“জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই” লাইনটা কি খুব পরিচিত মনে হচ্ছে? হীরকরাজার দেশে এই মন্ত্র শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তার প্রজাদের। কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কেও ঠিক তেমন কিছু বাজে মন্ত্র প্রচলিত হয়ে গেছে বাজারে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, এগুলোর প্রচলন হয়েছে সেইসব বড় বড় বিজ্ঞানীদের দ্বারাই যারা এই অভাবনীয় তত্ত্বের শুরুর দিককার তাত্তিক। কী সেসব কথা? কয়েকটার উদাহরণ দিচ্ছি, এই লেখার প্রথম লাইনটার মত সেগুলোও কিছু কিছু আপনাদের পরিচিত মনে হবে। “তুমি যদি ভাবো কোয়ান্টাম তত্ত্ব বুঝে ফেলেছো, তাহলে তুমি আসলে বোঝনি”, “ইউ আর নট অ্যালাউড টু আস্ক দ্যাট কোয়েশ্চেন”, “এই তত্ত্ব অবোধগম্য, ফলে এই বিশ্বও তাই”, “কিছু ঘটনা কোনো কারণ আর ব্যাখ্যা ছাড়াই ঘটে”… ইত্যাদি। টেক্সটবই আর জনপ্রিয়বিজ্ঞান লেখা খুঁজলে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। মানুষের আবিষ্কৃত সুন্দর আর সুক্ষ্মতম তত্ত্বটা তাই আটকা পড়েছে এক ধরনের অজ্ঞতা আর মিস্টিসিজমের বেড়াজালে। 

চিত্রঃ অসীমের অভিযাত্রী [ফ্লেমেরেশন এনগ্রেভিং, উইকিমিডিয়াকমন্স]

এ প্রসঙ্গে উনবিংশ শতকে কোনো এক নাম না জানা শিল্পীর আঁকা এই খোদাইচিত্রটির কথা আমরা ভাবতে পারি। এক অভিযাত্রী হাটতে হাটতে পৌছে গেছে পৃথীবির প্রান্তে, যেখানে আকাশ মিশেছে মাটিতে। তারপর নিদারুণ কৌতূহলে সে ঐ বাধা ফুঁড়ে  উকি দিয়েছে অজানার পানে। কী নিপুন দক্ষতায় রূপকে মাধ্যমে শিল্পি তুলে ধরেছেন মানব মননের গভীরতম প্রশ্নটি- অজানা আর জানার মধ্যে সীমানাটা কি কাল্পনিক, যেটা হলে সব সময়ই আমরা ঐ কল্পিত পর্দা ফুড়ে অজানাকে জেনে ফেলব? নাকি আসলেই আমরা আটকা পড়েছি এমন জগতে যেখানে সীমাবদ্ধতাটাই বাস্তব, শুধু মাত্র অলীক কল্পনাতেই সেই সীমার বাইরে কিছু দেখা সম্ভব? কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে একটু আগের অদ্ভুত কথাগুলো যারা বলেছেন, তারা যেন সেই সীমাবদ্ধতার কথাটাই প্রচার করছেন। কারণ কোয়ান্টাম তত্ত্ব বেশ অদ্ভুত হলেও (কেন অদ্ভুত সেটা দেখবো আমরা একটু পরেই) ভৌত জগতকে ব্যাখ্যা করছে আমাদের জানা আর যে কোনো তত্ত্বের চেয়ে অনেক বেশি সুক্ষ্মতায়। রিচার্ড ফাইনম্যান এর সুক্ষ্মতার তুলনা করেছিলেন এটা বলে যে, “কোয়ান্টাম মেকানিক্সের হিসাবগুলোর সঠিকতা নর্থ আমেরিকা কতটা চওড়া সেটা একটা মানব চুল পরিমান সুক্ষ্মতায় নির্ণয় করার সমতুল্য।” তার মানে আমাদের জানা ভৌত জগতের সবচেয়ে সঠিকতম বর্ণনা হচ্ছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এখন এই তত্ত্ব নিয়ে “তুমি বুঝে ফেলেছ ভাবলে আসলে তুমি বোঝনি” টাইপ কথা বলার অর্থ এটাকেই আমাদের জ্ঞানের সেই সীমানা ভেবে নেওয়া, যার অস্তিত্ব নিশ্চিত হলেও অনঅতিক্রম্য! 

