১. প্রলয় রাত্রি
২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল।
পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
রেলস্টেশনের পাশেই পাহাড়তলী রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাব। কিছুদিন ধরে এই ক্লাবটিই ব্যবহৃত হচ্ছে ইউরোপিয়ান ক্লাব হিসাবে। নিরাপত্তার খাতিরে চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়া থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে এখানে। প্রতি শনিবার রাতে ব্রিটিশ অফিসার এবং তাঁদের স্ত্রীরা আসেন। চলে অপরিমিত পানাহার এবং বল ড্যান্স। আজকেও তেমনি এক শনিবারের রাত। সন্ধ্যার পর থেকেই সমবেত হয়েছেন সকলেই। আনন্দপিয়াসী, উৎফুল্ল মেজাজ সবার। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে সামান্য চিন্তার কারণে সতর্কও সকলেই। প্রায় সবার কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। বাইরেই সশস্ত্র পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাবের বাইরে যে সাইনবোর্ড লাগানো থাকতো, এখানেও সেই একই সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে, ভারতীয় এবং কুকুরদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
রাত প্রায় নটা। পানীয়ের প্রভাবে তরল হয়ে এসেছে প্রায় সবাই। সতর্কতায় ঢিল পড়েছে। লঘু হাস্য এবং কৌতুক শোনা যাচ্ছে নাচের ফাঁকে ফাঁকে। ঠিক এসময়ই ক্লাবের পিছনের রান্নাঘরের ছোট্ট জানালার পাশে এসে দাঁড়ায় এক গ্রাম্য যুবক। হাতে একটা টর্চলাইট। ক্লাবেরই বাবুর্চি সে। সতর্কভাবে আশেপাশে তাকায়। তারপর হাতের টর্চটাকে বাইরের দিকে নিশানা করে। যুবকের হাতে জ্বলে উঠেই নিভে যায় টর্চলাইটটা। এরকম করে ঠিক তিনবার করে সে অতি দ্রুত।
অন্ধকার আকাশ থেকে নরক ভেঙে পড়ে যেন ক্লাবের উপর। খাকি সামরিক পোশাক পরা আটজন সশস্ত্র তরুণ হামলে পড়ে বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঝড়ের মত। মুহুর্তের মধ্যে গান, নাচ এবং হাসি বন্ধ হয়ে যায় ইউরোপিয়ান ক্লাবের। এর পরিবর্তে শোনা যেতে থাকে বোমার ভয়ংকর আওয়াজ, মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। চারিদিকে শুধু নরনারীদের গগনবিদারী আর্তনাদ, ভয়ার্ত চিৎকার। প্রাণভয়ে জানালা ভেঙে অনেকেই পালিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারে। মাত্র পনের মিনিটের মধ্যে থেমে যায় গুলি এবং বোমার শব্দ। মৃত্যুর হাহাকার এবং ধ্বংসলীলার মধ্যে শুধু শোনা যেতে থাকে আহতদের যন্ত্রণাকাতর ভয়ার্ত গোঙানি।
কোথাও বেজে উঠে একটা হুইসেলের শব্দ। সেই শব্দে আক্রমণকারী যুবকেরা সারি বেঁধে ফিরে যেতে থাকে। সামরিক প্রথামতে তাঁদের নেতা সবার পিছনে। জানালা ভেঙে পালানো একজন ইংরেজ যুবক লুকিয়ে ছিল নালার ভিতরে। পাগড়ি মাথার নেতাকে চোখে পড়ে তাঁর। খুব সন্তর্পনে নিজের কাছে রাখা অস্ত্র দিয়ে গুলি করে সে। বুকে গুলি লাগে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অধিনায়ক।
ঘন্টাখানেক পরে পুলিশ, মিলিটারি ও গোয়েন্দাদের দিয়ে ভরে যায় আশপাশ। রাস্তার উপরে পড়ে থাকা অধিনায়কের মৃতদেহ তুলে নিয়ে পোস্ট মর্টেমের জন্য পাঠানো হয়। পোস্ট মর্টেম করতে গিয়ে খোলা হয় মাথার পাগড়ি। সাথে সাথেই একরাশ দীর্ঘ কালো চুল বের হয়ে আসে পাগড়ির ভিতর থেকে। হতভম্ব সবাই আবিষ্কার করে কোনো পুরুষ নয়, শ্যামল বরণ একজন তরুণীর মৃতদেহ এটি।
বিহ্বল এবং বিমূঢ় সকলের সামনে পোস্ট মর্টেম টেবিলে নিথর শুয়ে থাকেন মাতৃভমির জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে জীবন আত্মোৎসর্গকারী, বাংলার প্রথম নারী শহীদ, বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার।
২. কৃষ্ণকলি
মে মাস, ১৯১১ সাল।
আসকার খানের দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে নেমে গেছে সরু একটা গলি। সেই গলি ধরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলেই শহর ছাড়িয়ে গ্রামে প্রবেশ। এরই শেষ মাথায় মিউনিসিপ্যালিটির বড় নালার উত্তরে একটা মাটির দোতলা বাড়িতে মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দাদারের সপরিবারে বাস। বড্ড টানাটানির সংসার তাঁর।
পাঁচ তারিখে জগদ্বন্ধুর স্ত্রী প্রতিভাদেবী দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেন। সেই সন্তান এমনিতেই মেয়ে তার উপরে আবার গায়ের রঙ কালো। এই কালো দেখে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেরই মুখ ঘোর অমাবস্যার মতো কালো হয়ে যায়। শুধু মা-ই পরম আদরে কাঁথায় জড়ানো ছোট্ট মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে নেন। ভালবেসে চুমু খান কপালে। হাসিমুখে স্বামীকে বলেন, আমার এই কালো মেয়ে দেখো একদিন তোমাদের সবার মুখ আলো করবে।
আদর করে মা তাঁর কন্যার নাম রাখেন রানী।
৩. ডাকাত দেখা
ডিসেম্বর মাস, ১৯২৩ সাল।
রানী তখন স্কুলে পড়ে। হঠাৎ করেই শহরে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। কিছুদিন আগে রেলওয়ের কর্মচারীদের বেতনের টাকা ডাকাতি হয়েছিল। সেই ডাকাত ধরা পড়েছে। শহরের উত্তরে এক ভুতুড়ে বাড়িতে ওরা এতদিন লুকিয়ে ছিল। পুলিশ কেমন করে খবর পেয়ে হামলে গিয়ে পড়েছে। ডাকাত দলের সঙ্গে অস্ত্র ছিল। আক্রান্ত হয়ে তারাও পালটা আক্রমণ করেছে। পুলিশের বেশ কয়েকজন লোক গুলিতে আহত হয়েছে। অবশেষে দুই ডাকাতকে ধরতে পেরেছে পুলিশ আহত অবস্থায়। (এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আছে অনন্ত সিংহের অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম বইতে।)
সশস্ত্র পুলিশের একটা দল হেঁটে আসতে থাকে দক্ষিণে, শহরের দিকে। রাস্তার দুইপাশে ভিড় জমে যায় কৌতুহলী মানুষের। রানী গিয়েছিল তার এক সহপাঠিনী রেণুর বাসায়। জনতার উৎসাহ আর কৌতুহল তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে যায়। ডাকাত দেখার জন্য সেও রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
কাছে আসতেই দেখা গেল পুলিশদের ঠিক মাঝখানেই একটি গরুর গাড়ি। তাতেই ডাকাত দুজনকে বসানো হয়েছে। একজনের শীর্ণ দেহ। এন্ডির চাদর গায়ে দুই হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। শান্ত, সমাহিত চেহারার একজন ভদ্রদর্শন ব্যক্তি। অন্যজন গৌরবর্ণের মধুরকান্তি এক যুবক। একজন হাবিলদার কিছু সময় পরপরই নির্দয়ভাবে লাথি-ঘুষি দিচ্ছে দুজনকে। ভীমদর্শন বিশালদেহী ডাকাত দেখবে বলে ভেবেছিল রানী। এরকম সাদামাটা ডাকাত দেখে চরম বিস্মিত হয় সে।
ঠিক সে সময়েই রেণুর ভাইয়ের বিস্মিত চিৎকার শোনা যায়। ‘একি? এতো আমাদের মাস্টারমশাই। চাদর গায়ে বসে আছেন যিনি, তিনি আমাদের অংকের মাস্টার। তাঁকে কেন এমন করে নিয়ে আসছে?’
রেণুর বাবা ডাক্তার। তিনি এই দু’জনকেই চেনেন। তিনি বলেন, ‘চাদর পরা ভদ্রলোকটি উমাতা স্কুলের শিক্ষক। নাম সূর্য সেন। অন্যজন দেওয়ানপুরের অম্বিকা চক্রবর্তী। সরকারী আপিসের কেরানী তিনি। ডাকাত ধরতে গিয়ে এই দুই নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে এসেছে পুলিশ।‘
রেণুর বাবা আংশিক সত্য ছিলেন। এঁরা কেউ-ই ডাকাত ছিলেন না, কিন্তু নিরীহ মানুষও ছিলেন না তাঁরা। বুকের মধ্যে সংগোপনে বিধ্বংসী দাবানলের বীজ বহন করে ঘুরে বেড়াতেন এঁরা।
৪. নিষিদ্ধ বই
ঊনিশশো একুশ, বাইশ সালের দিকে চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের একটাই মাত্র দল ছিল। নাম অনুশীলন। এঁদের প্রধান কাজ ছিল সরকারের বাজেয়াপ্ত করা বইপত্র গোপনে পড়া। ওইসব বই পড়িয়ে ছাত্র ও তরুণদের মধ্য থেকে দলের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহ করা। নিয়মিত ব্যায়াম করে শরীরকে সুঠাম রাখা। নৈতিক চরিত্র উন্নত রাখা।
চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলের সাথে সংশ্লিষ্ট এক যুবক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রথম বাঙালি সেনাদল ৪৯ নং বেঙ্গলী রেজিমেন্ট এর হাবিলদার ছিলেন। তাঁর নাম জুলু সেন। যুদ্ধশেষে ফিরে আসার পরে বিপ্লবীদের আরও সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ করার জন্য দাবী তোলেন তিনি। গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহদের মতো ছটফটে তরুণেরা শুধুমাত্র গোপনে বইপড়া, লুকিয়ে একটু অস্ত্রশস্ত্র নাড়াচড়া করা বা শরীরচর্চার কাজ করে সন্তুষ্ট ছিলেন না। মাঠে সক্রিয়ভাবে নামার জন্য মুখিয়ে ছিলেন তাঁরা।
এই ইস্যুতে চট্টগ্রামের বিপ্লবীদলের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে বৈঠক হয়। এই বৈঠকেই মতানৈক্যের কারণেই অনুশীলন দল ভেঙে যায়। সূর্য সেনের নেতৃত্বে যুগান্তর দল তৈরি হয়।
ডাকাতির মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী। কিন্তু বেঙ্গল অর্ডিনান্সের (এটি একটি কুখ্যাত আইন। এর আওতায় রাজনৈতিক সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটকে রাখা যেত।) আওতায় তাঁকে ধরার জন্য পুলিশ খুঁজছিল। তিনি তখন থাকতেন দেওয়ানবাজারে তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায়। একদিন ভোরবেলা বাড়িটার তিনদিক ঘিরে ফেলে পুলিশ। বাড়ির পিছনে একটা নালা ছিল। শুধু ওইদিকটাতে পুলিশ যায় নি। বাড়ির চারপাশে পুলিশ দেখে দোতলার জানালা দিয়ে পিছনের নালার মধ্যে লাফ দিয়ে পড়েন তিনি। নালার মধ্যে প্রচুর বালু থাকার কারণে তেমন শব্দ হয় না। নালা ধরে ধরে পালিয়ে যান তিনি। চট্টগ্রাম কলেজের পাশে এক বিপ্লবী সদস্যের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন।
এই বিপ্লবী তরুণটি কলেজ ছাত্র। সম্পর্কে রানীর খুড়তুতো ভাই। বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে বিপ্লবী দলের নেতৃত্বস্থানীয় লোকজন ধরা পড়ে গেলে নিষিদ্ধ বইগুলো সংরক্ষণের চিন্তা এসে পড়ে। বিপ্লবী ছাত্রটি নিজ দায়িত্বে বইগুলো রানীর কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তখন পর্যন্ত বিপ্লবী দলে কোনো নারী সদস্য ছিল না।
একটা কাগজের মোড়কে করে বেশ কয়েকটা বই এনে দেয় রানীকে। বলে দেয় যে, এগুলোকে লুকিয়ে রাখতে হবে। কেউ জানলে খুব ক্ষতি হবে।
রানী বইগুলোকে লুকিয়ে রাখে, কিন্তু ওগুলোতে কী আছে, সেটা নিয়ে তাঁর কৌতুহলের সীমা হয়ে উঠে আকাশছোঁয়া। সীমাহীন এই কৌতুহলের কারণেই একদিন গোপন জায়গা থেকে বের করে মোড়ক খোলে সে। মোড়কের ভিতরে চারটা বই, দেশের কথা, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম আর কানাইলাল।
গোগ্রাসের মতো বইগুলো পড়া শুরু হয়। সেই সাথে শুরু হয় মুখচোরা একজন লাজুক কিশোরীর সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে প্রবেশ। রোমাঞ্চকর এই জগৎ সম্পর্কে আগে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর।
একদিন ছেলেটা দেখে ফেলে রানীর বইপড়া। রানীর বইয়ের মাঝে আবিষ্কার করে ঝাঁসীর রানী লক্ষ্ণীবাঈয়ের ছবি। উত্তেজিত রানী বলে,
“এতকাল আগে থেকে মেয়েরা যদি দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়তে পারে, তা’হলে আমি কেন পারব না? আমার খুব ইচ্ছা করে ওদের মতো হতে। তোমরা সবাইতো আমাকে “রানী” বলে ডাক। নাটোর আর ঝাঁসীর রানী যা পেরেছিল চাটগাঁর রানী নিশ্চয়ই তা পারবে।“
এ কথা শুনে শিউরে উঠে ছেলেটি। বলে, “না রানী, মেয়েদের দিয়ে যুদ্ধ করা চলবে না। মেয়েরা টাকা পয়সা, অলংকার দিয়ে সাহায্য করবে, বা বইপত্র, অন্য কিছু লুকিয়ে রাখার মতো কাজ করে স্বাধীনতার যোদ্ধাদের সাহায্য করতে পারবে।”
রানীর মনে বারবার শুধু এই প্রশ্নই ঘুরে চলে, কেন মেয়েদের দিয়ে যুদ্ধ করা চলবে না?
