অনেক অনেক দিন আগের কথা তখন আরবের লোকেরা …… নাহ, অত আগের কথা না তবে খুব সম্ভবত আমি তখন চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। আব্বার চাকরীর সুবাদে আমরা সরকারী কোয়ার্টারে থাকি। আমাদের বিল্ডিংটার সামনে দিয়েই সরু একটা পাকা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার ওপাশে বাগান করার জন্য বেশ কিছুটা যায়গা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আশে পাশের সবাই সেখানে বছর জুড়ে শাকসব্জি চাষ করত। বাগানের পরেই ছিল বিশাল বড় একটা খোলা মাঠ। সেই মাঠে আমরা ছেলে-মেয়েরা সবাই শীত, গ্রীস্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা সহ সব ধরনের খেলায় সারা বছর নিজেদের ব্যস্ত রাখতাম। আমাদের বাসার ঠিক সরাসরি বাগানের পরেই মাঠের যেখানে শুরু ঠিক সেইখানটাতেই একটা তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কাঠ ফাটা গরমের দিনে পাকা তাল যখন ধাপুর ধুপুর করে মাটিতে পড়ত তখন আমাদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যেত কে আগে গিয়ে সেই তাল কুড়িয়ে নিতে পারে।

ইউ টিউব ভিডিও ১:

ইউ টিউব ভিডিও ২:

http://www.youtube.com/watch?v=4XRzD-2iuGU

একদিন সন্ধ্যা হব হব করছে এরকম সময়ে বাসার ব্যাল্কনির রেলিঙয়ে হাত রেখে হাতের উপর মুখটা রেখে গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবছিলাম। তখনকার আবহাওয়া কেমন ছিল ঠিক মনে নেই। আকশে বজ্রপাত হয়েছিল কিনা তাও মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে শেষ বিকেলের মরা আলোয় চারপাশটা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে ছিল। হঠাত চোখের কোনে উজ্জ্বল কিছু একটা জিনিষের নড়াচড়া ধরা পড়তেই হাতের উপর থেকে মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি আমাদের খেলার মাঠটার উল্টাপাশে তিন-চারতলা বিল্ডিংয়ের সমান উচুতে ফুটবলের থেকে আকাড়ে একটু ছোট গোল একটা জিনিষ জ্বলজ্বল করছে, অনেকটা ভরা পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্বল। প্রথম দেখায় জিনিষটাকে স্থির মনে হলেও দু-এক মুহুর্ত পরেই বুঝতে পারলাম আসলে জিনিষটা ভেসে ভেসে মাঠের এই পাশের তালগাছ বরাবর ভেসে ভেসে আসছে। প্রায় বিশ পঁচিশ সেকেন্ড ধরে বলটা আকাশে ভাসতে ভাসতে একসময় তালগাছের মাথায় ঘন পাতার মধ্যে হারিয়ে গেল। অনেকক্ষন গভীর মনযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম বলটার কি হল। কিন্তু কিছুই দেখতে কিংবা বুঝতে পারলাম না। তালগাছের মাথাটা সন্ধ্যার ম্রিয়মান আলোয় আগের চাইতে আরো বেশি অন্ধকার মনে হল।

