কুণাল জাতক নামে বৌদ্ধ শাস্ত্রের ৫৩৬ নম্বর জাতকে কুণাল পুরুষদের উপদেশ দেন – বলদ(ষাঁড়), ধেনু(গাভী), যান(বাহন) ও রমণী এই চারটি কখনো অন্যের আশ্রয়ে রাখতে হয়না। এদেরকে নিজের আশ্রয়ে সুরক্ষিত রাখতে হয়, তা না হলে সংকট তৈরি হয়। এই সম্পর্কিত নীতিগাঁথায় কুণাল বলেন-
“বলীবদ্র, ধেনু, যান, ভার্যা নিজ তব
রাখিও না অন্য গৃহে কখনো এসবো।
যান নষ্ট হয় পড়ে আনাড়ির হাতে
বলীবদ্র প্রাণে মরে অতি খাটুনিতে।
দুধ ধুয়ে বাছুরের জীবনান্ত করে
রমণী প্রদুষ্টা হয় থাকি জ্ঞাতিঘরে।”
আবার কুণালের মতে সব নারীই প্রকৃতপক্ষে বেশ্যা। এরা পঙ্গু দেখলেও ব্যাভিচারে রত হয়। সব নারীই হচ্ছে পরপুরুষগামিনী এবং বিশ্বাস অযোগ্যা। আসুন দেখি কুণাল তার নীতিগাঁথায় কি বলেছেন –
“পাইলে নিভৃত স্থান, পাইলে অবসর
হেন নারী নাই এই পৃথিবীর ভিতর।
না করিবে পাপ যেই, না পেলে অপরে
পঙ্গুর সহিত রত হয় ব্যাভিচারে।
সত্য বটে ভাবে লোকে সুখদা রমণী
কিন্তু সর্ব নারী হয় পরপুরুষ গামিনী।
দমিতে নারীর মন নিগ্রহের বলে
শক্তি কাহারো নাই এ মহীমণ্ডলে।
প্রিয়ঙ্করী, তবু এরা বিশ্বাস অযোগ্যা,
বেশ্যা, তীর্থবৎ এরা সর্বজন ভোগ্য।”
এইবার কুণাল বলেন কি কি কারণে স্ত্রীদের কলঙ্ক হয়। কুণালের মতে যেসব কারণে নারীদের কলঙ্ক হয় তার মধ্যে রয়েছে-
@ আরামে উদ্যানে ভ্রমণ করলে।
@ জ্ঞাতি কুটুম্বের বাসায় বেড়াতে গেলে।
@ মদ্য পান করলে।
@ বিচিত্র জামা কাপড় পড়তে চাইলে।
@ বিনা কাজে ঘোরাঘুরি করলে।
@ অন্য পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করলে।
@ দরজায় দাড়িয়ে থাকিলে।
কুণাল তার নীতিগাঁথায় এ সম্পর্কে বলেন –
“আরামে, উদ্যানে, রথে, জ্ঞাতিপর কূলে সদা
বেড়াইতে যায়,
মদ্যপান করে যারা, পরিতে বিচিত্র বস্ত্র
সদা যারা চায়।
বিনা কাজে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করে যারা
সদা শূন্যমন,
দ্বারে থাকে দাঁড়াইয়া, কুলষিতা হয় নারী
এই নব কারন।”
বৌদ্ধ শাস্ত্রের ৫৩৬ নম্বর জাতকে কুণাল আরও বলেন,
@ গরুরা নতুন ঘাসের আশায় নিজের গোয়াল থেকে বের হবার জন্য ছুটে, নারীও তেমনি নতুন নাগর লাভের আশায় ছোটাছুটি করে।
@ নৌকা যেমন এপারে-ওপারে, এখানে-সেখানে যথা প্রয়োজনে লাগে, নারীও তদ্রূপ প্রিয় অপ্রিয় বিবেচনা না করেই সর্ব পুরুষেই গমন করে।
@ কোন বুদ্ধিমান কখনো নারীর চরিত্রে বিশ্বাস স্থাপন করে না। যারা করে তারা নির্বোধ।
@ যতই নারীকে ধনে পরিপূর্ণ করা হোক না কেন সুযোগ পেলেই অসতীরা পুরুষের সম্মান নষ্ট করে।