৫.দীপালী সংঘ
ম্যাট্রিকে প্রথম বিভাগে পাশ করে রানী। অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট, তবে স্কলারশিপের জন্য যথেষ্ট নয়। রানীর প্রবল ইচ্ছা ছিল কোলকাতায় পড়ার। কিন্তু, তার দরিদ্র পিতামাতার পক্ষে কোলকাতায় তাকে রেখে পড়ানোর সঙ্গতি তাঁদের ছিল না। কল্পনা দত্ত উল্লেখ করেছেন যে, এ কারণে তার এবং রানী দুজনেরই মন খুব খারাপ ছিল। রানী ছাত্রী হিসাবে খারাপ ছিল না, তবে অংকে কাঁচা ছিল। অংকের কারণেই স্কলারশিপ পাওয়া হয় না তার। ঢাকার ইডেন কলেজে আই,এ তে ভর্তি হয় সে। কল্পনা দত্ত তখনও স্কুলে পড়ে। সে রানীর চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট ছিল। পরের বছর ম্যাট্রিক পাশ করে কল্পনা চলে যায় কোলকাতায় চলে পড়তে।
ঢাকায় তখন শ্রীসংঘ নামে একটা বিপ্লবী দল ছিল। এই দল প্রকাশ্য লাঠিখেলা, কুস্তি, ডনবৈঠক, মুষ্টিযুদ্ধ এগুলো শিক্ষা দেবার জন্য বিভিন্ন ধরণের ক্লাব এবং আখড়া গড়ে তুলেছিল। গোপন উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। এখান থেকে বাছাই করা ভাল ছাত্র এবং তরুণদের তারা বিপ্লবী দলের সদস্য করে নিত।
ঢাকায় শ্রীসঙ্ঘের একটা মহিলা শাখাও ছিল। নাম দীপালী সংঘ। দীপালী সংগঠনের নেত্রী ছিলেন লীলা নাগ। নারী শিক্ষা বিস্তার ও উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা ছিল এর প্রকাশ্য কাজ। লীলা নাগের প্রচেষ্টায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু, এগুলো ছিল বাইরের রূপ। ভিতরে খুব সংগোপনে এই সংঘ মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করতো।
দীপালী সংঘের সদস্য ইডেনের একজন শিক্ষিকার চোখ পড়ে প্রীতিলতার দিকে। দীপালী সংঘের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিতি আলোচনা করেন তিনি প্রীতিলতার সাথে। পরে সঙ্ঘের সদস্য হবার জন্য একটি ফর্ম দেন।
গরমের ছুটিতে চট্টগ্রাম ফিরে আসে প্রীতিলতা। সেই বিপ্লবী ভাইকে খবর দিয়ে আনায়। দীপালী সঙ্ঘের ফর্ম দেখায়। বিপ্লবী ভাইটি গম্ভীর মুখে ফর্মটি পড়তে থাকে। উত্তেজিত প্রীতি বলে, দেখেছো, এখানে লেখা আছে, প্রয়োজন হইলে দেশের মুক্তি-সংগ্রামে আমার সর্বস্ব, জীবন পর্যন্ত আমি ত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছি। এটি কিন্তু আমার খুব ভাল লেগেছে। তুমি আমাকে বলেছিলে আমরা মেয়েরা নাকি ওসব পারবো না। এখন কি বলো তুমি?
ছেলেটি কোনো উত্তর দেয় না। গভীর মনোযোগ দিয়ে ফর্মটি পড়তে থাকে। তারপর যেন আনমনেই ফর্মটি পকেটে পুরে ফেলে।
৬. গোপন সদস্য
বিপ্লবী দলের সদস্য এই ছেলেটি সূর্যসেনের সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করে। কিছুদিনের মধ্যেই তা মঞ্জুর হয়। সেই বৈঠকে প্রীতিলতাকে নিয়ে আলোচনা হয়। ছেলেটি সমস্ত কিছু পূর্বাপর খুলে বলে। প্রীতির কাছে নিষিদ্ধ বই রাখা প্রসঙ্গে, বিপ্লবী দলে যোগ দেবার প্রীতির আগ্রহের কথা সেই সাথে দীপালী সংঘে তাঁর যোগ দেবার আসন্ন সম্ভাবনা নিয়ে খোলাখুলি বক্তব্য রাখে সে। সুদীর্ঘ আলোচনার পরে সূর্যসেন বলেনঃ
“মেয়েদের সম্পুর্ণ বাদ দিয়েই এদেশে বিপ্লব হবে, একথা আমরা কোনোদিন ভাবিনি। তবে দেশে মুক্তির জন্য যে কঠিন শত্রুর সঙ্গে আমাদের লড়তে হবে, সেখানে আছে রক্তপাত, অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষ, আরও অনেক কঠিন কাজ। আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় মেয়েরা এইসব কাজে তোমাদের মতো করে যোগ দিতে এখনই পারবে না। পরে অবশ্যই পারবে, তারা আমাদেরই মা-বোন তো। এখন থেকে আমাদের দলের ছেলেদের আপন বোন, মা ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়দের আমরা দলে নেব। কিন্তু তা করতে হবে সাবধানে ও ধীরে ধীরে। বেশ কিছুদিন বইপত্র পড়বে, গোপনীয়তা রক্ষার মতো যোগ্যা এবং সর্বোপরি উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী হলেই তাদের কাছে দলের কথা বলা চলবে। হালকা বা চঞ্চল কোনো মেয়ে সাময়িক উৎসাহের লক্ষণ দেখালেই তাকে বিশ্বাস করবে না এবং দলের কোনো আভাসও তাকে দেবে না।“
“তাহলে প্রীতিকে কী বলবো? তাকে কি সদস্য হিসাবে গ্রহণ করবেন?” ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ছেলেটি।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন সূর্য সেন। হারিয়ে গেছেন যেন কোথাও। দীর্ঘক্ষণ পরে মৃদুস্বরে তিনি বলতে থাকেন।
“যে পবিত্র দেশপ্রেমের আদর্শ জীবনে গ্রহণ করেছি, তার জন্য আমাদের চরম আত্মদানের জন্য তৈরী হতে হবে। তার জন্য অন্য সবকিছুর সঙ্গে দরকার কঠোর সংযম। মা-বোনেরা স্নেহ, মমতা ও সেবা দিয়ে আমাদের যে সাহায্য করেন, তার সঙ্গে সঙ্গে কিছু দুর্বলতার বন্ধনেও তাঁরা আমাদের বাঁধতে চান। তাই যখনই সর্বস্বত্যাগের জন্য আমরা এগিয়ে যাই, স্নেহ-ভালবাসার অশ্রুজল নিয়ে আমাদের যাত্রাপথ তাঁরা আগলে থাকতে চান। তাই আমরা বিপ্লবীরা আজীবন কুমার থাকার ব্রত গ্রহণ করি। আমার পূজনীয় বড় ভাইয়ের কথা রাখার জন্য আমাকেও বিবাহ করিতে হয়েছিল। কিন্তু সেজন্য আমার মনে অনুশোচনা আসে এবং আমি গৃহত্যাগ করেছিলাম। আমি যখন বোম্বাইয়ের রত্নাগিরি জেলে বিনাবিচারে আটক, তখন সম্পুর্ণ অপরিচিতা আমার স্ত্রীর টাইফয়েড হয়। জীবনে তার সঙ্গে একটি কথা বলার দরকার হয়নি। সে চিরবিদায় নেবার আগে নাকি বলেছিল, তাকে আমার আদর্শ পথের সাথী কেন করলাম না? তারপর থেকে আমি অনেক ভেবেছি। আমার মনে হয়, বিপ্লবের সব কাজে মেয়েদের না নিতে পারলেও, অনেক বিশ্বস্ত ও গোপনীয় কাজের সাহায্যের জন্য তাদের আমরা নিতে পারি। প্রীতির কথা তোমার কাছে শুনে আমি স্থির করেছি যে, তাকে আমরা দলে নেব। তবে সঙ্গে এই সিদ্ধান্তও থাকছে যে, তাকে আজ থেকে দলের সদস্যা করা হল। এই কথা তুমি, আমি ও সে – এই তিনজনের বাইরে কেউ যেন না জানতে পারে, এই আদেশ তোমার উপর রইল, তাকে একথা বলে দিও।“
প্রীতির কাছে এই সুখবর পৌঁছুলো পরের দিন। পূজা ঘরে গিয়ে অদেখা, অচেনা, অসাধারণ গুরুটিকে অন্তর থেকে প্রণাম করে সে।।
৭. প্রমীলা চক্র
আই,এ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হন প্রীতিলতা। প্রথম হবার সুবাদে মাসে বিশ টাকার বৃত্তি জোটে তাঁর। কোলকাতায় যেতে আর কোনো বাধা থাকে না। বেথুন কলেজে ভর্তি হয়ে যান তিনি। কল্পনা দত্তও তখন কোলকাতায়। বেথুন কলেজে আই,এস,সি পড়ছেন। কল্পনা দত্ত সহ চট্টগ্রাম বিপ্লবীদলের চারজন মেয়ে এবং আরো কয়েকজন ছাত্রীকে নিয়ে প্রীতিলতা একটা চক্র গড়ে তোলেন। চট্টগ্রাম থেকে আনা নিষিদ্ধ বইস্মূহ শুধু নিজে পড়েই ক্ষান্ত থাকতেন না প্রীতিলতা। অন্য ছাত্রীদেরও তা গোপনে পড়াতে থাকেন তিনি। প্রীতিলতার এই প্রমীলা চক্র নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করে বিপ্লবীদের পাঠাতেন।
এই সময় বিপ্লবী দলের কাছ থেকে গোপন এক নির্দেশ আসে প্রমীলা চক্রের কাছে। কোলকাতার গোপন কারখানায় তৈরি বোমার খোল নিয়ে আসতে হবে চট্টগ্রামে। যখনই সুযোগ পেতো তখনই মেয়েরা বোমার খোল গোপনে চট্টগ্রামে নিয়ে আসতেন। ১৯২৯ সালের পূজার ছুটিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বোমার খোল নিয়ে আসেন মেয়েরা। প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, সরোজিনী পাল, নলিনী পাল, কুমুদিনী রক্ষিত প্রত্যেকে চারটি করে মোট বিশটি বোমার খোল নিয়ে আসেন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল এবং পরবর্তীতে অনেক বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে এইসব খোলের বোমাগুলিই ব্যবহৃত হয়েছিল।
নারী বিপ্লবীদের এই দলটি সরাসরি সূর্য সেনের তত্ত্বাবধানে কাজ করতো। সংগঠনের বহু লোকই এঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন না। অনন্ত সিং এর মত প্রথম সারির বিপ্লবীও জানতেন না যে নারী বিপ্লবীরা কাজ শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। তাঁর ভাষ্যে, আমাদের বিপ্লবী দলে কল্পনা, প্রীতিলতা ও অন্যান্য মেয়েরা ছিল। আমরা এদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তখন জানতামও না। যখন ১৯৩০ সালে আমাদের বিরুদ্ধে “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন” নাম দিয়ে সরকার মামলা চালাচ্ছিল তখন আমি প্রথম কল্পনা ও প্রীতিলতা সম্বন্ধে শুনতে পাই।
৮.মরণরে তুহু মম
২রা ডিসেম্বর, ১৯৩০ সাল
চাঁদপুর রেলস্টেশন, কুমিল্লা
ঘন কুয়াশায় ছেঁয়ে আছে রেল স্টেশন। চট্টগ্রাম থেকে আগত রেল ধীরে ধীরে স্টেশনে এসে থামে। ট্রেন থামতে না থামতেই তড়িৎ গতিতে প্রথম শ্রেণীর কামরার দরজা খুলে ঢুকে পড়ে দুজন সশশ্ত্র তরুণ।
কামরার একেবারে শেষ মাথায় বসে ছিলেন ইংরেজ পুলিশের ডি আই জি মিঃ ক্রেগ। সরকারী কাজে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। কাজ শেষ করে কোলকাতায় ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। সশস্ত্র দুই তরুণকে এভাবে ঢুকতেই দেখেই সতর্ক ক্রেগ বুঝে ফেলেন যে কী ঘটছে। চোখের নিমেষে বাথরুমে ঢুকে ভিতর থেকে বন্ধ করে দেন তিনি। ক্রেগের সাথে একজন দীর্ঘকায় বাঙালি পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন। তিনি ওভারকোট মুড়ি দিয়ে বসে ছিলেন শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য। তরুণ দুই বিপ্লবী তাকেই ক্রেগ ভেবে গুলি করে বসেন। বাঙালি ইন্সপেক্টরের বাংলায় মরণ চিৎকার শুনে তরুণদ্বয় বুঝতে পারেন যে ক্রেগ নিহত হন নি। দ্রুতগতিতে তখন তাঁরা নেমে যান প্লাটফর্মে। আকাশে কয়েকটা ফাঁকা গুলি করেন। গুলির শব্দে ভয়ে জনশূন্য হয়ে পড়ে চাঁদপুর স্টেশন। এই ফাঁকে পালিয়ে যান তাঁরা।
