তুমি জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখলে এবং হল ভর্তি বিজ্ঞ শ্রোতাদের সামনে পাঠ করলে তোমার নাবালিকা বধু মা হওয়ার ১১ মাস পরে ৪ সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ সালে। সেই “হিন্দুবিবাহ” প্রবন্ধে-

‘ইহা স্বীকার করিতেই হইবে যে, অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিক মান্য ব্যক্তিগণ কারণ দর্শাইয়া বলিয়া থাকেন যে, যৌবনারম্ভ হইবা মাত্রই অপতোৎপাদন স্ত্রী, পুরুষ এবং সন্তানের শরীরের পক্ষে ক্ষতিজনক . . . বৈজ্ঞানিক বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতদের কথায় যদি কর্ণপাত না করি তবে সত্য সম্বন্ধে কিছু কিনারা করা দুর্ঘট।’

তোমার এই লেখা পড়ে হঠাৎ মনে হয়েছিল, বিশেষ করে যখন বলো ‘সন্তানের শরীরের জন্য ক্ষতিকর’ তখন আমার বেলা রেণু শমীর জীবন দ্রুত শেষ হয়ে গেল কি এই কারণে ! সন্তানের শরীরে প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধের শক্তি গড়ে ওঠে না বা দুর্বল হয় নাবালিকার গর্ভজাত বলে! ১৪ বৎসর বয়সে রথীন হলো (১৮৮৮)। কয়েক মাস আগে অন্তঃসত্তা অবস্থায় গাজীপুর আসি। শরীরের ওই অবস্থা নিয়ে গাজীপুরের সংসার সাজাই। এক বৎসর না হতেই ১৮৮৯’র নভেম্বরে গাজীপুরের বাস তুলে শিলাইদহে যাত্রা। সেখানে থাকার ব্যবস্থা তখনও মনপুত নয়। আমরা শিশু বাচ্চা সহ পদ্মার বুকে ‘পদ্মা’ বোটে বাস করলাম দুই মাস। তার এক বৎসর পরেই জানুয়ারি ১৮৯১-তে জন্ম হলো রেণুকার, তখন আমার বয়স ১৬, এবং ৩ সন্তানের জননী। শিলাইদহে ৪ মাস কাটিয়ে এবার ৩ মাসের রেণুকা বেলা রথী সহ শান্তিনিকেতন বাস শুরু হলো এপ্রিল ১৮৯১তে আদিবাড়ি মানে ‘শান্তিনিকেতন’ বাড়ির দোতলায়। কিন্তু ওই বৎসরের মে মাসেই কলকাতায় পত্যাবর্তন, আবার বৎসর খানিক পর ১৮৯২ সনে ২য়বার শান্তিনিকেতন। এতো ঘন ঘন তোমার আবাস বদলের ফিরিস্তি করতে আর ভালো লাগছে না। কথাগুলো বলার লক্ষ্য হলো অল্প বয়সে ঘন ঘন মা হওয়া, এবং শিশু সন্তানগুলোকে নিয়ে এভাবে ঠিকানা বদলে মা শিশুর শরীর মনের ওপর বেশি চাপ পড়তেই পারে। রেণুকার জন্মের দুই বৎসর পর জানুয়ারি ১৮৯৩-তে চার নম্বর সন্তান মীরার জন্ম হলো। আর ডিসেম্বর ১৮৯৪-এ শমীন্দ্রনাথের জন্ম হলো। তাহলে মার্চ ১৮৭৪-এ আমার জন্ম, আর ১৮৯৪-এর ডিসেম্বরে ২০ বৎসর বয়সে পঞ্চম সন্তানের মা হলাম। বেলা থেকে শমীন্দ্র-পাঁচ সন্তানের জন্ম হলো। শরীরটা ঠিক শক্ত মতো গড়ে উঠবার সময় ক্ষরণ হয়েছে অনেক, ফলে, ভিতরে ভিতরে হয়তো দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম, না হলে আমার জীবনের শেষবার শান্তিনিকেতনে এমন কি কাজ করলাম যে অল্প দিনের মধ্যে প্রাণটাই আর ধরে রাখতে পারলাম না ! উনত্রিশ বছরের যুবতী শরীর মাত্র দুই তিন মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল ! কি রোগ হয়েছিল আমার-বসন্ত না কলেরা না, যক্ষা না, ক্যান্সারও না, হৃদযন্ত্রের ব্যাধিও নয়, অন্ত্র তন্ত্রের অসুখও নয়, তাহলে ! আমার রথী পড়ে অনুমান করছে অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল-

‘শান্তিনিকেতনে কয়েক মাস থাকার পর মায়ের মায়ের শরীর খারাপ হতে থাকল। আমার এখন সন্দেহ হয় তাঁর অ্যাপেণ্ডিসাইটিস হয়েছিল। তখন এ বিষয়ে কিছু জানা ছিল না, অপারেশনের প্রণালীও আবিস্কৃত হয়নি।’ (পিতৃস্মৃতি ৮০-৮১)

এরকম অনুমান সন্দেহ আরও আছে। হেমলতার ‘মুখের কথাও’ তোমার জীবনীকার লিখেছে, কিন্তু ডাক্তার বাবুদের ধারণাটা কী ছিল? তাদের কিছু ‘সন্দেহ’ হয়নি। রথীর কথাও ঠিক নয়, তখন কেন তার বহু আগেই ভারতে অপারেশন প্রণালি আবিস্কৃত হয়েছিল, এবং অ্যাপেন্ডিক্স্ ডাক্তারদের কাছে তখন অচেনা রোগ নয়। আমি জেনেই বলছি, কলকাতায় তখন বিলাত থেকে পড়ে আসা ভারতীয় ডাক্তার ও বিদেশি ডাক্তার যেমন অভাব নয়, তেমনি ডাক্তারি পাঠ্য বইতে অ্যাপেন্ডিক্স্ অন্তর্ভুক্ত বহুকাল আগে থেকেই, ওইসব বই কোনোটাই বাংলাতে ছিল না। বিদেশিদের লেখা ইংরেজি ভাষার বই পড়েই লোকে তখন অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার হতো, আর তোমার হোমিও চিকিৎসায়ও এর উল্লেখ ও বিধান আছে। কৃষিবিদ্যায় পাশ দেয়া রথীনের অনুমান শরীরবিদ্যার ক্ষেত্রে ঠিক নয়। রথীন তখন অপারেশনের প্রণালীর কথা বলছে আবিস্কৃত হয়নি। হতে পারে বোলপুর বা কলকাতায় এই নির্দিষ্ট অপারেশনের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু অপারেশন কোলকাতায় বহু আগে থেকেই হয়ে আসছিল। আমার শ্বাশুড়ি সারদা দেবীরও হাতে অপারেশন হয়েছিল বহু আগে। তুমিও ভাল করেই জানো এলোপ্যাথির আগেই এই ভারতে বহু ধরণের শল্য চিকিৎসা চালু ছিল। ভারতই শল্য চিকিৎসার পথিকৃত।

হেমলতার ‘মুখের কথা’- কে সাক্ষ্য মেনে প্রভাতবাবু যেমন তোমার জীবনী গ্রন্থে আমাকে অন্তঃসত্ত্বা বানালেন, অ্যালোপাথি, হোমিওপ্যাথি কি তখন অন্তসত্ত্বা কিনা বুঝতে শিখেনি ! তাদের ব্যবস্থাপত্রে যে ঔষুধ দেয়া হয়েছিল, তুমিও বড় ডাক্তারের পরামর্শে যে হোমিও দিতে তাতে কোথাও অন্তসত্ত্বার বিষয়ে সতর্কতা বা উল্লেখ নেই ! আমি কি তখন সত্যিই সন্তানসম্ভবা ছিলাম ! জীবনীকার বাবু শুধু একজন আত্মীয়ার মুখে শুনলেন, তিনি ডাক্তারদের ব্যবস্থাপত্র থেকে বুঝতে বা জানতে পারেন নি আমি অন্তসত্ত্বা ছিলাম কি না ! লিখছেন-

‘মৃণালিনী দেবী শ্রাবণ মাসের কোনো সময়ে হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। হেমলতা ঠাকুরের মুখে শুনিয়াছিলাম মৃণালিনী দেবী বোলপুরের মুন্সেফবাবুর বাড়িতে বর্ষাকালে কোনো নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়েছিলেন; সেখানে পড়িয়া যান ও আঘাত পান, তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। বোলপুরে ব্যাধি উপশমের সম্ভাবনা না হওয়ায় পূজাবকাশ আরম্ভ হইলে মৃণালিনী দেবীকে কলিকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়।’ (রবীন্দ্রজীবনী, ২য় খণ্ড, ৫৫ পৃষ্ঠা)

অন্য জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য কোথাও পাননি, অন্তঃসত্ত্বার খবরটি আর কেউ স্মৃতিচারণ করতে যেয়েও উল্লেখ করেননি। তোমাদের পারিবারিক হিসেবের খাতায় ডাক্তার আর ঔষুধের খরচের হিসেব আছে, কিন্তু সে-সব ব্যবস্থাপত্রের ওষুধের হিসাব থেকে বোঝা যায়। রোগী কি অন্তঃসত্ত্বা কি না ! তো রবিজীবনীতে প্রশান্ত বাবু পরিষ্কার জানিয়েছেন,

‘এ বিষয়ে আর কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য না পাওয়ায় আমরা মন্তব্য প্রকাশে বিরত রইলাম।’ (রবীজীবনী ৫ম খণ্ড, ৮৭ পৃষ্ঠা)।

মাত্র ২৯ বৎসরের রমণী আমি, যার স্বামীও খুব শক্তসমর্থ, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়তে তো পারি। কিন্তু কী আশ্চর্য জানো আমিও ঠিক বলতে পারছি না আসলেই কি ঘটেছিল ! তোমার মনে আছে ? সত্যি কি আমি …, দূর হলেই বা কী, ওরকম প্রাথমিক পর্যায়ের খবর পাঁচ সন্তানের জননী এবং কাজে কর্মে দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় নিজের কাছে ধরা নাও পড়তে পারে। অন্তত তেমন প্রাথমিক সময়ে। তবে এখন মনে হয়, আমার যে খুব অনিরাময়যোগ্য ব্যধি হয়েছিল তা নয়, হয়তো অতিরিক্ত ব্যস্ততা এবং ঠিক চিকিৎসার অভাবে ছোট সমস্যাই বড় হয়ে উঠেছিল। মনে আছে, তোমার আশ্রমের শুরুর প্রথম দিকে, আমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে এলে সপ্তমবারের মতো, ১৯০২-এর মার্চ এপ্রিলে। এসেই তোমার ছাত্রদের তত্ত্বাবধানের জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার রথীও আশ্রম ছাত্রদের সঙ্গে থাকত, খাওয়া দাওয়া করত। ওদের জলপানির সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নিয়ে নিই। সেই সময় চুলার আগুনের পাশে বসে বসে ও তো রান্না, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত কাজ করা হয়তো আমার শরীর আর নিতে পারছিল না। অন্যরাও তখন তাই বলেছে, সে জন্য মনে হয়, হয়তো আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলাম বলে শরীর ভিতর থেকে নাজুক হয়ে পড়েছিল। না হলে আমি তো খুব কাজ করতে পারতাম। কলকাতা বা শিলাইদহে, শান্তিনিকেতনে আমি খুবই ব্যস্ত থেকেছি সব সময়। তোমার আত্মীয়স্বজনরা আমার রান্না, হাতের মিষ্টি খুব পছন্দ করত। আমিও উৎসাহে তা সব সময় করেছি। তোমার ঠিক যোগ্য না হয়েও যেমন ভালোবাসা পেয়েছি, তেমনি আমার শ্বশুর বাড়ির সকলেই আমাকে পছন্দ করত, ছোট বউ হিসেবে সবার আদর পেয়েছি। আমার মনে হতো যে জ্ঞানদা বউদি থেকে আমাকেই তোমাদের বাড়ির লোকেরা, আমার শ্বশুরমশাই বেশি পছন্দ করতেন। আমারও ভালো লাগত। কলকাতাতে তো সেজন্য আমার বেশি থাকতে ইচ্ছে করত। যে কথা তোমাকে বলতে পারিনি, বলতে চাইও না। সে-সময় চেষ্টা ছিল তোমার কাজের জন্য তোমার পাশে পাশে থাকা। গাজীপুরে আমাদের প্রথম নিজস্ব সংসার আর শিলাইদহে আমার বড় সুখের স্মৃতি হয়ে আছে, তুমি যখন বাইরে থেকে আমাকে ডাকতে ডাকতে আসতে ‘ছোট বউ ছোট বউ’, তখন আনন্দে আমার প্রাণ নেচে উঠত। আর তোমার বিখ্যাত বন্ধু আমার সখী অমলা দাশের দাদা চিত্তরঞ্জন দাশ আমার হাতের লুচি মাংস খাবার বায়না বাড়ির সিঁড়ি থেকেই জানাতেন। আর নাটোরের একদা মহারাজ জগদীন্দ্রনাথ রায় আমার হাতের তৈরি দইয়ের মালপো কীই না প্রশংসা করতেন। তা ছাড়া তোমার জন্য করতেই হতো-চিঁড়ের পুলি, পাকা আমের মিঠাই, কত রকমের সন্দেশ। আমি এসব ক’রে খুব সুখ পেতাম। আবার এসব সুখের মধ্যে কখনো কখনো তোমার উদাসীন মন্তব্যে বেশ কষ্টও পেয়েছি। একবার শখ করে তোমার জন্মদিনে সোনার বোতাম অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছিলাম। বোতাম দেখে তুমি কেমন করে বললে, ‘ছি ছি, পুরুষমানুষে কখনও সোনা পরে ?’ জানো কষ্টে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। সেই সব সময়ের কত কথা, বিশেষ করে তুমি যখন গান বাঁধতে আমার এখনও বেশ মনে পড়ে একটা গানে সুর চড়িয়েই ডাকছ ‘অমলা ও অমলা শিগগির এসে শিখে নেও, এক্ষুনি ভুলে যাব কিন্তু।’ আমি হেসে বলতাম, ‘এমন মানুষ আর কখনও দেখেছ অমলা, নিজের দেওয়া সুর নিজে ভুলে যায়।’ আর তুমি হেসে চট জলদি বলতে, ‘অসাধারণ মানুষদের সবই অসাধারণ হয় ছোট বউ, চিনলে না তো।’ এসব কথাই দেখলাম তোমাকে নিয়ে লেখা অমিতাভ চৌধুরী, একত্রে রবীন্দ্রনাথ, (পৃষ্ঠা ২১৪) গ্রন্থে। অমলার কণ্ঠে মানাবে এমন সুর তুমি বাঁধতে। আমার এই সখীকেই মেয়েদের মধ্যে প্রথম গ্র্রামোফোন রেকর্ডে গান গাইবার অনুমতি তুমি দিয়েছিলে। তার আগে গৃহস্থ ঘরের কোনো মেয়েই এই অনুমতি পায়নি। তবে কয়েকজন বাইজি যেমন মানদাসুন্দরী, পূর্ণকুমারী ও আশ্চর্যময়ী প্রমুখ তোমার গান রেকর্ডে করলেও সেগুলি তোমার কথার ওপর নিজেদের সুর চড়িয়ে দিত, কথারও বদল হতো, ফলে বাইজিদের সে-সব গানকে বিবেচনা না করাই ভালো। আমার অমলা সখীই প্রথম তোমার অনুমতি নিয়ে রেকর্ডে গান গাইতে আরম্ভ করেছিলেন। তবে রেকর্ডে কখনো অমলার নাম লেখা হতো না কেন বলতে পার ! অমলা দাশের বদলে গরংং উধং লিখে কি ব্যবসা কি সমাজ উদ্ধার হয় বুঝতে পারি না। এই বিষয়ে তোমার উদ্যোগ থাকলে অমলা স্বনামেই রেকর্ডে রেকর্ড হয়ে যেত।

