আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে তখনকার দিনের শক্তিশালী স্প্যানিশ সরকার ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে স্থানীয় নেটিভদের উপর আধিপত্য বিস্তারের নিমিত্তে সুবিশাল এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনার দুটো ধরণ, আর সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সেখানে পাঠানোও হয় দুই ধরণের মানুষ- মিশনারি এবং মিলিটারি। মিলিটারি করবে আক্রমণ আর মিশনারি করবে ধর্মান্তকরণ। তাদের সেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফলস্বরূপ, ১৭৬৯ সাল থেকে ১৮২৩ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করা হয় ২১টি মিশন। সবচাইতে দক্ষিণের মিশন স্যান ডিয়েগো এবং সবচাইতে উত্তরের মিশন স্যান ফ্র্যান্সিসকো।
এই সুদীর্ঘ এক হাজার কিলোমিটারজুড়ে, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো মিশনগুলো, যেই রাস্তায় ঘোড়া ছুটিয়ে একদিন নির্মিত হয়েছে উপনিবেশ, সেখানটাতে জড়িয়ে আছে এক রাস্তার নাম। ক্ষমতাবানদেরর আধিপত্য আর দূর্বল নেটিভদের অস্তিত্ব্ব বিলীন হয়ে যাবার চাক্ষুস সাক্ষী হয়ে, আজও নীরবে নিশ্চুপ হয়ে থাকা সেই রাস্তার নামই এল ক্যামিনো রিয়েল।
এই এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে পৃথিবীর রং-রূপ-সৌরভে তৃপ্ত যেমন হয়েছি, তেমনি আবার ঠিক কোন রূপকথার গল্প শুনিয়ে এ-মাটির মায়েরা তাদের কোলের শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সেটা না জানতে পারায় অতৃপ্তও থেকেছি। আর বারে বারে মনে হয়েছে, মাত্র এক-জীবন সমান স্বল্প সময়ের জন্য,এই পৃথিবী অনেক বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর। পুরো এক হাজার কিলোমিটারের দুই প্রান্তের দুটি মিশনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা দুটি শহরের উপর ভিত্তি করে এই লেখা। দুই পর্বের প্রথম পর্ব স্যান ফ্র্যান্সিসকো শহরকে নিয়ে। আর নীচে অপর শহর স্যান ডিয়েগোকে নিয়ে লেখা দ্বিতীয় পর্ব।
শান্ত চুপচাপ পাহাড় ঘেঁষা উপতক্যার যে জায়গাটিতে আমার থাকার ব্যবস্থা, সেটা স্যান হোসে’র শহরতলী ধরা হয়ে থাকে। স্যান হোসে ক্যালিফোর্নিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর, আমেরিকায় স্থান দশম। কিন্তু, তৃতীয় হলে কি হবে, রূপ-লাবণ্য আর জৌলুসের বিচারে চতুর্থ স্থান দখলকারী স্যান ফ্র্যান্সিসকো শহরই গোটা বিশ্বে অধিক পরিচিত। বলতে গেলে স্যান হোসে শহরের নামই মানুষ জানে না। আজকাল আইটি কোম্পানিগুলোর বদৌলতে নাম-ডাক ছড়াতে শুরু করেছে মাত্র ।
সারাদিন ধরে শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় চলতে থাকা ট্রেনে চেপে ক্রপলি স্টেশানে নেমে, ছোট বটলাল গাছটার ছায়া মাড়িয়ে, প্রতিদিনই শান্ত-চুপচাপ মহল্লার এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট বাসাটাতে ফিরতে হয় আমাকে। আশপাশে শব্দ বলতে ক্ষণে ক্ষণে নাম না-জানা আমেরিকান পাখিদের ডাকাডাকি, আরো খানিকটা পরে নিকট রাস্তা দিয়ে দ্রুত বেগে ছুটে চলা গাড়ির শব্দ। ‘মহল্লা’ শব্দটা এখানে কেমন জানি বেমানান হয়ে শোনালো। পুরান ঢাকা কিংবা মোহাম্মদপুরের সাথে ‘শব্দটা যেমন করে মানিয়ে যায়, আর কোথাও কেন জানি তেমনটা করে মানায় না। আবার, এই যে বললাম ‘বটলাল’ গাছ, সেটাও কোনো কেতাবী নাম নয়। এ-গাছের পাতা লাল শাকের মত, আর গাছ দেখতে ছোট্ট একটা বটগাছের মত বলে আমি ‘বটলাল’ গাছ নামেই ডাকি।
