বামে- যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, ডানে- পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান

 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া হিন্দু সমাজের অবস্থা উন্নয়নের জন্য আমার প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পর চরম হতাশা এবং দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি আপনার মন্ত্রীসভা থেকে পরদত্যাগ করছি। আমার মনে হয় আমার জানানো উচিত কেন ভারতীয় উপমহাদেশের এই ক্রান্তিকালে আমি এই সিদ্ধান্ত নিলাম।

১। আমার পদত্যাগের পিছনের কারণগুলো বলার আগে, আমার মনে হয় মুসলিম লীগের সাথে আমার সহযোগিতাকালে কি কি ঘটেছিল সেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো বলা উচিত। ১৯৪৩ এর ফেব্রুয়ারিতে লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সাথে কথা হয়। আমি তাদের সাথে বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হই। ১৯৪৩ সালের মার্চে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভার পতনের পর ২১ জন নমঃশূদ্র সদস্যের প্রত্যক্ষ সম্মতিতে তদানীন্তন মুসলিম লীগের নেতা কাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৩ এর এপ্রিলে আবার মন্ত্রীসভা গঠন করেন। আমাদের সমর্থনের পিছনে কিছু শর্ত ছিল। এর ভিতর ছিল মন্ত্রীসভায় তিনজন নমঃশূদ্র মন্ত্রীকে নিয়োগ, নমঃশূদ্রদের লেখাপড়ার উন্নয়নে ৫ লাখ টাকা সহায়তা প্রদান এবং সরকারী চাকুরিতে কোটা প্রচলন করা।


২। এসব শর্তের বাইরেও মুসলিম লীগকে সহায়তার পেছনে আমার কিছু প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, বাঙ্গালী মুসলিমদের সাথে নমঃশূদ্রদের অর্থনৈতিক স্বার্থের মিল রয়েছে। মুসলিমরা ছিল মূলত কৃষক-শ্রমিক, অস্পৃশ্যরাও তাই। মুসলিমদের একটি অংশের মত নমঃশূদ্রদের একটি অংশও ছিল জেলে। দ্বিতীয়ত, তারা উভয়েই ছিল লেখাপড়ার দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী। আমাকে বোঝানো হয়েছিল যে লীগ এবং এর মন্ত্রিসভার সাথে আমার সহযোগিতা বিশাল পরিসরে আইনগত এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করবে। এই পদক্ষেপসমূহ ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধাকে আমলে না নিয়ে বাংলার এই বিশাল জনগোষ্ঠীর পারস্পারিক উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে এবং সাম্প্রদায়িক শান্তি-সৌহার্দ্য আরো মজবুত হবে, এমনটিই বলা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা যায় যে খাজা নাজিমুদ্দিন তার মন্ত্রীসভায় অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের ৩ জন সদস্যকে নিয়েছিলেন। তিনি আমার এই সম্প্রদায় থেকে ৩ জনকে সংসদ সচিব হিসেবেও নিয়োগ দিয়েছিলেন।

 

সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভাঃ

৩। মার্চ, ১৯৪৬ এর সাধারণ নির্বাচনের পর জনাব এইচ. এস. সোহরাওয়ার্দী সেই মাসেই লীগের সংসদ নেতার পদ পান এবং এপ্রিল, ১৯৪৬ এ লীগের মন্ত্রীসভা গঠন করেন। ফেডারেশনের টিকেটে কেবলমাত্র আমিই আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে নির্বাচনে জয়লাভ করতে সক্ষম হই। আমি জনাব সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রীসভার অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। সেই বছরের ১৬ আগস্ট কলকাতায় মুসলিম লীগ কর্তৃক ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবস’ পালিত হয়। আপনার জানা আছে যে শেষ পর্যন্ত এটা এক হত্যাযজ্ঞে রূপ নেয়। হিন্দুরা লীগের মন্ত্রীসভা থেকে আমার পদত্যাগপত্র দাবী করে। আমি প্রতিদিন চিঠির মাধ্যমে হুমকি পেতে থাকি। আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি আমার পথে অবিচল থাকি। তদুপরি, আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের পত্রিকা ‘জাগরণ’ এর মাধ্যমে নমঃশূদ্রদের কাছে আবেদন জানাই তারা যেন নিজেদের কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের এই রক্তাক্ত লড়াই থেকে দূরে রাখে। আমার অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত প্রতিবেশীগণ যেভাবে আমাকে ক্রুদ্ধ হিন্দুদের হাত থেকে নিরাপত্তা দেন তা আমি কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি। কলকাতা হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৪৬ এর অক্টোবরে শুরু হয় নোয়াখালীর দাঙ্গা। সেখানে শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে(নমঃশূদ্র সহ) হত্যা করা হয় এবং জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। হিন্দু মহিলারা অপহরণ এবং ধর্ষণের শিকার হন। আমার সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরও জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি ত্রিপুরা ও ফেনী যাই এবং কিছু দাঙ্গাপীড়িত এলাকা পরিদর্শন করি। হিন্দুদের দুর্দশা আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করে, কিন্তু আমি মুসলিম লীগের সাথে সহযোগিতা চালিয়ে যাই। কলকাতার বিশাল হত্যাযজ্ঞের পরপর সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে এক ভোটাভুটি আয়োজিত হয়। শুধুমাত্র আমার চেষ্টা দ্বারাই কংগ্রেসের পক্ষের চারজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সদস্য এবং চারজন অস্পৃশ্য সদস্যের সমর্থন যোগাড় করা সম্ভব হয় যা ব্যতীত মন্ত্রীসভার পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী।

৪। ১৯৪৬ এর অক্টোবরে সম্পূর্ণ অননুমিতভাবেই জনাব সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে আমার কাছে প্রস্তাব আসে ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে একটি পজিশন গ্রহণ করার জন্য। এক ঘণ্টার মধ্যে আমাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাতে বলা হয়। বেশকিছু সময় দোদুল্যমান থাকার পর আমি এই শর্তে রাজি হই যে আমার নেতা ড. বি. আর. আম্বেদকার যদি আমাকে ঐ জায়গায় না চান তবে আমাকে পদত্যাগের অনুমতি প্রদান করা হবে। ভাগ্যক্রমে, তিনি লন্ডন থেকে টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাঁর অনুমতি প্রদান করেন। আইনসভার সদস্য হিসেবে যোগদানের লক্ষ্যে দিল্লীতে রওনা দেয়ার আগে আমি তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দীকে রাজি করাতে সক্ষম হই যে তিনি আমার স্থানে ২ জন মন্ত্রীকে মন্ত্রীসভায় জায়গা দিবেন। তিনি নমঃশূদ্রদের ফেডারেশন গ্রুপ থেকে ২ জনকে সংসদ সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতেও সম্মত হন।

৫। আমি ১৯৪৬ সালের ১ নভেম্বর মধ্যবর্তী সরকারে যোগ দেই। এক মাস পর কলকাতাতে আমি যাই। তখন জনাব সোহরাওয়ার্দী আমাকে জানালেন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কথাঃ বিশেষ করে গোপালগঞ্জের কিছু জায়গাতে যেখানে নমঃশূদ্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন সেই অঞ্চলগুলো পরিদর্শনে যেতে এবং মুসলিম ও নমঃশূদ্রদের মাঝে সমঝোতা করতে। সেইসব এলাকার নমঃশূদ্ররা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি কয়েক ডজন সভা করে তাদেরকে সেই পথ থেকে দূরে ছড়িয়ে আনি। একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে সে এলাকা মুক্তি পায়।

৬। কয়েকমাস পর ব্রিটিশ সরকার তাদের ৩ জুন ঘোষণা (১৯৪৭) প্রদান করে যাতে ভারত ভাগ বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনার অবতারণা করা হয়। পুরো দেশ, বিশেষ করে সমগ্র অমুসলিম ভারত এতে হতবাক হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবিকে আমি সবসময় শুধুমাত্র দামাদামির অংশ হিসেবেই দেখে এসেছি। যদিও আমি বিশ্বাস করি যে ভারতের সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে উঁচুবর্ণের হিন্দুদের অন্যায় প্রভাবের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ক্ষোভ ন্যায়সঙ্গত, এ বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গী পরিষ্কার যে পাকিস্তানের জন্ম সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান কখনোই করবে না। বরঞ্চ, এটা কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও শত্রুতা বৃদ্ধিই করবে। পাশাপাশি আমি এই ধারণা পোষণ করতাম যে পাকিস্তানের সৃষ্টি মুসলিমদের অবস্থা উন্নয়ন করবে না। দেশভাগের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে আসবে দরিদ্রতা, অশিক্ষা এবং উভয় দেশের জনগণের দুর্দশা যা অনির্দিষ্টকাল না হলেও বহুদিন ধরে চলতে থাকবে। আমার আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে পশ্চাৎপদ এবং অনুন্নত দেশগুলোর একটিতে পরিণত হবে।

