১.

মেজাজ খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে তাঁর। সে কারণেই কিনা কে জানে, ডান হাতটাকে তীব্রবেগে নিয়ে এসে নিজের গালেই সশব্দে চড় লাগালেন । একটা মশা রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে ছিল। এই অতর্কিত আক্রমণে চারিদিকে রক্ত ছিটিয়ে মুহুর্তের মধ্যেই প্রাণ হারালো সেটা।

মেজাজ অবশ্য খামোখাই খারাপ না। যথেষ্ট কারণ রয়েছে এর পিছনে। আজ এবং কাল, এই দুইদিন ধরে ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং এর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন তিনি। ওয়ারলেসের একঘেয়ে ঘড়ঘড়ানি ছাড়া কিছুই আসছে না তাতে। সামনে শীতের শুষ্ক মহানন্দা। বর্ষার প্রমত্তা যৌবন হারিয়ে হাড্ডিসার এক সাদা চুলের শীর্ণদেহী বুড়িতে পরিণত হয়েছে সে। ওপারে লম্বা উঁচু বাধ। তার আড়ালেই ব্যাংকার খুঁড়ে লুকিয়ে আছে শত্রুরা। আর এপাশে বসে তিনি আঙুল চুষছেন।

বারঘরিয়ায় তাঁরা এসেছেন আরো একদিন আগে। ডিসেম্বরের দশ তারিখে। পঞ্চাশজনের দুর্ধর্ষ এই দলটা নিষ্কর্মা পড়ে আছে সেই তখন থেকেই। একদল সশস্ত্র যোদ্ধাকে এরকমভাবে ফেলে রাখা আর মেরে ফেলার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনি পেশাদার যোদ্ধা। সামরিক বাহিনী থেকে কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। যুদ্ধের প্রয়োজনে যুদ্ধহীন দীর্ঘ প্রতীক্ষাতেও সমস্যা হয় না তাঁর। কিন্তু, তাঁর সাথের যোদ্ধারা প্রায় সবাই সামরিক পটভূমিকাবিহীন। কেউ ছাত্র, কেউ মাঠে কাজ করতো, কেউ ইটের ভাটায়, কেউ বা টুকটাক ব্যবসা করতো, কেউ ছিল বেকার। বাপের হোটেলে বসেই অন্ন ধ্বংস করতো। এই যুদ্ধ শুরু হবার আগে এরা কেউ আগ্নেয় অস্ত্র চোখেও দেখে নি।ওপারে শত্রুদের রেখে এপারে নিশ্চুপ বসে থাকায় স্নায়ুর উপর তীব্র চাপ পড়ছে সবারই।

এই দলের প্রায় সবাই তাঁর কাছাকাছি বয়সের। কেউ কেউ তাঁর থেকে বয়সে বড়ও। কিন্তু কী কারণে যেন তাঁকে যমের মত ভয় পায় এরা। হয়তো তাঁর গম্ভীর আচরণের কারণে। কিংবা ভয়ংকর মেজাজের জন্যেও হতে পারে। একবার এক টগবগে রক্তগরম কিশোর যোদ্ধার সৌখিন চুল চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ছেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। দেশের জন্য যুদ্ধ করার সময় ব্যক্তিগত বিলাসিতাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, এই ছিল তাঁর যুক্তি। আরেকবার কয়েকটা ছেলে অবসরে রেডিওতে গান শুনছিল বলে, সেই রেডিও কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেছিলেন তিনি। তিরস্কার করে বলেছিলেন, “গ্রাম পুড়ছে, মানুষ মরছে, মেয়েদের উপর অত্যাচার হচ্ছে, আর তোমরা গান শুনে ফুর্তি করছো? রেডিও শুধু খবর শোনার জন্য। খবর শুনবে, তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে কালকে কোথায় যুদ্ধ করতে যাবে, কীভাবে যুদ্ধ করবে?”