ক্রেগকে হত্যার দায়িত্ব সূর্য সেন যে দুজন তরুণ বিপ্লবীর হাতে ন্যস্ত করেছিলেন তাঁরা হচ্ছে কালিপদ চক্রবর্তী এবং রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। এরা দুজনেই পরীক্ষিত এবং সুপ্রশিক্ষিত বিপ্লবী। ১৮ই এপ্রিলের চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের প্রাক্কালে বোমা বানাতে গিয়ে গুরুতরভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। পরে গোপন স্থানে চিকিতসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা হয় তাঁকে (এর বিশদ বিবরণ আছে অনন্ত সিংহের বইতে)।
পালিয়ে যাবার পথেই কুমিল্লা থেকে মোটরে করে আসা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান দুজনেই। বিচারে দুজনেরই ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বয়স স্বল্পতার অজুহাত দিয়ে দুজনের প্রাণদণ্ডাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। কালিপদকে করুণা করে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। কিন্তু রামকৃষ্ণের প্রাণদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। যদিও কালিপদ বয়সে রামকৃষ্ণের চেয়ে বড় ছিলেন, কিন্তু দেখতে তাঁকে ছোট দেখাতো। রামকৃষ্ণ ছিলেন ঘন গোঁফওয়ালা সুঠাম তরুণ। ফলে তাঁকে বেশি বয়ষ্ক মনে হতো।
রামকৃষ্ণকে কোলকাতার আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল।
দলের নির্দেশ ছাড়া কোনো মেয়ে অন্য কোনো ছেলে সদস্যের সাথে আলাপ করতে পারতো না। এটা ছিল সূর্য সেনের করা কঠোর নিয়ম। প্রীতিলতা এই নিয়ম জানতেন। কিন্তু খবরের কাগজে রামকৃষ্ণের ঘটনা জানার পরে উতলা হয়ে উঠে তাঁর মন। ছদ্মনাম নিয়ে রামকৃষ্ণের দূর সম্পর্কের বন সেজে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন প্রীতিলতা। রামকৃষ্ণও প্রীতিলতার মতই শ্যামল বর্ণের ছিলেন। ফলে, কেউ সন্দেহ করে নি। কিন্তু, রামকৃষ্ণ তাঁর বোন তাঁকে দেখতে এসেছে এই সংবাদে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। কোলকাতায় তাঁর কোনো বোন থাকার কথা নয়। তাঁর পরিবারে লোকজনের যে আর্থিক অবস্থা তাতে করে চট্টগ্রাম থেকে কোলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করা কথা কারো নয়।
রামকৃষ্ণের সাথে সাক্ষাৎ প্রীতিলতার জীবনের এক রোমাঞ্চকর এবং মোড় ঘোরানো ঘটনা। একজন তরুণ, মাত্র কদিন পরেই যে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলবে, তাঁর দুর্দান্ত সাহস, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, সাগরসম দেশপ্রেম নাড়িয়ে দেয় প্রীতিলতাকে। রামকৃষ্ণ তাঁর জন্য অনুপ্রেরণার এক বিরাট উৎস হয়ে আসে। ঘাড়ের কাছে মৃত্যুর গাঢ় নিঃশ্বাস টের পাবার পরেও কী অবিচল এই তরুণ! সামান্যতম কোনো বিকার নেই, নেই কোনো মৃত্যুভীতি। কল্পনা দত্তের মতে, প্রায় চল্লিশবার প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের সাথে জেলে গিয়ে দেখা করেছিলেন। রামকৃষ্ণের ফাঁসি হবার পরেই সম্মুখ লড়াইয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেন প্রীতিলতা।
প্রীতিলতা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেনঃ
“বিপ্লবী দলের জনৈক সহযাত্রী যখন আমাকে দেশের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করার অপরাধে ব্রিটিশ আইনে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করতে বললেন, তখন আমি এক নতুন প্রেরণার শিহরণ বোধ করলাম। আমি তার এক সম্পর্কিত বোন হিসাবে নিজের পরিচয় দিয়ে কোনোমতে এই হাস্যময় তরুণ বীরের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি যোগাড় করি। তাঁর ফাঁসির আগে তার সঙ্গে আমার প্রায় চল্লিশবার দেখা হয়েছে। তার সুসংযত দৃষ্টি, ভগবানে অগাধ বিশ্বাস, শিশুসুলভ সারল্য, আবেগপুর্ণ অন্তর, গভীর জ্ঞান ও বিপ্লবের আদর্শে বিশ্বাস আমাকে গভীরভাবে উদবুদ্ধ করে। আমি আগের চেয়ে আরও দশগুণ বেশি শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা তার কাছ থেকে পাই। আমার জীবনাদর্শকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে মৃত্যুপথযাত্রী ঐ দেশপ্রেমিকের সাহচর্য আমাকে খুব সাহায্য করেছে। রামকৃষ্ণের ফাঁসীর পরই কোনো বাস্তব বিপ্লবী কাজে যোগ দেবার জন্য আমার মনে বিশেষ আগ্রহ জাগে।“
৯. গুরু দর্শন
বি,এ পরীক্ষার পরে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন প্রীতিলতা। নন্দকাননে তখন মেয়েদের জন্য একটি নতুন ইংরেজি স্কুল গড়ে উঠেছিল। প্রীতিলতা ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রির পদে নিযুক্ত হন। প্রায় একই সময়ে কল্পনা দত্তও বেথুন কলেজ থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসেন চট্টগ্রাম কলেজে। চট্টগ্রামে ফিরেই সূর্য সেনের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য উদ্যোগ নেন প্রীতিলতা।
রামকৃষ্ণের বোন পরিচয় দিয়ে প্রীতিলতা যে তাঁর সঙ্গে অনেকবার দেখা করেছে, এই কথা তখন চলে এসেছে চট্টগ্রামেও। প্রীতির কাছ থেকে সেই বিবরণ শোনার জন্য সূর্য সেনও উৎসুক এবং আগ্রহী ছিলেন। ফলে, এই সাক্ষাতে খুব বেশি বিলম্ব হয় না।
ধলঘাটের এক গোপন ঘাটিতে সূর্য সেনের সাথে প্রীতিলতার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়।
সন্ধ্যার পরে সেই গোপন ঘাটিতে নিয়ে যাওয়া হয় প্রীতিলতাকে। ছোট্ট একটা মাটির দোতলা বাড়ি সেটি। এক পৌঢ়া বিধবা মালিক সেটির। নাম সাবিত্রী দেবী। ছেলে রামকৃষ্ণকে বসবাস করেন। কিছুদিন আগে বিয়ে হওয়া তাঁর কন্যাও বেড়াতে এসেছে মায়ের বাড়িতে।
কিছুক্ষণ পরেই সূর্য সেন সেখানে হাজির হন। সাথে অন্যতম নেতা নির্মল সেন এবং মাত্র আঠারো ঊনিশ বছর বয়েসী এক তরুণ অপূর্ব সেন। যার ডাক নাম ভোলা। মূলত সূর্য সেনের সহকারী সে।
খাওয়া দাওয়ার পরে আলোচনা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। প্রীতিলতায় সেদিন রান্না করেছিলেন। এর পরে কী ঘটেছিল তা প্রীতির বর্ণনাতেই শোনা যাকঃ
“খেতে বসতে যাব, তখনই মাস্টারদা বললেন, “পুলিশ”, “পুলিশ”। মাস্টারদাকে বললাম,আমি আপনাদের সঙ্গেই থাকব। তিনি চোখ বড় বড় করে বললেন, নীচে মেয়েদের মধ্যে চলে যাও, তাদেরই আত্মীয় বলে পরিচয় দিও। উপরে রইলেন, মাস্টারদা, নির্মলদা আর ভোলা। ক্যাপ্টেন ক্যামেরণ তখন সিঁড়ি বেয়ে রিভলভার হাতে উপরে উঠছে। নির্মলদা দাঁড়িয়ে তাকে গুলি করলেন। সাহেব ক্যাপ্টেন ক্যামেরণ গুলীবিদ্ধ হয়ে নীচে পড়ে গেল। তারপর দু’দিক থেকে কিছুক্ষণ গুলী চলল।
এমন সময় মাস্টারদা ভোলাকে নিয়ে নীচে নেমে এলেন। মাস্টারদার পাশে তখন ভোলা দাঁড়িয়ে। এত বিপর্যয়েও তার চোখে মুখে কোনো চাঞ্চল্য নেই, দেখে কি চমৎকার লেগেছিল। রিভলভারের ট্রিগারে হাত রেখে মাস্টারদার আদেশের অপেক্ষায় আছে। মাস্টারদা বললেন, চলো। আমরা তিনজন রওনা হলাম। পিছন দিক দিয়ে বেরোবার সময় শুকনো পাতার উপর ‘খস’ ‘খস’ হতেই অন্ধকারের বুক চিরে এক গুলি এসে অপূর্বর বক্ষভেদ করল। আমি আর মাস্টারদা অন্ধকারে নিরুদ্দেশ যাত্রা করলাম।“
সূর্য সেন ও প্রীতিলতার পলায়ন নিশ্চিত করতে তখনও প্রতিরোধ গড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন নির্মল সেন। আহত হয়েও যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর রিভলভারে গুলি ছিল, তিনি লড়ে গেছেন বীরোচিতভাবে। তারপর একসময় অসম লড়াইয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন আরো অসংখ্য সূর্যসৈনিকের মতো।
ক্যামেরণের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পুলিশ ধ্বংস করে দেয় সাবিত্রী দেবীর বাড়িটি। তাঁকে এবং তাঁর ছেলে-মেয়ে দুজনকেই গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়।
১০. আঁধার পথে পাড়ি
ধলঘাটের সংঘর্ষের পরই সরাসরি লড়াই করার জন্য উতলা হয়ে উঠেন প্রীতি। তাঁর এই আগ্রহের কথা হয়তো কোনোভাবে তিনি জানিয়েছিলেন সূর্য সেনকে। কিছুদিন পরেই প্রীতিলতাকে আত্মগোপনে যাবার নির্দেশ দেন তিনি। একই সময়ে কল্পনা দত্তকে একই ধরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখে পাহারড়তলীতে পুরুষের ছদ্মবেশে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান কল্পনা। পুলিশ জেলে পাঠিয়ে দেয় কল্পনা দত্তকে। কল্পনা যখন জেল গেইট পার হয়ে ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছিলেন, মধ্য বয়েসী এক শ্যামলা বিধবা নারী ছুটে আসে তাঁর কাছে। জিজ্ঞেস করে সে স্বদেশী কি না। মহিলার সারা গায়ে টিউমার। আঁতকে উঠে কিছুটা পিছিয়ে যান তিনি। কাটাস্বরে হ্যাঁ বলে দ্রুত সরে যেতে থাকেন তিনি। কিন্তু মহিলা তাঁকে ছাড়ে না। পিছু নেয়। জড়ানো এবং অসংলগ্নপ কণ্ঠে মহিলা বলে যেতে থাকে, “ওরা হয়তো তোমাকে নির্যাতন করবে, কিন্তু কিছু ফাঁস করে দিও না ওদের। তোমাকে হয়তো ফাঁসীতে ঝোলাবে বলে ভয় দেখাবে, কিন্তু কিছুই বলবা না ওদের।“
কল্পনা দত্ত পরে জানতে পারেন যে, এই মহিলার নাম সাবিত্রী দেবী। ধলঘাটে বাড়ি তাঁর। সূর্য সেনকে আশ্রয় দেবার অপরাধে আটক হয়ে আছেন তিনি।
১৯৩০ সালের যুব বিদ্রোহের সময়, অস্ত্রাগার এবং পুলিশ লাইনের সাথে সাথে চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গুড ফ্রাইডের কারণে ওইদিন বন্ধ ছিল ক্লাব। ফলে, বিপ্লবীদের আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যায় সেটি তখন। কিন্তু ওর পরেই এই ক্লাব বন্ধ করে দেয় ইংরেজরা ভয়ে। এর পরিবর্তে পাহাড়তলীর রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবকে ইউরোপিয়ান ক্লাব হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়।
এই ক্লাব আক্রমণের জন্য যে বিপ্লবী দল পাঠানো হবে তার নেতৃত্ব দেবার দায়িত্ব কোনো মেয়ে বিপ্লবীর হাতে দেবেন বলেই স্থির করেছিলেন সূর্য সেন। আর সে কারণেই প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্তকে আত্মগোপনে যেতে বলেছিলেন তিনি।
অস্ত্র এবং স্ট্রাটেজিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রীতি এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের নিয়ে আসা হয় সাগরপারের গ্রাম কাট্টলীতে। আক্রমণ যাতে নিখুঁত হয়, সে জন্য প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধানের জন্য সূর্য সেন নিজেও চলে আসেন কাট্টলী গ্রামে।