লাহোর ঘোষণাঃ

৭। আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম যে পাকিস্তানকে ইসলামী শরিয়ত এবং নিয়ম-নীতির উপর ভিত্তি করে একটি শতভাগ ‘ইসলামী’ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস করা হবে, যা এখন করা হচ্ছে। আমার অনুমান ছিল মার্চ ২৩, ১৯৪০ এ মুসলিম লীগের গৃহীত ঘোষণা অনুসারে সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ঘটানো হবে। অন্যান্য জিনিসের মাঝে এই ঘোষণায় ছিলঃ ১- ভৌগলিকভাবে পাশাপাশি অবস্থিত স্থানসমূহ প্রয়োজনীয় ভূমির অদল-বদলের মাধ্যমে এমনভাবে ভাগ করা হবে যেন ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে স্বাধীন-সার্বভৌম একাধিক রাষ্ট্র গঠন করা যায় এবং ২- এসব অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অন্যান্য স্বার্থ-অধিকার রক্ষার নিমিত্তে তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সংবিধানে যথেষ্ঠ, কার্যক্ষম ও আবশ্যিক নিরাপত্তা প্রদানের ধারা যুক্ত করা হবে। এই ঘোষণার মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিল ক) উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বের মুসলিম অঞ্চলগুলোতে ২টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হবে, খ) এই রাষ্ট্রগুলোর অংশসমূহ হবে স্বাধীন ও স্বায়ত্বশাসিত, গ) সংখ্যালঘুদের প্রদত্ত নিশ্চয়তা তাদের স্বার্থ ও অধিকার সংশ্লিষ্ট হবে এবং জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তা ভূমিকা রাখবে এবং ঘ) সংবিধানে সংখ্যালঘুদের এই সাংবিধানিক সুবিধাদি সংখ্যালঘুদের নিজেদের দ্বারাই নির্বাচিত হবে। গণপরিষদের সভাপতি হিসেবে কায়েদ-ঈ-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর ১১ আগস্ট ১৯৪৭ এ দেয়া ভাষণ এই ঘোষণা ও লীগের নেতৃবৃন্দের ব্যাপারে আমার বিশ্বাস আরো পোক্ত করে। এই ভাষণে তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় পক্ষকেই সমানভাবে বিবেচনার দৃঢ় আশ্বাস প্রদান করেন এবং তাদের আহ্বান করেন এটা মনে রাখতে যে তারা সবাই পাকিস্তানী। ইসলামিক রাষ্ট্র ও তার মুসলিম নাগরিকদের সার্বক্ষণিক হেফাজতে সেখানে ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ণাংঙ্গ মুসলিম এবং ‘জিমি’দের মধ্যে কোনোরূপ ভেদাভেদের প্রশ্নই ছিলনা। এটা প্রতীয়মান হয় যে আপনার জ্ঞাতসারে এবং সম্মতিক্রমে কায়েদ-ঈ-আজমের ইচ্ছা ও মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হিসেবে এই সকল ওয়াদার বরখেলাপ করা হচ্ছে যা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতি ও অপমানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলা ভাগ হল
৮। এই প্রসঙ্গে এটা বলে রাখা ভালো যে বাংলা ভাগের সময় আমাকে প্রবল বিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল। এই ধরণের ক্যাম্পেইনের ফল আমি শুধু বিরোধিতার সম্মুখীন হই নাই, হয়েছি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, অপমানিত এবং অবজ্ঞার শিকার। হতাশার সাথে আমি সেই সব দিনের কথা চিন্তা করতে চাই যখন ভারতবর্ষের ৩২ কোটি হিন্দু আমাকে হিন্দু এবং হিন্দু ধর্মের শত্রু বানিয়ে ছিল।আমি ছিলাম পাকিস্তানের প্রতি একান্ত অনুগত এবং অবিচল আস্থা। আমি চিন্তা করতাম পাকিস্তানের ৭০ লক্ষ হিন্দু দলিতের কথা যারা ছিল আমার সাথে। তারাই আমাকে সর্বদা সাহস যুগিয়েছে এবং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

৯। ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর আপনি পাকিস্তান মন্ত্রীসভা গঠন করেন। আমি এর একজন সদস্য ছিলাম। খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ব বাংলার জন্য একটি প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠন করেন। আগস্টের ১০ তারিখে আমি করাচীতে খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে কথা বলে পূর্ব বাংলার মন্ত্রীসভায় নমঃশূদ্রদের মধ্যে থেকে ২ জনকে নিয়োগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করি। তিনি কিছুদিন পরেই তা করবার আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আপনার, খাজা নাজিমুদ্দীন এবং পূর্ব বাংলার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সাথে আমার অপ্রীতিকর এবং হতাশাজনক আপসরাফা চলে। যখন আমি বুঝতে পারলাম যে খাজা নাজুমুদ্দীন এই-সেই অজুহাতে ব্যাপারটিকে এড়িয়ে চলছেন তখন আমি একইসাথে ক্রুদ্ধ এবং অধৈর্য হয়ে পড়লাম। আমি এই ব্যাপারে পাকিস্তান মুসলিম লীগে এবং এর পূর্ব বাংলা শাখার সভাপতিদ্বয়ের সাথেও আলোচনা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমি ঘটনাটি আপনার গোচরে আনি। আপনি সাগ্রহে আমার উপস্থিতিতে আপনার বাসায় খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা করেন। খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকায় ফিরে অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত একজনকে মন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হন। তার আশ্বাসের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে ওঠায় আমি কাজটি সম্পাদনের নির্দিষ্ট সময়-সূচী জানতে চাই। আমি জোর দাবী জানাই এই ব্যাপারে এক মাসের মধ্যে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য, অন্যথায় পদত্যাগের ব্যাপারে আমার সিধান্তে কেউ বাধা দিতে পারবে না। আপনারা দুজনেই এই প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেন। কিন্তু হায়, সম্ভবত আপনার মুখের কথা আপনার মনের প্রতিচ্ছবি ছিল না। খাজা নাজিমুদ্দীন তার ওয়াদা পালন করেন নি। জনাব নুরুল আমিন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবার পর আমি তার কাছেও এই বিষয়টি নিয়ে যাই। তিনিও সেই পুরাতন এড়িয়ে চলার নীতি চালিয়ে যান। ১৯৪৯ এ আপনার ঢাকা আগমনের প্রাক্কালে যখন আমি ব্যাপারটি আবারো আপনার গোচরে আনি আপনি আমাকে আশ্বস্ত করেন যে পূর্ব বাংলায় সংখ্যালঘু মন্ত্রী অবশ্যই নিয়োগপ্রাপ্ত হবে। আপনি আমার কাছে বিবেচনার জন্য ২/৩ জনের নামও চান। আপনার চাওয়ার প্রতি সশ্রদ্ধ বাধ্যবাধকতা প্রদর্শন করে আমি আপনার কাছে পূর্ব বাংলা পরিষদের ফেডারেশন গ্রুপ এবং ৩ জনের নাম সুপারিশ পূর্বক চিঠি পাঠাই। আপনি ঢাকা থেকে ফেরার পর আমি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিতে গেলে আপনি কঠিন মনোভাব প্রকাশ করেন এবং “নুরুল আমিনকে দিল্লী থেকে ফিরতে দাও” কেবলমাত্র এই মন্তব্যটুকু করেন। কিছুদিন পর আমি আবার বিষয়টি তুলে ধরি, কিন্তু আপনি তা এড়িয়ে যান। তখন আমি এই উপসংহারে আসতে বাধ্য হই যে আপনি বা নুরুল আমিন কেউই চান না যে পূর্ব বাংলা মন্ত্রীসভায় কোনো নমঃশূদ্র ব্যক্তি নিয়োগ পাক। এছাড়াও আমি দেখতে পারছিলাম যে জনাব নুরুল আমিন এবং পূর্ব বাংলা লীগের কিছু নেতৃবৃন্দ নমঃশূদ্রদের ফেডারেশন সদস্যদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছিলেন। আমার কাছে প্রতীয়মান হয় যে আমার নেতৃত্ব এবং বিশাল জনপ্রিয়তাকে খারাপ চোখে দেখা হচ্ছে। পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে নমঃশূদ্রদের স্বার্থ সংরক্ষণে আমার স্পষ্টবাদিতা, তদারকি এবং আন্তরিক কার্যকলাপ পূর্ব বাংলা সরকার এবং লীগের কিছু নেতার মনে বিরক্তির সৃষ্টি করে। কিন্তু এসব কিছুর পরোয়া না করে আমি পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করি।