তবে, তাঁর যোদ্ধারা তাঁকে শুধু ভয় পায় বললে ভুল হবে। এদের প্রবল শ্রদ্ধা এবং অসীম আস্থা তিনি অর্জন করে নিয়েছেন নিজ যোগ্যতা বলে। আর সে কারণেই মুখ ফুটে কেউ কিছুই বলছে না তাঁকে। কিন্তু তাদের চোখের অস্থির ভাষাটা পড়তে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না তাঁর। এভাবে বেশিক্ষন আটকে রাখা যাবে না এইসব টগবগে তরুণদের। বিশেষ করে যখন এরা টের পেয়ে গিয়েছে যে, যুদ্ধজয় আর বেশি দূরের ঘটনা নয়। একটা স্বাধীন দেশের জন্ম হতে যাচ্ছে তাদের হাত দিয়ে। এর থেকে রোমাঞ্চকর বিষয় আর কী হতে পারে?

চাপাই নবাবগঞ্জ দখল করার জন্য তিনটে দল ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে। একটা দল পজিশন নিয়েছে রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জ সড়কে। রাজশাহী থেকে চাপাই নবাবগঞ্জকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাই মুল উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় দল দায়িত্ব পেয়েছে কাটঅফ পার্টি নিশ্চিত করার। আর তাঁর দলের উপর মূল দায়িত্ব। চাপাই নবাবগঞ্জ দখল করা। আক্রমণের মূল পরিকল্পনা করা হয়েছিল ভারতে বসে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং ছিলেন সেই মিটিং এ। কথা ছিল যে, তাঁরা মহানন্দার এপাশে পজিশন নেবার পরেই এগারো তারিখে শত্রুপক্ষের উপর আর্টিলারির গোলাবর্ষণ করবে ভারতীয় বাহিনী। তাদের বিভ্রান্ত এবং দুর্বল করাই মূল লক্ষ্য। এই হট্টগোলের মধ্যে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন শত্রুর উপরে। তারপর দখল নেবেন চাপাই নবাবগঞ্জের।

সেই গোলাবর্ষণ আর হয় নি। ওয়ারলেসে হাজার চেষ্টা করেও ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন নি তিনি। মেজাজের পারদ সর্বোচ্চতে পৌঁছে গেছে সেই সময় থেকেই। দায়িত্বে অবহেলা আর কথা দিয়ে কথা না রাখাকে প্রবলভাবে ঘৃণা করেন তিনি। এই চুতিয়াদের উপর নির্ভর করাটাই বোকামি হয়েছে। এই দেশ আমাদের। যুদ্ধটাও আমাদের। যা করার আমাদেরই করতে হবে। মনে মনে প্রেম সিং এর মাকে নিয়ে প্রেম ভালবাসা বিষয়ক কুৎসিত একটা গালি দেন তিনি।

আবছা অন্ধকারে কিশোরীর রুপোলি ফিতার মত নিথর হয়ে পড়ে থাকা মহানন্দার দিকে তাকান তিনি। কপালে চিন্তার ভাঁজ। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আছেন নিজের অজান্তেই। নদীটা পাড়ি দিতে হবে। ওপারে একটা ব্যাংকারে লাইট মেশিনগান আছে। ওটাকে অকেজো করতে না পারলে নদী পার হওয়াটা অনেক বিপদজনক। কচুকাটা হয়ে যাবে তাঁর  অপেশাদার বাহিনী। মহানন্দার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সময়টা পিছিয়ে যেতে থাকে ক্রমাগত। এরকমই এক নদী পেরিয়ে এসে মাত্র কয়েক মাস আগে যুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি। আজ আরেক নদী পেরিয়ে সেই যুদ্ধের শেষ করতে যাচ্ছেন। মাঝখানে পেরিয়ে গিয়েছে কতখানি সময়, কতখানি ভৌগলিক দূরত্ব।

২.