তবে এই অবস্থা পালটাতে চলেছে। কিভাবে পালটাচ্ছে সেটা বলার আগে। প্রথম প্যারার অবৈজ্ঞানিকসুলভ আর প্রায় “ডগমাটিক” বাক্যগুলো এত বড় বড় বিজ্ঞানীদের বলার অন্য একটা ইন্টারপ্রিটেশনও বলি। সেটা হলো, কোয়ান্টাম তত্ত্ব এমন সব ধারণার উপর নির্ভর করে গঠিত, যেগুলো আমাদের ক্লাসিক্যাল ধারণার সাহায্যে বোঝা স্রেফ অসম্ভব। তাই হুঠ করে কেউ বুঝেছে দাবি করার অর্থ হয়তো সে কোনো একটা ক্লাসিক্যাল চিত্র আঁকছে মনে মনে, আর যে কোনো ক্লাসিক্যাল চিত্রই আসলে ভুল (এটা তাত্তিক আর পরীক্ষামূলক উভয়ভাবেই প্রমাণিত)। ক্লাসিক্যাল চিত্র আর অক্লাসিক্যাল চিত্র বলতে কি বোঝাচ্ছি সেটা অল্পতে বলি। যেমন আমাদের সেট থিওরীর কথাই ভাবা যাক, আপনি যদি কোনো একটা সেট আর কোনো একটা ইলিমেন্ট নেন। তাহলে ইলিমেন্ট বা উপাদানটি হয় ঐ সেটের মধ্যে থাকবে, অথবা সেটের বাইরে থাকবে। এই দুইটি ঘটনার বাদে আর কিছুই হতে পারে না। আমাদের সকল যুক্তিবিদ্যা এ ধরনের “ক্লাসিক্যাল” রিজনিং এর উপর নির্ভর করে গঠিত। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বএর দৃষ্টিতে একই সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রায় উভয়ই ঘটা সম্ভব! কেমন উদ্ভট শোনাচ্ছে না? এ কারণেই ক্লাসিক্যাল রিজনিংএ কোয়ান্টাম জগৎকে বোঝা ও বর্ণনা করা অসম্ভব। তাই হুঠ করে “বুঝে ফেলেছি” দাবি করাটা বেশিরভাগ সময়ই “বুঝিনি” বের হয়। নিজের ধারণার জগতে এ ধরনের “প্যারাডাইম শিফ্ট” ঘটানো সহজ সাধ্য নয়। এছাড়াও, ওসব কথা যখন বলা হয়েছে, তখন কোয়ান্টাম তত্ত্ব একেবারেই নতুন শিশু। যার সম্পর্কে তেমন কিছুই এক্সপ্লোর করা হয়নি। ফলে এমনকি ঐ তত্ত্বের প্রবক্তাদের কাছেও অনেক কিছুই ছিলো অজানা। কিন্তু সেই অবস্থা দ্রুত বদলাচ্ছে। যে প্রসঙ্গে আমরা আসবো পরে। 

সেট নিয়ে ধারনার জগতে কেবলই যে উদ্ভট পরিবর্তনটির কথাটি বললাম সেটাকে আরেকটু বিশদে না বললে লেখাটা অসম্পূর্ণ থাকে। আসলে, ধারণার জগতে এ ধরনের পরিবর্তন আমাদের অপরিচিত নয়। যেমন নিউটনিয়ান মেকানিক্সের কথাই ধরুণ। আমরা স্রেফ অভিভুত হই নিউটনের প্রায় একা হাতে তখন পর্যন্ত জানা দিন-দুনিয়ার সবকিছুর গাণিতিক সূত্র দিয়ে ফেলা দেখে। সেসব সূত্র পড়তেও আমাদের কাছে বেশ রিজনেবলই মনে হয়। অন্তত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো উদ্ভট কোনো “ঘাপলা” আছে বলে সাদা চোখে ধড়া পড়ে না। কিন্তু নিউটনকে তার তত্ত্ব দাঁড়া করাতে ধারণার জগতে ঠিক তেমনই একটা প্যারাডাইম শিফ্ট করতে হয়েছে। সেটা হলো ইনফিনিটিসিমাল ক্যালকুলাস। কোনো লিমিটের অঙ্ক করতে গিয়ে এক্স টেন্ডস টু জিরো হতে হতে আবার যখন উপর নিচে কাটাকাটি গিয়ে দারুণ একটা সসীম সংখ্যা চলে আসে, সেটা দেখে ক্ষণিকের জন্যও খটকা লাগেনি তেমন কোনো বিজ্ঞানের ছাত্র নেই। ছেলেবেলায় শিখি বলে ওসব নিয়ে অত চিন্তা করি না। মেনে নেই। কিন্তু এই ধরনের একটা সমস্যাই হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিকদেরকে আটকে ফেলেছিলো। ইন ফ্যাক্ট সেই সমস্যাটা থেকে উত্তরণের কোনো ধারনাগত পথ তারা পায়নি বলেই, ভৌতবিজ্ঞানকে নিউটন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় বর্তমান বেগ পেতে। সমস্যাটি হলো জেনোর প্যারাডক্স, মনে করুণ  একটা লাইন বরাবর আপনি আমার দশ ফুট সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় একই সঙ্গে আপনি সেকেন্ডে পাঁচ ফুট গতিতে সামনে চলতে শুরু করলেন। আর আমি সেকেন্ডে দশফুট হারে। এ অবস্থায় দু সেকেন্ডের মধ্যেই আপনাকে অতিক্রম করে যাবো আমি। যেমনটা ঘটতে দেখি আমরা অহরহ। উচ্চগতির গাড়িটি সব সময়ই নিম্ন গতির গাড়িকে অতিক্রম করে যায় এক সময় না এক সময়। কিন্তু এই ঘটনা নিয়ে আরেকটু গভীরভাবে ভাবুন তো। শুরুতে আপনি যেখানে ছিলেন সেখানে পৌছতে আমার লাগবে এক সেকেন্ড। কিন্তু তক্ষণে আপনিও কিছুটা এগিয়ে গেছেন। আপনার নতুন অবস্থানেও আমি এবার এক সেকেন্ডের কম সময়েই পৌছে যাবো, কিন্তু ততক্ষণে আপনি এগিয়ে যাবেন আরো একটু। এভাবে আপনার কোনো অবস্থানে আমি পৌছানো মাত্র আপনি আপনার গতির কারনে অতি ক্ষুদ্র পরিমানে হলেও এগিয়ে যাবেন। এবং এই ঘটনা চলতেই থাকবে। তাহলে তো, আমি কখনোই ছুতে পারবো না আপনাকে! যদিও শুরুতে আপনি ছিলেন মাত্র দশ ফুট দুরে। আর আপনার দ্বিগুণ গতি ছিলো আমার! বাস্তবে এমনটা ঘটেনা। বাস্তবে আপনাকে আমি ছুয়ে ফেলি ঠিকই। এবং অতিক্রম করে যাই। তাহলে আগের রিজনিং এ ভুলটা কোথায়? এই পাজল গ্রীকরা সমাধান করতে পারেনি। তাই তাদের দর্শন এক সময় ভৌত জগৎ ছেড়ে অলীক কল্পনার জগত নির্ভর হয়ে পড়ে। হাজার বছর পরে নিউটনের উদ্ভাবিত (লিব্ৎনিস ও ইন্ডিপেন্ডেন্টলি উদ্ভাবন করেছিলেন) ইনফিনিটিসিম্যাল ক্যালকুলাসের মাধ্যমে এই ধাঁধার সমাধান হয়। এভাবেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় আধুনিক বিজ্ঞানের। 