এখানেই তিনি ঘোষণা করেন যে, এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেবে প্রীতিলতা। বিস্মিত প্রীতিলতা আপত্তি জানিয়ে বললেন যে, একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে আমি এই অভিযানে যেতে চাই। আমার চেয়ে অনেক যোগ্য লোক রয়েছে নেতৃত্ব দেবার। তখন সূর্য সেন বলেন,
“বাংলার ঘরে ঘরে বীর যুবকেরদের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে কালারপুর পর্যন্ত এঁদের দীপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে তাজা রক্তে সিক্ত হয়েছে, কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও এবার যে শক্তির খেলায় মেতেছে সেই অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। তোমার সাফল্যে বা তোমার আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হয়ে উঠুক – এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ অবলোকন করুক যে, এদেশের মেয়েরাও আজ আর পিছিয়ে নাই।”
এই বক্তব্যের পরে আর কোনো আপত্তি থাকে না প্রীতিলতার। চব্বিশ তারিখে আক্রমণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয় বিপ্লবী দলকে।
চব্বিশ তারিখ রাতে রণসাজে সজ্জিত হয় বিপ্লবীরা। খাকি সামরিক পোশাকে সজ্জিত হন প্রীতিলতা। কোমরে চামড়ার কটিবন্ধে গুলিভরা রিভলভার। চামড়ার খাপে গোর্খা ভোজালি। পায়ে মোজা ও বাদামি রাবার সোলের জুতা। মাথার দীর্ঘ কেশরাশিকে সুসংবদ্ধ করে তার উপরে পরে ফেলেন সামরিক কায়দার পাগড়ি। গভীর ভালবাসা আর পরম মমতায় সযত্নে বুক পকেটে রাখেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের একটি ছবি। দেশের জন্য ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলা এই তরুণটি যে তাঁর জীবনের আদর্শ।
তাঁর সঙ্গীরাও একই ধরণের পোশাকে সজ্জিত। কারো হাতে রাইফেল, কারো কোমরে রিভলভার। কারো কারো কাঁধের ঝোলাতে বোমা।
একে একে সবাই সূর্য সেনের কাছ থেকে বিদায় নেন। তিনি পরম স্নেহে আশীর্বাদ করে বিদায় দেন।
একদল অকুতোভয়ী দেশপ্রেমী তরুণ তরুণী হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে দুঃসাহসিক এক অভিযানে যাবার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত। জন্মভূমির বুকে জমে থাকা দীর্ঘদীনের প্রগাঢ় আঁধারকে অপসারণ করতে আঁধার পথে মিলিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা একে একে।
পাজরভাঙা তীব্র যন্ত্রণা আর চোখে অবিরল জলের স্রোত নিয়ে অন্ধকার বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁদের নেতা। বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসতে থাকে ফেনাময় ঢেউয়ের সকরুণ দীর্ঘশ্বাস আর দখিনা বাতাসের তীব্র হাহাকার।
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের বর্ণনা শুরুতেই দিয়েছি। আবার দেবার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না। শুধু একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রীতি কিন্তু গুলিতে নিহত হন নি। আহত হয়েছিলেন। আহত অবস্থায় ধরা পড়ে যাবার ভয়ে পকেটে রাখা পটাসিয়াম সায়েনাইড ক্যাপসুল মুখে পুরে দেন তিনি। ইংরেজের কাছে বন্দী হবার চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন তিনি।
প্রীতিকে সায়েনাইড ক্যাপসুল দেবার জন্য সবসময়েই অনুশোচনা করেছেন সূর্য সেন। তিনি বলতেন, আমি আত্মহত্যায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু তাঁকে শেষ বিদায় জানানোর সময়ে সে আমাকে বাধ্য করেছিল পটাসিয়ান সায়েনাইড দেবার জন্য। সে এতো বেশি আগ্রহী ছিল এবং বন্দী হলে তার এটা প্রয়োজন হবে, এই বিষয়ে এতো জোরালো যুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছিল যে, আমি তার যুক্তির কাছে হার মেনে গিয়েছিলাম। ফলে, পটাসিয়াম সায়েনাইডের ক্যাপ্সুল আমি তাকে দিয়ে দিয়েছিলাম।
কল্পনাকে পরে সূর্য সেন বলেছিলেন যে, প্রীতি মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিল দেশবাসীর কাছে শুধু এটাই প্রমাণ করার জন্য যে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে এবং জীবন দিতে পারে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, বেঁচে ফিরে আসলেই বরং সে আরো বেশি কিছু করতে পারতো।
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের কিছুদিন আগে প্রীতিলতা পূর্নেন্দু দস্তিদারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। পূর্নেন্দু দস্তিদার তখন জেলে। সেই চিঠিতে প্রীতিলতার নিজের লেখা একটা কবিতা ছিল। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষের সেন্সরের কাঁচি তার পুরোটাকেই খেয়ে ফেলেছিল। শুধু শেষ দুটো লাইন পৌঁছেছিল পূর্নেন্দু দস্তদারের কাছে। সেই দুই লাইন এরকমঃ
আঁধার পথে দিলাম পাড়ি
মরণ-স্বপন দেখে।
এর মাত্র কিছুদিন পরে সত্যি সত্যিই একমুখি এক আঁধার পথে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি।
১১. শেষ চিঠি
প্রীতিলতার পোস্ট মর্টেম করার সময়ে তাঁর সামরিক পোশাকের মধ্যে নিজ হাতে লেখা একটি বিবৃতি বের হয়ে আসে। অত্যন্ত যত্নে তিনি এটিকে অন্য একটি কাগজে মুড়ে পোশাকের ভিতরে রেখে দিয়েছিলেন। বেশ বড়সড় একটি বিবৃতি এটি। বেশ ভেবেচিন্তেই তিনি বিবৃতিটি লিখেছিলেন। দেখিয়েছিলেন তিনি এটি সূর্য সেনকে। সূর্য সেন পড়ে অনুমোদনও দিয়েছিলেন। এই বিবৃতিটি পড়লেই বোঝা যায় যে, প্রীতিলতা জানতেন, এই আক্রমণের পরে তাঁর জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সে কারণেই শেষ লাইনে তিনি লিখেছিলেন, এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।
বিবৃতিটি সরকারী পক্ষ আদালতে হাজির করেছিল। পুরো বিবৃতিটি এরকমঃ
আমি বিধিপূর্বক ঘোষণা করিতেছি, যে প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া, অত্যাচারের স্বার্থসাধনে নিয়োজিত সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শসনের উচ্ছেদ সাধন করিয়া আমার মাতৃভূমি ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করিতে ইচ্ছুক, আমি সেই ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখার একজন সদস্য।
এই বিখ্যাত “চট্টগ্রাম শাখা” দেশের যুবকদের দেশপ্রেমের নবচেতনায় উদবুদ্ধ করিয়াছে। স্মরণীয় ১৯৩০-এর ১৮ই এপ্রিল এবং উহার পরবর্তী পবিত্র জালালাবাদ ও পরে কালারপুল, ফেনী, ঢাকা, কুমিল্লা, চন্দন নগর ও ধলঘাটের বীরোচিত কার্যসমূহই ভারতীয় মুক্তিকামী বিদ্রোহীদের মনে এক নূতন প্রেরণা জাগাইয়া তুলিয়াছে।
আমি এইরূপ গৌরবমণ্ডিত একটি সঙ্ঘের সদস্যা হইতে পারিয়া নিজেকে সৌভাগ্যবতী অনুভব করিতেছি।
আমরা দেশের মুক্তির জন্য এই সশস্ত্র যুদ্ধ করিতেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অংশ।
বৃটিশ জোরপুর্বক আমাদের স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইয়াছে। ভারতের কোটি কোটি নরনারীর রক্তশোষণ করিয়া তাহারা দেশে নিদারুণ দুর্দশার সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারাই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংসের এবং সকল অধঃপতনের একমাত্র কারণ। সুতরাং তাহারাই আমাদের একমাত্র অন্তরায়। যদিও মানুষের জীবন সংহার করা অন্যায়, তবু বাধ্য হইয়া বড় বড় সরকারী কর্মচারীর ও ইংরেজদের জীবন সংহার করিতে আমরা অস্ত্রধারণ করিয়াছি। মুক্তিপথের যে কোনো বাধা বা অন্তরায় যে কোনো উপায়ে দূর করার জন্য আমরা সংগ্রাম করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আমাদের দলের মহামান্য ও পূজনীয় নেতা মাস্টারদা অদ্যকার এই সশস্ত্র অভিযানে যোগ দিবার জন্য যখন আমাকে ডাক দিলেন, তখন আমি নিজেকে যথেষ্ট সৌভাগ্যবতঈ মনে করিয়াছিলাম। মনে হইল, এতদিনে আমার বহু প্রত্যাশিত অভীষ্ট সিদ্ধ হইল এবং সম্পুর্ণ দায়িত্ব লইয়া আমি এই কর্তব্যভার গ্রহণ করিলাম। এই উন্নত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্ব যখন আমার মত একটি মেয়েকে এই গুরুভার অর্পণ করেন, তখন এতগুলি কর্মঠ ও যোগ্যতর ভাইয়েরা বর্তমান থাকিতে অভিযানে নেতৃত্বের ব্যাপার একজন ভগিনীর উপর কেন ন্যস্ত হইবে, এই বলিয়া আমি আপত্তি জানাইলাম এবং একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে ঐ কাজে যাইতে চাহিলাম।
কিন্তু আমি পরে পূজ্য নেতার আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইলাম।
আমি মনে করি যে, আমি দেশবাসীর নিকট আমার কাজের কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যবশতঃ এখনও হয়ত আমার প্রিয় দেশবাসীর মধ্যে এমনও অনেকে আছেন, যাঁহারা বলিবেন যে – ভারতীয় নারীত্বের ঊর্ধ্বতন আদর্শে লালিত একটি নারী কি করিয়া নরহত্যার মত এই ভীষণ হিংস্র কাজে লিপ্ত হইল।
দেশের মুক্তি-সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না? ইতিহাসে অনেক উদাহরণ আছে, রাজপুত রমণীরা অসীম সাহসের সহিত রণাঙ্গনে যুদ্ধ করিতেন এবং স্বদেশের স্বাধীনতা ও নারীত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য তাহারা শত্রুর প্রাণ-সংহার করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করিতেন না। ইতিহাসের পৃষ্ঠা এইরূপ কত নারীর বীরত্বগাথায় পূর্ণ। তবে কেন আমরা, আজিকার ভারতীয় নারীরা বিদেশীর দাসত্বশৃংখল হইতে নিজের দেশকে পুনরুদ্ধার করিবার জন্য এই মহান যুদ্ধে যোগদান করিব না? যদি বোনেরা ভাইদের সঙ্গে কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে, তবে সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগদানে তাহাদের বাধা কি? সশস্ত্র বিদ্রোহে অন্য দেশের বহু নারী যোগদান করিয়াছে, তবে কেন ভারতীয় নারীরা বিপ্লবের এই পন্থাকে অন্যায় বলিয়া মনে করিবে?
নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন – এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।
(স্বাক্ষর) প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার
১২. প্রতিমা বিসর্জন
অপারেশনে মৃত্যু হতে পারে, এটা জেনেও সূর্য সেন প্রীতিলতাকে কমান্ডার করে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে পাঠিয়েছিলেন। এটাই কোনো নারী বিপ্লবীর প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ এবং কোনো নারী বিপ্লবীর প্রথম আত্মত্যাগ। প্রীতিলতার মৃত্যুতে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সূর্য সেনের? তাঁর আত্মাহুতির পনের দিন পরে লেখা সূর্য সেনের ডায়েরি থেকে জানতে পারা যায় এর কিছুটা। বিজয়ার দিনে তিনি লিখেছিলেনঃ
“পনের দিন আগে যে নিখুঁত পবিত্র প্রতিমাটিকে এক হাতে আয়ুধ, অন্য হাতে অমৃত দিয়ে বিসর্জন দিয়ে এসেছিলাম তার কথা আজ সব চেয়ে বেশি মনে পড়ছে। তার স্মৃতি আজ সবকে ছাপিয়ে উঠেছে। যাকে নিজ হাতে বীর সাজে সাজিয়ে সমরাঙ্গনে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ঝাঁপিয়ে প|ড়তে অনুমতি দিয়ে এসেছিলাম, তার স্মৃতি যে আজ পনের দিনের মধ্যে এক মুহুর্ত ভুলতে পারলাম না। সাজিয়ে দিয়ে যখন করুণভাবে বললাম, ‘তোকে এই শেষ সাজ সাজিয়ে দিলাম। তোর দাদাতো তোকে জীবনে আর কোনদিন সাজাবে না,’ তখন প্রতিমা একটু হেসেছিল। কি করুণ সে হাসিটুকু। কত আনন্দের, কত বিপদের, কত অভিমানের কথা তার মধ্যে ছিল।
সে তো নিজ হাতে অমৃত পান করে অমর হয়ে গেছে। কিন্তু মরণজগতে আমরা তার বিসর্জনের ব্যথা যে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আজ বিজয়ার দিনে, সেদিনের বিজয়ার করুণ স্মৃতি যে মর্মে মর্মে কান্নার সুর তুলেছে।“
প্রীতিলতা একবার নিজে ডায়েরিতে লিখেছিলেনঃ
“কোনপথে আমি জীবনকে ভাসিয়ে দিলাম? এই তো আমার টেবিলের সামনে রাধাকৃষ্ণের ছবি। এই প্রেম স্বর্গীয়। এমনভাবেই মাতৃভূমিকে আমাকে ভালবাসতে হবে। অন্য কোন প্রেম ভালবাসা আমার হৃদয়ে স্থান পাবে না। রাধার মতই আমার দেশপ্রেম আমি উজাড় করে দেব, নিজেকে নিঃশেষে আমি দান করে যাব।“
কথা রেখেছিলেন তিনি। নিজেকে সত্যি সত্যিই নিঃশেষে দান করে দিয়ে গিয়ে ছিলেন তিনি জন্মভূমির জন্য। একুশ বছর বয়সের একটা তরুণীর যখন কোনো তরুণের সাথে গভীর ভাব-ভালবাসা করার কথা, তখন তিনি সযত্নে সেই প্রলোভনকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। নিজের প্রতিটা মুহুর্ত তিনি ব্যয় করেছেন মাতৃভুমির কলংক মোচনের উদ্দেশ্যে। তিল তিল করে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন উৎসর্গ করার উদ্দেশ্যে। তাঁর আত্মাহুতি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, নয় কোনো দুর্ঘটনা। আত্মাহুতির জন্য নিজেকে ঘষে মেজে অনেক যত্নে তৈরি করেছেন তিনি। প্রীতিলতা নামের এক অসম সাহসী, অসীম দেশপ্রেমী তরুণীটির এই অসামান্য আত্মত্যাগ এবং অকাতর আত্মোৎসর্গকে বোঝার মত উপলব্ধি আমাদের আছে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমার।
১৩. আত্মাহুতির পরে
প্রীতিলতাকে সনাক্ত করার পরেই শুরু হয় পুলিশের বর্বরতা। প্রথমেই পুলিশ হামলা চালায় প্রীতির কাকার বাসায়। তিনি রেলওয়ে কারখানায় কাজ করতেন। রেল কোয়ার্টারে সপরিবারে থাকতেন। রাত্রেই তাঁর ঘরে খানাতল্লাসী করা হয়। তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের মারধর করা হয়। তাঁকে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে আসা হয় প্রীতিলতার মৃতদেহের কাছে। পরিচিতি নিশ্চিত করা হয় তাঁর সনাক্তকরণের মাধ্যমে। সেখানে উপস্থিত ইংরেজ কর্মচারীরা সবুট পদাঘাতে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেন।
প্রীতিলতাদের বাড়িতেও হামলে পড়ে পুলিশ। পুলিশের নির্যাতনের হাত থেকে শোকাতুর প্রীতির মাও রক্ষা পান নি। তাঁর ভাই-বোনদের উদ্দেশ্যে চলে পুলিশের অশ্লীল খিস্তিখেউর।
সারা শহরে চিরুনি অভিযান চালায় পুলিশ। বিপ্লবি সন্দেহে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক ছাত্র ও তরুণকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তথ্য সংগ্রহরের জন্য পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় তাঁদের উপরে।
প্রতিহিংসায় পাগল সরকার প্রীতিলতার পিতা ও কাকাকে সরকারী চাকুরি থেকে বহিষ্কার করে। প্রীতির বাবার বিষয়ে অবশ্য কিছুটা ভিন্নমত আছে। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মতে, প্রীতির আত্মাহুতির কারণে প্রীতির বাবা চাকুরি হারান। কিন্তু কল্পনা দত্তের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর বাবা চাকুরি হারিয়ে ছিলেন আরো আগে। প্রীতিই মূলত সংসার চালাতেন। কল্পনা দত্তের ভাস্যেঃ
প্রীতিলতার বি,এ পরীক্ষার ঠিক আগ দিয়ে তাঁর বাবা চাকরি হারায়। ফলে, তাঁর নিজস্ব আয় দিয়েই সংসার চালাতে হতো প্রীতিকে। একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতো প্রীতি, সেই সাথে কয়েকটি মেয়েকে বাড়িতে গিয়েও পড়িয়ে আসতো। এভাবেই সে বাবা-মা সহ চার চারটে ছোট ভাই-বোনের সংসারকে চালাতো।
প্রীতির আত্মাহুতিতে তার বাবা পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন। অসংলগ্ন আচরণ করতেন তিনি। মেয়ের অকাল মৃত্যুর এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারেন নি। গৃহ শিক্ষকতা করে অল্প কিছু আয় রোজগার করতেন তিনি। কিন্তু, মা ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া। বুক ফুলিয়ে আকাশচুম্বী অহংকারে তিনি বলতেন, আমার মেয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। শোককে শক্তিতে পরিণত করেছিলেন তিনি। বংশ আভিজাত্য ভুলে ঘরের বাইরে বের হয়ে এসেছিলেন এই গর্বিত মাতা। প্রীতির মৃত্যুর পরে সংসারের হাল ধরেন তিনি। ধাত্রী হিসাবে কাজ শুরু করেন চট্টগ্রাম শহরে।
১৪. লাল সালাম
বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী নারী, দেশের জন্য সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া প্রথম নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার, আপনার আত্মাহুতি দিবসে, আপনার জন্য রইল অফুরন্ত ভালবাসা।
নামেই শুধুমাত্র রানী নন, সত্যিকারেই আপনি চাটগাঁয়ের রানী, আমাদের নয়নের মণি।
লাল সালাম কমরেড কমান্ডার।
সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১। বীরকন্যা প্রীতিলতাঃ পূর্ণেন্দু দস্তিদার
২। Chittagong Armoury Raiders Reminiscences: Kalpana Dutt
৩। অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রামঃ অনন্ত সিংহ
__________________________________
শেষের কথামালা
নৈবেদ্য
আজ চব্বিশে সেপ্টেম্বর। এখন থেকে ঠিক একাশি বছর আগে বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী নারীটি মাতৃভূমির জন্য সম্মুখ লড়াই করে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। এই অসমসাহসিক, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অসামান্য দেশপ্রেমিক বিপ্লবীটির জন্য ,এই ভেতো এবং ভীতু বাঙালিটির তরফ থেকে রইল একবুক ভালবাসা।
যাঁর হবার কথা ছিল সমস্ত বাঙালি নারীদের আদর্শ এবং প্রেরণার উৎস, তিনি কী করে যেনো হারিয়ে গেছেন আমাদের জীবন থেকে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বাংলা পত্রিকা আর ইংরেজি পত্রিকায় এক ঝলক নজর বুলালাম। কোথাও প্রীতিলতার উল্লেখ দেখতে পেলাম না। কত আউল-ফাউল নারীর জন্মদিন-মৃত্যুদিন পালন করে চলেছে আমাদের পত্রিকাগুলো, আর চব্বিশ ক্যারটের খাঁটি সোনার ক্ষেত্রেই তাদের এই উদাসীনতা। আজব!
মৃত্যু দিবস
আমি সবসময়ই জেনে এসেছি যে, প্রীতিলতার মৃত্যুদিবস চব্বিশে সেপ্টেম্বর। উইকি ঘাটতে গিয়ে বিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখলাম যে, একাধিক জায়গায় ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দিন ও তাঁর মৃত্যুদিবস লেখা হয়েছে তেইশে সেপ্টেম্বর। উইকি কোথা থেকে এই দিন পেয়েছে জানি না।
প্রীতিলতার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন কল্পনা দত্ত। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে প্রীতির সাথে কল্পনাও সহযোদ্ধা হিসাবে থাকতেন, যদি না তিনি ধরা পড়তেন এই ঘটনা ঘটার এক সপ্তাহ আগে। সেই কল্পনা দত্ত তাঁর নিজের বইয়ে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দিনক্ষন কত ছিল তা জানাতে গিয়ে লিখেছেন,
24th September, 1932, was one such Saturday. The music, laughter and revelry came to a dead stop suddenly about 9 o’clock in the night.
আমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম যে, ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের চব্বিশ তারিখ সত্যি সত্যি শনিবার ছিল।
এ ছাড়া এই বইতে আরেক জায়গায় লিখেছেনঃ
On the morning of the 25th of September the D.I.B. Inspector came to see me. He started off at once, “God, we saved you in the nick of time!” A little later, another official came and said, “It is our great, good fortune to have saved a girl like you from death.” Whatwere they driving at? – the suspense made me crazy with impatience. The D.I.B Inspector came out with it finally. “Preeti died yesterday,” he said, “she raided pahartali club and then took potassium cyanide. Thank God, we arrested you – or you would have gone the same way. |Preeti was dressed exactly as you were.”
কল্পনা দত্তের বক্তব্যের পরে আর কোনো সন্দেহই থাকে না যে, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হয়েছিল চব্বিশ তারিখ রাতে এবং সেই রাতেই প্রীতিলতা আত্মাহুতি দেন।
পূর্ণেন্দু দস্তিদারও তাঁর বইতে কল্পনা দত্তের মতো একই কথা বলছেন।
“ওই সিদ্ধান্তের পরে কিছুদিনের মধ্যে আক্রমণের ব্যবস্থা নিখুঁত করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে সব কিছু নিজে তদারক করার উদ্দেশ্যে তিনি কাট্টলী গ্রামে চলে আসেন। তাঁর নির্দেশে প্রীতিলতাকেও গোপনে সেখানে আনানো হয়।
মাস্টারদা তাকে জানিয়ে দিলেন, ১৯৩২ – এর ২৪শে সেপ্তেম্বর রাত্রিতে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হবে এবং তার নেতৃত্বভার তাকেই গ্রহণ করতে হবে।“
নামহীন ছেলেটি
পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বইতে বার বার একটি ছেলের কথা উঠে এসেছে। এই ছেলেটি অসম্ভব স্নেহ করতো প্রীতিকে। ছেলেটি প্রীতির খুড়তুতো দাদা। তিনিই প্রীতির কাছে নিষিদ্ধ বইগুলো রাখতে দিয়েছিলেন, তিনিই প্রীতির বিষয় নিয়ে সূর্য সেনের সাথে মিটিং এ বসেছিলেন, প্রীতিকে সংগঠনের সদস্য করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাঁর বইয়ের কোথাও সেই ছেলেটির নাম উল্লেখ করেন নি। কিন্তু আমার ধারণা আমি তাঁর নাম জানি। এই ছেলেটি পূর্ণেন্দু দস্তিদার নিজেই। কারণ তাঁরা দুজনেই একই গ্রামের অধিবাসী। তিনি লিখেছেন,
“প্রীতিলতা আমার সহোদর বোনের মতো। তার জন্ম আমাদের গ্রামের বাড়িতেই। খুব অল্পবয়সে পিতৃহীন হয়ে প্রীতিলতার পিতা পার্শ্ববর্তী গ্রাম ডেঙ্গাপাড়া থেকে বিধবা মায়ের সঙ্গে তাঁর মাতুলালয়ে ধলঘাট গ্রামে আমাদের বাড়িতে আসেন। তাঁর মামা (আমার পিতামহ) তাঁর মা ও অন্য দুই ছট ভাইয়ের জন্য আমাদের গ্রামের ভদ্রাসনের এক অংশ বসবাসের জন্য ছেড়ে দেন। পরে ওই বাড়িতেই প্রীতিলতার জন্ম হয়।“
ব্যক্তিগত কথন
আমার ছেলের ডাক নাম অর্ক। আদর করে ডাকি অর্কবুড়া বলে। অবশ্য অতি আদরে বেশিরভাগ সময়ই অর্ক হারিয়ে গিয়ে শুধু বুড়া বা বুড়ুই হয়ে যায়। ওর অর্ক নামটা কাউকে বলার পরেই প্রথম যে কথাটা আমাদের শুনতে হয়, তা হচ্ছে ও আচ্ছা কালবেলার অনিমেষের পুত্র। ছেলের নাম অর্ক রাখার পিছনে কালবেলার আংশিক ভূমিকা আছে তবে পুরোটা নয়। ওর নাম অর্ক রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।
আমার ছেলের জন্ম চব্বিশে সেপ্টেম্বর, বীরকন্যা প্রীতিলতার মৃত্যু দিবসে। অর্ক মানে সূর্য। কিন্তু, আমার ছেলের নাম সৌরজগতের কেন্দ্রভূমিতে থাকা বহু দূরবর্তী সূর্য থেকে আসে নি, এসেছে আমাদের খুব কাছের মর্তভূমির একজন অসামান্য বীর, দেশের জন্য ভালবাসায় পরিপূর্ণ মানুষ সূর্য সেনের সূর্য থেকে। ছেলে না জন্মে ওইদিন যদি কন্যা সন্তান জন্মাতো, তবে আমরা নিশ্চিতভাবেই তার নাম রাখতাম প্রীতিলতা।
যাঁর নাম স্মরণ করে আমরা আমাদের সন্তানের নাম রেখেছি, সেই লোকটি ছিলেন অনন্য একজন মানুষ। শীর্নদেহী, খর্বকায়, অতি সাধারণ চেহারার এই অসাধারণ মানুষটি একদল অসামান্য দেশপ্রেমিক বিপ্লবী তৈরি করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে এই বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের মতো একটি ছোট এবং প্রান্তিক শহর থেকে ভারতবর্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিশ এবং তিরিশের দশকে চট্টগ্রাম যা করেছে, বিপ্লবের যে দাবানল জ্বালিয়েছে, তার ধারে কাছে যাবার মতো কোনো শহর ছিল না গোটা ভারতবর্ষে। ঊনিশশো তিরিশ সালে সশস্ত্র হামলা করে চারদিন নিজেদের করায়ত্বে রেখেছিলেন তাঁরা চট্টগ্রামকে। ইংরেজদের কোনো নিয়ন্ত্রণই তখন ছিল না চট্টগ্রামের উপর। ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীন হওয়া স্থানটির নাম চট্টগ্রাম, যদিও তা ছিল স্বল্পকালীন।
সেকারণেই ইংরেজদের ভয়ংকর আক্রোশ ছিল তাঁর প্রতি। ফাঁসি দেবার আগে জেলখানায় সমস্ত রীতি ভেঙে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয় তাঁকে। সাঁড়াশি দিয়ে তাঁর সমস্ত নখ তোলা হয়, হাতুড়ি দিয়ে দাঁত ভাঙা হয়, হাত –পা থেকে শুরু করে হাঁটু এবং অন্যান্য সব জয়েন্টের হাঁড় ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর অজ্ঞান অবস্থায় টেনে হিঁচড়ে তাঁকে নিয়ে গিয়ে তোলা হয় ফাঁসির মঞ্চে।
কত জানা এই ইতিহাস আবার জানলাম আর মনটা বিষাদে ভরে গেলো। ধন্যবাদ আপনাকে ঘুমিয়ে থাকা ইতিহাসটাকে এভাবে জাগিয়ে তোলার জন্য। আমি চাটগাঁর সেই সুবাদেও আপনাকে সাধুবাদ জানাই এ লেখার জন্য আরো একবার।
আমার পড়া পাঁচ মিনিট আগেই হয়েছে… চোখ অনেকক্ষণ ঝাপসা ছিল, কিন্তু পানি গড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি, তার আগেই শুকিয়ে গেছে! কি অদ্ভুত সুন্দর জীবন, কি অদ্ভুত গৌরবের মৃত্যু!