কথার পিঠে কত কথা, স্মৃতির পর স্মৃতি বারবার প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে। এসবই তো স্মৃতি, স্মৃতির স্মরণ কি ক্রমিকতা অনুসরণ করে ! অবাক লাগে তোমার মতো বড়ো মানুষের সংসারে এসেছিলাম বলেই মাত্র ১৯ বৎসরেরও কয়েকদিন কম সময়ের সংসারে এতো কথার ভিড় ! এতো গার্হস্থ মানুষের আটপৌঢ়ে সংসার নয়। সে কারণে এই অনন্ত যাত্রা পথে স্মৃতিরা মেঘপুঞ্জের মতো আমাকে ঘিরে যখন ভেসে বেড়ায় তখন দুনিয়ার মানুষের মতো মনে অভিমান হয়, এতো দ্রুত, এতো অল্প সময়ের মধ্যে কেন বিদায় নিতে হলো ! তোমার সঙ্গ ও সংসারের আশ্চর্য দিনগুলো আর কখনো পাবো না। হ্যাঁ গো, আমার কবি, প্রাণাধিক রবি পারলে না তোমার ছোটবউ, ভাই ছুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। তোমার হাতের সেবা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হইনি, মহা পু ণ্য অন্য কোনো জন্মে অর্জন করেছিলাম, না হলে স্ত্রী হিসেবে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের হাতের সেবা জোটে ! কিন্তু সেবাই সব ! সেবা তো আমাকে সংসারের অভাবিত সুখের জঙ্গমতায় বাঁচিয়ে রাখতে পারল না। তোমার আত্মীয়া সে ইন্দিরা বা হেমলতা হোক যখন পুরোমাত্রায় আধুনিক এ্যালোপাথি চিকিৎসা না করিয়ে নিজে যখন হোমিও দিয়ে চেষ্টা করলে তখন তোমার চেষ্টাকে কটাক্ষ করে লিখেছে। ইন্দিরা তো তোমার এক বন্ধুর আক্ষেপের সূত্র ধরে বলেছে, মানে তোমার বন্ধুদের মধ্যেও হোামিও-এর ওর বেশি নির্ভরতার জন্য আড়ালে কথা বলেছে। ইন্দিরা লিখছে-

‘ বিশেষ বিশেষ চিকিৎসা-পদ্ধতির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসও তাঁর [রবীন্দ্রনাথের] ছিল। যথা, হোমিয়োপ্যাথি এবং বায়োকেমি। নিজে অনেককে ওষুধ দিতেন এবং তাতে উপকার হয়েছে শুনলে খুব খুশি হতেন। কাকিমার শেষ অসুখে এক হোমিয়োপ্যাথি ধরে রইলেন ও কোনো চিকিৎসা বদল করলেন না বলে কোনো কোনো বিশিষ্ট বন্ধুকে আক্ষেপ করতে শুনেছি।’ (রবীন্দ্রস্মৃতি – পৃষ্ঠা ৬২)।

তবে তুমি বিখ্যাত এ্যালোপাথি’র ডঃ ডি. এন. চট্টোপাধ্যায়কে সহ অনেককে দেখিয়েছ সত্য। তোমার মনের মধ্যে আমার আরগ্য লাভের ফল আরও দ্রুত ঘটবে ভেবে নিয়েছিলে। হলো না যখন তখনই শুধু বেশি করে হোমিয় নির্ভর হয়েছ। নিজেই আবার সেই চিকিৎসার ভার নিলে, যদিও বিখ্যাত হোমিয়প্যাথ ডি. এন. রায়, প্রতাপ মজুমদারের পরামর্শেই করেছ। তোমার ব্যবস্থাপত্র সম্বন্ধে তাদের অনুমোদন পেয়েছ, সবই ঠিক। কিন্তু এ্যালোপাথির মতো বিজ্ঞান-নির্ভর চিকিৎসার ফল পাওয়ার জন্য অধর্য না হলে কি ভালো হতো না ! এসব এখন মনে হয়। তোমার ছেলে রথীন্দ্রনাথও বলেছে- ডাক্তাররা আমার অসুখ ধরতে না পারায় তুমি তোমার চিকিৎসা ব্যবস্থায়-

‘এ্যালোপ্যাথ ডাক্তাররা কী অসুখ ধরতে না পারায় বাবা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করাতে লাগলেন। তখনকার দিনে প্রসিদ্ধ ডাক্তাররা প্রতাপ মজুমদার, ডি. এন. রায় প্রভৃতি সর্বদাই বাড়িতে আসতে থাকলেন। তাঁরা সকলেই বাবাকে সমীহ করতেন, এমন-কি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিদ্যায় তাঁদের সমকক্ষ মনে করতেন। মায়ের চিকিৎসা সম্বন্ধে বাবার সঙ্গে পরামর্শ করেই তাঁরা ব্যবস্থা দিতেন। এঁদের চিকিৎসা ও বাবার অক্লান্ত সেবা সত্ত্বেও মা সুস্থ হলেন না।’ (পিতৃস্মৃতি পৃষ্ঠা ৮১)

যাই বলো, মনের আক্ষেপ থেকেও হতে পারে, মনে হয় তুমি অধর্য হয়ে পড়েছিলে শুধু নয়, এ্যালোপাথির ওপর তোমার ভরসাও কম ছিল। রোগ নির্ণয় অনেক সময়ই সময়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। তার জন্য কিছু সময় বড় ডাক্তারদের দিতে হয়। তোমাদের হোমিয় কি পেরেছিল রোগের জাত ঠিকঠাক চিনতে ! তোমার হোমিয়’র ওপর ভরসা থেকেই এরপর রাণীর চিকিৎসা চলল। আমার মেয়েটাও অভিমান ভরা রাণী কৌশর অতিক্রম করার আগেই বিদায় নিল। আমার অসুখের শেষ পর্যায়ে তুমি পাশে বসে সেবা করেছ, তালপাতার পাখা দিয়ে ঘরের গুমোট দূর করতে চেষ্টা তোমার ছিল। কিন্তু তোমাকে আমি কতক্ষণ পেয়েছি ? রোগের প্রথম থেকে বেশি সময় শান্তিনিকেতনে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি একাই ছিলাম। তুমি বড় বড় হোমিয় ডাক্তারের পরামর্শ মতো শান্তিনিকেতনে ওষুধ পাঠাতে। অসুখের বাড়াবাড়ি হলে আমার ভাইকে পাঠিয়ে তুমি কলকাতায় আনিয়ে নিলে। তখনো তোমার মতো বড় মানুষের, ব্যস্ত মানুষের আমার পাশে বসার জন্য সময় কমই হতো। মৃত্যুর আগের মাসটি কার্তিক, কার্তিকের ৪, ৫, ৮, ৯, ১০, ১১, ১৩, ১৬, ১৭, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৬. ২৭, ২৯, ৩০ এবং মৃত্যুর মাস অগ্রহায়ণের ১ম দিকে প্রায় প্রতিদিনই তুমি বেরিয়েছ, সভা সমিতি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ইত্যাদি নিজের কাজ করতে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, বউবাজার, সুফিয়া স্ট্রিীট, বাদুড়বাগান, পার্শিবাগান, রায়বাগান, গোলতলা, রাজাবাগান, যোড়াপুকুর ইত্যাদি এলাকায় গেছ। তুমি খুব বড় মানুষ বলে তোমার সবরকম চলন-বলনের রেকর্ড রাখা আছে। এর মধ্যে অবশ্যই তুমি হোমিয় ও এ্যালোপ্যাথি ডাক্তারদের সঙ্গেও পরামর্শ করতে যে গেছ তা ঠিক।

তালপাতার পাখার বাতাস সম্পর্কে বলি, আমার শেষ শয্যা পাতা হয়েছিল তোমার লালবাড়ির দোতলায়। তখন ওই বাড়িকে নতুন বাড়িও বলা হতো, আরো পরে হয়েছিল বিচিত্রা। এ বাড়ির সামনেই ছিল গগনদের বিরাট অট্টালিকা। সেখানে আলো বাতাসের অভাব ছিল, সেজন্য তালপাতার বাতাস করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অমন ঘরে কেন আমাকে রাখা হলো ! দোতলার লম্বা ঘরে পরপর আলমারি রেখে একরকম পার্টিশন বানিয়ে তিনটি ঘর বানিয়ে নিলে। তার একটি ঘরেই আমার শয্যা। ছোটমেয়ে মীরা দেবী স্মৃতিচারণ করে বলছে-

‘একটা ঘরে আমরা থাকতুম। সব চেয়ে শেষের পশ্চিমের ঘরে মাকে রাখা হল নিরিবিলি হবে বলে। আমাদের বাড়ির সামনে গগনদাদাদের বিরাট অট্টালিকা থাকাতে কোনো ঘরে হাওয়া খেলতা না। সে বাড়িতে তখন বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না, তাই একমাত্র তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা ছাড়া গতি ছিল না। ঐ বাতাসহীন ঘরে অসুস্থ শরীরে মা না জানি কত কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু বড়বউঠান হেমলতা দেবীর কাছে শুনেছি যে বাবা মা’র পাশে বসে সারা রাত তালপাখা নিয়ে বাতাস করতেন।‘ (স্মৃতিকথা, পৃষ্ঠা ১৯-২০)।

আমার মৃত্যুর সময় মীরা (১৮৯৩-১৯৬৯) বাচ্চা একটা মেয়ে, আমার স্মৃতি দীর্ঘকাল পরে ওর কতটুকু মনে থাকবে ! নিজেই সে কথা শুরুতে বলছে, মাকে আমার স্পষ্ট মনে না থাকলেও আবছায়া মত মনে পড়ে। খানিকটা হয়তো বাস্তবে ও কল্পনায় মিশে গেছে, যেটুকু মনে আছে তাই বলছি।’ (ঐ, পৃ ১৮)। মীরার এই বড়ো বউঠান আরও অনেক কথাই বলেছে। তার সবটুকু সত্য নয়, মিথ্যাই বা কতটুকু ! যেমন সত্যিই তো তুমি আমার চোখের মণি ছোট ছেলে শমীকে আমার কাছ থেকে নিয়ে সুবোধচন্দ্র বাবুকে (মজুমদার) দিয়ে শন্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিলে। আমার কিন্তু সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল। ছেলেটা বাবা মা ছাড়া শান্তিনিকেতনে থাকবে! তখনো তো তোমার আশ্রমের সব ব্যবস্থা আজকের মতো সুচারু হয়ে ওঠেনি। আমি ছেলেমেয়েদের বিকেলের জলপানির ব্যবস্থা নিজে হাতে করে দিতুম, কারো অসুখ হলে নিজের কাছে রেখে মাতৃস্নেহে সারিয়ে তুলতুম। এখন কী হবে ! আমিও নেই। তার মধ্যে ছোটছেলেটিকেও পাঠিয়ে দিলে! তো সেকথাই হেমলতা লিখেছে, সত্যি কথাটাই লিখেছে তার ‘সংসারী রবীন্দ্রনাথ’ স্মৃতিকথায়। লেখা প্রকাশ হয় প্রবাসী’র পৌষ সংখ্যায় (১৩৪৬)। ‘আচ্ছন্ন অবস্থায় কবি-পত্নী অনেকবার বলতেন,

“আমাকে বলেন ঘুমাও ঘুমাও, শমীকে রেখে এলেন বিদ্যালয়ে, আমি কি ঘুমাতে পারি তাকে ছেড়ে ! বোঝেন না সেটা !”