আমার বাড়ির মালিক জুলি। প্রথম দিন যখন বাসা ভাড়া নেবার জন্য ফোন করি, ফোন ধরেই আমাকে প্রশ্ন করে, ‘তুমি কি ইঞ্জিনিয়ার? ইঞ্জিনিয়ার না হলে আমি কিন্তু বাসা ভাড়া দেই না।’ একবার ভাবলাম উত্তর দেই, ‘আমি পাপুয়া নিউগিনির প্রেসিডেন্ট’। আমি ইঞ্জিনিয়ার না প্রেসিডেন্ট সেটা সে বুঝবে কি করে! না-কি আমাকে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ঢুকতে হবে! কিন্তু, আরো খানিকটা কথা বলে বুঝলাম, মহিলা অমায়িক, কেমন জানি সৌম্য একটা ভাব আছে। কোনো ধরণের অতি চালাকির চেষ্টা নেই। তাইওয়ান থেকে এসেছে আমেরিকায়। আসলে বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপণ দেখেই আমার পছন্দ হয়েছিলো। বিজ্ঞাপণের প্রথম লাইনে লেখা ছিলো- ‘এই পরিবারটি তাইওয়ান থেকে আমেরিকা এসেছে’। অর্থাৎ তাদের নিজেদের সম্পর্কে আগেভাগে সরাসরি একটা ধারণা দিয়েই বিজ্ঞাপণটা শুরু করে।
প্রথম দিন বাসায় যেতেই জুলি দরজা-জানালা, কিচেন-ক্যাবিনেট, হাবি-জাবি সব কিছু দেখাতে শুরু করে। তার মধ্যে কিভাবে দরজায় চাবি ঢুকিয়ে ঘোরালে দরজা খুলে যায় সেটাও আছে। কিন্তু, সে-সবে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, খেয়ালও নেই। সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে তার জন্য আমার প্রথম প্রশ্ন-‘ইন্টারনেট কানেকশান কি করে নেব?’ ঠোঁটের কোনে গর্বের হাসি ফুটিয়ে জুলি উত্তর দেয়, ‘সেটা আমি কি করে বলবো, আমিতো আর ইঞ্জিনিয়ার না। আমার ভাই ইঞ্জিনিয়ার। সে ছাড়া কেউ ইন্টারনেট লাগাতে পারে না। দাঁড়াও তাকে ডেকে আনি।’ জুলির ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়ের নাম ডেভিড। ইঞ্জিনিয়ার ডেভিড এসেই বলতে শুরু করলো ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য আমাকে কম্পিউটারে এক বিশেষ জিনিস ইন্সটল করতে হবে। যেটার নাম হলো ব্রাউজার। ডেভিড যখন আমাকে ইন্টারনেট আর ব্রাউজারের জ্ঞান প্রদানে ব্যস্ত, অপূর্ব এক তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জুলি দেখছিলো তার গুণী ভাইয়ের কাণ্ড-কীর্তি। কিন্তু, ইঞ্জিনিয়ার না হবার কারণে ভাইয়ের কথা-বার্তা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
দিনের পর দিন যায়। মাঝে মাঝে আমি রান্না করতে গেলে কিচেনে এসে ডেভিড অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চারপাশে ঘুর ঘুর করে। একদিন এসে আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেললো, ‘আমি অনেক দিন ধরে তোমাকে জিজ্ঞেস করবো বলে ভাবছি। তুমি যে মাছটা ফ্রাই করছো, ওটার নাম কি? আমি আমার সারাজীবনে এত সুঘ্রাণযুক্ত মাছ দেখিনি।’ আমি বীরের হাসি হেসে বললাম, ‘ইলিশ মাছ’। বলতে পারতাম, ‘হিলশা ফিশ’। কিন্তু, মনে হলো সেটা বলবো কেন। ইলিশ মাছকে হিলশা ফিশ বললেইতো তার স্বাদ অর্ধেক নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া, ইংরেজীতে যদি বলতেই হয়, তাহলে ইলিশের ইংরেজী নাম হওয়া উচিৎ ছিলো ‘রয়েল বেঙ্গল হিলশা’।