হিন্দু বিদ্বেষী নীতি

১০। বাংলা ভাগের প্রসঙ্গ উঠতেই নমঃশূদ্ররা এর বিপদজনক ফলাফলের কথা অনুমান করে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দীর কাছে তারা কিছু প্রতিনিধি পাঠালে তিনি সানন্দে একটি প্রেস রিলিজ ইস্যু করেন যাতে বলা ছিল নমঃশূদ্ররা ভোগ করছে এমন কোনো সুবিধা ও অধিকারই কর্তন করা হবেনা, বরং আরো বৃদ্ধি পাবে। জনাব সোহরাওয়ার্দী এই আশ্বাস কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ভাবেই দেননি, লীগ মন্ত্রীসভার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও দিয়েছেন।অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে ভারত ভাগের পরে, বিশেষ করে কায়েদ-ঈ-আজমের মৃত্যুর পর থেকে নমঃশূদ্ররা কোনো বিষয়েই তাদের প্রাপ্য বুঝে পায়নি। আপনার স্মরণে থাকবে যে আমি সময়ে সময়ে এই অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠীর দুর্দশার চিত্র আপনার সামনে তুলে ধরেছি। বেশকিছু ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার অকার্যকর প্রশাসনের চিত্র আপনার কাছে ব্যাখ্যা করেছি। পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ দাখিল করেছি। অসার ভিত্তির উপর নির্ভর করে পুলিশের বর্বর নৃশংসতার ঘটনাসমূহও আমি আপনার নজরে এনেছি। পূর্ব বাংলার সরকার বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের একাংশের হিন্দু বিদ্বেষী নীতির কথা আপনাকে জানাতেও আমি কুণ্ঠাবোধ করিনি।

কিছু
ঘটনাঃ

১১। প্রথম যে ঘটনা আমাকে মর্মাহত করে তা ঘটেছিল গোপালগঞ্জের দিঘারকুল গ্রামে। সেখানে স্থানীয় নমঃশূদ্রদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা মিথ্যা অভিযোগে গুজব রটিয়ে বর্বরতা চালায়। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে একজন মুসলিম জেলে মাছ ধরতে জাল ছুঁড়ে মারে। একজন নমঃশূদ্র একই উদ্দেশ্যে জাল ছুঁড়ে মারে। এই নিয়ে দুইজনের ভিতর কথা কাটাকাটি হয়। মুসলিম যুবক গ্রামে গিয়ে মিথ্যা গুজব রটায় যে তাকে এবং এক মহিলাকে নমঃশূদ্ররা আক্রমণ করেছে। গোপালগঞ্জের উপ জেলা প্রশাসক সে সময় নৌকায় করে সে জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কাছে অভিযোগ করলে তিনি কোন তদন্ত ছাড়াই সশস্ত্র পুলিশ পাঠান নমঃশূদ্রদের দমন করতে। তাদের সাথে স্থানীয় মুসলিমরা যোগ দেয়। তারা নমঃশূদ্র হিন্দুদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। তাদের হামলায় বাড়িঘর ধ্বংস হয়, প্রচুর নারী পুরুষ আহত হয়। শেষ সহায় সম্বলটুকু লুট করে নিয়ে যায় মুসলিমরা। এক হিন্দু মহিলা যিনি কিনা ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা তাকে পিটিয়ে গর্ভপাত করে দেয় তারা। বিশাল এলাকা জুড়ে আতংক সৃষ্টি হয়।

১২। হিন্দুদের উপর পুলিশ দিয়ে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের পরের ঘটনা ঘটে ১৯৪৯ সালের শুরুতে। বরিশাল জেলার গৌরনদীর পুলিশ সুপারের অধীনে। পুলিশের একদল সোর্স তাদের প্রতিপক্ষকে কমিউনিস্ট বলে চালিয়ে দেয় পুলিশের কাছে। তারা এও বলে ঐ পক্ষ পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করবে। গৌরনদী থানার ওসি এই শুনে কোনরকম সত্যতা যাচাই না করে হেডকোয়ার্টার থেকে পুলিশের রিসার্ভ ব্যাটালিয়ন নিয়ে আসেন। পুলিশ বাহিনী বিশাল এলাকা অবরুদ্ধ করে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ চালায়। প্রচুর লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। শিক্ষক এবং ছাত্রদের কমিউনিস্ট সন্দেহে আটক করা হয়। তাদের উপর নির্যাতন চালানো হয়। আমি ঘটনাটা জানতে পারি কারণ ঘটনাস্থল আমার গ্রামের বাড়ির কাছেই। আমি জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারকে জানাই এবং নির্দেশ দেই ঘটনা তদন্তের জন্য। কিন্তু আমার চিঠিতে কোন কাজ হয় নাই। আমি তখন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ মহল মানে আপনার কাছে ঘটনাটা জানাই। কিন্তু আপনি কোন ব্যবস্থা নেন নাই।

সামরিক বাহিনী দিয়ে মহিলাদের উপর নির্যাতন
১৩। সিলেট জেলার হাবিবগড়ের নিরীহ হিন্দুদের উপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর অত্যাচারের বিষদ বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি। নিরীহ হিন্দু এবং মহিলাদের উপর  নির্মম নির্যাতন চলে। বিশেষ করে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এর শিকার হয়। মহিলাদের শ্লীলতাহানি করা হয় এবং তাদের বাড়িঘরে লুটপাট চলে। পুলিশের সাথে স্থানীয় মুসলিমরা যোগ দেয়। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে হিন্দু মহিলাদের নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। আমি আপনার কাছে এই ঘটনার কথাও রিপোর্ট করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনি তদন্তের আশ্বাস দিয়েও এর কোন সুরাহা করেন নাই।

১৪। রাজশাহীর নাচোলে একটি ঘটনার কথা বলি। কমিউনিস্টদের দমনের নামে পাকিস্তানের পুলিশ স্থানীয় মুসলিমদের নিয়ে হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালায় এবং তাদের সম্পদ লুটপাট করে। স্থানীয় সাঁওতালরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। তারা সেখানে তাদের উপর চালানো বর্বরতার কথা বলে।

১৫। খুলনা জেলার মোল্লারহাটের অন্তর্গত কালশিরা গ্রামে ২০ ডিসেম্বর,১৯৪৯ এ ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নির্মম ও ঠাণ্ডা মাথায় ঘটানো এসব ঘটনার একটি উদাহরণ। সেদিন গভীর রাত্রে কালশিরা গ্রামের জনৈক জয়দেব ব্রাহ্মা এর বাড়িতে সন্দেহজনক কমিউনিস্টদের খোঁজে ৪ জন কনস্টেবল হানা দেয়। পুলিশের আসার সংবাদে জনা ছয়েক তরুণ, কমিউনিস্ট বা সাধারণ, বাড়িটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ বাড়িতে ঢুকে জয়দেব ব্রাহ্মার স্ত্রী এর উপর আক্রমণ চালালে তার চিৎকার তার স্বামী এবং বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া তার কিছু সঙ্গীর কানে আসে। মরিয়া হয়ে তারা গৃহে পুনঃপ্রবেশ করে এবং ৪ জন কনস্টেবলকে কেবলমাত্র একটি বন্দুক সহ পায়। সম্ভবত এই দৃশ্য তাদের প্রণোদিত করে এবং তাদের আঘাতে অস্ত্রধারী কনস্টেবলটি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। তারা তারপর দ্বিতীয় কনস্টেবলের উপরও হামলা চালালে বাকি ২ জন সেখান থেকে পালিয়ে যেয়ে আশেপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং সফল হন। কিন্তু গ্রামবাসী এগিয়ে আসবার আগেই রাতের অন্ধকারে অপরাধীগণ মৃতদেহসহ গা ঢাকা দেয়। পরদিন বিকেলে খুলনার এস.পি. একদল মিলিটারি এবং আর্মড পুলিশসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ইতোমধ্যে অপরাধীগণ এবং বুদ্ধিমান প্রতিবেশীগণ অত্র এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। কিন্তু বেশিরভাগ গ্রামবাসীই তাদের নিজ ঘরেই রয়ে যায় কারণ তারা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং পরবর্তীতে কি ঘটতে পারে সে সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই ছিলনা।
এর পর এসপি, মিলিটারি ও আর্মড পুলিশ পুরো গ্রামজুড়ে নিরীহ গ্রামবাসীকে মারধর শুরু করে এবং আশেপাশের মুসলিমদের লুটপাটে প্ররোচিত করে। বেশকিছু মানুষ নিহত হয়, বহু হিন্দু নর-নারীকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। বাসাবাড়ির দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙচুর করা হয়, পূজোর স্থান অপবিত্র ও ধ্বংস করে দেয়া হয়। পুলিশ, মিলিটারি এবং স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য কর্তৃক হিন্দু মহিলারা ধর্ষিত হন। এভাবে শুধুমাত্র এক থেকে দেড় মাইল দৈর্ঘ্যের গ্রাম, এক বিরাট জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল কালশিরাই নয়, এর আশেপাশের বেশকিছু নমঃশূদ্র গ্রামেও বাস্তবিক অর্থেই নরক নেমে আসে। কালশিরা গ্রামটি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কখনোই কমিউনিস্ট কার্যকলাপের জন্য সন্দেহের তালিকাভুক্ত ছিল না। কালশিরা থেকে ৩ মাইল দূরবর্তী ঝালরডাঙ্গা গ্রামটি কমিউনিস্ট কার্যকলাপের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ঘটনার দিন এই গ্রামটিতে সন্দেহভাজন কমিউনিস্টদের ধরতে পুলিশের এক বিরাট বাহিনী হানা দিলে তাদের কিছু সংখ্যক পালিয়ে কালশিরা গ্রামের পূর্বোল্লিখিত বাড়িতে আশ্রয় নেয় যা তাদের কাছে নিরাপদ আত্মগোপনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।