@ নারীদের এতোই জঘন্য স্বভাব যে এখানে সেখানে তারা যদিচ্ছা ঘুরাফেরা করে।
@ নারীদের চোখের পানিতে গলে যাওয়া ঠিক না কারণ নারীদের সত্য মিথ্যার সমান।
@ নারীরা সব সময় প্রেমালাপে পুরুষদের বস করে যদিও মনের মধ্যে তাদের থাকে খারাপ অভিলাস।
@ তীর্থে যেমন সকলেই ভ্রমন করতে পারে, নারীও তেমন তীর্থসম।
@ টাকা হীন কুলীন ব্রাহ্মণ নারীর কাছে চণ্ডালের মতো। তাইতো ধনবান চণ্ডাল কে নারী আজীবন পূজিতে পারে শুধু ধনের আশায়।
আসুন এই বিষয়ে আমরা কুণালের নীতিবাক্যর গাথাগুলো দেখি –
“মনের মতো রমণী লভিয়া
ধনপূর্ণা ধরা কর তারে দান,
তথাপি অসতি পেলে অবসর
কভু না রাখিবে তোমার সম্মান।
নারীদের এমন জঘন্য স্বভাব
সদা সর্বস্থানে করি বিলোকন,
করে কি কখনো বুদ্ধিমান জন
চরিত্রে তাহাদের বিশ্বাস স্থাপন?
ভালোবাসে মোরে ভাবি ইহা মনে
করো না বিশ্বাস কভু নারীগণে,
অশ্রু বিসর্জন দেখিয়া তাহার
ভিজে নাকো যেন মন কখনো তোমার।
এ পারে, ও পারে নদীর যেমন
লাগে গিয়া নৌকা যথা প্রয়োজন,
প্রিয় বা অপ্রিয় বিচার না করি
সেবে পরপুরুষেরে সর্বজন নারী।
অতীব দুঃশীলা, অতি অসংযতা
রতিদানে মুড়ে তুষিতে নিরতা,
প্রামালাপ করে বসি তব পাশ
মনে কিন্তু সদা পাপের অভিলাষ।
তীর্থসম সর্বভোগ্যা নারীগণ
নারীরে বিশ্বাস করো না কখন,
নাই তাদের সত্য মিথ্যা জ্ঞান
সত্য তাদের মিথ্যার সমান।
গবীসম নব তৃণের আশায়
গোচর বাহিরে ছুটি যথা যায়,
নবীন নাগর লোভিতে তেমনি
ছোটাছুটি করে সকল রমণী।
নির্ধন কুলীনে নারী করে হেয় জ্ঞান
সে জন নারীর চক্ষে চণ্ডাল সমান,
অথচ চণ্ডাল যদি হয় ধনেশ্বর
ধনহেতু ভজে তারে নারী নিরন্তর।”
নারী প্রসঙ্গে বৌদ্ধ শাস্ত্রের ঐ একই জাতক অর্থাৎ কুণাল জাতকে, কুণাল আর গ্রিথরাজের মধ্যে কথোপকথন প্রণিধানযোগ্য। এখানে গ্রিথরাজের কাছে কুণাল নারী চরিত্র কেমন তা বর্ণনা করেন। নারীর প্রকৃত চরিত্র কেমন সে সম্পর্কে কুনাল যা যা বলেন তা হলঃ
@ ব্রাহ্মণ, সাগর, নরপতি আর নারী এই চারকে কখনোই কেউ সন্তুষ্ট করতে পারে না।
@ একজন নারীর যদি আটজন সেক্সি স্বামীও থাকে তারপরও সে নবম জনার প্রতাশা করে।
@ নারীর জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো যোনী সব সময়ই অপূর্ণ থাকে।
@ নারী অগ্নির মতো সব কিছু গিলে খায়।
@ নারী নদীর মতো সব দিকে প্রবাহিত হয়।
@ নারী হল কাটা গাছের ন্যায়।
@ নারী সব সময় পুরুষের দুঃখের কারণ হয়।
@ নারী ধনের জন্য কুপথে যায়।
@ নারী নিজের স্বামীকে সেবা না করে পরপুরুষকে সেবা দেয়।
@ নারী যেহেতু অধঃগামী তাই তাদের নরক নিশ্চিত।