জুলাই মাসে তিনি ছিলেন কারাকোরামে। আরো তিনজন বাঙালি অফিসারকে নিয়ে মিলিশিয়ার ছদ্মবেশ ধরে শিয়ালকোট সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে ভারতে আসেন তাঁরা। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল সারা এলাকা। কোথাও হাঁটু পরিমাণ পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও বা গলা পরিমাণ পানি। এগুলো ভেঙেই এগোচ্ছিলেন তাঁরা। ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে তাঁরা ভুল করে পৌঁছে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি রেঞ্জারদের ক্যাম্পের পাশে। কোন হ্যায় বলে অস্ত্র হাতে তারা বের হয়ে এসেছিল খোঁজাখুঁজি করার জন্য। পানির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে শুধু নাক জাগিয়ে নিথর হয়ে পড়ে ছিলেন তাঁরা। বৃষ্টিময় রাতে অন্ধকারে কাউকে না দেখতে পেয়ে ফিরে গিয়েছিল রেঞ্জাররা।

গভীর রাতে তাঁরা পৌঁছেছিলেন মুনাওয়ার তাবী নদীর ধারে। এই নদী পার হলেও ওপারে ভারত। কিন্তু নদীতে পা দিয়ে চমকে গিয়েছিলেন তাঁরা। ভয়ংকর স্রোত আর বরফের মত শীতল পানি নদীর। বরিশালের ছেলে তিনি। নদী নালাতে জীবন কেটেছে তাঁর। সেই তিনিও সাহস পেলেন না এই যৌবন উন্মত্ত নদীতে সাঁতার দিতে। আরো দুই তিন মাইল উজানে হেঁটে গিয়েছিলেন তাঁরা যৌবনবতী নদীর সরু কোমরের আশায়। পেয়েছিলেন সেরকম। কিন্তু সেখান দিয়ে পার হতে গিয়েও জীবন প্রায় বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা। পুরো পথটাই তেমন কোনো কথা হয় নি তাঁদের। বিশেষ করে তিনি একেবারেই নিশ্চুপ ছিলেন। তাঁকে গম্ভীর দেখে অন্যেরাও কথা বলে বিরক্ত করে নি তাঁকে। কিন্তু বিদায় নেবার সময় আচমকাই ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন প্রশ্ন করে বসেছিলেন তাঁকে।

“আচ্ছা, পালাবার ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেকের মনেই এক-একটা না একটা কারণ কাজ করেছে। আপনার পালানোর পিছনে বিশেষ কোনো কারণ ছিল কী?”

আচমকা এই প্রশ্নে স্থির হয়ে যান তিনি। যখন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন যে, এর উত্তর তিনি পাচ্ছেন না, ঠিক সেই সময়ে কথা বলে উঠেন। মৃদু স্বরে বলেন, “প্রথম থেকেই পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাবো, এরকম ইচ্ছে ছিল। তবে পালাবার পথ বা সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু যেদিন জানতে পারলাম যে, পাকিস্তানিরা কিছু বাঙালি মেয়েকে ধরে এনে লাহোরে বিক্রি করে দিয়েছে, সেদিন থেকে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম।“

একটু দম নেন তিনি। চোখ নামিয়ে নেন মাটির দিকে। তারপর প্রায় শোনা যায় না, এমন অনুচ্চ স্বরে বলেন, “খবরটা জানার পর আট-দশদিন পানি ছাড়া আর কিছু খেতে পারি নাই আমি। আমার নিজের একটা কিশোরী বোন আছে। ওর ছবি সবসময় আমার মানিব্যাগে থাকে। তার মুখটা শুধু ভেসে উঠেছে আমার চোখের সামনে।“

৩.

নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি। তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে আউয়ালও এসে দাঁড়ায় পাশে। আউয়াল এই অপারেশনের সহকারী কমাণ্ডার।

“কোনো সমস্যা স্যার?”