১৬। ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমি কালশিরা গ্রাম এবং তার সংলগ্ন গ্রামগুলো পরিদর্শন করতে যাই। খুলার পুলিশ সুপার এবং মুসলিম লীগের নেতারা আমার সাথে ছিলেন। আমি যখন কালশিরাতে পৌঁছাই এক ধ্বংসপ্রাপ্ত বিরানভূমি দেখি। পুলিশ সুপ্র জানা এখানে ৩৫০ বাড়ি ছিল। এর ভিতর মাত্র ৩ টি বাড়ি টিকে আছে। সব লুটপাট করা হয়েছে। আমি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, প্রধান সচিব, পুলিশ প্রধান এবং আপনার কাছে ঘটনাটি জানিয়ে ছিলাম।

১৭। কালশিরার ঘটনা পশ্চিমবাংলার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে হিন্দুদের মাঝে উত্তেজন দেখা দেয়। এই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া হিন্দুরা সেখানে গিয়ে এই ভয়াবহতার কথা বললে সেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয়।


ফেব্রুয়ারির
হিংসার কারণগুলো

১৮। এটা স্বীকার করতেই হবে কালশিরার মত পূর্ব বাংলার হানাহানির ফলে পশ্চিম বাংলাতেও সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখা দেয়। পূর্ব বাংলার মিডিয়ার খবর সেখানে আলোড়ন ফেলে। ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক পরিষদে বাজেট অধিবেশনে সংসদ সদস্যরা স্পীকারের কাছে অনুমতি চান কালশিরা এবং নাচোলের পরিস্থিতি নিয়ে সম্পূরক আলোচনা করার জন্য। কিন্তু অনুমতি নিলে নাই। সদস্যরা প্রতিবাএ ওয়াক আউট করেন। কপ্রাদেশিক পরিষদের হিন্দু সদস্যদের এই প্রতিবাদ মুসলিম  মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং অফিসারদের রুষ্ট করে। সম্ভবত ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব বাংলার হিংসার কারণ এটাই।

১৯। ১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টা। ঢাকায় পূর্ব বাংলার সচিবালয়ে একজন মহিলাকে হাজির করা হয়। তার স্তন কাটা ছিল। বলা হয় সে কলকাতা দাঙ্গার শিকার। সাথে সাথে সচিবালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীরা কাজ বন্ধ করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তারা মিছিল বের করে এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক শ্লোগান দেয়। মিছিল ক্রমে বড় হয় এবং একসময় এক মাইল লম্বা হয়। ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে মিছিল শেষ হয় দুপুর বারোটার দিকে। সেখানে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেওয়া হয়। এর ভিতর ছিল কিছু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা।

সবথেকে মজার বিষয় হচ্ছে যখন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই মিছিল বের করেছিলেন তখন পূর্ব বাংলার প্রধান সচিব পশ্চিমবাংলার প্রধান সচিবের সাথে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন খোদ সচিবালয়ে কিভাবে দুই বাংলার সাম্প্রদায়িক হিংসা কমানো যায় সেই বিষয়ে!!!

সরকারী কর্মকর্তাদের মদদে লুটেরাদের হামলা

২০।  দাঙ্গা শুরু হল সেদিন দুপুর একটার দিকে। সারা শহরে একই সাথে। সারা শহরে হিন্দুদের হত্যা, লুণ্ঠন আর অগ্নিসংযোগ চলতে থাকে। মুসলিমরা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই এইসব অপরাধ চালায়। হিন্দুদের স্বর্ণের দোকানে পুলিশের উপস্থিতিতেই লুটপাট চলে। এমনকি তারা লুটেরাদের দিকনির্দেশনাও দেয় কিভাবে লুটপাট করতে হবে সে বিষয়ে। আমি সেদিন অর্থাৎ ১৯৫০ এর ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এসে পৌঁছাই বিকাল পাঁচটার দিকে। আমি কাছ থেকেই ঘটনাগুলো দেখি। যা দেখেছি এবং যা শুনেছি সত্যি তা ছিল মর্মস্পর্শী এবং হৃদয়বিদারক।

২১। ঢাকার দাঙ্গার পেছনে প্রধান কারণ ছিল ৫টিঃ

(i) কালশিরা এবং নাচোলের ঘটনাসমূহের উপর আনিত ২টি মুলতবি প্রস্তাব গণপরিষদে প্রত্যাখ্যাত হলে হিন্দু প্রতিনিধিদের স্পর্ধিত ওয়াক আউটের জন্য হিন্দুদের শিক্ষাপ্রদানের উদ্দেশ্যে
(ii)  সংসদীয় দলে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ এবং নাজিমুদ্দীন গ্রুপের মাঝে দিনকে দিন বেড়ে চলা মতবিরোধ ও পার্থক্য
(iii) পূর্ব বাংলার মন্ত্রণালয় এবং মুসলিম লীগ হিন্দু-মুসলিম উভয় পক্ষের নেতাদের দ্বারা পূর্ব-পশ্চিম দুই বাংলার মিলনের স্বপক্ষে একটি আন্দোলন শুরু হতে পারে এমন ভয়ে ভীত ছিল। তারা এই মিলন রোধ করতে চাইছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল যে পূর্ব বাংলায় যেকোনো বড় আকারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাব পশ্চিম বঙ্গেও পড়বে এবং সেখানে মুসলিমদের হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে। উভয় বঙ্গে এরূপ দাঙ্গা দুই বাংলার মিলনকে অসম্ভব করে তুলবে বলে তাদের বিশ্বাস ছিল।
(iv) পূর্ব বাংলার বাঙালী এবং অবাঙালী মুসলিমদের মধ্যে বৈরিতা ক্রমশ বাড়ছিল। এটা রোধের একমাত্র উপায় ছিল পূর্ব বঙ্গের মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো। ভাষার ব্যাপারটিও এর সাথে জড়িত ছিল এবং
(v) অবমূল্যায়নে অসম্মতি এবং ইন্দো-পাকিস্তান ব্যবসার ক্ষেত্রে অচলাবস্থার ফলাফল পূর্ব বাংলায় অনুভূত হচ্ছিল, প্রথমে শহরাঞ্চলে পরবর্তীতে গ্রামাঞ্চলেও। মুসলিম লীগের সদস্য এবং কর্মকর্তাগণ এই আসন্ন অর্থনৈতিক ধ্বস থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে দিতে হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদের সূচনা করতে চেয়েছিলেন।

হতভম্বকারী বর্ণনা-প্রায় ১০,০০০ মৃত্যুঃ

২২। ঢাকায় আমার ৯ দিনের অবস্থানকালে আমি শহর ও শহরতলীর বেশিরভাগ দাঙ্গা আক্রান্ত অঞ্চলে গিয়েছি। তেজগাঁও এর অন্তর্ভুক্ত মিরপুরেও আমার যাওয়া হয়েছে। আমি সবচেয়ে মর্মাহত হয়েছি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেনে শত শত নিরপরাধ হিন্দু হত্যার খবরে। ঢাকার দাঙ্গার দ্বিতীয় দিনে আমি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাকে অনুরোধ করি দাঙ্গা যেন জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ যেন তিনি অবিলম্বে জেলা কর্তৃপক্ষ গুলোর নিকট পৌঁছে দেন। ২০ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫০ তারিখে আমি বরিশাল শহরে পৌঁছে সেখানকার ঘটনা শুনে বিস্মিত হয়ে যাই। জেলা শহরে বেশকিছু হিন্দু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়, প্রচুর হিন্দু নিহত হয়। আমি জেলাটির প্রায় সব দাঙ্গা আক্রান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। জেলা শহরের ৬ মাইলের মধ্যে অবস্থিত এবং গাড়ি চলাচলের রাস্তা দিয়ে সংযুক্ত কাশিপুর, মাধবপাশা, লাকুটিয়ার মত জায়গাগুলোয় ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ দেখে আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। মাধবপাশা জমিদার বাড়িতে প্রায় ২০০ মানুষ নিহত হন, আহত হন আরো অন্তত ৪০ জন। মুলাদী নামক স্থানে যেন নরক নেমে আসে। স্থানীয় মুসলিমদের ও কিছু কর্মকর্তার ভাষ্য অনুসারে শুধু মুলাদী বন্দরেই ৩০০এর বেশি লোক নিহত হয়। আমি মুলাদী গ্রামও পরিদর্শন করি এবং সেখানে মৃতদেহের কঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখি। কুকুর এবং শকুন নদীর ধারে মৃতদেহ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। আমাকে অবগত করা হয় যে সকল পূর্ণবয়স্ক পুরুষকে হত্যার পর সমস্ত যুবতীদের দুর্বৃত্ত দলের হোতাদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। রাজাপুরের অন্তর্গত কৈবর্তখালী নামক স্থানে ৬৩ জন নিহত হয়। থানা থেকে ঠিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত হিন্দু বাড়িগুলোতেও লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, সেগুলোতে বসবাসকারীদের হত্যা করা হয়। বাবুগঞ্জ বাজারের সকল হিন্দু দোকানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, বহু হিন্দু নিহত হয়। বিস্তারিত বর্ণনা পাবার পর কম করে ধরলেও দেখা যায় শুধুমাত্র বরিশাল জেলাতেই ২,৫০০ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে পূর্ব বঙ্গে মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার! সব খোয়ানো নারী-শিশুদের স্বজন হারাবার হাহাকারে আমার হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজের কাছেই জানতে চাইলাম “ইসলামের নামে পাকিস্তানে কি ঘটতে চলেছে”।