এখন আসি কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্রসংগে। একটু আগের জেনোর দৌড় প্রতিযোগিতার উদাহরণে গ্রীকদের যুক্তিটিকে যদি ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের সাথে তুলনা করি। তাহলে ঐ পিছনের ব্যক্তির সামনের ব্যক্তিকে অতিক্রম করে যাওয়ার ঘটনা (যেটা সব সময় ঘটতে দেখি আমরা)-কে ভাবা যায় সেইসব নতুন কোয়ান্টাম ঘটনার সাথে যেগুলো সব সময় ঘটতে দেখছি কিন্তু ক্লাসিক্যাল যুক্তি তার ব্যাখ্যা করতে পারছে না। শ্রোডিঞ্জার, ডিরাক, হাইজেনবার্গদের আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম তত্ত্ব হচ্ছে নিউটনের সেই ইনফিনিটিসিম্যাল ক্যালকুলাসের মত একটা নতুন ধারণা যেটা কোয়ান্টাম পাজলের সমাধান দিয়েছে। আর একটু আগে সেট নিয়ে বলা অদ্ভুত কথাটি কোয়ান্টাম সঙ্গঠনের অন্ততম গোড়ার কথা। যার কেতাবি নাম সুপারপজিশন। সুপারপজিশনের কথা শুতে নিশ্চয়ই অদ্ভুত লাগছে, আমি নিশ্চিত গ্রীকদের সামনে ইনফিনিটিসিম্যাল ক্যালকুলাসের ধারণা নিয়ে গেলে তারাও শুরুতে তেমনটাই ভাবতো। আর হয়তো চেষ্টা সাধনা করে একসময় ঠিকই বুঝে ফেলতো আসলে ঘটনা কি। কি হতো না হতো সেসব কল্পনার কাছে ফেলে আসুন আমরা আইনস্টাইনের কাছে যাই। 

চিত্র: নমনীয় সময় [দ্য পার্সিস্টেন্স অফ মেমরি, সালভাদর দালি, উইকিমিডিয়াকমন্স]