“সবাইকে জড়ো করো। কথা বলা প্রয়োজন।“ গম্ভীর স্বরে তিনি বলেন।

নিশব্দে বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে এগিয়ে যায় আউয়াল। দীর্ঘদিনের ট্রেনিং তাকে বিড়ালের মত শব্দহীন বানিয়ে ছেড়েছে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই সবাইকে জড়ো করে ফেলে আউয়াল। দ্রুতগতিতে তাঁর নজর ঘুরে আসে সবার উপর দিয়ে। দৃঢ় প্রত্যয়ী সব মুখ। নির্ভীক চোখ। কিন্তু তারপরেও তাদের অস্থিরতাটুকু দৃষ্টি এড়ায় না তাঁর। অধৈর্য হয়ে পড়েছে এই তরুণেরা।

“তোমরা জানো আমরা কেন এসেছি এখানে। ওপারে শত্রুরা অপেক্ষা করছে। ওদের নিকেশ করে চাপাই নবাবগঞ্জের দখল নিতে হবে আমাদের। ভারতীয় বাহিনী আমাদের সাহায্য করার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই সাহায্য আমরা পাই নি। পাবো কিনা তাও জানি না। ওয়ারলেসে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না তাদের সাথে।“ সামান্য থামেন তিনি। এক ঝলকে ঘুরে এলেন সবার মুখ। মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছে সবাই।

“সাহায্য আসে নি, খারাপ কথা। কিন্তু এর জন্য আমরা বসে থাকতে পারি না। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে লড়ছি আমরা। এই যুদ্ধ যখন শুরু করেছিলাম, আমরা কারো আশায় শুরু করি নাই। কেউ আমাদের সাহায্য করবে সে আশাও আমরা করি নাই তখন। এটা আমাদের যুদ্ধ, নিজের মাকে বাঁচানোর যুদ্ধ। নিজেদেরই এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।“

আবারো থামেন তিনি। সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মহানন্দার দিকে তাকান। মৃদু একটা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করেন। তারপর আবার শুরু করেন।

“মহানন্দা পার হবো আমরা। তারপর চোরাগুপ্তা আক্রমণ শানাবো শত্রুর উপরে। অনেকটা হাতাহাতি ধরণের। মেশিনগানটাকে অকেজো করতে হবে। এর জন্য বিশজন লোক প্রয়োজন আমার। কে কে যাবা আমার সাথে, হাত উঠাও।“

একটা হাতও ওঠে না। তার পরিবর্তে পিছন থেকে ভেসে আসে মৃদু কণ্ঠের জিজ্ঞাসা।

“এটা কি আত্মঘাতী মিশন?”

স্থির চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন সহযোদ্ধাদের দিকে। চোখ দুটো কুঁচকে গিয়েছে। চোয়ালটা সামান্য শক্ত।

“হ্যাঁ, এটা আত্মঘাতী মিশন। আমিসহ তোমাদের এই বিশজনের কেউ-ই হয়তো কাল আর বেঁচে থাকবো না। যদি বেঁচে থাকি, আবার দেখা হবে। নাহলে এই শেষ দেখা। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশ নেয়, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই বাঁচে। আমরা ভাগ্যবান যে এখনো বেঁচে আছি। কিন্তু এই অপারেশনে যাওয়া বা না যাওয়াটা তোমাদের ইচ্ছাধীন। আমি কাউকে জোর করবো না।“

তাঁকে অবাক করে দিয়ে একে একে সবগুলো হাত উঠে আসে শূন্যে।

অজানা আবেগে চোখের কোণ  দুটো ভিজে যায় তাঁর। ভাগ্য ভালো আবছা অন্ধকারে কেউ দেখতে পায় নি তাঁর এই আবেগ। নইলে ভারি লজ্জায় পড়ে যেতে হতো তাঁকে। কিংবা কে জানে দেখেছে হয়তো।

“এদের মধ্য থেকে বিশজনকে বাছাই করো আউয়াল। আর কয়েকটা নৌকা জোগাড় করো। কাল ভোরে আমরা নদী পার হবো। বাকিদের নিয়ে তুমি এখানে থাকবে। আমরা ইশারা করলেই মহানন্দা পার হবে তোমরা। তার আগে নয়।“ আদেশ করেন তিনি।

৪.