কিন্তু, বাঙ্গালী বেশিক্ষণ গর্বিত হয়ে থাকতে পারে না, কপালে সহে না। ইলিশ নিয়ে ভাব নেওয়া শেষ হতে না হতেই ডেভিড জিজ্ঞেস করে বসে, ‘এবারে অলিম্পিকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কয়টা স্বর্ণপদক পেয়েছে?’ ‘এখনো পর্যন্ত একটাও না’ বলতেই ডেভিডের প্রায় জ্ঞান হারানোর দশা। নিজেকে সামলে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার দেশে না পনের কোটি মানুষ!’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ’। সে বলে, ‘তাহলে কোনো পদক নেই কেন?’ আমি বলি, আমরা এসব খেলি না’। সে বলে, ‘কি খেলো তোমরা’। আমি বলি, ‘হা-ডু-ডু’। সে বলে, ‘ওটা কি’। আমি বলি, ‘আরেকদিন বলবো’। নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য মনে মনে বলি, ‘ব্যাটা তোদের মত তিড়িং-বিড়িং জাতি হলেতো গন্ডায় গন্ডায় অলিম্পিক পদক পেতাম। আমরা কি তিড়িং-বিড়িং জাতি নাকি।’ তবে, সান্ত্বনা পাবার জন্য সেটা ভেবে থাকলেও, ডেভিডের অবাক হবার যথেষ্ট কারণ আছে। অলিম্পিকের মত বিশ্ব আসরে আমাদের অর্জন এত নগণ্য যে সেটা নিয়ে বিব্রতই হতে হয়।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে, এল ক্যামিনো রিয়েলের আমেরিকা অংশের শেষপ্রান্ত স্যান ডিয়েগো যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। জুলি এসে বারবার জানিয়ে গেলো, পরিচয় পত্র সাথে রাখতে। কারণ, স্যান ডিয়েগো শহর মেক্সিকো বর্ডারের কাছে। মেক্সিকো থেকে প্রচুর অবৈধ অভিবাসী আমেরিকায় প্রবেশ করতে চায়। যার ফলে, পুলিশ সবসময় সতর্ক থাকে, সময় বিশেষে আইডি কার্ড দেখতে চায়।
স্যান ডিয়েগো শহরের সুখ্যাতি আছে নানাবিধ কারণে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো তাপমাত্রা। সারাবছরই চমৎকার আবহাওয়া থাকে এখানে। বসবাসের জন্য বেস্ট আমেরিকান শহরগুলোর তালিকায় স্যান ডিয়েগোর নাম সবসময় উপরের দিকেই থাকে। তার উপর আছে সুদীর্ঘ বিচ্। আবার, স্যান ডিয়েগোকে বলা হয়ে থাকে ক্যালিফোর্নিয়ার জন্মস্থান। আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে সর্বপ্রথম এখানেই এসে জাহাজ ভীড়ায় ইউরোপিয়ানরা।
কিন্তু, সবকিছুকে পেছনে ফেলে যে জিনিসটা এখানে বিশেষ জায়গা ধারণ করে আছে সেটা হলো স্যান ডিয়েগো জু। গোটা বিশ্বে সমাদৃত স্যান ডিয়েগো জু বৈচিত্র, পরিবেশ আর গবেষণার দিক থেকে অনন্য। স্যান ডিয়েগো জু সম্পর্কে আরো একটা কথা না বললেই নয়। ৬৫০ প্রজাতি-উপপ্রজাতির প্রায় চার হাজার প্রাণীর আশ্রয়স্থল এই স্যান ডিয়েগো জু তেই ধারণ করা হয় ইউটিবের প্রথম ভিডিও। ২০০৫ সালের ২৩শে এপ্রিল ইউটিউবের কো-ফাউন্ডার বাংলাদেশি বংশদ্ভুত জায়েদ করিমের একাউন্ট থেকে সর্বপ্রথম নীচের ভিডিওটি আপলোড করা হয়।
