ছয়

এদিকে ৬ দফা দাবীতে আন্দোলন দানা বাঁধে-ক্রমে তীব্র হতে থাকে। শেখ মুজিব যেমন সারা দেশে ৬ দফার প্রচারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তেমনি সরকারও তাকে বারংবার কারারুদ্ধ করছে। এক জেল থেকে বের হলে জেল গেইট থেকে গ্রেপ্তার করে আরেক জেলে ঢোকানো হচ্ছে তাকে। দীর্ঘ পাঁচ মাসাধিক কাল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হল। অভিযুক্তদের সামরিক হেফাজতে রাখা হল এবং অভিযুক্তদের বিচারের জন্য এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করা হল। প্রবাসী বাঙ্গালীদের নিযুক্ত ব্রিটিশ এমপি ব্যারিষ্টার টমাস উইলিয়াম শেখ মুজিবের পক্ষে কৌশলী হিসাবে যোগ দেন। মামলা যখন শুরু হল, তখন প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকায় তার বিবরণ প্রকাশ হতে লাগল। সাধারণ মানুষের মধ্যে তা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করতে লাগল। আলমের বাবা ইত্তেফাক পত্রিকা আনতেন প্রায়স। আলম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তা পড়তেন। তার বাবাই তাকে প্রথম শিখিয়ে দেয় কিভাবে পত্রিকার সংবাদ পড়তে হয় এক পাতা থেকে অন্য পাতায় গিয়ে। পত্রিকার এসব সংবাদ আলমের বাবা সবিস্তারে বুঝিয়ে বলতেন। বাঙালির মুক্তিত্রাতা হিসাবে শেখ মুজিব মানুষের মনের মণিকোটায় আস্তে আস্তে স্থান করে নিতে লাগল। শেখ মুজিবের মুক্তির দাবী ক্রমে গণদাবীতে পরিণত হতে লাগল। শুরু হলো হরতাল, আন্দোলন। গঠিত হলো সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফা দাবী উত্থাপন করল। ১৯৬৯ এর ২০শে জানূয়ারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া এক ছাত্র মিছিলের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বাঁধে। মিছিলের উপর গুলি ছুড়ে পুলিশ। নিহত হন ছাত্র নেতা আসাদ। আসাদের লাশ তীব্র করে তুলে গণ আন্দোলনকে। আসাদের রক্তমাখা তাজা লাশ গণআন্দোলনকে গণঅভ্যূত্থানে রূপান্তরিত করে। টগবগ করে ফুটতে থাকে বাংলার মানুষ। সেকি আবেগ! সেকি উত্তেজনা! আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসল ছাত্ররা। বিক্ষোভ-সমাবেশ-মিছিল নিত্যদিনের বিষয়ে পরিণত হল। পুলিশের সহায়তায় সেনাবাহিনী নামানো হল। কার্ফু জারী করা হল। কিন্তু জনতা প্রতিনিয়ত সে কার্ফু ও জরুরী অবস্থা ভাঙ্গতে লাগল । সৈন্যদের নির্বিচার গুলিতে আরো কিছু লোক জীবন হারালো। আন্দোলনের চাপে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গোল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দিলেন লাহোরে। বিতর্ক শুরু হলো-শেখ মুজিবকে ছাড়া সে বৈঠক হবে কি না। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিতে চাইল সরকার। কিন্তু শেখ মুজিব তা প্রত্যাখান করলেন। এদিকে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীতে রাজপথ ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে লাগল। অবস্থা এহেন বেগতিক দেখে আইয়ুব খান ১লা ফেব্রুয়ারী তারিখে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠকের আমন্ত্রণ জানাবেন বলে ঘোষণা করলেন। এদিকে আন্দোলন মফস্বল শহর ছাড়িয়ে গ্রামে পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। তার উত্তাল ঢেউ এসে লাগলো পতেঙ্গায়। শহরের সাথে সাথে পতেঙ্গার মত গ্রামেও হরতাল পালিত হতে লাগল। গ্রামে যানবাহন বলতে রিক্সা ও সাইকেল, তাও চলাচল বন্ধ। কাঁচা আধা-পাকা মুদির দোকানের ঝাঁপি খোলা হত না। টান টান উত্তেজনা নিয়ে আলম ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পিকেটিং