ফরিদ ভাই,
অনেকদিন পরে শিহরণ জাগা লেখাটা পড়ে স্তম্ভিত রিতিমতো। শেয়ার করার লোভ সম্বরণ সম্ভব নয় অতএব……
@ফরিদ ভাই,
প্রথমে ধন্যবাদ জানাই আপনাকে বীরকন্যা প্রীতিলতাকে নিয়ে
অসাধারণ একটা লেখার জন্য ।
আমি জানি না মাস্টারদা সূর্যসেনকে নিয়ে আপনার কোনো লেখা আছে কি না।
তাই লিখে না থাকলে ভবিষ্যতে মাস্টার দাকে নিয়ে লেখার অনুরোধ রইলো।
আমার মনে হয়, আপনি মাস্টার দাকে নিয়ে লিখলে তা এই লেখার মতই হৃদয় ছুয়ে যাবে। 🙂
লেখার শেষ অংশে আপনি বলেছেন,
“উইকি ঘাটতে গিয়ে বিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখলাম যে, একাধিক জায়গায় ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দিন ও তাঁর মৃত্যুদিবস লেখা হয়েছে তেইশে সেপ্টেম্বর। উইকি কোথা থেকে এই দিন পেয়েছে জানি না।”
উইকি ঘেটে আমি যা দেখলাম তাতে উইকির এ ভুল করা ছাড়া উপায় বোধ হয় ছিল না।
কারণ উইকিতে যে সমস্ত স্মৃতি ফলক পাওয়া যায় তাতে ২৩ সেপ্টেম্বরকেই প্রীতিলতার আত্মাহুতি তারিখ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব স্মৃতিফলক নিশ্চই উইকি বানায় নি ।
টেররিজম বিষয়টি এখনও সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য কেন ধাঁধা এটা বোঝা যায় 😕
@সংবাদিকা,
নিক্তির ঠিক মাঝখানে বসতে পারলে, এটা আর ধাঁধাঁ থাকতো না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে সবাই-ই কোনো না কোনো পাল্লায় বসে আছে।
@ফরিদ আহমেদ,
কি আশ্চর্য, এইটা সমস্যা হবে কেন? পরিস্কার অবস্থানই তো বরং ভালো। ৭১ এ আমাদের চোখে আমরা স্বাধীনতাকামী আর মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে পাকি এবং পাকিপ্রেমীদের চোখে সেই একই আমরা আবার বিধর্মী এবং সন্ত্রাসী। সংবাদিকা যেমন কোট করেছে; One man’s terrorist is another man’s freedom fighter. আবার মুক্তমনার প্রতিকী ভাস্কর্য্য অগাস্তে রোদিনের ভাবুক বসে ভাবে; সংবাদিকার সেই একই ভাবুক উল্টে ভাবে!
@কাজী রহমান,
সমস্যা আমার বা আপনার জন্য নয়। আমরা ঘোষিত জাতীয়তাবাদী। পরিষ্কার একটা অবস্থান আছে আমাদের, যদিও তা নিরপেক্ষ নয়, আবেগ রসে সিক্ত। আবার নিরপেক্ষ নয় বলে আমরা লজ্জিতও না (খুব খারাপ 🙁 )। কিন্তু মনে করুন কেউ একজন জাতীয়তাবাদকে অনেক নীচুস্তরের আবেগ বলে মনে করে, লজ্জাকর অনুভূতি বলে বিবেচনা করে। নিরপেক্ষ অবস্থানকে মনে করে বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চ অবস্থান। তাঁর কী দশা হবে? :-s তাঁর চোখেতো পাকিস্তান আর্মি এবং মুক্তিযোদ্ধা দুই পক্ষই সমান দোষে দুষ্ট হয়ে যাবে। ধর্ষক যেমন দায়ী ধর্ষণের জন্য, তেমনি ধর্ষিতাও দায়ী ধর্ষণের সময় নীরব সম্মতি বাদ দিয়ে বাধা দিতে গিয়ে ধর্ষকের চোখে মুখে আঁচড় কাটার জন্য। যদিও নিন্দুকেরা বলবে যে, আসলে পাকিস্তান প্রেমিক এই লোক, কিন্তু মুখে সেটা স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই নিরপেক্ষতার ভাণ ধরেছে।
এটাই আমার মূল পয়েন্ট। সত্যিকারের নিরপেক্ষ বলে কেউ নেই। যাঁরা নিরপেক্ষতার অভিনয় করেন তাঁরা মূলত সুচতুরভাবে ক্রিয়ার পক্ষ নেন, প্রতিক্রিয়াকে সমদোষে দুষ্ট প্রমাণ করার`চেষ্টার মাধ্যমে।
@ফরিদ আহমেদ,
:))
@সংবাদিকা,
হা হা হা!!! দারুণ!!! অনেক দিন পর মুক্তমনায় রিয়েল উইট পেলাম। আমি, আপনি আর খালেদা জিয়া এক কাতারে। :))
শতভাগ সহমত। বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর চিন্তার অধিকারী হওয়া যায়, কিন্তু শতভাগ মুক্তচিন্তার অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। কোথাও না কোথাও সমাজের লাগামটা ঠিকই থেকে যায়।
অবশেষে পুরো লেখা এক সাথে শেষ করে উঠতে পারলাম। ফরিদ ভাই এর এইসব লেখা শুধু ইতিহাসের পাঠ না, সুসাহিত্যেরও সুপটু কাজ থাকে বলে অতি সুখপাঠ্য হয়। প্রীতিলতাকে নিয়ে বাংলা ব্লগে মনে হয় না এমন লেখা আগে আর লেখা হয়েছে বলে।
চট্টগ্রামের আশকার দীঘির কাছাকাছি এক যায়গাতেই আমার বাল্যকালের প্রথম অংশ কাটে, সেখানে কারো মুখে কোনদিন মাষ্টার দা/প্রীতিলতা এদের কারো কথা শুনিনি। সেই অস্ত্রাগার বা সার্কিট হাউজের উলটো দিকের আলমাস সিনেমায় কত সিনেমা ছোটবেলায় দেখেছি। পরে মনে হয়েছে যে সেই ইউরোপিয়ান ক্লাব সম্ভবত এখনকার পাহাড়তলীর কোন এলাকা হবে।
ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকের বিপ্লবী দলগুলি মোটামুটি শতভাগ হিন্দু নামধারীদের দখলে থাকলেও তার আগে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের ভূমিকা আছে। বলা যায় প্রথম সুসংঘবদ্ধভাবে ব্রিটিশের চ্যালা চামুন্ডা ধনীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন মুসলমান হাজি শরিয়তউল্লাহ। এরপর তীতুমীর তো আছেই। সিপাহী বিদ্রোহকেও ততকালীন মুসলমান আলেমগন জিহাদ অভিহিত করেছিলেন। তার নির্মম মূল্যও তাদের দিতে হয়েছে।
অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর সমিতি এসব বিপ্লবী সংগঠনে হিন্দু মৌলবাদের ছাপ (আমার মনে হয়েছে আসলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ) আছে বলে জানা যায়। কেউ কেউ বলে সে কারনেই নাকি এসব বিপ্লবী দলে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ফরিদ ভাই এ তত্ব সম্পর্কে কি বলেন?
ওপরে সফিকের বলা পয়েন্টটা আমাকেও বেশ ভাবায়। ওর উদাহরনটা হয়ত সেভাবে জুতসই হয়নি তবে অন্য উদাহরন দিলে হয়ত বোঝা যেতে পারে। যেমন সিপাহী বিদ্রোহ আমাদের উপমহাদেশীয় চোখে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে জাষ্টিফাইড এক্ট। ইংরেজী কি নৃশংস ভাবে যে বিদ্রোহ দমন করেছিল, সিপাহীদের মাইলের পর মাইল ফাঁসী দিয়ে পাবলিক ডিসপ্লে করেছিল সকলেই জানি। অন্যদিকের চিত্র বলে যে সে সময় তার আগে সিপাহীদের হাতে বহু ম্যাসাকার হয়েছে। কিছু যায়গায় নিরীহ ইংরেজ নারী শিশুও রীতিমত গনহত্যার শিকার হয়েছে। এখন এই ঘটনাকে ঠিক কিভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে? আমার কাছে বড়ই জটিল প্রশ্ন।
একই লাইনে আজকের দিনেও আল কায়েদা ফায়দার সন্ত্রাসকেও অনেকে হালাল করার চেষ্টা করে। আরো উঁচু স্তরের বুদ্ধিজীবি যেমন বিশিষ্ট কলামিষ্ট, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ফরহাদ মাজহার বাংলা বাহিনীর কার্যক্রমকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তূলনা করেছিলেন।
@আদিল মাহমুদ,
কে কি করলো তাতে কিছু আসে যায় না। কোনটা সন্ত্রাসবাদ আর কোনটা মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার সংগ্রাম, সেটা বুঝতে খুব বেশি বেগ পাওয়ার কথা নয়।
@ফরিদ আহমেদ,
হুমমম উত্তর সঠিক হয়েছে, ১০ নম্বর দেওয়া গেলো (D)
অনেক বড় লেখা। তাই দুবারে পড়তে হয়েছে। তবে পয়সা উসুল।
আমাদের দুঃসাহসী বীরদের কেন আমরা নিত্য স্মরণ করি না? কেন এঁরা হারিয়ে যান ইতিহাসের পৃষ্ঠার নিচে? অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
@তামান্না ঝুমু,
সপ্তকের ভয়ে বড় করে লিখেছি। আগের লেখাটা ছোট ছিল বলে কঠিন ঝাড়ি দিয়েছিলেন ভদ্রলোক আমাকে। 😛
কাকে পয়সা দিলেন এই লেখা পড়তে? আমি কিন্তু কিছুই পাই নি। 🙁
@ফরিদ আহমেদ,
সপ্তক যে ভদ্রলোক এইটা বুঝা যাইবো ক্যামনে? ভদ্র ……. হইলে দোষ কি?
@কাজী রহমান,
ঝাড়ি দেওয়া দেইখা। ভদ্রলোকেরা সামনাসামনি ঝাড়ে আর অভদ্রলোকেরা পিছন থেকে ঝেড়ে দেয়।
দোষ কী জানি না। তবে মার খাওয়া লাগে, এইটা জানি। বাইরের মানুষের কাছে প্রথম মার খেয়েছিলাম ষোল বছর বয়সে। সেটা ভদ্র হবার অপরাধে। “শালা ভদ্রতা মারাস”, এই বলে আমার বাম পাজর বরাবর আধমণি ঘুষি বসিয়ে দিয়েছিল শাহজাহানপুরের এক পাতি মাস্তান। কিশোর বয়সের ওই অপ্রত্যাশিত, অপমানজনক, অপ্রীতিকর এবং অমধুর অভিজ্ঞতাটি জীবনে অনেক কাজে লেগেছে আমার। 🙂
@ফরিদ আহমেদ,
লেখার লেখক মানে আপনাকেই তো দিয়েছিলাম। আপনি পাননি? হায় হায় পয়সা তবে গেল কই? :-s :-s
@তামান্না ঝুমু,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনার উপায় কী? খাজনা দিতে গিয়ে দয়াল কাজী মেরে দিয়েছে মনে হচ্ছে। :))
@ফরিদ আহমেদ,
ওহ আচ্ছা, যত দোষ নন্দঘোষ না?