স্যান হোসেতে অবস্থিত আমার বাসা থেকে স্যান ডিয়েগো শহরের দূরত্ব প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার। টানা গাড়ি চালালে লাগবে আট থেকে নয় ঘণ্টা। অতিরিক্ত গতির জন্য পুলিশের করা জরিমানার ভয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর ইচ্ছা থাকলে সময় লাগবে আরো কম। আট ঘন্টা সময় আসলে কিছুই না, দুইবার গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী যাবার সমান। কিন্তু, সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। যাবার পথেইতো পড়বে আরেক বিশ্বখ্যাত নগরী লস অ্যাঞ্জেলেস্। সেটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া অসম্ভব। সেই সাথে আছে স্যান্টা ক্রুজ, স্যান্টা বারবারা আর ক্যাটালিনা আইল্যান্ড। এর মধ্যে স্যান্টা ক্রুজ বিখ্যাত বিচ্ এর জন্য। পানির রঙ যে এত সুন্দর হতে পারে সেটা বুঝতে পারি স্যান্টা ক্রুজ-এ। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট স্যান্টাক্রুজের ক্যাম্পাসে, ছোট্ট একটা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে দূর থেকে তাকিয়ে দেখা যায় স্যান্টা ক্রুজ বিচ্। সেখান থেকে দেখে মনে হয়, সুনীল এক চাদরের উপর কোনো শিল্পী বুঝি পরম যত্নে পালতোলা নৌকাগুলো এঁকে রেখেছেন। অন্যদিকে, স্যান্টা বারবারা আর ক্যাটালিনা আইল্যান্ড মূল সড়ক থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তাই যাওয়ার পথে সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
সমস্ত পরিকল্পনা আর অপরিকল্পনা এক সূতোয় বেঁধে নিয়ে, জুলাইয়ের এক বাদামী বিকেলে, এল ক্যামিনো রিয়েলের পাহাড়ি রাস্তা ধরে ছুটে চললাম স্যান ডিয়েগোর পথে। পাহাড় দেখে কখনো আমার তৃপ্তি মেটে না। শুধু প্রশ্ন জাগে, হাজার হাজার বছর আগে ঠিক কবে জন্ম হয়েছিলো পাহাড়গুলোর। পাহাড় গুলোর যদি স্মৃতি থাকতো তাহলে জিজ্ঞেস করা যেতো। এই হাজার হাজার বছর ধরে কি কি দেখেছে তারা, কোন্ কোন্ গল্প জমা আছে তাদের কাছে। কোন্ কোন্ নদী একদা তাদের কাছে এসেছিলো, আবার গতি পরিবর্তন করে চলে গেছে অন্য কোথাও। কোন মানব জাতি তাদের গা বেয়ে পার হয়ে গেছে খাবারের সন্ধানে, শিকারের সন্ধানে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। বস্তুত, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের সৌন্দর্যের তুলনা নেই। কি নেই এখানে! সমুদ্র, নদী, পাহাড়, ফরেস্ট, ঝর্ণা, লেক। ক্যালিফোর্নিয়া প্রকৃতির বিউটি পার্লার। এখানে এসে প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে নেয়।
ছোটো ছোটো পাহাড়ী রাস্তাগুলোর মাঝে ছুটে পার হতে গিয়ে কখনো সমতল এলে দুপাশে দেখা যায় স্ট্রবেরীর ক্ষেত। সাইনবোর্ডে লেখা থাকে, ‘ফ্রেশ স্ট্রবেরী, কিনতে চাইলে এক্ষুণি গাড়ী থেকে নেমে পড়ুন। একেবারে নিজ হাতে তুলে নিন বাগান থেকে’। এদিকে সময়ের সাথে সাথে বাদামী বিকেল কখন যে লালচে হতে শুরু করেছে, জ্বলে উঠেছে ছোট ছোট শহরের বাতিগুলো। মাইলের পর মাইল পার হচ্ছি। শুধু জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, কি এই শহরের নাম, কি নাম তাহার শহরতলীর, কি-ইবা নাম ঐ দূরের গ্রামের। কারা থাকে ওখানে। কিন্তু, জানা হয় না, জানা যায় না। এক জীবন এত দূরন্ত গতিতে ছুটে চলেও শেষ করা যায় না, তার আগেই নিঃশেষ হয়ে যায়!
