স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ ৪২ বছর পর যখন বাংলাদেশ নিজেদের কলঙ্ক মুক্ত করার প্রথম অধ্যায়ে পা রেখেছে, ঠিক তখনই জাতিসংঘ থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, তুরষ্ক, পাকিস্তানের মত দেশগুলো তার বিরোধিতা করে চলছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের জামাতে ইসলামের শাখা তাদের সহযোদ্ধা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এমনকি তারা পাকিস্তানকে আহ্বান জানাচ্ছে বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ করার জন্য। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করতে হয় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলি খান কাদের মোল্লার ফাঁসিতে অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য প্রদান করেছেন। পাক-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,- “একাত্তর সালে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করে কাদের মোল্লা দেশ-প্রেমিকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছেদ হওয়ায় পাকিস্তানিদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে আবারও ব্যাথা দেওয়া হলো এই ফাঁসির মাধ্যমে।”

এই তালিকায় পিছিয়ে নেই পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের প্রধান ও সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান। ইমরান খান, একজন মানবাধিকার কর্মীর কাছে কাদের মোল্লা সম্পর্কে শুনে তাকে ‘নির্দোষ’ হিসেবে দাবি করেছেন। তিনি দাবি করেন, ওই মানবাধিকারকর্মীই নাকি তাঁকে বলেছেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল, তা সব মিথ্যা। আর সেগুলোর ব্যাপারে ইমরান খান কিছুই জানতেন না।

এই ব্যাপারে একটু বিশ্লেষণ করা যাক; দেখা যাক বেশির ভাগ পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে কি জানে। যেখানে পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তকে এখন পর্যন্ত উল্লেখ আছে,- ”১৯৭১ সালে পাকিস্তান ও মুসলিম ভাইদেরকে বিভাজনের মূল কারণ ছিল ইন্ডিয়ার ষড়যন্ত্র আর শেখ মুজিব ছিল তার মূল নায়ক।” সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানী নাগরিকদের কাছ থেকে এই গণহত্যার খবর কিভাবে আড়াল করা হয়েছিল, এই মর্মে প্রভাবশালী পাকিস্তানী দৈনিক “দ্য ডন” এর রিপোর্ট দেখা যাক:

Soon after the military operation ‘Searchlight’ began in former East Pakistan on March 25, 1971, the uprising became the subject of discussion all over the world. Chained by censorship, West Pakistan newspapers did not give a single word to their readers about what was happening in the Eastern wing; hence only foreign news radio was heard and believed. BBC’s were the most popular broadcasts.

পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর এই নৃশংসতা যাতে কোনভাবেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার হতে না পারে এজন্যও তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায়। ২৫ মার্চের আগেই অধিকাংশ বিদেশী সাংবাদিককে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এমনকি এই রাতে যারা ঢাকায় অবস্থান করছিলেন, তাদেরকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান হোটেল রূপসী বাংলা) এ অবরূদ্ধ রাখা হয়। তবুও একাধিক বিদেশী সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই রাতের রিপোর্ট লিখেন। এদের মাঝে এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস এবং সাইমন ড্রিং এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে আসলে কি ঘটছে সে ব্যাপারে বিশ্বকে জানাতে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

এছাড়া, জুলফিকার আলী ভুট্টোর দৌহিত্র ফাতিমা ভুট্টো ”Songs of Blood and Sword” নামের একটা বই লিখেছেন। সেই বই নিয়ে ”দৈনিক প্রথম আলো” একটা প্রতিবেদনও ছেপেছিলো। বইটিতে লেখা হয়েছে,- ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যুদ্ধের কৌশল হিসেবে চার লাখ নারীকে ধর্ষণ করেছে। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে শায়েস্তা করা ও দুর্দশায় ফেলার অংশ হিসেবেই পাকিস্তান সৈনিক বাহিনী এ কাজ করেছে। সেই বইতে ”সুসান ব্রাউনমিলার”কে কোট করা হয়েছে, সঙ্গে এটাও লেখা হয়েছে যে ফাতিমা তার পিতামহ জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দেখেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য সিন্ধুর জেনারেল গুল হাসানকে খুব এক চোট ধমকে ছিলেন। ফাতিমা তার পিতামহকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে মহাপুরুষ বানিয়ে দেননি। ফাতিমা আরও লিখেছেন, মুজিব চেয়েছিলেন তাঁর দল এককভাবে সংবিধান রচনা করবে এবং তাঁকে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। সেনাবাহিনী যদিও ভুট্টোকে আওয়ামী লীগের সমপরিমাণ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তাতে তিনি (ভুট্টো) আশ্বস্ত হতে পারেননি। এরপর ফাতিমার বিশ্লেষণ করেছেন, সেনাবাহিনী এই দুজনকে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে এবং যাতে শান্তিপূর্ণ কোনো সমাধান না হয় তা নিশ্চিত করেছে। তাঁর ভাষায়, ”এরপর সারা পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা ও রক্তের বন্যা বইতে লাগল।”

এবার ফিরে দেখা যাক, সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে কাদের মোল্লা বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া। এক দিকে যখন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলি খান আর তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের প্রধান ও সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও যখন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের নাক গলানোর চেষ্টা করছেন। সেই সঙ্গে গতকাল সোমবার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হচ্ছে ঠিক তখন পাকিস্তানের পিপলস পার্টি আর এমকিউএম সংসদে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়েছে, সেখানকার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির শাখা সেক্যুলার ফোরামও। পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সাংসদ আবদুল সাত্তার বাচানি পরিষদকে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ না করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘পুরো বিষয়টিই বাংলাদেশের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের উচিত হবে না একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এ ধরনের প্রস্তাব পাস করা।’