তুমি কবি, ভাবুক, সমাজ-হিতৈষী, উদাসীন নও। মানুষের জন্য পরিবারের জন্য তোমার ভাবনার অন্ত ছিল না। সংসারের সবার মঙ্গলের চিন্তা তোমার ছিল। তাহলে তোমার এই কর্তব্যপরায়ণ মনে ও চোখে এও বুঝেছ, দেখেছো-শান্তিনিকেতন বা শিলাইদহে শুধু নয় তোমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও আমি আমার সাধ্যমতো সবার সেবা যতœ করেছি। অন্যদের ভালোবাসাও পেয়েছি। কাজ করেই আনন্দ পেতাম, সত্যি বলতে কি আমার মতো অতি সাধারণ একটি মেয়ে এমন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান পরিবারে ওইটুকু কাজ কর্ম করেই জায়গা ক’ের নিয়েছিলাম, সংসারের নিত্য কাজেও অসমর্থ হলে আমার কি অবস্থা হতো ! আমার সে সময়ের সংসারী জীবনের কথা রথীও মনে করে সব লিখেছে, পড়ে দেখ-

‘বাবা ছিলেন তাঁর নিজের ঘরে লেখাপড়া নিয়ে। মা ছিলেন তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংসারের কাজে। সেই জন্যই ছেলেবেলার কথা মনে করতে গেলে মায়ের কথাই বেশি মনে পড়ে। তাঁর নিজের পাঁচটি ছেলেমেয়ে, কিন্তু তাঁর সংসার ছিল সুবৃহৎ। বাড়ির ছোটো বৌ হলে কি হয়, জোড়াসাঁকো বাড়ির তিনিই প্রকৃত গৃহিণী ছিলেন। তাঁর কাছে সকলেই ছুটে আসত তাদের সুখ দুঃখের কথা বলতে। সকলের প্রতি তাঁর সমদৃষ্টি ছিল, তিনি ছিলেন সকলের দুঃখে দুঃখী, সকলের সুখে সুখী। তাঁকে কোনদিন কর্তৃত্ব করতে হয় নি, ভালবাসা দিয়ে সকলের মন হরণ করেছিলেন। সেই জন্য ছোটরা যেমন তাঁকে সমীহ করত, বড়রা তেমনি স্নেহ করতেন। সকলের মধ্যে বলুদাদা তাঁর বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন।’ (পিতৃস্মৃতি)।

আর তুমি আমার ছোট ছেলেটারে একা থাকতে পাঠিয়ে দিলে? ওকে ছাড়া আমার সত্যিই ঘুম আসত না। হেমলতা ভুল লেখেনি গো। হেমলতার ওই একই লেখার এক স্থানে আছে আরও প্রসঙ্গ, এতে তোমার বিরুদ্ধে লোকে কথা বলার সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু কথাটা তো অসত্য নয়, তবে কিছু অসতর্ক ভুল করতেই পারে। আর সেটা হলো আমার রোগ শয্যায় সেবা যত্ন বিষয়ে। হেমলতা লিখেছে,

‘প্রায় দু-মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন; ভাড়া-করা নার্সদের হাতে পতœীর শুশ্রুষার ভার কবি এক দিনের জন্যও দেন নাই। . . . ভাড়াটে শুশ্রুষাকারিণীর প্রচলন তখন ঘরে ঘরে; কবির ঘরে তার ব্যত্যয় ঘটল প্রথম।’ (সংসারী রবীন্দ্রনাথ)

কথাটা একদিকে সত্য পেশাদার নার্স বা সেবকদের বদলে তুমি নিজের হাতেও, বাড়ির অন্যরা সেবার কাজটি করেছো। অসুস্থতার অনির্ণেয় জটিলতা তোমরা জানতে না, নার্সও নিশ্চয় বুঝতে পারত না, কারণ দু’ধরনের ডাক্তারি বিদ্যা অপারগ হয়েছে জটিলতা বুঝতে। কিন্তু নার্স তার প্রশিক্ষণের গুণে এ ধরণের রোগিকে কিভাবে ওঠ বস, ঔষুধ খাওয়ানো ইত্যাদি নিশ্চয় সাধারণের চেয়ে ভালো জানত, ভালো করত ! তাছাড়া তুমি তো খুবই কাজের মানুষ কত রকমের বিষয় মন ঘিরে আছে, তোমার সময় কত প্রয়োজন আমি বুঝি সেখানে, যেখানে এই সেবা করে সময় নষ্ট করার মতো সময় কোথা! তবুও তুমি অনেক সময় দিয়েছ, এ শুধু তোমার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা নয়, তোমার কল্যাণকামী শুভ মনের পরিচয়। তবে যখন আমার অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকল, বেডপ্যান টমাক টিউব ব্যবহার করা ছাড়া উপায় ছিল না, তখন কিন্তু তুমি ঠিক নার্স ও দাই নিয়োগ করেছিলে। তোমাদের হিসেবের খাতায় নার্সের পারিশ্রমিক প্রতিদিন ২ টাকা মোট ২৬ টাকা পরিশোধের কথা আছে। দাইয়ের যাওয়া-আসার খরচের হিসেবও আছে। তাছাড়া বেশ পড়ে কিন্তু ছোটমেয়ে মীরা বা বউমা প্রতিমা অসুস্থ হলে ওদের জন্য নার্স আনা হয়েছিল প্রথম থেকেই। আমার সেবার জন্য যে তুমি নার্স না রেখে নিজেই সেবা করেছ সে-কথা রথীও লিখেছে। শেষ ক’দিনের জন্য নার্সকে নিয়োগ দেওয়া হেম বা রথী মনে রাখেনি। রথী লিখেছে, ‘… এক মাস ধরে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) অহোরাত্র মা’র সেবা করেছেন, নার্স রাখতে দেননি, শ্রান্তিতে শরীর মন ভেঙ্গে পড়ার কথা।’ (পিতৃস্মৃতি)

তোমার তুলনায় সংসারের বাকি আমরা সবাই খুবই সাধারণ, অশেষ রবীন্দ্রনাথের মন বুঝবার অসাধ্য, ওই মনের গভীরে পৌঁছে তার কথা, কষ্ট, বোধ বুঝে নিতে পারে এমন কেউ সংসারে ছিল না। মৃত্যুর অনেক পরে, অনন্ত যাত্রার অশেষ পথে ঘুরতে ঘুরতে এখন হয়তো আমি কিছু হলেও বোঝার চেষ্টা করছি। না হলে সাধারণ সাংসারিক বুদ্ধিতে তোমার বোধ উপলব্ধির কিনারা করা যাবে না। লোকে বলতে পারে, বলেও, তোমার একজন জীবনীকার মন্তব্যও করেছেন, আমার মুখাগ্নি তুমি রথীকে করতে দেওনি, এমন কী মৃত্যুর পর আমাকে আর কোনো ছেলে মেয়েকে দেখতে দেওনি। মৃত্যুর ঠাণ্ডা বিবর্ণ মুখশ্রী দেখে কী হতো ! তার চেয়ে চিরকালের স্নেহময়ী মায়ের জাগরুক রূপটিই সন্তানের স্মৃতিতে বেঁচে থাকুক এই তোমার হয়তো ভাবনা ছিল। এমন শান্ত বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনা আটপৌঢ়ে মানুষ কিভাবে করবে বলো ! মুখাগ্নির মাধ্যমে একটি ধর্মীয় সংস্কার হয়তো পালন হয়, কিন্তু তোমার মন যে দিনে দিনে ধর্মের অপ্রয়োজনীয় সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে উঠতে চেয়েছে। প্রচলিত অনেক ধর্মীয় সংস্কার ও ধর্মবোধ, বিশ্বাস যেমন তোমার মনে খুব স্থায়ীভাবে ছিল না, তেমন ভাবে তোমার সন্তানদের মনেও তেমন সংস্কার দখল থাক চাও নি। তো মুখাগ্নির মতো ধর্মীয় সংস্কারের প্রতি যদি বিশ্বাস আবেগ না থাকে তাহলে ওই মুখাগ্নি মনের শান্ত সৌম্য অন্দরে অনল হয়ে জ্বলবে, কষ্ট দিবে। তোমার মুখাগ্নিও রথী করেনি। এজন্য তোমার আমার রোগে জীর্ণ, ব্যথা বেদনায় ক্লান্ত জীবনের শেষ দিনগুলো থেকে মৃত্যুর পথে মুক্তি পেয়ে আনন্দযাত্রায় কোনো বিঘœ ঘটেনি। আমার স্নেহের সন্তানদের যে আমার মরা মুখ দেখতে দেওনি, এজন্য এখন কৃতজ্ঞ বোধ করছি, অবুঝ মন তোমার নিন্দা করুক, মন্তব্য করুক। আমি বা তোমার সন্তানেরা তাঁদের পিতামাতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুখাগ্নি করতে না পারার আক্ষেপ কেউ করেনি। শ্মশানের পথে আমার শেষ যাত্রায় রথীরা ছিল না। এটা সাধারণের আশ্চর্য লাগতেই পারে। জীবনীকার প্রশান্তকুমার মন্তব্য করছেন-

“আশ্চর্য লাগে, শেষযাত্রায় জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথকেও নিয়ে যাওয়া হয়নি। পুত্রের হাতের আগুন মাতা পাননি, ঘটনাচক্রে পিতাও তা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন।”

রথী বঞ্চিত হয়নি, কারণ মুখাগ্নি তার আকাঙ্খা ছিল না। মায়ের অকালমৃত্যু যদি আকাঙ্খিত না হয়, মুখাগ্নিও নয়। অসাধারণ এক জ্ঞান বরং লাভ করেছে। আমার আয়ু যখন শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছে, তখন কিন্তু তুমি ঠিকই শান্তিনিকেতন থেকে সন্তানদের আনিয়ে আমার পাশে বসালে। আমি ওদের মুখ দেখলাম। যন্ত্রণা শোক ঢেকে ভগবানের দরবারে শুধু প্রার্থনা জানালাম আমার শোক যেন ওদের বিমর্ষ না করে, ওরা যেন ভালো থাকে। অগ্রহায়ণের ১ তারিখে ওদের কলকাতায় আনা হল। রথী এই কথাও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে লিখেছে:

‘মৃত্যুর আগের দিন [৬ অগ্র শনি ২২ নভেম্বর ১৯০২] বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন। তখন তাঁর বাক্রোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা। আমাদের ভাইবোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরানো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কার মধ্যে আমাদের সারা রাত জেগে কাটল। ভোরবেলায় অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, নিঝুম; কোনো সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম আমাদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” (পিতৃস্মৃতি)

রথীর লেখা থেকে ভালোভাবে বুঝতে পারি তোমার শোক-জর্জর মনের কথা। শিশু কিশোর বয়স থেকে তোমার সন্তানেরা দেখেছে কীভাবে ব্যক্তিগত আবেগ কষ্ট দশজনের সামনে প্রকাশ না করে নিজের মধ্যেই আড়াল করে রেখেছ। অন্যের সহানুভূতির পাত্র হওয়া তোমার স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গভীর কষ্টকে আড়াল করে বাইরে শান্ত সহজ আচরণ করে যাও, অন্যদের হাহাকার প্রকাশ করার সুযোগ থাকে না। কৈশোর থেকে মায়ের মৃত্যু বউঠানের মৃত্যুসহ সব নিকটজনের একে একে মুত্যুর ব্যক্তিগত শোক অনুভূতি প্রকাশ ও উদয়াপনের এমন এক সংস্কৃতি তৈরি করে নিয়েছ যা অন্যের পক্ষে অবোধগম্য। প্রিয় বউঠানের মৃত্যুশোক আজীবন বহন করেছ। কবিতা গানে কখনো বা নিকট কারো কাছে সেই কষ্টের কথা, কখনো কাব্যিক কখনো দার্শনিক ভাবুকতায় প্রকাশ হয়েছে। আদরের মেয়ে বেলা, রাণী, স্ত্রী, পিতার মৃত্যুশোক এবং আরো বড় হৃদয় বিদারক শোকে তোমার হৃদয় দীর্ণ করে দেয় ছোট ছেলে শমী, তোমার শমী ঠাকুরের অকাল মৃত্যু হলে। তুমি ছাদের ওপর অন্ধকার আর নক্ষত্রের নিচে অথবা নিজের ঘরে জীবন মৃত্যু সুখ ও শোকের অর্থ, কার্যকারণ এবং তা মানব জীবনে উপলব্ধির পথ খুঁজে ফিরেছ। মহাভারতের সেই অমর শ্লোক (শান্তিপর্ব) বারবার আবৃত্তি করে গভীর দুঃখের ঘোর সরিয়ে মনে এনেছ শান্তি, শান্ত স্বাভাবিক থাকার পথ করে নিয়েছ। লিখেছিলে, তখন ভালো করে বুঝিনি, আমাকে লেখা এক চিঠিতেও শ্লোকটি সংস্কৃতি ভাষাতেই ছিল, সুখং বা যদিবা দুঃখং প্রিয়ং বা যদিবাপ্রিয়ং প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা। এ না হলে সৃষ্টিশীল বিশ্ব ও কর্মসাগরের জন্য শক্তি কোথায় পাবে ! এ এক অনন্য মনের গড়ন, শান্তি পর্বের শ্লোকটি- তোমার অনুবাদে-

