আমার মা’কে আমি আম্মু বলেই ডাকি। মা শব্দটাতে আবেগ হয়ত বেশি, কিন্তু আম্মু ডাকেই আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আম্মু থাকে বগুড়ায়, আর আমি ঢাকায়। গ্রামীণফোন বলছে, দূরত্ব কোন সমস্যা না, ফোন করলেই সকল দূরত্ব মুছে যাবে। যায় কী? ফোনের কথাবার্তায় একটা প্যাটার্ন বোধ হয় চলে আসে, আম্মু ফোন দিলে কি কথা হবে তা প্রায় মুখস্ত বলে দিতে পারি আমি, আশেপাশের বন্ধুদের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি ব্যতিক্রম থাকলেও অনেকের অবস্থাই আমার মত।

আম্মু গ্রামে মানুষ। সকালে গরম ভাত বা কখনো পান্তা খেয়ে কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে স্কুলে যেত আম্মু। আরও দশ জন বড় ভাই-বোন থাকার জন্য পড়াশুনা শিখেছে বড় বোনদের কাছেই। কিন্তু এস এস সি পাস করার আগেই বিয়ে হয়ে যায়, তারপরও কোন রকম গ্যাপ না দিয়েই আমার বড় ভাইয়ের জন্ম হবার পরও এস এস সি পরীক্ষা দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে। এরপর বেশ কিছুদিন পড়াশুনায় ছেদ পড়ে। সময় করে ঠিকই এইচ এস সি পরীক্ষা দেয় এক সময়। ততদিনে আমারও জন্ম হয়ে গিয়েছে, সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো আম্মু’র এইচ এস সি রেজাল্টের স্মৃতি আমার এখনও কিভাবে জানি মনে আছে। গ্রামের একজন ছেলে যে নিজেও সেবার এইচ এস সি দিয়েছিল, রেজাল্ট দেখে এসে জানালো যে আম্মু ঠিকই পাস করেছে, কিন্তু সে নিজে ফেল করেছে।  আমার এক সময় মনে হতো এই স্মৃতিটা বোধ হয় কল্পনা, কিন্তু আম্মু’র কাছে শুনে দেখেছি আমার বর্ণনার সাথে আসলেই মিলে যায়।

এইচ এস সি’র পর আর পড়াশুনা করা হয়ে উঠেনি আম্মু’র। এরপর আমরা পুরোপুরি বগুড়া শহরে সেটলড হয়ে যাই। শহুরে মানুষদের মাঝে নিজেদের প্রমাণ করার ইচ্ছেতেই হোক আর অন্য কোন কারণেই হোক, আব্বু-আম্মু দু’জনেই আমাদের দুই ভাইকে বিদ্বান বানানোর ব্যাপারে একেবারে মন প্রাণ ঢেলে দিল। বড় ভাইকে দিলো বগুড়া’র সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্কুলে, ভাইয়া বেশ ভালোই রেজাল্ট করতে থাকলো। প্রতিবেশী আরও অনেকের বাচ্চা একই স্কুলে একই ক্লাসে বা পিঠেপিঠি ক্লাসে পড়ার কারণে তাদের বাবা-মা’দের মধ্যেও একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল। বড় ভাইয়ার কল্যাণে সেই প্রতিযোগিতায় আব্বু-আম্মু বেশ ভালোই করছিল। বড় ভাইয়ের স্কুলে বাসে করে প্রতিদিন যেতে হয় দেখে আমারও বহুদিনের শখ ছিল সেই স্কুলে পড়ার। শেষমেষ আমাকেও ভর্তি করিয়ে দিলো আব্বু-আম্মু। সেই স্কুলে ভর্তি হয়ে এমনই রেজাল্ট করা শুরু করলাম যে অভিভাবকদের প্রতিযোগিতায় আমার আব্বু-আম্মু’র অবস্থান ছিল নিরঙ্কুশ ভাবে সবার উপরে।