আমরা জানি আইনস্টাইনও ধারণার জগতে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন তার আপেক্ষিকতার তত্ত্বের মাধ্যমে। তিনি দেখিয়েছিলেন, সময়, ভর দূরত্বের মত, একেবারে “কঠিন” জিনিশও আসলে কতটা নমনীয়। কতটা আপেক্ষিক! কিন্তু তার আপেক্ষিক জগতেও কিছু ব্যাপার ছিলো সুনির্ধারিত। যেমন আপনি যে জড়তার কাঠামো থেকেই মাপুন না কেন, বস্তুর ভর-দৈর্ঘ আপনার ঘড়ির সময় দুরত্ব এসব গতি ভেদে ভিন্ন হলেও ভরবেগ, শক্তি, ইত্যাদি অপরিবর্তনীয়। এই যে এই আপেক্ষিক ভৌত জগতের বর্ণনায় কিছু রাশির মান, অন্তত সুনিশ্চিত, এই ব্যাপারটিকেই আইনস্টাইন বলতেন “অবজেক্টিভ রিয়েলিটি”। মানে ঐ মানগুলো আমি জানি বা না জানি, কোনো অস্তিত্বশীল বস্তুর বর্ণনাকারী ঐ সব রাশির সুনির্ধারিত মান থাকবে। তারমানে আপনি যদি একটা সেট বানান যেখানে শুধু শুধু সেইসব ইলেক্ট্রন আছে যাদের কৌনিক ভরবেগ এক্স এর কম। তাহলে যে কোনো ইলেক্ট্রন হয় ঐ সেটের মধ্যে থাকবে অথবা বাইরে থাকবে। অর্থাৎ আমাদের আদি সেট থিওরিক বর্ণনা এখানে খাটছে। কিন্তু পরীক্ষাগারে আমরা অহরহ এমন সব ইলেক্ট্রন দেখি এমনকি প্রস্তুতও করি যারা একই সংগে ঐ সেটের মধ্যে এবং বাইরে! এই অদ্ভুত ঘটনা ক্লাসিক্যাল কোনো যুক্তিতেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ইন ফ্যাক্ট এবারের (২০১২) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী দুজন হচ্ছেন এরকম অদ্ভুত বৈশিষ্টের কোয়ান্টাম সিস্টেম প্রস্তুত করা, আর সেগুলো ব্যবহার করে অভাবনীয় কাজকর্ম অচিন্তনীয় সুক্ষ্মতায় সমাধা করার বিশেষজ্ঞ। কত সুক্ষ্ম তা বলি। তারা কোয়ান্টাম ঘটনা ব্যবহার করে এমন সুক্ষ্ম ঘড়ি বানাতে সক্ষম হয়েছেন যার এক দিনে সময় পরিমাপের ভুল বড় জোর এক পিকো সেকেন্ড। আরেকটু সহজভাবে বললে, ঐ ঘড়ি এতটাই সুক্ষ্ম যে পুরো ইউনিভার্সের যে বয়স, (১৩.৭ বিলিয়ন বছর) অতদিন ধরে এই ঘড়ি চললে ঘড়িটি সঠিক সময়ের থেকে বড়জোর পাঁচ সেকেন্ড কম বা বেশি দেখাবে। একভাবে দেখলে, এটা ঐ  কোয়ান্টাম কণিকার (যেমন ইলেক্ট্রন) গুণ নয় যে সে একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ভরবেগে, (এমনকি ভিন্ন ভিন্ন স্থানেও) থাকতে পারছে। বরং এটা এই মহাবিশ্বেরই একটা বৈশিষ্ট্য, যে সে ঐ কণিকাকে একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় থাকতে দিচ্ছে! 

এসবের সঙ্গে যোগ করুন হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি, এন্ট্যাংলমেন্ট, রান্ডমনেস, বিচ্ছিন্নতা, তাহলেই শেষ। মনে হবে এই বুঝি বিজ্ঞানের খেল খতম হয়ে গেল! এতসব সমস্যা একসঙ্গে সে ট্যাকেল দেবে কিভাবে! প্রকৃতির উপর ছড়ি ঘোরানোর দিনই বুঝি শেষ হয়ে এলো। কিন্তু হয়েছে এর অন্যথা। কোয়ান্টাম তত্ত্ব যেন একটা মুক্তির দুয়ার খুলে দিয়েছে আমাদের সামনে! একে ব্যবহার করে আমরা আমূল পালটে নিয়েছি আমাদের জগৎ। আপনার মোবাইলফোন, বা কম্পিউটারটির কথাই ভাবুন। যে সেমিকন্ডাক্টর ট্রাঞ্জিস্টর এর প্রাণভোমরা, সেটা কোনোভাবেই বানানো সম্ভব হতো না যদি কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমাদের জানা না থাকতো। অনেক প্রযুক্তিগত আবিষ্কার আছে (যেমন এক্স রে) যেটা মানুষ অ্যাক্সিডেন্টালি খুঁজে পেয়েছে, পরে গাণিতিক ও তাত্তিকভাবে ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু ট্রাঞ্জিস্টরের ধারণাটাই মানুষ করেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র থেকে। পুরোপুরি তাত্তিক ভাবে। পরে অনেক সাধনার ফলে সেটা আমরা বানাতে সমর্থ হই। এমন আরো আছে, লেজার, নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজন্যান্স (এম আর আই মেশিনে যেটা ব্যবহার হয় ডায়গোনস্টিক সেন্টারে) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং … এই তালিকা ফুরোবার নয়। গত কয়েক দশকে পৃথিবীটা আমূল বদলে গেছে কোয়ান্টাম তত্ত্বে আমাদের পারদর্শিতা বেড়ে যাবার ফলে। আর সামনে আসছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। সে প্রসঙ্গে যাই।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের গল্পটা শুরু করা যাক ১৯৬৫ থেকে। এই সময় গরডন মুর তার বিখ্যাত অনুমানটি করেন, যেটা মূরের সূত্র নামে বিখ্যাত। তিনি বলেন, প্রায় প্রতি দুই বছরে ইঞ্জিনিয়াররা একটা মাইক্রোচিপে ট্রান্সিস্টরে সংখ্যা দ্বিগুন করে ফেলবে। মাইক্রোচিপের উন্নয়ন এখনও পর্যন্ত এই সূত্রকে ভঙ্গ করেনি। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে সামনে বিপদ। এ নিয়ম মেনে আর অল্প কয়েক বছরের মধ্যে একটা মাইক্রোচিপে এত বেশি ট্রাঞ্জিস্টরের যায়গা দিতে হবে যে একেকটা ট্রাঞ্জিস্টরকে হতে হবে একেক্কটা পরমানুর সমান! অর্থাৎ সামনেই বুঝি সেই অলংঘনীয় বাধা! 