সুখ বা হোক্ দুখ বা হোক্
প্রিয় বা অপ্রিয়
অপরাজিত হৃদয়ে সব
বরণ করে নিয়ো।

শ্লোকটির আরও একটি অনুবাদও তুমি করে নিয়েছিলে পরে।

সুখ হোক দুঃখ হোক,
প্রিয় হোক অথবা অপ্রিয়,
যা পাও অপরাজিত
হৃদয়ে বহন করি নিয়ো।

এ শুধু কথার কথা ছিল না, কাব্যিক হেঁয়ালি ছিল না, মৃত্যু শোককে শক্তিতে পরিণত করা তোমার সফল সাধনায় সম্ভব হয়েছিল। বুঝে নিয়েছিলে শোক দুঃখ ও বিপর্যের ভিতর মঙ্গলের পথে চলার শক্তি অর্জন প্রকৃতিরই অভিপ্রায়, এ তোমার অন্তর্গত বিশ্বাসে সত্য হয়ে ওঠে তোমার নিজের কাছে। আমার মৃত্যুর কয়েক দিন পর ১৮ অগ্রহায়ণ ব্রজেন্দ্র কিশোর দেবমাণিক্যকে লিখেছ-

‘ঈশ্বর আমাকে যে শোক দিয়েছেন সেই শোককে তিনি নিষ্ফল করিবেন না- তিনি আমাকে এই শোকের দ্বার দিয়ে মঙ্গলের পথে উত্তীর্ণ করিয়া দিবেন।’ (রবিজীবনী পঞ্চম খণ্ড)।

তোমার অনুরক্ত যুবা বয়সের মোহিতচন্দ্র সেনকেও তুমি প্রায় অনুরূপ লিখেছ-

‘ঈশ্বর আমার শোককে নিষ্ফল করিবেন না। তিনি আমার পরম ক্ষতিকেও সার্থক করিবেন তাহা আমার হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিয়াছি। তিনি আমাকে আমার শিক্ষালয়ের এক শ্রেণী হইতে আর এক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করিলেন।’ (বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩৪৯)।

নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের এই মোহিতচন্দ্রের কথা কিছু বলতে হয়, তোমার ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ছেলেটি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে সেই সময়ে আশ্রমটি যখন খুব আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে, আমি আমার সমস্ত সোনার গহনা এনে তোমার হাতে দিলাম (১৯০১-এর) ব্যবস্থা করে অর্থ সংগ্রহ করার জন্য। তোমার মনে তখন কিছু হলেও শান্তি এসেছিল। তবে যখন মোহিতচন্দ্র তার অল্প আয়ের সঞ্চয় থেকে আশ্রমের সংকটে ১৯০৩ সালে ১,০০০ টাকা দান করেন তখন তুমি অভিভূত হয়েছিলে। এক চিঠিতে তুমি মোহিতকে লিখলে-

‘ধনীর দানে আমাদের বাহ্য অভাব মোচন হইত মাত্র, কিন্তু আপনার দানে আমাদের বল ও নিষ্ঠা বাড়িয়া গেছে।’

মোহিতও আমার মতো, তেমন বড় অসুখ না বাধিয়েই মাত্র ৩৫ বৎসরে মরে গেল। আমার মৃত্যু একদিকে শোক অন্যদিকে তোমাকে অসহায় করে তোলে। মীরা, শমী খুব ছোট, রথীই বা কতটুকু, রাণীর শরীরও দিন দিন খারাপ হওয়ার পথে; তার মধ্যে আশ্রম পরিচালনা, আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠা। সংসারের তবুও একটা ব্যবস্থা আমিই করে এসেছিলাম রাজলক্ষী পিসীমাকে (পিসীমার সপতœী) অনুরোধ করে আমার সংসার ও সন্তানদের ভার নেয়ায় সম্মত করিয়ে। পিসীমা আমার কথা রেখেছেন, এ বিষয়টা দেখলাম হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যয় তার ‘কবির কথা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-

‘মৃণালিনী দেবী যখন শয্যাগত, সেই সময়ে তাঁহার পিসীমার সপতœী রাজলক্ষ্মী দেবী তাঁহাকে দেখিতে কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। সপতœী হইলেও মৃণালিনী দেবীর প্রতি আপন পিসীমার মতই তাঁহার অকৃত্রিম স্নেহ ছিল। সেই সময় ভাইঝি তাঁহাকে বলিয়ােিছলন “পিসীমা, আমি শয্যাগত, ছেলেমেয়েদের বড় কষ্ট হচ্ছে। তাদের দেখাশুনা করার কেউ নেই, তাদের ভার নিলে নিশ্চিন্ত হইতে পারি।” পিসীমা ভাইঝির কথা রক্ষা করিয়াছিলেন, সেই দিন হইতেই তিনি সংসারে থাকিয়া শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার গ্রহণ করিয়ােিছলন। শান্তিনিকেতনে কবির নূতন বাড়ীতে সংসারের ভার লইয়া তিনি শিশুদের প্রতিপালন করিয়াছেন দেখিয়াছি। মীরা শমী তখন শিশু।’

হরিচরণ বাবু শুধু ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থের জন্যই শুধু বিখ্যাত নন, তাঁর স্মৃতিকথা থেকে আমাদের পরিবারের অনেক কথাই তোমার পাঠক গবেষক দেখি টুকে নেয়। শিলাইদহ সেরেস্তার কর্মচারী হরিচরণকে তার অসাধারণ সংস্কৃত জ্ঞানের জন্য শান্তিনিকেতনে এনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে অমর অবদানের সুযোগ করে দিলে। তুমি অনেকেরই জন্যে খোলা পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজের পথ খুলে দিয়েছ। তাদের কেউ কেউ সংকটকালে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন, বই লিখেছেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আবার অন্যদিকে সংকটকালে কলকাতার শিক্ষিত পণ্ডিতজন, অবস্থা সম্পন্ন বন্ধুর কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাওনি। মোহিতচন্দ্র সামান্য উপার্জনের থেকে ১০০০ টাকা তুমি না চাইতেই আশ্রমে দান করে তোমাকে মানসিক আনন্দ দেন, আবার ধনী বন্ধু বিখ্যাত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত’র মতো অনেকে প্রয়োজনের সময় তোমার আবেগী আবেদনের প্রতি সম্মান রাখতে পারেন না। তোমার আশ্রমের আর্থিক সংকটকালে তুমি চিঠি লিখলে হীরেন্দ্রনাথ বাবুকে, আরও অন্যদেরকেও একই আবেদন জানিয়ে। আমার মৃত্যু হয়েছে অল্পদিন হলো, শোক ঠিক মতো কাটিয়ে ওঠার আগেই আশ্রমের অর্থ যোগাড়ে তোমাকে চিন্তিত হতে হলো, চিঠিতে পরলোকগত স্ত্রীর কল্যাণ কামনায় সামান্য সহযোগিতাকে ‘ভিক্ষাব্রত’ বলে প্রার্থনা করলে-

“আপনার সহিত আমার অনেকটা পরিচয় হইয়াছে বলিয়া বিশ্বাস জন্মিয়াছে। সেইজন্য সঙ্কোচ পরিহারপূর্বক আপনার কাছে একটি ভিক্ষা লইয়া উপস্থিত হইলাম। শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে কয়েকটি দরিদ্র বালককে বিনা বেতনে পড়াইয়া থাকি। তাহাদের ব্যয়ভার আমরা বান্ধবদের মধ্যে পরস্পর ভাগ করিয়া লইবার জন্য উদ্যত হইয়াছি। একটি বালকের ভার আপনি যদি গ্রহণ করেন তবে উপকৃত হইব। হিসাব করিয়া দেখা গেছে প্রত্যেক বালকের খাইখরচের জন্য মাসে প্রায় ১৫ টাকা অর্থাৎ বৎসরে ১৮০ টাকা লাগে। প্রতি বর্ষে অগ্রহায়ণ মাসে এই ১৮০ টাকা বার্ষিক দান পাইবার জন্য আমি সুহৃদগণের দ্বারে সমাগত। আপনাকে বলিতে সঙ্কোচ করিব না আমার পরলোকগত পতœীর কল্যাণকামনার সঙ্গে আমি এই ভিক্ষাব্রত জড়িত করিয়াছি।”(রবিজীবনী ৫ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৭) (রবিজীবনী ৫ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৭)

প্রখ্যাত দার্শনিক বন্ধু হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তোমার ভিক্ষা নামঞ্জুর করলেন। তোমার জীবনীকার বলছেন, ‘ভিক্ষাব্রত কতটুকু সফল হয়েছিল বলা শক্ত।’ তখন তখন প্রাপ্তির অর্থে সফল হয়তো হলো না। কারণ অল্প দিন পরেই ২২ অগ্রগায়ণ হীরেন্দ্রনাথ বাবুকে লিখলে, তোমার সে লেখায় উষ্মা ছিল :

‘আমি আপনাকে যে পত্র পাঠাইয়াছিলাম যদি তাহার প্রয়োজন না থাকে তবে এই লোক মারফৎ ফেরৎ পাঠাইবেন। পত্রটি অবশ্য প্রাপকের কাছে থেকে গিয়েছিল।’ (রবিজীবনী ৫ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৭)।

আমি বলব সফল হয়েছিল, ভালোভাবেই তুমি সফল-তোমার লক্ষ্যতো ছিল আশ্রমকার্য ঠিক মতো চালিয়ে নেয়া। ব্রহ্মাচর্যাশ্রম এক দিনের জন্যেও বন্ধ হয়নি, উত্তরোত্তর নানা শাখায় বিভাগে জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা পথে প্রবহমান থেকে বিশ্বের সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ পরিণত। বলব বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ষোলকলায় পূর্ণ আজ। এর পেছনে কাজ করছে ওই তোমার মনের একাগ্র ইচ্ছা শক্তি। তোমার মতো করে তোমার ভগবানের কাছে এই শক্তিই তুমি প্রার্থনা করেছিলে, রোগ শোক দুঃখ বিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে তুমি যেন মঙ্গলময় পথে যাওয়ার শক্তি অর্জন করতে পার। সব কষ্ট শোক যেন বৃথা না যায়। তোমার সাহিত্য শিল্প সঙ্গীত ধর্ম সমাজ ভাবনা যারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং যারা গ্রহণ করতে অপারগ ছিল তারা সবাই কালে তোমাকে সম্মান করতে বাধ্য হবে। তা শুধু বিদেশিদের স্বীকৃতি নয় দেশের জন-মানুষের মধ্যে দিনে দিনে তোমার কীর্তি প্রেরণার ও আনন্দের হয়ে উঠতে থাকলে বিচ্ছিন্ন থাকা আর সম্ভব হয় না নিজেদের স্বার্থেই।

মাতৃশোক তোমার হৃদয়ে সেইভাবে ক্ষত তৈরি করতে পারেনি, মায়ের স্নেহমাখা হাতের স্পর্শ কমই জুটেছিল। কিন্তু স্নেহ, বন্ধুত্ব আর উৎসাহে উজ্জীবিত করা বউঠানের অকাল মৃত্যুর শোক শেষ পর্যন্ত বহন করলেও এর মধ্য থেকে শক্তি খুঁজে নিয়েছ। বন্ধন থেকে মুক্তির স্বাদ ও শান্তি অনুভব করে নিজেকে কর্ম জগতে এবং নতুন স্ত্রী ও সংসারে ব্যস্ত হয়ে ওঠার সুযোগ করে নিয়েছিলে। জীবনস্মৃতিতে সেই সময়ের মনের ভাব লিখলে, তখন তো মাত্র ২২ বছরের যুবক তুমি, তখনি এমন উপলব্ধি তোমার !

