২০শে অগাস্ট, ১৯৭১।

মশরুর বিমান ঘাটি, পাকিস্তান।

সকাল প্রায় এগারোটা। টি-৩৩ বিমান নিয়ে আকাশে উড়বার কথা পাইলট অফিসার রশীদ মিনহাজের। মিনহাজের বিমানের সাংকেতিক নাম ব্লু-বার্ড ১৬৬। পাইলট অফিসার মিনহাজ যথারীতি কন্ট্রোল টাওয়ারের কাছে অনুমতি চাইলো। ব্লু-বার্ডকে নিয়ে আকাশে উড়তে চায় সে।। কন্ট্রোল টাওয়ারও কোনো গড়িমসি না করেই স্ট্যান্ডার্ড ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিলো ব্লু বার্ডকে।

ব্লু বার্ডকে নিয়ে ২৭ নম্বর রানওয়েতে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হলো মিনহাজ। ৪ নং ট্যাক্সি ট্রাক ধরে এগিয়ে সে। সামনেই একটা টিলা। এটি কিছুটা আড়াল করে রেখেছে ট্যাক্সি ট্রাককে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে। ওখানেই একটা গাড়িতে বসে ওৎ পেতে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। তীব্র গতিতে নিজের গাড়ি চালিয়ে তিনি ছুটে গেলেন ৪ নম্বর ট্যাক্সি ট্রাকের দিকে। মিনহাজকে বিমান থামানোর জন্য সংকেত দিলেন তিনি। এই ফ্লাইটের সেফটি অফিসার তিনি। কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি থাকার পরেও সেফটি অফিসারের সংকেত পেলে বিমান থামানো অনেকটা বাধ্যতামূলক। মতিউর ভাব করলেন যেনো জরুরি কিছু বলার আছে তাঁর মিনহাজকে। বিমান থামায় মিনহাজ। তারপর কথা শোনার জন্য বিমানের ক্যানোপি খোলে সে। এই সুযোগে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিমানের ককপিটে উঠে পড়েন মতিউর। শক্তি প্রয়োগ এবং ক্লোরোফর্মের সাহায্যে কাবু করে ফেলেন মিনহাজকে। এর আগেই অবশ্য তিনি গাড়িটাকে এমনভাবে ট্যাক্সি ট্রাকের উপর রেখেছেন যাতে করে অন্য কোনো টি-৩৩ তাকে ধাওয়া করতে না পারে।

ট্যাক্সি ট্রাকের মাঝপথে বিমান থামতে দেখে নাক গলায় কন্ট্রোল টাওয়ার। জানতে চায় কোনো অসুবিধা আছে কি না। ব্লু বার্ড থেকে কোনো উত্তর আসে না। এর পরিবর্তে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ব্লু বার্ড এগিয়ে যায় রানওয়ের দিকে। ঠিক একটু আগেই একটা বিমান নেমেছে রানওয়েতে। ফলে, রানওয়ে তখন খালি। এই সুবর্ণ সুযোগে ব্লু বার্ডকে নিয়ে শা করে আকাশে উঠে যান মতিউর রহমান।

অবিচলিত কণ্ঠে তিনি কন্ট্রোল টাওয়ারে খবর পাঠালেন। ব্লু বার্ড ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। কন্ট্রোল টাওয়ার তখনো হতভম্ভ, হতচকিত। বললো, ‘নিশ্চিত করে জানাও।’

বেতার সেটে মতিউর রহমানের পরিষ্কার কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘নিশ্চিত।’

রাডারে যাতে ধরা না পড়ে সে কারণে খুব নিচু দিয়ে, একেবারে মাটির গা ঘেষে ব্লু বার্ডকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকেন মতিউর রহমান। পিছনে ফেলে আসা স্ত্রী এবং দুই শিশু কন্যা নয়, তাঁর দু’চোখে ভাসছে সামনে পড়ে থাকা স্বপ্নের স্বাধীন দেশ। এই বিমান নিয়ে পৌঁছে যাবেন তিনি ভারতে। তারপর এটা দিয়ে আকাশপথে যুদ্ধ হবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাথে।

কন্ট্রোল টাওয়ারে তখন হুলুস্থূল পড়ে গেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই দু’টো এফ-৮৬ জঙ্গী বিমান উঠে পড়ে আকাশে। আশে পাশের সব বিমান ঘাটির রাডারগুলো সচল হয়ে ওঠে। চিরুনি তালাশ শুরু হয়ে যায়।

এর মধ্যে বিমানের মাঝে শুরু হয় আরেক নাটক। হঠাৎ করেই জ্ঞান ফিরে পায় মিনহাজ। একটু ধাতস্থ হতেই টের পেয়ে যায় মতিউর রহমানের উপরে। দুই দেশের দুই বীর যোদ্ধা নিজ নিজ দেশের জন্য আকাশে শুরু করে আকাশযুদ্ধের এক অসামান্য ক্লাসিক লড়াই। একজন এটিকে ছিনতাই করে নিয়ে যেতে চান তাঁর দেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। অন্যজন তার দেশের বিমানকে রক্ষার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। এ যেনো হেক্টর আর একিলিসের মরণপণ লড়াই। সেই লড়াইয়ে জিতেছিলো একিলিস। কিন্তু, এই বাস্তব লড়াইয়ে জয় হয় না কারো, পরাজয়ও ঘটে না কারো। অসমসাহসী দুই বীরের দাপাদাপি সইতে পারে না ব্লু বার্ড। দুজনকে নিয়েই ধ্বংস হয়ে যায় সে।