অনিশ্চয়তার নীতি বলছে পারমাণুর জগতে বস্তুর অবস্থান, গতি এসব একটা মাত্রার চেয়ে সূক্ষ্মভাবে জানা অসম্ভব! এই অসম্ভবতাটা আমাদের সুক্ষ্ম যন্ত্র তৈরি না করতে পারার কারণে না, বরং একেবারে তাত্তিক ভাবেই একই কনার এই দুইটা রাশির সুনির্ধারিত মান নেই। অর্থাত, আপনি যদি বের করতে পারেন, কনাটির গতি পাঁচ মিটার পার সেকেন্ডের খুব কাছাকাছি, তখন বস্তুটির অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। একটু আগে বলা সেই সেট বর্ণনার মত। অবস্থানের মান তখন একই সঙ্গে অনেক রকম হবে। গতি, অবস্থান এসবের মান কন্টিনিউয়াস ভেরিয়েবল হতে পারে। ফলে ব্যবহার করা মুশকিল। কিন্তু পরমাণুর কক্ষপথে ইলেক্ট্রনের শক্তি বা কোন শক্তিস্তরে ইলেক্ট্রনটা আছে, সেগুলো নির্দিষ্ট ধাপে ধাপে হয়। অর্থাৎ এমন একাধিক বিচ্ছিন মান পাওয়া সম্ভব, যেগুলো কোনো ইলেক্ট্রনের শক্তি হতে পারে। কিন্তু এদের মাঝামাঝি শক্তি নিয়ে কোনো ইলেক্ট্রন পরমানুতে থাকে না। ফলে পরমাণুর কোন শক্তি স্তরে ইলেক্ট্রনটি আছে, সেটা ব্যবহার করে আমরা তথ্য প্রক্রিয়া (ইনফরমেশন প্রোসেসিং) করতে পারি। মানে একটা শক্তি স্থরকে ০ আর অন্য আরেকটা শক্তি স্তরকে ১ ধরলেই হলো। এভাবে যে কোনো ইনফরমেশনকেই আমরা একসার পরমানুর ইলেক্টরণের শক্তিস্তর দিয়ে প্রকাশ করতে পারি। 

এখন তথ্য প্রক্রিয়া করার জন্য আমাদেরকে ইচ্ছা মত ০ কে ১ বা ০ কে ১ করতে পারতে হবে। সেটাও সহজ। কোন ধরনের পরমাণুর কোন শক্তিস্তর ব্যবহার করছি সেটা জানা থাকলে, ঠিক কোন ফ্রিকুয়েন্সির লেজার পাল্স, কত তীব্রতায় এবং কত সময় ধরে পাঠালে এই পরিবর্তন ঘটবে সেটা কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমাদের বলে দেয়। পাই-পাল্স নামক নির্দিষ্ট লেজার পাল্স দিলে, এক আর শূন্যের মধ্যে এই বদল ঘটে। কম্পিউটার বিজ্ঞানে একে বলে “নট” গেট। অর্থাৎ আগে যা ছিলো তার উলটোটা করে দেওয়া। কম্পিউটারের ট্রাঞ্জিস্টর ইন ফ্যাক্ট এ ধরনের কাজই করে। অতয়েব দেখা যাচ্ছে, চাইলে পরমানুকে ট্রাঞ্জিস্টর হিসাবে ব্যবহার করেও আমরা কম্পিউটার বানাতে পারি। 

কিন্তু যেহেতু আমরা কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছি, সেহেতু চাইলে এই পারমানবিক ট্রাঞ্জিস্টরের সাহায্যে এমন কাজ করা যায় যেটা কোনো ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার করতে, বা ক্লাসিক্যাল চিন্তাবিদ চিন্তাও করতে পারবে না। সেটা হলো, আমরা পাই পাল্স না পাঠিয়ে হাফ- পাই অর্থাৎ আগের সময়ের অর্ধেক সময় ধরে পাল্সটা পাঠাতে পারি। তখন ইলেক্ট্রনটা অর্ধেক পথ এসে থাকতে পারবে না। কারণ কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলছে, ইলেক্ট্রণ ঐ দুই শক্তি অবস্থার মাঝা মাঝি কোনো মানের শক্তিতে থাকতে পারে না। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব এটাও বলছে ইলেকট্রনটি চাইলে একই সঙ্গে (নির্দিস্ট মাত্রায়) উভয় শক্তিস্তরেই থাকতে পারে! এই নতুন অবস্থাটাকে আমরা লিখতে পারি ০|১ পরবর্তিতে যদি আমরা আবার আরেকটা হাফ পাই পাল্স পাঠাই, তখন ইলেকট্রনটি তার স্টেট ট্রাঞ্জিশন পুরোপুরি সম্পন্ন করবে এবং আদি অবস্থার উপর নির্ভর করে, ১ থেকে ০ বা ০ থেকে ১ এ গিয়ে থিতু হবে। তাহলে এই যে হাফ-পাই পাল্স দেওয়ার প্রক্রিয়া। এটাকে আমরা “স্কয়ার রুট অফ নট গেট” বা একটা নট গেটের বর্গমূল ভাবতে পারি! কারণ পরপর দুইবার এই গেট প্রয়োগ করার অর্থ হলো একবার নট গেট প্রয়োগ করা। 