আমি যে অল্প কয়েকজন মানুষের সাথে আমার এই অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছি তাদের প্রায় সবাই আমাকে বলেছে এটা জ্বিন কিংবা ভূত ছিল। কিন্তু আমি জানতাম জ্বিন কিংবা ভূত এই ঘটনার যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা না। খুব ছোটবেলা থেকেই গল্পের বই পড়ার প্রচন্ড নেশা হয়ে ছিল। ছোটদের উপযোগি সব ধরনের বই পড়া তখন শেষ। ঠাকুরমার ঝুলি, রাশিয়ান উপকথা, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের বইয়ের মত রুপকথা, রাক্ষস-খোক্ষস, এবং ভূতের গল্পের বইগুলি প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। এসব সত্ত্বেও সেই বয়সে একটা জিনিষ খুব ভাল করেই মনে গেঁথে গিয়েছিল যে পৃথিবীতে ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই। যা কিছুই ঘটুক না কেন তার পিছনে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকতেই হবে। ব্যাখ্যা খুঁজে না পাওয়া মানে এই নয় যে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। আর এ কারনেই উজ্জ্বল গোলকটা নিজের চোখে দেখা সত্ত্বেও আমার মনে একবারের জন্যেও মনে হয়নি যে এটা জ্বীন-ভূত হতে পারে। আমার মনে দৃড় বিশ্বাস ছিল এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে, থাক্তেই হবে। এর পর মাঝখানে বেশ অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বছর দুয়েক আগে ইউটিউবে একটা ভিডিও খুঁজতে যেয়ে হঠাত করেই বজ্র গোলকের (Ball lightning) উপর একটা ভিডিও খুঁজে পেলাম। এতগুলো বছর না পাওয়া অমিমাংসিত রহস্যের সমাধান বোধহয় শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম।

আমরা সবাই বজ্রপাত বা বিজলীচমকের সাথে পরিচিত। ধারণা করা হয় যে পৃথিবীতে প্রতি ৩০ থেকে ১৫০ জনে অন্ততঃ একজন বজ্র গোলক আকাশে ভেসে বেড়াতে দেখেছে, দেয়াল ভেদ করে চলে যেতে দেখছে, এমনকি কখনও কখনও মানুষের মৃত্যুর কারনও হতে দেখছে। যদিও এই উজ্ঝ্বল গোলক অবলোকনের গল্প মধ্যযুগ, এমনকি প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায়ও পাওয়া যায় তথাপিও প্রথম লিপিবদ্ধ অবলোকনের সন্ধান পাওয়া যায় যখন ১৮ শতাব্দীতে তড়িৎ গবেষণার পথিকৃত জর্জ রাইখম্যানের ম্বৃত্যু ঘটে বজ্র গোলকের দ্বারা।

সম্ভবতঃ সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বজ্র গোলক অবলোকনের ঘটনাটি ঘটে উনিশ শতাব্দীতে যখন রাশান জার দ্বিতীয় আলক্সান্দারের নাতি অল্পবয়সী জার নিকোলাস চার্চ সার্ভিস চলাকালীন একটি প্রজ্জ্বলিত গোলক দেখেন। জারের মত হাই প্রোফাইল মানুষের দেখার ঘটনাও আসলেই সেটি বজ্র গোলক ছিল কিনা সেই সন্দেহ থেকে মুক্ত করতে পারেনি। মানুষের ধারণা ছিল এগুলো অতিপ্রাকৃত ঘটনা। এই সন্দেহ দূর হতে শুরু হয় যখন ১৯৬৩ সালে একদল বিজ্ঞানী নিউ ইয়র্ক থেকে প্লেনে করে ওয়াশিংটন ডিসিতে যাচ্ছিল। তারা বিমানের আইল ধরে একটি উজ্জ্বল গোলককে শূণ্যে ভাসতে ভাসতে বিমানের পিছন দিকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেন। এই দৃশ্যের কারণ খুঁজতে যেয়েই শুরু হয় গবেষণা।

সাধারনতঃ বজ্রপাত চলকালীন বিদ্যুতচমকের পরপরই আভির্ভাব হয় এই উজ্জ্বল বজ্র গোলকের। এই ভাসমান অগ্নিগোলক একটি ১০০ ওয়াট বাল্বের সমান ঔজ্জ্বল্যতা থাকে এবং এরা সাদা, হলুদ, কমলা, লাল, এমনকি নীল রঙেরও হয়ে থাকে। আর আকারে একটি ছোট গলফ বল থেকে শুরু করে বিচ বলের (ফুটবলের চেয়ে একটু বড়) সমান হতে পারে।