@ফরিদ আহমেদ,
অর্থ আত্মসাতের অপরাধে দয়াল কাজীর বিচার চাই।
@তামান্না ঝুমু,
হ। মামুন কাজির এজলাশে দয়াল কাজীর বিচার হোক।
ইতিহাস জানা এবং উপলব্ধি করা ছাড়া আত্নপরিচয় নির্মাণ অসম্ভব। আর এই নির্মাণ ছাড়া কোন জাতি বিশ্ব দরবারে জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাড়াতে পারে না । আমাদের বর্তমান প্রজন্মের খুব কম ছেলে মেয়েই দেশের ইতিহাস এবং বাঙালি হয়ে ওঠার ইতিহাস জানে। আর যে জাতি নিজেদের ইতিহাস যত কম জানে ঠিক সেই জাতি ততটাই বিভ্রান্ত। যেই কারনে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪২ বছর পরও ৭১ এর যুদ্ধে মানবতা বিরোধী বিচার নিয়ে জাতি বিভক্ত যা পৃথিবীতে বিরল ঘটনা।
আপনার এই লেখা থেকে নতুন অনেক কিছু জানলাম। এই লেখাটার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ
@লিটন বড়ুয়া,
চমৎকার বলেছেন। আমাদের সব বিভ্রান্তি আসলে সঠিক ইতিহাস না জানার কারণেই এসেছে। আমি সবসময় একটা উদাহরণ দেই। তা হচ্ছে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়। আমরা এমনভাবে এই ইতিহাসকে পড়ি যেন বখতিয়ার খিলজি ছিল আমাদের লোক, তার সাথে সাথে আমরাও বঙ্গ বিজয় করেছিলাম। ঘটনাটা যে উলটো, আমরা আসলে বিজিত হয়েছিলাম ভিনদেশি এক ডাকাতের হাতে, সেটা কিন্তু উপলব্ধি করি না।
ফরিদ ভাই, আপনাকে ধন্যবাদ প্রীতিলতা, সুর্যসেন এবং বিপ্লব ও বিপ্লবীদের কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। এঁদের কাহিনি এমন জোরালোভাবে আমাদের আর কেউ বলেনি। চট্টগ্রামের যে সমস্ত জায়গার কথা আপনি উল্লেখ করেছেন তার সবখানেই আমি গিয়েছি – কিন্তু প্রীতিলতাদের কথা আজকাল আর কেউ বলেন না। এক সময়ের বীর চট্টলা এখন জামায়াত শিবির আর তেঁতুল হুজুরদের অভয়ারণ্য। ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রীতিলতা হল হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামে আর কোথাও এঁদের সম্মান জানানো হয় না এখন।
সূর্যসেনের নামে আপনাদের ছেলের নাম রেখেছেন – আপনাদের বিপ্লবী স্যালুট। ক’জন পারে এমন?
@প্রদীপ দেব,
আপনারা যাঁরা চাটগাঁর লোক, তাঁদেরকেই এই সব ইতিহাস তুলে ধরতে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। যে শহরে একসময় এইসব মৃত্যুঞ্জয়ী বীর জন্মেছে শয়ে শয়ে, সেই শহর মৌলবাদীদের আখড়া হয় কীভাবে?
যে ছেলের জন্ম প্রীতিলতার মৃত্যুদিবসে, তার নামতো সূর্য সেনের নামেই হবে, নাকি?
একটা অপ্রিয় প্রসংগ, ব্রিটিশদের অফিসার্স ক্লাবে রাতের বেলায় নারী-পুরুষের উপরে বিপ্লবীদের হামলার সাথে আজকের ভারতে কাশ্মীরের বিদ্রোহীরা সিভিলিয়ানদের উপরে হামলা করার মধ্যে কতটা পার্থক্য করা যায়?
@সফিক,
“একটা অপ্রিয় প্রসংগ”, এই শব্দগুচ্ছ না থাকলে আপনার প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে বেশ বেগই পেতে হতো আমাকে। কিছুটা হলেও এখন আন্দাজ করতে পারছি যে, আপনার চিন্তাধারাটা ঠিক কোনদিকে বইছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়ে আমার আগ্রহ প্রায় শূন্যের কোঠায়। আমার পড়াশোনার পরিধিও সীমিত। সে কারণে কাশ্মিরে ঠিক কী ঘটেছে বা ঘটছে, সেই সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণাই নেই। আপনার কথা থেকে বুঝতে পারছি যে, সেখানে বিদ্রোহীরা সিভিলিয়ানদের উপরে হামলা চালাচ্ছে। এর সঙ্গে ১৯৩২ সালের ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পার্থক্য খোঁজার যুক্তিটা বুঝতে পারলাম না। দুটো সম্পুর্ণ ভিন্ন ঘটনা, ভিন্ন সময়ে ঘটেছে, এবং নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন পরিস্থিতিতে ঘটেছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে আপেল আর কমলার তুলনা করা। এখানেও সেরকমই ঘটছে।
ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের সাথে কোনো ঘটনার মিল-অমিল খুঁজতে চাইলে আমাদের ১৯৩২ এর আগে যেতে হবে। সেই সময়কার কোনো ঘটনার সাথে তুলনা করতে হবে। আরো পরিষ্কার করে বললে ১৭৫৭ থেকে ১৯৩২, এই টাইমফ্রেমকে বেছে নিতে হবে। এই সময়ে দুটো বিবাদমান পক্ষ রয়েছে। একটি আমরা বা আমাদের পূর্বপুরুষেরা, যাদের মাতৃভূমি হচ্ছে ভারতবর্ষ। অন্য পক্ষটি হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা, যারা বাহুশক্তির বলে দখল করে নিয়েছে আমাদের মাতৃভূমি। অপ্রিয় প্রসংগের বদলে প্রিয় প্রসঙ্গ হবে, এই পক্ষ দুটোর মধ্যে কে কত বেশি পরিমানে সিভিলিয়ানদের উপর হামলা করেছে সেই হিসাব বের করে এদের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু আছে তা নিরূপণ করা।
ইউরোপিয়ান ক্লাবে যারা সেইদিন রাতে ছিল, তাদেরকে ঠিক সিভিলিয়ানের পর্যায়ে ফেলা যায় কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমার। এরা সকলেই ছিল সাম্রাজ্যবাদী সরকারের কর্মকর্তা। এদের মাধ্যমেই নিপীড়নমূলক কার্যকলাপ, শাসন-শোষণ চালাতো সরকার। যদি ভেবে থাকেন যে এরা নিরস্ত্র ছিল, তাহলেও ভুল করছেন। সেই সময় সাদা চামড়ার কর্মকর্তাদের অস্ত্র রাখার অনুমতি দিয়ে রেখেছিল সরকার। এদের স্ত্রীরা হয়তো নিরস্ত্র ছিল, কিন্তু পুরুষেরা মোটেও নিরস্ত্র ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ক্লাব থেকে পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া ইংরেজ যুবকের মাধ্যমে। এই যুবক তার কাছে রাখা অস্ত্র দিয়ে প্রীতিলতাকে আহত করেছিল। এর বাইরেও ক্লাব পাহারা দেবার জন্য সশস্ত্র পুলিশ ছিল সেখানে। যুদ্ধটা একপেশে হয় নি, এক তরফা কিছু নিরপরাধ এবং নিরীহ মানুষকেও মেরে ফেলা হয় নি।
শাহজাদির বদলে রানী পাইলাম তাই রে নাই রে না……এও মন্দ না।
বাসায় গিয়ে সময় নিয়ে পুরোটা পড়তে হবে। আমি একটা বইতে পড়েছিলাম মাষ্টারদাকে হত্যার পর লাশ সাগরে ফেলার আগে এক ইংরেজ পুলিশ আক্রোশে লাশের মুখে লাথি মেরে দাঁত ভেংগে দেয়।
পড়তে গিয়ে গা শিউরে উঠেছে বারবার। প্রীতিলতা তোমায় স্যালুট! সুকান্তের লাইনগুলো মনে আসছে:
” ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়,
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে,
গুলি বন্দুক বোমার আগুনে
আজও রোমাঞ্চকর!!”
@অভি,
লেখাটা পড়া এবং মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। (F)
ইতিহাস কইতে জানে ফরিদ। শুনাতেও জানে। জানা কথা কিভাবে নতুন করে জানাতে হয় সে কৌশল ফরিদের আয়ত্ব। পড়তে পড়তে উপন্যাসের ক্যানভাসে ঢুকে গিয়েছিলাম। এটাকে তো উপন্যাসেও রূপ দেয়া যায়। যায় না?
@গীতা দাস,
যায়তো অবশ্যই। তবে আমাকে দিয়ে হবে না। উপন্যাস লেখার সামর্থ এবং যোগ্যতা কোনোটাই নেই আমার।
ফরিদ ভাই,
অনন্য একটি লেখা! এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। কখনো চোখের কোন ভিজে উঠলো কখনো নিজের প্রতি হলো করুণা, কখনো আজকের তরুণদের কথা মনেপরে ব্যথিত হলো মন। আমাদের অতীতেও এমন আলো ছিলো তাহলে? আপনার কলমের ডগার হীরকের মতো অক্ষর গুলো যদি আমাদের আবার জাগিয়ে তুলে….. সেই আশায় শেয়ার করলাম অন্যত্র!
@কেশব অধিকারী,
অন্ধকারের পাশাপাশি আলো-ও ছিল অনেক। আমাদেরকে আঁধারটা দেখানো হয় ঘটা করে, আর আলোর রেখাগুলোকে ঢেকে রাখা হয় খুব সযত্নে।
কুইনাইন দিয়েছে ফরিদ আহমেদ। আবার সেই টেকনিক। সফল এবং উত্তেজনায় ভরপুর। আমাদের মাটিতে যে সব উজ্জল বীরকথা রয়েছে, সেগুলোর অনেকগুলি ফরিদ আহমেদের কলম থেকে কুইনাইন হয়ে বের হোক; আমাদের ম্যালেরিয়া জ্বর হয়েছে।
@কাজী রহমান,
জ্বর কি সারছে কবি? নাকি কুইনাইনের ডাবল ডোজ দিমু? 🙂
@ফরিদ আহমেদ,
প্রো-বায়োটিক লাগব। অঘা ডাক্তারগুলি এন্টি বায়োটিক দিয়া সর্বনাশ করছে। পুপ থেরাপী ছাড়া উপায় নাই।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দারকে নিয়ে সেই ছোটবেলা থেকে নানা লেখা পড়েছি। ফরিদ ভাই এর এই লেখাটি তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ফরিদ ভাই এর ইতিহাসের শিক্ষক হওয়া উচিত ছিল। আপনি বাংলার গৌরব্বোজ্জল ইতিহাস আরো লিখুন ফরিদ ভাই। নেটিজেনরা জানুক মানুষ কিভাবে দেশের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের অনেক ওপরে রেখে কাজ করে যেতে পারে। এইসব বিশুদ্ধ প্রাণ, দিশাহীন সবুজের অক্সিজেন। আমরা আবদ্ধ আজ শহরের দূষিত বায়ুতে- নেই বিশুদ্ধ প্রাণ কোথাও। এক সময় মনে হয়, এরা কি সত্যই রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন। নিজেকে উনাদের জায়গায় বসাতে গেলে ভয় হয়-কত সাহস আর প্রেরণা থাকলে মানুষ দেশের জন্য এত ত্যাগ করতে পারে! আর আমরা? ভাল জীবনের জন্য আগেই দেশত্যাগ করে বসে আছি :-s দেশের জন্য আর ত্যাগ করবো কি? 🙁
@বিপ্লব পাল,
সেই ভাল জীবনটা কী আসলেই পাওয়া যায় বিদেশে? যায় না মনে হয়। ভাল থাকার ভাণটাই করে যেতে হয় সারাজীবন। এই ভাণ শুধু অন্যের সাথেই করা হয় না, নিজের সাথেও করা হয়। 🙁
অসীম সাহসী বাঙালী নারী “প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার” এর মৃত্যু দিবসে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা এবং লাল সালাম।
এটাই আমদের দেশের সাংবাদিকতার আসল রূপ। আলতু-ফালতু খবরে টিভি/প্রিন্ট মিডিয়ার ইন্টারেস্ট বেশী।
@তারিক,
একমত। একপাল গর্দভ এখন মিডিয়ারাজ্যে বিচরণ করে চলেছে।
গল্পনির্ভর ইতিহাস লিখনে ফরিদ ভাই অপ্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠছেন। থ্রিলার গল্পগুলোর মত শুরুই হল শ্বাসরুদ্ধকর একটি দৃশ্য দিয়ে…..শোকে ম্যুহমান পাঠকের সামনে এরপর ভেসে উঠে প্রীতির এক একটি চাপ্টার, আটপৌরে বাঙ্গালির মত, কিন্তু তবু কত আলাদা!