চিত্রঃ নট গেটের বর্গমূল

এখন আমরা যদি গণিতের কথা ভাবি। গাণিতিক সত্যগুলো সাধারনত পদার্থবিজ্ঞান নির্ভর নয়। কিন্তু সেসব সত্যকে জানার যে প্রক্রিয়া, সেটা পদার্থবিজ্ঞান নির্ভর। মানে আমরা যেসব ভৌত ঘটনা দেখি, শুনি জানি, সেগুলোর ভিত্তিতেই গাণিতিক মডেলগুলো গড়ে তুলি। এবং আমরা কি কি জিনিশ পর্যবেক্ষণ করি সেগুলো নির্ধারিত হয় পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনেই। আবার গাণিতিক “প্রমাণ” এর কথা ভাবুন। গাণিতিক প্রমাণ হচ্ছে, একের পর কিছু যৌক্তিক বাক্য এবং সে সব বাক্যের উপর আমাদের প্রয়োগ করা লজিক্যাল অপারেশনের (যেমন নট গেট, ইত্যাদি) তালিকা, যার মাধ্যমে আমরা একটা উপসংহারে পৌছাই। এখন যেহেতু, কোয়ান্টাম মেকানিক্স খাটিয়ে আমরা “নট গেট এর বর্গমুল” নামক এক ধরনের নতুন লজিক্যাল অপারেশন করতে পারছি। সেহেতু একেবারে নতুন ধরনের গাণিতিক প্রমান এখন লেখা সম্ভব হবে। এ যেন সেই অভিযাত্রীর সীমানা পেরিয়ে অজানা কোনো জগতে উকি দেওয়া। 

কোয়ান্টাম কম্পিউটার এসব গেট ব্যবহার করে অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারে। কিভাবে সেটা নিচের উদাহরণে দেখি। 

ধরুন একটা ফাংশন আছে f(x) যেখানে x এর মান ১ অথবা ০ হতে পারে। ফাংশনটির আউটপুটও ১ অথবা ০ হয়। ধরি ফাংশনটা কি তা আপনি জানেন না। কিন্তু আপনাকে একটা মেশিন দেওয়া হয়েছে, যেখানে ১ বা ০ ইনপুট দেওয়ার একদিন পরে মেশিনটা আপনাকে ফাংশনটির মান জানায়। এখন আপনাকে প্রশ্ন করা হলো, f(০)=f(১) নাকি f(০)!=f(১)। অর্থাৎ আপনাকে স্রেফ বলতে হবে, উভয় ইনপুটের জন্য আউটপুট একই, নাকি ভিন্ন ভিন্ন। ক্লাসিক্যালি এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে, একবার ০ ইনপুট দিয়ে একদিন অপেক্ষা করা। আউটপুট পাবার পরে, ১ দিয়ে আরেকদিন অপেক্ষা করা। তারপর আউটপুটগুলো সমান নাকি অসমান সেটা দেখে উত্তর দেওয়া। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে এই সমস্যা মেশিনটিকে মাত্র একবার ব্যবহার করেই সমাধান করা সম্ভব। আমরা যদি ০ কে নিয়ে প্রথমে “নট গেট এর বর্গমূল” চালাই। তখন সংখ্যাটি একই সংগে ১ ও ০ হয়ে যাবে। এই অবস্থায় মেশিনটি একবার মাত্র ব্যবহার করে। আমরা একই সঙ্গে তাদের ফাংশন মান দুটি সমান নাকি অসমান সেটা গণনা করতে পারি। যেখানে ক্লাসিক্যাল কোনো যুক্তিতেই, দুইবারের কম ব্যবহার করে সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব নয়। এই অতি সুন্দর গাণিতিক ট্রিকটা সঙ্গত কারণেই এই লেখায় পাঠকের সাথে শেয়ার করতে পারছি না। আগ্রহী পাঠকরা ডয়েট্স অ্যালগরিদম (Deutsch’s algorithm) লিখে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখে নিতে পারেন। 