দিল্লী চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকতার অভাবঃ

২৩। মার্চের শেষভাগে বিশাল সংখ্যায় হিন্দুরা বাংলা ছাড়তে শুরু করে। মনে হচ্ছিল কিছুদিনের মধ্যেই সকল হিন্দু ভারতে চলে যাবে। ভারতে রণধ্বনি বেজে উঠলো। পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ল। জাতীয় দুর্যোগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিল। ৮ এপ্রিলের দিল্লী চুক্তি অবশ্য এই অনুমিত দুর্যোগকে থামিয়ে দিতে পারল। ভয়ার্ত হিন্দুদের মনোবল পুনরুদ্ধারের আশায় আমি সারা পূর্ব বাংলা চষে বেড়ালাম। আমি ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা ও যশোরের অনেক স্থান পরিদর্শন করলাম। আমি বহু বড় বড় জনসমাবেশে হিন্দুদের নিকট আহ্বান জানাই তারা যেন তাদের সাহস ধরে রাখে এবং নিজেদের পূর্বপুরুষের ভিটা-মাটি ছেড়ে না যায়। আমি আশা করেছিলাম যে পূর্ব বাংলার সরকার এবং মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ দিল্লী চুক্তির শর্তসমূহ যথাযথভাবে পালন করবে। কিন্তু যতই সময় গড়াতে লাগল আমি উপলব্ধি করলাম এই দুই পক্ষের কেউই দিল্লী চুক্তির শর্তাদি পালনের ব্যাপারে প্রকৃতরূপে উৎসাহী নয়। দিল্লী চুক্তির শর্ত মোতাবেক একটি সিস্টেম দাঁড় করাতে পূর্ব বাংলার সরকার যে শুধুমাত্র অক্ষম ছিল তাই নয়, সেই বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপও তারা নিতে চায়নি। দিল্লী চুক্তির পরপর বেশ কিছু হিন্দু তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে আসলেও ইতোমধ্যে মুসলিমদের দখলে চলে যাওয়া তাদের জায়গা-জমি ও ঘরবাড়ি আর ফিরে পায়নি।


মাওলানা আকরাম খানের প্রেরণায়ঃ

২৪। ‘মোহাম্মাদী’ নামক একটি মাসিক পত্রিকার ‘বৈশাখ’ সংখ্যায় ছাপা হওয়া প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আকরাম খানের সম্পাদকীয় পড়ে লীগের নেতৃবৃন্দের মনোভাব সম্বন্ধে আমার অনুমান যে অভ্রান্ত তা আমি বুঝতে পারি। ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী ড. এ. এম. মালিকের প্রচারিত প্রথম রেডিও বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি এই সম্পাদকীয় লিখেন। ড. মালিক বলেন, “এমনকি নবী হযরত মুহম্মদ(সাঃ)ও আরবের ইহুদীদের নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন”। মাওলানা আকরাম খান এর প্রেক্ষিতে বলেন, “ড. মালিক তার বক্তব্যে আরবের ইহুদীদের প্রসঙ্গ না টানলেই ভাল করতেন। এটা সত্য যে নবী হযরত মুহম্মদ(সাঃ) আরবের ইহুদীদের নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; কিন্তু সেটা ছিল ইতিহাসের প্রথম অংশ মাত্র। শেষদিকে তাঁর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল এরকম – আরব থেকে সকল ইহুদীদের বিতাড়িত কর”। মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক জীবনে অতি উচ্চ পদে আসীন একজন ব্যক্তির এহেন মন্তব্যের পরেও আমি আশা করে ছিলাম যে নুরুল আমিন মন্ত্রীসভা এতটা আন্তরিকতাশূন্য হবেনা। কিন্তু দিল্লী চুক্তির শর্ত মেনে নিতে যখন নুরুল আমিন ড. এন. বারারীকে মন্ত্রী মনোনিত করলেন তখন আমার সমস্ত আশা চূর্ণ হয়ে গেল। শর্তে ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনে হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তাদের একজন করে প্রতিনিধি পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলার মন্ত্রীসভায় নিয়োগ পাবে।

নুরুল আমিন সরকারের আন্তরিকতাশূন্য কার্যকলাপঃ

২৫। আমার এক সাধারণ বিবৃতিতে আমি ড. এন. বারারীকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবার ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে বলি যে এর ফলে কোনো বিশ্বাস তো ফেরত আসবেই না বরং নুরুল আমিন সরকারের আন্তরিকতে বিষয়ে যদি সংখ্যালঘুদের মনে কিছু আশার মরীচিকা তখনো জেগে থাকে তবে তাও পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।আমার নিজস্ব মত হল নুরুল আমিনের সরকার যে শুধু আন্তরিকতাহীন কাজ করেছে তাই নয়, তাদের ইচ্ছা ছিল দিল্লী চুক্তির প্রধান প্রধান লক্ষ্যসমূহ অর্জনে বাধা প্রদান করা। আমি আবারো বলতে চাই যে ড. এন. বারারী নিজেকে ছাড়া আর কারো প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি কংগ্রেসের টিকেটে সংগঠনটির টাকা এবং সাংগঠনিক শক্তির সুবাদে বাংলার আইনসভায় ফিরে আসতে সক্ষম হন। তিনি নমঃশূদ্রদের ফেডারেশনটির প্রার্থীদের বিরোধিতা করেছিলেন। নির্বাচিত হবার কিছুদিন পর তিনি কংগ্রেসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেডারেশনে যোগ দেন। মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হবার কালে তিনি ফেডারেশনেরও সদস্য ছিলেন না। বাঙ্গালী হিন্দুরা আমার সাথে একমত হবেন যে পূর্ববর্তী কার্যকলাপ, চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে দিল্লী চুক্তি অনুসারে মন্ত্রী নিযুক্ত হবার পক্ষে বারারী বিবেচনার উপযুক্ত নন।

২৬। আমি জনাব নুরুল আমিনকে এই পদের জন্য ৩ জনের নাম সুপারিশ করেছিলাম। এদের মধ্যে একজন ছিলেন এমএ, এলএলবি, অ্যাডভোকেট, ঢাকা হাইকোর্ট। তিনি প্রথম ফজলুল হক মন্ত্রীসভার সময়কালে ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রায় ৬ বছর ধরে কোলকাতার কয়লা খনি গুদামজাত বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। তিনি নমঃশূদ্রদের ফেডারেশনটির সহ-সভাপতি ছিলেন। আমার দ্বিতীয় সুপারিশ ছিলেন একজন বিএ, এলএলবি। সংস্কার ঘটার আগে তিনি ৭ বছর যাবৎ আইনসভার সদস্য ছিলেন। আমি জানতে ইচ্ছুক ঠিক কোন কারণে জনাব নুরুল আমিন এই দুজন ভদ্রলোককে বাদ দিয়ে এমন একজনকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলেন সঙ্গত কারণেই যার নিয়োগের বিরোধিতা আমি করেছিলাম। কোনো প্রতিবাদের মুখোমুখি হবার ভয় ছাড়াই আমি বলতে পারি জনাব নুরুল আমিনের বারারীকে দিল্লী চুক্তি অনুসারে মন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয়াই এর চরম প্রমাণ যে পূর্ব বাংলার সরকার এখানকার হিন্দুদের জান-মাল, সম্মান ও ধর্ম ঠিক রেখে জীবনধারণের উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য সম্পাদিত দিল্লী চুক্তিকে কখনোই গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সাথে বিবেচনা করেনি।

