[বাবা পড়ে আছে মর্গে / লালমোহনের মেয়ের মাধ্যমিক /পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষিত করগে /’এনকাউন্টার’ হলো কী বাস্তবিক?…সুমন কবিরের গান]
পাহাড়ি আদিবাসী নেত্রী কল্পনা চাকমার মতোই চলেশ রিছিল এখন টাঙ্গাইলের মধুপুরের গারো ও কোচ আদিবাসী অধ্যুষিত শালবনের অমিংমাসিত অধ্যায়।
বছর আটেক আগে মধুপুরের শালবন গর্জে উঠেছিলো বন বিভাগের একতরফা ইকো-পার্ক প্রকল্পের বিরুদ্ধে। সে সময় আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিল আদিবাসীদের সংগঠিত করেন ইকো-পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলন। এ জন্য পাঁচ বছর আগে যৌথবাহিনীর ‘এনকাউন্টারে’ জীবন দিতে হয় তাকে। আন্দোলনের সময়ই পুলিশ ও বনরক্ষীদের গুলিতে প্রাণ যায় পিরেন স্নাল নামক আরেক আদিবাসী নেতার। পিরেনের রক্তের বিনিময়ে সে সময় বাতিল হয় ইকো পার্ক প্রকল্প। কিন্তু বাতিল এ প্রকল্পের বন মামলার দায় এখনো বহন করে চলেছেন মৃত চলেশ। এ মামলায় ‘গরহাজির’ থাকায় সম্প্রতি আদালত তাঁর বিরুদ্ধে সমনও জারি করেছেন!
আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিশোধের আগুন
কিছুদিন আগে মধুপুরের বিস্তৃর্ণ শালবনে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, চলেশ রিছিল ও ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনে তার সহযোদ্ধা সংগ্রামী আদিবাসী জনতার হাল-হকিকত।
টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে ৪৭৮ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী শালবনে কয়েক শ বছর ধরে প্রায় আড়াই হাজার গারো ও কোচ আদিবাসীর বসবাস। ২০০০ সালে বন বিভাগ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সেখানে ইকো পার্ক প্রকল্প করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, বনের মাঝখানে হবে ১০টি পিকনিক স্পট এবং ছয়টি ব্যারাক। বিশাল জায়গাজুড়ে দেওয়াল তুলে ঘিরে ফেলা হবে পুরো পার্ক এলাকা। তবে সে সময় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বন কর্তৃপক্ষ বনের স্থানীয় অধিবাসী আদিবাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। বন থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কায় আদিবাসীরা ইকো পার্ক প্রকল্প প্রতিরোধের জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন।
২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি বনরক্ষী ও পুলিশ গুলি চালালে আদিবাসী নেতা পিরেন স্নাল মৃত্যুবরণ করেন। গুলিতে আহত হন ৩৪ জন নারী-পুরুষ। এরপর সরকার মধুপুর ইকো পার্ক প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে। তবে সেই সময় আন্দোলনে জড়িত আদিবাসী নারী-পুরুষের বিরুদ্ধে বন আইনে শত শত মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলাগুলো এখনো চলছে।
মধুপুরের এমন ‘রাজনৈতিক হয়রানীমূলক মামলা’র সংখ্যা আনুমানিক প্রায় পাঁচ হাজার মামলা। বছরের পর বছর ধরে এসব মামলার দুর্ভোগে এখন তাঁদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। শুধু তাই-ই নয়, ১০ থেকে ১৫ বছরের পুরনো আরো অনেক বন মামলা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা, স্কুলশিক্ষক, ছাত্র, কৃষিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার আদিবাসীর বিরুদ্ধে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জেলা সদরে এসে এসব মামলার খরচ চালাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হতে বসেছেন। বন মামলায় কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পেয়ে নতুন করে আবারও জড়িয়ে পড়েছেন মামলায়- এমন নজিরও রয়েছে। এভাবে মামলার মরণফাঁদে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে সেখানের আদিবাসী জীবন। অথচ আগেই বলা হয়েছে, আন্দোলনের মুখে মধুপুর ইকো পার্ক প্রকল্পটি সরকার আট বছর আগেই বাতিল ঘোষণা করেছে।
চলেশ রিছিল: ইতিহাসের অমিমাংসিত অধ্যায়
কে এই চলেশ রিছিল? কেনো তিনি এক-এগারোর সেনা সমর্থিত অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ভীতিকর হয়ে উঠেছিলেন? ঠিক কী ছিলো তার অপরাধ?