এইসব কারনেই বুদ্ধিমানের অবশ্যই নারীকে পাশ কাটিয়ে চলা উচিত। আসুন কথা না বাড়িয়ে আমরা কুণালের মতে নারী চরিত্রের নীতিগাঁথা শুনী।
“নারীর চরিত্র আমি বলিতেছি আজ
সাবধানে শ্রবণ করো হে গ্রিথরাজ
সমুদ্র, ব্রাহ্মণ, নরপতি আর নারী
পুরীতে কাহারো সাধ্য নাই এই চারি।
এক রমণীর যদি হয় অষ্টপতি
বীর বলবান সবে, কামপ্রদ অতি
লবিতে নবম তবু চায় সেই মনে
আগ্নেয়গিরি অপূর্ণ তার থাকে সর্বক্ষণে।
অগ্নিসম সর্বভক্ষা সকল রমণী
নদিসমা সর্বনারী সর্বপ্রবাহিণী
কন্টকশাখার তুল্য রমণী সকল
পুরুষের হয় হেতু দুঃখের কেবল।
ধনলোভে সব নারী কু পথেতে যায়
ত্যাজি পতি রত হয় পরপুরুষ সেবায়
নারীর গমন সদা অধঃপথে
মরনের পর নরকে নিবাস
তাই সুধীগণ অতি সাবধানে
দুর হতে ত্যাজি নারীদের পাশ।
ডুবিলে নারীর মায়ার আবর্তে
ব্রহ্মচর্য পায় অচিরে বিনাশ
তাই সুধীগণ অতি সাবধানে
দূর হতে ত্যাজি রমণীর পাশ।”
(চলবে)
নারীদের ছোট করার অধিকার কারোরই নেই। আপনি বদ্ধ ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের ছোট করছেন। আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই – রাজাদের অনেক অনেক বউ থাকতো, তবুও তারা পর নারীর দিকে খেয়াল করতো। এখনকার সমাজে দেখা যায় অনেক ছেলেরা একসাথে বসে মেয়ে দেখে, মেয়েদের উত্তক্ত করে ।
এমন কাজ কখনোই মেয়েরা করে না।
যে ধর্ম মানুষ সম্পর্কে এমন বাজে কথা বলে সে ধর্ম পরিহার করা উচিত ॥
যে কুণাল নারীদের নিয়ে এমন নিচু মানসিকতার পরিচয় দিলো সেতো কোন নারীরই পেটে জন্মেছে। তার মাকে সে এভাবে অপমান করলো, জগতে কিছু নারীর স্বভাব খারাপ হতেই পারে যেমন সব পুরুষ তুলসী পাতায় ধুঁয়া নয়।
হেফাজতে কুণাল!
@গীতা দাস,
দিদি ভাগ্যিস কুণাল দর্শন এতো বেশী প্রচারিত হয়নি এখনো। আর বর্তমান বৌদ্ধ সাংসারিক জীবনেও এর প্রয়োগ ঐ ভাবে আমি দেখিনা অন্তত আমাদের বাঙ্গালী বৌদ্ধদের মধ্যে।
@নিলয় নীল,
কুনাল নামের একটা পাখীর fairy tale নিয়ে যে দর্শন ভাজাভুজি চালাচ্ছেন, তাতে আমি বিস্মিত
এমনিতে বেশ শান্ত শিষ্ট, সুবোধ স্বভাব, দারুন অহিংস বৌদ্ধদের এই হল নারী বিষয়ক দৃষ্টি ভঙ্গি!
হায় রে, নারী কোন শাস্ত্রেই দু’পয়সা দাম পেল না!
নীল, লেখাটি ভাল হচ্ছে, চালিয়ে যাও।
@মুরশেদ,
আসলেই নারী কোন শাস্ত্রেই মূল্যায়ন পায় নি, তারপরও এখনো নারীদের মধ্যেই ধর্ম পালন ও ধর্ম বিশ্বাসের হার বেশী দেখা যায়। ধন্যবাদ আপনাকে।
@নিলয় নীল,
এত নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে, নীলভাই?
শাস্ত্রবিদেরা তো অনেক ভালু ভালু কথাও কয়েছেন!!
