কেউ যদি শৈশবে ডিজনীর কার্টুন না দেখে থাকে, তাহলে তার শৈশবই যেন অসম্পূর্ণ। ছোট্টবেলার সেই প্রেম অনেকের বড়বেলায়ও কাটে না। ডিজনীর কার্টুনগুলো সৃষ্টিশীলতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। চোখ ধাঁধানো রংয়ের ব্যবহার, চরিত্র নির্মাণসহ সব কিছুতে তাদের অঙ্কনশিল্পের তুলনা শুধু তারাই। ডিজনী কার্টুন তৈরি করে যাচ্ছে সেই ৩০ এর দশক থেকে। রূপকথার গল্পকে কার্টুন বা অ্যানিমেশনের মাধ্যমে তারা যাত্রা শুরু করে। ১৯৪২ সালে অস্ট্রিয়ান লেখক ফেলিক্স সালটেন এর ব্যাম্বি, আ লাইফ ইন দ্য উডজ উপন্যাসের অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রায়ণ করে ওয়াল্ট ডিজনী। বিখ্যাত অ্যানিমেটর ডেভিড হ্যান্ডের তত্ত্বাবধানে অনেকজন সিক্যুয়েন্স ডিরেক্টর কাজ করে ব্যাম্বি ছবিটি নির্মাণ হয়। ব্যাম্বি ডিজনীর নির্মিত পঞ্চম চলচ্চিত্র।
১৯২৩ সালে লেখা ফেলিক্স সালটেন এর উপন্যাসটি সূচনা লগ্নের পরিবেশবাদী উপন্যাস। ইউরোপের বনভূমিতে ব্যাম্বি নামের হরিণশিশুর জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং মানুষের দ্বারা বনাঞ্চল ধ্বংসের করুণ পরিণতি নিয়ে গড়ে ওঠে এর পটভূমি। এটি ছিল বয়স্ক পাঠকের জন্য লেখা, তাই কিছুটা ধীর ও বিষণ্ণ। ডিজনী কাহিনীটিকে আমেরিকার বনের পরিবেশে প্রতিস্থাপিত করে এবং শিশুদের উপযোগী করে তৈরি করে। অ্যানিমেশন ক্লাসিক হিসেবে এটি আজও সমান সমাদৃত।
Love is a song that never ends . . . . গান দিয়ে শুরু হয় ফিল্মটি এবং পুরো কাহিনী জুড়ে বর্ণনা করে যেতে থাকে কথাটির গুরুত্ব। একটি সুন্দর সকালে বনের রাজপুত্র হরিণশিশু ব্যাম্বির জন্ম হয়। তাকে দেখতে বনের সকলে ভীড় করে। তার সাথে থাম্পার নামের এক উৎসাহী খরগোশের বন্ধুত্ব হয়। সে তাকে হাঁটতে, কথা বলতে এবং পাখি, ফুল, প্রজাপতি সবকিছুর নাম শিখতে সাহায্য করে। আমেরিকার বনাঞ্চলের ভোঁদরসদৃশ একটি প্রাণী স্কাঙ্ক, যারা ফুলের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। ব্যাম্বি এমন একজনেরও বন্ধু হয় এবং তাকে নাম দেয় ফ্লাওয়ার। তারা তিনজন একইসাথে বড় হতে থাকে।
শিশু ব্যাম্বি সবকিছুতে অবাক হয়। বৃষ্টি পড়া দেখে, বৃষ্টির পানি বয়ে যাওয়া দেখে, বনের প্রাণীর ছুটোছুটিতে, ফুল, পাখি, ঘাস, লতা পাতা, জলে নিজের ছায়া, যা—ই দেখে অবাক হয়। আবার বজ্রপাতের শব্দে ভয় পেয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকায়। ব্যাম্বি খুব মাতৃসংলগ্ন হয়ে বড় হতে থাকে। কিছুটা বড় হলে তার মা তাকে তৃণভূমিতে নিয়ে যায়। তৃণভূমি খোলা আর অরক্ষিত বলে খুব সাবধানে এগোতে হয়।
ফেলিন নামে এক মেয়ে হরিণশিশুর সাথে তার দেখা হয়। ব্যাম্বি খুব লাজুক স্বভাবের ছিল। ক্রমে সে ফেলিনের বন্ধু হয়ে যায়।