এই সব প্রশ্নের জবাব তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ানো হয় ঝিরঝির বৃষ্টির ভেতর, শালবনের পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত পথে তরূণ আদিবাসী গাইডের মটরসাইকেলে পেছনে চড়ে। জলছত্র, কাঁকড়াগনি, বেদুরিয়া, জয়নাগাছাসহ বিভিন্ন এলাকার আদিবাসীরা বলছেন, ইকো পার্ক আন্দোলনের সাফল্যের কারণে চলেশ রিছিল হয়ে উঠেছিলেন সেখানের আদিবাসীদের আশা-ভরসার প্রধান আশ্রয়স্থল। তিনি আন্দোলন সংগঠিত করে মধুপুরের সব আদিবাসীদের মনে আশার সঞ্চার করতে পেরেছিলেন যে, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে কাঠচোর বন বিভাগই একক ও শেষ কর্তৃত্ব নয়। বরং বনের ওপর আদিবাসীদেরই প্রধান অধিকার। শত সহস্র বছর ধরে সেখানের চাষ-বাস গড়ে তোলায় বনজ সম্পদের ওপরে তাদেরই প্রধান কর্তৃত্ব থাকা প্রয়োজন। এ জন্য বন বিভাগ বৃহত্তর মধুপুর অঞ্চলে চলেশ রিছিলকে সমান্তরাল সরকার বলে মনে করে, তাকে তারা যথেচ্ছ বন উজাড়ে প্রধান হুমকি বলে ধরে নেয়।
চলেশ রিছিলের সহযোদ্ধারা জানান, গত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলকে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী। পরে পুলিশ ‘এনকাউন্টার/ক্রসফায়ার’ এ নিহত বলে দাবি করে চলেশের পরিবারকে তাঁর মৃতদেহ হস্তান্তর করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী আদিবাসীদের অভিযোগ, গ্রেপ্তারকৃত চলেশ রিছিলকে জানালার গ্রিলে ঝুলিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ৯ সদস্য নির্যাতন করেছিল। এ কারণেই সে সময় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁরা জানান, চলেশের মরদেহ পরীক্ষা করে দেখা হয়, তাঁর চোখ দুটো ছিল উপড়ানো, ডান হাতের তিনটি আঙুলের নখও উপড়ে ফেলা হয়েছিল। তাঁর অণ্ডকোষ নষ্ট করে দেওয়া হয়, সারা গায়ে ছিল প্রচণ্ড আঘাতের চিহ্ন। মরদেহের ছবিতেও নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট ধরা পড়ে।
পাহাড়ি নেত্রী কল্পনা চাকমা সামরিক জান্তা কর্তৃক অপহরণের দেড় যুগ পরেও এই রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার লংঘনের বিচার হয়নি। দেড় যুগ ধরেই তার সতীর্থরা কল্পনা চাকমা অপহরণের সুবিচার দাবি করে আসছেন। আর তবু বাংলাদেশ নামক বাংলা ভাষাভাষির কর্তৃত্বপরায়ন রাষ্ট্র কল্পনা চাকমা অপহরণের দায় বহন করেই চলেছে ওই দেড়যুগ ধরেই।…
বলা ভালো, কল্পনা চাকমা একই সঙ্গে পাহাড়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণগুলোর একটি; আবার একই সঙ্গে তিনি আন্দোলনের প্রেরণাও। মধুপুরে যৌথবাহিনীর হেফাজতে নিহত চলেশ রিছিলও তাই। তিনিও এখন ইতিহাসেরই আরেক অমিমাংসিত অধ্যায়। আবার একই সঙ্গে আদিবাসীর আন্দোলনের প্রেরণাও। …গত পাঁচ বছরেও তার হত্যার বিচার তো হয়ইনি, উপরন্তু তার নামে সমন জারি করে রাষ্ট্রপক্ষ কী মারাত্নক প্রহসনই না করে চলেছে!
