যুদ্ধের শেষে অথবা দ্বিতীয় জন্মের আগে
কবিতা
আদনান আদনান


বোমা পড়া বন্ধ হয়ে গেছে গতরাতেই। ঠুস্-ঠাস্ গোলাগুলিরও আওয়াজ নেই আর। সবাই যে স্বপ্ন দেখেছিলো এতোদিন ধরে, অবশেষে তা-ই হলো। সব শেষ। শুধু বেঁচে আছে একটি বিড়াল। সে চুপচাপ বসে আছে কোন কারো বারান্দায়, যে হয়তো সকালেও ছিলো শরীর-ও-মনে। যেনো সে কবি, মনের ভিতরে দলা পাঁকাচ্ছে শব্দের, যা সে অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলবে, “নে, এবার কবিতা খা তোরা। এখন আর কিছু নেই দেবার, শুধু কবিতা আছে। তাই পেট ভরে কবিতা খা। এরপর যদি আবার ক্ষুধা পায় তো ফিরে আসিস, আমি এক বাটি দর্শন খুঁজে রাখবো”। কিছুক্ষণ পরে নিজের নিশ্চুপতায় নিজেরই বিরক্তি ধরে গেলে নরম পায়ে সে হয়তো চলে যাবে কোথাও। সে-ও হয়তো হারিয়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে। শুধু রেখে যাবে একরাত নীরবতা।


আমি বেশ আছি অন্য কোনো এক শহরে অন্য কোনো এক সময়ে, যুদ্ধের থেকে দূরে। ত্রিশের ঘরে পা দিয়েছি, তা-ও তো হলো বেশ কিছুকাল, কিন্তু এখনো কোনো যুদ্ধ দেখিনি। প্রতারক তাই টিকে আছি বেশ, যুদ্ধের থেকে দূরে থেকে। আমি ছাড়া আর কি কেউ আছে যে বিশ ও একুশ শতকে বেঁচে থেকেছে অথচ যুদ্ধ তার গায়ে একটি আঁচড়ও দিতে পারিনি? এ কেমন দুনিয়া, যার প্রায় সবখানে যুদ্ধে মরছে মানুষ, আর আমার মতো তুচ্ছ একজন শয়তানের গর্ভে বাসা বেঁধেছে তাই থাকছে টিকে ঠিকঠাক?


কেউ নেই তাই ঐ শহরে কবিতার থেকে উবে গেছে কবিতা। শকুনে খাওয়া লাশের কঙ্কালের মতো শুধু কিছু শব্দ পড়ে আছে এখানে সেখানে। এখন সময় আরো কিছু, নতুন কিছু, কবিতা লেখার। এখন সময় আমার কবি হয়ে ওঠার।


আমি কবি। আমি অপেক্ষাই থাকি কবে কখন কোথায় পড়বে বোমা আর মরবে একদল শিশু বা ধর্ষিত হবে একটি বালিকা তার প্রথম চুম্বনের আগে বা কোনো মায়ের গর্ভে মানুষের মতো কোনো একজন কেউ খাঁমচে ধরবে একটি বেয়নেট। আমি অপেক্ষাই থাকি এ-সব ঘটনা ঘটার ও আরো একটি কবিতা লেখার। আমি কবি। কবিতা লেখা আমার দায়িত্ব, আর আমার আসক্তি-ও।


কপট দুনিয়ায়, বুঝি, কবিতাও কপট। সে জানে কিভাবে বাঁচাতে হয় নিজেকে। বুঝতে পারি, আমাকে সে শুধু দেয় কবিতার নামে সেই সব কিছু যা আমার ইতিহাসকে করবে কলঙ্কিত। আর যা কিছু কবিতা, তা সে দূরে রাখে আমার থেকে। শুধু আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি, আমার পাশে সে তখন শুয়ে থাকে নগ্ন নারী হয়ে, আর কাঁদে একা একা। আমি তা জানতেও পারিনা। যদি জানতাম তো তাকে লিখে আমি অমর হয়ে যেতে পারতাম। আমার অমরত্বের পিপাসা মিটে যেতো। কিন্তু আমি বুঝতে পারি কপট কবিতা আমাকে সে সুখ দেবেনা। আমাকে সেই সুখ না দেওয়াটা-ই তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তার শ্রেষ্ঠ কবিতা।