সরকারী মদদে হিন্দুদের নির্মূল করার চেষ্টা

২৭। আমি এই প্রসঙ্গে আমি আমার পূর্ণ বিশ্বাস এবং সন্দেহ ব্যক্ত করতে চাই যে পূর্ব বাংলা সরকার এই প্রদেশ থেকে হিন্দুদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করতে চায়। এই বিষয়ে আমি আপনাকে একাধিকবার সাক্ষাতে অনেক কথা বলেছি। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি পশ্চিম পাকিস্তান হিন্দু নিধনে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে এই প্রক্রিয়া সফলতার সাথে অগ্রসর হচ্ছে। ডি এন বারারি এর নিয়োগ এবং আমার এই বিষয়ে অসম্মতির পরও পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে তারা কি অর্থে নিজেদের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র দাবি করে। পাকিস্তান না হিন্দুদের বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে না পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়েছে। এখন তারা হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মারতে চায় যাতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবন তাদের দ্বারা আর প্রভাবিত না হতে পারে।

যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর বিষয়টিকে এড়িয়ে চলাঃ

২৮। আমি বুঝতে পারি না নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যাপারটিতে কেন এখনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। সংখ্যালঘু সাব-কমিটি তৈরির পর ৩ বছর পার হয়ে গেছে। ৩বার মিটিংও হয়ে গিয়েছে। গত ডিসেম্বরে কমিটির সভায় যৌথ বা পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যাপারে কথা উঠলে পাকিস্তানের সকল স্বীকৃত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিগণ পশ্চাৎপদ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর জন্য সংরক্ষিত আসন রেখে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর স্বপক্ষে মত দেন। আমরা নমঃশূদ্রদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রেখে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি জানাই। গত আগস্টের আরেক সভাতেও এই ব্যাপারে কথা উঠে। কিন্তু এর উপ কোনোরূপ আলোচনা ছাড়াই সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পাকিস্তানী শাসকদের সময়ক্ষেপণের নীতির পেছনে কোন মতলব কাজ করছে তা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হবার কথা নয়।

হিন্দুদের দুঃসহ ভবিষ্যৎ

২৯। এখন আসি দিল্লী চুক্তির ফলে পূর্ব বাংলার হিন্দুদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমি বলতে পারি এখন হিন্দুদের অবস্থা শুধু হতাশাজনক নয় বরং সম্পূর্ণ আশাহীন এবং ভবিষ্যৎ অন্ধাকার অমনিশায় আচ্ছন্ন। পূর্ব বাংলার হিন্দুদের ভিতর আস্থা ফিরিয়ে আনতে কিছুই করা হচ্ছে না। চুক্তিটি মুসলিম লীগ কাগজের ভিতরই সীমাবদ্ধ রেখেছে। বিপুল সংখ্যক হিন্দু শরণার্থী বিশেষ করে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এলেও এটা প্রমাণ করে না যে হিন্দুদের আস্থা ফিরে এসেছে। বরং এটা প্রমাণিত হয় পশ্চিম বাংলা বা ভারতীয় ইউনিয়নের ভিতর তাদের পুনর্বাসনের কোন সুযোগ নেই। উদ্বাস্তু জীবনের বেদনাই তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে বাধ্য করেছে।
পাশাপাশি অনেকেই ফিরে আসছে তাদের অস্থাবর সম্পত্তি সাথে নিয়ে যেতে এবং স্থাবর সম্পত্তির একটা গতি করতে। পূর্ব বাংলায় অতি সাম্প্রতিককালে কোনো বড় রকমের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে নি, কিন্তু এর কৃতিত্ব দিল্লী চুক্তিকে দিলে তা ভুল হবে। কোনো চুক্তি বা আপস ছাড়াই এটা একসময় বন্ধ হত, সহজভাবে বলতে গেলে এটা এভাবে চলতে থাকা ছিল অসম্ভব।

৩০। স্বীকার করতেই হবে দিল্লী চুক্তি সমস্যায় সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। এই চুক্তির ভিতর ছিল কিছু শর্ত যাতে ভারত এবং পাকিস্তানের ভিতর বিবদমান সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়। কিন্তু চুক্তির ছয় মাস পরেও কিছুই হয় নাই। অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে দেশে এবং বিদেশে অপ্প্রচার চালিয়েই যাচ্ছে পুরোদমে। মুসলিম লীগ দ্বারা সারা পাকিস্তান জুড়ে কাশ্মীর দিবস পালন করা এর একটি উদাহরণ। পাকিস্তান শাসিত পাঞ্জাবের গভর্নরের সাম্প্রতিক বক্তব্য যাতে তিনি উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী দরকার ভারতের মুসলিমদের রক্ষায়, পাকিস্তানের আসলে চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে। এই ধরণের বক্তব্য দুইদেশের ভিতর শুধু উত্তেজনাই বাড়াবে।

পূর্ব বঙ্গের বর্তমান চিত্রঃ

৩১। এখন পূর্ব বাংলার অবস্থা কেমন? দেশভাগের পর থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ হিন্দু দেশ ছেড়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারীর দাঙ্গা বাদেও এর পেছনে বহু কারণ কাজ করেছে। মুসলিমদের বয়কটের কারণে আইনজ্ঞ, মেডিকেল প্র্যাকটিশনার, দোকানদার, বিক্রেতা ও বণিক সহ প্রায় সব পেশার হিন্দুদেরই জীবিকার খোঁজে পশ্চিম বঙ্গে চলে যেতে হয়েছে। আইনগত পদ্ধতি অনুসরণ না করেই হিন্দু বসতবাড়ির সম্পূর্ণ মালিকানা কিনে নেয়া এবং বাড়ির মালিকদের কোনোরূপ ভাড়া পরিশোধ না করার ফলে তারা ভারতে আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। হিন্দু জমিদারদের খাজনা দেয়া বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তদুপরি, হিন্দুদের নিরাপত্তার প্রতি সবসময়ের হুমকি হিসেবে আছে আনসার যাদের ব্যাপারে আমি সব জায়গা থেকে অভিযোগ পেয়েছি। শিক্ষা এবং তা প্রদানের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাজে ইসলামীকরণের নামে হস্তক্ষেপ হাইস্কুল এবং কলেজের শিক্ষকদের তাদের পরিচিত পরিবেশের বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছে। তারা এই বাংলা ছেড়ে যাচ্ছে। ফলে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি জানতে পেরেছি যে কিছুদিন আগে শিক্ষা কর্তৃপক্ষ একটি সার্কুলার প্রকাশ করেন যাতে সব সম্প্রদায়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য পবিত্র কোরআন হতে আবৃত্তি বাধ্যতামূলক করা হয়। আরেকটি সার্কুলারের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকদের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বিভিন্ন ব্লক জিন্নাহ, ইকবাল, লিয়াকত আলী, নাজিমুদ্দীন প্রমুখ ১২ জন পরিচিত মুসলিমদের নামে নামকরণ করতে বলা হয়। অতি সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেন যে পূর্ব বাংলার ১৫০০ ইংরেজি স্কুলের মধ্যে মাত্র ৫০০টি চালু আছে। মেডিকেল প্র্যাকটিশনারেরা দেশ ছেড়ে যাওয়ায় রোগীদের সঠিক চিকিৎসা প্রাপ্তির আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। হিন্দু বসতবাড়িতে পূজা-অর্চনা করতেন এমন প্রায় সকল পুরোহিত দেশ ত্যাগ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলো পরিত্যক্ত পড়ে রয়েছে। ফলে পূর্ব বাংলার হিন্দুদের জন্য বিয়ের মত সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো যেখানে একজন পুরোহিতের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক সেসব পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দেব-দেবীর মূর্তি প্রস্তুতকারী শিল্পীরাও দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। পুলিশ এবং সার্কেল অফিসারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্মতিতে দমনমূলক নীতির মাধ্যমে ইউনিয়ন বোর্ডগুলোর সভাপতির পদ থেকে হিন্দুদের মুসলিমদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। হিন্দু প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের সচিবদেরও মুসলিমদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। হাতে গোনা যে অল্প কজন হিন্দু সরকারী চাকরিজীবি আছেন তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। হয় তাদের জুনিয়র মুসলিম সহকর্মীরা তাদের পেছনে ফেলে উপরে উঠে যাচ্ছে অথবা যথেষ্ট বা কোনো কারণ ছাড়াই তাদের অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। অতি সাম্প্রতিককালেই একজন হিন্দু পাবলিক প্রসিকিউটরকে কোনো কারণ ছাড়াই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। শ্রীযুক্তা নেলি সেনগুপ্ত এর এক বিবৃতিতে ঘটনাটি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা আছে। অন্তত তাঁকে কেউ মুসলিম বিদ্বেষী বলে চিহ্নিত করতে পারবে না।