বন মামলা: অরণ্যবাসীর গলার ফাঁস
মধুপুরের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে বন মামলা নেই, এমন আদিবাসী নারী-পুরুষ খুঁজে পাওয়ায়ই দুস্কর। এজাহারভূক্ত বন মামলার আসামী ছাড়াও শত শত বন মামলায় ‘অজ্ঞাত পরিচয়ের আসামী’ রয়েছে আরো প্রায় কয়েক হাজার। বন বিভাগ চাইলেই এসব মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বী যে কোনো আদিবাসীর নাম ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে গ্রেফতার ও হয়রানী করতে পারে; এমনটি তারা যথেচ্ছ করেও চলেছে।
ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনটি যেহেতু সে সময় আদিবাসীর সামাজিক আন্দোলন, তথা জীবন-জীবিকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, তাই এই প্রতিরোধ আন্দোলনে তখন আদিবাসীরা দলে দলে যোগ দেন।
প্রত্যন্ত পশ্চিম কাঁকড়াগনি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসী পঞ্চরাজ গাগরা (৫৮) এই লেখককে বলেন, ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের দায়ে ২০০৩ সালে তাঁর বিরুদ্ধে বন আইনে চারটি মামলা হয়। পরে ২০০৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আরো পাঁচটি মামলা। এসব মামলায় মোট ৭০ দিন কারাভোগের পর এখন তিনি জামিনে রয়েছেন। সবশেষ গত ৩০ এপ্রিল তিনি একটি মামলায় জেলা জজ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। তবে একই দিন একই মামলায় হাজিরা না দেওয়ার জন্য নিহত আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলের বিরুদ্ধে আদালত একটি সমন বা হাজিরাসংক্রান্ত পরোয়ানা জারি করেন।
তিনি জানান, ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনে পিরেন স্নাল নিহত হওয়ার দিনে (২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি) নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে পঙ্গু হন বেদুরিয়া গ্রামের উৎপল নকরেক। আদালতে নিয়মিত হাজিরা না দেওয়ায় গত ৩০ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধেও সমন জারি করা হয়েছে।
কৃষিজীবী পঞ্চরাজ গাগরা বলেন, এটি ছিল আমাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন। তাই আদিবাসীরা এই সামাজিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ছড়রার গুলিতে আমার স্ত্রী রহিলা সিমসাং, ছেলে মিঠুন, যুবরাজ ও তরুণ মারাত্মক আহত হয়। কিন্তু বন মামলার ভয়ে আমি তখন তাদের লুকিয়ে চিকিৎসা দিতে বাধ্য হই। এখন অভাবের কারণে আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছে। অন্যদিকে বছরের পর বছর জেলা সদরে গিয়ে মামলার খরচ চালাতে গিয়ে আমার এখন পথে বসার দশা।
বেদুরিয়া গ্রামের কেজাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মালতী নকরেক (৪৫) জানান, একই বছর ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে রসুলপুর রেঞ্জ বন বিভাগ তিনটি বন মামলা করে। এই মামলাগুলোতে তিনি এখন জামিনে আছেন। তাঁর স্বামী আবেল মানখিনও (৫০) একই রকম আরেকটি মামলার আসামি ছিলেন। তবে ২০১০ সালে ওই মামলাটি থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন।