একদিন তৃণভূমিতে সে হরিণদলের প্রধানকে দেখে। এই প্রবীণ হরিণকে সবাই গ্রেট প্রিন্স অফ দ্য ফরেস্ট বলে। হঠাৎ গ্রেট প্রিন্স কিছু একটা দেখে সবাইকে পালানোর সঙ্কেত দেয়। নেপথ্যে গুলির শব্দ শুনে আমরা বুঝতে পারি, বিপদের কারণ।
ঝোপের ভেতর পালিয়ে যায় ব্যাম্বি ও তার মা। পরে সব শান্ত হলে ব্যাম্বি মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘What happened, mom? Why did we all run?’ মা উত্তরে বলেন, ‘Man was in the forest’. এই কথাটি পরে এতটাই প্রচলিত হয়ে যায় যে, যখন ডিজনীর কোম্পানীর কর্ণধার ওয়াল্ট ডিজনী অফিসের হলরূমে আসতেন, তখন বাকি কর্মকর্তা, কর্মচারীরা তাঁর উপস্থিতি বোঝানোর জন্য Man is in the forest বাক্যটিকে সঙ্কেত হিসেবে ব্যবহার করতেন।
বনে একসময় আসে পাতাঝড়া শীতকাল। জলাশয়ের পানি জমে শক্ত হয়ে যায়। তাতে ব্যাম্বি আর থাম্পার খেলা করে। শীতকালে খাবারের প্রাপ্যতা কমে গেলে তাদের ধৈর্য ধরে টিকে থাকতে হয়। আবার একদিন বনে গুলির শব্দ শোনা গেলে ব্যাম্বি উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে থাকে। নিরাপদে পৌঁছে দেখে তার মা আসতে পারে নি। ব্যাম্বির বাবা গ্রেট প্রিন্স জানান, তার মা আর কখনো ফিরে আসবে না। সে তার বাবার সাথে চলতে শুরু করে।
বড় হয়ে বন্ধুদের মধ্যে ফিরে আসে ব্যাম্বি। ক্রমে থাম্পার ও ফ্লাওয়ার নিজ নিজ সাথী খুঁজে নিয়ে যূথবদ্ধ হয়। ব্যাম্বি ফেলিনের দেখা পায়। তারাও যূথবদ্ধ হয়। কিন্তু একটা ষন্ডা ধরণের হরিণ ফেলিনকে বলপূর্বক কেড়ে নিতে চাইলে ব্যাম্বির সাথে তার লড়াই অনিবার্য হয়ে পড়ে। ব্যাম্বিকে তার চেয়েও বিপুল শরীরের হরিণের সাথে লড়াই করে ফেলিনকে পেতে হয়।
তাদের প্রেম ঘনীভূত হয়। এটাকে চিত্রয়িত করা হয় I bring you a song, for I’m seeking romance গানের মাধ্যমে।
বনে আবার মানুষের আক্রমণ হয়। এবার লেলিহান আগুনে জ্বলে যায় বনের বিশাল অংশ। বনের সব প্রাণী ভয়ে পালাতে শুরু করে। কিছু হিংস্র শিকারী কুকুর ফেলিনকে তাড়া করে। ব্যাম্বি অনেক লড়াই করে ফেলিনকে বাঁচিয়ে পালানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয়। ব্যাম্বির বাবা তাকে আগুন বাঁচিয়ে পালাতে সাহায্য করে। তারা বনের আরও গভীরে চলে যায়। সেখানে ব্যাম্বি ফেলিনকে খুঁজে পায়। যথাসময়ে ফেলিনের ব্যাম্বির মত দেখতে জমজ বাচ্চা হয়। Love is a song that never ends . . . . গানের মাধ্যমে শেষ হয় কল্পনাশৈলিতে ভরা চলচ্চিত্রটি।
ছবিটিতে সংলাপ খুবই কম। সর্বসাকুল্যে ১০০০ শব্দের মত সংলাপ আছে। ফিল্মটি মূলত দৃশ্যায়ন নির্ভর। কিন্তু এর আবহ সঙ্গীত মন হরণ করার মত। এতে আছে চারটি গান যা চল্লিশের দশকের পাশ্চাত্য ক্লাসিক ঘরানার। পূর্বোক্ত দুটি গান ছাড়াও আছে বর্ষার গান Drip drip drop little April shower এবং বসন্তের গান Lets Sing A Little Spring Song.