‘…যাহাকে ধরিয়াছিলাম তাহাকে ছাড়িতেই হইল, এইটাকে ক্ষতির দিক দিয়া দেখিয়া যেমন বেদনা পাইলাম তেমনি সেইক্ষণেই ইহাকে মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া একটা উদার শান্তি বোধ করিলাম। সংসারের বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবনমৃত্যুর হরণপুরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারিদিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, সে-ভার বন্ধ হইয়া কাহাকেও কোনোখানে চাপিয়া রাখিয়া দিবে না-একেশ্বর জীবনের দৌরাত্ম্য কাহাকেও বহন করিতে হইবে না-এই কথাটা একটা আশ্চর্য নূতন সত্যের মতো আমি সেদিন যেন প্রথম উপলব্ধি করিয়াছিলাম।’ (জীবনস্মৃতি)

বউঠানের শোকে হাহাকার কবিতা গানে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ল। কত গদ্যে, কথায় আবরণাহীন ভাষায় বউঠানের প্রসঙ্গ লিখেছ। মৃত্যুর অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই নানাভাবে বউঠানকে ৬টি বই উৎসর্গপত্রে কোথাও তার নাম নেই, তবে অতি সাধারণ পাঠকও জানে উৎসর্গটি কাদম্বরী দেবীকেই। আদরের শমীর আকস্মিক মৃত্যুও গভীর শোক থেকে শক্তি অর্জনে ও কর্মজগতের পথে প্রেরণা অনুভব করার এক আশ্চর্য মানসিক জগত তুমিই তৈরি করে নিতে পার। ‘মৌচাক’ পত্রিকার সম্পাদক সুধীরচন্দ্র সরকারের বোন তোমার ভক্ত কাদম্বিনী দত্ত (১২৮৫-১৩৫০) যার সঙ্গে ঈশ্বর দর্শন ও সাহিত্য প্রসঙ্গে প্রায় ৩০ বছর পত্র বিনিময় করেছ, শমীর মৃত্যুর পর তার একটি মহানুভূতি উত্তরে লিখছো ১৯ অগ্রহায়ণ তারিখে, ‘ ঈশ্বর আমাকে বেদনা দিয়েছেন কিন্তু তিনি তো আমাকে পরিত্যাগ করেন নাই-তিনি হরণও করিয়াছেন পূরণও করিবেন। আমি শোক করিব না-আমার জন্য শোক করিয়ো না।’- (চিঠিপত্র-৪, পত্র-৬৬)। নিজের ব্যক্তিগত দুঃখে তুমি অন্যের সহানুভূতি সান্ত¡না দেওয়ার কোনো সুযোগ কখনো কাউকে দেওনি। তাই প্রিয়তম পুত্রের শোকেও নিজের অন্তরের বাইরে সামাজিক করে তুলতে তুমি রাজি নও। এই চিঠি লিখবার ৭/৮ দিন পর এবং শমীর মৃত্যুর (৭ অগ্রহায়ণ) ২০দিন পর ২৭ অগ্রহায়ণ এক অসাধারণ গান লিখলে-

অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে,
নির্মল করো , উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে ॥

গানটি পরে গীতাঞ্জলিতে রাখলে। কাদম্বিনী দত্ত অকাল বৈধবের পর তোমার অনুপ্রেরণায় শোকের মধ্যে শান্তির সন্ধান করেন। কতটুকু শান্তি তিনি পেয়েছিলেন জানি না, তবে তুমি সৃষ্টি ও সামাজিক কর্ম প্রবাহের মধ্যে শোকে বিষণœ হয়ে থাকোনি কখনো। শমীর কলেরার খবর পেয়ে দ্রুত মুঙ্গের চলে এলে। শরীর তোমার ভালো নয়। বহরমপুর বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন (নভেম্বর ৩, ৪, ১৯০৭) শেষ করে তুমি কেবল কলকাতায় ফিরেছ, কয়েকদিনে অনিয়মে অর্শের পীড়া বেড়েছে। তবুও একজন ডাক্তারকে সঙ্গে করে ছেলের কাছে এলে। বড় অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসা হলো, ভালো হওয়ার লক্ষণ দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত ভালো হলো না। তোমার নির্ভর ও ভরসা অনেকটাই হোমিয়প্যাথে, সেই চিকিৎসাও ব্যর্থ হলো। মুঙ্গের আসবার সময় শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক তোমার অনুরাগী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল (১৮৭৭-১৯৬২)-কে টেলিগ্রাম করে ডেকে আনলে। আহা-রে এই লোকটা রাত জেগে আমার সোনামণি শমী’র সেবা করেছে, একজন অনাত্মীয় পুরুষ এইভাবে রাত জেগে অন্যের কিশোর সন্তানের সেবা করার দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই, শুধু তো শমী নয়, তোমার ভালো মন্দ ও মানসিক অবস্থার দিকেও তার খুব খেয়াল ছিল। তোমার মৃত্যুর পর দেশ শারদীয় সংখ্যায় (১৩৪৯) ‘রবীন্দ্র প্রসঙ্গ’ নামে স্মৃতিচারণ করে যে রচনাটি লিখল, তাতেই আমার শমী আর তোমার সেই সময়ের খবরগুলো ভালো করে জানতে পারি। ভূপেন্দ্রকে তুমি ছোট একটি নির্দেশ দিলে, শমীকে ব্রাহ্মণ মতে দাহ করতে, একথা বলেতে হলো কারণ তখন ওর উপনয়ন হয়নি। তুমি নিজে কখনো শেষ যাত্রায় শরিক হতে চাও না, চিতাগ্নির পাশে তোমাকে দেখা যায় না। মুখাগ্নির নিয়ম কখনো মানোনি, এই তোমার খুব প্রয়োজন হলো ব্রাহ্মণ মতে দাহ করার বিষয়ে মত দেয়ার! কী হয় এতে, তোমার প্রিয়ধন সোনামণির মৃত দেহ আগুনে ঝলসে যাবে, সেই আগুন লাগাবার নিয়ম এতে রকমফের ঘটাবে না। অথচ শমীর মৃত্যুর শোকে তুমি কেমন পাথর নিস্তব্ধতায় মনের ভিতরে শুধু গুমরে মরেছ ! ভূপেন্দ্রনাথের লেখার এই অংশটুকু তোমাকে একবার শোনাব, ওর লেখায় বিছানায় শীর্ণ কাতর শমীকে আমি দেখতে পাই, দেখতে পাই তোমাকেও-

‘. . . গিয়া দেখিলাম শমী একটু ভালই আছে। শমীকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি তুমি কেমন আছ,” শমী নিজেই বলিল ”ভাল আছি।” শুনিয়া আনন্দ হইল এবং আশাপ্রদ বলিয়া বোধ হইল। ডাক্তাররা কোন আশঙ্কা নাই বলিতেছেন। আমি ডাক্তার সৌরীন্দ্রমোহন গুপ্তকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি বলিলেন, “পথ্য না পাওয়া পর্যন্ত কোন বিশ্বাস নাই।’ প্রথম রাত্রে রবীন্দ্রনাথ আমাকে বলিলেন, “শমী ২/৩ দিনের মধ্যে একটু সুস্থ হইলেই একটি ২য় শ্রেণীর গাড়ি রিজার্ভ করিয়া তাহাকে লইয়া আপনি ও আমি কলিকাতায় চলিয়া যাইব।” সকলেরই মনে খুব আশা হইল যে, এ যাত্রা শমী রক্ষা পাইল। সেই দিনই শেষরাত্রের দিকে শমীর হঠাৎ পীড়া বৃদ্ধি পাইল। দুই ভাই ডাক্তারকে তখনই ডাকা হইল, তাঁহারা ঊঠিয়া নূতন ঔষধের ব্যবস্থা করিলেন। ঔষধ ও শুশ্রƒষা চলিতে লাগিল, কিন্তু পরদিন প্রাতেও পীড়ার বেগ হ্রাস না পাইয়া বরং বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। আমাদের মনে নূতন আশঙ্কা দেখা দিল। রবীন্দ্রনাথের ইছা হইল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হউক। মুঙ্গেরে যে সব হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ছিলেন, তাঁহাদের সকলকেই ডাকা হইল। সৌভাগ্যবশত সে-সময় প্রসিদ্ধ চিকিৎসক নগেন্দ্রনাথ মজুমদার মহাশয় উপস্থিত ছিলেন। তিনি মনমোহনবাবুর সহপাঠী এবং অ্যালোপ্যাথিক ও হোমিওপ্যাথিক উভয় চিকিৎসাতেই সুপণ্ডিত। তিনি দেখিয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন। ঔষধের ংবষবপঃরড়হ খুব সুন্দর হইতেছে, কারণ ঔষধ প্রয়োগ মাত্রেই বেশ ফল পাওয়া যাইতে লাগিল, কিন্তু আধ ঘন্টার বেশি তাহা স্থায়ী হয় না দেখিয়া সকলেই হতাশ হইলেন। রবীন্দ্রনাথও হোমিওপ্যাথিক সুপণ্ডিত ছিলেন, তাঁহার ইচ্ছানুরূপ রাত্রে ২/১ বার ঔষধ বদলাইয়া দেওয়া হইল, কিন্তু কোন ফলই হইল না, ক্রমেই রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হইতে লাগিল। আমি সারারাত্রি শমীর পার্শ্বে বসিয়া রইলাম, রবীন্দ্রনাথ পাশের ঘরেই জাগিয়া বসিয়া রহিলেন। যতই রাত্রি শেষ হইতে লাগিল ততই শমীর জীবন প্রদীপ নির্বাণোমুখ হইতেছে, এ ঘটনা তাঁহাকে শুনাইতে যাইবার সাহস হইল না। তখন তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অবস্থিত। কিছুক্ষণ পরে তিনি আমাকে ডাকিয়া বলিলেন “এ সময়ের যাহা কিছু কৃত্য আমি করিয়া দিলাম, এখন অবশেষ যাহা কর্তব্য আপনি করুন। ব্রাহ্মণের মতনই শমীর শেষ কৃত্য যেন হয়, আর আমার কিছু বলিবার নাই।” পরে আমরা কয়েকজনে শমীর শবদেহ শ্মশানে লইয়া আসিলাম। রবীন্দ্রনাথ তখনও প্রস্তরের মত নিশ্চল হইয়া বসিয়া আছেন। কোমল প্রাণ শ্রীশবাবু কাঁদিয়া আকুল হইলেন। আমি ও শ্রীশবাবু তখন রবীন্দ্রনাথের গৃহে প্রবেশ করিলাম। শ্রীশবাবু অত্যন্ত ব্যাকুল হইলেন, চক্ষে তাঁহার ধারা আর থামে না, আমারও চক্ষে ধারা বহিতেছিল, এই সময় রবীন্দ্রনাথেরও চক্ষে ধারা বহিতে লাগিল। আমি তাঁহার অশ্রুপাত দেখিয়া যেন একটু আশ্বস্ত হইলাম। তাঁহার সেই নিশ্চল গম্ভীর ভাব ও শোকপূর্ণ অবস্থা দেখিয়া মনে বড় আতঙ্ক জন্মিতেছিল। সেইদিনই গাড়িতে বোলপুর চলিয়া যাওয়া স্থির হইল। আমি তাড়াতাড়ি রন্ধন করিলাম। রবীন্দ্রনাথ ভোজনে বসিলেন মাত্র, দুই এক গ্রাস মুখে দিয়াই তিনি উঠিয়া পড়িলেন। যাবার সমস্ত আয়োজন ঠিক হইতে লাগিল, যথাসময়ে আমরা মুঙ্গের স্টেশনে আসিয়া পৌঁছিলাম। অনেকগুলি ভদ্রলোক উকিল ও পদস্থ রাজকর্মচারী স্টেশনে আসিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিলেন। পূর্বদিনেও রবীন্দ্রনাথের ভোজন হয় নাই, আজও কিছু হইল না, বোলপুরে পৌঁছিতেই রাত্রি হইবে, এই ভাবিয়া আমি সাহেবগঞ্জে আমার মাতুল শিবচন্দ্র রায় মহাশয়কে রবীন্দ্রনাথের জন্য কিছু খাবার তৈয়ার করিয়া আনিবার জন্য টেলিগ্রাম করিয়াছিলাম। সাহেবগঞ্জে অনেকক্ষণ গাড়ি দাঁড়ায়, গাড়ি সাহেবগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছিতেই মাতুল মহাশয় ট্রেনের নিকট খাবার লইয়া উপস্থিত হইলেন। রবীন্দ্রনাথকে খাবার দেওয়া হইল, তিনি কিছু খাইলেন দেখিয়া আনন্দিত হইলাম। তারপর তিনি মাতুল মহাশয়ের সহিত আলাপ করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে আমি মাতুল মহাশয়কে চুপে চুপে মুঙ্গেরের সমস্ত দুর্ঘটনার কথা জানাইলাম। তিনি শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাঁহার সহিত আলাপ করিবার সময় তিনি টের পান নাই যে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে।
… … …