কী অদ্ভুত সময়-ই না কেটেছে! বড় ভাইয়ের ঠিক উপরের ক্লাসের ভালো ছাত্রের খাতা, নোট এসব নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে রীতিমত একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব ছিল, বড় ভাই আমার ঠিক উপরের ক্লাসে ছিল বলে আমি অবশ্য সবকিছু রেডিমেড-ই পেতাম। এখনও মনে আছে, বড় ভাই তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। পরের বছর প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষা, তাই তখন থেকেই আগের বছর যে বগুড়া শহরে ট্যালেন্টপুলে প্রথম হয়েছে তাঁর খাতা, নোট এগুলো যোগাড় করার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল। তো এগুলো সংগ্রহের জন্য যখন রিকশা করে আম্মুর সাথে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি পুলিশ লাইন স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আম্মু একটু একটু ফোঁপাচ্ছে। নিজে থেকেই বলা শুরু করলো, ‘আহারে, আমার সোনামুনি পরের বছর  এখানে(তখন আমাদের স্কুলের বৃত্তি পরীক্ষার সিট পুলিশ লাইন স্কুলেই পড়ত)  পরীক্ষা দিবে, না জানি কী দিবে!’ এখন এই ঘটনা মনে পড়লে অবাক হই, আম্মু কি বুঝত না যে এইসব বৃত্তি পরীক্ষার দুই পয়সা দাম নেই আসল পৃথিবীতে। আবার এই ঘটনা থেকে এইটাও বুঝি, আম্মু’র জীবন কি পরিমাণ আবর্তিত হতো আমাদের ঘিরে!

এক সময় প্রকৃতির নিয়মেই আমরা বড় হতে লাগলাম, আম্মু’কে ছাড়াই আমরা বেশ নিজে নিজেই পড়াশুনা করতে শিখে গেলাম। তখন বরং আম্মু পড়া ধরতে আসলেই বিরক্ত লাগতো। এর মধ্যেই আমার চেয়ে ১২ বছরের ছোট একটা ফুটফুটে বোন হলো, আম্মু’ও বোধ হয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

এখন আমরা দুই ভাই-ই ঢাকায়। সেমিস্টার ব্রেক আর ঈদের ছুটি ছাড়া বাড়ি যাওয়া হয়না বললেই চলে। যখন যাই, আম্মুর মুখে স্বাভাবিক ভাবেই কয়েক হাজার ওয়াটের বাতি সব সময় জ্বলজ্বল করতে থাকে। আমার প্রিয় খিচুরি আর পিঠা-পায়েস বেলায় বেলায় হাজির হতে থাকে। বাড়িতে একটা হইচই ভাব থাকে। ছোট বোনও ফুর্তির আমেজে থাকে। কিন্তু আমরা চলে আসলে এসব কিছুই থাকে দৃষ্টিকটু রকমের ভাবে অনুপস্থিত।

আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে যে দৌড়াদৌড়ির সাইকেল শুরু হয়েছিল, সেই পুরনো উদ্যমে না হলেও কাছাকাছি রকমের উৎসাহে সেইটা আবার শুরু হয়েছে আমার ছোট বোনকে দিয়ে। আমার মা’ও তাই কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি, ছোট বোন না থাকলে কি হতো, কিভাবে সময় কাটতো আম্মুর! আব্বু সেই সকালের দিকে বের হয়ে যায়। নিজের ব্যবসার কাজে, রাজনীতির কাজে ভীষণ ব্যস্ত থাকে সারাদিন। আব্বু’র সময়টা বোধ হয় বেশ জমজমাট-ই কাটে। কিন্তু কেমন থাকে আমার আম্মু? রান্নাবান্না ছাড়া কি কিচ্ছু করার আছে! টিভি চালিয়েও কিছু দেখার মত অবস্থা আছে! ঘর দোর গোছাতে আর তরকারির লবণ দেখতে হাঁপিয়ে উঠেনা আম্মু মাঝে মাঝে?

জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন আম্মুকে, ‘বয়স তো প্রায় ৪৫ হলো। কেমন কাটলো এখন পর্যন্ত তোমার জীবন?’ আম্মুর উত্তরে ঘুরে ফিরে উঠে আসে শুধু তাঁর সন্তানদের কথা, তাঁর স্বামীর কথা। তাঁর সন্তানেরা দুধে-ভাতে থাকলেই সে সুখী বলে জানায় আমাকে। তাই কী? সুখ হয়ত এমনিতেই বিমূর্ত একটি ধারণা, তারপরও আম্মুকে দেখে একটা শূন্যতা ঠিকই টের পাওয়া যায়। তাঁর দৈনন্দিন সময়গুলোকে আমার বড্ড বেশি ক্লিশে মনে হয়, মনে হয় আম্মু ঠিকঠাক বলে দিতে পারবে আজকে কি ঘটবে, তার পরদিন, কিংবা তারও পরদিন কি হবে সবই বলে দিতে পারার কথা আম্মুর। একটা অদ্ভুত একঘেয়েমির ছকে আম্মু যে বাঁধা পড়েছে বুঝতে পারি আমি। সে জীবনে কোন উত্তেজনা নেই, কোন উত্তাপ নেই, নেই ভবিষ্যতের দিকে কোন শ্যেন দৃষ্টি। আবার জিজ্ঞেস করি, ‘কোন ইচ্ছে বাকি আছে তোমার জীবনে? কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে কিংবা করতে ইচ্ছে করে অন্য কিছু?’ নির্বিকার ভাবে আম্মু মুখস্ত বুলি আওড়াতে থাকে, আমার আবার ইচ্ছে কী! তোরা আরও বড় হ, মানুষের মত মানুষ হ, তাইলেই শান্তি পাবো। আমি তারপরও আম্মু’র ভিতরের নিজস্ব এন্টিটি’টাকে বের করে আনার চেষ্টা করি, ‘কোথাও যেতেও ইচ্ছে করেনা? সমুদ্র?’ প্রশ্নের ধরন দেখেই হয়ত হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ায়। তারপরও বেশ বুঝা যায় বছরের পর বছর নিজের ইচ্ছে গুলোকে অবদমিত রাখতে রাখতে ইচ্ছেগুলো এমন ভুতুড়ে গলিতে আটকা পড়েছে যে তারা পথ হারিয়ে বাড়ি ফেরার আশা বহু আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছে।

একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারি, এই নিরুত্তাপ, স্থির জীবন শুধু আমার আম্মু’র-ই নয়, আশেপাশে অনেককেই এই ফাঁদে আটকা পড়তে দেখি। গৃহিণী এসব আম্মু’রা বাড়ির এ দেয়াল থেকে ও দেয়ালেই তাদের জীবন আটকে ফেলে দিনদিন নিজেদের মহীয়সী করে তুলে। আমরা বাহবা দিই, আম্মু’র আদর-যত্নে আহ্লাদিত হই, কিন্তু সেই মানুষটা নিজেই হয়ত একটা চক্রে আটকে গেছে। কোন একদিন আমি হয়ত আমার আম্মু’র স্বপ্নের মত একটা মহীরুহ হয়ে উঠবো, আমার সার্টিফিকেট আর মোটা অঙ্কের চাকরির কথা শুনে আম্মু’র বুকের ভিতর হয়ত একটা শীতল বাতাস বইবে, কিন্তু সেই বাতাস কি বড্ড ক্ষণস্থায়ী নয়? একটু খানি শান্তি শেষে সেই একাকীত্বের শীতলতাই বোধ হয় গ্রাস করবে আম্মু’কে।

কাকে দোষ দিই? কাউকেই কি দেয়া যায়? আমরা ব্যস্ত আম্মু’র স্বপ্নের মহীরুহ হওয়া নিয়ে, আব্বু ব্যস্ত তাঁর নিজের জীবনকে জীবন্ত রাখতে, ছোট বোনটাও একদিন ব্যস্ত হয়ে পড়বে আমাদেরই মতন করে। দেখা হলে আম্মুকেও খিচুরি পাকানোতে কিংবা পিঠার আয়োজনেও ভীষণ ব্যস্ত মনে হবে, কিন্তু না দেখা সময়টাতে আম্মু হয়ত এক কোণে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে চুপ করে মিথ্যে শান্তির উপকরণ খুঁজবে।

আম্মু’কে অনেক বেশি-ই ভালোবাসি। তাই কাল যখন হুমায়ুন আজাদের ‘আমাদের মা’ কবিতাটি পড়ছিলাম, কবিতাটি আমাকে অনেকখানি ছুঁয়ে গিয়েছিল। আম্মু’কে নিয়ে লেখার তাড়না পেলাম-ই আসলে সেই কবিতা পড়ার পর-ই। সেই কবিতা দিয়েই শেষ করছি-

‘আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।

আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,

কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।

আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে

মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।

আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।

আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।

বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম

বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম

বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই

মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।

ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।

আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো

আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,

আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।

আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।

আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।

আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।

আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।

আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না

চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।

আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,

আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।

ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।

সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।

আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে

আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।

আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা

আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না

আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা

আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।

কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত

আমাদের মা আজো টলমল করে।’