কুয়াশার চাদরকে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে ঠিক ভোরে নদী পার হয়ে আসে যোদ্ধা দলটা। উত্তর দিকের বাংকার থেকে কমান্ডো আক্রমণ শুরু করে তারা। নীরবে, নিঃশব্দে। বাংকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেয়োনেটের আঘাতে পরপারে পাঠিয়ে দিতে থাকে পাকিস্তানিদের। আর মাত্র অল্প কিছু বাংকার বাকি। এই সময়েই টের পেয়ে যায় পাকিস্তানিরা। বাধের উপরে কিছু সৈন্য ছিল। তারাও এসে যোগ দেয় এদের সাথে। অনর্গল গুলি ভেসে আসতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। মেশিনগান থেকে খইয়ের মত গুলি ফোটাচ্ছে পাকিস্তানিরা।

হাতাহাতি যুদ্ধ শেষ। গুলির প্রত্যুত্তরে গুলিই চালাতে হবে। ব্যাগের ভিতর থেকে গ্রেনেডটা বের করেন তিনি। ক্রলিং করে এগিয়ে যান মেশিনগান রাখা বাংকারের দিকে। এটাকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত শান্তি নেই তাঁর। বাংকারের খুব কাছে এসে গ্রেনেডের পিন খোলেন তিনি। তারপর ডান হাতটাকে উঁচিয়ে গ্রেনেডটাকে সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে দেন বাংকারের দিকে। ভয়ংকর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে চারিদিক। গ্রেনেডটা ছুড়েই বুঝেছিলেন যে, এতেই কাজ হবে। প্রবল আত্মতৃপ্তি নিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকে আগুনের লেলিহান শিখার দিকে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের ফুলকি। ফুলকিতো নয়, যেন ফুল ঝরে পড়ছে চারপাশে। পরম তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে তাঁর ঠোঁটে। ক্লান্তি আর অবসাদে ঘুম এসে যাচ্ছে। চোখ মুদলেন তিনি। আহ! কী শান্তি!!

“পালিয়ে গেলো, পালিয়ে গেলো।“ বিকট শব্দ আর হৈচৈ এর মধ্যে কে যেনো চেচাচ্ছে। চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকালেন তিনি। আগুন আর ধোঁয়ায় একাকার চারিদিক। ডান পাশ থেকে নাদিম নামের বাচ্চা ছেলেটা চেচাচ্ছে। এরই বাবরি চুল জোর করে কেটে দিয়েছিলেন তিনি। নাদিমের প্রসারিত হাত এক পলায়নপর পাকিস্তানি সেনার দিকে। কুয়াশার আড়ালে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে সে।

বিদ্যুৎ খেলে যায় তাঁর সারা শরীরে। এক লাফে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ান তিনি। রক্তে আগুনস্রোত অনুভব করছেন। এই জানোয়ারগুলো তাঁর সোনার দেশটাকে ছারখার করে দিয়েছে। এই খচ্চরগুলোই তাঁর দেশের মেয়েদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে। এই শ্বাপদ্গুলো বিনা কারণে মেরে ফেলেছে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। সেই দ্বিপদী শ্বাপদটা ছুটে যাচ্ছে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে।

লক্ষ লক্ষ বছর আগে তাঁর কোনো এক পুর্বপুরুষ হয়তো শ্বাপদ শিকারে গিয়েছিল। ঢাকের দ্রিম দ্রিম শব্দে  গ্রানাইটের মত কালো শরীরটা নেচে নেচে উঠেছিল তার। বর্তমানের কোনো কোলাহল  কানে আসছে না  তাঁর, কোনো হইচইও শুনতে পাচ্ছেন না। তিনি চলে গেছেন বহু  বহু অতীতে। সেই দ্রিম দ্রিম করা  মাদলের আদিম  মাতাল শব্দ শুনতে পাচ্ছেন তিনি শরীরের প্রতিটা রক্ত কণায়। ভেসে আসছে সুপ্রাচীন কোনো  কাল থেকে, অজানা কোনো উপায়ে।