জয়নাগাছা গ্রামের কৃষক ইলারি কুবি (৪১) জানান, ১২ বছর আগে কয়েকজন আদিবাসী যুবক মিলে কাঠচোরদের একটি মোষ টানা গাড়ি আটক করেছিল। বন কর্তৃপক্ষ উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই কাঠ চুরির মামলা দায়ের করে। ১৯৯৬ সালের ওই মামলাটির পর ২০০৪ সালে ইকো পার্ক প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হয় আরেকটি মামলা। শেষের মামলায় ২৪ দিন কারা ভোগ করে এখন তিনি দুটি মামলাতেই জামিনে আছেন।
তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, আমরা আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় মধুপুরের এই শালবনে বাস করছি। অরণ্যের সন্তান হিসেবে যুগ যুগ ধরে আমরাই বন, জঙ্গল ও প্রকৃতিকে রক্ষা করে চলেছি। অথচ বরাবরই বন কর্তৃপক্ষ আমাদের বনের শত্রু মনে করে আসছে। তাই তারা আমাদের এভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। মামলার হাজিরা দিতে দিতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। আমাদের কারো মনে কোনো সুখ নেই।
‘আমরা দেখছি কী করা যায়’
এসব বিষয়ে বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে, সেই গঁত বাধা ছেলে ভুলানো বুলি: আমরা দেখছি, কী করায়! তবে বন কর্তৃপক্ষ নির্লজ্জের মতো স্বীকারও করেন শত শত মামলায় আদিবাসীদের অহেতুক হয়রানী করার কথা।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) অসীত রঞ্জন পাল এই লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় স্বীকার করে বলেন, দু-আড়াই বছর আগেও প্রতিবছর মধুপুরে গড়ে সাড়ে তিন শ বন মামলা দায়ের করা হতো। আমি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আমার নির্দেশে এসব মামলায় কাউকে হয়রানির শিকার যাতে না হতে হয়, সে জন্য গত দুই বছরে এখানে নতুন কোনো মামলা হয়নি। তিনি আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে বলেন, এখন আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, ১০-১৫ বছরের পুরনো বন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার।
অন্যদিকে এসব শুকনো আশ্বাসের বাণীতে শেষ পর্যন্ত চিড়া ভিজছে না। আদিবাসী নেতারা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মধুপুরের জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, আন্দোলনে নিহত চলেশ রিছিলের বিরুদ্ধে বন মামলায় সমন জারির ঘটনাই প্রমাণ করে মধুপুরে বন কর্তৃপক্ষ আদিবাসীদের বিরুদ্ধে কী নির্মম নির্যাতনই না চালাচ্ছে! …আমরা একের পর এক সরকার, বন ও পরিবেশমন্ত্রী, সচিব, বন বিভাগ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে হয়রানিমূলক বন মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের দাবি, যেন একটি বিশেষ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দ্রুত হয়রানিমূলক বন মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সরকারই আমাদের দাবি পূরণে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।…
মুক্তিরো-মন্দিরো সোপানো তলে, কতো প্রাণ হলো বলি দান
আদিবাসী বিষয়ক বিভিন্ন সভা, সেমিনার, গোল টেবিল আলোচনা, জনসভাসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে প্রায়ই দেশের প্রত্যন্ত আঞ্চলের আদিবাসীরা নিজ নিজ শোষণ, বঞ্চনার কথা বলতে গিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। হতাশা ছড়ায় দাতা গোষ্ঠির অর্থপুষ্ট এনজিও কাম মানবাধিকার কর্মীদের কণ্ঠেও। এই ঘোর অন্ধকারের শেষ কোথায়? কোথায় সেই কাঙ্খিত মুক্তির দিশা?
সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন, মানুষের নির্ভুল চিন্তা আকাশ থেকে পড়ে না। এগুলো মাটি ভেদ করেও উদিত হয় না। অনুশীলন থেকেই মানুষের নির্ভুল চিন্তার উৎপত্তি ঘটে। তাই আন্দোলনের অনুশীলনেই ওই প্রশ্নসমূহের জবাব নিহিত।
অর্থাৎ, সিঁধু-কানহু, বিরসা মুন্ডা, এমএন লারমা, আলফ্রেড সরেন, পিরেন স্নাল, চলেশ রিছিলের প্রদর্শিত রক্তে পিচ্ছিলই পথই আদিবাসীর মুক্তির পথ। …তবে বাস্তবতা বলছে, আদিবাসীর একক আন্দোলনে তার মুক্তি নেই; এ আন্দোলনে প্রগতিশীল অ-আদিবাসীদেরও তার সাথে থাকা চাই।
___
ছবি: চলেশ রিছিল, ফাইল ফটো ও নিহত হওয়ার পরে এবং চলেশের সহযোদ্ধা প্রতাপ জাম্বিল, আদিবাসী ফোরামের সৌজন্যে।
___
সংযুক্ত: ১. বন মামলায় সংকুচিত আদিবাসীদের জীবন, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৯ আগস্ট ২০১২।
২. Nightmare in Modhupur, Star Weekend Magazine, March 30, 2007
যতদূর জানি , পাট্রিসিয়া বিউটেনিসের চাপে চলেশ রিছিলের মৃত্যুর প্রায় তিন মাস পরে তার দেহাবশেষ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়মনসিংহ মেডিকেলে ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছিলে। সেই ময়নাতদন্তের রিপোর্টে কি পাওয়া গেল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে কি রকম আইনগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তা জানি না। মামলাটি কি এখনও নথিভুক্ত আছে ? চলেশ রিছিলের মৃত্যুপূর্ব জীবন বৃত্তান্ত , তার পেশা ইত্যাদি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জানালে মুক্তমনা পাঠকেরা উপকৃত হতেন।
সেসময় আমাদের বিশ্ববিদ্যারয় জীবন মাত্র শুরু হয়েছে। চলেশ রিছিলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে আমরা যখন তার প্রতিবাদ করেছিলাম- তখন আমাদের জরুরী অবস্থার জুজু দেখানো হয়েছিলো; শুধু তাই না- সেই প্রতিবাদে অঙশগ্রহণ করায় আমাদের বিভাগের দুজন (আমিও আছি) ছাত্রকে একজন কোর্স শিক্ষক বলেছিলেন- এরা পাশ করে সন্ত্রাসী হবে। যথারীতি আমরা কোর্স ভাইভায় কেবল পাশ মার্ক পেয়েছিলাম।
চলেশ রিছিলের জন্য হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা। বিপ্লব ভাইকে ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
@শনিবারের চিঠি,
প্রতিবাদী মিছিলে স্বাগতম। যাত্রা হোক শুভ। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
আপনার এ লেখাটি পড়ে গিদিতা রেমার কথা মনে পড়ল। টাঙ্গাইলের মধুপুরে সে ২০০১ সালে খুন হবার পর আমরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলাম।যতদূর মনে পড়ে সঞ্জীব দ্রং ও আমাদের সাথে ছিলেন। কিন্তু কোন এক অলিখিত কারণে বা অন্য সব ঘটনার মতই সময়ের স্রোতে বিষয়টি বিলীন হয়ে যায়। এমন কত খুন যে সংঘটিত হচ্ছে কে তার হিসেব রাখে, আপনার মত দুয়েকজন ছাড়া।
লেখা অব্যহত থাকুক।।
আপনার লেখা পড়ে বিরিশিরি, বিড়ইডাকুনী, রাংরাপাড়ার স্মৃতি জেগে উঠলো। মাঝে অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, তবে তিমির কাটেনি বুঝলাম।
আচ্ছা, আদিবাসী আন্দোলনে প্রমোদ মানখিন এর মত নেতাদের ভূমিকা কি ছিলো অথবা সঞ্জীব দ্রং এর মত মানবাধিকার কর্মীদের?
@কেয়া রোজারিও,
আপনার মতামত সব সময়েই খুব প্রেরণাদায়ক।
সঞ্জিব দ্রং বরাবরই আদিবাসীর অধিকার আদায়ে সোচ্চার। তবে আদিবাসী নিপীড়নের ধারাবাহিকতা থেকে তিনিও মুক্ত নন। দুবছর আগেও তার ওপর সশস্ত্র হামলা হয়েছে [ দ্র. সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাইলেন সঞ্জীব দ্রং]