অথচ সেই চট্রগ্রাম আজ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে…
নাটোরের রানীর কাহিনিটি ঠিক জানি না, ফরিদ ভাই।
সেই স্কুলগুলো আজও আছে? কৌতূলের কারণঃ সে আমলে মেয়েদের স্কুল খুব বিরল ছিল, তাই নিশ্চয়ই স্কুলগুলো খুব প্রসিদ্ধ স্কুল হওয়ার কথা।
চমৎকার লেখাটির জন্য ধন্যবাদ, ফরিদ ভাই!
@কাজি মামুন,
প্রায় একই রকম কথা বলতে চেয়েছিলাম। যা হোক আরেকটু যোগ করি। কোন মুসলমান নাম দেখলাম না। এটাই কি ইতিহাস নাকি সে সময় যারা ইতিহাস লিখেছে তারা পক্ষপাতিত্ব করেছে। এবং এ সময়ে এ সব গৌরবগাথা নিয়ে কোন উচ্যবাচ্যও নেই। এটা কি নীচতা নাকি অন্য কিছু? এই সেদিনের ইতিহাস, এই সেদিনের দেশপ্রেম, এই সেদিনের আত্মত্যাগ, আত্মাহুতি; কোন উচ্যবাচ্য নেই। আহ ।
@কাজী রহমান,
না, এটাই ইতিহাস। কেউ পক্ষপাত করে নি। এই অগ্নিযুগে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। পাশাচাত্য শিক্ষার কারণে বাংলায় যে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল, তার হাত ধরেই হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজে জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটে। মুসলমানরা এই চেতনা বহির্ভুত ছিল। ইংরেজ আসার আগে ভারতবর্ষ শাসন করেছে মুসলমানরা। এই অভিমান তারা ভুলতে পারে নি। ফলে, ইংরেজি শিক্ষা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে অভিমানে। এর ফলশ্রুতিতে হিন্দুদের কাছ থেকে যোজন যোজন পিছনে পড়ে গেছে তারা, শিক্ষা এবং এবং আধুনিক চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতায়। জাতীয়তাবাদের মত আধুনিক আবেগ তাদের স্পর্শ করে নি। ফলে, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ ছিল মোটামুটি শূন্যের কোঠায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু তরুণেরাই মূলত এই আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে, আর মুসলমানেরা নিষ্ক্রিয় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখেছে শুধু।
তবে, আগুনের এই আঁচ যে সামান্য হলেও লাগে নি, সেটা বলা অবশ্য অন্যায় হবে।
জালালাবাদ যুদ্ধে আহত বিপ্লবী নেতা অম্বিকা চক্রবর্তীকে আহত অবস্থায় একজন মুসলমান কৃষক কাঁধে করে নিয়ে যায়। আমজাদ আলী নামের একজন কৃষক তাঁকে ঐ যুদ্ধে আহত জেনেও আশ্রয় দেয়। সেখান থেকে পরে এক মুসলমান মহিলার বাড়িতে আশ্রয় নেন অম্বিকা চক্রবর্তী। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই লিখেছেনঃ
একটি মুসলিম মায়ের কথা এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে। ফতেয়াবাদের বড় দীঘির পাড়ে বৃদ্ধা বিধবা ফয়েজুন্নেসার বাড়িতে আমি দুই দিন দুই রাত্রি ছিলাম। তখন তাঁর ১৭/১৮ বছরের ছেলে ফজল আহমদ জালালাবাদ পাহাড়ে একটি ওয়েলবি রিভলবার কুড়িয়ে পায় ও এবং আমাকে তা এনে দেয়। তার জন্য কিছু দাম বা পুরস্কার আমি ঐ ফয়েজুন্নেসা বিবিকে দিতে গেলে, তিনি বলেন, এইটি দিয়ে একটা সাহেব (ইংরেজ) মারলে আমি বেশী খুশি হব।
অনন্ত সিংহকে বিপ্লবের জন্য অনেকগুলো অস্ত্র সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন তাঁর জাহাজী বন্ধু ইয়াকুফ। অনন্ত সিংহের ভাষ্যেঃ
“আর একজন জাহাজী মুসলমান বন্ধু – নাম তার ইয়াকুফ। খুব চতুর ও স্মার্ট। চলনে বলনে পোষাকে খুব কেতা দুরস্ত। ইনিই আমাদের সবচেয়ে বেশি অস্ত্র দিয়েছেন। এক একবার একভাবে delivery দিয়েছেন। একবার ঠিক সময়ে একটা খুব বড় প্রাইভেট গাড়ি এসে নির্ধারিত স্থানে থামল। আমি ও অনুকূলদা পাঁচ মিনিট আগে থেকে দাড়িয়েছিলাম। গাড়িটি থামার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াকুফ ও আরেকজন খুব জাদরেল লোক গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। ঈংগিতে দেখিয়ে গেলেন পেছনের seat এর পা রাখবার জায়গায় একটা পোঁটলা আছে। তাঁরাও চলে গেলেন আর অনুকূলদা পোঁটলাটা সরিয়ে নিলেন। গাড়ি পূর্ণ বেগে মোড় ঘুরে উধাও।“
এ ছাড়া রজ্জক খাঁ নাম একজনও অস্ত্র সরবরাহ করতেন বলে অনন্ত সিংহ উল্লেখ করেছেন।
এতো শুধু সাহায্য। তাঁদের সংগঠনে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত একজন কান্তিময় মুসলমান বালকের কথাও জানা যায়। তার নাম দলিলর রহমান। সূর্য সেনের সরাসরি ছাত্র ছিল সে। রেলওয়ের কর্মচারীদের বেতনের যে টাকা ডাকাতি করা হয়েছিল তার একটা অংশ কোলকাতায় পৌঁছে দিয়েছিল এই ছেলেটি। অনন্ত সিংহ এ বিষয়ে লিখেছেনঃ
“দু’টি ভাগে টাকা নিয়ে কলকাতা পর্যন্ত যাবার দায়িত্ব দিতে হবে দুটি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য সভ্যের উপর। আবার তার উপর পুলিশের নজর থাকলে চলবে না। ঠিক হল এক টাকা ও পাঁচ টাকা নোটের তাড়াগুলি একটা সুটকেশে ভরে নিয়ে যাবে অম্বিকাদা। আর দশ টাকার নোটের তাড়া যাবে দলিলর রহমান নামে দলের একজন খুব বিশ্বাসী সভ্যের সঙ্গে।”
@ফরিদ আহমেদ,
বিশাল উত্তরখানার জন্য অনেক ধন্যবাদ ফরিদ আহমেদ।
আমার মনে হয় গবেষনায় আর সেই নির্ভর লেখা পরিমার্জন, পরিশোধন, পরিশীলন, পরিবর্ধন, পরিশোধন ইত্যাদির জন্য উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন যাতে সেগুলো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হতে থাকে (C)
@কাজী রহমান,
– কিছু মনে করবেন না, আপনার কথাগুলি প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেল; যদিও হাসির লক্ষ্য আপনি নন।
এখানে আলোচিত বিপ্লবী মাষ্টারদার পৈত্রিক সম্পত্তি ‘৭৬ সালে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার অসাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে জোর পুর্বক অধিগ্রহন করে নিয়েছে। এই আইনের আওতায় একই কায়দায় গিলে ফেলা হয়েছে ব্রিটিশ আন্দোলনের আরো ক’জন নেতা যেমন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, ৩৪ বছর ব্রিটিশের জেলখাটা রবি নিয়োগীর সম্পত্তিও।
এই তালিকায় আরো আছেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে প্রথম বাংলা ভাষার দাবী তোলা জনদরদী নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সদা হাস্যময় অমায়িক শহীদ জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা সহ আরো অনেকে।
সরকারী খাতায় এরা সকলে দেশের শত্রু। শত্রু চিহ্নিত করনের উপায় হল নাম।
বাংলাদেশে সাম্প্র্দায়িক সমস্যা আছে শুনলেই অনেকে কেন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে তা বোঝা খুব কঠিন নয়।
এ নিয়ে আরেক ব্লগে একটি লেখা দিয়েছিলাম, পড়তে পারেন।
@আদিল মাহমুদ,
ঘৃণ্য এনিমি প্রপার্টি বা শত্রু সম্পত্তি ব্যাপারটা কিন্তু পুরনো। ৭৬’এ সেটা নতুন দাপটে এসেছে।
পুরনো ঢাকাসহ দেশে অনেক হিন্দু সম্পত্তি দীর্ঘ সময় ধরে দখল বেদখল হয়েছে আর ইচ্ছেমত লিজও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়, এই বাংলায় ছলে বলে কৌশলে হিন্দু খেদাও আর ওদের সম্পত্তি দখল করো মানসিকতা কিন্তু ৪৩ ৪৬ ৭৬ পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালীই হয়েছে। এখন তো ওদের অবদান রীতিমত অস্বীকার করার পর্যায়েই এসে গেছে।
আশালতা সেনের মহিলা সমিতি কর্যক্রম জন্ম থেকেই দেখেছি। বাসন্তী গুহ ঠাকুরতাকে সাথে নিয়ে তার স্কুলের বাইরের বিভিন্ন সংগঠনে তার সাথে একসাথে কাজ করবার সুযোগ পেয়েছি। পুরনো ঢাকার অনেক অনেক সমাজকর্মে সহায়তা চাইবার সময় হিন্দু নামগুলো তালিকার শীর্ষেই থাকত। এখন নামগুলো খারিজ হয়ে গেছে। এই সেদিনের কথা। যারা বিদ্যা শিক্ষায় সমাজ কর্মে মানবতায় শত শত বছর ধরে অবদান রেখেছে, তাদের নাম ডিসমিস হয়ে গেছে। নামেরও ধর্মান্তর ঘটেছে। ক্ষমতাবানেরা রাতকে দিন করে, আপন স্বার্থে, এমনই ঘটে। ভায়া, এমনি ঘটে।
===============
অনেককাল আগে।
যখন কিছুই শেখেনি মানুষ; ভাবনা ছাড়া,
দিনরাত ধরে,
পশুর মতই গিলেছে বনবাদাড়ের ঐ যাচ্ছেতাই।
মরতে মরতে;
একসাথে হওয়া কাকে বলে জানলো; বাঁচতে।
বেঁচে দেখলো,
কিছু দাঁতাল শুয়োর; মত্ত পশুরাই প্রতিপক্ষ,
এবং মুলতঃ;
খাবারের তরে দাগ কেটেছে পেশল জন্তু।
তখনও মানুষ
বেঁচেছে, মুক্ত মেধাবী অস্তিত্বে ভর করে।
অথচ আজকে,
হিংস্র ক্ষমতাপেশল পূজারী জন্তুমানব, উলঙ্গ উল্লাসে,
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে,
ঈশ্বরভীত কম্পমান নোয়া মানুষগুলোকে ছিঁড়ে খায়,
অবিরাম বারবার,
জাতিকেটে দাগ টানে, লোভী, মৌলোভী মানুষ,
শুষে খেতে;
ভয় দেখিয়ে শূন্যে বানায় স্বরচিত স্বর্গনরক;
লুটেরা স্বার্থমানব।
অযত্ন অবহেলায়
গাছ পোড়ে মাঠ পোড়ে, পোড়ে বরফ
কালের অপেক্ষায়।
অনিয়মের নিয়মে,
তবুও কোথাও; অল্প কিছু ঘাড়ত্যাড়া মানুষ।
নিজের মনেই
অঁগাস্তে রোদিনের ভাস্কর্যের মত ভাবতে বসে,
সাগর আকাশ
একাকার করে উত্তর খোঁজে, আলোর তরে,
বাইরে ছুঁড়ে
বাঁধাই খাতা, ভালোবাসে জিজ্ঞাসা; নিবিড় কৌতূহলে,
একান্তে, মুক্তমনে।
…………………………………….
ঘাড়ত্যাড়া সব আলোকিত মানুষ; শুভেচ্ছা (D)
@কাজি মামুন,
হুম!! নিজেরাই নিজেদের গৌরবগাথা ভুলে গেলে আমরা কী করতে পারি?
এই ভদ্রমহিলা জমিদার ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।
আছেতো অবশ্যি। তবে নাম পালটে গেছে। আর অতীত ইতিহাসও ভুলে গেছে সবাই। আমাদের দেশে ইতিহাস নিয়ে তথ্য পাওয়া মুশকিল। কেউ কিছু লিখে যেতে চায় না। আরমানিটোলা গার্লস স্কুল, কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল, শেরে বাংলা গার্লস স্কুল, এগুলো সব লীলা নাগের প্রতিষ্ঠা করা স্কুল।
চমৎকার মন্তব্যের জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ মামুন। (F) (F)
আপনার লেখাটি পড়ে চোখে পানি এসে গেল।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের চাঁদপুরে অপারেশন আর জেলখানায় প্রীতিলতার সাক্ষাতকার নিয়ে সেলিনা হোসেনের একটি উপন্যাস আছে “ভালোবাসার প্রীতিলতা”। উপন্যাস হলেও লেখিকা ইতিহাসের প্রতি সৎ থেকেছেন।এটিও পড়ে দেখতে পারেন।
প্রীতিলতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
@বিপ্লব কুমার কর্মকার,
পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। (F)
সেলিনা হোসেনের বইটা পড়া হয় নি আমার। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার এই এক হ্যাপ্যা। বাংলা বই পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠে। 🙁
পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও চোখ সরাতে পারিনি।
@প্রাক্তন আঁধারে,
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। (F)