আমরা যথাসময়ে বোলপুর স্টেশনে নামিয়া শান্তিনিকেতনে আসিয়া উপনীত হইলাম। তখনও মুঙ্গেরের দুর্ঘটনার সংবাদ সেখানে উত্তমরূপে প্রচারিত হয় নাই, টেলিগ্রামে শব্দের কি গোলমাল ছিল। রাত্রিটা কাটিয়া গেল। সেখানে রবীন্দ্রনাথের কন্যারা কেহই ছিলেন না, সকলেই কলিকাতায়। পরদিন বেলা হইলে আমাকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। আমি তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিয়া তাঁহার নিকট চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম, সেখানে তখন কেহই ছিল না। তারপর একটু কথা কহিতে গিয়াই তাঁহার নেত্র আর্দ্র হইয়া উঠিল, কণ্ঠস্বরও যেন বাহির হইতেছিল না, আমারও সেই অবস্থা। সেইদিনই বোধহয় সন্ধ্যার সময় এই দুর্ঘটনার সংবাদ পাইয়া সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় শান্তিনিকেতনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় মধ্যে মধ্যে আসিয়া কিছু বলিতে না পারিয়া কেবল তাঁহার পিঠটিতে হাত বুলাইয়াতে লাগিলেন আর মধ্যে মধ্যে “রবি, রবি” এই শব্দ করিতে লাগিলেন। সে দৃশ্যটি বড় করুণাপূর্ণ। সুরেন্দ্রবাবু আসাতে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলাম। পরদিন রবীন্দ্রনাথকে লইয়া তিনি কলিকাতায় চলিয়া গেলেন।’ (ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল, রবীন্দ্র প্রসঙ্গ)

শমী’র মৃত্যু ৭ অগ্রহায়ণ, তারিখটা কি তোমার মনে আর কোনো ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয় ! চার বছর আগে এই ৭ অগ্রহায়ণ তারিখে আমার মৃত্যু হয়েছিল। মা ও ছোট ছেলের মৃত্যুর একই তারিখ ! আশ্চর্য ! মীরার ২১ বছরের ছেলে নীতীন্দ্রনাথের (১৯১১-১৯৩২) মৃত্যুর পর মীরাকে সান্ত¡না দিয়ে যে চিঠি লিখেছিলে সেখানেও শমী’র মৃত্যুশোক তুমি কীভাবে নিজের মনে শক্তি ও শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলে তার কথা আছে। একজন পুত্র শোকাতুর পিতা তার মেয়ে পুত্রশোকাতুর মা’কে লিখছে :

‘. . . যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে অবাধ গতি হোক্ আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে। … শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় [রাসপুর্ণিমা ৩ অগ্র : ১৯ নভেম্বর] আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি-সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তার মধ্যে। সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল। যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনোখানে কোনো সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়-যা ঘটেছে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে।’

গুণবান শমী ওই কিশোর বয়সে অনেকের মনে আশা জাগিয়ে ছিল যে, শমী ঠিক তোমার মতো প্রতিভাববান হবে। তোমার কিশোরকালের ছবির মতোই শমীর আদলটা ছিল। ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রস্মৃতি গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৫৬) লিখেছেন, “লোকে বলে যে, রবিকাকার ছোটোছেলে শমীন্দ্রই বেশি তাঁর মত দেখতে ছিল। শমী অল্পবয়সেই বিসর্জনের মতো শক্ত নাটকের কবিতাও অনর্গল মুখস্থ বলতে পারত। দুলে দুলে রবিকাকার উপাসনা করাও নকল করত। হেমলতা বউঠানের কাছে শুনেছি, বাপের টেবিলে বসে নাকি তাঁর মতো লেখক হবার অভিনয় করত।”

আচ্ছা ডাকঘর (১৩১৮) নাটকের অমল চরিত্রটি কি শমীর আদলেই গড়া ! নাকি অমলের জীবনের করুণ সমাপ্তির জন্যই শমীর কথা মনে এল !

প্রিয়জনদের একে একে মৃত্যুর শোক বহন করার জন্য এমন মনের গড়ন ও দার্শনিক উপলব্ধি তৈরি না হলে জীবনময় কর্ম ও সৃষ্টিপ্রবাহ কী করে হতো বলো ! আমার তবুও মনে হয়, অন্তরগত শোক দুঃখ আশ্চর্য উপায়ে নিরাময় করে নিলেও আমার মৃত্যু তোমাকে বড় অসহায় করে তুলে ছিল। সংসার, সন্তান চারিদিক সামাল দেওয়ার জন্য যেমন আমার দরকার তেমনি একান্তে শরীর ও মনের প্রশান্তির জন্য আমিই ছিলাম। আমাদের নিজস্ব ঘরটি দিন শেষে সেই সেই প্রশান্তির জায়গা ছিল, যেখানে কত কথা তুমি বলতে। আমি তোমার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হলাম এই দুঃখ থেকে আমার হৃদয়ে বেশি বাজে তোমার জন্য নির্ভরযোগ্য এমন একটি আশ্রয়ও রইল না। জীবনের প্রান্তে এসে অনুরক্ত মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে এলে ১৯৪০-এ, উদ্দেশ্য হাওয়া বদল, সেবা গ্রহণ, মৈত্রেয়ীর সেবাপরায়ণ সঙ্গ লাভের সুখ। না বাকি দুই একটি কাজ করে নেয়া তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তোমার ওই শরীরে। তো মংপুতে একদিন মৈত্রেয়ী জানতে চেয়েছিল তুমি এখনো স্ত্রীর অভাব বোধ কর কিনা, উত্তরে তুমি বললে, ‘স্ত্রী বিদায়ের পর আমার এমন কেউ নেই যাকে সব কথা খুলে বলা যায়।’ তোমার এই কথাটা আমি খুব সত্য মানি, তোমার সঙ্গের সব স্মৃতি ঘটনা একে একে মনে এলে মনে হয়, আহ্া র আমার স্বামী মানুষটা একজন বিখ্যাত হলেও স্ত্রীর অন্তরঙ্গ সঙ্গ শেষ জীবন পর্যন্ত অনুভব করতে পারল না। আচ্ছা আমি কি কখনো এমন ভেবেছি বা মনে হয়েছে যে তুমিই আমার সেই মানুষ ছিলে যাকে মনের সব কথা খুলে বলা যায় ! মনে হয় না, কারণ সংসারের ব্যস্ততা আর তোমার কত শত কথা আব্দারের ভিড়ে আমার আবার যে মনের কথা আছে তা মনেও হয়নি, কাজেই বলারও দরকার পড়েনি। তবে বারবার বাড়ি বদল, আবাস বদল, যেভাবে মেয়েদের বিয়ে দিলে, বিশেষ করে আমার রাণীর (১৮৯১-১৯০৩) বিয়েটা, মীরাও লিখছে, ‘বাবা তিন দিনের মধ্যে রাণীদির বিয়ের দিন স্থির করে ফেললেন। … এরকম বিয়ে দেওয়াতে মা মোটেই খুশি হন নি।’ (স্মৃতিকথা পৃ:১৫)। মীরা আরো লিখেছে, ‘সব সময় ঘরসংসার করবার মন নিয়ে জন্মায় না। … বাবা যদি রাণীদিকে অল্প বয়সে বিয়ে (১১ বৎসর বয়সে) না দিয়ে লেখাপড়া করাতেন তাহলে বোধহয় ভালো করতেন।’

আমার অসুস্থতা জেনেও আমাকে শান্তিনিকেতনে রেখে কলকাতায় ব্যস্ত ছিলে, শমীকে আমার কাছ থেকে নিয়ে আশ্রমে পাঠালে বা ধরো তোমার ‘নবৌঠান’ মানে দাদা বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী প্রফুল্লময়ীর সঙ্গে সম্পত্তিগত ঝামেলা এবং এসব নিয়ে আমাকে লেখা তোমার একটা চিঠির বক্তব্য ইত্যাদি আরও কত বিষয় নিয়ে আমার মনে নানা রকম কথা ঘুরেছে, ভিন্ন চিন্তা হয়েছে কিন্তু কোনোদিন তোমাকে মন খুলে সেসব কথা বলতে পারিনি। কেন পারিনি তখন ! জানি না। বলতে পারলে মন হাল্কা হতো। যাইহোক, এখন এসব অনেক অতীতে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তুমি হারাওনি, মহালোকের যাত্রা পথে তোমাকে পাঠ উপলব্ধি চলছেই। সেজন্য তোমার মনের ব্যথা বেদনা বা সুখের কথাগুলো মন থেকে যায় না। আমার মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর দীনেশচন্দ্র সেনকে যে চিঠি লিখলে সেই চিঠিতে শোক নিরাময়ের আধ্যাত্মিক বোধে মনকে শান্ত করার সঙ্গে স্ত্রী হিসেবে তোমার সহায়ক ছিলাম তার কথাও আছে। পুরির বাড়ি বিক্রি করেও হলো না ঋণের ভার আর আশ্রম চালনার টাকার চিন্তায় তোমার মন বড় অস্থির যখন তখন আমার সব গহনা তোমাকে এনে দিলাম। কিছু টাকার ব্যবস্থা হোক, তোমার মনে তখন শান্তির উদয় হয়েছিল আমার সহায়তার হাত পেয়ে। একজন নারীর কাছে তার বিয়ের গহনা কত গুরুত্বপূর্ণ তা সব নারীই জানে। কিন্তু তোমার মনের অশান্তির চেয়ে ওই গহনা কখনোই বড় ছিল না আমার কাছে। দীনেশচন্দ্র সেনকে লিখেছিলে –

‘ইশ্বর আমাকে যে শোক দিয়াছেন তাহা যদি নিরর্থক হয় তবে এমন বিড়ম্বনা আর কি হইতে পারে ! ইহা আমি মাথা নীচু করিয়া গ্রহণ করিলাম। যিনি আপন জীবনের দ্বারা আমাকে নিয়ত সহায়বান করিয়া রাখিয়ছিলেন তিনি মৃত্যুর দ্বারাও আমার জীবনের অবশিষ্টকালকে সার্থক করিবেন। তাঁহার কল্যাণী স্মৃতি আমার সমস্ত কল্যাণ কর্ম্মেও নিত্যসহায় হইয়া আমাকে বলদান করিবে।” (২৮ অগ্রহায়ণ, ১৪ ডিসেম্বর ১৯০২)

তোমার সঙ্গে আমার সংসার জীবন ১৯ বৎসরের হলেও প্রকাশিত বই ও রচনার সংখ্যা কম নয়। কিন্তু কোনো বই তুমি তোমার স্ত্রী, সন্তানের জননী সংসার কর্মের সহায় আমাকে উৎসর্গ করোনি। পরে দেখেছি বই উৎসর্গ করার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু ভাবনা কাজ করেছে, মানে উৎসর্গ পত্রে যাদের নাম আছে তাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্কের জায়গাগুলো ভালো করে দেখলে বোঝা যায় এ বিষয়ে তোমার ভাবনা কী ছিল। আবার কখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের পাতাতে দেখি কাউকে উৎসর্গ করা হয়নি, যেমন গীতাঞ্জলির মতো আলোচিত বই, ‘জীবনস্মৃতি’, ‘শেষের কবিতা’, ‘রক্তকরবী’, নৌকাডুবি,’ ‘চোখের বালি’, ইত্যাদি গ্রন্থ। মনের মধ্যে অভিযোগ পুষে রেখে এ কথা বলছি না। এ চিঠির ভিতর আমি আমার মতো করে তোমাকে বোঝার যে চেষ্টা করলাম, এই চেষ্টায় আমি কবি শিল্পী রবীন্দ্রনাথকে বিবেচনা করিনি শুধু ব্যক্তিগত জায়গা থেকে স্বামী মানুষটিকে বুঝে নেয়া, জগৎখ্যাত কবিকে নয়। শুধুই ব্যক্তিগত, সাংসারিক, তোমার সৃষ্টিশীল কর্মমুখর জগতে যার ভূমিকা গভীর গবেষণার তেমন কাউকে তুমি বই উৎসর্গ করোনি, এমন বিবেচনা থেকে তোমার মা জননী সারদা দেবীকেও নয়, রথীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোনো পুত্র-কন্যাকেও নয়, মীরা (১৮৯৪-১৯৬৯) তোমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জড়িয়ে ছিল, বেলা তোমার খুব আদরের, প্রথম পিতা হওয়ার সুখ দিয়েছিল, তাকেও নয় ! ভাবনার দিক থেকে তোমার অন্য মেরুর বলা যায় অনেক ক্ষেত্রেই—সেই মহাত্মা গান্ধীকেও নয়। তো আমার কোনো আফশোস হওয়ার কথা নয়। অন্যদিক থেকে আমার বেলায় এ-কথা শুধু আমার জীবনকাল পর্যন্ত বলা চলে। কারণ এই ‘সহায়বান’ স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে যে ব্যক্তিগত অধিকারে শূন্যতা তৈরি হলো, সন্তান সংসার নিয়ে যে ব্যস্তবতা সামনে উপস্থিত হলো তখন স্ত্রীকে তুমি আকুলভাবেই স্মরণ করেছ। মৃত্যুর অল্প পরেই ‘স্মরণ’-এর সনেটগুচ্ছে বেদনা আর শূন্যতা শব্দবন্ধ করে আমাকে স্মরণ করলে, মৃত্যুর অভিঘাত অন্তর্গত শোক ছন্দোবন্ধ করে তোমার সাহিত্য ভাণ্ডারে মৃণালিনী দেবীকে জায়গা করে দিলে। আমার শেষ নিদ্রা তুমি ঠিক উপলব্ধি করেছিলে। ছাদে চলে গেলে— সারারাত ছাদে, আকাশের দিকে তাকিয়ে নিভৃতে নিঃশব্দে মৃত্যুর শোক ও শূন্যতাকে জীবনের কাছে অর্থময় করার সাধনা প্রবল। এসব খুব সুন্দর করে ফুটে উঠেছে রথীর লেখাতে। জানো রথী অনেক লিখলে খুব ভলো করত, তেমন লিখল না।