করছে তার সহপাঠী ও জৈষ্ঠ ছাত্রদের সাথে। পিকেটিং বলতে কোন খানে কোন দোকানের ঝাঁপি খোলা আছে কিনা দেখা, রিক্সা সাইকেল বন্ধ রাখা । তাতে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না। তাদের দেখলে সহাস্যে সাইকেল থেকে নেমে যান আরোহীরা। দোকানীরা কেউ দোকানের ঝাঁপি খোলেন না। এলাকায় খন্ড খন্ড মিছিল। মিছিলে গলা কাপাঁনো শোগ্লান- আইয়ুব যদি বাঁচতে চাও- শেখ মুজিবের মুক্তি দাও। সারাদিন মিছিল মিটিং করে সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে আলম। ক্লান্তিহীন উত্তেজনা তখনো তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সকালে ওঠে আবার স্কুলে যাত্রা। স্কুলে সারাদিন এসব মিছিল মিটিং এর আলোচনা। মিছিল করতে করতে তারা পতেঙ্গা বিমান বন্দরে চলে যায়। সেখানে বিমান বন্দরের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে টাঙ্গানো আইয়ুব খানের মিলিটারী টুপি পরা ফিল্ড মার্শাল মার্কা ছবিটি যখন নামিয়ে ফেলে ছাত্ররা ভেঙ্গে ফেলছিল, তখন উল্লাসে চিৎকার করে শ্লোগান দিতে থাকে সবাই-আইয়ুব যদি বাঁচতে চাও-শেখ মুজিবের মুক্তি দাও। সর্বাপেক্ষা উপভোগ্য সে ঘটনাটি নিয়ে তারা আলোচনায় মেতে ওঠে। বিমান বন্দর থেকে আসার পথে কিছু ছেলেপিলে রানওয়ের কিছু বৈদ্যুতিক বাতি ইট দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে বাল্বগুলো নিয়ে এসেছে। এ ঘটনা আলমকে যারপরনাই পীড়া দিয়েছে। এমনিতে এখনো পতেঙ্গা বিমান বন্দরে রাত্রে বৈদ্যুতিক বাতির মধ্যে মধ্যে ডাউস সাইজের তেলের কুপি বসিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে এসব বাল্বগুলো ভেঙ্গ ফেলা ঠিক হয় নি। নিজেদের মিছিল থেকে এ জাতীয় ঘটনা ঘটেছে বলে নিজের মধ্যে অপরাধ বোধ জাগে আলমের। এভাবে নিজের অজান্তেই রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে কিশোর আলম। পতেঙ্গায় ছাত্র লীগের কমিটি হয়, তাকে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ক্রমে মিছিলের একজন অনুসারী থেকে মিছিলের একজন সংগঠকে পরিণত হয় আলম। শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলন ক্রমে গণআন্দোলনে রূপ নিতে থাকে। আইয়ুব খানের আহ্বানে লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় গোল টেবিল বৈঠক। বৈঠকের প্রাক্কালে আন্দোলনের মুখে আয়ুবশাহী শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ৬দফা ভিত্তিক স্বায়ত্ত শাসনের প্রশ্নে সর্বদলীয় গোল টেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়। গোল টেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানালেন শেখ মুজিব। আন্দোলনে ফেটে পড়ল এদেশের জনগণ। সভা সমাবেশ মিছল ধর্মঘটে ঊত্তপ্ত সারা দেশ । আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে গঞ্জে। যেন টগবগ করে ফুটতে লাগল সারা দেশ। এ আন্দোলনের মুখে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হল আইয়ুব খান। দৃশ্যপটে আর্বিভূত হলেন জেনারেল ইয়াহীয়া। ক্ষমতায় এসেই ইয়াহীয়া ঘোষণা করলেন, তিনি সাধারণ নির্বাচন দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন। আন্দোলন আপাততঃ স্থিমিত হলো। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হল- প্রথমে ১৯৭০ সালের ৫ই অক্টোবর, পরবর্তীতে ৭ ই ডিসেম্বর, ১৯৭০। ক্রমে নির্বাচনী প্রচারণা জমে ঊঠতে লাগল। জেলায় জেলায় থানায় থানায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ৬ দফার পক্ষে সভা সমাবেশ করে বেড়াতে লাগলেন। ৬ দফা গ্রামের মানুষদের কাছে আরো বেশী বোধগম্য ও গ্রহণ যোগ্য হতে লাগল। এভাবে নির্বাচনী প্রচারণা যখন অনেকটা জমে উঠেছে, তখন এদেশে ঘটে গেল এক প্রাকৃতিক মহা বিপর্যয়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চল সন্ধীপ, হাতিয়া, ভোলা বরিশাল ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে গেল এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছাস। হাজার হাজার মানূষ প্রাণ হারালো । লক্ষ লক্ষ মানুষ হলো গৃহহীন। সমুদ্রের বেলাভূমি পতেঙ্গাও ল-ভ- হল এ সামুদ্রিক ঝড়ে। জলোচ্ছাস না হওয়ায় প্রাণহানি ঘটে নি পতেঙ্গায়। তবে অনেক বাড়ি ঘর বিধ্বস্থ হয়েছে। অনেক গবাদি পশু মারা গেছে। কিন্তু মানুষের দুঃখ দুর্ভোগ সবকিছু ছাপিয়ে বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল সরকারের নির্র্লিপ্ততা ও নির্মম নিষ্ক্রিয়তা। সরকারের চরম উদাসিন্যের কারণে অনাহারে অর্ধাহারে ও ডায়েরীয়া কলেরায় আরো হাজার হাজার মানুষ অকাতরে জীবন দিতে লাগল। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায় সরকারের উদসীন্য এত সীমাহীন ছিল যে, ঘূর্ণিঝড়ের ১ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন বিদেশী জাহাজ সমুদ্র থেকে ভাসমান জীবন্ত মানুষ উদ্ধার করেছে, দীর্ঘদিন তাদের নিন্মাঙ্গ সামুদ্রিক মাছের উপাদেয় খাদ্য হয়েছে। অথচ সরকার চেষ্টা করলে এসমস্ত ভাসমান লোকদের দু’এক দিনের মধ্যেই উদ্ধার করতে পারত।
পাকিস্তান সরকারের এ উদাসীনতা বাঙ্গালী জাতির অন্তরে লালিত জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঘৃতাহুতি দিল। তারা যেন স্পষ্টই বুঝতে পারল পূর্বপকিস্তানের মানুষের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের দরদ কী। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ত্রাণ তৎপরতায় আত্মনিয়োগ করল। সরকারের এ বিমাতা সুলভ আচরণ তারা মানুষের কাছে তুলে ধরতে লাগল। প্রাকৃতিক এ বিপর্যয়ের সুযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচন পিছানোর দাবী তুললেও আওয়ামী লীগ এ দাবীর বিরোধীতা করল। নির্বাচন পেছানোর দাবীকে নির্বাচন বাঞ্ছালের একটি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কড়া হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বললেন- জনগন এ চক্রান্ত প্রতিহত করবে। সমুদ্রের উত্তাল জলে ভাসমান মৃত মানুষের অগুণিত ছবি, বাস্তুহীন মানুষের হৃদয়বিদারক আহাজারির দৃশ্য আলমকে বিহ্বলিত করে তুলল। তারা সিদ্ধান্ত নিল এবারের ঈদুল ফিতর তারা অনাড়ম্বড়ে উদ্যাপন করবে। ঈদগাহে “বেহেস্ত নসীব করিও সকল মৃত্যুব্যথিত প্রাণ” লেখা কালো কাপড়ের বিরাট ব্যানার টাঙ্গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করল তারা। জনগণের দাবীর মুখে নির্বাচন স্থগিত করা সম্ভব হল না। তবে উপদ্রুত এলাকার ১৭টি আসনে নির্বাচন স্থগিত রাখা হল। অবশেষে ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০ নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। ৩১৫ আসনের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন পেল। নির্বাচনে আলম তার সহপাঠিরা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছে । তাই সারাদেশ ব্যাপী আওয়ামী লীগের এ বিজয় তাকে যারপরনাই অনুপ্রানিত করেছে। পুর্বাঞ্চলের এ নির্বাচনী ফলাফল পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীকে হতচকিত করে দিল। সমগ্র বাঙ্গালী তাদের মুক্তি সনদ ৬ দফার প্রশ্নে আজ ঐক্যবদ্ধ – এটাই প্রমাণিত হল।