এই গোলক থেকে আঁকশির মত চিকন বর্ধিত অংশ বের হয় যা গোলকটিকে ঝাকুনি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে থাকে ফলে মনে হয় এটি বুঝি কোন এক ক্রীড়নকের হাতের ইশারায় এগুচ্ছে। এরা খুবই ধীরে এবং গন্তব্যহীনের মত চলতে থাকে এবং সাধারনত এদের পিছনে ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা যায় এবং খুবই অল্প সময়ের জন্য, মাত্র ২০-৩০ সেকেন্ড সময়কাল ধরে অস্তিত্বশীল থাকার পর বিলীন হয়ে যায়। বজ্র গোলকের দেখা পাওয়ার ঘটনাও এত স্বল্প যে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিতে এ নিয়ে গবেষনার সুযোগ খুব একটা পান না। এর একটি মাত্র নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই তবে বেশ কয়েকটি গ্রহনযোগ্য তত্ত্ব আছে।

সবচাইতে জনপ্রিয় এবং স্বীকৃত তত্ত্বটি দিয়েছেন নিজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের ক্যান্টারব্যুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন এ্যাব্রাহামসন। তাঁর মতে সিলিকন কনিকা পুড়ে বায়ুতে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া সৃষ্টি করে তার ফলেই এই বজ্র গোলকের সৃষ্টি হয়। যখন বজ্রপাত ভূমিতে আঘাত করে তখন মাটিতে থাকা প্রাকৃতিক সিলিকন কণা অক্সিজেন এবং কার্বনের সাথে মিশে বিশুদ্ধ সিলিকন বাস্পের সৃষ্টি হয়। এই বাষ্প ঠান্ডা হলে সিলিকন কণারা ঘন মিহি ধূলায় পরিনত হয়। এই মিহি ধূলায় যে কনাগুলি থাকে তারা বজ্রপাতে সৃষ্ট বৈদ্যুতিক চার্জের কারণে পরস্পেরের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং একে অন্যের সাথে বন্ধন সৃষ্টি করে গোলাকৃতি ধারন করে। গোলকের উজ্জ্বলতা এবং উত্তাপ আসে বায়ুতে অক্সিজেনের সাথে সিলিকনের পুনঃসংযুক্তির কারনে সৃষ্ট রাসায়নিক শক্তি থেকে। আর যখন সিলিকন কণারা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় তখন গোলকটিও আকাশে মিলিয়ে যায়। এই তত্ত্ব অনুসারে সিলিকন ছাড়াও এ্যালুমিনিয়াম এবং লৌহের মত ধাব পদার্থও একি রকম বজ্র গোলক সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং বজ্রপাত ছাড়াও যে কোন ধরণের বায়ুমন্ডলীয় শক্তি নিঃসরণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ব্যাখ্যা করা সম্ভব বৈদ্যুতিক খুঁটি কিংবা বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ, এমনকি ভূতাত্ত্বিক ফল্টের আশাপাশে কেন বজ্র গোলকের দেখা পাওয়া যায়।

ব্রাজিলের পার্নামবুকো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এন্টোনিও পাভাও এবং গার্সোঁ পাইভা এই সিলিকন তত্ব নিয়ে কাজ করেছেন এবং দাবী করেছেন গবেষণাগারে তাঁরা এটি প্রমান করতে সমর্থ হয়েছেন। ইজরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলাই জারবি এবং ভ্লাদিমির দিখতিয়ারও “মাইক্রোউয়েভ ড্রিল মেশিন” নামক যন্ত্রের সাহায্যে সফলতার সাথে বজ্রগোলক তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এই বজ্রগোলক এত স্বল্প সময়ের জন্যে থাকে যে দেয়াল ভদ করে যাওয়ার ব্যাপারটাকে এখনও প্রমানের আওতায় আনা যায়নি। বজ্র গোলকের বৈশিষ্ট্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না প্রাচীন জনপদ গুলিতে উদ্ভূত কিছু কিছু জ্বিন কিংবা ভূতের গল্পের পেছনের আসল রহস্য আসলে কি হতে পারে।