সাধনায় শুধু শোককে অর্থময় করা নয়, তোমার জীবনের কিছু দৈনন্দিন অভ্যাসও পাল্টে গেল। সম্পূর্ণ নিরামিষাশি, কিছুদিন তো ভাত রুটিও ছুলে না, শুধু ভিজানো ছোলা, ভিজানো মুগ এসব খেয়ে দিন পার করা। আমার মায়ের কাছে মনে হলো, আহারে এসব খেয়ে এমন জোয়ান মানুষটার চলতে পারে না, মায়ের মন সব-সময় চায় ছেলে মেয়ে খেয়ে পড়ে সুখে থাক। তিনি ফুলতলা থেকে ছুটে এলেন নগেন্দ্র’র কাজের জায়গায়। তোমাকে খবর দিলেন, তুমি তখন শিলাইদহ ছিলে, কতরকম রান্না মা করেছিলেন, তোমার পছন্দের দই দিয়ে কই মাছও ছিল। তুমি খেতে রাজি নও। না খাওয়াটাও যেন ব্রত ছিল, তবুও তোমাকে কিছু খাইয়েই ছাড়লেন।

বিয়ের কিছু পরে আমার শরীরটাকে আবিষ্কার পর্বের সময় তোমার কবিতা যেমন সঙ্কোচহীন দৈহিক সুখ আনন্দের প্রকাশে ভরে উঠেছিল, আমার মৃত্যুর পর আবার স্মরণগুচ্ছেও শোক, শূন্যতা, আমার অভাব হাহাকার করে ওঠে, কড়ি ও কোমলের কবিতায় যৌবনের উচ্ছাস, স্মরণগুচ্ছে বিষণ্ণতা, স্মরণ-এর ২৭টি কবিতায় ভাব ও সুর ঐক্যে গাঁথা,

তখন নিশীথরাত্রি; গেলে ঘর হতে
যে পথে চল নি কভু সে অজানা পথে।
যাবার বেলায় কোনো বলিলে না কথা,
লইয়া গেলে না কারো বিদায়বারতা।
সুপ্তিময় বিশ্ব-মাঝে বাহিরিলে একা—
অন্ধকারে খুঁজিলাম, না পেলাম দেখা।
মঙ্গলমুরতি সেই চিরপরিচিত
অগণ্য তারার মাঝে কোথা অন্তর্হিত।
গেলে যদি একেবারে, গেলে রিক্তহাতে ?
এ ঘর হইতে কিছু, নিলে না কি সাথে ?
বিশ বৎসরের যে সুখদুঃখভার
ফেলে রেখে দিয়ে গেলে কোলেতে আমার। (৪ স্মরণ)

‘স্মরণ’ কবিতা গ্রন্থের কবিতায় শুধু বিষণœতার নীল বিবর্ণ করে তোলেনা, বিষণœতার মাধুরীও তুমি কবি সৃষ্টি করলে কবিতায়, কবিতায়-

মিলন সম্পূর্ণ আজি হল তোমা — সনে
এ বিচ্ছেদবেদনার নিবিড় বন্ধনে।
এসেছ একান্ত কাছে ছাড়ি দেশ কাল
হৃদয়ে মিশায়ে গেছ ভাঙি অন্তরাল।
… তোমারি বেদনা বিশ্বে করি অনুভব। (৮ স্মরণ)

আমার মৃত্যুর ৩ সপ্তাহ পরে ২ পৌষ এক কবিতায় লিখলে, স্মরণ-এর ১৪ সংখ্যক কবিতা-

দেখিলাম খানকয় পুরাতন চিঠি—
স্নেহময় জীবনের চিহ্ন দু-চারিটি
স্মৃতির খেলেনা-ক’টি বহু যতœভরে
গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে।
… … …
লুকায়ে রাখিয়াছিলে, বলেছিলে মনে
অধিকার নাই কারো আমার এ ধনে!

পরের দিন লিখলে-

স্বল্প-আয়ু এ জীবনে যে-কয়টি আনন্দিত দিন
কম্পিত-পুলকভরে, সংগীতের বেদনা-বিলীন
লাভ করেছিলে, লক্ষ্মী, সে কি তুমি নষ্ট করে যাবে ?
সে আজি কোথায় তুমি যতœ করি রাখিছ কি ভাবে
চেয়ে দেখি এক দৃষ্টে সেথা কোন্ করুণ অক্ষরে । (১৬ স্মরণ)

‘পুরাতন চিঠি’ গুলো আমি সযতেœ রক্ষা করে আসছিলাম। সব হয়তো রক্ষা হলো না, তবুও শেষ পর্যন্ত ৩৬টি চিঠি আমার অমূল্য সম্পদ হয়েই ছিল। সংসারের কত খুটিনাটি বিষয় যেমন, তেমন আমাকে মনে পড়ার সময়গুলো এই চিঠিতে তুমি লিখেছ। এসব ঠিক বিবিকে লেখা ছিন্নপত্রের চিঠির মত সাহিত্য, কবিতা, ধর্ম, প্রকৃতি, রাত, অন্ধকার, আকাশ, নক্ষত্র নিয়ে অসাধারণ ভাব ও কাব্যময় চিঠি নয়, ওই কয়টি চিঠি আমার নিজস্ব^, আমর রবীন্দ্রনাথের লেখা, এই চিঠির তুমি বিশ্বের নও, শুধু মৃণালিনী দেবীর ! যাত্রাপথে কখনো চিঠিগুলি দেখি, বারবার পড়ি। ছেলে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিল,

‘মা পেয়েছিলেন প্রচুর, বিবাহের যৌতুক ছাড়াও শাশুড়ির পুরণো আমলের ভারি গয়না ছিল অনেক। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ জোগাতে সব অন্তর্ধান হল।’

না বাবা, সব অন্তর্ধান হয়নি। যা যা আমি অমূল্য জ্ঞান করেছি, তা জীবনের শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেই গেছি, সেজন্য আজ তা তোমার মৃত্যুর পর (১৩৪৯) চিঠিপত্রের সমগ্র বের হতে শুরু হয়, প্রথম খণ্ডে জায়গা করে চিরস্থায়ী হয়ে গেল এই চিঠিগুলি। উৎসাহী পাঠক গবেষকের হাতের মধ্যেই থাকল। মনে হয় তোমার গবেষকরা তোমাকে লেখা আমার চিঠিও পড়ে দেখতে আগ্রহী। দেখতে চায় সে-সব চিঠিতে তোমাকে আমি কি বলে সম্মোধন করতাম। তার খোঁজ করে গবেষকরা হিমশিম খাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের মতো আমি কেউ নই কিন্তু তার স্ত্রী তো, লোকের কৌতূহল কেন হবে না। তোমার লেখা চিঠি তুমি কপি করতে, সংগ্রহে রাখতে, তোমার আশেপাশের মানুষও সেটা করত, কেউ তোমার এমনকি তুমিও আমার একটি চিঠি রক্ষা করতে পারলে না ! আমার ভাষা কাঁচা, বিষয় লিখতে আরও আনাড়ি ছিলাম, সেসব ঠিক, কিন্তু তোমার স্ত্রীর সে সবও প্রয়োজন হয় অন্যদের, লেখাপড়ার শিক্ষা তো তোমাদের বাড়ি এসে তোমার সাহচর্যেই ঘটেছে। সেসব চিঠি হয়তো সে শিক্ষারও কিছু পরিচয় দিত। তবে হ্যা, আত্মীয়বর্গের কাছে লেখা আমার চিঠির কিছু ছেঁড়াখোড়া নিদর্শন গবেষকরা টুকে নিয়ে লিখছে-

‘অসাধারণ সেই চিঠি। একটি গ্রাম্য মেয়ের উত্তরণের সাক্ষী সেই চিঠি। বাংলা সংস্কৃত ইংরেজি ভালো শিখেছিলেন মৃণালিনী দেবী। তাঁর চিঠির ভাষাও চমৎকার ! (অমিতাভ চৌধুরী, একত্রে রবীন্দ্রনাথ, পৃষ্ঠা ২১৩)

এসব কথার মধ্যে যে অতিশয়ক্তি আছে তার কারণ আমি কবিগুরুর পত্মী, প্রশংসা করাই বাঞ্ছনীয়। সেসব চিঠিগুলোতে সংসারের কথায় ভরা, সাধারণ ভাব ও ভাষা। চমৎকার শব্দটাই শুধু এক্ষেত্রে চমৎকার। তুমি পড়ে দেখো, চারুবালা দেবীকে লেখা (তোমার বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্রবধু, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা) আমার চিঠি-

‘চারু, অনেকদিন পর তোমার একখানা চিঠি পেলুম। তোমার সুন্দর মেয়ে হয়েছে বলে বুঝি আমাকে ভয়ে খবর দাওনি, পাছে আমি হিংসা করি! তার মাথায় খুব চুল হয়েছে শুনে পর্যন্ত কুন্তলীন মাখতে আরম্ভ করেছি। তোমার মেয়ে মাথাভরা চুল নিয়ে আমার ন্যাড়ামাথা দেখে হাসবে, সে আমার কিছুতেই সহ্য হবে না…(একত্রে রবীন্দ্রনাথ)’

হয়তো আমার চিঠির সহজ ভাষায় সরল অভিব্যক্তি প্রকাশটাই চমৎকার ! সেটাই অমিতাভ বাবু বলতে চেয়েছেন।

আর একখানা চিঠি। তোমার ভাগনে সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা-

‘আগেকার যে পঞ্চাশ টাকা আমার নামে সরকারীতে হাওলাত আছে, আর সেদিন যে চল্লিশ টাকা নিয়েছি এ নব্বুই টাকা এ মাসে কেটে নিও না। আগামী মাসে কেটে নিও। এ মাসে কেটে নিলে আমার খরচ চলা অসম্ভব। মাসকাবারি কবে বেরোবে। আমার টাকাটা আজকেই দিতে বলে দিও। আমার কাছে মোটে টাকা নেই।’ (একত্রে রবীন্দ্রনাথ)

বাবাকে লেখা একটা চিঠির অংশ, এখানে মহর্ষির কথা আছে,

‘নগেন্দ্রর চিঠি পেয়েছি। আমাদের এখানে আজ তিন-চার দিন থেকে দিনরাত ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। আপনাদের ওখানেও কি বৃষ্টি হচ্ছে? আমরা সকলে ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন লিখবেন। আমার প্রণাম জানিবেন।’- মৃণালিনী
‘পুনশ্চ। এর মধ্যে যদি কোনো লোক আসে তো তার সঙ্গে কচু ও কলম্বা নেবু পাঠিয়ে দেবেন কিংবা ডাকে পাঠিয়ে দেবেন — অনেক দিন থেকে বাবামহাশয় কচুর কথা বলেছেন। দিদিমার জন্যে একটা চিঠি দিলুম, তাঁকে পড়ে শুনিও।’ (একত্রে রবীন্দ্রনাথ)

তবে যাই বলো, তোমাকে লেখা আমার চিঠির প্রয়োজন ও কৌতূহল কি এতে মেটে! আমাকে লেখা তোমার চিঠির একটি থেকে আমার এই চিঠি শুরু করেছিলাম। এখন আর দুই একটি চিঠির অন্তত অংশ না পড়লে আমার চলবে না। তোমাকে কত কথার ভিড়ে স্মরণ করার সময়ে এই চিঠিগুলি আমি বারবার যে পড়ি। চিঠিগুলির শব্দে জড়িয়ে আছে রস, ভালোবাসা, অধিকার, শাসন, নির্দেশাবলি, কত দরকারি কথা, সেই সময় তখন সব জীবন্ত হয়ে ওঠে। চিঠিপত্রের প্রথম খণ্ডে চিঠিগুলো রাখা হলো রবীন্দ্র অনুরাগীদের জন্য। তোমার তো সেসব পড়ার দরকার নেই। কিছু অংশ তোমাকে শোনাই, নিজেও আর একবার শুনি।

সাহাজাদপুর। জানুয়ারী ১৮৯০ ওঁ

ভাই ছোটবউ
যেম্নি গাল দিয়েছি অম্নি চিঠির উত্তর এসে উপস্থিত। ভালমান্ষির কাল নয়। কাকুতি মিনতি করলেই অম্নি নিজমূর্ত্তি ধারণ করেন আর দুটো গালমন্দ দিলেই একবারে জল। একেই ত বলে বাঙ্গাল। ছি, ছি, ছেলেটাকে পর্য্যন্ত বাঙ্গাল করে তুল্লে গা। আজ এতক্ষণ এক দল লোক উপস্থিত ছিল— তোমাদের চিঠি যখন এল তখন খুব কথাবার্ত্তা চল্চে চিঠিও খুল্তে পারিনে, উঠ্তেও পারিনে। একদল উকীল আর স্কুলের মাষ্টার এসেছিল। আমার বই স্কুলে চালাবার জন্য কথাবার্ত্তা কয়ে রেখেছি কেবল বই আর পাচ্চিনে। কই, আজও ত বই এসে পৌঁছল না। ভাল গেরোতেই ফেলেছ। রাজর্ষি যে-খানা আমার কাছে ছিল সেইটেই ইন্স্পেক্টরের হাতে দিয়েছি, নদিদির গল্পসল্পও দিয়েছি। আবার ইন্স্পেক্টরের গলা ভেঙ্গে গেছে বলে তাকে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধও দিয়েছি—এতে অনেক ফল হতে পারে—তার গলা ভাঙ্গা না সারলেও তবু মনটা প্রসন্ন থাক্বে। দেখ্চ, বসে বসে কত উপার্জ্জনের উপায় করচি। সকালে উঠেই বই লিখ্তে বসেছি তাতে কত টাকা হবে একবার ভেবে দেখ। ছাপাবার সমস্ত খরচ না উঠুক্ নিদেন দশ পঁচিশ টাকাও উঠ্বে। এইরকম উঠে পড়ে লাগ্লে তবে টাকা হয়। তোমরা ত কেবল খরচ কর্ত্তে জান—এক পয়সা ঘরে আন্তে পার ? . . .