- ছবিঃ বাদামী বিকেল যখন লালচে হয়ে আসে
রাতের মধ্যেই বিশ্বখ্যাত লস এঞ্জেলেস শহরে গিয়ে উঠি। সেখানটাতে সবকিছু শেষ হলে আবার ছুটে চলা স্যান ডিয়েগোর দিকে।(লস এঞ্জেলেস এর কাহিনী এখানে)। লস এঞ্জেলেস থেকে স্যান ডিয়েগো যাবার পথে আরেক শহর আরভাইন। এ- শহরে পাহাড়ের ধাপে ধাপে বাড়িগুলো এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হয় কেউ বুঝি বইয়ের তাকে বই সাজিয়ে রাখার মত করে পাহাড়গুলো কেটে বাড়ীগুলোকে তাকে তাকে সাজিয়ে রেখেছে। আরভাইন শহর পেরিয়ে যখন চলন্ত গাড়িতে ছুটে চলি, তখন রাস্তার এক পাশে যত দূরে চোখ যায় শুধু একটাই জিনিস- সাগর আর সাগর, অনেক অনেক সাগর; অশান্ত সেই মহাসাগর, প্রশান্ত তার নাম।
- ছবিঃ পাহাড়ের গায়ে বেড়ে উঠা আরভাইন
মূল স্যান ডিয়েগো শহরে যাবার আগেই আগুন্তুকদের অভ্যর্থনা জানাতে থাকে সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করে দাঁড়িয়ে থাকে মরমন ধর্মাবলম্বীদের গির্জা। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরমনদের ১৩৬ টি গির্জার মধ্যে এটি একটি। গির্জা পার হয়ে চলন্ত গাড়িতে এগিয়ে যেতে থাকি মূল গন্তব্যে, গন্তব্যস্থল স্যান ডিয়েগোর হারবারের কাছাকাছি। মূল সড়ক ছেড়ে সেখানে যাবার পথে শুধু তাকিয়ে দেখেছি একটা পাশে, কখনো তাকিয়ে দেখতে পারিনি কি ছিলো অন্য একটা পাশে। যে-পাশে তাকিয়েছি সে-পাশ থেকে চোখ সরাতে পারিনি। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে যে জলরাশি খানিকটা ভিতরে ঢুকে এসেছে, জানি না কে তাকে এমন রঙে রাঙ্গিয়ে দিয়েছে; নীল-সবুজ-জলপাই, জানি না কোন রঙের সংমিশ্রণে তৈরী সে-জলের রঙ। সে জলের এক ধারে বড়শি ফেলে মাছ ধরে যায় সৌখিন শহরের সৌখিন মানুষগুলো, আর অন্য ধারে উঁচু উঁচু ভবন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সৌখিন সে-শহর স্যান ডিয়েগো।
- ছবিঃ মরমনদের উপাসনালয়
- ছবিঃ সৌখিন শহর স্যান ডিয়েগো
শহরের উপস্থিত হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয় শেং ওয়াং। শেং ওয়াং আমার পরিচিত একমাত্র চীন দেশীয় মানুষ, যে গল্প বলতে পারে। অবশ্য, সে গল্প করতে শুরু করলে গাধার মাংস খাওয়ার একটা গল্প বারবার ঘুরে ফিরে আসে। শেং ওয়াং দুইদিন আগে থেকে ফোন করে খবর নিতে শুরু করেছে আমি তখন কোথায়। আরো বলে রেখেছে, স্যান ডিয়েগো শহর সে আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে, অন্য কারো সাথে যেন না যাই। গাড়ীতে উঠিয়ে শেং ওয়াং প্রথমেই নিয়ে গেল তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়-ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান ডিয়েগোর ক্যাম্পাসে।
- ছবিঃ ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান ডিয়েগোর Geisel লাইব্রেরি
সেখান থেকে ‘লা হ’য়া’(La Jolla) বিচ্। উদ্দেশ্য সুর্যাস্ত দেখা। আদিগন্ত প্রশান্ত মহাসগরের কোলে আস্তে করে লুকিয়ে পড়ে পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরের সূর্য্য। অপূর্ব সে দৃশ্য। দেখতে দেখতে মনে হলো, প্রায় দশ হাজার বছর ধরে এই স্যান ডিয়েগোর উপকূলে বসবাসকারী কুমিইয়াই আদিবাসী, সভ্যতার জোয়ারে আজ যারা আবর্জনার মত ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, হাজার হাজার বছর আগে কি ভাবতো সে মানুষগুলি, যখন দেখতো দিনের বেলার চকচকে রূপালি সূর্য বিকেল বেলায় রক্তবর্ণ ধারণ করে তলিয়ে যায় সাগরের অপর পারে!