১৯৩৩ সালে পরিচালক সিডনী ফ্রাঙ্কলিন উপন্যাসের লেখকের কাছ থেকে ফিল্ম বানানোর অনুমতি নেন। কিন্তু পরে নির্মাণের ঝামেলা দেখে ১৯৩৭ সালে ডিজনীর কাছে সত্ত্ব বিক্রি করেন। ডিজনী এটা নিয়ে কাজ শুরু করলেও বিভিন্ন কারণে কাজ পিছিয়ে যায়। ১৯৩৯ সালে এর স্টোরিবোর্ডিংয়ের কাজ শুরু হয়। তারপরও ১৯৪২ এর আগে একে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয় নি। এ থেকেই বোঝা যায় কতটা সময় আর যত্ন নিয়ে চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছে।
যদিও ডিজনী এর আগেও পশু পাখির অ্যানিমেশন করেছিল, তবুও ব্যাম্বি তৈরির সময় তারা অ্যানিমেশনকে অনেক বেশি বাস্তবিক করতে চেয়েছিল। রিকো লেব্রুন নামে এক চিত্রকর, যিনি পশু পাখির ছবি আঁকতেন, তিনি ডিজনী অ্যানিমেটরদের পশু পাখির চলন বলন সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দেন। ডিজনী কোম্পানীর ভিতরে একটি ছোট চিড়িয়াখানা স্থাপন করে তার ভিতরে খরগোশ, পেঁচা, হাঁস, একজোড়া হরিণশিশু এনে রাখা হয়, যাতে ব্যাম্বির অ্যানিমেটররা খুব কাছে থেকে তাদের চলাফেরা দেখে আঁকায় প্রয়োগ করতে পারে। বনের দৃশ্যের জন্য ডিজনীর চিত্রকর মরিস জেক ডে পূর্ব আমেরিকার বনাঞ্চলে প্রায় বছরখানেক ঘুরে বেড়ান এবং ছবি তুলেন। পরে টাইরাস উওং নামক এক চীনা অ্যানিমেটর বনভূমির উপর তাঁর কিছু ইম্প্রেশানিস্ট ছবি দেখান। মরিস ডে ছবি দেখে পছন্দ করে তাঁকে ব্যাম্বির আর্ট ডিরেক্টর নিযুক্ত করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ব্যাম্বি ইউরোপে ব্যবসা করতে পারে না। ফলে ডিজনীকে লোকসান গুণতে হয়। ১.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে বানানো ব্যাম্বির ১৯৪২ সালের প্রথম রিলিজে শুধু ১.৬৪ মিলিয়ন উঠে আসে। সমালোচকরাও ছবিটিকে খুব ভাল দৃষ্টিতে দেখেন নি। কিন্তু পরে ১৯৪৭, ৫৭, ৬৬, ৭৫, ৮২ এবং ৮৮ তে এর রি-রিলিজ বের হয় এবং ব্যাম্বি লাভের মুখ দেখে। আজ ব্যাম্বিকে শুধু ডিজনীর নয়, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ক্লাসিক হিসেবে দেখা হয়। রটেন টোমাটোর জরিপে এটা এখনো ৯১% সজীব। আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিট্যুট বা AFI এর গত শতাব্দীর সেরা অ্যানিমেশন ফিল্মের তালিকায় এর অবস্থান ৩য়। ব্যাম্বির ভিলেন চরিত্র মানুষ, যাকে দৃশ্যে আনা হয় নি, তা খল চরিত্র হিসেবে AFI এর তালিকায় ২০ তম অবস্থানে আছে। ব্যাম্বি তিনটি বিভাগে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়।
ব্যাম্বি শিশুদের জন্য নির্মিত হলেও তা বড়দেরও সমানভাবে আকর্ষণ করে। একটা শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ব্যাপারটি খুব সুন্দর করে দেখানো হয়েছে এতে। কাহিনী, আবহ সঙ্গীত, অঙ্কন, সব বিষয়েই এটি একটি মাস্টারওয়ার্ক।
চমৎকার সিনেমা। দেখেছি অনেক আগেই, তথ্যগুলোর জন্য ধনবাদ…
দেখতে হবে সময় করে… (F)