ওই হামলার নেপথ্যে বতর্মান সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানখিনের প্রত্যক্ষ মদদ ছিলো বলে জেনেছি। প্রমোদ মানখিন যতটুকু না আদিবাসী নেতা, তারচেয়ে বেশী আওয়ামী লীগ নেতা। দীপংকর তালুকদার, যতিন্দ্র লাল ত্রিপুরা, বীর বাহাদুর, এথিন রাখাইন প্রমুখও তাই।
আবারো সঙ্গে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ। (Y)
ভাষা নেই 🙁
@রৌরব,
সঙ্গে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ। (Y)
চলেশ রিছিলের ওপর কি বীভতস নির্যাতন হয়েছিল তা জাফর ইকবালের কলাম থেকে পড়েছিলাম। পাক আর্মি প্রদত্ত শিক্ষা আমাদের বাহিনীরাও পেয়েছে আরেকবার বুঝেছিলাম।
তবে মানবাধিকারের কান্না ফান্না অন্তত বাংলাদেশে গেয়ে লাভ নেই। উর্দিওয়ালাদের কচুও করতে পারবেন না। সরকারী যুবলীগের নেতা গুম খুনের ঘটনায় র্যাবকে দায়ী করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। সে রিপোর্টের ব্যাপারে র্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বক্তব্য শুনেন,
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-08-12/news/281302
বোঝেন একবার, উর্দির কি মহিমা, নিজ মন্ত্রনালয়ের ওপর ওয়ালার রিপোর্টের দাম হল প্রকাশ্যেই দুই পয়সা, যেখানে ভিক্টিম হল মহা পরাক্রমশালী সরকারী দলের নেতা। আর বিচার আশা করেন কোথাকার কোন আদিবাসী চরেশ রিছিলের হত্যা নির্যাতনের।
@আদিল মাহমুদ,
এরা হচ্ছে সেই ফ্রাঙ্কেস্টাইন, যারা জন্মদাতাকে অস্বীকার করে, হয়তো একসময় তাকে খুন করে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবে না। আপনি ঠিকই বলেছেন, এদের কাছে সুবিচার প্রার্থণা করা বৃথা। তবে যতোদিন না কল্পনা চাকমা অপহরণ বা চলেশ রিছিল হত্যার বিচার না হচ্ছে– ততদিন বাংলাদেশ নামক কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকেই এইসব চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় বহন করতে হবে।
আর তাদের প্রদর্শিত সংগ্রামের পথই আদিবাসীর মুক্তির পথ।
ভাবনাটিকে উস্কে দেওয়ায় অনেক ধন্যবাদ। চলুক।
এই যে আমরা ঘুমিয়ে আছি, কুম্ভকর্ণের ঘুম; কেন ডাক-ঢোল পিটিয়ে বৃথাই আমাদের মধ্যবিত্ত ঘুম ভাঙ্গাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জানেন তো, আমরা সময় বুঝে বুঝে জেগে উঠবো, এমন সব বিষয় নিয়ে, এমন সব কারণে যে রাষ্ট্রযন্ত্র তখন আমাদের মন্তব্যে যারপরনাই আনন্দিত হয়ে নিজেই চলে যাবে কুম্ভকর্ণের ঘুমে।
তবুও লেখাটা কাঁটা হয়ে বিঁধে রইলো রাষ্ট্রের গলায়।
আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটা গান মনে পড়ে গেলো।
আলু বেচো ছোলা বেচো … কান্না বেচো না …স্বপ্ন বেচো না।
httpv://www.youtube.com/watch?v=P2qNCiJnFVQ
@স্বপন মাঝি,
কণ্টন যাতনাটুকু জরুরি। আবারো সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ। (Y)
বিপ্লব ভাই, আপনার লেখাটার জন্য ধন্যবাদ। আপনি কষ্ট করে যে একটা ভালো কাজ করছেন তা যে কেউ বুঝতে পারছে। কিন্তু আমি একটা দিক থেকে একটু পিছনের দিকেই থেকে যাচ্ছি, আর তা হোলো বাঙলাদেশ সরকারের সাথে আদিবাসীদের এই সংগ্রামের সূত্রপাত বা কারণ কি? আমি তাদের ইতিহাস অনেকটাই জানি, কিন্তু এর যে শুরুটা কিভাবে আমি সত্যিই তা জানিনা। আমাকে কি সংক্ষেপে একটু দয়া করে জানানো সম্ভব?