- ছবিঃ লা হ’য়া ভিলেজ থেকে দেখা সূর্যাস্ত
রাতের স্যান ডিয়েগো শহর নিশাচর হয়ে পরিভ্রমণ করে সেদিনের জন্য বিরতি দেয়া। পরবর্তী দিন বিখ্যাত স্যান ডিয়েগো জু দেখবার আয়োজন। ১৯১৬ প্রতিষ্ঠিত এই চিড়িয়াখানা এবং সাথে থাকা সাফারী পার্কে বিপন্ন প্রাণীদের রক্ষার্থে প্রতিনিয়ত চলছে গবেষণা।
- ছবিঃ স্যান ডিয়েগো জু
১০০ একর জায়গায় বিস্তৃত এই স্যান ডিয়েগো জু তেই ১৯৯৯ সালে বিরল আর বিলুপ্তপ্রায় জায়ান্ট পান্ডা হুয়া মেইর জন্ম হয়। সেটি ছিলো আমেরিকার কোনো চিড়িয়াখানায় প্রথম পান্ডা জন্ম হবার ঘটনা এবং নবজাতক পান্ডা দেখার জন্য সে-সময় হাজার হাজার লোক চিড়িয়াখানায় ভীড় করে। তারও আগে ১৯৮৭ চীন সরকার দুইশ দিনের জন্য স্যান ডিয়েগো চিড়িয়াখানাকে দু’টি পান্ডা ধার দেয়। চীন সরকারের বিভিন্ন দেশকে পান্ডা উপহার পাঠানোর কিংবা ধার দেবার রীতিটি ইতিহাসে পান্ডা ডিপ্লোম্যাসি নামে পরিচিত। এই পান্ডাগুলো এত বেশি জনপ্রিয় আর বিখ্যাত যে স্যান ডিয়েগো চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ওয়েব ক্যাম দিয়ে সরাসরি সেগুলো দেখার ব্যাবস্থা করে রেখেছে। প্রযুক্তির সর্বোত্তম এই ব্যবহার নীচের লিঙ্কে ক্লিক করে দেখা যাবে।
স্যান ডিয়েগো জু থেকে সরাসরি পান্ডাগুলি দেখা যাবে এখানে ক্লিক করলে।
স্যান ডিয়েগোর পরের শহর টিহুয়ানা (Tijuana)। নাহ! সেই শহরের দিকে আর এগিয়ে যাওয়া নয়। টিহুয়ানা মেক্সিকোর অংশ। সে-শহরে যাবার অনুমতি আমার নেই। মানুষের নির্মিত কাল্পনিক সীমানায় বন্দী হয়ে যায় মানুষ। স্যান ডিয়েগো পাড়ি দিয়ে শেষ করি এল ক্যামিনো রিয়েলের আমেরিকা অংশের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পথ। তারপর, শুধুই ফিরবার পালা।
মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]
স্টেইটস্ অব আর্ট সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলিঃ
:: নিউইয়র্ক (প্রথমার্ধ) :: নিউইয়র্ক (দ্বিতীয়ার্ধ) :: পোর্টল্যান্ড (ওরিগন) :: সিলিকন ভ্যালি (ক্যালিফোর্নিয়া) :: ওয়াশিংটন ডিসি :: ডেট্রয়েট (মিশিগান) :: রিচ্মন্ড (ভার্জিনিয়া) :: লস এঞ্জেলেস (ক্যালিফোর্নিয়া) :: কলাম্বাস (ওহাইও) :: গোল্ডেন গেইট ব্রিজ ::
সত্যি বেশ চমৎকার করে আপনি ভ্রমণ কাহিনি লিখেন। তামান্ন ঝুমুর মন্তব্যের সাথে আমি সহমত। আপনার যে দেখার জন্য দুটো চর্ম চক্ষুর সাথে মরমেরও বেশ কয়েকটা চক্ষু আছে- এটা আমাকে আনন্দিত করে খুব।