হিন্দুরা রীতিমত নিরাপত্তাহীন

৩২। হিন্দুদের সম্পত্তি চুরি-ডাকাতি এবং হত্যাকাণ্ডও আগের মত চলছে। থানা পুলিশ হিন্দুদের অভিযোগ নিচ্ছে না। অবশ্য হিন্দু মেয়েদের জোরপূর্বক অপহরণ এবং ধর্ষণের সংখ্যা আগের থেকে কমে গেছে। এর কারণ হল পূর্ব পাকিস্তানে ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সে কোন হিন্দু মেয়ে আর নেই। আর যারা পালাতে পারে নাই তারা মুসলিম গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচে নাই। আমি অনেক খবর পেয়েছি নিম্নবর্ণের হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণের খবর। হিন্দুরা বাজারে পাট এবং কৃষিপণ্য বিক্রি করতে যায়। মুসলিম ক্রেতারা খুব কম সময়ই পুরো দাম দেয়। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানে আইনের শাসন নেই, বিশেষ করে হিন্দুদের জন্য।

পশ্চিম পাকিস্তানে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণঃ

৩৩। পূর্ব পাকিস্তানের কে পাশে সরিয়ে এখন পশ্চিম পাকিস্তান, বিশেষ করে সিন্ধ এর দিকে মনোনিবেশ করা যাক। দেশভাগের পর পশ্চিম পাঞ্জাবে প্রায় লাখ খানেক অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ছিল। এদের মধ্যে একটা বড় অংশকে ইসলামে ধর্মান্তর করা হয়। কর্তৃপক্ষের কাছে বারংবার আবেদনের পরেও অপহৃত ১২ জন নমঃশূদ্র মেয়ের মাঝে কেবল মাত্র ৪ জনকেই এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে। অপহৃত মেয়েদের নাম ও তাদের অপহরণকারীদের নাম সরকারের নিকট পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। এই অপহরণের ঘটনার অফিসার-ইন-চার্জের সাম্প্রতিকতম উত্তরে ছিল “তার কাজ হল হিন্দু মেয়েদের উদ্ধার করা এবং ‘অচ্ছুতেরা’ (অস্পৃশ্য/নমঃশূদ্র) হিন্দু নয়”। যে ক্ষুদ্র হিন্দু জনগোষ্ঠী এখনো সিন্ধ এবং পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে বসবাস করছে তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। আমার কাছে করাচি ও সিন্ধ এর ৩৬৩টি হিন্দু মন্দির ও গুরুদুয়ারার একটি তালিকা আছে(যা কোনো উপায়েই সম্পূর্ণ নয়) যারা এখনো মুসলিমদের দখলে রয়েছে। কিছু কিছু মন্দিরকে মুচির দোকান, কসাইখানা এবং হোটেলে পরিণত করা হয়েছে। কোনো নোটিশ ব্যাতিরেকেই হিন্দুদের কাছ থেকে জমিজমা কেড়ে নিয়ে শরণার্থী ও স্থানীয় মুসলিমদের ভাগ করে দেয়া হয়েছিল, তাদের কেউই আর তা ফেরত পায় নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি ২০০ থেকে ৩০০ হিন্দুকে চিনি যারা বহুকাল পূর্বেই তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃক এই অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাদের সম্পত্তি তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। শত্রু সম্পত্তি নয় হিসেবে ঘোষিত হবার পরেও করাচি পিঞ্জিরাপোল এখনো ট্রাস্টিদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয় নি। করাচিতে আমি বহু হতভাগ্য বাবা ও স্বামীর কাছ থেকে আবেদন পেয়েছি অপহৃত হিন্দু মেয়েদের সম্পর্কে, যাদের বেশিরভাগই ছিল নমঃশূদ্র। এ ব্যাপারে আমি দ্বিতীয় প্রাদেশিক সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। কিন্তু এ ব্যাপারে অগ্রগতি ছিল শূন্যের কোঠায়। আমি অত্যন্ত দুঃখ পাই একথা জেনে যে সিন্ধ এ এখনো অব্দি বসবাস করা নমঃশূদ্রদের এক বিরাট অংশকে জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে।

পাকিস্তান, হিন্দুদের জন্য অভিশাপঃ

৩৪। উপরের সংক্ষিপ্ত চিত্র থেকে এটা বলাই চলে যে সবদিক দিয়েই পাকিস্তানের হিন্দুরা আজ নিজভূমে পরবাসী। তাদের একমাত্র দোষ হল তারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ বারবার বলছেন পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র আছে এবং থাকবে। ইসলামকে সকল বৈশ্বিক পঙ্কিলতা দূরীকরণের পথ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের পারস্পরিক সাংঘর্ষিক মতবাদের মধ্যে আপনি ইসলামিক গণতন্ত্রের আনন্দজনক সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধকে তুলে ধরছেন। শরীয়ত অনুসারে মুসলিমরা একচ্ছত্র শাসক এবং হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের নিরাপত্তায় বেঁচে থাকা জিমির মত। এর জন্য তাদের আবার দামও দিতে হয়। এবং অন্য সকলের চেয়ে আপনি ভাল করে জানেন প্রধান মন্ত্রী সাহেব এর পরিমাণ কতটুকু। দীর্ঘ বিবেচনার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে পাকিস্তান হিন্দুদের বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত স্থান নয়। এখানে তাদের ভবিষ্যত হল ধর্মান্তরিত হওয়া অথবা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। উচ্চ বংশীয় এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই এর মধ্যে পূর্ব বাংলা ছেড়ে গেছে। যেসকল অভিশপ্ত হিন্দু পাকিস্তানে থেকে যাবে আমার আশঙ্কা ধীরে ধীরে পরিকল্পনামাফিক তাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হবে নয়ত ধ্বংস করে দেয়া হবে। এটা আসলেই অবাক করার মত ব্যাপার যে আপনার মত একজন শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা, অভিজ্ঞ ব্যক্তি মানবতার প্রতি হুমকিস্বরূপ এবং সকল সমতা ও শুভবোধের ধ্বংসকারী এরূপ মতবাদে পরিপূর্ণ হবার নজির রেখে যাচ্ছেন। আমি আপনাকে এবং আপনার সাথীদের বলতে চাই যে যেরূপ খুশি ব্যবহার করা হোক বা লোভ দেখানো হোক না কেন, হিন্দুরা নিজেদের জন্মভূমিতে নিজেরা জিমি হিসেবে গণ্য হতেও পিছপা হবে না। আজকে হয়ত অনেকে দুঃখে নয় ভয়ে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগামীকাল তারা জীবনের অর্থনীতিতে নিজেদের স্থান আদায় করে নেবার জন্য সংঘর্ষে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কে বলতে পারে ভবিষ্যত কি লুকিয়ে রেখেছে? যখন আমি নিশ্চিত যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে আমার অবস্থান হিন্দুদের কোনো উপকারেই আসছে না তখন নিজের বিবেকের কাছে নিজেকে পরিষ্কার রাখার জন্যই আমি পাকিস্তান এবং বিদেশের হিন্দুদের মনে এমন কোনো মিথ্যে আশার জন্ম দিতে চাই না যে তারা এখানে সম্মান এবং জান-মাল ও সম্পত্তির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সহকারে বসবাস করতে পারবে। হিন্দুদের নিয়ে বলার ছিল এটুকুই।

মুসলমানদেরও সামাজিক স্বাধীনতা নেই

৩৫। সেই মুসলিমদের কি খবর যারা মুসলিম লীগ এবং তার দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্রকে সমর্থন করেন না? পাকিস্তানে সামাজিক স্বাধীনতা বলতে কিছু নাই। উদাহরণস্বরূপ খান আবদুল গাফফার খান নামক সেই ধর্মপ্রাণ মুসলিমের কথা চিন্তা করুন। কিংবা তার দেশপ্রেমিক ভাই ডা খান সাহিবের পরিণতি চিন্তা করুন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পূর্ব বাংলার নেতাদের আপনারা বিনা বিচারে আটকে রেখেছেন। বাংলাতে মুসলিম লীগের বিজয় পতাকা বহনকারী জনাব  সোহরাওয়ার্দিকে এখন সরকারের ইচ্ছায় চলতে হয় এবং মুখ খুলতেও অনুমতি লাগে।  বাংলার প্রবীণ বৃদ্ধ নেতা, লাহোর প্রস্তাবের উত্থাপনকারী জনাব ফজলুল হক বর্তমানে ঢাকা হাই কোর্টের চারদেয়ালের মাঝে তার একাকী জমিতে লাঙ্গল চড়াচ্ছেন এবং তথাকথিত ইসলামিক চিন্তাতে লিপ্ত যেটা সম্পূর্ণ অমানবিক। আর পূর্ব বাংলার সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করুনঃ তারা ভালো আছে বলতে পারবে না। তারা আশ্বাস পেয়েছিল স্বায়ত্তশাসন এবং আঞ্চলিক স্বাধিকারের। কিন্তু তারা আসলেই কি পেয়েছে? যদিও পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের মিলিত জনসংখ্যার চেয়ে বেশি মানুষ এখানে থাকে, তবুও পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। এই অবিচারের পরও করাচীর কোন অধিকার নেই সেখান থেকে অয়াদেশ জারি করার। পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর আগ্রহ এই বিচিত্র ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাথর ছুঁড়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে মরু সিন্ধু এবং পাঞ্জাব থেকে সাহায্য পাওয়ার বদলে।