২৯ অগস্ট ১৮৯০ ওঁ
শ্যাম
শুক্রবার
ভাই ছোট বৌ—
. . . . এডেনে পৌঁছে আর একটা জাহাজে বদল করতে হবে, সেই একটা মহা হাঙ্গাম রয়েছে। এবারে সমুদ্রে আমার যে অসুখটা করেছিল সে আর কি বল্ব— তিন দিন ধরে যা’ একটু কিছু মুখে দিয়েছি অম্নি তখনি বমি কওে ফেলেছি—মাথা ঘুরে গা ঘুরে অস্থির—বিছানা ছেড়ে উঠিনি—কি করে বেঁচে ছিলুম তাই ভাবি। রবিবার দিন রাত্রে আমার ঠিক মনে হল আমার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে জোড়াসাঁকোয় গেছে। একটা বড়ো খাটে একধারে তুমি শুয়ে রয়েছ আর তোমার পাশে বেলি খোকা শুয়ে। আমি তোমাকে এক্টু আধ্টু আদর করলুম আর বল্লুম ছোট বৌ মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম—বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে কি না। তার পরে বেলি খোকাকে হাম দিয়ে ফিরে চলে এলুম।

… কাল রাত্তিরে বেলিটাকে স্বপ্নে দেখেছিলুম—সে যেন ষ্টীমারে এসেচ—তাকে এমনি চমৎকার ভাল দেখাচ্চে সে আর কি বলব—দেশে ফেরবার সময় বাচ্চাদের জন্যে কি রকম জিনিষ নিয়ে যাব বল দেখি …।

{সাহাজাদপুর। ১৮৯১] ওঁ

ভাই ছুটি
আজ সকালে এ অঞ্চলের একজন প্রধান গণৎকার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সমস্ত সকাল বেলাটা সে আমাকে জ্বালিয়ে গেছে—বেশ গুছিয়ে লিখ্তে বসেছিলুম বকে বকে আমাকে কিছুতেই লিখ্তে দিল না। আমার রাশি এবং লগ্ন শুনে কি গুণে বল্লে জান? আমি সুবেশী, সুরূপ, রংটা শাদায় মেশানো শ্যামবর্ণ, খুব ফুটফুটে গৌর বর্ণ নয়।— আশ্চর্য ! কি করে গুণে বল্তে পারলে বল দেখি ? তার পরে বল্লে আমার সঞ্চয়ী বুদ্ধি আছে কিন্তু আমি সঞ্চয় করতে পারব না—খরচ অজস্র করব কিন্তু কৃপণতার অপবাদ হবে—মেজাজটা কিছু রাগী (এটা বোধ হয় আমার তখনকার মুখের ভাবখানা দেখে বলেছিল)। আমার ভার্য্যাটি বেশ ভাল। আমার ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হবে—আমি যাদের উপকার করব তারাই আমার অপকার করবে। ষাট বাষট্টি বৎসরের বেশি বাঁচব না। যদিবা কোন মতে সে বয়স কাটাতে পারি তবু সত্তর কিছুতেই পেরতে পারব না। শুনে ত আমার ভারি ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে। এই ত সব ব্যাপার। যা হোক তুমি তাই নিয়ে যেন বেশি ভেবো না। এখনো কিছু না হোক ত্রিশ চল্লিশ বৎসর আমার সংসর্গ পেতে পারবে। ততদিনে সম্পূর্ণ বিরক্ত ধরে না গেলে বাঁচি। . . .


{সাহাজাদপুর। জুন ১৮৯১] ওঁ

ভাই ছুটি
আচ্ছা, আমি যে তোমাকে এই সাহাজাদপুরের সমস্ত গোয়ালার ঘর মন্থন করে- ও উৎকৃষ্ট মাখনমারা ঘের্ত্ত, সেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলুম তৎসম্বন্ধে কোন রকম উল্লেখমাত্র যে করলে না তার কারণ কি বল দেখি? আমি দেখচি অজস্র উপহার পেয়ে পেয়ে তোমার কৃতজ্ঞতা বৃত্তিটা ক্রমেই অসাড় হয়ে আস্চে। প্রতি মাসে নিয়মিত পনেরো সের করে ঘি পাওয়া তোমার এমনি স্বাভাবিক মনে হয়ে গেছে যেন বিয়ের পূর্ব্বে থেকে তোমার সঙ্গে আমার এই রকম কথা নির্দ্দিষ্ট ছিল।

১৪

{শিলাহদহ। জুন-জুলাই ১৮৯৩] ওঁ

ভাই ছুটি
কাল ডিকিন্সন্দের বাড়ি থেকে আবার তাগিদ্ দিয়ে আমার কাছে এক একশো বিরাশি টাকার বিল এবং চিঠি এসেছে। আবার আমাকে সত্যর শরণাপন্ন হতে হল। তা হলে তার কাছে আমার ন শো টাকার ধার থাক্ল। সে কি তোমাকে চার শো টাকা দিয়েছে? আমাকে ত এখনো সে সম্বন্ধে কিছুই লেখেনি। আজকের বিবির চিঠিতে তোমাদের কতকটা বিবরণ পেলুম। সে লিখেছে তোমরা প্রায়ই সেখানে যাও—এবং আমার ক্ষুদ্রতম কন্যাটি মেজবোঠানের কোলে পড়ে পড়ে নানা বিধ অঙ্গভঙ্গী এবং অস্ফুট কলধ্বনি প্রকাশ করে থাকে। তাকে আমার দেখ্তে ইচ্ছে করে। আমি যদি আষাঢ় মাস মফস্বলে কাটিয়ে যাই তা হলে ততদিনে তার অনেক পরিবর্ত্তন এবং অনেক রকম নতুন বিদ্যে শিক্ষা হবে। বেলির সঙ্গে খোকা কি গান শিখ্চে না? তার গলা কি রকম ফুটচে ? কেবল সা-রে-গা-মা না শিখিয়ে তার সঙ্গে একটা কিছু গান ধরানো ভাল—তা হলে ওদের শিখ্তে ভাল লাগ্বে—নইলে ক্রমেই বিরক্ত ধরে যাবে। মনে আছে ছেলেবেলায় যখন বিষ্ণুর কাছে গান শিখ্তুম তখন সা-রে-গা-মা শিখ্তে ভারি বিরক্ত বোধ হত। যে দিন সে নতুন কোন গান শেখানো ধরাত সেই দিন ভারি খুসি হতাম। . . .

১৭
[কলকাতা। ২৮ অগস্ট ১৮৯৯] ওঁ

ভাই ছুটি
… একদিন রাত্রে বৈঠকখানায় ঘুমাচ্ছিলুম সেই অবস্থায় আমার পায়ে বিছে কামড়ায়—যখন খুব যন্ত্রণা বোধ হচ্ছিল আমি আমার সেই কষ্টকে, আমার দেহকে আমার আপনার থেকে বাইরের জিনিষ বলে অনুভব করতে চেষ্টা করলুম—ডাক্তার যেমন অন্য রোগীর রোগযন্ত্রণা দেখে, আমি তেমনি করে আমার পায়ের কষ্ট দেখতে লাগলুম—আশ্চর্য্য ফল হল—শরীরে কষ্ট হতে লাগল অথচ সেটা আমার মনকে এত কম ক্লিষ্ট করলে যে আমি সেই যন্ত্রণা নিয়ে ঘুমতে পারলুম। তার থেকে আমি যেন মুক্তির একটা নতুন পথ পেলুম। এখন আমি সুখদুঃখকে আমার বাইরের জিনিষ এই ক্ষণিক পৃথিবীর জিনিষ বলে অনেকসময় প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করতে পারি—তার মত শান্তি ও সান্ত¡নার উপায় আর নেই। …

চিঠির এই টুকরো গুলোতে আমি তোমাকে দেখতে পাই। সাহিত্যের অলঙ্কার পূর্ণ নয়, জীবন রসের আর সম্পর্কের বন্ধন এতে ফুটে ওঠে।

প্রেম ভালোবাসা আবেগ নিরপক্ষ এই মহাকালের যাত্রাতেও মাঝে মাঝে মনে ছায়া জমে, মেঘ হয়, সহজে সে মেঘ উড়ে যায় না। ‘জ্বালো ওগো, জ্বালো ওগো, সন্ধ্যাদীপ হৃদয়ের এক প্রান্তে. ওইটুকু আলো জ্বালো- স্বহস্তে জাগায়ে রাখো…।’ (২৩, স্মরণ)। এই চিঠি লেখার সময়কালের স্মৃতি- তা সুখ, মহা সুখ, গোপন বেদনা, তোমাকে সে ভাবে কাছে না পাওয়ার হাহাকার, এত অল্প সময়ে বিদায় নেয়া সব মিলিয়ে এখনো মানবীয় অনুভূতিগুলো জেগে ওঠে। রথীর লেখা পড়েও এরকম হয়। রথীর লেখায় আশ্চর্য এক শক্তি আছে- মা বাবার নানা স্মৃতি, অসুস্থতা, মৃত্যুর কথা রথী এমন করে লেখে যে, ভেতরের আবেগ ভাষার ওপর চেপে বসল না, কিন্তু পাঠকের মন অব্যক্ত আবেগে ওই নিরাভরণ ভাষা সরিয়ে ভিজে ওঠে। আমার মৃত্যুর সময়ের কথাগুলো, তোমার মনের ক্ষরণ রথীর লেখা থেকেই বুঝতে পারি, আমার এই চিঠি এখনকার মতো শেষও করতে চাই রথীর লেখা পড়ে।

জীবনের শেষ নিশ্বাস পড়ার দিনটি ছিল ৭ অগ্রহায়ণ ১৩০৯ রবিবার ২৯ নভেম্বর ১৯০২, সময় খুব ভোর। তোমার মতো আমারো আশা ছিল, আমরা দু’জন শেষ পর্যন্ত পরস্পরের সহায় এবং সংসারক্লান্ত হৃদয়ের একান্ত নির্ভরস্থল হয়ে জীবনকে সুন্দরভাবে বয়ে নিয়ে যাব জীবনের শেষ অঙ্কে, তারপর সব অবসান, মুক্তি ঘটবে সংসার ক্লান্তির। হলো না। বিদায় হলো আমার- তখনো রাতের অন্ধকার দূর হয়নি। আকাশে অনেক তারা। সতেরো দিন কম উনিশ বছরের সঙ্গীকে হারিয়ে তুমি ওই অন্ধকার আর তারার নিচে বাড়ির ছাদে বসে আকাশের অখণ্ড পথে তাকিয়ে রইলে। ভোরে সূর্য প্রণাম সেরে নিচে নেমে এলে। ততক্ষণে লোক খবর পেতে শুরু করেছে রবীঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যুর কথা। দিন বাড়তে বাড়তে মানুষের ভিড় বাড়ে। রথী তখন লিখেছে :

‘… সমবেদনা জানাবার জন্য সেদিন রাত পর্যন্ত লোকের ভিড়। বাবা সকলের সঙ্গেই শান্তভাবে অসম্ভব ধৈর্যের সঙ্গে কথা বলে গেলেন, কিন্তু কী কষ্টে যে আত্মসংবরণ করে তিনি ছিলেন তা আমরা বুঝতে পারছিলুম। এক মাস ধরে তিনি অহোরাত্র মা’র সেবা করেছেন, নার্স রাখতে দেন নি, শ্রান্তিতে শরীর মন ভেঙে পড়ার কথা। তার উপর শোক। যখন সকলে চলে গেল, বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে মায়ের সর্বদা ব্যবহৃত চটিজুতো জোড়াটি আমার হাতে দিয়ে কেবলমাত্র বললেন, “এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।” এই দু’টি কথা বলেই নীরবে তাঁর ঘরে চলে গেলেন।’ (পিতৃস্মৃতি )

আকাশের অখণ্ড পথ থেকে এই আমার কথা কবি !

ইতি
তোমার ছোটবউ ভাই ছুটি !