@কাজি মামুন,
পুরুষ নারীকে ছাড়া থাকতে পারবে না তাই পুরুষ নারীকে কখনোই অস্বীকার করতে পারে নি। যেহেতু অস্বীকার করা সম্ভব নয় তাই নিয়ন্ত্রণটাই বেছে নিয়েছে পুরুষ। আর কাউকে নিয়ন্ত্রণ করে তার কাছ থেকে ভালো সার্ভিস পেতে হলে তাকে পটাতে হয় মাঝের মধ্যে ভালু ভালু কথাও বলতে হয়। 😉 😉 😉
বাহ্! নারীকে কত উচ্চাসন দেয়া হয়েছে এখানে! তীর্থ তো আর ফেলনা কোন বস্তু না!
জাতকও দেখছি, নারীদের ব্যাপক সন্মাননা দান করে!! আচ্ছা, জাতক বৌদ্ধধর্মের কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করে? মানে, জাতক যা বলে, বৌদ্ধ ধর্ম তাই নিঃশর্তে মেনে নেয়? বা, জাতক বৌদ্ধদের জন্য অবশ্য-অনুসরনিয় কিনা?
লেখাটা পড়ে অনেক কিছু জানা হল। দরকারী বিষয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু পরীক্ষার স্ক্রিপ্টের মত না লিখে কিছু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ/বিশ্লেষণ যোগ করা যায় না? তাছাড়া, তথ্যসূত্রের উল্লেখ থাকাটা দরকার ছিল মনে হয়।
@কাজি মামুন,
বৌদ্ধ ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থের নাম ত্রিপিটক, আর এই জাতক সেই ত্রিপিটকেরই অংশ। তিন পিটকের সমন্বিত সমাহারকে ত্রিপিটক বোঝানো হচ্ছে। এই তিনটি পিটক হলো বিনয় পিটক, সূত্র পিটক ও অভিধর্ম পিটক। পিটক শব্দটি পালি এর অর্থ – ঝুড়ি, পাত্র, বক্স ইত্যাদি, অর্থাৎ যেখানে কোনো কিছু সংরক্ষন করা হয়। দাবী করা হয় ত্রিপিটকে যা আছে তা বৌদ্ধ বচন।
ত্রিপিটকের তিনটি পিটকের মধ্যে একটি হল সূত্র পিটক। সূত্র পিটক আবার কতোগুলো নিকায় রয়েছে যার মধ্যে একটি হল খুদ্দক নিকায়। এই খুদ্দক নিকয়ে আবার ১৬ টি আলাদা আলাদা গ্রন্থ আছে যার একটি হল জাতক। এই জাতক আবার ৫ খণ্ডের। প্রত্যেকটা জাতকের আলাদা আলদা নাম আছে, আমি বর্তমানে আলোচনা করছি কুণাল জাতক। এই কুণাল জাতকের মধ্যে আলাদা ভাবে অতিরিক্ত কিছু রেফারেন্স দেবার দেখছি না।
জাতক অবশ্য অনুকরণীয় কিনা এই বিষয়ে Prof. Winternitz একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি ” the suttapitak is our mose reliable source for the Dhamma , the religion of Buddha and his earliest disciples” তবে এর কাহিনীগুলো কতোটা গৌতম বৌদ্ধের বক্তব্য এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে, ধর্ম হিসেবে এটি অপেক্ষাকৃত কম বাধ্যবাধকতায় বিশ্বাসী বলেই আমার মনে হয়। আর ধার্মিকরা কখনো তাদের ধর্ম গ্রন্থ লাইন ধরে অনুসরণ করে না বরং নিজেদের সুবিধা মতো অনুসরণ করে আবার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আপডেট করে।
মানুষ আজকাল ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ বা পর্যবেক্ষণ খুব বেশী শুনতে চায়না বরং মূল বিষয়কে দেখে নিয়ে নিজেই বিশ্লেষণ করে। তাছাড়া আমি খুব বেশী বড় করে নিজের মতামত দিতেও চাইনি, তবে পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ মন্তব্বে হতে পারে। ধন্যবাদ আপনাকে।
@নিলয় নীল, আপনার এই বিষয়টা নিয়ে লেখার মৌলিক উদ্দেশ্য যদি বলতেন?