আমার নিজের দুঃখভারাক্রান্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা

৩৬। পাকিস্তানের সমগ্র চিত্র আর অন্যের প্রতি অবিচার আর শোষণের কথা বাদ দিলেও আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আপনি প্রধানমন্ত্রী এবং শাসকদলের প্রধান হিসেবে আপনার নিজের অবস্থান ব্যবহার করে আমাকে একটি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে বলেছিলেন এবং আমি গত ৮ সেপ্টেম্বর তা করেছিও। আপনি জানতেন আমি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং অর্ধসত্যের সংমিশ্রণে কোন বক্তব্য দিতে রাজি না। কিন্তু আমি একজন মন্ত্রী এবং আপনার অধীনে কাজ করছি। তাই আমার পক্ষে এই অনুরোধ রক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। কিন্তু এই মিথ্যার ভার আর বহন করা আমার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয় এবং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আপনার মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করবো। এই পদত্যাগপত্র আমি এখনই আপনার হাতে জমা দিচ্ছি এবং আমি আশা করছি আপনি বিন্দুমাত্র দেরি না করে তা গ্রহণ করবেন। অবশ্যই আপনার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এই পদত্যাগপত্র নিয়ে কি করবেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। অথবা আপনার ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রীতিনীতি এবং উদ্দেশ্যের সাথে মিলে এমন কোন উপায়ে লুকিয়ে ফেলা।
আপনার বাধ্যগত
এসডি./-জে এন মণ্ডল
৮ অক্টোবর ১৯৫০

(ইংরেজি থেকে অনূদিত) 


মূল পত্রটি এখানে পাবেন 
Resignation letter of Jogendra Nath Mandal

পরিশিষ্টঃ
১। যোগেন মণ্ডল বরিশালের মৈস্তারকান্দি গ্রামে নমঃশূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ ও বিএল ডিগ্রি নিয়ে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি বরিশাল সদর লোকাল বোর্ডেও সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে সাধারণ নির্বাচনে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে বাখরগঞ্জ উত্তর-পূর্ব আসন থেকে অশ্বিনী দত্তের ভাইপো সরল দত্তকে হারিয়ে এমএলএ নির্বাচিত হন। সরল দত্ত জমিদার এবং উচ্চবর্ণেও মানুষ ছিলেন। তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জিতেছেন। নির্দলীয় প্রার্থী হওয়ায় নমঃশূদ্র এবং মুসলমানদের ভোটও পেয়েছেন। কিন্তু নমঃশূদ্রের প্রার্থী ছিলেন না। তিনি যতখানি এই নির্বাচনে শূদ্রনেতার চেয়ে জননেতার ইমেজটাই মুখ্য হতে পারে। কিন্তু তাঁর এই অভূতপূর্ব সাফল্যকে ম্লান করা হয় শূদ্রনেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায়। ১৯৪০ সালে তিনি সুভাষচন্দ্র বসু ও শরৎ বসুর সহযোগিতায় কলকাতা সিটি করপোরেশনের ৩নং বটতলা ওয়ার্ড থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি তফশিলি ফেডারেশনের প্রার্থী হিসেবে পিরোজপুর-পটুয়াখালী কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে সোহরাওয়ার্দির মন্ত্রিসভায় বিচার, পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রী হন। ৪৭-এর দেশভাগে তাঁর সায় ছিল না। তিনি দেশভাগের বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তবে দেশভাগের পাশাপাশি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা গঠনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম, শরৎ বসু প্রমুখ নেতা, সে উদ্যোগের সঙ্গেও ছিলেন যোগেন মণ্ডল। অন্যরা জাতীয় নেতার স্বীকৃতি পেলেও যোগেন মণ্ডল হয়ে পড়লেন সমালোচিত ও বিতর্কিত। তিনি তখন করাচি চলে যান। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের অস্থায়ী স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৫ আগস্ট দেশভাগ গলে তিনি পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ঢাকা-বরিশাল-খুলনা অঞ্চলে ভয়াবহ দাঙ্গায় সংখ্যালঘুদের পক্ষে সরকারের নীরবতার প্রতিবাদে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এর পরের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। এর পরে তিনি কলকাতা চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও কোনো নির্বাচনেই বিজয়ী হতে পারেননি। এমনকি ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে বামফ্রন্টের সমর্থন নিয়ে আরপিআই-এর প্রার্থী হিসেবেও বারাসাত লোকসভা কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন। এভাবেই ১৯৩৭ সালের বিজয়ী নায়ক ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবন শেষে করুণ পরাজয়ের মধ্য থেকে মঞ্চ থেকে বিদায় নেন। আস্তে আস্তে তিনি হারিয়ে যান বাংলার ইতিহাস থেকেও।

২। ভারতে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী অহিংস আন্দোলনের অন্যতম নেতা খান আবদুল গাফফার খান (সীমান্ত গান্ধী) ১৯৮৮ সালের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানের পেশোয়ারে ইন্তেকাল করেন। আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবেও তার পরিচিতি ছিল। ফখরে আফগান বা বাদশাহ খান নামেও তিনি পরিচিত। মহাত্মা গান্ধীর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন তিনি।
১৮৯০ সালে তত্কলীন ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (বর্তমানে পাকিস্তান) তার জন্ম। তার বাবা বৈরম খান ছিলেন একজন ভূস্বামী। ব্রিটিশ মিশনারি স্কুল এডওয়ার্ড মিশন স্কুলে তার পড়াশোনা।
পারিবারিক উত্সাহেই তিনি ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু এক সতীর্থের প্রতি ব্রিটিশ কর্মকর্তার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। মায়ের হস্তক্ষেপে এ সময় ইংল্যান্ডে পড়াশোনায়ও ইস্তফা দেন।
তিনি দেখলেন, ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং সংস্কারই হবে বেশি উপযোগী, যার অংশ হিসেবে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে খোদাই খিদমতগার আন্দোলন। এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। ’৪৭-এর দেশভাগের বিরোধী ছিলেন তিনি। দেশভাগের পর পাকিস্তান সরকার তাকে বেশ ক’বার গ্রেফতার করে।
১৯৮৫ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন তিনি। ১৯৮৭ সালে প্রথম অভারতীয় হিসেবে তিনি ভারতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ভারতরত্নে ভূষিত হন।
অত্যন্ত ধর্মভীরু মুসলিম ছিলেন তিনি। আফগানিস্তানের জালালাবাদে তিনি সমাহিত।

৩। ২০ ডিসেম্বর ১৯৪৯। খুলনা জেলার বাগেরহাট মহাকুমার মোল্লার হাট থানার কালশিরা গ্রামের জয়দেব বর্মার বাড়িতে শেষ রাতে কয়েকজন কম্যুনিস্ট সন্দেহভাজনকে গ্রেফতারের জন্য ৪ পুলিশ কনেস্টবল অভিযান চালায়।কোন আসামীকে না পেয়ে,একজন পুলিশ কনেস্টবল জয়দেবের স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়।গৃহবাসীদের তাৎক্ষণিক প্রতিরোধে হানাদারদের একজন নিহত হয়। হৈচৈ শুনে আশপাশের মানুষ এসে বাকি তিনজনকে উদ্ধার করে।পরের দিন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসার বাহিনী এসে কালশিরা ও পার্শবর্তী হিন্দু গ্রামে বিভীষিকা সৃষ্টি করে।হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্মান্তরিতকরনের ঘটনা হয়। এক মাসের মধ্যে ৩০ হাজার হিন্দু নরনারী ভারতে চলে যায়।

৪। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ বাহিনীর একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে একদল কনস্টেবল নাচোলের চণ্ডীপুর গ্রামে চাঁদা তুলতে আসে। গ্রামবাসী সংগঠিত হয়ে পুলিশ বাহিনীকে পাল্টা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করতে থাকে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে উম্মত্ত গ্রামবাসী ওই পুলিশ কর্মকর্তা ও পাঁচ জন পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর নাচোলের চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার দু’দিন পর ৭ জানুয়ারি শুরু হলো পুলিশের প্রতিশোধ। দুই হাজার সেনা কাছাকাছি রেলওয়ে স্টেশনের কাছে উপস্থিত হয়ে অভিযান শুরু করে। বারোটি গ্রাম ঘেরাও করে তছনছ করে, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, চারিদিকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে অনেক গ্রামবাসীকে। নারীদের ওপর যৌন অত্যাচার এমনকি শিশুদের ওপরও নির্যাতন করে। এই আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন ইলা মিত্র।