কোয়ান্টাম লজিক শুধু “নট গেট এর বর্গমূল”-ই না, এমন আরো অনেক কিছুই করতে দেয়। এবং সেগুলো ব্যবহার করে যুক্তিবিদ্যা থেকে শুরু করে গণনা, গাণিতিক প্রমাণ পদ্ধতি সবকিছুতেই আমূল পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এইসব ফাংশন গণনার ব্যাপার স্যাপার যদি আপনাকে ইম্প্রেস করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বলি। এটা তো জানা যে কোনো ধুমকেতু, কোনো গ্রহ, বা উপগ্রহ কবে কোথায় কিভাবে থাকবে সব আমরা গণনা করে ফেলতে পারি নিক্ষুত দক্ষতায় (অবশ্যই কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে) কিন্তু অণু পরমাণু, এসব যেহেতু কোয়ান্টাম তত্ত্বের নিয়ম মেনে চলে সেহেতু আমাদের এখনকার কম্পিউটারে (যেটাকে বলি ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার) এগুলোর গাঠনিক ও ক্রিয়া-বিক্রিয়ার হিসাব সহজে করতে পারে না। ইন ফ্যাক্ট মাত্র কয়েকটা পরমাণু তাদের ইলেক্ট্রন প্রোটন নিয়ে একে অপরের সাথে কিভাবে বিক্রিয়া করবে, সেটা এখনকার কম্পিউটারে হিসাব করতে যে মেমরী দরকার, তা বানাতে কয়েকটা (ইন প্রিন্সিপ্যল) গ্রহ খরচ হয়ে যেতে পারে! আর সময় লাগবে মহাবিশ্বের বয়সের চেয়ে বেশি। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার যেহেতু নিজেই কোয়ান্টাম লজিক মেনে চলে, সেহেতু অণুপরমাণুর কোয়ান্টাম ইন্টার্যাকশনের হিসাব, সে করতে পারবে সহজাত ভাবেই। ফলে, ইচ্ছে মত নতুন নতুন যৌগ তৈরি সম্ভব হবে। যেমন হয়তো কোনো একটা জীবানূকে ঘায়েল করতে ঠিক নির্দিষ্ট বৈশিষ্টের অণু দরকার। কোয়ান্টাম কম্পিউটারে হিসাব করেই মূহুর্তের মধ্যে সেটা বের করা সম্ভব হবে। এমনকি সেটার প্রস্তুত প্রনালীও বের করে ফেলতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। বা হয়তো সূর্যের আলোকে সরাসরি তড়িৎ প্রবাহ, বা সরাসরি কৃত্রিম সালোক সংশ্লেষনের মাধ্যমে গ্লুকোজ বানানো দরকার তেমন কিছু বানাতে কি করতে হবে সেটাও সুক্ষ্মভাবে সিমুলেট করতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। 

বাজে ফিলোসফি বনাম কোয়ান্টাম তত্ত্ব
[এ অংশটি ডেভিড ডয়েট্স এবং আর্থার একার্ট (বর্তমান সময়ের দুজন শীর্ষ কোয়ান্টাম পদার্থবিদ)-এর লেখা আর্টিকেলটির শেষাংশের অনুলিখন] 

কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে কোনো কণিকা যদি কোনো অবস্থায় একাধিক পথে যেতে পারে তাহলে কখনো কখনো সেটা একই সঙ্গে একাধিক পথে যায়। এই একি সঙ্গে একাধিক পথে যাওয়াটা আমাদের সেট বর্ণনা অনুযায়ী দেখতে পারি এভাবে। ধরুন একটা পরীক্ষায় দুটো পথ আছে, বাম পথ আর ডান পথ। যেগুলো দিয়ে কিছু কনিকা যেতে পারে। আমি একটা সেট ঘোষণা করলাম। “বাম পথ দিয়ে যাওয়া কণিকার সেট”। এখন ক্লাসিক্যাল যুক্তিতে পরীক্ষায় ব্যবহৃত যে কোনো কণিকা হয় বাম পথ দিয়ে গেছে অথবা ডান পথ দিয়ে গেছে। ফলে সেটি নিশ্চিত ভাবে সেটটির ভিতরে আছে অথবা বাইরে। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী, কনাটি একই সঙ্গে উভয় পথ দিয়েই যেতে পারে। তখন আর আমাদের ক্লাসিক্যাল সেট তত্ত্ব অনুযায়ী এটাকে সেটের ভিতরে বা বাইরে বলা সম্ভব হয় না। এই তত্ত্বের জনক স্রডিঞ্জার এক ভাষণে এই কথা বলার আগে শ্রোতাদের সতর্ক করেছিলেন, “আমি যা বলতে যাচ্ছি তা হয়তো পাগলের প্রলাপ মনে হবে”। পরবর্তিতে ১৯৩৩ সালে তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য নোবেল প্রাইজ পান। কিন্তু এই তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তোলপাড় ফেলে দেয়। আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি কিন্তু এতটা বিতর্কের জন্ম দেয়নি। যদিও সেটাও আমাদের বাস্তবতার ধারণা আমূল পালটে দিয়েছিলো। 

এই বাড়তি তোলপাড়ের কারণ হচ্ছে “বাজে ফিলোসফি”। “দর্শন এবং মৌলিক পদার্থ বিজ্ঞান এতটাই সম্পর্কিত- (যদিও উভয় পক্ষই বহুবার এ কথা অস্বীকার করতে চেয়েছে)- যে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকগুলোতে দর্শন যখন দ্রুত অধপতিত হচ্ছিল, সেটা পদার্থবিজ্ঞানকেও বেশ খানিকটা টেনে নামিয়ে ফেলে। 