অভুক্ত চিতার ক্ষিপ্রতা নিয়ে ধাবমান জন্তুর দিকে তিনি ছুটে যেতে থাকেন প্রবল আক্রোশে। যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম ভুলে গেছেন তিনি। ভুলে গেছেন নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মৌলিক সূত্রটা। কে যেন চিৎকার করে মানা করছে তাঁকে। কিন্তু কিছুই কানে যাচ্ছে না তাঁর। পশুটা পালাচ্ছে। তাকে হত্যা করতে হবে। আদিম এই বর্বর ভূমিতে বেঁচে থাকার লড়াই বড় নিষ্ঠুর, বড় নির্মম। হয় মারো, না হয় মরো। এর বাইরে আর কিছু নেই।

পাশের একটা বাংকার থেকে ছুটে আসে বুলেটটা। বখাটে ছেলের মত শিস বাজিয়ে। তীব্র গতিতে লাল একটা বৃত্ত এঁকে দেয় তাঁর কপালের ঠিক মধ্য বিন্দুতে। মনে হয় যেন তাঁর প্রাণপ্রিয় দেশের পতাকার মাঝখানের লাল সুর্যটা কেউ বসিয়ে দিয়েছে তাঁর ললাটে। বুলেটের তীব্র আঘাতে থমকে যান তিনি।  ধীরে,  খুব  ধীরে হাঁটু  ভাঁজ হয়ে পড়ে যেতে থাকেন  মাটিতে।

কপালে উদিত সূর্য নিয়ে তিনি শুয়ে থাকেন শ্যামল মাটিতে, শিশির ভেজানো এক ভোরে।

_______________________

শেষের কথাঃ

এখন থেকে একচল্লিশ বছর আগের ঘটনা। তেইশ বছরের এক তরতাজা তরুণ দেশের জন্য যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিলেন। চুড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন সূর্য দেখে যেতে পারেন নি, কিন্তু এর উদয়নে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে গেছেন তিনি।

যুদ্ধের শুরুতে তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। কাজ করতেন সামরিক বাহিনীতে, অফিসার পদে। বিলাসবহুল জীবন ছিল তাঁর, ছিল আরামদায়ক এবং নিশ্চিত ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। কিন্তু সেসবকে তুচ্ছ করে দিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি ভারতে। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বিলাসিতা বন্ধ করেন এই তরুণ। তাঁর দলের মধ্যে যাতে বিভাজন তৈরি না হয় সে কারণে সবার একই ধরণের পোশাক পরার নির্দেশ দেন। লুঙি, গেঞ্জি, লাল গামছা আর ক্যানভাসের জুতো। নিজেও একই পোশাক পরতেন। শুধু যে পরতেন তাই নয়, এই পোশাক পরেই ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে মিটিং করতেন তিনি। বিলাসিতা বলতে যা ছিল তা হচ্ছে বই। ৭ নম্বর সেক্টরে তাঁর ঘর ভর্তি ছিল একগাদা বই। মাও সে তুং এর সামরিক রচনাবলী, রক্তে রাঙা লাওস, চট্টগ্রাম বিপ্লব, কম্বোডিয়া নয়াফ্রন্ট, চে গুয়েভারা, এই সব বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধ, গণ আন্দোলন আর গেরিলা তৎপরতা বিষয়ক বই দিয়ে ভরা ছিল তাঁর ঘর।

ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখে চাপাই নবাবগঞ্জ মুক্ত করার জন্য অল্প কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মহানন্দা নদী পার হয়ে পাকিস্তানিদের শক্তিশালী পজিশনে আক্রমণ করেন তিনি। এই সময়ই শত্রুর ছোড়া ক্লোজ র‍্যাঞ্জের গুলি তাঁর কপালে বিদ্ধ হয়। অসমসাহসিক এক তরুণ যোদ্ধার জীবনাবসান হয় তা্ৎক্ষণিকভাবে।

আজ সেই চৌদ্দ তারিখ, ডিসেম্বর মাস।

ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ আপনি।  শ্রদ্ধা আর ভালবাসায়পূর্ণ বরমাল্য পরিয়ে দিলাম আপনার গলায়।

সব কটা জানালা খুলে দাও না।