ধন্যবাদ।
@আদনান,
আপনার আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। খুব সংক্ষেপে বলছি: বাংলাদেশে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের সমস্যা ঠিক একই রকম নয়। তবে প্রধান সমস্যা অবশ্যই জাতিগত; সংঘাতটি পাহাড়, ভূমি, অরণ্য, জলা, এককথায়– জমিকে কেন্দ্র করে, বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠির সঙ্গে এই সংঘাত বংশপরম্পায় চলে, কখনো কখনো এই সংঘাতটিতে সরকার ও তাদের নানান বিভাগ [যেমন, মধুপুরে বন বিভাগ] -এর সঙ্গেও সরাসরি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সংঘাতের সূচনা সেই ষাট দশকে, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করে প্রথম তাদের ওপর বড়ো ধরণের আঘাত হানা হয় [দ্র. Chittagong Hill Tracts] স্বাধীন দেশে অস্বীকার করা হয় তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি [‘তোরা সবাই বাঙালি হইয়া যা’], শুরু হয় রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্ব-সংঘাত [দ্র. গেরিলা নেতা এমএন লারমা]। একের পর এক গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়নে বিপর্যস্ত পাহাড়ি জনপদে শান্তিচুক্তি আশার সঞ্চয় করে [দ্র. একটি প্রায় বিস্মৃত গণহত্যার কথা]। কিন্তু চুক্তির মৌলিক শর্তসমূহ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে জাতিগত হামলা-সহিংসতা এখনো চলছেই [দ্র. পাহাড়ে কেন এত সহিংসতা?]…পাহাড়ে ব্যাপক হারে সামরিকীকরণ এবং বাঙালি সেটেলার অভিবাসনও এই সংঘাতটিকে বরাবরই তীব্র করেছে [দ্র. Life is not Ours, Land and Human Rights in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh]।
অন্যদিকে, উত্তর জনপদে সাঁওতাল, উঁরাও, মুন্ডাসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির জমি-জমা বৃহত্তর অ-আদিবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠি নানান মামলা-মোকদ্দমায় হাতিয়ে নিচ্ছে। খাস জমিতে বংশপরম্পায় বসবাস করলেও জমির বন্দোবস্তিও তাদের নামে দেওয়া হয় না। সরকার ও প্রশাসন বরাবরই দুষ্টচক্র-দখলদারদের পক্ষে কাজ করে [দ্র. সরেজমিন দিনাজপুর : : দখলদারদের থাবায় আদিবাসীদের জমি এবং বিশ্ব আদিবাসী দিবস পরবর্তী একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ]। জমির বন্দোবস্তি না পাওয়ার একই রকম সমস্যা বৃহত্তর সিলেটের খাসিয়া পাহাড়ে, সেখানেও পাহাড় ও অরণ্যর ওপর আদিবাসীদের অধিকার নেই [দ্র. বৃক্ষ নিধনযজ্ঞে বিপন্ন খাসিয়া পাহাড়…।। ফটোব্লগ ।।] । সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে ত্রিপুরা জনপদে চলছে একই রকম শোষণ [দ্র. সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে এখনো শ্রমদাস!]। আবার দেশের পূর্ব-দক্ষিণাংশের কক্সবাজারের রাখাইন জনজাতি বাঙালি জনগোষ্ঠির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্রমেই দেশান্তরি হচ্ছেন [দ্র. রাখাইনরা কেন দেশ ছেড়ে যান?]। এই সব নানা মুখি আগ্রাসনের বাইরে রয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও [দ্র. আদিবাসী শিশু শিক্ষা: মাতৃভাষায় পাঠ]।
বলা ভালো, ওপরে যা বলা হলো, তা মোটেই সারাদেশের আদিবাসীদের সার্বিক চিত্র নয়, এটি একটি টুকরো চিত্র মাত্র, প্রকৃত অবস্থা আরো ভয়াবহ। বিষয়টি শুধু পঠন-পাঠনেই উপলব্ধ হবে, এমন নয়; এ জন্য দীর্ঘ সরেজমিন অনুসন্ধানও জরুরি। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
ধন্যবাদ।
আমার খুব ইচ্ছে এ-সব জায়গা একবার ঘুরে দেখার আপনার সাথে, এবং কিছু লেখার। আপনি যে জ্ঞান অর্জন করেছেন তার তুলনা আর কোথাও দেখিনি। আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো, আর সময়-সুযোগ হলে আগামী বছর কি একবার যাওয়া সম্ভব? আপনি কি বলেন?
আদনান
@আদনান,
আপনার আগ্রহকে সাধুবাদ জানাই। ভ্রাতা, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে একসঙ্গে যেতে বাধা নেই। তবে আমি কর্মব্যস্ত মানুষ; আপনাকে কতটুকু সাহায্য করতে পারবো, আদৌ পারবো কি না, এখনই তা বলতে পারছি না। তবে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক সহযোগিতা অবশ্যই থাকবে।
আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের ফেবু গ্রুপ – এ যোগ দিতে পারেন [https://www.facebook.com/groups/CHTVoice/] । আবারো অনেক ধন্যবাদ।