কালপ্রিটগুলো হচ্ছে, লজিক্যাল পজিটিভিজম (যদি কিছুকে এক্সপেরিমেন্টালি ভেরফাই করা না যায়, সেটা অর্থহীন), ইনস্ট্রুমেন্টালিজম (তত্ত্বের অনুমান যদি কাজ করে, তাহলে এর পিছনের কারণ নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই) এবং ফিলোসফিক্যাল রিলেটিভিসম (কোনো স্টেটমেন্ট নৈর্বক্তিকভাবে সত্য কিংবা মিথ্যা হতে পারে না, স্রেফ কোনো নির্দিষ্ট কালচার সেটাকে গ্রহনযোগ্য বা অগ্রহনযোগ্য হিসাবে গন্য করে)। ক্ষতিটা করেছিলো, এসব মতবাদের মধ্যে যেটা কমন, সেটা- (ডিনায়াল অফ রিয়ালিজম) বাস্তবতাবাদকে অস্বীকার, বা একথা অস্বীকার করা যে ভৌত জগতের অস্তিত্ব আছে, এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে সে সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা সম্ভব। 

এরকম একটা দার্শনিক পরিবেশেই নীল্স বোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের একটা প্রভাবশালী ইন্টারপ্রিটেশন দাঁড়া করান, যেটা নৈর্বক্তিকতা (অবজেক্টিভিটি) নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনার সম্ভাবনাই নস্যাত করে দেয়। এই ইন্টারপ্রিটেশনে কোনো চলকের মান, তাকে যখন অবজার্ভ করা হচ্ছিলো না তখন কত ছিলো সেই প্রশ্ন করাই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পদার্থবিজ্ঞানীদের পক্ষে যদিও এসব প্রশ্ন না করে থাকা মুশকিল। তারপরেও তারা নিজেদের বিরত রাখার চেষ্টা করেন। এবং নিজেদের ছাত্রদেরো সেই শিক্ষাই দেন। এভাবে সবচে মৌলিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে অগ্রসর তত্ত্বটি জোর গলায় সত্যের অস্তিত্ব, ব্যাখ্যা এবং ভৌত বাস্তবতা কেই অস্বীকার করতে শুরু করে। 

অবশ্য সব দার্শনিক বাস্তবতাবাদকে পরিত্যাগ করেননি (যেমন বারট্রান্ড রাসেল এবং কার্ল পপার) পরিত্যাগ করেননি সকল পদার্থবিদও (যেমন আইনস্টাইন, ডেভিড বম (Davit Bohm) নতুন এই ট্রেন্ডের বিরোধিতা করেন)। হউহ এভের্ট (Hugh Everett) প্রস্তাব করেন, আসলেই ভৌত রাশিমালা একই সঙ্গে একাধিক মান ধারণ করে (এই ধারনাটাই কোয়ান্টাম কম্পিউটেশনের মূলনীতির সাথে যায়)। (অর্থাৎ দুইটি পর্যবেক্ষনের মধ্যবর্তী সময়ে রাশিটির মান একই সঙ্গে একাধিক রকম হতে পারে। যেটাকে বলে বিকল্প ইতিহাস। ফাইনম্যানের ফর্মুলেট করা কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিক্স এই বিকল্প ইতিহাস তত্বকেই ব্যবহার করছে খুবই সফল ভাবে। এ নিয়ে গ্র্যান্ড ডিজাইন বইটার “বিকল্প ইতিহাস” অধ্যায়টা পড়া যেতে পারে।) সে সময়, দার্শনিকরা ছিলো বাস্তবতার ব্যাপারে উদাসীন, আর পদার্থবিদরা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব কে কেবলমাত্র একটা টুল(হাতিয়ার) হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। আর এতসব ডামাডোলে কোয়ান্টাম প্রক্রিয়ার স্বরূপ কেমন, সেই মৌলিক গবেষণার প্রচেষ্টাই হারিয়ে যায়। 

গত কয়েক দশকে ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। পদার্থবিজ্ঞানই দর্শনকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনছে। কারণ যত জোরেই অস্বীকার করুক না কেন, মানুষ বাস্তবতাকে জানতে চায়। ফলে আমরা এতদিনে বাজে দর্শনের (ব্যাড ফিলোসফি) এঁকে দেওয়া সেই গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছি। 

কি হবে যদি এই তত্ত্ব ভুল পরিগনিত হয়? কি হবে যদি স্কেলেবল কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সেই ধরণের ফলাফলও সাদরে গ্রহীত হবে। কারণ তখন কেন এই তত্ত্ব ভুল সেটা আমরা জেনে যাবো। যার অর্থ আরো শক্তিশালী তত্ত্ব এসে ধরা দেবে আমাদের হাতে। যার সাহায্যে সম্ভব হবে আরো শক্তিশালী অকল্পনীয় সব গণনা। যাই হোক না কেন, জ্ঞান আহরণ আর অগ্রগতি কখনোই থেমে থাকবে না। 

*লেখাটিতে উদার হস্তে সাহায্য নিয়েছি সায়েন্টিফিক আমেরিকান সেপ্টেম্বর ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত ডেভিড ডয়েট্স এবং আর্থার একার্টের লিখিত আর্টিকেল Beyond Quantum Horizon থেকে। 

*একটানে লিখেই পোস্ট করে ফেললাম। সঙ্গত কারণেই লেখায় হাজার হাজার ভুল থাকার কথা। কিছু চোখে পড়লে জানাতে ভুলবেন না।