@শনিবারের চিঠি,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার মন্তব্য পেয়ে বেশ ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন। 🙂
আমি রাজুর লেখায় ভ্রমণের সাথে সাথে রসবোধটুকু খুবই উপভোগ করি। যেমনঃ
লেখার মাঝে মাঝে দার্শনিকতাও মনকে ছুঁয়ে গেছে।উদাহরণস্বরূপঃ
@গীতা দাস,
ধন্যবাদ গীতা’দি।
কোট্ করা নীচের লাইনগুলো আমি নিজেও লেখার সময় বসে বসে কিছুক্ষণ চিন্তা করছিলাম। নাম না জানলে কিংবা স্থানীয় মানুষজনের সাথে কথা না বললে আমার কেন জানি মনে হয় কি যেন বাকী থেকে গেল। কিন্তু, এত সময়তো আমাদের জীবনে নেই, আরো কত কত পার্থিব ব্যস্ততা, সেটাকেও যে অগ্রাহ্য করতে পারি না।
ভালো থাকবেন। 🙂
আপনার ভ্রমণ কাহিনীগুলো দারুণ লাগে। আপনার একটা লেখায় পড়েছিলাম, আমেরিকায় বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতি থেকে আসা স্টুডেন্টদের সংস্কৃতি পরষ্পরের মধ্যে আদান-প্রদানের জন্য একটা শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা আছে। সেখানে আপনিও গিয়েছিলেন। খুব ভাল লেগেছিল। আবার পড়তে ইচ্ছে করছে সেই লেখাটি। আপনার এতগুলি লেখার মধ্যে খুঁজে পাচ্ছি না। যদি দয়া করে লিংকটা দিতেন!
@তামান্না ঝুমু,
আপনি মনে হয় হ্যাকারস ক্যাম্প লেখাটার কথা বলছিলেন। সেটা পাবেন এখানে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 🙂
(Y) পড়ে ভালো লাগল
@লাট্টু গোপাল,
ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন। 🙂
চমৎকার………………………………
(Y) (F)
@ভক্ত,
ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂 (C)
বরাবরের মতই দারুণ লাগলো।
এই ব্যাপারটা নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি, আমার যদি যাতায়াতের টাকাও থাকে তাও আমার ইচ্ছা হলেই আমি আটলান্টিকের তীরে বা আন্দিজ পাহাড়ে পা রাখতে পারবোনা, তার আগে অনুমতি(ভিসা) নিতে হবে কিছু মানুষের!! দারুণ হতো যদি পুরো পৃথিবীটা একটি দেশ হতো imagine গানে জন লেনন যেমনটা স্বপ্ন দেখেছেন।
@রামগড়ুড়ের ছানা,
ধন্যবাদ রামগড়ুড়ের ছানা। আমি সুযোগ পেলেই লেননের গাওনটা শুনি। সেটার উপর ভিত্তি করে বার্জার এর একটা অ্যাড্ আছে। সেটাও বেশ ভালো লাগে। 🙂
httpv://www.youtube.com/watch?v=z5PxCw3IAE4