সারাদিন অনেক চেষ্টা করেও ব্লু বার্ডের হদিস পাওয়া যায় না। বিকালের দিকে খবর পাওয়া গেল যে, থাট্টার অদূরে ব্লু বার্ডের বিধ্বস্ত শরীর পড়ে আছে। এর দুই বৈমানিকই নিহত।

মতিউর রহমানকে মশরুর বিমান ঘাটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে কবর দেওয়া হয়। গাদ্দার বলে তাঁর জানাজা পড়ানো হয় না। কোনো রকম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই দেশের জন্য জীবন দেওয়া, বাংলাদেশের এক অকুতোভয় শ্রেষ্ঠ বীর পড়ে থাকে অনাদরে আর অবহেলায়, ভিন্ন এক দেশের মাটিতে ভিনজাতীয়দের ঘৃণার পাত্র হয়ে।

এতো গেলো ভিনদেশি মানুষদের কথা। এরা লিপ্ত ছিলো আমাদের সাথে এক অন্যায় যুদ্ধে। এদের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু, আমাদের সুমহান দেশরক্ষক রাজাকাররা, যারা আমাদেরই মাটির সন্তান। মাটির সন্তান, কিন্তু মাটি বা মানুষের প্রতি ছিলো না কোনো মায়া-মমতা, ভালবাসা। এর বিপরীতে প্রবল আক্রোশ অনুভব করতো স্বজাতির বিরুদ্ধেই। বিজাতীয় প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য নিজের দেশের মানুষের রক্তে হোলি খেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নি তারা। তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিলো? এর জন্য অবশ্য খুব বেশি অনুমান করতে হয় না।

বাঙালি মতিউর রহমান নয়, বরং পাকিস্তানি মিনহাজের বীরত্বে গর্ববোধ করেছে তারা। ৩০ শে আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম ‘আমরা গর্বিত’ নামে সম্পাদকীয় ছাপে। সেই সম্পাদকীয়তে লেখা হয়ঃ

“পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পাইলট অফিসার রশীদ মিনহাজ জাতীর জন্য নিজের জীবন কোরবানী দিয়ে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের এক অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন আমাদের সামনে রেখে গেলেন। পাকিস্তান সরকার সাহসিকতার জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাবে নিশানে হায়দার দিয়ে মরহুম মিনহাজকে সম্মানিত করছে। মরহুম মিনহাজের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কাহিনী যখন আমরা শুনেছি তখন আমাদের বুক গর্বে আনন্দে ভরে উঠেছে।”

রশীদ মিনহাজ যে একজন বীর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই রাজাকার সাহেবদের রশীদ মিনহাজের বীরত্বে গর্ব হয়, কিন্তু একজন বাঙালি বীর যে তাঁর দেশের মুক্তির জন্য একটা আস্ত যুদ্ধ বিমান ছিনতাই করে লড়াইয়ে নামতে চায়, তাকে নিয়ে কোনো গর্ববোধ করে না।

গর্ববোধ তো অনেক দূরের কথা, তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলতেও বিন্দুমাত্র বাধে না তাদের। ১লা সেপ্টেম্বর একটা লেখা ছাপা হয় দৈনিক সংগ্রামে। এর শিরোনাম ছিলো ‘শহীদ মিনহাজের জীবনের শেষ কয়েকটি মুহুর্ত’। এই লেখায় বলা হয়ঃ

“আমাকে হাইজ্যাক করা হচ্ছে – এই ছিল তার শেষ কথা যা টেপ রেকর্ডে ধরা পড়েছে। এই কণ্ঠস্বর ছিল পরিষ্কার ও জোরালো এবং কথাটি তিন বার উচ্চারণ করা হয়েছে। প্রথমবার ছিল অনুমান করার মত। ঠিক যখন বিশ্বাসঘাতক ফ্লাইট লেঃ মতিউর রহমান তাকে ক্লোরফর্ম দিয়ে কাবু করার চেষ্টা করেছিল। এই উচ্চারণ শুনে মনে হয় তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যখন তার কাছে দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তার ইন্সট্রাক্টর বিমানটিকে ভারতে নিয়ে যাবেই তখন তিনি শেষ বারের মত প্রাণপন চেষ্টা করে বিমানটিকে দুর্ঘটনাকবলিত করেন। এইভাবে তিনি দেশ ও নিজ কর্তব্যের প্রতি চুড়ান্ত আত্মত্যাগ করে গেলেন।”

শুধু সংগ্রামই নয়, ইসলামি ছাত্র সংঘের প্রধান মতিউর রহমান নিজামীও মিনহাজের জন্য শোকার্ত হয়ে ওঠে। মিনহাজ তার কাছে মহান দেশ্রেমিক আর অন্যদিকে মতিউর রহমান ভারতের হানাদার এজেন্ট। মিনহাজের বাবার কাছে শোকবার্তা পাঠায় নিজামী। দৈনিক সংগ্রাম সেপ্টেম্বরের চার তারিখে পত্রিকায় এটি তুলে আনে। শিরোনাম ছিলো, “মিনহাজের পিতার নিকট ছাত্রসংঘ প্রধানের তারবার্তা”। সেখানে বলা হয়ঃ

“পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি জনাব মতিউর রহমান নিজামী শহীদ রশীদ মিনহাজের পিতার নিকট এক তারবার্তা প্রেরণ করেছেন।

পাকিস্তানী ছাত্র সমাজ তার পুত্রের মহান আত্মত্যাগে গর্বিত। ভারতীয় হানাদার ও এজেন্টদের মোকাবেলায় মহা্ন মিনহাজের গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা অক্ষুণ্ণ রাখতে তারা বদ্ধ পরিকর।”

এই রাজাকারটাকে ফাঁসিতে না ঝুলালে, কাকে ঝুলাতে হবে বলেন?