যদিও কিছুদিন আগে ”দৈনিক প্রথম আলো”কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেছিলেন,- বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত। তিনি দাবি করেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশে অভিযান শুরুর আগে তিনি শেষ বিমানে করে ঢাকা ছেড়েছিলেন। ১৯৭১ সালে বাঙালি হত্যায় পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের নির্দেশ প্রদান প্রসঙ্গে ইমরান খান বলেন, ‘আমি নিজ কানে শুনেছি, তারা বলেছে, এই বামন ও কালোদের হত্যা কর। তাদের একটা শিক্ষা দাও।’ ইমরান খানের সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেছিলেন,’৭১ থেকে শিক্ষা নেয়নি পাকিস্তান। ইমরান জানিয়েছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী অপরাধীরা শাস্তি পেলে পশতুনরা আজ হয়রানির শিকার হতো না।আজ একজন মানবাধিকার কর্মীর কাছে কাদের মোল্লা সম্পর্কে শুনে তাকে ‘নির্দোষ’ হিসেবে দাবি করাটা ইমরান খানকে জেনারেল নিয়াজীর যোগ্যতম উত্তরসূরী হিসেবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করে। আজ ইমরান খান বলছেন,- ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর “ঢাকার পতন” আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পুরো ব্যাপারটির নিষ্পত্তিই সে সময় গণতান্ত্রিকভাবেই হওয়া উচিত ছিল।’ এর কারন হলো ইমারান খানের চাচা জেনারেল নিয়াজী। তাই আজ চাচা জেনারেল নিয়াজীর পরিচালিত সেনাহত্যা যজ্ঞের সহযোগী কাদের মোল্লাকে নির্দোষ দাবী করে নিজেকে উন্মোচিত করেছেন ইমরান খান। তার এই বক্তব্যের এবং কাদের মোল্লাকে সমর্থন জানানোর মানে এই দাঁড়ায়, ৭১ এর হত্যাযজ্ঞ তার চোখে মানবতা বিরোধী অপরাধই ছিলোনা।

আন্তর্জাতিক বিশ্বের চোখে পাকিস্তান আজ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। তারা তাদের নিজের দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। বছরে আনুমানিক গড়ানুপাতে ৫ হাজারের মতো মানুষ আত্মঘাতি বোমা হামলায় মারা যাচ্ছে। পাকিস্তান সমগ্র বিশ্বের চোখে একটি তালেবানী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। জুলফিকার আলী ভুট্টো, বেনজীর ভুট্টো, মোহাম্মদ জিয়াউল হকের মতো রাষ্ট্রপ্রধানদের আততায়ীর আক্রমণে মৃত্যু বারে বারে ইতিহাসের পূণরাবৃত্তি করে। তারা মুখে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিলেও এখন পর্যন্ত একটি সরকারও সামরিক শাসনের দখলদারীত্ব ছাড়া স্থাপন করতে পারেনি। ২০০১ টুইনটাওয়ারের ঘটনা থেকে শুরু করে আজমল কাসব ও তার বাহিনীর ভারতের তাজমহল হোটেলের উপর আক্রমণ পাকিস্তানের হিংস্রতাই প্রমাণ করে। যে আমেরিকা এক সময় পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিলো, তাদের দেশেই সবচেয়ে সন্দেহভাজন নাগরিকদের দলে পাকিস্তানীরা। অসংখ্য হলিউড সিনেমা বা সিরিয়ালের দিকে তাকালে দেখা যায়, ইসলামিক রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী হিসেবে এক পাকিস্তানী নাগরিকই সেটির ভিলেন চরিত্রের ভূমিকায় রয়েছে। যদিও পাকিস্তানের এই পরিস্থিতির জন্য আমেরিকার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি অনস্বীকার্য।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছিল কিছু সুবিধাবাদি দেশদ্রোহী রাজাকার, আলবদর, আল শামস আর বিহারীদের একটি বিশাল অংশ। এই বিশেষ বাহিনীর একজন ছিল কাদের মোল্লা। সেই কাদের মোল্লার ফাঁসিতে পাকিস্তানের এমন ভূমিকায় বাংলাদেশীরা অবাক হয় না।নিজেদের কৃতকর্মকে বৈধতা দিতেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। এই পাকিস্তান এক সময় আমাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিলো। এমনকি গত ৪২ বছরে ৭১ এর গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্যও বাংলাদেশের কাছে রাষ্ট্রীয় ভাবে ক্ষমা চায়নি তাদের সরকার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাতের মতো একটি সংগঠনকে সমর্থন করে বার বার একটি কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় পাকিস্তান, আর তা হলো বাংলাদেশের কাছে নিজেদের পরাজয়কে আজও তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই কাদের মোল্লার ফাঁসি তাদের জন্য আরেকটি পরাজয় মাত্র। পরিশেষে ইমরান খানের এই বক্তব্য বিপরীতে স্যার হুমায়ুন আজাদের করা একটি উক্তি মনে পড়ে যায়,- ”পাকিস্তানীদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা হাতে গোলাপ নিয়ে আসে- এমন কী তখনো।”

httpv://www.youtube.com/watch?v=SDANKHiZaj8

ফারজানা কবীর খান (স্নিগ্ধা)

তথ্যসূত্রঃ
১) উইকিপিডিয়া বাংলা
২) ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম
৩) বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অনলাইন আর্কাইভ
৪) বিভিন্ন জাতীয় এবং বিদেশী পত্রিকার অনলাইন আর্কাইভ
৫) www.genocidebangladesh.org
৬) Songs of Blood and Sword – ফাতিমা ভুট্টো
৭) www.cadetcollegeblog.com